You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.20 | দৈনিক ইত্তেফাক-আবহাওয়া দফতরের প্রতি নির্দেশ - সংগ্রামের নোটবুক

মার্চ ২০, ১৯৭১ শনিবার ঃ দৈনিক ইত্তেফাক

আবহাওয়া দফতরের প্রতি নির্দেশ ঃ পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দিন আহমদ গতকাল (শুক্রবার) এক বিবৃতিতে আবহাওয়া দফতরকে অবিলম্বে পুরাদমে কাজ শুরু করার নির্দেশ দান করেন। এ.পি.পি,।বাংলাদেশবাসীর উদ্দেশ্যে ঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদের বেতার ভাষণ (স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হতে এপ্রিল ১১, ১৯৭১ তারিখে প্রচারিত) স্বাধীন বাংলাদেশের বীর ভাই-বােনেরা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মুক্তিপাগল গণ-মানুসের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সরকারের পক্ষ থেকে আমি আপনাদেরকে আমার সংগ্রামী অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি তাদের যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে গিয়ে তাদের মূল্যবান জীবন আহুতি দিয়েছেন। যতদিন বাংলার আকাশে চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা রইবে, যতদিন বাংলার মাটিতে মানুষ থাকবে, ততদিন মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামের বীর শহীদদের অমর স্মৃতি বাঙ্গালির মানসপটে চির অম্লান থাকবে। ২৫ মার্চ মাঝরাতে ইয়াহিয়া খান তার রক্তলােলুপ সাঁজোয়া বাহিনীকে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর লেলিয়ে দিয়ে যে নর-হত্যাযজ্ঞের শুরু করেন তা প্রতিরােধ করবার আহ্বান জানিয়ে আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। আপনারা সব কালের সব দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী মানুষের সাথে আজ একাত্ম।

পশ্চিম-পাকিস্তানী হানাদার দস্যুবাহিনীর বিরুদ্ধে যে প্রতিরােধ আপনারা গড়ে তুলেছেন তা এমন এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। যে, পৃথিবীর সমস্ত স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে আপনাদের এ অভূতপূর্ব সংগ্রাম সর্বকালের প্রেরণার উৎস হয়ে রইল। প্রত্যেকদিনের সংগ্রামের দিনপঞ্জি আমাদের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করছে, বিশ্বের কাছে আমাদের গৌরব বৃদ্ধি করছে। আপনাদের অদম্য সাহস ও মনােবল, যা দিয়ে আপনারা রুখে দাঁড়িয়েছেন ইয়াহিয়ার ভাড়াটে দস্যুদের বিরুদ্ধে, তার মধ্য দিয়ে আপনারা এইটেই প্রমাণ করেছেন যে, যুদ্ধক্ষেত্ৰাস্তীর্ণ ধ্বংসাবশেষের মধ্য দিয়ে ধূলি-কাদা আর রক্তের ছাপ। মুছে এক নতুন বাঙ্গালি জাতি জন্ম নিল। পৃথিবীর কাছে আমরা ছিলাম শান্তিপ্রিয় মানুষ। বন্ধু-বাৎসল্যে, মায়া ও হাসিকান্নায়, গান, সংস্কৃতি আর সৌন্দর্য্যের ছায়ায় গড়ে ওঠা আমরা ছিলাম পল্লী-বাংলার মানুষ। পৃথিবী ভাবত, আমরাও ভাবতাম, যুদ্ধ রণডংকা আমাদের থেকে অনেক দূরে। কিন্তু আজ ? আমাদের মানবিক মূলবােধ ও আদর্শের পতাকা সমুন্নত রেখে আমরা আবার প্রমাণ করেছি যে, আমরা তিতুমীর-সূর্য সেনের বংশধর। স্বাধীনতার জন্যে যেমন আমরা | জীবন দিতে পারি, তেমনি আমাদের দেশ থেকে বিদেশী শত্রু-সৈন্যদের চিরতরে হটিয়ে দিতেও আমরা সক্ষম।

আমাদের অদম্য সাহস ও মনোেবলের কাছে শত্রু যত প্রবল পরাক্রম হােক না কেন, পরাজয় বরণ করতে বাধ্য। আমরা যদি প্রথম আঘাত প্রতিহত করতে ব্যর্থ হতাম তাহলে নতুন স্বাধীন প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হয়ত কিছুদিনের জন্যে হলেও পিছিয়ে যেত। আপনারা শত্রুসেনাদের ট্যাঙ্ক ও বােমারু বিমানের মােকাবেলা করেছেন এবং আপনাদের যার হাতে যে অস্ত্র ছিল তাই নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছেন এবং তাদেরকে পিছু হটে গিয়ে নিজ শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছেন। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ মুক্ত। বৈদেশিক সাংবাদিকরা আজ স্বাধীন বাংলাদেশের যে কোন জায়গায় বিনা বাধায় ঘুরে বেড়াতে পারেন এবং আপনাদের এ বিজয়ের কথা তারা বাইরের জগৎকে জানাচ্ছেন। আজ প্রতিরােধ আন্দোলনের কথা গ্রাম-বাংলার প্রতিটি ঘরে পৌঁছে গেছে। হাজার হাজার মানুষ আজকের এই স্বাধীনতা সংগ্রামে যােগ দিয়েছেন। বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ই.পি.আর.-এর বীর বাঙ্গালি যােদ্ধারা এই স্বাধীনতা সংগ্রামের যে যুদ্ধ তার পুরােভাগে রয়েছেন এবং তাদেরকে কেন্দ্র করে পুলিশ, আনসার, মােজাহিদ, আওয়ামী লীগ, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, ছাত্র, শ্রমিক ও অন্যান্য হাজার হাজার সগ্রামী মানুষ এই যুদ্ধে যােগ দিয়েছেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে এদেরকে সমর কৌশলে পারদশী করা হয়েছে ও শক্রদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া অস্ত্র ও গােলা-বারুদ দিয়ে বাংলার এ মুক্তিবাহিনীকে শক্রদের মােকাবেলা করার জন্যে প্রস্তুত করা হয়েছে। সাগরপারের বাঙ্গালি ভাইয়েরা যে যেখানে আছেন আমাদেরকে অস্ত্র ও অন্যান্য সাহায্য পাঠাচ্ছেন। সিলেট ও কুমিল্লা অঞ্চলে বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর খালেদ মােশাররফকে আমরা সমর পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছি। খালেদ মােশাররফের নেতৃত্বে আমাদের মুক্তিবাহিনী অসীম সাহস ও কৃতিত্বের সাথে শত্রুর সংগে মােকাবেলা করেছেন এবং শত্রু সেনাদেরকে সিলেট ও কুমিল্লার ক্যান্টনমেন্টের ছাউনিতে ফিরে যেতে বাধ্য করেছেন।

আমাদের মুক্তিবাহিনী শীঘ্রই শত্রুকে নিঃশেষ করে দেবার সংকল্প গ্রহণ করেছে। চট্টগ্রাম ও নােয়াখালি অঞ্চলে সমর পরিচালনার ভার পড়েছে মেজর জিয়াউর রহমানের ওপর। নৌ, স্থল ও বিমান বাহিনীর আক্রমণের মুখে চট্টগ্রাম শহরে যে প্রতিরােধব্যুহ গড়ে উঠেছে এবং আমাদের মুক্তিবাহিনী ও বীর চট্টলের ভাইবােনেরা যে সাহসিকতার সাথে শত্রুকে মােকাবেলা করেছেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই প্রতিরােধ স্ট্যালিনগ্রাডের পাশে স্থান পাবে। এই সাহসিকতাপূর্ণ প্রতিরােধের জন্য চট্টগ্রাম আজও শক্রর কবলমুক্ত রয়েছে। চট্টগ্রাম শহরের কিছু অংশ ছাড়া চট্টগ্রাম ও সম্পূর্ণ নােয়াখালি জেলাকে “মুক্ত এলাকা” বলে ঘােষণা করা হয়েছে। ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল অঞ্চলের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে মেজর শফিউল্লাহর ওপর। ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল এলাকা সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করে আমাদের মুক্তিবাহিনী ঢাকার | দিকে অগ্রসর হবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পূর্বাঞ্চলের এই তিনজন বীর সমর পরিচালক।

ইতােমধ্যে বৈঠকে মিলিত হয়েছেন এবং একযােগে ঢাকা রওনা হবার পূর্বেই পূর্বাঞ্চলের শত্রুদের ছােট ছােট শিবিরগুলােকে সমূলে নিপাত করবার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে ই.পি.আর.-এর বীর সেনানী মেজর ওসমানের ওপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে কুষ্টিয়া ও যশাের জেলার। কুষ্টিয়ার ঐতিহাসিক বিজয়ের পর আমাদের মুক্তিবাহিনী সমস্ত এলাকা থেকে শত্রুবাহিনীকে বিতাড়িত করেছে এবং শক্রসেনা এখন যশাের ক্যান্টনমন্টে ও খুলনা শহরের একাংশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। মেজর জলিলের ওপর ভার দেওয়া হয়েছে ফরিদপুর-খুলনা-বরিশালপটুয়াখালির। উত্তরবঙ্গে আমাদের মুক্তিবাহিনী মেজর আহমদের নেতৃত্বে রাজশাহীকে শত্রুর কবল থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করেছেন। মেজর নজরুল হক সৈয়দপুরে ও মেজর নওয়াজেশ রংপুরে শত্রুবাহিনীকে সম্পূর্ণ অবরােধ করে ব্ৰিত করে তুলেছেন। দিনাজপুর, পাবনা ও বগুড়া জেলাকে সম্পূর্ণ মুক্ত করা হয়েছে। রংপুর ও সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট এলাকা ছাড়া জেলার বাকি অংশ এখন মুক্ত। স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের এ অভূতপূর্ব সাফল্য ভবিষ্যতে আরও নতুন সাফল্যের দিশারী। প্রতিদিন আমাদের মুক্তিবাহিনীর শক্তি বেড়ে চলেছে। একদিকে যেমন হাজার হাজার মানুষ মুক্তিবাহিনীতে যােগ দিচ্ছে তেমনি শত্রুর আত্মসমর্পণের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। আর একই সংগে আমাদের নিয়ন্ত্রণে আসছে শত্রুর কেড়ে নেয়া হাতিয়ার। এই প্রাথমিক বিজয়ের সাথে সাথে মেজর জিয়াউর রহমান একটি বেতার কেন্দ্র গড়ে তােলেন এবং সেখান থেকে আপনারা শুনতে পান স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কণ্ঠস্বর। এখানেই প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের কথা ঘােষণা করা হয়। আপাততঃ আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধান কার্যালয় স্থাপিত হয়েছে।

দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মুক্ত এলাকায়। পূর্বাঞ্চলের সরকারী কাজ পরিচালনার জন্যে সিলেট-কুমিল্লা এলাকায় বাংলাদেশ সরকারের আর একটি কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। আমরা এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্রের প্রতিনিধি, কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি, তারা যেন স্বচক্ষে এবং সরেজমিনে দেখে যান যে স্বাধীন বাংলাদেশ আজ সত্যে পরিণত হয়েছে। সাথে সাথে আমরা সমস্ত বন্ধু রাষ্ট্র ও পৃথিবীর সমস্ত সহানুভূতিশীল ও মুক্তিকামী মানুষের মানুষের কাছে ও ‘রেডক্রস’ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে সাহায্যের আহ্বান জানাচ্ছি। যারা আমাদের সাহায্য করতে ইচ্ছুক অথচ বর্বর ইসলামাবাদ শক্তি যাদের এই মানবিক কাজটুকু করবার বিরুদ্ধে নিষেধ উঁচিয়ে দাড়িয়েছে তারা এখন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের সাথে সরাসরি যােগাযােগ স্থাপন করতে পারেন।আমরা যদিও বিদেশ থেকে পাঠানাে ত্রাণ-সামগ্রীর জন্যে কৃতজ্ঞ, কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, আজকের দিনে বাংলাদেশের জন্যে সবচেয়ে বড় ত্রাণের বাণী বয়ে আনতে পারে উপযুক্ত এবং পর্যাপ্ত হাতিয়ার, যা দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ হানাদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে এবং রক্ষা করতে পারে তার ও তার প্রিয় পরিজনের জান, মান আর ভ্রম। বৃহৎ শক্তিবর্গের অস্ত্রাগারের আধুনিক সরঞ্জামে সজ্জিত জেনারেল ইয়াহিয়ার হানাদার বাহিনী আজ আমাদের শান্তিপ্রিয় ও নিরস্ত্র বাঙ্গালির কষ্ঠ স্তব্ধ করে দেয়ার এক পৈশাচিক উন্মত্ততায় মত্ত। আমরা সেইসব বৃহৎ শক্তিবর্গের কাছে মানবতার নামে আবেদন জানাচ্ছি, যেন এই হত্যাকারীদের হাতে আর অস্ত্র সরবরাহ করা না হয়। এ সমস্ত অস্ত্র দেয়া হয়েছিল বিদেশী শত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্যে-বাংলার নিস্পাপ শিশুদেরকে ও নিরপরাধ নর-নারীকে নির্বিচারে হত্যা করার জন্যে নিশ্চয়ই এ অস্ত্র তাদের হাতে তুলে দেয়া হয়নি। বাংলাদেশের কৃষকশ্রমিকের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে যে অস্ত্র কেনা হয়েছে এবং যাদের টাকায় ইয়াহিয়া খানের এই দস্যুবাহিনী পুষ্ট, আজ তাদেরকেই নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে।

আমরা অস্ত্র সরবরাহকারী শক্তিবর্গের কাছে আবেদন জানাচ্ছি যে, শধু অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করলেই চলবে না, যে অস্ত্র তাদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে সে অস্ত্র দিয়ে সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালিকে স্তব্ধ করে দেয়ার প্রয়াস বন্ধ করতে হবে। পৃথিবীর জনমতকে উপেক্ষা করে আজও ইয়াহিয়ার ভাড়াটে দস্যুরা বাংলাদেশের বুকে নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই আমরা সমস্ত দেশের কাছে অস্ত্র সাহায্য চাচ্ছি এবং যারা জাতীয় জীবনে স্বাধীনতাকে সর্বোচ্চ মূল্য দিয়ে এসেছেন ও নিজেদের দেশেও হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন তারা আমাদের এ ডাকে সাড়া না দিয়ে পারবে না, এ বিশ্বাস আমরা রাখি। বিদেশী বন্ধু রাষ্ট্রসমূহের কাছে যে অস্ত্র সাহায্য আমরা চাইছি তা আমরা চাইছি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে,-একটি স্বাধীন দেশের মানুষ আর একটি স্বাধীন দেশের মানুষের কাছে। এই সাহায্য আমরা চাই শর্তহীনভাবে এবং আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামের প্রতি তাদের শুভেচ্ছা ও সহানুভূতির প্রতীক হিসেবে,-হানাদারদের রুখে দাঁড়াবার এবং আত্মরক্ষার অধিকার হিসেবে, যে অধিকার মানবজাতির শাশ্বত অধিকার। বহু বছরের সংগ্রাম, ত্যাগ ও তিতিক্ষার বিনিময়ে আমরা আজ স্বাধীন বাংলাদেশের পত্তন করেছি। স্বাধীনতার জন্যে যে মূল্য আমরা দিয়েছি তা কোন বিদেশী রাষ্ট্রের উপ-রাষ্ট্র হবার জন্যে নয়। পৃথিবীর বুকে স্বাধীন সার্বভৌম একটি শান্তিকামী দেশ হিসাবে রাষ্ট্র পরিবারগােষ্ঠীতে উপযুক্ত স্থান আমাদের প্রাপ্য। এ অধিকার বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্মগত অধিকার।

আমাদের বাঙ্গালি ভাইয়েরা, আপনারা পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে থাকুন না কেন, আজকে মাতৃভূমির এই দুর্দিনে সকল প্রকার সাহায্য নিয়ে আপনাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। বিদেশ থেকে অর্থসংগ্রহ করে অস্ত্র কিনে আমাদের মুক্ত এলাকায় পাঠিয়ে দিন, যাতে করে আমাদের মুক্তিবাহিনীর সৈনিকরা অতি সত্বর সে অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে তার মাতৃভূমিকে রক্ষা করবার কাজে। ইতােমধ্যেই আমাদের বাংলাদেশের ঘরে ঘরে প্রত্যেকেই নিজেদের হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছেন। যাদের হাতে আজও আমরা আধুনিক অস্ত্র তুলে দিতে পারিনি তাদের আহবান জানাচ্ছি, যার হাতে যা আছে তাই নিয়ে লড়াইয়ে অংশ নিন। আমাদের স্থির বিশ্বাস যে, শীঘ্রই আপনাদের হাতে আমরা আধুনিক অস্ত্র তুলে দিতে পারব। ইতােমধ্যে প্রত্যেকে আধুনিক অস্ত্র ব্যবহারের ট্রেনিং নেবার জন্যে নিকটবর্তী সংগ্রাম পরিষদের সংগে যােগাযােগ করুন। যাদের হাতে আধুনিক অস্ত্র নেই। তাদেরও এই জনযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এবং ক্ষমতা রয়েছে। শক্রর ছত্রী ও গুপ্তবাহিনীকে অকেজো করে দেবার কাজে আপনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে পারেন। সম্মুখসমরে কাজ না করতে পারলেও আপনি রাস্তা কেটে, পুল উড়িয়ে দিয়ে এবং আরাে নানাভাবে আপনার উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে শক্রকে হয়রান ও কাবু করতে পারেন। নদীপথে শত্রু যাতে না আসতে পারে তার সম্ভাব্য সমস্ত ব্যবস্থা আপনাকেই গ্রহণ করতে হবে ও সবদিকে কড়া দৃষ্টি রাখতে হবে। নদীপথে সমস্ত ফেরি, লঞ্চ ও ফ্ল্যাট অকেজো করে দিতে হবে। এ সমস্ত দায়িত্ব পালন করার জন্যে স্থানীয় সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ছােট ছােট দলে সংগঠিত হতে হবে। এর জন্যে আপনার এলাকার সমর পরিচালকের সাথে সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে যােগাযােগ করতে হবে এবং তার আদেশ ও নির্দেশাবলী মেনে চলতে হবে। যুদ্ধে অংশ নেয়া ছাড়াও বাংলাদেশকে সব দিক দিয়ে বাঁচিয়ে রাখবার দায়িত্বকেও অবহেলা করলে চলবে না। শাসনকার্যে অভিজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট বাঙ্গালি অফিসারদের মধ্যে যারা এখনও আমাদের সাথে যােগ দিতে পারেননি, তারা যে যেখানেই থাকুন। কেন, আমরা তাদেরকে মুক্ত এলাকায় চলে আসতে আহ্বান জানাচ্ছি। অনুরূপভাবে আমরা আহ্বান জানাচ্ছি সমস্ত বুদ্ধিজীবী, টেকনিসিয়ান, ইনজিনিয়ার, সংবাদপত্রসেবী, বেতার শিল্পী, গায়ক ও চারুশিল্পীদের, তারা যেন অনতিবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। আমাদের সামনে বহুবিধ কাজ তার জন্যে বহু পারদর্শীর প্রয়ােজন এবং আপনারা প্রত্যেকেই স্বাধীন বাংলাদেশের সেবায় আত্মনিয়ােগ করবার সুযােগ পাবেন। আমরা বিশেষ করে সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতাদেরকে বাংলাদেশের এই সংঘবদ্ধ জনযুদ্ধে সামিল হতে আহ্বান জানাচ্ছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে সাড়ে সাত কোটি মানুষের এই ঐতিহাসিক প্রতিরােধ ও প্রতিরক্ষা আন্দোলনকে চিরাচরিত রাজনৈতিক গন্ডির উর্ধে রাখবার জন্যে আমরা আবেদন জানাচ্ছি। হানাদার শত্রুবাহিনীর সাথে কোন প্রকার সহযােগিতা করা বা সংশ্রব রাখা চলবে ।

