আগস্ট ১৮, ১৯৭২ শুক্রবার ঃ দৈনিক পূর্বদেশ
আমরা চাই, আমলাতন্ত্র চাই না ঃ (স্টাফ রিপাের্টার)। অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেছেন, বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ভবিষ্যতের দিকে লক্ষ্য রেখে গণতন্ত্রের মূল্যায়ন করতে হবে। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিক্ষক কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত শহীদুল্লাহ হলের নব-নির্বাচিত ছাত্র সংসদের অভিষেক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি একথা বলেন। মন্ত্রী বলেন, গণতন্ত্রকে কখনই সমাজতন্ত্রের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে দেয়া হবে না। তিনি বলেন, মৌলিক অধিকার গণতন্ত্রের একটি অন্যতম দিক। অথচ ধনতান্ত্রিক দেশে সকলে এই মৌলিক অধিকার ভােগ করতে পারে না। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পাকিস্তান আমলে মৌলিক অধিকার থাকা সত্বেও আমাদের দেশের দরিদ্র জনসাধারণের যে সব জমি সরকার হুকুম দখল করেছিলেন তাদের সে সব জমির উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ থেকে তারা বঞ্চিত হয়েছিল। পক্ষান্তরে মৌলিক অধিকার ক্রয় করার মত অবস্থাপন্ন ব্যক্তিরাই কেবল তা ভােগ করতেন। উদাহরণস্বরূপ তিনি জনৈক এডভােকেট কর্তৃক ঢাকা শহরের এলিফ্যান্ট রােডের কিছু অংশ নিজ দখলে রাখার কথা উল্লেখ করেন। জনাব তাজউদ্দিন ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের ধারণার তীব্র বিরােধিতা করে বলেন যে, যে মৌলিক অধিকার সাধারণ মানুষ ভােগ করতে পারে না তার কোন প্রয়ােজন নেই। তিনি বলেন, পৃথিবীর বিভিন দেশে গণতন্ত্র প্রচলিত থাকলেও তার প্রয়ােগ এক রকম নয়। তিনি বলেন, এককালে শিল্প বিপ্লবের স্বার্থে গণতন্ত্রের প্রয়ােজন ছিল।
আজ সমাজতন্ত্রের স্বার্থে গণতন্ত্র অপরিহার্য। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক পদ্ধতি যদি বিপ্লবী চেতনার অন্তরায় হয় তবে তা ভাঙ্গতে হবে। জনাব তাজউদ্দিন বলেন, বাংলাদেশে সমাজতন্ত্রের প্রশ্নে কারাে কোন দ্বিমত নেই। তিনি বলেন, সমাজতন্ত্র কি পদ্ধতিতে বা কোন পন্থায় প্রতিষ্ঠা করা হবে তা নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে। এই উদ্দেশ্যে তিনি সংবাদপত্রে একটি কোরাম’ খােলার জন্য আহ্বান জানান। এই কোরামের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি সম্পর্কে জনগণ আলােচনায় অংশগ্রহণ করতে পারবে। সমাজের বিভিন্নস্তরে দুর্নীতির কথা আলােচনা করে তিনি দৃঢ়ভাবে মত প্রকাশ করেন যে, “পারমিট’ প্রথা অবশ্যই উচ্ছেদ করতে হবে। নতুবা দুর্নীতি দূর হবে না। এ প্রসঙ্গে তিনি সাংবাদিকদের সরকারের পারমিটধারী ব্যক্তিদের নাম সংবাদপত্রে প্রকাশ করার অনুরােধ জানান। এর ফলে এইসব ব্যক্তিদেরকে জনগণ চিনে নিতে পারবে এবং প্রয়ােজনবােধে এদের দুনীতি জনতাই দমন করবে। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ ছাত্র সমাজকে পরস্পরের মতের প্রতি সহনশীল ও শ্রদ্ধাশীল হওয়ার আবেদন জানান। তিনি ছাত্রদের রাজনীতির পাশাপাশি লেখাপড়াও ঠিকভাবে চালিয়ে যাবার পরামর্শ দেন। ছাত্রদের তিনি স্মরণ করিয়ে দেন যে, ছাত্রদের প্রাথমিক এবং প্রধান কর্তব্য হল লেখাপড়া করা। তিনি বলেন, যারা বিপ্লব করতে চায় তাদের সাথে আমি একমত। যদি গণতন্ত্রের মাধ্যমে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হই তবে অবশ্যই বিপ্লব করতে হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে বিপ্লবের গতিধারাকে পুনর্গঠনের কাজে লাগাতে হবে। তিনি বলেন শশাষণহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাই আমাদের মূল লক্ষ্য।
সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ-ইতিহাসের পাতা থেকে – সিমিন হোসেন রিমি