You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.08.20 | বঙ্গবন্ধু আত্মপক্ষ সমর্থনে রাজী নন | জয় বাংলা পত্রিকা | ২০ আগস্ট ১৯৭১ - সংগ্রামের নোটবুক
বঙ্গবন্ধু আত্মপক্ষ সমর্থনে রাজী নন
করাচী, ১৬ই আগষ্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান আত্মপক্ষ সমর্থনে অসম্মতি জ্ঞাপন করায় গােপন সামরিক বিচার মুলতুবী হতে পারে। গােপন সূত্রের বরাত দিয়ে এ, এফ, পি উপরােক্ত সংবাদ পরিবেশন করে। বঙ্গবন্ধু পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তাকে জানিয়ে দিয়েছেন যে তিনি কোন অপরাধই করেননি। জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে নেবার জন্য এবং শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য তিনি এবং তার দল আইনসম্মতভাবে রাজনৈতিক আন্দোলন করেছিলেন।
জয়বাংলা (১) ॥ ১ : ১৫ ॥ ২০ আগস্ট ১৯৭১
বিস্তারিত –
হাশমী হুঙ্কার ছাড়লাে, “এই বিবৃতিতে সই করবে কি না?” কক্ষের চারদিকে উদ্যত সঙ্গিন বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে মামলা সাজানাে হচ্ছে।
জয়বাংলা প্রতিনিধি।
“আমার টেবিলের সামনে ইংরেজিতে টাইপ করা কয়েক পৃষ্ঠা কাগজ রাখলাে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সদ্য আমদানী করা প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিষ্ট্রেট ই, এ, হাশমী। বললােঃ পড়ে দেখাে । এটাই হবে তােমার স্বজ্ঞানে স্বেচ্ছায় এবং নির্ভয়ে প্রদত্ত বিবৃতি  “পড়লাম। নিয়ম রক্ষার জন্যে হাশমী জিজ্ঞেস করলােঃ কোন বক্তব্য আছে? বললাম এখানে যা লেখা রয়েছে, তার কিছুই তাে আমি জানি না। কঠিন হয়ে উঠলাে হাশমীর এতক্ষণের বিনয়ের মুখােস পরা হাসি হাসি মুখ। আমার সামনের চেয়ারের ওপরে একটা পা তুলে দিয়ে হিংস্র হায়েনার বিষাক্ত হাসির তীর ছুঁড়ে গর্জন করে উঠলাে ! এ বিবৃতি স্বাক্ষর করবে কি না বল? এক্ষুনি জবাব চাই। “আমার চার দিক যেন হঠাৎ অন্ধকার হয়ে এলাে।” মুক্ত বাতাসের জন্যে প্রাণ আঁকুপাঁকু করে উঠলাে। ঢাকার এগারাে নম্বর বেইলী রােডের এই গােপন কক্ষটির নৈশব্দ ক্রুরতায় ভয়ংকর। মুহূর্তে  সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই নিস্তব্ধ কক্ষের ওপারেই ঘাতকবাহিনী সঙ্গীন উচিয়ে অপেক্ষা করছে। আমার সমস্ত অণুপরমাণু চিল্কার করে উঠলােঃ না, না। কিন্তু মুখ দিয়ে সেই ‘না’ উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে এই আমি একটি নিষ্প্রাণ শব দেহে পরিণত হব। তারপর তারা ঝাপিয়ে পড়বে আমার পরিবারবর্গের ওপরে । না বলার বেয়াদবী তারা যে সহ্য করবে না অন্যান্য সাক্ষীদের উপলব্ধির জন্যে তা তারা দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরবে।
ঘাতকের কারাগার “সিদ্ধান্ত নিলাম পালাবাে এই অবরুদ্ধ এলাকার এই নৃশংস কারাগার ও বধ্যভূমি থেকে  সিদ্ধান্ত নিলাম অভিনয়ের আশ্রয় নিতে হবে। মুখের রেখার এতটুকু পরিবর্তন আর কুঞ্চন দেখা দিলে চলবে “বললাম : নিশ্চয়ই সই করবাে জানা ঘটনা তাে নয়, জেরার সময় যদি গুলিয়ে ফেলি। সেই জন্যেই কথাটা বলেছি। জেরা ! হুঃ ! “হাশমী আবার পা নামিয়ে বসলাে। চেহারায় আবার আঁটলাে সেই বিনয়ের দ্রতার মুখােস। একটা ক্রুর তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললােঃ জেরা! হুঃ! “কিছুই আর অস্পষ্ট রইলাে না। অস্পষ্ট রইলাে না— গােপনে সবার চোখের অন্তরালে বিদেশী কৌসুলীর সহায়তার অধিকার হরণের অর্থ।” সম্প্রতি ঢাকা থেকে মুক্ত এলাকায় আগত বাংলাদেশের জনৈক বিশিষ্ট সাংবাদিক জয়বাংলার নিজস্ব প্রতিনিধির কাছে উপরােক্ত তথ্য প্রকাশ করেন। আত্মীয় স্বজনের নিরাপত্তার জন্যে তিনি নিজের নাম প্রকাশ করতে সমর্থ হন নি। তখন তাঁর চোখেমুখে অবরুদ্ধ এলাকার বিভীষিকা আর পশ্চিম পাকিস্তানী পাঞ্জাবী সামরিক চক্রের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা আর ক্রোধের ছাপ পরিস্ফুট। ১১নং বেইলী রােড : সাক্ষ্য প্রমাণ তৈরীর কারখানা তিনি আমাদের নিজস্ব প্রতিনিধিকে জানান যে, একটা বে-আইনী ও সাজানাে বিচার প্রহসন করে। পশ্চিম পাকিস্তানের বর্বর জঙ্গী সরকার সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর মুক্তিমন্ত্রের উদাতা’, জাতীয় চেতনার দীক্ষা গুরু ও মুক্তি সংগ্রামের অগ্রনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও তাঁর সংগ্রামী জাতীয় সংগঠন আওয়ামী লীগের ওপরে বাঙলাদেশের নারকীয় গণহত্যা ও নৃশংস অত্যাচারের দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়ার এবং বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে জাল নথীপত্র, সাক্ষ্য প্রমাণ, সাজানাে ছবি তৈরী করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর ব্যাজ ও টুপির অনুকরণে ব্যাজ ও টুপি তৈরী করে।
রাজাকার ও দালালদের সেই ব্যাজ ও টুপি পরিয়ে তাদের দিয়ে হত্যা ও লুঠতরাজ ও অগ্নি সংযােগ করিয়ে ছবি তুলে নেয়া হচ্ছে। ঢাকার এগারাে নম্বর বেইলী রােডে জাল নথীপত্র সাক্ষ্যপ্রমাণ ও ফটোগ্রাফ তৈরীর কারখানা স্থাপিত হয়েছে। কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক ও সিভিলিয়ান অফিসারের ওপর এই কারখানার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মত এই মামলাও যাতে ফেসে না যায় আর তার চেয়েও যাতে অনেক বেশী চাঞ্চল্য ও চমক সৃষ্টি করতে পারে সে জন্যে জল্লাদবাহিনীর পশুশক্তির সাহায্যে সব রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। সাক্ষ্য প্রমাণের ক্ষেত্রে একটা রেসপেকটিবিলিটি আনার জন্যে শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, অধ্যাপক, শিক্ষক, ব্যবহারজীবী, সরকারী অফিসার প্রভৃতিকে সাক্ষী হতে বাধ্য করা হচ্ছে। তাদের সম্মুখে একটা টাইপ করা বিবৃতি ফেলে দিয়ে সই করিয়ে নেয়া হচ্ছে। সই করতে অস্বীকৃতি জানাবার পরিণতি একটাই— অবধারিত মৃত্যু সপরিবারে নিধন । আইনের পরিহাস।  বিবৃতির ওপরে লেখা থাকে তথাকথিত বিবৃতিদানকারীর নাম এবং তাতে লেখা হয় যে প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিষ্ট্রেট মিঃ ই, এ, হাশমী নিজে পাকিস্তান ফৌজদারী দণ্ডবিধির ১৬৪ ধারা মতে বিবৃতিদানকারীর নিজের ভাষায় লিপিবদ্ধ করেছেন। এই ভাবেই তৈরী হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বিরুদ্ধে বিচার প্রহসনের উপকরণ।
জয়বাংলা (১) (১: ১৫ ৪)
২০ আগস্ট ১৯৭১।

সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৩