বাংলাদেশে আজ কোন মীরজাফরের স্থান নেই। যদি কেউ হঠাৎ করে নেতা সেজে শত্রু সৈন্যের ছত্রছায়ায় রাজনৈতিক গাের থেকে গাত্রোখান করতে চায়, যাদেরকে গত সাধারণ নির্বাচনে বাংলার মানুষ ঘৃণ্যভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে, তারা যদি এই সুযােগে বাংলাদেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে, বাংলাদেশের স্বার্থবিরােধী কার্যকলাপে লিপ্ত হয়, তবে বাংলাদেশের মানুষ তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে, তারা সাড়ে সাত কোটি বাংলাদেশবাসীর রােষবহ্নিতে জ্বলে খাক হয়ে যাবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আমাদের দেশের উপর একটা যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাজেই স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হতে বাধ্য। হয়ত কোথাও নিত্য প্রয়ােজনীয় জিনিসের ঘাটতি দেখা যেতে পারে। আমাদের উচিত হবে যতদূর সম্ভব ব্যয়সংকোচ করা এবং জিনিসপত্র কম ব্যবহার করা। দোকানদার ও ব্যবসায়ীদের কাছে বিশেষ অনুরােধ তারা যেন মজুতদারি ও কালােবাজারির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন এবং জিনিসপত্রের দাম যাতে সাধারণ লােকের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে না যায় তার দিকে দৃষ্টি রাখেন। এ যুদ্ধে যে আমাদের জয় অবশ্যম্ভাবী তাতে সন্দেহের কারণ নেই। আপনারা ইতােমধ্যে সাহস ও ত্যাগের বিনিময়ে যে বিজয় অর্জন করেছেন শত্রুপক্ষ আজকে তা স্পষ্টই বুঝতে পেরেছে। তারা ভেবেছিল যে, আধুনিক সমর সজ্জায় এবং কামানের গর্জনের নীচে স্তব্ধ করে দেবে বাঙ্গালির ভবিষ্যৎ আশা-ভরসা। আর চোখ রাঙিয়ে ভয় দেখিয়ে বাঙ্গালিকে তারা বুটের নীচে নিষ্পেষণ করবে। কিন্তু তাদের সে আশা আজ ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। আমরা তাদের মারমুখী আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে আছি এবং তাদেরকে যে প্রতিনিয়ত হটিয়ে দিচ্ছি এতে তাদের সমস্ত ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে গেছে। তাদের খাদ্য সরবরাহের সকল পথ আজ বন্ধ, ঢাকার সাথে আজ তাদের যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন। উড়ােজাহাজ থেকে খাবার ফেলে এদেরকে ইয়াহিয়া খান আর বেশি দিন টিকিয়ে রাখতে পারবে না। ওদের জ্বালানি সরবরাহের লাইন আমাদের মুক্তিবাহিনী বন্ধ করে দিয়েছে। ইয়াহিয়ার উড়ােজাহাজ আর বেশিদিন বাংলাদেশের আকাশে দেখা যাবে না।

বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি উত্তাল জনসমুদ্রের মাঝখানে ওরা আজকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত। বাংলাদেশের আকাশে শীঘ্রই ঝড়ের মাতন শুরু হচ্ছে। ওরা জানে ওরা হানাদার। ওরা জানে ওদের বিরুদ্ধে পৃথিবীর সমস্ত মানুষের ভ্রুকুটি ও ঘৃণা। ওরা ভীত,-ওরা সন্ত্রস্ত,মৃত্যু ওদের সামনে পরাজয়ের পরােয়ানা নিয়ে হাজির। তাই ওরা উন্মাদের মত ধ্বংসলীলায় মেতে উঠেছে। পৃথিবী আজ সজাগ হয়েছে। পৃথিবীর এই অষ্টম বৃহৎ রাষ্ট্র বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছে বিশ্বের মানুষ যেখানে ওরা এ ধ্বংসের খেলায় মেতে উঠেছে। বিশ্বের মানুষ আজ আর ইসলামাবাদ সরকারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার মিথ্যা যুক্তি আর অজুহাত স্বীকার করে নিতে রাজি নয়। যে সমস্ত সাংবাদিক বাংলাদেশের এই যুদ্ধের ভয়াবহতা ও নৃশংসতা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন তারা ইয়াহিয়ার এই অন্যায় ও অমানবিক যুদ্ধ আর ধ্বংসলীলার বিরুদ্ধে নিন্দা জানাচ্ছেন। অপরপক্ষে যে সমস্ত সাংবাদিক আমাদের মুক্ত এলাকা পরিদর্শন করছেন তারা বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশের মানুষের এই বীর প্রতিরােধ যুদ্ধের খবর আর বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ইয়াহিয়া সরকারের ধ্বংস ও তান্ডবলীলার চাক্ষুষ প্রমাণ। ইতােমধ্যে সােভিয়েট রাশিয়া এবং ভারতবর্ষ এই নির্বিচার গণ-হতার বিরুদ্ধে তাদের হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছে এবং সােভিয়েট রাশিয়া অবিলম্বে এই হত্যাযজ্ঞ ও নিপীড়ন বন্ধ করবার আহবান জানিয়েছে। গ্রেট বৃটেনও বাংলাদেশের এ অবস্থা সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠেছে। যে সমস্ত পাকিস্তানী বিমান মৃত্যুর সরঞ্জাম নিয়ে ঢাকা আসার পথে জ্বালানি সংগ্রহ করছিল, তাদেরকে জ্বালানি সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র সিংহল ও ব্রহ্মদেশ।

যদিও কোন কোন দেশ বাংলাদেশের ঘটনাবলীকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে অভিহিত করেছেন, তবু এ কথা এখন দিব্যলােকের মত সত্য হয়ে গেছে যে, সাড়ে সাত কোটি মানুষকে পিষে মারার চেষ্টা, তাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতাকে ব্যর্থ করে দেবার ষড়যন্ত্র একটি আন্তর্জাতিক ব্যাপারে পরিগণিত হয়েছে এবং এই সমস্যা আজ পৃথিবীর সমস্ত মানুষের বিবেককে নাড়া দিচ্ছে। বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে আমরা বিদেশে অবস্থানরত বাঙ্গালি ভাইদের বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টি ও পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে অনুরােধ জানিয়েছি। পৃথিবীর বিভিন্ন রাজধানীতে আমরা আমাদের প্রতিনিধি পাঠাচ্ছি এবং বিদেশের সমস্ত রাষ্ট্রের কাছে কূটনৈতিক স্বীকৃতি ও আমাদের স্বাধীনতা ও আত্মরক্ষার সংগ্রামে সাহায্য ও সহানুভূতি চেয়ে পাঠাচ্ছি। আমাদের যে সমস্ত ভাইবােন শক্রকবলিত শহরগুলােতে মৃত্যু ও অসম্মানের নাগপাশে আবদ্ধ, আদিম নৃশংসতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সাহস ও বিশ্বাসের সাথে মুক্তির পথ চেয়ে আছেন তাদেরকে আমরা এক মুহূর্তের জন্যে ভুলতে পারি না। যারা আমাদের সংগ্রামে শরিক হতে চান তাদের জন্যে রইল আমাদের আমন্ত্রণ। যাদের পক্ষে নেহাৎই মুক্ত এলাকায় আসা সম্ভব নয় তাদেরকে আমরা আশ্বাস এবং প্রেরণা দিচ্ছি বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের পক্ষ থেকে, শহীদ ভাইবােনদের বিদেহী আত্মার পক্ষ থেকে। শহীদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না।

