You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.01 | রক্ত যখন দিয়েছি আরও রক্ত দেবাে - সংগ্রামের নোটবুক

রক্ত যখন দিয়েছি আরও রক্ত দেবাে

শুধু হানাদার পাক সেনা নিধন যজ্ঞেই মুক্তি বাহিনীর বীর যােদ্ধারা রক্ত দিচ্ছে না, জীবন দিচ্ছে । আজকের শত্রু নিধন অভিযানের বহু আগে থেকেই এই রক্ত ঝরার ইতিহাসের সূচনা হয়েছে। বাংলার অধিকার বঞ্চিত মানুষ যখনই নিজেদের অধিকারের কথা বলেছে তখনই পশ্চিমা শােষকদের হিংস্র আঘাতে রক্তাক্ত হয়েছে বাংলার মাটি। বাংলার মাটিতে, আকাশে, বাতাসে আজকে যে রক্তের গন্ধ ছড়াচ্ছে সে গন্ধে মিশে আছে বরকত, মতিউর, জব্বার সালামের রক্ত। তাতে মিশে আছে শহীদ। আসাদের রক্তের গন্ধ। দিনে দিনে বাংলার বাতাসে রক্তের গন্ধের তীব্রতা বেড়েছে কৃষকের, শ্রমিকের, বুদ্ধিজীবির, ছাত্রের রক্তে। রাজপথ রঞ্জিত। সবুজ ধানের চারা রঞ্জিত। শ্যামল মাটি রঞ্জিত। বুকের উষ্ণ তাজা রক্তে রঞ্জিত হয়েছে সব। শ্যামনগরে শ্রমিকের রক্ত খালের পানির ঘােলাটে রং বদলিয়ে গিয়েছে। টঙ্গীর শ্রমিকের রক্তে রক্তাক্ত হয়েছে শিল্প উপনগরী টঙ্গীর রাজপথ।

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বেইমানের অত্যাচার আর বিশ্বাসহন্তাদের বিশ্বাসঘাতকতা বাংলার মাটিকে যেন বিকৃতির ক্লেদ দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলাে। তাই রক্ত দিয়ে ধুতে হচ্ছে অতীতের সেই ক্লেদাক্ত ইতিহাস। মাটির বুকে অনেক দিনের জমে থাকা হাহাকার রক্তের তুষায় যেন দিশেহারা। মাটি মায়ের সেই রক্ত তৃষা মেটাতে গিয়ে বুকের তাজা রক্ত দিয়েছে ছাত্র-শিক্ষক, কৃষক-শ্রমিক, বুদ্ধিজীবি তথা জনতা। ‘বুও রক্তের তৃষা মেটেনি মাটির। পচা অতীতের গ্লানি ধুয়ে মুছে পবিত্রতর হয়নি মাটি। আরও রক্ত চাই। যে রক্ত চেয়ে নেতাজী বলেছিলেন “তােমরা আমায় রক্ত দাও, আমি তােমাদের স্বাধীনতা দেব”, সেই আহ্বান যেন ইতিহাসের পথ ধরে এসে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে উত্তর পেয়েছে। রক্ত যখন দিয়েছি আরও রক্ত দেবাে।” সে রক্ত দেয়ার শেষ নেই। রক্তের রক্তিম আলিঙ্গন মেখেই বাংলার স্বাধীনতা সূর্য উঠেছে। রক্ত দিয়ে গড়ে তোলা স্বাধীনতার ইতিহাসকে রক্ষা করতে আরও রক্ত দিয়ে যেতে হচ্ছে—রক্তের শােধ নিতে হচ্ছে বিদেশী শােষকের লেলিয়ে দেয়া হিংস্র পশুগুলােকে হত্যা করে।

শহীদের রক্তের ডাক, বঙ্গবন্ধুর ডাক, নেতাজীর ডাক, বাংলার বঞ্চিত মানুষের ডাক, বাংলা মায়ের ডাক আরও রক্ত চাই। শহীদ তীতুমীর, সূর্য সেন, ক্ষুদিরামের রক্তের প্রতিশােধ। রক্ত দিয়ে নিতে হবে রক্ত। চিরকালের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস আমাদের বলেছে, বঙ্গবন্ধু আমাদের বলেছে রক্তে দাও, আরও রক্ত। এই রক্ত দেওয়ার সােনালী ইতিহাস হবে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস। তাকে শুধু রক্তাক্ত ইতিহাস বলবাে না, তাকে অনাগত ভবিষ্যত বংশধবদের স্বাধীনতা রক্ষার প্রেরণাও বলবাে।রক্ত ঝরার কাহিনী গান হয়ে, কবিতা হয়ে, ইতিহাস হয়ে বলে দেবে রক্তদানকারী শহীদদের কাহিনী। রক্তপাত দিয়ে যে ইতিহাসের সূচনা ঘটেছে, বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে তাই রূপ লাভ করেছে আরও রক্ত দেবার শপথে। তিনি বলেছিলেন “অনেক রক্ত দিয়েছেন আপনারা, এবার আমি রক্ত দেবাে।” আবার বলেছেন, “রক্ত যখন আমরা দিতে শিখেছি, তখন ইনশাল্লাহ স্বাধীনতা আমাদের কেউ ঠেকাতে পারবে। ” রক্ত শপথে উজ্জীবিত মুক্তি সৈনিকের কানে বাংলার আকাশে বাতাসে তাই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে রক্ত শপথ। রক্ত দিয়েই পাক-হানাদার সৈন্য নিশ্চিহ্ন করবাে আমরা।

বাংলার মুখ ॥ ১ : ৭-৮

১ অক্টোবর ১৯৭১

সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৩