You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.10 | পাকিস্তানের ভারত আক্রমণের ইতিহাস | সপ্তাহ - সংগ্রামের নোটবুক

পাকিস্তানের ভারত আক্রমণের ইতিহাস

স্বাধীনতা লাভের পর থেকে ভারত বরাবরই পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তি এবং মৈত্রীকে বসবাস করবার প্রয়াস চালিয়ে এসেছে। এদেশ পাকিস্তানের দিকে বারবার মৈত্রীর হাত প্রসারিত করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পাকিস্তানি শাসকরা দেশ বিভাগের দিনটি থেকেই সব সময় বলেছেন, ভারত পাকিস্তানের পয়লা নম্বরের শত্রু। বলেছেন, ভারতকে ধ্বংস করেই কেবল পাকিস্তান উন্নতি করতে পারবে। এই এলক্ষ্য অর্জনের জন্যে তারা বিগত ২৫ বছরে তিনবার ভারতের ওপর নগ্ন আক্রমণ চালিয়েছেন এবং বহুবার ভারতের বিরুদ্ধে বৈরীসুলভ আচরণ করেছে।

কাশ্মীর আক্রমণ (১৯৪৭)
ভারতের আঞ্চলিক সংহতির ওপর পাকিস্তান প্রথম আঘাত হানে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের সাত সাত সপ্তাহের মধ্যেই। এসময় নিয়মিত পাকিস্তানি ফৌজের সহায়তায় আদিবাসী হানাদাররা জম্মু ও কাশ্মীর আক্রমণ করে। পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ এড়াবার জন্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ১৯৪৭ সালের ২২ ডিসেম্বরে লেখা এক চিঠিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে অনুরােধ জানান, হানাদারদের যেন তারা কোনােরকম সাহায্য বা মদত
দেন এবং যুদ্ধকে প্রলম্বিত না করেন। পাকিস্তান এ অভিযােগ দৃঢ়তার সঙ্গে অস্বীকার কররে। ১৯৪৭ সালের ৩০ ডিসেম্বরর এক চিঠিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জানালেন, পাকিস্তান সরকার হানাদারদের সাহায্য দিচ্ছেন বলে যে অভিযােগ আনা হয়েছে, আমরা তা জোরের সঙ্গে অস্বীকার করছি। পক্ষান্তরে যুদ্ধ ছাড়া অন্যান্যভাবে আদিবাসী আন্দোলন নিরুৎসাহিত করতে পাকিস্তান সরকার সাধ্যমতাে সর্বপ্রকার চেষ্টা করে আসছেন।” এরপর ১৯৪৮ সালের ১৫ জানুয়ারিতে লেখা এক চিঠিতে পাকিস্তানের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার মহম্মদ জাফরুল্লা খান রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহাসচিবকে জানান, “তথাকথিত হানাদারদের মদত ও সাহায্য দেওয়া হচ্ছে অথবা ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালানাে হচ্ছে বলে যে অভিযােগ করা হয়েছে। পাকিস্তান সরকার তা দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করছেন”।
এই অভিযােগ অস্বীকার অবশ্য সত্যি সত্যি যা ঘটেছে তার বিপরীত ভারতের হাতে তখন যেসব তথ্য ছিল সেসব তথ্যের ভিত্তিতে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করতে পারত। কিন্তু নিজস্ব নীতির সঙ্গে সংগতি রেখে ভারত শান্তির পথকেই বেছে নিয়েছিল এবং যুদ্ধের বদলে রাষ্ট্রসঙ্ঘের শরণ নিয়েছিল। ১৯৪৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর ভারত পাকিস্তানের আক্রমণের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদে অভিযােগ পেশ করে। ১৯৪৮ সালের জুলাই মাসে রাষ্ট্রসংঘ কমিশন সরেজমিন তদন্তের পর এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, জম্মু ও কাশ্মীরে পাকিস্তানি সেনার উপস্থিতি বেআইনি এবং পাকিস্তানকে তার সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে হবে। কমিশন যখন করাচী পরিদর্শন করেন এবং কাশ্মীরে রাষ্ট্রসঙ্ঘের উপস্থিতি আসন্ন হয়ে দাঁড়ায় তখন পাকিস্তান সরকার তার আগেকার কথা বেমালুম হজম করে গেল এবং স্বীকার করল যে জম্মু এবং কাশ্মীর আক্রমণে তার যােগসাজস ছিল। স্যার জাফরুল্লা খান অসংকোচে নিরাপত্তা পরিষদকে জানালেন, কাশ্মীরে পাকিস্তানি ফৌজের তিনটি ব্রিগেড রয়েছে এবং মে মাসের প্রথমার্ধেই এই ফৌজ কাশ্মীরে পাঠানাে হয়েছে।