ইন্শাআল্লাহ্, জয় আমাদের সুনিশ্চিত। আমাদের যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে না বলে আমাদের স্থির বিশ্বাস; কারণ প্রতিদিনই আমাদের শক্তি বৃদ্ধি হচ্ছে এবং আমাদের এ সংগ্রাম পৃথিবীর স্বীকৃতি পাচ্ছে। কিন্তু আমাদের মুক্তিবাহিনীর হাতে শেষ পরাজয় মেনে নেয়ার আগে শত্রুরা আরও অনেক রক্তক্ষয় আর ধ্বংসলীলা সৃষ্টি করবে। তাই পুরাতন পূর্ব-পাকিস্তানের ধ্বংসাবশেষের ওপর নতুন বাংলাদেশ গড়ে তােলবার সংকল্পে আমাদের সবাইকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে। আমাদের এই পবিত্র দায়িত্ব পালনে এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলে গেলে চলবে না যে এ যুদ্ধ গণযুদ্ধ এবং সত্যিকারের অর্থে এ কথাই বলতে হয় যে এ, যুদ্ধ বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের যুদ্ধ। খেটে খাওয়া সাধারণ কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, ছাত্র-জনতা তাদের সাহস, তাদের দেশপ্রেম, তাদের বিশ্বাস, স্বাধীন বাংলাদেশের চিন্তায় তাদের নিমগ্নপ্রাণ, তাদের আত্মাহুতি, তাদের ত্যাগ ও তিতিক্ষায় জন্ম নিল এই নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ। সাড়ে সাত কোটি মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ফলপ্রসু হয়ে উঠুক আমাদের স্বাধীনতার সম্পদ। বাংলাদেশের নিরন্ন দুঃখী মানুষের জন্যে রচিত হােক এক নতুন পৃথিবী, যেখানে মানুষ মানুষকে শশাষণ করবে না। আমাদের প্রতিজ্ঞা হােক ক্ষুধা, রােগ, বেকারত্ব আর অজ্ঞানতার অভিশাপ থেকে মুক্তি। এই পবিত্র দায়িত্বে নিয়ােজিত হােক সাড়ে সাত কোটি বীর বাঙ্গালি ভাইবােনের সম্মিলিত মনােবল ও অসীম শক্তি। যারা আজ রক্ত দিয়ে উর্বর করছে বাংলাদেশের মাটি, যেখানে উকর্ষিত হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন মানুষ, তাদের রক্ত আর ঘামে ভেজা মাটি থেকে গড়ে উঠুক নতুন গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা; গণ-মানসের কল্যাণে সাম্য আর সুবিচারের ভিত্তিপ্রস্তরে লেখা হােক “জয় বাংলা”, “জয় স্বাধীন বাংলাদেশ”।

TAJUDDIN CALLS FOR ARMS AID Text of Mr. Tajuddin Ahmad’s broadcast on April 14, 1971. The Bangladesh Prime Minster, Mr. Tajuddin Ahmad, today invited the world Press and diplomatic and political observers to tour the liberated areas and see for themselves the realities in his free country. In a broadcast over the Swadhin Bangla Betar Kendra Mr. Ahmad, also asked friednly Governments and people as well as international agencies like the Red Cross to establish direct contact with the Bangladesh Government and render help. Laying special emphasis on arms help which was “a permanent need for Bangladesh today”, the Prime Minister said arms were immediately needed to repel the aggressors. He also appealed to countries supplying arms and ammunition to Pakistan to suspend forthwith their supplies to an “army of murderers who were killing innocent men, women and children”

(THE TIMES OF INDIA, New Delhi-April 15. 1971)

এপ্রিল ১৭, ১৯৭১ গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের ভাষণ ঃ

আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের সাংবাদিক বন্ধুদেরকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি এই জন্য যে, তারা আমাদের আমন্ত্রণে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি দেখে যাবার জন্য বহু কষ্ট করে, বহু দূর-দূরান্ত থেকে এখানে উপস্থিত হয়েছেন।

আমি কিছু বলবার আগে প্রথমেই বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি আমাদের সংবাদপত্রসেবী এবং নিউজ এজেন্সির প্রতিনিধিদেরকে যে, তারা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে আগাগােড়া সমর্থন দিয়ে গিয়েছেন এবং সত্য কথা প্রকাশ করতে চেষ্টা করেছেন। যদিও ইয়াহিয়া সরকার তাদেরকে এবং তার সেই দস্যু বাহিনী বিদেশী সাংবাদিকদেরকে ভেতরে আসতে দেয়নি, যারা ভেতরে ছিলেন তাদেরকেও জবরদস্তি করে ২৫ তারিখ রাতেই বের করে দিয়েছেন। আমি আপনাদেরকে আরাে ধন্যবাদ দিচ্ছি, আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি এই জন্য যে, আমার বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের যে সংগ্রাম, স্বাধীনতা সংগ্রাম, সেই সংগ্রাম কোন অবস্থাতেই যাতে ব্যাহত না হয় এবং কোন অবস্থাতেই সে সংগ্রামকে ভুল ব্যাখা দেয়া হয় সে জন্য আপনারা আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন, সঠিক পথ দেখিয়েছেন। আমি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের পক্ষ থেকে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে আবেদন জানাবাে ভবিষ্যতেও আপনারা দয়া করে চেষ্টা করবেন যাতে সঠিক সংবাদ পরিবেশিত হয়, যাতে কোন দুষ্কৃতকারি বা কোন শত্রু বা এজেন্ট ভুল ব্যাখা দিয়ে আমাদের আন্দোলনের কোন রকম ভুল ব্যাখা করতে না পারে, ভুল বােঝাতে না পারে। সেই সাথে আমি আপনাদেরকে আরাে অনুরােধ জানাব আমাদের বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে যে হ্যান্ড আউট যাবে সেটাকেই বাংলাদেশ সরকারের সঠিক ভাষ্য বলে ধরে নেবেন, সেটাকেইে ভিত্তি হিসেবে ধরে নেবেন। আর আমি আপনাদেরকে আরাে একটি অনুরােধ জানাব জানি না কিভাবে সেটা সম্ভব হবে, আমাদের বাংলাদেশের মাটি থেকে আপনারা কিভাবে সংবাদ সংগ্রহ করতে পারবেন, কিভাবে বাংলাদেশ সরকারের সাথে লিয়াজো করতে পারেন সেই ব্যাপার আপনারা চিন্তা করে দেখবেন এবং সেই ব্যাপারে আপনাদের পরামর্শ আমরা অত্যন্ত সাদরে, আনন্দের সাথে গ্রহণ করব। এখন আমি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আমার ভাষ্য তুলে ধরব। “বাংলাদেশ এখন যুদ্ধে লিপ্ত। পাকিস্তানের ঔপনিবেশবাদী নিপীড়নের বিরুদ্ধে।

জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে আত্ম-নিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জন ছাড়া আমাদের হাতে আর কোনও বিকল্প নেই। বাংলাদেশে গণ-হত্যার আসল ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়ার লক্ষ্যে পাকিস্তান সরকারের অপপ্রচারের মুখে বিশ্ববাসীকে অবশ্যই জানাতে হবে কিভাবে বাংলার শান্তিকামী মানুষ সশস্ত্র সংগ্রামের পরিবর্তে সংসদীয় পদ্ধতিকেই বেছে নিয়েছিল। তবেই তারা বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত আশা আকাংখাকে সত্যিকারভাবে উপলদ্ধি। করতে পারবেন। পাকিস্তানের জাতীয় সংহতি রক্ষার শেষ চেষ্টা হিসেবে আওয়ামী লীগ পূর্ণ। আন্তরিকতার সাথে ৬-দফার আলােকে বাংলাদেশের জন্য স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিলেন। ১৯৭০-এ আওয়ামী লীগ এই ৬-দফা নির্বাচনী ইশতেহারের ভিত্তিতেই পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের মােট ৩১৩টি আসনের মধ্যে বাংলাদেশের জন্য বরাদ্দ ১৬৯টি আসনের মধ্যে মােট ১৬৭টি আসন লাভ করেছিল। নির্বাচনী বিজয় এতই চূড়ান্ত ছিল যে, আওয়ামী লীগ মােট শতকরা আশিটি ভােট পেয়েছিল। এই বিজয়ের চূড়ান্ত রায়েই আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। স্বভাবতঃই নির্বাচন পরবর্তী সময়টি ছিল আমাদের জন্য এক আশাময় দিন। কারণ সংসদীয় গণতন্ত্রে জনগণের এমনি চূড়ান্ত রায় ছিল অভূতপূর্ব। দুই প্রদেশের জনগণই বিশ্বাস করেছিলেন যে, এবার ৬-দফার ভিত্তিতে উভয় প্রদেশের জন্য একটি গ্রহণযােগ্য গঠনতন্ত্র প্রণয়ন সম্ভব হবে। তবে সিন্ধু এবং পাঞ্জাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভকারী পাকিস্তান পিপলস্ পার্টি তাদের নির্বাচন অভিযানে ৬-দফাকে। এড়িয়ে গিয়েছিল। কাজেই ৬-দফাকে গ্রহণ বা প্রত্যাখান করার জন্য জনগণের কাছে এই দলের জবাবদিহি ছিল না। বেলুচিস্তানের নেতৃস্থানীয় দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ছিল ৬-দফার পূর্ণ সমর্থক। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের প্রভাবশালী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিও ৬-দফার আলােকে পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনে বিশ্বাসী ছিল। কাজেই প্রতিক্রিয়াশীলদের পরাজয় সূচনাকারী ৭০-এর নির্বাচনে পাকিস্তান গণতন্ত্রের আশাপ্রদ ভবিষ্যতেরই ইঙ্গিত বহন করেছিল। আশা করা গিয়েছিল যে, জাতীয় পরিষদ আহ্বানের প্রস্তুতি হিসেবে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলি আলােচনায় বসবে। এমনি আলােচনার প্রস্তাব এবং পাল্টা প্রস্তাবের ওপর গঠনতন্ত্রের ব্যাখ্যা উপস্থাপনের জন্য আওয়ামী লীগ সব সময়ই সম্মত ছিল।

