You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.16 | মুজিবের কিছু হলে স্বাধীনতার পরও আমাদের যুদ্ধ চলবে- মুক্ত অঞ্চলের জনসভার ঘােষণা-লড়াই (পূর্বাঞ্চলীয় যুদ্ধ বুলেটিন-১) - সংগ্রামের নোটবুক

মুজিবের কিছু হলে স্বাধীনতার পরও আমাদের যুদ্ধ চলবে- মুক্ত অঞ্চলের জনসভার ঘােষণা

সম্প্রতি আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতৃবর্গের সাথে পূর্বাঞ্চলিয় কমাণ্ডার যখন ফেনির কাছেই মুক্তাঞ্চলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পরিদর্শন করতে যান তখন শুভর বাজারে জনগণ স্বতস্ফূর্তভাবে এক মিটিংএর আয়ােজন করে। এই মিটিং জাতীয় এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধি, স্থানীয় নেতা সমেত লেঃ কর্ণেল খালেদ মােসাররফও বক্তৃতা দেন। প্রত্যেকেই মুক্তিযােদ্ধাদের অগ্রসর এবং সাফল্যের ভূয়সি প্রশংসা করে বলেন যে পৃথিবীর মুক্তি সংগ্রামে বাংলাদেশ একটা বিশেষ স্থান অধিকার করে নিয়েছে ন্যায় ও সত্যের সংগ্রাম সফল হবেই বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই এবং সেই জন্যে সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তার পথ অনুসরণ করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। পাক সরকারের প্রশাসন ব্যবস্থা ভেঙ্গে দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের শাসন প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

লেঃ কর্ণেল খালেদ মােশাররফ দৃপ্ত কণ্ঠে বলেন যে বঙ্গবন্ধুর কোন ক্ষতি হলে তার প্রতিশােধ আমরা নেই। তার নির্দেশ এবং তার ইচ্ছাতেই আজ বাংলার মানুষ স্বাধীনতার সংগ্রাম করছে। তার সংক্ষিপ্ত ভাষণে তিনি জনগণকে ধন্যবাদ জানান এ সংগ্রাম তাদের সক্রিয় অংশ গ্রহণের জন্য। তিনি বলেন যে “শুধু হাতিয়ার থাকলেই যুদ্ধ হয় না যুদ্ধে নিরস্ত্র জনগণও অংশ নিতে পারেন অনেকভাবে। সবাইকে অস্ত্র তুলে দেওয়া সম্ভব নয় প্রয়ােজনও নেই তবে মুক্তি যােদ্ধাদের সাহায্যে এগিয়ে এসে শত্রুদের যাতায়াত ব্যবস্থা ভেঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে ওদের পঙ্গু করে রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক দিক থেকে ওদের অচল করে দিয়ে প্রত্যেকেই এ যুদ্ধে যােগ দিতে পারেন। গ্রামে গ্রামে সংগঠন গড়ে তুলতে হবে আরও সুসংগঠিত হতে হবে।” পাক হানাদারদের সমাধান করে কমাণ্ডার দেশবাসীকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে বলেন যে বঙ্গবন্ধুর জন্যে প্রয়ােজন হলে স্বাধীনতার পরও পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ চলবে।

লড়াই (পূর্বাঞ্চলীয় যুদ্ধ বুলেটিন-১)

উত্তরাঞ্চলীয় মুক্তি পরিষদের সভায় বক্স কঠিন ঘােষণা অবিলম্বে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি করে বাঙলাদেশে স্বাধীনতা উৎসব পালন করা হবে- বিশেষ প্রতিনিধি।

সদ্য সমাপ্ত উত্তরাঞ্চলীয় মুক্তি পরিষদের একটি সাধারণ সভায় ভাষণ দিতে গিয়ে পরিষদের সভাপতি জনাব মতিয়ার রহমান এম, এন, এ বজ্র কঠিন কণ্ঠে ঘােষণা করেন খুব শীঘ্রই বাঙলাদেশের মাটি থেকে হানাদার পশ্চিমা দস্যু বাহিনীকে তাড়িয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়েই বাঙলাদেশের মাটিতে স্বাধীনতা উৎসব পালন করা হবে। জনাব মতিয়ার রহমান বলেন- আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নেতা বাঙালী জাতির জনক শেখ। মুজিবর রহমানের বিচার প্রহসনের মাধ্যমে বাঙালী জাতির মনােবল ভেঙে দেবার মত ক্ষমতা ইয়াহিয়া গােষ্ঠির নেই । সমস্ত বাঙালী জাতির ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম তার রক্তের বিনিময়েই বঙ্গবন্ধু আমাদের মধ্যে। ফিরে আসবেন। তিনি আরও বলেন বাংলাদেশে পুতুল সরকার দাঁড় করানাের সমস্ত দিবে।

