জুলাই ৭, ১৯৭৩ শনিবার ঃ দৈনিক পূর্বদেশ
রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের প্রতি উৎসাহ দেয়া হবে না : জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেছেন, আমরা সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে বন্ধু সার্বভৌম রাষ্ট্রের কাছ থেকে সাহায্য নেব। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘােষণা করেন, আমাদের প্রয়ােজনের সময় যারা পাশে এসে দাড়িয়েছিলেন আমাদের সেই সব বন্ধুদের প্রতি যখন আমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করি তখন সেই কৃতজ্ঞতাকে বশ্যতা বলে ধরে নেয়া যায় না। তিনি ঘােষণা করেন। যে, বশ্যতার ভিত্তিতে কারাে কাছ থেকে সাহায্য নেয়া হবে না। তিনি বলেন যে, চিরকাল যাতে পরমুখাপেক্ষী না থাকতে হয় সে জন্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে। তাহলে আমাদেরকে আর কখনাে বিদেশের উপর নির্ভর করতে হবে না। শিক্ষা প্রসঙ্গে ঃ জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেন যে, ভবিষ্যৎ সমাজ গঠনের জন্য। প্রয়ােজনীয় শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা দরকার। সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় শিক্ষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করার জন্য শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়েছে। কমিশন প্রাথমিক প্রতিবেদন দাখিল করেছে। পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনের জন্য কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে। তিনি বলেন যে, সরকার উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা করেছে। ১৩টি কলেজে স্নাতকোত্তর পাঠ এবং ২৪ টি কলেজে অনার্স শিক্ষা কোর্স প্রবর্তন করা হয়েছে। তিনি ঘােষণা করেন যে, সরকার নীচ থেকে উপরে আসার নীতিতে বিশ্বাসী। প্রাথমিক শিক্ষাকে হাতে নেয়ার আগে কলেজ শিক্ষাকে হাতে নিতে পারি না। তিনি বলেন যে, সরকার প্রাথমিক শিক্ষা সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রতিরক্ষা সম্পর্কে বেশি সচেতন রয়েছি। তিনি জাতীয় সম্পদের সাথে মিল রেখে প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন যে, আমরা আমাদের প্রতিরক্ষা সম্পর্কে বেশি সচেতন রয়েছি। জনগণই রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা। তিনি বলেন যে, বর্তমান জগত কোন সামরিক শক্তি ছাড়া যেমনি আত্মরক্ষা করতে পারে না, তেমনি অপরকে দাবিয়েও রাখতে পারে না। তিনি বলেন যে, আমাদের সৈনিকদের আমরা এমনভাবে সজ্জিত করব যাতে তারা এ দিয়েই হামলা প্রতিহত করতে পারে। | বিরােধী দল কোন বিকল্প প্রস্তাব দেয় নি। তিনি বলেন যে, সংসদীয় রাজনীতিতে বিরােধী দল একটি বিকল্প সরকার। তিনি বিরােধী দলের বিভিন্ন বক্তব্যের জবাব দিয়ে বলেন যে, বিরােধী দল বিকল্প সরকারের দায়িত্ববােধ নিয়ে কোন বিকল্প পরামর্শ দেয়নি। তিনি বিরােধী দলের একজন সদস্যকে উদ্দেশ্য করে বলেন যে, এটা কি করে বুর্জোয়া বাজেট হল বুঝতে পারছি না। তিনি বলেন যে, সম্পদ কর দ্বিগুণ করাতে কোন চাষি আহত হয়নি। টেলিফোনের উপর কর বসানাের ফলে কোন কৃষক ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি। পররাষ্ট্র নীতি সম্পর্কিত বিরােধী দলের সমালােচনা প্রত্যাখ্যান করে তিনি বলিষ্ঠভাবে পররাষ্ট্র নীতির প্রতি সমর্থন জানান। এ প্রসঙ্গে তিনি শতাধিক রাষ্ট্র কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের বিষয়টি উল্লেখ করেন। | তিনি ভারত, সােভিয়েট ইউনিয়ন ও অপরাপর রাষ্ট্রের এবং জাপানেরও প্রশংসা করেন। এবং মন্তব্য করেন যে, এসব দেশ নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের জনগণের প্রশংসা পাওয়ার যােগ্য। যারা প্রশংসা করতে অক্ষম তাদের নিন্দা করারও কোন অধিকার নেই। কারণ তারা শুধু জনগণের নিন্দাই কুড়াবে।
মন্ত্রী আরাে বলেন, বিভিন্ন পর্যায়ে যারা বাংলাদেশের বিরােধিতা করেছে তারা তাদের ভুল বুঝতে পারবে। কারণ বাংলাদেশ তাদের বিরুদ্ধে কোনই শত্রুতা পােষণ করে না। জুলাই ৯, ১৯৭৩ সােমবার শ্রীঘ্রই বেতনের নতুন স্কেল ঘােষণা করা হবে : স্টাফ রিপাের্টার। অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেছেন যে, শীঘ্রই কয়েক শ্রেণীর সরকারী কর্মচারির জন্য বেতনের নতুন স্কেল ঘােষণা করা হবে এবং তা গত ১ জুলাই থেকে কার্যকর বলে পরিগণিত হবে। গতকাল রবিবার সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে প্রাথমিক শিক্ষকদের এক সম্মেলনে ভাষণ দানকালে তিনি একথা বলেন। অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেন, সমাজের ভিত্তি গড়ে তুলতে প্রাথমিক | শিক্ষার ভূমিকাই মুখ্য। তাই সরকার প্রাথমিক শিক্ষার ওপরও সর্বাধিক গুরুত্ব আরােপ করেন। শশাষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার পথে জাতি অগ্রসর হচ্ছে, তাই এ ব্যাপারে প্রাথমিক শিক্ষকদের দায়িত্বও বেড়েছে বহুগুণে। তিনি বলেন, নিরক্ষর জনগণকে দিয়ে সমাজতন্ত্র অর্জন সম্ভব নয়। তাই শিক্ষকদের দেশের প্রতিটি প্রান্তে শিক্ষার আলাে পৌছে দিতে হবে। কলেজ ও মাধ্যমিক শিক্ষকদের দাবি প্রসঙ্গে তিনি সুপারিশ করেন যে, মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজকে জাতীয়করণ করার দাবির আগে, তাদের প্রথমে প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার দাবিতে এগিয়ে আসতে হবে, যাতে পাঁচ বছরের কোন শিশুই স্কুল শিক্ষা হতে বঞ্চিত না থাকে। সরকারী সম্পদ ও স্বাধীনতা যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতির কথা বিবেচনা করে তিনি মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষকদের প্রতি ধর্মঘট হতে বিরত হওয়ার জন্য আকুল আবেদন জানান। তিনি তাদের জানান যে, সরকার তাদের জন্য সম্ভাব্য সবকিছু করছেন। বাসস এ খবর পরিবেশন করে। অর্থমন্ত্রী প্রাথমিক স্কুল শিক্ষকরা ১৯৭৩ সালের ১ জুলাই থেকে সরকারী চাকুরে হয়ে গেছেন বলে উল্লেখ করে বলেন যে, তারা সরকারী চাকুরে হিসাবে সকল রকম সুযােগ সুবিধা পাবেন। তিনি বলেন যে, সরকার নীতিগতভাবে বেতন কমিশন রিপাের্ট মেনে নিয়েছেন এবং রিপাের্ট বাস্তবায়নের জন্যে বাজেটে ১৭ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন। তিনি বলেন যে, সরকার প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট গুরুত্ব আরােপ করেছেন। শশাষণহীন সমাজ গঠনের দায়িত্ব প্রাথমিক শিক্ষকদের উপরও অনেকখানি নির্ভর করছে।
সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ-ইতিহাসের পাতা থেকে – সিমিন হোসেন রিমি