তবে এই দল বিশ্বাস করেছে যে, যথার্থ গণতান্ত্রিক মূল্যবােধকে জাগ্রত রাখার জন্য গােপনীয় সম্মেলনের পরিবর্তে জাতীয় পরিষদেই গঠনতন্ত্রের ওপর বিতর্ক হওয়া উচিত। এরই প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ চেয়েছিল যথাসত্ত্বর জাতীয় পরিষদ আহ্বানের জন্য। আওয়ামী লীগ আসন্ন জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে উপস্থাপনের লক্ষ্যে একটি খসড়া গঠনতন্ত্র প্রণয়নের কাজে লেগে গেল এবং এ ধরনের একটি গঠনতন্ত্র প্রণয়নের সব আইনগত এবং বাস্তব দিকও তারা পরীক্ষা করে দেখল। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ওপর আলােচনার জন্য জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং শেখ মুজিবের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় জানুয়ারি ‘৭১-এর মাঝামাঝি সময়ে। এই বৈঠকে জেনারেল ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের ৬-দফা ভিত্তিক কর্মসূচিকে বিশ্লেষণ করলেন এবং ফল কি হতে পারে তারও নিশ্চিত ভরসা নিলেন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। কিন্তু প্রস্তাবিত গঠনতন্ত্র সম্পর্কে ইয়াহিয়া খান তার নিজস্ব মন্তব্য প্রকাশে বিরত থাকলেন। তিনি এমন এক ভাব দেখালেন যে, ৬-দফায় সাংঘাতিক আপত্তিজনক কিছুই তিনি খুঁজে পাননি। তবে পাকিস্তান পিপলস্ পার্টির সাথে একটি সমঝােতায় আসার ওপর তিনি জোর দিলেন। পরবর্তী আলােচনা অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তান পিপলস পার্টি এবং আওয়ামী লীগের সাথে ঢাকায় ২৭ জানুয়ারি ‘৭১। জনাব ভুট্টো এবং তার দল আওয়ামী লীগের সাথে গঠনতন্ত্রের ওপর আলােচনার জন্য এ সময়ে কয়েকটি বৈঠকে মিলিত হন। ইয়াহিয়ার ন্যায় ভুট্টোও গঠনতন্ত্রের অবকাঠামাে সম্পর্কে কোনও সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব আনয়ন করেননি। বরং তিনি এবং তার দল ৬-দফার বাস্তব ফল কি হতে পারে সে সম্পর্কে আলােচনার প্রতিই অধিক ইচ্ছুক ছিলেন। যেহেতু এ ব্যাপারে তাদের প্রতিক্রিয়া ছিল না সূচক, এবং যেহেতু এ নিয়ে তাদের কোনও তৈরি বক্তব্যও ছিল , সেহেতু, এ ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ আপােস ফরমূলায় আসাও সম্ভব ছিল না। অথচ দুই দলের মধ্যে মতানৈক্য দূর করার জন্য প্রচেষ্টার দুয়ার সব সময়ই খােলা ছিল। এই আলােচনা বৈঠক থেকে এটাও স্পষ্ট হয়ে গেল যে, কোন্ পর্যায় থেকে আপােস ফরমূলায় আসা সম্ভব সে সম্পর্কেও জনাব ভুট্টোর নিজস্ব কোনও বক্তব্য ছিল না।

এখানে একটি কথা আরাে পরিষ্কারভাবে বলে রাখা দরকার যে, আওয়ামী লীগের সাথে আলােচনায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে এ ধরনের কোনও আভাসও পাকিস্তান পিপলস পার্টি ঢাকা ত্যাগের আগে দিয়ে যাননি। উপরন্তু তারা নিশ্চয়তা দিয়ে গেলেন যে, আলােচনার জন্য সব দরজাই খােলা রয়েছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ-আলােচনার পর পাকিস্তান পিপলস্ পার্টি আওয়ামী লীগের সাথে দ্বিতীয় দফায় আরাে অধিক ফলপ্রসু আলােচনায় বসবেন, অথবা জাতীয় পরিষদেও তারা ভিন্নভাবে আলােচনার বসার জন্য অনেক সুযােগ পাবেন। পরবর্তী পর্যায়ে জনাব ভুট্টোর জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বয়কটের সিদ্ধান্ত সবাইকে বিস্মিত ও হতবাক করে। তার এই সিদ্ধান্ত এ জন্যই সবাইকে আরাে বেশি বিস্মিত করে যে, শেখ মুজিবের দাবি মােতাবেক ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান না করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ভুট্টোর কথামতই ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডেকেছিলেন। পরিষদ বয়কটের সিদ্ধান্ত ঘােষণার পর ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য সমস্ত দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে ভীতি প্রদর্শনের অভিযান শুরু করেন। এ অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল তাদেরকে পরিষদের অধিবেশনে যােগদান থেকে বিরত রাখা। এ কাজে ভুট্টোর হস্তকে শক্তিশালী করার জন্য জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইয়াহিয়ার ঘনিষ্ঠ সহচর লে. জেনারেল ওমর ব্যক্তিগতভাবে পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের সঙ্গে দেখা করে তাদের ওপর পরিষদের অধিবেশনে যােগদান না করার জন্য চাপ দিতে থাকেন। জনাব ভুট্টো ও লে. জেনারেল ওমরের চাপ সত্ত্বেও পি.পি.পি. ও কাইয়ুম লীগের সদস্যগণ ব্যতীত অপরাপর দলের সমস্ত সদস্যই ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যােগদানের জন্য বিমানে পূর্ব-বাংলায় গমনের টিকিট বুক করেন। এমনকি কাইয়ুম লীগের অর্ধেক সংখ্যক সদস্য তাদের আসন বুক করেন। এমনও আশ্বাস পাওয়া যাচ্ছিল যে, পি.পি.পি.-র বহু সদস্য দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করে ঢাকায় আসতে পারেন। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এভাবে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেও যখন কোন কুলকিনারা পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন ১ মার্চ অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতবি ঘােষণা করেন জেনারেল ইয়াহিয়া তার দোস্ত ভুট্টোকে খুশি করার জন্য। শুধু তাই নয়, জেনারেল ইয়াহিয়া পূর্ব-বাংলার গভর্নর আহসানকেও বরখাস্ত করলেন। গভর্নর আহসান ইয়াহিয়া প্রশাসনে মধ্যপন্থি বলে পরিচিত ছিলেন।

বাঙ্গালিদের সংমিশ্রণে কেন্দ্রে যে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছিল তাও বাতিল করে সরকারের সমস্ত ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানী মিলিটারি জান্তার হাতে তুলে দেয়া হল। এমতাবস্থায় ইয়াহিয়ার সমস্ত কার্যক্রমকে কোনক্রমেই ভুট্টোর সাথে চক্রান্তে লিপ্ত  হয়ে বাংলাদেশের গণ-রায় বানচাল করার প্রয়াস ছাড়া আর কিছু ভাবা যায় না। জাতীয় পরিষদই ছিল একমাত্র স্থান যেখানে বাংলাদেশ তার বক্তব্য কার্যকরি করতে পারত এবং রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শন করতে পারত। এটাকে বানচাল করার চেষ্টা চলতে থাকে। চলতে থাকে জাতীয় পরিষদকে সত্যিকার ক্ষমতার উৎস না করে একটা ঠুটো জগন্নাথে’ পরিণত করার। জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিতের প্রতিক্রিয়া যা হবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল তাই হয়েছে। ইয়াহিয়ার এই স্বৈরাচারী কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য সারা বাংলাদেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে পড়ে। কেননা বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে পেরেছিল যে, ক্ষমতা হস্তান্তরের কোন ইচ্ছাই ইয়াহিয়া খানের নেই এবং তিনি পার্লামেন্টারি রাজনীতির নামে তামাশা করছেন। বাংলাদেশের জনগণ এটা স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছিল যে, এক পাকিস্তানের কাঠামােতে বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ের কোন সম্ভাবনা নেই। ইয়াহিয়া নিজেই আহ্বান করে আবার নিজেই যেভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বন্ধ করে দিলেন তা থেকেই বাঙ্গালি শিক্ষা গ্রহণ করেছে। তাই তারা এক বাক্যে পূর্ণ স্বাধীনতা ঘােষণার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর চাপ দিতে থাকেন। শেখ মুজিব এতদ্সত্ত্বেও সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধানের জন্য চেষ্টা করতে থাকেন। ৩ মার্চ অসহযােগ কর্মসূচির আহবান জানাতে গিয়ে তিনি দখলদার বাহিনীকে মােকাবেলার জন্য শান্তির অস্ত্রই বেছে নিয়েছিলেন। তখন তিনি আশা করছিলেন যে, সামরিক চক্র তাদের জ্ঞানবুদ্ধি ফিরে পাবে। গত ২ ও ৩ মার্চ ঠাণ্ডা মাথায় সামরিক চক্র কর্তৃক হাজার হাজার নিরস্ত্র ও নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করার মুখে বঙ্গবন্ধুর অহিংস অসহযােগ আন্দোলনের নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। শেখ সাহেবের অসহযােগ আন্দোলন আজ ইতিহাসের অন্তর্গত। অসহযােগ আন্দোলনের ক্ষেত্রে তিনি সৃষ্টি করলেন এক নতুন ইতিহাস।

