বঙ্গবন্ধুর বিচারের বিরুদ্ধে বিশ্বগীর্জা পরিষদ
জেনেভা থেকে প্রাপ্ত সংবাদে জানা গেছে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গােপন বিচারের বিরুদ্ধে জেনেভায় অবস্থিত বিশ্বগীর্জা পরিষদ সম্প্রতি ইসলামাবাদ সরকারের নিকট প্রতিবাদ জানিয়েছেন। পাক প্রেসিডেন্ট এহিয়া খানের নিকট প্রেরিত এক তারবার্তায় বিশ্ব গীর্জা পরিষদের সেক্রেটারী প্যাক্টর ইউজিন ব্লেক বিশ্বের প্রােটেস্ট্যান্ট গীর্জাসমূহের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুরের বিচার ব্যবস্থায় গভীর ধিক্কার জানিয়েছেন। তিনি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে অন্তরালে এই বিচার-ব্যবস্থা শত্রুতা, সন্দেহ এবং মানবীয় দুর্গতিকেই শুধু বাড়াবে এবং তার ফলে সংঘর্ষ ও বিরােধের এলাকা সম্প্রসারিত হবে।’
জন্মভূমি । ১; ৭ ! ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
মুজিবের বিচারের অধিকার নেই—গলব্রেথ (ভারতীয় প্রতিনিধি প্রেরিত)
পাকিস্থানের একজন সমর্থক, ভারতে প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত, অধ্যাপক জন কেনেথ গলব্রেথ কোলকাতার দৈনিক বসুমতীর প্রতিনিধির সঙ্গে এক সাক্ষাঙ্কারে বলেছেন, শেখ মুজিবরের মৃত্যুদণ্ড দূরে থাক, তার বিচার করারও অধিকার কারাে নেই। কারণ, নির্বাচনে বেশী ভােট পাওয়া অপরাধ হতে পারে না। মিঃ গলব্রেথ বাংলাদেশ পরিস্থিতি এবং শরণার্থীদের দেখার জন্য এখানে এসেছেন।
বিপ্লবী বাংলাদেশ | ১৪ ৫ ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
এই যৌবন জল তরঙ্গ রােধিবি কি দিয়া বালির বাঁধ? বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের অপ্রতিহত অগ্রযাত্রা
(রাজনৈতিক ভাষ্যকার)।
স্বাধীন বাংলার জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ডাক দিয়াছেন— তাই, এক দিনে এক দুর্জয়। সামরিক শক্তির দুর্লভ গৌরবে মাথা উঁচু করিয়া দাঁড়াইয়াছে দুর্ধর্ষ বাঙ্গালী জাতি। শঙ্খলিতা দেশমাতৃকার বুক হইতে হানাদার দুশমনকে সমূলে উৎখাত করার জীবনপণ প্রতিজ্ঞায় মুক্তি পাগল। বাংলার মানুষ প্রলয়রাত্রির বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের হিংস্র ছােবলের মত, দয়াহীন নির্মম নিয়তির মত প্রচণ্ডতম শক্তিতে একের পর এক আঘাত হানিয়া চলিয়াছে শক্রর শিবিরে। অপ্রতিহতগতিতে বাংলার দুঃসাহসী মুক্তিযােদ্ধাদের বিজয় অভিযানের রথচক্রতলে নিষ্পিষ্ট হইয়া ভাঙ্গিয়া-চুরিয়া ধুলিস্মাৎ হইয়া যাইতেছে পাঞ্জাবী উপনিবেশবাদের ভিত্তিমূল। বাংলার দশ দিগন্তে মুজিব বাহিনীর জয় জয়াকারের তৃর্যনাদ— থর থর করিয়া কাপিয়া জল্লাদের বুক টলটলায়মান জঙ্গী মসনদ। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বীর প্রসবিনী বাংলার অপরাজেয় গণশক্তি জননী জন্মভূমিকে শত্রুমুক্ত করার জন্য অমিত বিক্রমে লড়িয়া চলিয়াছে। ইয়াহিয়ার ভাড়াটিয়া বাহিনীর বিরুদ্ধে। মুক্তিযােদ্ধাদের দুঃসাহসিক পাল্টা আক্রমণে প্রতিদিন নাজেহাল নাস্তানাবুদ হইতেছে হানাদার বাহিনী। মুক্ত হইতেছে নয়া নয়া এলাকা। শেখ মুজিবের বাংলাদেশ আজ এক বিদ্রোহের জলন্ত অগ্নিকুণ্ড, মুক্তির দীপ্ত তারুণ্যে উন্মিমুখর এক প্রমত্ত মানব ইতিহাসের ভয়াবহতম জল্লাদী বর্বরতার মুখেও অপ্রতিহত সাফল্যের জয়টিকা শােভিত বাংলাদেশ আজ পৃথিবীর বিস্ময় উপনিবেশবাদী শৃঙ্খল জঙ্গী শাসনের সামনে এক উদ্ধত প্রশ্নের জ্বলন্ত সূর্যপিণ্ড মুক্তিকামী বাংগালী জাতির “এই যৌবন জল তরঙ্গ রােধিব কি দিয়া বালিরাধ’?”