কচ্ছ আক্রমণ—১৯৬৫
কাশ্মীরে চক্রান্ত ব্যর্থ হওয়ায় এরপর পাকিস্তান ভারতের অন্য অংশের দিকে দৃষ্টি ফেরায়। ১৯৬৫ সালের দিকে দৃষ্টি পাকিস্তান কচ্ছের রাণে উত্তর অর্ধাংশে ভারতীয় এলাকা ছাদ বেট অঞ্চল জোর করে দখল করবার ব্যর্থ চেষ্টা করে। ঐ বছর ২৫ ফেব্রুয়ারি ভারতীয় সেনাবাহিনী যখন ঐ এলাকায় পাঠানাে হলাে তখন পাকিস্তানিরা সীমান্তের ওপারে নিজেদের এলাকায় গিয়ে সরে দাঁড়াল। ১৯৬৪ সালের প্রথম দিকে তারা আবার সীমান্ত লঙ্ঘন করে ভারতীয় এলাকা কাজারকোট দখল করল এবং সেখানে একটি ঘাঁটি সংস্থাপন করল। শান্তি এবং মৈত্রীর নীতিতে বিশ্বাসী ভারত প্রস্তাব দিল,
১৯৬০ সালের সীমান্ত চুক্তি অনুযায়ী দু দেশের স্থানীয় কমান্ডারেরা স্থিতাবস্থা বজায় রাখবার জন্যে বৈঠকে মিলিত হােক। ভারত আরাে প্রস্তাব দিল, বিরােধটি শান্তিপূর্ণভাবে মিটিয়ে ফেলার জন্যে পাকিস্তানের ইচ্ছানুযায়ী যে কোন পর্যায়ে দু-দেশের সরকারি প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক বৈঠক হােক। পাকিস্তান এই সব আবেদন উপেক্ষা করল এবং আগেকার সমস্ত মানচিত্র ও চুক্তি অগ্রাহ্য করে ১৯৬৫ সালের ৯ এপ্রিল কচ্ছের সদর এলাকায় আমাদের মীমান্ত ঘাটির ওপর কাপুরুষের মতাে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। পাকিস্তান এই আক্রমণে একটি পদাতিক ব্রিগেড নিয়ােগ করেছিল এবং সঙ্গে ট্যাঙ্ক ও ভারী কামানও ছিল। ১৯৬৫ সালের ২৮ এপ্রিল লােকসভায় এক ভাষণে প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী বলেছিলেন, “পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের কাছ থেকে পাওয়া দলিলপত্র থেকে এবং তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করবার ফলে এটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে এই আক্রমণ ছিল পূর্ব-পরিকল্পিত। ৭ এপ্রিল এই আক্রমণের আদেশ দেওয়া হয় এবং ৯ এপ্রিলের ভােরের দিক এই আক্রমণ চালানাে হয়।”
পাকিস্তানের এই যথেচ্ছ আক্রমণ ঢাকা দেবার চেষ্টায় ১৫ এপ্রিল তারিখে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেড এ ভুট্টো একটা দুর্বল যুক্তি খাড়া করার চেষ্টায় বললেন, “এটা মনে রাখা দরকার যে এই বিরােধ দেখা গিয়েছে চব্বিশতম সমান্তরালের কিঞ্চিৎ উত্তরে অবস্থিত একটি এলাকা নিয়ে। এই বিরােধ দেখা দিয়েছে সীমান্তরেখা অচিহ্নিত থাকবার দরুন নয়, বিতর্কিত এলাকটি ভারতীয় অধিকারে থাকার দরুন।” এর অর্থ, পাকিস্তান এমন একটি এলাকা সশস্ত্র আক্রমণ চালাবার জন্যে বেছে নিল যেখানে পাকিস্তান কখনাে দখল দাবি করেনি। আর এই আক্রমণ রাষ্ট্রসঙ্ দলিল এবং ১৯৬০ সালের পাক-ভারত সীমান্ত চুক্তির অন্তর্গত গ্রাউন্ড রুলের বিরােধী।
এই প্ররােচলা সত্ত্বেও ভরত সংযম দেখিয়েছে। ১৯৬৫ সালের ১৯ এপ্রিল সে পাকিস্তানের কাছে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিল। ভারত প্রস্তাব করল, যুদ্ধ-বিরতের পর পূর্বেকার স্থিতাবস্থ ফিরিয়ে আনবার জন্যে দুদেশের অফিসার পর্যায়ে আলােচনা হােক এবং পরে সীমানা প্রশ্ন নিয়ে আলােচনার জন্যে দুদেশের সরকারের মধ্যে এক উচ্চ-পর্যায়ের বৈঠকের ব্যবস্থা করা হােক। ২৪ এপ্রিল নয়াদিল্লিস্থিত পাকিস্তানি হাইকমিশনার ভারত সরকারের কাছে এক বিকল্প প্রস্তাব দিলেন। এতে বলা হলাে, পাকিস্তানের মতে যেসব এলাকা সম্পর্কে বিরােধ রয়েছে যেসব এলাকা থেকে উভয়পক্ষের সৈন্য সরাতে হবে। কিন্তু পাকিস্তান যেরকম সব সময় করে থাকে এবারেও কূটনৈতিক পর্যায়ে যখন আলােচনা চলছিল তখন এক ব্রিগেড পাকিস্তানি বাহিনী ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ছাদ বেটের পশ্চিয়ে ৮৪ নম্বর পয়েন্টে ভারতীয় ঘাঁটির ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালাল। ভারতীয় বাহিনী তখন প্রতিরােধে নেমে পড়ল এবং অনুপ্রবেশকারীদের হটিয়ে দিল। ভারতীয় বাহিনী নিজেদের এলাকা রক্ষা করতে এগিয়ে আসায় পাকিস্তান সরকার সােরগােল করে প্রতিবাদ জানাতে লাগল এবং যুদ্ধের জিগির তুলল। ১৯৬৫ সালের জুন মাসে লন্ডনে কমনওয়েলথ প্রধানমন্ত্রী সম্মেলনে বিষয়টি তােলা হলাে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মিঃ হ্যারলড উইলসনের উদ্যোগে এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখবার জন্যে ভারতের ঐকান্তিক আগ্রহে ১৯৬৫ সালের জুন মাসে ভারত এক যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করল। এই চুক্তির ধারাগুলাে নিম্নরূপ :
(১) ১৯৬৫ সালের ১ জুলাই থেকে যুদ্ধবিরতি ;
(২) ১৯৬৫ সালের ১ জানুয়ারির স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে আনা ;
(৩) সিন্ধু-কচ্ছ সীমানা নির্ধারণের ব্যাপারে উভয়পক্ষসম্মত পদ্ধতি গ্রহণ করা
এই চুক্তি অনুযায়ী সুইডেনের বিচারপতি ল্যাগারগ্রেনের নেতৃত্বে তিনজন সদস্যের একটি ট্রাইবুনাল গঠিত হলাে। পাকিস্তানের সঙ্গে সুচিহ্নিত সীমানা থাকা সত্ত্বেও ভারত শান্তির স্বার্থেই এই ট্রাইবুনাল গঠনে সম্মত হলাে। ১৯৬৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ট্রাইবুনালের রায় বের হলাে। পাক-ভারত সীমানা যে ২৪তম সমান্তরাল রেখার বরাবর—পাকিস্তানের এই দাবি ট্রায়বুনাল নাকচ করে দিল। ভারতের কচ্ছ এবং পাকিস্তানের সিন্ধুর মধ্যে সীমানা ২৪তম সমান্তরাল রেখা বরাবর কচ্ছের রান এলাকার অধিকাংশ তাদের বলে পাকিস্তান যে যুক্তি দেখিয়েছিল ট্রাইবুনাল তাও বাতিল করে দিল। পক্ষান্তরে কচ্ছের রানের উত্তর কিনারা বরাবর ভারত-পাকিস্তান সীমানারেখা করা রয়েছে বলে ভারত যে ব্যাখ্যা দেয় ট্রাইবুনাল তা গ্রহণ করে। একমাত্র রানের উত্তরপ্রান্তের সীমানা নির্ণয়ের ব্যাপারেই ট্রাইবুনাল অধিকাংশের রায়ে পাকিস্তানকে সামান্য এলাকা (৩২০ বর্গমাইল) দেবার নির্দেশ দেন, যদিও পাকিস্তানের দাবি ছিল ৩৫০০ বর্গমাইল এলাকার ওপর। এক্ষেত্রে ট্রাইবুনালের অন্যতম সদস্য মি. অ্যালেস ব্যাবলার ভিন্নমত পােষণ করেন। তিনি ভারতের বক্তব্য সমর্থন করে বলেন, ১৮৭০ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এই ৭৭ বছর ধরে ম্যাকডােলাণ্ড সীমারেখা বজায় আছে এবং ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উত্থানপতনেও এই সীমারেখার স্থান পরিবর্তন হয়নি। এই সুদীর্ঘ সময়ে এই সীমারেখার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হয়নি। ১৮৬৫ থেকে ১৮৭০ সালের মধ্যে সমস্ত সিন্ধুর এলাকায় প্রথম সমীক্ষা শেষ হবার পরে ১৮৭১ ও ১৮৭২ সালে যে চূড়ান্ত রিপাের্ট পেশ করা হয় তাতে গ্রেট রান এলাকার সীমারেখা সুনির্দিষ্ট করে দেখা হয়। এই রিপাের্টেল শেষতম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯২৮ সালে। ম্যাকডােনাল্ড রেখাও সিন্ধুপ্রদেশের ১৯০৫ সালের মানচিত্র সূচিতে দেখানাে হয়। ভারত ব্রিটিশ শাসন যতদিন না শেষ হয় ততদিন পর্যন্ত সমস্ত সরকারি মানচিত্র এই সীমারেখা দেখা যায়।
পাকিস্তানের প্রকৃত স্বরূপ আবার এভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ে এবং বিশ্বের দরবারে ধ্বিকৃত হয়। কিন্তু এখানেই গল্পের শেষ নয়।

সূত্র: সপ্তাহ, ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১