বাংলাদেশে ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত অসহযােগ আন্দোলন যেভাবে এগিয়ে গেছে মুক্তি আন্দোলনের ইতিহাসে তার নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। এত কার্যকরি অসহযােগ আন্দোলন কোথাও সাফল্য লাভ করেনি। পূর্ণ অসহযােগ আন্দোলন চলেছে দেশের সর্বত্র। নতুন গভর্নর লে. জেনারেল টিক্কা খানের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করার জন্য পাওয়া গেল না হাইকোর্টের কোন বিচারপতি। পুলিশ এবং পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসসহ গণ-প্রশাসন বিভাগের কর্মচারিগণ কাজে যােগ দিতে অস্বীকার করেন। জনগণ সেনাবাহিনীর সরবরাহ বন্ধ করে দিল। এমনকি সামরিক দপ্তরের অসামরিক কর্মচারিগণ তাদের অফিস বয়কট করলেন। কেবল কাজে যােগদান থেকে বিরত থেকে তারা ক্ষান্ত হলেন না, অসামরিক প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগের লােকেরাও সক্রিয় সমর্থন ও নিজেদের আনুগত্য প্রকাশ করলেন শেখ সাহেবের প্রতি। তারা স্পষ্টভাবে ঘােষণা করলেন যে, আওয়ামী লীগ প্রশাসনের নির্দেশ ছাড়া তারা অন্য কারাে নির্দেশ মেনে চলবেন না। এ অবস্থার মুখােমুখি হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতাসীন না হয়েও অসহযােগের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার দায়িত্ব স্বহস্তে গ্রহণে আওয়ামী লীগ বাধ্য হল। এ ব্যাপারে শুধু আপামর জনগণই নয়, বাংলাদেশের প্রশাসন ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের দ্ব্যর্থহীন সমর্থন লাভ তারা করেছিলেন। তারা আওয়ামী লীগের নির্দেশাবলী সর্বান্তকরণে মাথা পেতে মেনে নিলেন এবং সমস্যাবলীর সমাধানে আওয়ামী লীগকে একমাত্র কর্তৃপক্ষ বলে গ্রহণ করলেন। অসহযােগ আন্দোলনের ফলে বাংলাদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ফাটল ধরলে দেখা দেয়। নানাবিধ দুরূহ সমস্যা। কিন্তু এসব সমস্যাবলীর মধ্যেও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দেশের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক দপ্তরের কাজ যথারীতি এগিয়ে যাচ্ছিল।

বাংলাদেশের কোন আইনানুগ কর্তৃপক্ষ না থাকা সত্ত্বেও পুলিশের সহযােগিতায় আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবকগণ আইন শৃংখলা রক্ষার যে আদর্শ স্থাপন করেছিলেন, তা স্বাভাবিক সময়েও অন্যদের অনুকরণীয় হওয়া উচিত। আওয়ামী লীগ ও ঐতিহাসিক অসহযােগ আন্দোলনের প্রতি জনগণের সর্বাধিক সমর্থন দৃষ্টে জেনারেল ইয়াহিয়া তার কৌশল পাল্টালেন। ৬ মার্চ ইয়াহিয়াকে একটা কন্টেশনের জন্য উত্তেজনা সৃষ্টিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ বলে মনে হল। কেননা তার ঐ দিনের প্ররােচনামূলক বেতার বক্তৃতায় সঙ্কটের সম্পূর্ণ দায়িত্ব চাপালেন আওয়ামী লীগের ওপর। অথচ যিনি ছিলেন সঙ্কটের স্থপতি সেই ভুট্টো সম্পর্কে তিনি একটি কথাও বললেন না। মনে হয় তিনি ধারণা করেছিলেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করবেন। অনুরূপ উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে তা নির্মূল করার জন্য ঢাকার সেনাবাহিনীকে করা হয় পূর্ণ সতর্কীকরণ। লে. জেনারেল ইয়াকুব খানের স্থলে পাঠানাে হল লে. জেনারেল টিক্কা খানকে। এই রদবদল থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় সামরিক জান্তার ঘৃণ্য মনােভাবের পরিচয়। কিন্তু ইতােমধ্যে মুক্তিপাগল মানুষ স্বাধীনতা লাভের জন্য পাগল হয়ে ওঠে। এ সত্ত্বেও শেখ মুজিব রাজনৈতিক সমাধানের পথে অটল থাকেন। জাতীয় পরিষদে যােগদানের ব্যাপারে তিনি যে ৪-দফা প্রস্তাব পেশ করেন তাতে যেমন একদিকে প্রতিফলিত হয়েছে জনগণের ইচ্ছা, অপরদিকে শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌছানাের জন্য ইয়াহিয়াকে দেয়া হয় তার শেষ সুযােগ। বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এটি অবশ্যই সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ইয়াহিয়া এবং তার জেনারেলদের ছিল না। তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশে সামরিক শক্তিকে জোরদার করার জন্য কালক্ষেপণ করা। ইয়াহিয়ার ঢাকা সফর ছিল আসলে বাংলাদেশে গণ-হত্যা পরিচালনার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা। এটা আজ পরিষ্কার বােঝা যাচ্ছে যে, অনুরূপ একটি সঙ্কট সৃষ্টির পরিকল্পনা বেশ আগেভাগেই নেয়া হয়েছিল।

১ মার্চের ঘটনার সামান্য কিছু আগে রংপুর থেকে সীমান্ত রক্ষার কাজে নিয়ােজিত ট্যাঙ্কগুলাে ফেরত আনা হয়। ১ মার্চ থেকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পশ্চিম পাকিস্তানী কোটিপতি ব্যবসায়ী পরিবারসমূহের সাথে সেনাবাহিনীর লােকদের পরিবার পরিজনদেরকেও পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানাে হতে থাকে। ১ মার্চের পর থেকে বাংলাদেশের সামরিক শক্তি গড়ে তােলার কাজ ত্বরান্বিত করা হয় এবং তা ২৫ মার্চ পর্যন্ত অব্যাহত গতিতে চলে। সিংহলের পথে পি.আই.য়ের কমার্শিয়াল ফ্লাইটে সাদা পােশাকে সশস্ত্র বাহিনীর লােকদের বাংলাদেশে আনা হল। সি ১৩০ পরিবহন বিমানগুলাের সাহায্যে অস্ত্র এবং রসদ এনে বাংলাদেশে স্তুপিকৃত করা হয়। হিসাব নিয়ে জানা গেছে ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চের মধ্যে প্রয়ােজনীয় সাজ সরঞ্জামসহ অতিরিক্ত এক ডিভিশন সৈন্য বাংলাদেশে আমদানি করা হয়। ব্যাপারটা নিরাপদ করার জন্য ঢাকা বিমানবন্দরকে বিমান বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। সমগ্র বিমান বন্দর এলাকায় আর্টিলারী ও মেশিনগানের জাল বিস্তার করা হয়। যাত্রীদের আগমন-নির্গমনের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করা হয়। ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও হত্যাকান্ড সংগঠনে ট্রেনিংপ্রাপ্ত একদল এস, জি, কমাণ্ডো গ্রুপ বাংলাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে ছেড়ে দেয়া হয়। ২৫ মার্চের পূর্ববর্তী দুই দিনে ঢাকা ও সৈয়দপুরে যেসব কুকাণ্ড ঘটে এরাই সেগুলাে সংঘটন করেছিল। সামরিক হস্তক্ষেপের অজুহাত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে স্থানীয় ও অস্থানীয়দের মধ্যে সংঘর্ষ সৃষ্টির মাধ্যমে একটা উত্তেজনার পরিবেশ খাড়া করাই ছিল এ সবের উদ্দেশ্য। প্রতারণা বা ভণ্ডামির এই স্ট্রাটেজি গােপন করার অংশ হিসেবেই ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের সাথে তার আলােচনায় আপােসমূলক মনােভাব গ্রহণ করেছিলেন। ১৬ মার্চ আলােচনা শুরু হলে ইয়াহিয়া তৎপূর্বে যা ঘটেছে তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। এবং সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আন্তরিক আগ্রহ প্রকাশ করেন। শেখ মুজিবের সাথে আলােচনার এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে ইয়াহিয়ার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল আওয়ামী লীগের ক্ষমতা হস্তান্তরের ৪-দফা শর্তের প্রতি সামরিক জান্তার মনােভাব কি? জবাবে ইয়াহিয়া জানান যে, এ ব্যাপারে তাদের তেমন কোন আপত্তি নেই। তিনি আশা করেন যে, ৪-দফা শর্ত পূরণের ভিত্তিতে উভয় পক্ষের উপদেষ্টাগণ একটা অন্তবর্তীকালীন শাসনতন্ত্র প্রণয়নে সক্ষম হবেন। আলােচনাকালে যে সব মৌলিক প্রশ্নে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয় সেগুলি হল ঃ

