ভাষা আন্দোলনে দিনাজপুর
দুই পর্বেই আন্দোলন বিস্ফোরক চরিত্রের
ভাষা আন্দোলনে পিছিয়ে ছিল না রাজনীতিসচেতন দিনাজপুরের মানুষ। দিনাজপুরে বিভিন্ন মত ও পথের মধ্যে প্রাধান্য ছিল বাম মতাদর্শের রাজনীতির। এদের লক্ষ্য ছিল ভােগ্যপণ্য থেকে শুরু করে ভাষার মতাে যেকোনাে বিষয় নিয়ে সরকারবিরােধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তােলা।
এমন এক সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক পরিবেশের কারণে দিনাজপুরে ভাষা আন্দোলন রীতিমতাে বিস্ফোরক চরিত্র অর্জন করে। পাকিস্তান গণপরিষদে ব্যবহারিক বাংলার দাবি বাতিল হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ফেব্রুয়ারির (১৯৪৮) শেষ দিক থেকেই দিনাজপুরে ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক পর্ব শুরু। যথারীতি এ ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের। এ খবর আবার ঘটা করে প্রকাশিত হয় কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায়।
ভাষা আন্দোলনের সূচনাকালেই কয়েক পা এগিয়ে ছিল দিনাজপুর। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৪৮ সারের ৩ মার্চ দিনাজপুর শহরে পূর্ণাঙ্গ হরতাল পালিত হয়। স্কুল-কলেজের ছাত্রদের বিক্ষোভ প্রকাশ পায় মিছিলে, স্লোগান ওঠে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’।
একই দিন বিকেলে জনসভা হয় কংগ্রেস ময়দানে খান বাহাদুর আমিনুল হকের সভাপতিত্বে। সভা শেষে ১১ মার্চের কর্মসূচি পালনের প্রস্তুতিপর্ব চলতে থাকে গােপনে, কিছুটা প্রকাশ্যেও। পরিস্থিতি লক্ষ করে বিচলিত প্রশাসন ১১ মার্চের কর্মসূচি ভন্ডুল করতে হঠকারী পদক্ষেপ নেয়, অর্থাৎ ১৪৪ ধারা জারি করে।
কিন্তু ছাত্ররা ১৪৪ ধারা অমান্য করে সভা-সমাবেশ ও মিছিলে সংগঠিত হয়। এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন মীর্জা নুরুল হুদা ছােটি, দবিরুল ইসলাম, আসলেহ উদ্দিন আহমেদ, গােলাম রহমান প্রমুখ। পুলিশ এঁদের আটক করে।
কিন্তু তাতে আন্দোলন বন্ধ হয়নি। পরবর্তী পর্যায়ে আবদুল হক, মুস্তফা নুরুল ইসলাম, মতিউর রহমান চৌধুরী প্রমুখের চেষ্টায় এবং সাধারণ ছাত্রদের স্বতঃস্ফূর্ত তৎপরতায় আন্দোলন সচল থাকে।
ভিন্ন ছিল না ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির তথা একুশের ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির দীর্ঘ সময় দিনাজপুরেও একুশের জন্য আন্দোলনের বীজতলা তৈরি করে। এ পর্বে উল্লেখযােগ্য নেতৃত্বের কৃতিত্ব পূর্বোক্ত মীর্জা নুরুল হুদা ছােটি ও আসলেহ উদ্দিন আহমেদের সেই সঙ্গে তাদের সহযােগী নেতা-কর্মীদের তৎপরতা। এদের সঙ্গে তৎপর হতে দেখা যায় একাধিক সংগঠনের ছাত্রনেতাদের, যেমন আবদুল হাফিজ মােহাম্মদ ফরহাদ, মােহাম্মদ নাসিম, দলিলউদ্দিন প্রমুখ। আদর্শগত ও সাংগঠনিক বিচারে বাম সংগঠনের পাশাপাশি যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতাদের আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিতে দেখা যায়।
