You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.24 | দৈনিক পূর্বদেশ-প্রশাসনিক কর্মচারিদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান - সংগ্রামের নোটবুক

ডিসেম্বর ২৪, ১৯৭১ শুক্রবার ঃ দৈনিক পূর্বদেশ

প্রশাসনিক কর্মচারিদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান ঃ ঢাকা, ২৩ ডিসেম্বর (এপিবি)। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ প্রশাসন কাজে নিয়ােজিত ব্যক্তিদের মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির সম্পূর্ণ ও দ্রুত পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়েছেন এবং একজন সৈনিকের মত দেশের পুনর্গঠন কাজে আত্মনিয়ােগ করার উপদেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট প্রাঙ্গণে সরকারী কর্মচারিদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করছিলেন। সেখানে মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্যও উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন যে, বাংলাদেশ একটি বিপ্লবী জাতি এবং যারা প্রশাসন কাজে নিয়ােজিত আছেন তাদের বৈপ্লবিক চেতনা নিয়ে কাজ করে যেতে হবে এবং পুরানাে দৃষ্টিভঙ্গি ত্যাগ করতে হবে। লাল ফিতার দৌরাত্ম্য শেষ হয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। প্রধানমন্ত্রী তার ৫৫ মিনিটব্যাপী বক্তৃতায় জনগণ বিশেষ করে সরকারী কর্মচারিদের জাতি গঠন কাজের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। সরকারের নীতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন যে, বাংলাদেশে শশাষণমুক্ত ন্যায় বিচার, শান্তি ও ঐক্যবদ্ধ সমাজ প্রতিষ্ঠা করা হবে। সশস্ত্র বিপ্লব ঃ জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেন যে, একটি জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য একটি শাসনতান্ত্রিক সংগ্রাম সশস্ত্র বিপ্লবে রূপান্তরিত হয়। ফলে ২৫ মার্চের সেই দুর্যোগপূর্ণ রাতে পাকিস্তানী সৈন্যরা অসংখ্য নিরস্ত্র শান্তিপ্রিয় নাগরিককে নৃশংসভাবে হত্যা করে।

আমাদের ছেলেরা যারা খেলনা বন্দুক চিনত তারা মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে শত্রুর উপর ঝাপিয়ে পড়ে। প্রধানমন্ত্রী কর্মচারিদের সতর্ক করে দিয়ে বলেন যে, দেশের ছেলেদের বিপ্লবী চেতনা সম্পর্কে হুঁশিয়ার না থাকলে তারা যে কোন সময় নির্মূল হতে পারেন। জনাব তাজউদ্দিন তার পরিষদের অন্যান্য সদস্য নিয়ে কর্মচারিদের মধ্যে উপস্থিত হলে। কর্মচারিগণ ‘জয় বাংলা’, ‘বঙ্গবন্ধু জিন্দাবাদ’ ধ্বনিতে তাদের সংবর্ধনা জানান। প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতায় ভারত, সােভিয়েট ইউনিয়ন ও ভুটানের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, জাতি গঠনের কাজে শান্তির প্রয়ােজন এবং স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধের প্রয়ােজন। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। স্বাধীনতা ও ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণ তাদের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। এখন দেশ থেকে সকল প্রকার শোষণ দূর করতে হবে। সহযােগিতা কামনা ঃ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সকল শ্রেণীর মানুষের সহযােগিতা কামনা করেন। তিনি বলেন, শােষণ ও অত্যাচার মুক্ত একটি স্বাধীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে হবে। শ্রমের মর্যাদা দিতে হবে। কৃষকগণ যাতে কৃষিজাত দ্রব্যের ন্যায্য অংশ পায় তার দিকে নজর রাখতে হবে।

তিনি বলেন যে, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। দেশের ভবিষ্যৎ বংশধরগণ যাতে সত্যিকার নাগরিক হতে পারে, সে রকম শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, ধর্মের নামে কাউকে রাজনীতি করতে দেয়া হবে না, এটা একটি ধর্ম-নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্ম-নিরপেক্ষতার অর্থ এই নয় যে, দেশে ধর্ম থাকবে না। ভারতকে ধন্যবাদ । বাঙ্গালিদের সাহায্য ও সমর্থন জানানাের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ও ভারতের জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়ে জনাব তাজউদ্দিন বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এখন কোথায়, কেমন আছে, তা কেউ জানে না। স্বাধীনতার জন্য আমরা যে আত্মত্যাগের পরিচয় দিয়েছি তার তুলনা ইতিহাসে নেই। তিনি বলেন যে, পশ্চিম-পাকিস্তান শুধু বাংলাদেশকে শােষণ করেনি, তারা বাঙ্গালি জাতিকে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল। সকলের সাড়া ঃ তিনি বলেন যে, দখলদার সৈন্যদের প্রতিরােধ করার জন্য ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু জনগণের প্রতি যে আহ্বান জানান দেশের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা তাতে সাড়া দেয়। জনগণ জীবন দিয়েছে। কিন্তু শক্রর কাছে মাথা নত করেনি। জনাব আহমদ বলেন, বর্বর পাকিস্তানী সৈন্যরা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করেছিল। ভারতের দোষ সে ছিন্নমূল বাঙ্গালিদের আশ্রয় দিয়েছিল।

