বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করুন কে, জি, মুস্তাফা প্রদত্ত
অবশেষে স্বাধীন গণ প্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম অনেক জল্পনা কল্পনার অবসান করে তার ঐতিহাসিক বেতার ভাষণে বাঙালী মুক্তি আন্দোলনের অগ্রদূত বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবর রহমান সাহেবের গ্রেপ্তারের সত্যতা স্বীকার করেছেন। তাই তাঁর এই গ্রেপ্তারের কথা স্মরণ করলেই প্রতিটি বাঙালী মাত্রই আতঙ্কে শিউরে উঠেন। আমরাও আজ সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আওয়াজ তুলতে চাই— এশিয়া মহাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক নেতা, গণতন্ত্রের ইতিহাসের প্রথম রেকর্ড স্থাপনকারী একমাত্র নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এখন নীরবে কারাগারের অন্তরালে বসে ভাগ্যাহত বাঙালী জাতির দুর্দশার কথা স্মরণ করে অস্থিরভাবে। সময় যাপন করছেন। বঙ্গবন্ধুর গ্রেপ্তারের তিন মাস অতীত হয়ে গেল——পাকিস্তান সামরিক চক্র ফলাও করে শুধুমাত্র তার গ্রেপ্তারের কথাই প্রচার করেছেন অথচ তার মত একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন রাজনৈতিক নেতার পরবর্তী অবস্থান সম্পর্কে কোন প্রকার বিবৃতি অদ্যাবধিও প্রদান করেন নাই। ফলে, স্বভাবতঃই প্রতিটি বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তিই বঙ্গবন্ধুর এই পরিস্থিতির জন্য অস্থিরতা প্রকাশ করছেন। গ্রেপ্তারের দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়া স্বত্ত্বেও পাকিস্তানের সামরিক চক্র নরপিশাচ ইয়াহিয়া খাঁর সেনাবাহিনী সরকার কোন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক অথবা, বুদ্ধিজীবির সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কোন প্রকার সাক্ষাতের সুযােগ দেন নাই। তাই, বিশ্বের দরবারে বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার ব্যাপারে একটি চাপা। ক্ষোভ ধুমায়িত হয়ে উঠেছে সত্য, কিন্তু মুখ খুলে কেউ তার নিরাপত্তার কথা বলছেন না দেখে আমরা বেদনাহত। বাংলাদেশের মুক্তি আনদোলন এখন এক চূড়ান্ত পর্যায়ে সমুপস্থিত। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই হয়তাে মুক্তিফৌজ জয়ের মালা পড়ে বাংলাদেশকে পশ্চিমা বেনিয়া গােষ্ঠীর নাগপাশ থেকে মুক্ত করে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাজ্যের সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে। কিন্তু আমাদের শঙ্কা হয় যিনি নানা ত্যাগ, তিতিক্ষা সহ্য করে পৃথিবীর ইতিহাসের পাতায় একটি নতুন রাজ্যের সংযােজন করার স্বপ্ন দেখেছিলেন— তাকে দেশ স্বাধীন হবার পর আমাদের পাশে বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত বেশ নিয়ে পাব কি-না?
