৭ জুন, ১৯৭২ বুধবার ঃ দৈনিক বাংলা
৭ জুন মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী মােড় পরিবর্তন ও স্টাফ রিপাের্টার। “জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম এগােয় সর্পিল গতিতে। আঁকা বাঁকা পথ ধরে। রক্ত পিচ্ছিল এই পথ। বাধা এখানে অসংখ্য। পার হতে হয় অনেক চড়াই উৎরাই। সংগ্রামের এক একটা মােড় পরিবর্তনে ইতিহাসে সংযােজিত হয় নতুন অধ্যায়। ৭ জুন আমাদের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে এমনি একটি যুগান্তকারী মােড় পরিবর্তন। কথাগুলি বলেছেন জনাব তাজউদ্দিন আহমদ। ৬-দফা আন্দোলনের অগ্নি দিনের সংগ্রামী প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। বর্তমানে গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী। সূর্য তখন পড়ন্ত। দিনান্তের কর্মমুখর সেক্রেটারিয়েট ভবন জনশূন্য। অফিস ছুটি হয়েছে সে কোন বিকেলে। লিফট বন্ধ। সিড়ি বেয়ে উঠলাম অতিকায় ভবনের তেতলায়। প্রশস্ত বারান্দার দুদিকে সারিবদ্ধ রুমগুলাে বন্ধ। দশটা পাঁচটার মত বারান্দায় আর লােকের ভীড় নেই। নেই মুখভার করা সাক্ষাপ্রার্থীদের ইতস্তত পায়চারি। দিন শেষের সেক্রেটারিয়েট যেন এক নির্জনপুরি। আর এই নির্জনপুরীর একটি কক্ষের দরজা তখনও খােলা। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ নিবিষ্ট মনে তখনও কাজ করছেন। একান্ত সচিবের অনুমতি গিয়ে ঢুকে পড়লাম সে কক্ষে। সন্তর্পণে পা ফেলে গিয়ে বসলাম টেবিলের সামনে সাজানাে একটি চেয়ারে। তিনি তখনও ঝুঁকে ফাইল পড়ছেন। বুঝলাম আমার আগমন তিনি টের পাননি। ব্যাঘাত ঘটেনি। তার কাজে। ফাইল পড়া শেষ করে মুখ তুলেই হাসলেন। স্বভাবসুলভ সে হাসি। তারপর জানতে চাইলেন আমার আগমনের উদ্দেশ্য। বললাম ঐতিহাসিক ৭ জুন সম্পর্কে আপনার সাক্ষাৎকার নিতে এসেছি। হাতের ফাইলটা বন্ধ করতে করতে জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বললেন, সেক্রেটারিয়েটে ফাইলের উপর বসে সংগ্রামী দিনগুলাের সম্পর্কে চট করে কিছু বলা মুশকিল।
অতীতের সংগ্রামমুখর ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে আলােচনার জন্যে দরকার নিরবচ্ছিন্ন অবসর। রিটায়ার করলে সে সব নিয়ে কিছু লেখার ইচ্ছে আছে। তবু আমার অনুরােধে তিনি বললেন ঐতিহাসিক ৬-দফা আন্দোলন, ৭ জুন, তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এবং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা । জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বললেন, ঐতিহাসিক ৬-দফা ছিল বাঙ্গালি জাতির স্বাধিকার আন্দোলন। পরবর্তী পর্যায়ে এই স্বাধিকার আন্দোলই রূপ নেয় স্বাধীনতা সংগ্রামে। সংগ্রামে আমরা জয়ী হয়েছি। বাংলাদেশ অর্জন করেছে তার যুগ যুগের সংগ্রামের ফসল স্বাধীনতা। তিনি বলেন, পয়ষট্টি সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর আইয়ুব খান আসলেন ঢাকা। জনাব নূরুল আমিন উদ্যোগ নিলেন তার সাথে আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য বিরােধী দলের নেতাদের সাক্ষাৎ ঘটানাের। আমাদের সাথে আইয়ুব খানের সে সাক্ষাৎকার হয়েও ছিল। কিন্তু এর আগে আমরা তৎকালীন স্থানীয় সমস্যাসহ পাকিস্তানের রাজনৈতিক পটভূমিকায় তৈরি করি একটি দাবিনামা। তাতে ছিল তেরটি দফা (১৩টি দফা)।
নূরুল আমিন সাহেবকেও তার একটি কপি আমরা দিয়েছি। কিন্তু তিনি সে কপির দফাগুলাে দেখেই চমকে উঠলেন। বললেন, তাহলে তাে আর আলােচনাই হাতে পারে না আইয়ুব খানের সাথে। আমরা অনড় রইলাম। তবুও সাক্ষাঙ্কার হল। সম্ভবতঃ নূরুল আমিন সাহেব তার কপিটা আইয়ুব খানকে দিয়েছিলেন। তারপর আসল ১৯৬৬ সাল। লাহােরে বসল সর্বদলীয় কনফারেন্স। এর উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্য ছিল সব বিরােধী দলকে জড়াে করিয়ে তাসখন্দ ঘােষণার বিরুদ্ধে কিছু আদায় করে নেয়া। আমরাও সে সম্মেলনে আমন্ত্রণ পেলাম। যাবার আগে শেখ সাহেব বললেন, লাহাের কনফারেন্সের জন্যে বাঙ্গালিদের পক্ষ থেকে কিছু তৈরি করে নিতে। আমরা তখন সেই ১৩ দফার স্থানীয় কিছু বাদ দিয়ে তৈরি করলাম এক দাবিনামা। তাতে অনেক উপ-দফা বাদ দিয়ে মােট দাবি হল ৬টি। তাই নিয়ে আমরা গেলাম লাহােরে, তা পেশ করা হল সম্মেলনের বিষয় নির্বাচনী কমিটিতে। কিন্তু সাবজেক্ট কমিটি আমাদের দাবিনামা দিলেন নাকচ করে। পরদিন প্রতিবাদে আমরা বর্জন করলাম সর্বদলীয় সম্মেলন। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বললেন, দাবিনামায় যে ৬টি দফা ছিল তার ওপর আমরা তেমন গুরুত্ব দেইনি।