মাত্র ১৪ দিনের যুদ্ধ ঃ তিনি বলেন, মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী মাত্র ১৪ দিনের যুদ্ধে বাংলাদেশকে মুক্ত করে ফেলেন। বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে তিনি ঘােষণা করেন, সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালি পারস্পরিক স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে চিরদিন ভারতের বন্ধু হয়ে থাকবে। দেশে পুনর্গঠনের কাজে ভারতের সমর্থন ও সাহায্য পাওয়া যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। জনাব আহমদ বলেন যে, সকল অত্যাচারিত জনগণ স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করতে পারবেন। দেশের লাখাে লাখাে জীবনের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। এই রক্ত বৃথা যেতে দেওয়া হবে না। পুনর্বাসনের ব্যবস্থা ও পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে অত্যাচারিত হয়ে যে সব ছিন্নমূল মানুষ ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন তাদের পুনর্বাসনের কাজে সহযােগিতা করার জন্য প্রধানমন্ত্রী সরকারী কর্মচারিদের প্রতি আহ্বান জানান। দু’মাসের মধ্যেই উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন করতে হবে। এ ব্যাপারে কোন শৈথিল্য বরদাস্ত করা হবে না বলে তিনি সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন। বীরাঙ্গনা ও বর্বর দখলদার সৈন্যদের হাতে বাংলাদেশের যে সব মহিলা নানাভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন তাদের পূর্ণ মর্যাদা ও সম্মানের সাথে সমাজে প্রতিষ্ঠা করা হবে। যে মুক্তিযােদ্ধা স্বাধীনতার সগ্রামে জীবন দিয়েছেন তাদের পরিবারবর্গের প্রতি সরকারের দায়িত্ব রয়েছে বলে তিনি জানান।

আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ও বন্ধুদেশ ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ভাঙ্গন সৃষ্টির জন্য। আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের প্রতি হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন যে, বাংলাদেশ গ্রাস করার কোন উদ্দেশ্য যদি ভারতের থাকত তাহলে ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিত সপ্তম নৌবহর ঃ বঙ্গোপসাগরে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের উপস্থিতির উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, সপ্তম নৌবহর মৎস্য শিকার কিংবা প্রমােদ ভ্রমণে এখানে আসেনি। বর্বর পাক সৈন্যরা যখন নিরীহ বাঙ্গালি হত্যায় মত্ত ছিল তখন সপ্তম নৌবহর আমাদের উদ্ধারের জন্য আসেনি। এসেছে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের মুখে। সােভিয়েট ইউনিয়নকে ধন্যবাদ আমাদের বিপদের দিনে সােভিয়েট ইউনিয়ন যে মহান ভূমিকা পালন করেছে প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, আমাদের সেই দুঃসময়ে যখন সবাই চুপ করে ছিলেন, তখন। সােভিয়েট প্রেসিডেন্টই সর্বপ্রথম প্রকাশ্যে আমাদেরকে সমর্থন করেন এবং স্পষ্টভাষায় বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি করেন। সােভিয়েট জনগণও আমাদের স্বার্থ এবং ন্যায়সঙ্গত সংগ্রাম সমর্থন করেন। সােভিয়েট ইউনিয়ন নিরাপত্তা পরিষদে তিনবার ভেটো ক্ষমতা প্রয়ােগ না করলে মার্কিনি চালই হয়ত জয়যুক্ত হত। আমরা ক্ষুদ্র জাতি হতে পারি তবে স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আমরা যে কোন সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে পারি। সােভিয়েট ইউনিয়নকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, সােভিয়েট ইউনিয়ন আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় সমর্থন দিয়েছে এবং সােভিয়েট ইউনয়ন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন রক্ষার চেষ্টা করেছে। তিনি। পােল্যান্ডেরও প্রশংসা করেন। চীন প্রসঙ্গে চীনের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ আশা প্রকাশ করেন যে, চীনের জনগণ তাদের নেতৃবৃন্দকে সঠিকপথে পরিচালিত করবে এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে। ক্ষমা করা হবে না।

তিনি আরাে বলেন যে, যারা শত্রু সৈন্যদের ইচ্ছাকৃতভাবে সহযােগিতা করেছে তাদের ক্ষমা করা হবে না। তাদের যুদ্ধবন্দি হিসাবে বিচার করা হবে। তিনি আইন স্বহস্তে গ্রহণ না করার জন্য জনগণকে উপদেশ দেন। অফিসে যােগদান ঃ অপর এক খবরে প্রকাশ, প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ ও তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্যগণ আগামীকাল থেকে বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েটে তাদের নিজ নিজ অফিসে বসবেন। অপরাধীদের বিচার করে শাস্তি দেওয়া হবে : ঢাকা, ২৩ ডিসেম্বর (এপিবি)। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ আজ এক ঘােষণায় বলেন যে, সরকার কোন প্রকার পাইকারি ব্যবস্থা নিবেন না, তবে যে সমস্ত দালাল স্বাধীনতা সংগ্রামে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে এবং বাঙ্গালি হত্যায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সহায়তাকরেছে তাদের বিচার করা হবে এবং শাস্তি দেওয়া হবে। বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েটে সরকারী কর্মচারিদের উদ্দেশ্যে এক ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, যে সকল লােক বাঙ্গালি হত্যাযজ্ঞে পাকিস্তানী দস্যুদের সহযােগিতা করেছে তাদেরকে অবশ্যই আইনের সামনে দন্ডায়মান হতে হবে। দালাল গােষ্ঠী, সে বাঙ্গালি বা অবাঙ্গালি যেই হােক না কেন রেহাই পাবে না। প্রধানমন্ত্রী আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন যে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করাই ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনের একমাত্র ব্রত। প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, বঙ্গবন্ধু এখনও পাকিস্তানের কারাগারে অন্তরীণ। বাংলাদেশে বসবাসকারী বাঙ্গালি বা অবাঙ্গালি সবাই এ দেশের সমপর্যায়ের নাগরিক।

সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ-ইতিহাসের পাতা থেকে – সিমিন হোসেন রিমি