একুশের কর্মসূচি সফল করতে ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে প্রত্যক্ষ ও প্রকাশ্য তৎপরতা বেশ জোরেশােরে শুরু হয় প্রধানত মীর্জা নুরুল হুদার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনসভার মাধ্যমে। বিশেষ গােপনীয়তায় চলে পােস্টার লেখা, পােস্টার সাঁটা, ইশতেহার লেখা, ছাপা ও বিতরণ করার কাজ। এসব কাজে বাম মতাদর্শের ছাত্রছাত্রী ও নেতৃস্থানীয়দের ছিল বিশেষ ভূমিকা। অন্যদিকে আন্দোলনের সাংগঠনিক দিকে বিশেষ সহায়ক ভূমিকা রাখেন স্থানীয় জেলা আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি আবদুর রহিম। প্রকৃতপক্ষে একুশের কর্মসূচি পালনের প্রচেষ্টা সর্বদলীয় চরিত্র অর্জন করে।
অবস্থাদৃষ্টে বিচলিত প্রশাসন ২০ ফেব্রুয়ারি শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে সভা, সমাবেশ, মিছিল নিষিদ্ধ ঘােষণা করে। এ নিষেধাজ্ঞা ছাত্রদের মনােবল বাড়িয়ে দেয়। তাদের চেষ্টা যেকোনাে মূল্যে একুশে ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি সফল করে তােলা।
একুশে ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে শুরু হয় শহরের বিভিন্ন সড়কে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিল। সেই মিছিল যেন এক অন্তহীন যাত্রার পথপরিক্রমা, যা শেষ পর্যন্ত মাদ্রাসা ময়দানে এসে শেষ হয়। এরপর স্কুল ময়দানে শিক্ষক মাহমুদ মােকাররম হােসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় ছাত্রজনসভা। এ সভায় জ্বালাময়ী বক্তব্য দেন মীর্জা নুরুল হুদা, আসলেহ উদ্দিন আহমেদ, আবদুল হাফিজ প্রমুখ। জনসভা শেষে সন্ধ্যায় আবারও শহরে প্রতিবাদী মিছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান কণ্ঠে ধারণ করে।
ঢাকায় গুলিবর্ষণের সংবাদে পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি হয় দিনাজপুর শহরে গর্জমান মিছিল, শােক, ক্রোধ ও আবেগ নিয়ে। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে শহর ছাড়িয়ে সংলগ্ন এলাকায়। চলতে থাকে হরতাল, সভা ও মিছিল। ছাত্রদের খণ্ড খণ্ড মিছিলে যােগ দেন সাধারণ মানুষ, শ্রমজীবী মানুষ। ক্রুদ্ধ শােকার্ত স্লোগান ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’,’ নুরুল আমিনের রক্ত চাই’, ‘মন্ত্রিসভা গদি ছাড়।’ অবিকল ঢাকার চালচিত্র যেন।
উল্লিখিত গুলিবর্ষণের প্রতিক্রিয়ায় এখানেও ছাত্র আন্দোলন ব্যাপক গণআন্দোলনে পরিণত হয়। মিছিল শেষে বিশাল জনসভা। সেই জনসভায় ক্ষুব্ধ বক্তব্য দেন হাজি মােহাম্মদ দানেশ, গুরুদাশ তালুকদার, আবদুর রহিম প্রমুখ রাজনীতিক এবং পূর্বোক্ত ছাত্রনেতারা। একই ধারায় পরদিন বিশাল বিক্ষোভ মিছিল ও জনসভা। আন্দোলন চলে ফেব্রুয়ারিজুড়ে। মার্চে ব্যাপক গ্রেপ্তার। আন্দোলন ক্রমশ থিতিয়ে আসে। কিন্তু পরিস্থিতি ছিল ছাইচাপা আগুনের মতাে।
বাম রাজনৈতিক আন্দোলনের জনপদ দিনাজপুরেও ভাষা আন্দোলন জেলা শহর দিনাজপুর ছাপিয়ে থানাসহ গ্রামাঞ্চলে উপচে পড়ে। এমনকি এর কিছুটা প্রকাশ ১৯৪৮-এর মার্চের আন্দোলনেও দেখা গেছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে ভাষা আন্দোলন-এর লেখক ভাষাসংগ্রামী তসিকুল ইসলাম লিখেছেন, ১৯৪৮-এর মার্চের আন্দোলন দিনাজপুরের বীরগঞ্জে ব্যাপক চরিত্র নিয়ে প্রকাশ পায়। ‘এ ছাড়াও পাঁচদোনা ও বক্তারপুরেও এদিন ছাত্ররা ধর্মঘট করে বাংলা ভাষার পক্ষে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।’
