ইয়াহিয়ার নতি? আমার মাথা নত করে দাও হে
লণ্ডন, ২১শে আগষ্ট–পাকিস্তানের সঙ্গে যে সব দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক আছে, তাদের প্রায় প্রত্যেকের প্রচও কূটনৈতিক চাপে ইয়াহিয়া খান শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করেছেন। সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বিচারে এ, কে, ব্রোহী তার পক্ষ সমর্থন করবেন বলে যে ঘােষণা করা হয়েছে তার এই অর্থ করা হচ্ছে। এমন কথাও বলা হচ্ছে যে, ইয়াহিয়া খান বুঝতে পারছেন, বর্তমান সঙ্কট থেকে উদ্ধার পাবার একটা পথ তাকে বার করতেই হবে এবং তিনি তার প্রাসাদশীর্ষ থেকে নেমে আসতেও চাইতে পারেন। জনাব ব্রোহী সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধুর গােপন বিচারে তার পক্ষ সমর্থন করলে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করার অভিযােগ থেকে অব্যাহতি পেতে পারেন। কারণ, জনাব ব্রোহী। একজন প্রথম শ্রেণীর আইনজ্ঞ হিসাবেই বিখ্যাত নন, একজন উদার মনের মানুষ হিসাবেও তাঁর নাম আছে এবং তিনি মানুষের মর্যাদা দেন। জুলফিকর আলি ভুট্টো কখনও জনাব ব্রোহীকে সহ্য করতে পারেন নি। বরাবরই তিনি তাকে অপছন্দ করেছেন। তিনিই তাকে পাকিস্তানের কূটনৈতিক কর্ম থেকে সরিয়ে দিয়েছেন।
বাংলাদেশ (1) l ১: ১২ ৪ ২৩ আগস্ট ১৯৭১
শেখ মুজিবের বিচার প্রহসন
জঙ্গী শাসন ও পশ্চিমা শােষণে জর্জরিত বাংলাদেশ আজ মুক্তির সংগ্রামে লিপ্ত, বর্বর পশ্চিম পাকিস্তানী জঙ্গীশাহী বিশ্বের ইতিহাসের সমস্ত অত্যাচারকে স্নান করিয়া দিয়া বাংলাদেশের উপর তুলনা হীন ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করিয়াছে। যাহার ফলে প্রায় আশি লক্ষ লােক শরণার্থী হিসাবে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হইয়াছে এবং অগণিত লােক এখনও ভারতে যাইতেছে। পৃথিবীর দুইটি বৃহৎ রাষ্ট্র পাকিস্তানকে অস্ত্র ও অন্যান্য সাহায্য দেওয়ায় পশ্চিম পাকিস্তানে যুদ্ধবাজদের অত্যাচার বাড়িয়াই চলিয়াছে। এমন কি সে ভারতকে আক্রমণ করার হুমকি দিতেছে। ভারতের অপরাধ সে শরণার্থীদের। আশ্রয় দিয়াছে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতি জানাইয়াছে। অন্যদিকে বর্বর। জঙ্গীশাহী মীমাংসা চরিতার্থ করার জন্য সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিচার শুরু করিয়াছে। বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রই ইহাতে উদ্বেগ প্রকাশ করিয়াছে। তবুও যুদ্ধবাজদের চৈতন্য হয় নাই । ভারত ও সােভিয়েট ইউনিয়ন এই দুই দেশের মধ্যে সম্প্রতি যে শান্তি ও মৈত্রীর চুক্তি সম্পাদিত। হইয়াছে; তাহাতে হয়ত বা পশ্চিম পাকিস্তানী যুদ্ধবাজদের ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকি স্তিমিত হইতে পারে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে দমন করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধ-বাজরা।