পশ্চিমা বেনিয়া গােষ্ঠির ধারক বাহক ইয়াহিয়া খাঁ তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য | বিদেশী আক্রমণ প্রতিহত করার অজুহাত দেখিয়ে যে সমস্ত বিদেশী অস্ত্র শস্ত্র বাংলা দেশের অর্থে ক্রয় করেছিলেন সেই সমস্ত আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র যখন নিৰ্ব্ববািদে বাংলার নিরীহ নিরস্ত্র জনসাধারণের উপর । ব্যবহার করে কয়েক লক্ষ অজ্ঞ কৃষক শ্রমিককে হত্যা করেছে তখন বঙ্গবন্ধুর প্রতি নাখােশ হয়ে হয়তাে শেষ মুহূর্তে বাংলাদেশ ত্যাগ করার পূৰ্ব্বে তাদের শেষ উদ্দেশ্য হাসিল করে বঙ্গবন্ধুর উপর একটি চরম ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে পারে। তাই সময় থাকতেই এ ব্যাপারে প্রকৃত পদক্ষেপ গ্রহণ করা | প্রতিটি বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তির একান্ত প্রয়ােজন বলে আমরা মনে করি। বাংলা দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সংগে সংগে বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা ও তাকে মুক্ত করার জন্য। জনমত গঠন এখন একান্ত প্রয়ােজন। তাই বিশ্বের প্রতিটি রাজ্য ও বাংলাদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দকে ঐক্যবদ্ধভাবে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করার জন্য আন্দোলন গড়ে | তােলার আহ্বান জানাই।
সােনার বাংলা (১) ১ : ৩ ৪ ২ জুলাই ১৯৭১
ঘরে ঘরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান।
ইয়াখা তুমি সাবধান, বাঙ্গালীর ঘরে বাংলাদেশের ক্ষেতখামার আর অরণ্য প্রান্তরে, কোটী কোটা মুজিবের জন্ম হয়েছে। তারা অমর, তারা অক্ষয়, তারা সব ঈশ্বরের জ্যোতির্ময় আলােক শিশু, পাকিস্তানের আজরাইল ইয়াখার টুটি টিপে ছিড়ে ফেলবার জন্যে তারা প্রস্তুত। ওরে তােরা সব জয়ধ্বনি কর আজ নূতনের কেতন ওড়ে
কালবােশেখির ঝড়। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে কোটী কোটী মুজিবের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে জয়ধ্বনি উঠেছে–
জয় বাংলার জয়
জয় মুজিবের জয় ॥
জল্লাদ ইয়াখা, তুমি ভেবেছ বাংলাদেশের জননায়ককে তুমি কারাগারে-অনাহারে-অদ্রিায়-শত। নির্যাতনের মধ্যে রেখে তিলে তিলে অত্যাচারের কাটা ফুটিয়ে বাংলাদেশের কলােনী থেকে কোটী কোটী টাকা মুনাফা লুটে তােমার বিবিদের নিয়ে আনন্দের ফোয়ারা ছুটাবে, খুশী করবে তােমার এক চোখ কানা প্রভুদের । কিন্তু সাবধান ইয়াখা, স্তব্ধ কর তােমার শয়তানের চাল, নতুবা তােমার মত আল্লাহদ্রোহী কাফেরকে কখনাে বাঙ্গালী ক্ষমা করবে না।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের গদীতে বসে সুরা আর নারীতে মত্ত হয়ে সাড়ে সাত কোটী বাঙ্গালীর অবিসম্বাদী নেতা মুজিবর রহমানকে কারাগারে রেখে তাকে হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে ইয়াহিয়া যে পাপ ও অন্যায়ের স্রোতে ছুটে চলেছ তার থেকে তােমার পরিত্রাণ নেই। বাংলার শান্ত সমাহিত শ্যামল প্রান্তরে তুমি রক্তের স্রোত বইয়ে দিয়েছ, বারাে লক্ষের উপর ভাইবােনদের তুমি হত্যা করেছ। মায়ের সতীত্ব কেড়েছ, স্ত্রী-ভগ্নি আর হাজার হাজার যুবতীদের উপর। তােমার লেলিয়ে দেওয়া পশুর দল বলাকার করেছে স্ত্রীর সামনে স্বামীকে হত্যা করেছ, পিতার সামনে পুত্রকে, ভাইয়ের সামনে ভগ্নিকে— ক্ষমা নেই, ক্ষমা নেই ইয়াখা, অন্যে তােমাকে ক্ষমা করলে বাঙ্গালী তােমাকে ক্ষমা করবেনা, ইতিহাস তােমাকে ক্ষমা করবেনা রক্তের বদলা তােমাকে দিতেই হবে। প্রাণের বদলে প্রাণ তােমাকে। দিতেই হবে।
তােমার ওই কারাগারের দোর খুলে মুজিবের মুক্তি দিতেই হবে—সাড়ে সাত কোটী বাঙ্গালীর স্বাধীনতা স্বীকার করতেই হবে—স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রামী বীরদের মুক্তি দিতেই হবে—তােমার ওই কারাগারের লৌহশৃঙ্খল থেকে
কারার ওই লৌহ কপাট ভেঙ্গে ফেল কররে লােপাট যতসব বন্দীশালায় আগুন জ্বালা আগুন জ্বালা আগুন জ্বালা।
বিপ্লবী বাংলাদেশ ১:১
৪ আগস্ট ১৯৭১
শেখ মুজিবের বিচার করার অধিকার ইয়াহিয়া সরকারের নেই
প্রখ্যাত আন্তর্জাতিক আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ মিঃ সুব্রত রায় চৌধুরী ইয়াহিয়া খান কর্তৃক স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে গােপনে সামরিক আদালতে বিচারের ধৃষ্ঠতাকে অবৈধ এবং আন্তর্জাতিক আইন বিরােধী বলে অভিহিত করেছেন। জাতিসংঘের সনদ বিবেচনার আন্তর্জাতিক আইন সমিতির কলকাতা শাখার চেয়ারম্যান মিঃ সুব্রত রায় চৌধুরী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বিচার প্রসঙ্গে ইয়াহিয়া খানের সাম্প্রতিক বিবৃতির কথা উল্লেখ করে বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রস্তাব ১৯৪৯ সালের ১২ই আগষ্টের চারটি জেনেভা চুক্তির সাধারণ অনুচ্ছেদও তৃতীয় অনুচ্ছেদের বিরােধী। পাকিস্তান এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক ধরনের না হলে ও জেনেভা চুক্তি স্বাক্ষরকারী কোন দেশে কোন সশস্ত্র সংঘর্ষ ঘটলে তা তৃতীয় অনুচ্ছেদের আওতায় আসবে। যুদ্ধাবস্থা স্বীকৃত না হলেও যে কোন গৃহযুদ্ধের ক্ষেত্রে এই অনুচ্ছেদটি প্রযােজ্য। পাকিস্তানে এখন যে সশস্ত্র সংঘর্ষ চলছে তা আন্তর্জাতিক ধরনের না হলেও তাতে এই অনুচ্ছেদ প্রয়ােগ করা যাবে। যে সব ব্যক্তি সশস্ত্র বিরােধে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন নি অথবা যারা আত্মসমর্পন করেছেন তারা এর আওতায় পড়বেনা। স্বভাবতই শেখ মুজি রহমানের ক্ষেত্রে ৩নং অনুচ্ছেদ প্রযােজ্য।
তিনি আরও বলেন, ১৯৪৮ সালের ৬ই ডিসেম্বর জাতি সংঘের সাধারণ পরিষদে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকারের সনদ গৃহীত হয়। এই ঘােষণার ২নং ধারায় রাজনৈতিক মতবাদের পূর্ণ স্বাধীনতা স্বীকৃত হয়েছে। ১০ এবং ১১ নং ধারায় প্রতিটি ব্যক্তির কোন অপরাধের জন্য স্বাধীন বিচারালয় দ্বারা ন্যায় এবং প্রকাশ্য বিচারের অধিকার স্বীকৃত। শেখ মুজিবর রহমানের প্রস্তাবিত বিচার এইসব মৌলিক নীতির সম্পূর্ণ অস্বীকৃতি। জাপান সংসদ সদস্যের বিবৃতি জাপানের সংসদ সদস্য মিঃ কামিচি মিসিসুরা অবিলম্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তি দাবী করেছেন। তিনি বলেন যে, বাংলাদেশে নির্বাচনে শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বাধীনে আওয়ামী লীগ সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। মিঃ মসিমুরা বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ ও পাকিস্তানের নেতাদের সঙ্গে আলােচনা শুরু করার জন্য উত্থানটের কাছে দাবী জানিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের সীমান্তে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক পাঠানাের বিরােধীতা করেন। তিনি বলেন যে, জাতিসংঘ বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছুই করেনি। ৮ই আগষ্ট মুজিবর রহমান দিবস। বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতি আগামী ৮ই আগষ্ট ভারতে মুজিবর রহমান মুক্তি দিবস পালনের উদ্যোগ। নিয়েছেন। ভারতের সংসদের ৪০ জন সদস্য এক যুক্ত বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের গোপন । বিচারের নামে ইয়াহিয়ার ঘৃণ্য চক্রান্ত সম্পর্কে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য দেশের সর্বত্র সভাশােভাযাত্রা সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে সকল রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য সংস্থাগুলির প্রতি আহ্বান। জানিয়েছেন। তারা তাদের বিবৃতিতে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলির কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তি দাবীতে ইয়াহিয়ার উপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য আবেদন জানিয়েছেন।