কিন্তু সম্মেলন বর্জনের পরদিন পশ্চিম পাকিস্তানের সংবাদপত্রে ব্যানার হেডিংয়ে বের হল শেখ সাহেবের ৬-দফা। অথচ সে সময়ে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনে (ডিপিআর) কোন সম্মেলনের খবর প্রকাশ করা ছিল নিষিদ্ধ। তবুও ৬-দফার সংবাদ বের হল খবরের কাগজে। সঙ্গে সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবাদের অপবাদ দিয়ে লেখা হল সম্পাদকীয় । ৬-দফা দাবি ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র । সে বছর মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে বসল আওয়ামী লীগের বার্ষিক কাউন্সিল সভা। আমরা ৬-দফাকে অন্তর্ভূক্ত করলাম আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টোতে। মার্চের কাউন্সিল অধিবেশনের তৃতীয় ও শেষ দিনে ২০ মার্চ পল্টনে হল আমাদের বিরাট জনসভা। শেখ সাহেব ব্যাখ্যা দিলেন ৬-দফা কর্মসূচির। শুরু হল ৬-দফার আন্দোলন। শেখ সাহেব সফর করলেন সারা বাংলা। সভা করে আমরা প্রচার শুরু করলাম ৬-দফার। কিন্তু এরি মধ্যে শুরু হল আইয়ুব শাহীর মরণছােবল। নেমে আসতে লাগল নির্যাতনের স্টিমরােলার। শেখ সাহেবের বিরুদ্ধে জেলায় জেলায় জনসভার পর দায়ের করা হল মামলা। জামিন নাকচ করে বার বার তাকে করা হল গ্রেফতার। সর্বশেষে ১৯৬৬ সালের ৮ মে তাকে গ্রেফতার করে নেয়া হল সেন্ট্রাল জেলে। তার সাথে গ্রেফতার হলেন জনাব জহুর আহমদ চৌধুরী, খন্দকার মুশতাক আহমদ, জনাব নুরুল ইসলাম, রাজশাহীর মুজিবর রহমান ও আমি (তাজউদ্দিন)। তারপর ধীরে ধীরে গ্রেফতার হতে লাগলেন আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীরা।
শেখ সাহেব ও আওয়ামী লীগের ওপর এই নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠল। বাঙ্গালি জাতি। বজ্র কষ্ঠে তারা দাবি জানালেন তাদের প্রিয় নেতার মুক্তির। কিছু। টনক নড়ল স্বৈরতন্ত্রী শাসকদের। অবশেষে ৭ জুন ডাক দেয়া হল সারা দেশব্যাপী পূর্ণ হরতালের। হরতাল পালিত হল বাংলাদেশের শহরে-বন্দরে, হাটে-গঞ্জে, স্কুলকলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে, গায়ে পাঠশালায়। কলের চাকা সেদিন ঘােরেনি। উঠেনি চিমনীর ঠোয়া। বাজেনি কারখানার ভেঁপু। গাড়ির চাকা বন্ধ। সারা দেশব্যাপী বিক্ষুব্ধ জনতার উত্তাল স্রোত। বন্যার বেগে তারা নেমে আসলেন রাজপথে। অপর দিকে স্বৈরাচারী আইয়ুব-মােনেম খান জারি করলেন ১৪৪ ধারা। তলব করা হল সেনাবাহিনী। কিন্তু বিপ্লবী জনতা কোন বাধাই মানল না। বজ্রমুষ্ঠি তুলে বেরিয়ে আসলেন রাজপথে। বিপ্লবের লাল ঝান্ডা উড়িয়ে শ্রমিকরা নেমে পড়লেন পথে ঘাটে। শুরু হল গুলি। কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ। শহীদ হলেন এগার জন সংগ্রামী বীর। আহত হলেন শত শত। কিন্তু এই নজীরবিহীন নির্যাতনেও ৬-দফার আন্দোলন এগিয়ে চলল, শাসক গােষ্ঠী হয়ে পড়লেন ক্ষেপা কুকুরের মত। তারা সাজালেন মিথ্যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। শেখ সাহেবকে করা হল মামলার এক নম্বর আসামী। কিন্তু তাও টিকেনি। জনতার রুদ্র রােষে তা ভেসে গেল। শেখ সাহেবকে সম্মানে মুক্ত করে দেওয়া হল। তারপর নির্বাচন। সবশেষে শুরু হল স্বাধীনতার সংগ্রাম। জনাব তাজউদ্দিন বললেন, ৭ জুনকে এক অর্থে বলা যায় ৬-দফার দিবস। এই দিনে ৬-দফার দাবিতে বাঙ্গালি রক্ত দিতে শুরু করে। স্বাধিকারের এই আন্দোলনই ধাপে ধাপে রক্ত নদী পেরিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে গিয়ে শেষ হয়েছে। কাজেই বাঙ্গালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামে ৭ জুন অমর। অবিস্মরণীয় এক ঐতিহাসিক দিন ৭ জুন।
সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ-ইতিহাসের পাতা থেকে – সিমিন হোসেন রিমি