এখানে উল্লেখ করা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নিয়মতান্ত্রিক পথেই বাঙ্গালীর আন্দোলনকে পর্যায়ে পর্যায়ে সামনে আগাইয়া আনিয়াছেন। উহারই পাশাপাশি চলিয়াছে বিপ্লবের প্রস্তুতি। শেখ সাহেব নিজেই বলিয়াছেন “বিপ্লবের যখন প্রয়ােজন হইবে, সে ডাক আমিই দিব।” বস্তুতঃ এই ইঙ্গিতটুকু এবং ৭ই মার্চ রেসকোর্সের ভাষণে তার আহ্বান ‘যদি হুকুম দিতে না পারি হাতের কাছে যা পাও তাই নিয়ে শত্রুর মােকাবেলা করাে।” ছিল আসলে বিপ্লবের সার্বিক প্রস্তুতিরই এক অবিচ্ছেদ অঙ্গ। মার্চ মাসের ২৪ তারিখ পর্যন্তও আন্দোলন চলিয়াছে শান্তিপূর্ণভাবে অহিংস অসহযােগ আন্দোলন। আজ যখন সময় আসিয়াছে, বিপ্লবের প্রয়ােজন হইয়াছে ২৫শে মার্চ রাতে গ্রেফতার হইবার আগেই তিনি দিয়াছেন সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক, জাতির প্রতি নির্দেশ দিয়াছেন বঙ্গবন্ধু “বাংলাদেশ আজ হইতে স্বাধীন, সার্বভৌম। শত্রু আমাদের আক্রমণ করিয়াছে। সজোরে পাল্টা আঘাত হানাে। বঙ্গবন্ধুর এই নির্দেশের শেষ শব্দটির রেশ বাতাসে মিলাইয়া যাইবার আগেই বাঙ্গালী হাতে হাতিয়ার তুলিয়া নিয়াছে। ঝাপাইয়া পড়িয়াছে দুশমনের উপর। মাত্র একদিনে শেখ মুজিব। এ শুধু শেখ মুজিবের পক্ষেই সম্ভব, এ শুধু বাংলাদেশেই সম্ভব। পৃথিবীতে এখন ঘটনার দ্বিতীয় নজির আর নাই। আর নাই বলিয়াই সমগ্র পৃথিবী অবাক বিস্ময়ে চাহিয়া দেখিতেছে বাংলাদেশের মানুষ তার নেতা বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য, মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য অমিত বিক্রমে লড়িতে লড়িতে আজ এক দুর্ধর্ষ সামরিক শক্তিতে পরিণত হইয়াছে। বাঙ্গালী জাতির নবজন্ম হইয়াছে। আর এই নতুন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথই বাংলার সার্বিক মুক্তির পথ । শেখ মুজিবের মন্ত্রে দীক্ষিত জাতীয়তাবাদী বাঙ্গালী জাতির চোখে মুখে স্বাধীনতার আলােক রশ্মি ।
বুকে বুকে ঢেউ খেলিতেছে খুশির দূরন্ত সরবাের। আর মুক্তি মন্ত্রে উজ্জীবিত এই হাত প্রসারিত করিয়া দুরাশার বালুচরে আত্মবষার পথ খুজিয়া বেড়াইতেছে ইয়াহিয়া খান। ঢাকার একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক খবর দিয়াছে, একটি আপােষ মীমাংসায় পৌছাইবার উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে পারে। বিবিসির খবরে বলা হইয়াছে, বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার লাট বাহাদুর গাদ্দার মালিক বলিয়াছে একটি আপােষ রক্ষার জন্য আমি আওয়ামী লীগ। নেতাদের সাথে দেখা করতে চাই’। সুতরাং বুঝতে কষ্ট হইবার কথা নয়, নাভিশ্বাস উঠিয়াছে জঙ্গীশাহীর। ইয়াহিয়ার এখন মরণদশা। সবেতাে শুরু। বীর বাঙ্গালী জাতির মুক্তিযুদ্ধের অপ্রতিহত সাফল্যের প্রচণ্ড তরঙ্গখাতে ক্ষত বিক্ষত হইয়া জল্লাদ ইয়াহিয়া একদিন এই আপােষ প্রস্তাবের পথ ধরিয়াই আগাইতে আগাইতে গিয়া পৌছবে পরাজয়ের অতল গহ্বরে। নতি স্বীকার তাকে করিতেই হইবে বাঙ্গালী জাতির জয় হইবেই। বঙ্গবন্ধুই বলিয়াছেন ‘বাঙ্গালী যখন রক্ত দিতে শিখিয়াছে তখন কেহই আর তাদের দাবাইয়া রাখিতে পারিবে না।’ নেতার এই প্রত্যয়দৃপ্ত ঘােষণা মিথ্যা প্রতিপন্ন হইবে না হইতে পারে না।
বাংলার বাণী ! ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৩