জনাব রহমান বলেন বাংলাদেশের মানুষের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে যারা বিদেশী বেনিয়া। গােষ্ঠীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্র করবে তাদেরকে কেউই ক্ষমা করবে না এবং বিশ্বাসঘাতকদের রক্ত দিয়েই বাঙলার স্বাধীনতার ইতিহাস লেখা হবে। তিনি এ সম্পর্কে বিশ্বাসঘাতক প্রাক্তন গভর্ণর আবদুল মােনেম খানের শােচনীয় মৃত্যুর প্রতি। আলােকপাত করে বলেন— অর্থ ও পদের লােভে যে সমস্ত পদলেহী কুত্তার দল ইয়াহিয়া খানের খান সাহেবীর ভূমিকায় অভিনয় করছে মুক্তিবাহিনীর উদ্যত গােলা বারুদ তাদের সমুচিত শিক্ষা দান। করবে। উত্তরাঞ্চলীয় মুক্তি পরিষদের এই সভায় যুব সমাজের প্রতি উদ্দেশ্য করে বলা হয়বাঙলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে ত্বরান্বিত করার জন্যে মুক্তিবাহিনীতে যােগদান করে হানাদার বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে বাঙালী নিধন যজ্ঞের প্রতিশােধ গ্রহণ করার দায়িত্ব যুব সমাজের উপর ন্যাস্ত। তাই, যারা এখনও মুক্তিবাহিনীতে যােগ দান করেন নাই তাদেরকে মুক্তিবাহিনীতে যােগদানের জন্য উদাত্ত আহ্বান জানান হয়। এই সভায় পরিষদ পরিচালনা, প্রশাসনিক কাজকৰ্ম্ম সুষ্ঠভাবে পরিচালনা ও মুক্তি বাহিনীর ব্যয়ভার বহনের জন্য কয়েক লক্ষ টাকার বাজেট প্রস্তুত করা হয়েছে।

রণাঙ্গন (২) # ১৯৭১

ঢাকা আমাদের মহানগরীর সরকারী বেসরকারী ভবনে স্বাধীন বাংলার পতাকা : বঙ্গবন্ধু দীর্ঘজীবি হােন ধ্বনিতে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত

আজ (বৃহস্পতিবার) বিকেল ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। অগ্রসরমান মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় জওয়ানদের সম্মিলিত অভিযানে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা নগরী মুক্ত হয়েছে এবং সকল সরকারী বেসরকারী ভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড্ডীন হয়েছে। মুজিবনগর থেকে শীঘ্রই স্বাধীন বাংলার প্রশাসনিক সদর দপ্তর ঢাকায় স্থানান্তরিত হচ্ছে বলে জানা গেছে। তাবেদার গভর্ণর মালেকের পদত্যাগের পর খানসেনারা নিজেরাই যুদ্ধবিরতির আরজি জানায়। আজ বাংলাদেশের বীর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় জওয়ানগণ পাকিস্তানী হানাদারদের পশ্চাৎধাবন করে মহানগরী ঢাকায় প্রবেশ করলে বিরান ও ধ্বংসস্তুপ নগরী আবার সজীব হয়ে ওঠে এবং জয়বাংলা ও বঙ্গবন্ধু দীর্ঘজীবি হােন, বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী স্থায়ী হােক ধ্বনিতে ঢাকার আকাশ বাতাস। প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। খান সেনারা এবং তাদের তাবেদারেরা সদলে আত্মসমর্পণ করেছে। আত্মসমর্পণের তারা জেনারেল মানেকশ’র কাছে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব জানালে ভারতের সেনাপতি তাদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। ঢাকা শহর মুক্ত হওয়ার খবরে অশ্রুসজল কণ্ঠে আমাদের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট এক বাণীতে বলেছেন, আমাদের বিজয়লাভ সম্পূর্ণ হল। এখন আমাদের সামনে আরাে কঠিন কাজ বাকী । তা হল। ধ্বংসস্তুপের মধ্যে একটা জাতির পুনর্বাসন এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠন।  প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেছেন, স্বাধীন বাংলাদেশ বিশ্বে নিপীড়িত ও লাঞ্চিত  মানবতার একটি অকৃত্রিম বন্ধু জাতি হিসাবে গড়ে উঠবে। আমরা দেশ ও জাতিকে মুক্ত করার সংগ্রামে  জয়ী হয়েছি। কিন্তু এখন জাতির পিতাকে মুক্ত করার সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হবে।

জয়বাংলা (১) # ১: ৩৩ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১

সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৩