যতই অত্যাচার ও গণহত্যা করুক না কেন, উহাকে কোন প্রকারে স্তব্ধ করিতে পারিবে না। সংগ্রাম জয় যুক্ত হইবেই। দুনিয়ার কোন জাতির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সংগ্রাম নিস্ফল হয় নাই। ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী বিরাট শরণার্থী সমস্যার সমাধান করিতে হইলে বর্তমানে বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করিলে স্বাধীন বাংলা’ দেশই ইহার চূড়ান্ত সমাধান। দুনিয়ার সমস্ত গণতান্ত্রিক দেশ ও সকল গণতন্ত্রকামী সংস্থার নিকট আমাদের আবেদন : বাংলাদেশের এই স্বাধীনতা সংগ্রামকে সৰ্ব্ব রকমে সাহায্য করিয়া জয় যুক্ত করুন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবরের বিচার প্রহসন বন্ধ করার জন্য বিশ্বের সমস্ত দেশ গুলির সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করা উচিত। যদি তাহারা কোন বাস্তব পন্থা না নিতে পারেন তবে যে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হইবে, তাহাতে আর কোন মীমাংসার পথ উন্মুক্ত থাকিবে না। শ্রী দেবেন্দ্র নাথ ঘােষ (বরিশাল), বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল
জয়বাংলা (১) x ১:১৬ ॥ ২৭ আগস্ট ১৯৭১
জল্লাদ ইয়াহিয়াকে ঠেকাও
বাংলাদেশ মুক্তি বাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্ণেল এম, এ, জি, ওসমানি বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মুক্তি পিয়াসী জনগণের আশা আকাঙ্খার প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বিচারের নামে যে প্রহসন চালানাে হচ্ছে তা বন্ধ করার ব্যাপারে জল্লাদ ইয়াহিয়া সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য বিশ্ব বিবেকের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। মুক্তি বাহিনীর জনসংযােগ শাখা মুজিবনগর থেকে প্রচারিত এই আবেদনে সর্বাধিনায়ক ওসমানি বলেছেনঃ আমাদের জাতীয় নেতাকে হত্যা করা বন্ধ করুন। মানবীয় মূল্যবােধের অবলুপ্তি হইতে । দেবেন না।
জয়বাংলা (১) # ১: ১৫ ২০ আগস্ট ১৯৭১
বৃহৎ শক্তিবর্গের কাছে প্রধান মন্ত্রীর আবেদন
মুজিবের প্রাণ রক্ষা করুন। শেখ মুজিবের প্রাণরক্ষা করার জন্য বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বিশ্বের বৃহৎ শক্তিবর্গের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেন যে, শেখ মুজিবের বিচার করার মত আইনগত, সংবিধানগত অথবা অন্য কোন অধিকার পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নেই । ক্ষমতামত্ত পাঞ্জাবী পুঁজিপতি ও সামরিক চক্রের এটা একটা গণহত্যারূপী চক্রান্ত। জনাব আহমদ বলেন যে, বাংলাদেশের কল্যাণের স্বার্থে নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শান্তির জন্য শেখ মুজিবের উপস্থিতি প্রয়ােজন। শেখ মুজিবের জীবন নিয়ে কিছু করা হলে সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দারুণ সংকট দেখা দেবে। বলে প্রধানমন্ত্রী সকলকে সতর্ক করে দিয়েছেন। পাকিস্তানকে মার্কিন সাহায্য দান সম্পর্কে এক প্রশ্নোত্তরে জনাব আহমদ বলেন যে, ‘বিশ্বের কোন বিচার-বুদ্ধি সম্পন্ন গণতান্ত্রিক দেশ ইয়াহিয়ার গণহত্যার যুদ্ধকে সাহায্য করতে পারে না। তিনি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা বড় অংশ ও বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের দাবীকে সমর্থন করেছেন এবং ইয়াহিয়ার নিন্দা করেছেন। তিনি আশা করেন, মার্কিন সরকার শীঘ্রই তাদের ভুল বুঝতে পারবেন এবং বাংলাদেশের সংগ্রামকে সমর্থন জানাবেন।
জয়বাংলা (১) [১: ১৫ ॥ ২০ আগস্ট ১৯৭১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৩