আর একুশের আন্দোলন তাে ছিল বিস্ফোরক চরিত্রের। দৈনিক আজাদ এর প্রতিবেদনেই দেখা যায় এ আন্দোলন দিনাজপুর শহর থেকে পঞ্চগড়, পার্বতীপুর প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হয়ে শিবপুর, বােদা, প্রামাণিক পাড়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। শেষােক্ত স্থানে অনুষ্ঠিত বিরাট এক ওয়াজ মাহফিলেও বাংলা ভাষার পক্ষে সমর্থন জানানাে হয়। একে বলা হয় “বৈধ দাবি”।
আজাদ-এর অন্য একটি প্রতিবেদনে (২৯ ফেব্রুয়ারি) দেখা যায় যে ঠাকুরগাঁও মহকুমা মুসলিম লীগের সভাপতি জমীরউদ্দীন প্রধানের সভাপতিত্বে তেঁতুলিয়া, পঞ্চগড়, বােদা ও দেবীগঞ্জ থানার জনসাধারণের এক সভা হয়। এ সভায় পুলিশের গুলিবর্ষণের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে হাইকোর্টের জজদের নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠনের পাশাপাশি মুসলিম লীগ দলের পক্ষ থেকেও ‘একটি নিরপেক্ষ বেসরকারি তদন্ত কমিটি গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়’। এখানে তাতে সমর্থন জানানাে হয়।
বুঝতে পারা যায় সরকার ও মুসলিম লীগ দেশব্যাপী ব্যাপক ও তীব্র আন্দোলনের মুখে কতটা চাপের মুখে পড়েছিল। কিন্তু যথাযথ বলিষ্ঠ রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাবে এ আন্দোলনের পুরােপুরি সদ্ব্যবহার কর যায়নি। অর্থাৎ ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের আগে পূর্ববঙ্গে মুসলিম লীগ সরকারের পতন ঘটানাে সম্ভব ছিল বিস্ফোরক ওই ফাল্গুনেই। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত এ আন্দোলনের আহ্বানের চাপে নুরুল আমিন সরকারের পক্ষে পদত্যাগের কোনাে বিকল্প ছিল না।
উল্লেখ্য, ২৭ এপ্রিল (১৯৫২) ঢাকার বার লাইব্রেরি হলে প্রদেশের বিভিন এলাকা থেকে আগত প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত ভাষাকর্মী সম্মেলনে দিনাজপুরের ভাষাকর্মীর বলিষ্ঠ আহ্বান মনে রাখার মতাে, ‘প্রতিজ্ঞা করুন, ভাষার দাবি না মেটা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।’
সে দায়িত্ব সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপকভাবে পালিত না হলেও অচিরকালের মধ্যেই ঢাকাসহ প্রদেশের অনেক শহর-গ্রামে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস পালন শুরু হয়ে যায় আরও জোর উদ্দীপনার ভেতর দিয়ে।
১৯৫৩ সালে দিনাজপুরের সুরেন্দ্রনাথ কলেজ প্রাঙ্গণে ছাত্রছাত্রীদের চেষ্টায় তৈরি হয় শহীদ মিনার। এটি ভেঙে ফেলা হয় ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনামলে। পরবর্তী সময়ে গড়া মিনার ভাঙে একাত্তরের পাকিস্তানি সেনারা। পরিশেষে ১৯৭২ সালে নতুন করে যে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়, আজও তা মাথা উঁচিয়ে দাড়িয়ে আছে।
সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক