সামরিক আদালতে মুজিবের ‘বিচার অভিযােগ প্রমাণিত হইলে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দেওয়া যাইতে পারে—ইয়াহিয়া
(বিশেষ প্রতিনিধি)
ইসলামাবাদের সামরিক-চক্র কর্তৃক গণপ্রজাতন্ত্রী বাঙলাদেশ সরকারের প্রধান শেখ মুজিবর রহমানের সামরিক আদালতে বিচারের চক্রান্ত দেশবাসী ও রাজনৈতিক মহলে তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করিয়াছে। সকল মহল ইহাকে ‘বে-আইনী’ ইসলামাবাদ গােষ্ঠীর অধিকার বহির্ভূত এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আর একটি ষড়যন্ত্রমূলক কার্য বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। উল্লেখযােগ্য যে, শেখ মুজিব বর্তমানে ইয়াহিয়ার হাতে বন্দী। বিবিসি প্রচারিত এক খবরে ফাইনান্সিয়াল টাইমস পত্রিকার সংবাদের বরাত দিয়া বলা হয় ইয়াহিয়া উক্ত পত্রিকার প্রতিনিধিদের জানাইয়াছে যে শীঘ্রই শেখ মুজিবর রহমানকে বিচারের জন্য সােপর্দ করা হইবে। এই বিচার সামরিক আদালতে গােপনে অনুষ্ঠিত হইবে। ইয়াহিয়া নাকি আরও বলে যে, শেখ সাহেবের বিরুদ্ধে যে অভিযােগ আনয়ন করা হইয়াছে উহা প্রমাণিত হইলে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দেওয়া যাইতে পারে।
বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সােভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান এবং ভারত, চীন, বৃটেন, ক্যানাডা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি প্রধানমন্ত্রীদের কাছে শেখ। মুজিবের নিরাপত্তা ও মুক্তির ব্যাপারে হস্তক্ষেপের জন্য আবেদন জানাইয়া তারবার্তা প্রেরণ করিয়াছেন। | কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপের নেতৃবৃন্দ ইয়াহিয়া গােষ্ঠীর এই সিদ্ধান্তের নিন্দা করিয়া বলেন যে, ইহা ত বিচার নয়, বিচারের প্রহসন করিয়া শেখ মুজিবকে হত্যার ষড়যন্ত্র মাত্র। তাহারা বলেন, ইয়াহিয়ার এই চক্রান্ত ও তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ন্যায় একই পরিণতি লাভ করিবে।। কমিউনিষ্ট পার্টির জনৈক মুখপাত্র বলেন শেখ মুজিবর রহমানের বিচার করার কোন অধিকার ইয়াহিয়া চক্রের নাই। উল্লেখযােগ্য যে, কমিউনিষ্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির এক সভায় সম্প্রতি শেখ মুজিবর রহমানের বিনাশর্তে মুক্তি দাবী করা হয় ।
আমাদের নিজস্ব বার্তা পরিবেশক জানান ঃ শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে মামলায় সাক্ষ্যদানের জন্য সামরিক বাহিনীর গােয়েন্দারা ঢাকার সাংবাদিকদিগকে পীড়ন করিতেছে। বিভিন্ন পত্রিকার বার্তা সম্পাদক, বার্তা পরিবেশক, আলােকচিত্র শিল্পী প্রভৃতিকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়া গিয়া শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগ সংক্রান্ত বিবৃতিতে স্বাক্ষর আদায় করা হইতেছে। কতকগুলি দালাল সংবাদপত্র এ ব্যাপারে সােৎসাহে সহযােগিতাও করিতেছে।
মুক্তিযুদ্ধ ॥ ১: ৩ ৪
২৫ জুলাই ১৯৭১
বাংলাদেশের মানুষ বরদাশত করবে না
(নিজস্ব প্রতিনিধি)
বঙ্গবন্ধুর বিচার করবে, একথা প্রচার করেছে ইসলামাবাদের খুনী চক্র। কিন্তু এ অধিকার তাকে কে দিয়েছে? ইতিহাসের পথ রােধ করে যারা ক্ষমতার দাপটে উন্মাদ হােয়ে উঠে, বাংলার সরল প্রাণ মানুষ তাদের শায়েস্তা করেছে। আর তাদেরই অবিসম্বাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু আজ বন্দীদশায় কাল কাটাচ্ছেন জঙ্গীশাহীর কারান্তরালে। কিন্তু তাঁকে বিচার করবার অধিকার তাদের নেই। জবরদস্তি কোরে এ প্রহসন করলে বাংলাদেশের মানুষ তাকে বরদাশত্ করবে না। এ উদ্ধৃত আচরণের সমুচিত জবাব দেবেই বাংলার মানুষ। স্বাধীন বাংলাদেশ একটি সত্য । পৃথিবীর মানচিত্রে এ এক সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাম । ইতিহাসে এ নাম সাড়ে সাত কোটি মানুষের রক্তের অক্ষরে লেখা চিরভাস্বর। এই দেশেরই প্রতিটি মানুষের। প্রাণপ্রিয় সুহৃদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে দেশদ্রোহীর অপরাধে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চায়, এমন ধৃষ্ঠতা কার? পাকিস্তান’ নামের যে দেশটি আজ মৃত, তারই নরপতি ইয়াহিয়া যদি এই দুঃসাহস নিয়ে বিশ্বের মানবগােষ্ঠীকে বােকা বানাতে চায় আর বাংলার সার্বিক মুক্তির অপ্রতিরােধ্য সংগ্রামকে করতে চায় দুর্বল তবে জেনে রাখাে ইয়াহিয়া তােমাদের জবাবের দিন সমাগত। এবারেতে প্রতিশােধ কসম নিয়েছি, পালাবার পথ দেবাে না তােমাদের জঙ্গী পাকা সরকারের হাতে মাতৃভূমি বাংলাদেশ থেকে দেড় হাজার মাইল দূরে পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দী বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের নয়নমণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জল্লাদ অধিপতি ইয়াহিয়া খান কর্তৃক সামরিক আদালতে বিচারের হুমকী সম্পর্কে প্রকাশিত খবরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও তার পরিবারবর্গের আশু মুক্তির জন্য জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উথান্ট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সােভিয়েত রাশিয়া, গ্রেট বৃটেন, গণচীন, ভারত, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের নিকট পৃথক পৃথক তারবার্তা প্রেরণ করে তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। এ ছাড়া গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজুদ্দিন আহমদ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী খােন্দকার মােশতাক আহমদ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্র প্রধান ও অবিসম্বাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধান ও জাতিসংঘের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। বাংলাদেশে ছাত্র লীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ যুবশক্তির অদম্য প্রেরণার অফুরন্ত উৎস বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির ব্যাপারে বিশ্বের যুব সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। নেতৃবৃন্দ তাদের বিবৃতিতে বলেন যে, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার করার ন্যায় ও আইন সঙ্গত অধিকার। আজ জঙ্গী সরকারের নেই।
জয়বাংলা (১) ! ১ : ১২ !! ৩০ জুলাই ১৯৭১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৩