শেখ মুজিবের জন্য বিশিষ্ট বৃটিশ আইনবিদ। বিশিষ্ট বৃটিশ আইনবিদ মিঃ সীন ম্যাক ব্রাইড বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের গােপন বিচার এবং তাঁকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করার যে সম্ভাবনা রয়েছে তা রােধ করার ব্যাপারে শীঘ্রই পাকিস্তান সফরে যাবেন বলে জানা গেছে। পাক সামরিক কর্তৃপক্ষ মিঃ ম্যাক ব্রাইডকে তাঁর মক্কেল শেখ মুজিবর । রহমানের সাথে দেখা করতে অনুমতি দেবে কিনা তা উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করা হচ্ছে।
জয়বাংলা (১) # ১ : ১৩ ॥ ৬ আগস্ট ১৯৭১।
শেখ মুজিবরের মুক্তির জন্য উথানটের হস্তক্ষেপ কামনা
বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে মুক্তিদানের ব্যাপারে জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উথানটের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেলের কাছে প্রদত্ত এক আবেদনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বক্তব্যের উল্লেখ করে বলা হয় যে, শেখ মুজিবর রহমানের মানবিক অধিকার এতে খর্ব করা হয়েছে। বাংলাদেশে পাক সেনারা যে নির্মম গণহত্যা চালিয়েছে আবেদন পত্রে তার উল্লেখ রয়েছে ।
জয়বাংলা (১) [১:১৩ ॥ ৬ আগস্ট ১৯৭১।
বঙ্গবন্ধুর বিচারের নামে প্রহসনের এই প্রতিক্রিয়া মারাত্মক হবে
বাংলাদেশ নেতৃবৃন্দের তেজোদীপ্ত ঘােষণা। অস্থায়ী রাষ্ট্র প্রধানের তারবার্তা-প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল মিঃ উথান্ট ও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের নিকট প্রেরিত তারবার্তায় বলেন ইয়াহিয়া খান বর্তমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মজিবর রহমানের বিচারের প্রহসনে মেতে উঠেছে ।। সৈয়দ নজরুল ইসলাম জানান, বাংলাদেশে ব্যাপক গণহত্যায় নিমগ্ন হয়ে ইয়াহিয়ার সৈন্যদের যে । প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা চাপা দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা হিসাবে জঙ্গী সরকার এখন বঙ্গবন্ধুর বিচারের প্রহসনে মেতে উঠেছে, এধরনের উদ্ধত আচরণের দ্বারা জঙ্গী ইয়াহিয়া সরকার তার সৈন্যদের নৈতিক অধ:পতন ঠেকাতে পারবে না। | রাষ্ট্র প্রধানগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর বিচারের নামে এ ধরনের কোন উদ্ধত আচরণ বা অপরিণামদর্শী উদ্যোগ নিলে তার প্রতিক্রিয়া মারাত্মক রূপ ধারণ করবে, রাষ্ট্রপ্রধানদের নিকট প্রেরিত তারবার্তায় তিনি বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারবর্গের মুক্তির ব্যাপারে তাদের প্রভাব বিস্তারের অনুরােধ জানিয়েছেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ পশ্চিম পাকিস্তানে জল্লাদ সরকারের হাতে বন্দী বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের নয়নের মণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের কথিত বিচার প্রহসন বন্ধের ব্যাপারে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকারের পৃথক পৃথক এবং জাতিসংঘের মাধ্যমে সমষ্টিগত আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। মুজিবনগর থেকে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর তথাকথিত বিচার প্রহসনে কেবল প্রতিবাদীই বিচারক এবং রায় কার্যকরকারী। সুতরাং এহেন বিচার প্রহসনের ফলাফল সহজেই অনুমেয়। তিনি বলেন, ইয়াহিয়া খানের এই জঘন্য চক্রান্ত অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।
বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। আরও বলেন, জঙ্গী সরকারের এই উদ্দেশ্যমূলক বিচার প্রহসনের ব্যাপারে বিশ্ববাসী যদি কেবল নীরব। দর্শক হয়ে থাকেন তাহলে ইহা মানবতা ও সভ্যতার মূল্যায়নের সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা ও অপরাধের কাজ হবে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবর রহমানের জীবনের গুরুত্ব শুধু বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের শান্তি ও সমৃদ্ধির মধ্যেই নিহিত নয়, বিশ্বের এই অংশের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য ও তাঁর জীবনের গুরুত্ব অপরিসীম। তিনি বলেন, পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা দখল এবং বাংলাদেশের জনমত ও মানবাধিকারকে নিস্পিষ্ট করার অপরাধে অপরাধী জেনারেলদের কোন নৈতিক ও আইনগত অধিকার নেই বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের আশা আকাঙ্খার মূর্তপ্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে বিচার করার! | লণ্ডনে অবস্থানরত জাতিসংঘে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসনের হুমকিতে বিশ্বের শক্তিবর্গ এবং বিবেকবান মানুষকে এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের আবেদন জানান। তিনি বলেন এই প্রচেষ্টা রােধ করতে না পারলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যে বিক্ষোভের দাবাগ্নি জ্বলে উঠবে, তা বিশ্ব-শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত মারাত্মক হবে। বাংলার সাড়ে ৭ কোটি ও বিশ্বশান্তির স্বার্থে তিনি জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংরক্ষণের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলােকে এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপের আবেদন জানান।
বাংলাদেশ (১) ১:১০ ৯ আগস্ট ১৯৭১
ভারত বঙ্গবন্ধুর মুক্তি নিয়ে আলােচনা করছে
-শরণ সিং
নয়াদিল্লী, ৩রা আগষ্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তি সম্পর্কে ভারত কয়েকটি দেশের সঙ্গে আলাপ আলােচনা করছে।
বহির্বিষয়ক দফতরের মন্ত্রী শ্ৰীশরণ সিং আজ রাজ্যসভায় বলেন যে, ভারত এই দেশগুলিকে জানিয়েছে পাকিস্তান যদি মুজিবর রহমানের বিচারের প্রহসন করে তা হলে বিষয়টিকে আরও জটিল করে তােলা হবে এবং সমস্যা সমাধানের পক্ষে তাতে কোন লাভ হবে না।
বাংলাদেশ (1) ! ১: ১০ ৯ আগস্ট ১৯৭১
অক্টোবরের আগেই বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদণ্ড হতে পারে
মুজিবনগর, ৩রা আগষ্ট–পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এই মর্মে আশ্বাস দিতে অস্বীকার করেন যে, ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতার জন্য সামরিক আদালতে বিচারের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে প্রাণদণ্ড দেওয়া হবে না। গত সপ্তাহে তেহেরানের দৈনিক সংবাদপত্র কেহান ইন্টারন্যাশনালের সংবাদদাতার সঙ্গে এক সাক্ষাঙ্কারে তিনি বলেন, শেখ মুজিবরের সামরিক আদালতে বিচার হবে এবং জাতীয় পরিষদের বৈঠক পৰ্য্যন্ত তিনি জীবিত থাকবেন কিনা, তা আমি বলতে পারি না। আমির তাহের জেনারেল ইয়াহিয়ার সঙ্গে ওই সাক্ষাৎকার করেন। তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, জাতীয় । পরিষদের বৈঠক ডাকার আগেই শেখ মুজিবরের বিচার ও প্রাণদণ্ড হবে কিনা? জেনারেল ইয়াহিয়া মুজিবরের বিচারের সঠিক তারিখ দিতে পারেন নি। তবে অক্টোবরের আগেই শেখের বিচার প্রহসন শেষ হবে বলে জানিয়েছেন। তিনি শুধু বলেন, বিষয়টি সামরিক ন্যায় বিচারের এক্তিয়ারে।’ তিনি জানান, আসন্ন উপ-নির্বাচনে যে সব আওয়ামী লীগ সদস্য ‘দোষী সাব্যস্ত হবেন না, তারা সবাই নির্দল প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন। এই সংবাদপত্রের খবরে জানা যায়, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আরও একবারের জন্য পাক প্রেসিডেন্ট পদে থাকতে ইচ্ছুক।
বাংলাদেশ (১) ১ ১০ ৯ আগস্ট ১৯৭১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৩