১। মার্শাল ল বা সামরিক আইন প্রত্যাহার করে প্রেসিডেন্টের একটি ঘােষণার মাধ্যমে একটা বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। ২। প্রদেশগুলিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলসমূহের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। ৩। ইয়াহিয়া প্রেসিডেন্ট থাকবেন এবং কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা করবেন। ৪। জাতীয় পরিষদের পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্যগণ পৃথক পৃথকভাবে বৈঠকে মিলিত হবেন। আজ ইয়াহিয়া ও ভুট্টো জাতীয় পরিষদের পৃথক পৃথক অধিবেশনের প্রস্তাবের বিকৃত ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। অথচ ইয়াহিয়া নিজেই ভুট্টোর মনােনয়নের জন্য এ প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এ প্রস্তাবের সুবিধা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইয়াহিয়া সেদিন নিজেই বলেছিলেন যে, ৬-দফা হল বাংলাদেশের এবং কেন্দ্রের মধ্যকার সম্পর্ক নির্ণয়ের এক নির্ভরযােগ্য নীল নক্সা। পক্ষান্তরে এটার প্রয়ােগ পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য সৃষ্টি করবে নানারূপ অসুবিধা। এমতাবস্থায় পশ্চিম পাকিস্তানী এম. এন. এ.দের পৃথকভাবে বসে ৬-দফার ভিত্তিতে রচিত শাসনতন্ত্র এবং এক ইউনিট ব্যবস্থা বিলােপের আলােকে একটা নতুন ধরনের ব্যবস্থা গড়ে তােলার সুযোেগ অবশ্যই দিতে হবে। শেখ মুজিব এবং ইয়াহিয়ার মধ্যকার এই নীতিগত মতৈক্যের পর একটি মাত্র প্রশ্ন থেকে যায় এবং তা হল অন্তর্বর্তী পর্যায়ে কেন্দ্র ও বাংলাদেশের মধ্যে ক্ষমতা বন্টন। এক্ষেত্রেও উভয় পক্ষ এই মর্মে একমত হয়েছিলেন যে, ৬-দফার ভিত্তিতে অদূর ভবিষ্যতে যে শাসনতন্ত্র রচিত হতে যাচ্ছে মােটামুটি তার আলােকেই কেন্দ্র ও বাংলাদেশের মধ্যে ক্ষমতা বন্টন হবে।

অন্তর্বর্তীকালীন মীমাংসার এই সম্পর্কে একটা পরিকল্পনা তৈরির উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্টের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা জনাব এম, এম, আহমদকে বিমানে করে ঢাকা আনা হয়। আওয়ামী লীগ উপদেষ্টাদের সাথে আলাপ-আলােচনায় তিনি স্পষ্টভাবে এ কথা বলেন যে, রাজনৈতিক মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ৬-দফা কার্যকরি করার প্রশ্নে দুর্লভ কোন সমস্যা দেখা দেবে না। এমনকি অন্তর্বর্তী পর্যায়েও না। আওয়ামী লীগের খসড়ার ওপর তিনি যে তিনটি সংশােধনী পেশ করেছিলেন তাতে এ কথাই প্রমাণিত হয়েছিল যে, সরকার এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে তখন যে ব্যবধানটুকু ছিল তা নীতিগত নয়, বরং কোথায় কোন্ শব্দ বসবে সে নিয়ে। ২৪ মার্চের বৈঠকে ভাষার সামান্য রদবদলসহ সংশােধনীগুলি আওয়ামী লীগ গ্রহণ করে। অতঃপর অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্র চূড়ান্তকরণের উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া ও মুজিবের উপদেষ্টাদের শেষ দফা বৈঠকে মিলিত হওয়ার পথে আর কোন বাধাই ছিল না। এ প্রসঙ্গে একটা জিনিস পরিষ্কার করে বলতে হয়, কোন পর্যায়েই আলােচনা অচলাবস্থার সম্মুখীন হয়নি। অথচ ইয়াহিয়া বা তার উপদেষ্টারা আভাস-ইঙ্গিতেও এমন কোন কথা বলেননি যে, তাদের এমন একটা বক্তব্য আছে যা থেকে তারা নড়চড় করতে পারেন না। গণ-হত্যাকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য ইয়াহিয়া ক্ষমতা হস্তান্তরে আইনগত ছত্রছায়ার প্রশ্নেও আজ জোছুরির আশ্রয় নিয়েছেন। আলােচনায় তিনি এবং তার দলবল একমত হয়েছিলেন যে, ১৯৪৭ সালে ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের মাধ্যমে যেভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়েছিল তিনিও সেভাবে একটা ঘােষণার মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। ক্ষমতা হস্তান্তরের আইনগত ছত্রছায়ার ব্যাপারে ভুট্টো পরবর্তীকালে যে ফ্যাকড়া তুলেছেন ইয়াহিয়া তাই অনুমােদন করেছেন।

আশ্চর্যের ব্যাপার, ইয়াহিয়া ঘুণাক্ষরেও মুজিবকে এ সম্পর্কে কিছু জানাননি। ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য জাতীয় পরিষদের একটা অধিবেশন বসা দরকার ইয়াহিয়া যদি আভাস ইঙ্গিতেও এ কথা বলতেন তাহলে আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই তাতে আপত্তি করত না। কেননা এমন একটা সামান্য ব্যাপারকে উপেক্ষা করে আলােচনা বানচাল করতে দেয়া যায় না। তাছাড়া জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগুরু দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ভয় করার কিছুই ছিল না। দেশের দুই অংশের জাতীয় পরিষদের সদস্যদের পৃথক পৃথক বৈঠকের যে প্রস্তাবে আওয়ামী লীগ সম্মতি দিয়েছিল, তা শুধু ভুট্টোকে খুশি করার জন্যই করা হয়েছিল। এটা কোন সময়ই আওয়ামী লীগের মৌলিক নীতি ছিল না। ২৪ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া এবং আওয়ামী লীগ উপদেষ্টাদের মধ্যে চূড়ান্ত বৈঠকে জনাব এম. এম, আহমদ তার সংশােধনী প্রস্তাব পেশ করেন। এই খসড়া প্রস্তাবের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য জেনারেল পীরজাদার আহ্বানে একটা চূড়ান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। দুঃখের বিষয় কোন চূড়ান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। বরং জনাব এম, এম. আহমদ আওয়ামী লীগকে না জানিয়ে ২৫ মার্চ করাচী চলে গেলেন। ২৫ মার্চ রাত ১১টা নাগাদ সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন হয় এবং সেনাবাহিনী শহরে ‘পজিশন’ গ্রহণ করতে থাকে। মধ্যরাত্রি নাগাদ ঢাকা শহরের শান্তিপ্রিয় জনগণের ওপর পরিচালনা করা হল গণ-হত্যার এক পূর্ব নির্দিষ্ট কর্মসূচি। অনুরূপ। বিশ্বাসঘাতকতার নজির সমসাময়িক ইতিহাসে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগকে দেননি কোন চরমপত্র। অথবা মেশিন গান, আর্টিলারি সুসজ্জিত ট্যাঙ্কসমূহ যখন মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ও ধ্বংসলীলা শুরু করে দিল তার আগে জারি করা হয়নি কোন কারফিউ অর্ডার।

পরদিন সকালে লে. জেনারেল টিক্কা খান তার প্রথম সামরিক নির্দেশ জারি করলেন বেতার মারফত। কিন্তু ৫০ হাজার লোেক তার আগেই প্রাণ হারিয়েছেন বিনা প্রতিরােধে। এদের অধিকাংশই ছিল নারী ও শিশু। ঢাকা শহর পরিণত হয় নরককুণ্ডে, প্রতিটি অলিগলি ও আনাচেকানাচে চলতে লাগল নির্বিচারে গুলি। সামরিক বাহিনীর লোেকদের নির্বিচারে অগ্নিসংযােগের মুখে অন্ধকারে বিছানা ছেড়ে যে-সব মানুষ বের হওয়ার চেষ্টা করল তাদেরকে নির্বিচারে হত্যা করা হয় মেশিনগানের গুলিতে। আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত আক্রমণের মুখেও পুলিশ ও ই.পি.আর, বীরের মত লড়ে গেল। কিন্তু দুর্বল, নিরীহ মানুষ কোন প্রতিরােধ দিতে পারল না। তারা মারা গেল হাজারে হাজারে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের নির্দেশে সেনাবাহিনী যে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছে আমরা তার একটা নির্ভরযােগ্য তালিকা প্রস্তুত করছি এবং শীঘ্রই তা প্রকাশ করব। মানব সভ্যতার ইতিহাসে যে, সব বর্বরতা ও নিষ্ঠুতার কাহিনী আমরা শুনেছি, এদের বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতা তার সবকিছুকে ম্লান করে দিয়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে ২৫ মার্চ রাতে ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করলেন। যাওয়ার আগে তিনি তাদেরকে দিয়ে গেলেন বাঙ্গালি হত্যার এক অবাধ লাইসেন্স। কেন তিনি এই বর্বরতার আশ্রয় নিয়েছিলেন, পরদিন রাত ৮টার সময় বিশ্ববাসীকে জানান হল এর কৈফিয়ত। এই বৃিবতিতে তিনি নরমেধযজ্ঞ সংগঠনের একটা ব্যাখ্যা বিশ্ববাসীকে জানালেন। তার বক্তব্য একদিকে ছিল পরস্পর বিরােধী এবং অন্যদিকে ছিল মিথ্যার বেসাতিতে ভরা। মাত্র ৪৮ ঘন্টা আগেও যে দলের সাথে তিনি শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আলাপ-আলােচনা চালাচ্ছিলেন সে দলের লােকদের দেশদ্রোহী ও দলটিকে অবৈধ ঘােষণার সাথে বাংলাদেশের পরিস্থিতি বা আলাপ-আলােচনায় কোন সংগতি খুঁজে পেল না বিশ্ববাসী ।

বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিনিধিত্বশীল এবং জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগুরু আসনের অধিকারী আওয়ামী লীগকে বে-আইনী ঘােষণা করে গণ-প্রতিধিদের হাতে তার ক্ষমতা হস্তান্তরের ওয়াদাকে সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালির অবাধ মত প্রকাশের প্রতি তামাশা ছাড়া মানুষ আর কিছু ভাবতে পারল না। তার বক্তব্য থেকে এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হল যে, ইয়াহিয়া আর যুক্তি বা নৈতিকতার ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিতে চান না এবং বাংলাদেশের মানুষকে নির্মূল করার জন্য জঙ্গি আইনের আশ্রয় নিতে বদ্ধপরিকর। পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে। বাংলাদেশে যে শত সহস্র মানুষের মৃত্যু হয়েছে তা পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব-পাকিস্তানের মধ্যে একটা দুর্লঙ্ প্রাচীর হিসেবে বিরাজ করছে। পূর্বপরিকল্পিত গণ-হত্যায় মত্ত হয়ে ওঠার আগে ইয়াহিয়ার ভাবা উচিত ছিল তিনি নিজেই পাকিস্তানের কবর রচনা করছেন। তারই নির্দেশে তার লাইসেন্সধারী কসাইরা জনগণের ওপর যে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে তা কোনমতেই একটা জাতীয় ঐক্যের অনুকূল ছিল না। বর্ণগত বিদ্বেষ এবং একটা জাতিকে ধ্বংস করে দেওয়াই ছিল এর লক্ষ্য। মানবতার লেশমাত্রও এদের মধ্যে নেই। উপরওয়ালাদের নির্দেশে পেশাদার সৈনিকরা লংঘন করেছে তাদের সামরিক নীতিমালা এবং ব্যবহার করেছে শিকারী পশুর মত। তারা চালিয়েছে হত্যাযজ্ঞ, নারী ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযােগ ও নির্বিচারে ধ্বংসলীলা। বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে এর নজীর নেই। এ সব কার্যকলাপ থেকে এ কথারই আভাস মেলে যে, ইয়াহিয়া খান ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের মনে দুই পাকিস্তানের ধারণা দৃঢ়ভাবে প্রােথিত হয়ে গেছে। যদি না হত তাহলে তারা একই দেশের মানুষের ওপর এমন নির্মম বর্বরতা চালাতে পারত না। ইয়াহিয়ার এই নির্বিচারে গণহত্যা আমাদের জন্য রাজনৈতিক দিক থেকে অর্থহীন নয়। তার এ কাজ পাকিস্তানের বিয়ােগান্ত এই মর্মান্তিক ইতিহাসের শেষ অধ্যায়, যা ইয়াহিয়া রচনা করেছেন বাঙ্গালির রক্ত দিয়ে। বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হওয়া বা নির্মূল হওয়ার আগে তারা গণহত্যা ও পােড়া মাটি নীতির মাধ্যমে বাঙ্গালি জাতিকে শেষ করে দিয়ে যেতে চায়। ইত্যবসরে ইয়াহিয়ার লক্ষ্য হল আমাদের রাজনৈতিক, বুদ্ধিজীবী মহল ও প্রশাসন ব্যবস্থাকে নির্মূল করা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কারখানা, জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানসমূহ ধ্বংস করা এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে শহরগুলােকে ধূলিস্যাৎ করা, যাতে একটি জাতি হিসেবে কোনদিনই আমরা মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারি ।

ইতােমধ্যে এ লক্ষ্য পথে সেনাবাহিনী অনেকদূর এগিয়ে গেছে। যে বাংলাদেশকে তারা দীর্ঘ ২৩ বছর নিজেদের স্বার্থে লাগিয়েছে, শােষণ করেছে, তাদেরই বিদায়ী লাথির উপহার হিসেবে সেই বাংলাদেশ সর্বক্ষেত্রে পাকিস্তান থেকে ৫০ বছর পিছিয়ে পড়ল। অসউহজের পর গণ-হত্যার এমন জঘন্যতম ঘটনা আর ঘটেনি। অথচ বৃহৎ শক্তিবর্গ বাংলাদেশের ঘটনার ব্যাপারে উট পাখির নীতি অনুসরণ করে চলেছেন। তারা যদি মনে করে থাকেন যে, এতদ্বারা তারা পাকিস্তানের ঐক্য বজায় রাখার ব্যাপারে সহায়তা করেছেন, তাহলে তারা ভুল করেছেন। কেননা, পাকিস্তানের ভবিষ্যত সম্পর্কে ইয়াহিয়া খান নিজেও মােহমুক্ত। তাদের বােঝা উচিত যে, পাকিস্তান আজ মৃত এবং ইয়াহিয়া নিজেই পাকিস্তানের হত্যাকারী । স্বাধীন বাংলাদেশ আজ একটা বাস্তব সত্য। সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালি অজেয় মনােবল ও সাহসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে এবং প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙ্গালি সন্তান রক্ত দিয়ে এই নতুন শিশু রাষ্ট্রকে লালিত পালিত করছেন। দুনিয়ার কোন জাতি এ নতুন শক্তিকে ধ্বংস করতে পারবে না। আজ হােক কাল হােক দুনিয়ার ছােট বড় প্রতিটি রাষ্ট্রকেই গ্রহণ করতে হবে এ নতুন জাতিকে। স্থান দিতে হবে বিশ্ব রাষ্ট্রপুঞ্জে। সুতরাং রাজনীতি এবং মানবতার স্বার্থেই আজ বৃহৎ শক্তিবর্গের উচিত ইয়াহিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করা, তার লাইসেন্সধারী হত্যাকারীদের খাঁচায় আবদ্ধ করা এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য করা। আমাদের সংগ্রামকে সােভিয়েট ইউনিয়ন, ভারত এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের স্বাধীনতা প্রিয় মানুষ যে সমর্থন দিয়েছেন তা আমরা চিরকাল কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করব। গণচীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, গ্রেট বৃটেন ও অন্যান্য দেশের কাছ থেকেও আমরা অনুরূপ সমর্থন আশা করি এবং তা পেলে সে জন্য তাদেরকে অভিনন্দন জানাব।

প্রত্যেকটি রাষ্ট্রের উচিত তাদের নিজ নিজ পর্যায়ে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করা এবং তারা যদি তা করেন তাহলে ইয়াহিয়ার পক্ষে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আর একদিনও হামলা অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়। জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের অষ্টম বৃহৎ রাষ্ট্র। আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হবে ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীর সৃষ্ট ভষ্ম ও ধ্বংসস্তুপের ওপর একটা নুতন দেশ গড়ে তােলা। এ একটা দুরূহ ও বিরাট দায়িত্ব। কেননা আগে থেকেই আমরা বিশ্বের দরিদ্রতম জাতিসমূহের অন্যতম। এছাড়া একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য মানুষ এক ঐতিহাসিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। তারা প্রাণপণে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। তারা প্রাণ দিচ্ছে অকাতরে। সুতরাং তাদের আশা আমরা ব্যর্থ করতে পারি না। তাদের ভবিষ্যতকে উজ্জ্বল করতেই হবে। আমার বিশ্বাস, যে জাতি নিজে প্রাণ ও রক্ত দিতে পারে, এত ত্যাগ স্বীকার করতে পারে, সে জাতি তার দায়িত্ব সম্পাদনে বিফল হবে না। এ জাতির অটুট ঐক্য স্থাপনের ব্যাপারে কোন বাধা বিপত্তি টিকতে পারে না। আমাদের এই অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে আমরা কামনা করি বিশ্বের প্রতিটি ছােট বড় জাতির বন্ধুত্ব। আমরা কোন শক্তি, ব্লক বা সামরিক জোটভূক্ত হতে চাই না—আমরা আশা করি শুধুমাত্র শুভেচ্ছার মনােভাব নিয়ে সবাই নিঃসংকোচে আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসবেন। কারাে তাবেদারে পরিণত হওয়ার জন্য আত্ম-নিয়ন্ত্রণের দীর্ঘ সংগ্রামে আমাদের মানুষ এত রক্ত দেয়নি, এত ত্যাগ স্বীকার করছে না। আমাদের এই জাতীয় সংগ্রামে, তাই আমরা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং বৈষয়িক ও নৈতিক সমর্থনের জন্য বিশ্বের জাতিসমূহের প্রতি আকুল আবেদন জানাচ্ছি। এ ব্যাপারে প্রতিটি দিনের বিলম্ব ডেকে আনছে সহস্র মানুষের অকাল মৃত্যু এবং বাংলাদেশের মূল সম্পদের বিরাট ধ্বংস।

তাই বিশ্ববাসীর প্রতি আমাদের আবেদন, আর কালবিলম্ব করবেন না, এই মুহূর্তে এগিয়ে আসুন এবং এতদ্বারা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের চিরন্তন বন্ধুত্ব অর্জন করুন। বিশ্ববাসীর কাছে আমরা আমাদের বক্তব্য পেশ করলাম, বিশ্বের আর কোন জাতি আমাদের চেয়ে স্বীকৃতির বেশি দাবীদার হতে পারে না। কেননা, আর কোন জাতি আমাদের চেয়ে কঠোরতর সংগ্রাম করেনি, অধিকতর ত্যাগ স্বীকার করেনি। জয়বাংলা।”

PRESS STATEMENT Issued By MR. TAJUDDIN AHMAD PRIME MINISTER OF BANGLADESH ON 17TH APRIL 1971 TO THE PEOPLE OF THE WORLD : Bangladesh is at war. It has been given no choice but to secure the right of self-determination through a national liberation struggle against the colonial oppression of West Pakistan. In the face of positive attempts by the Government of Pakistan to distort the facts in a desperate attempt to cover up their war of genocide in Bangladesh, the world must be told the circumstances under which the peace-loving people of Bangladesh were driven to substitute armed struggle for parliamentary politics to realise the just aspirations of the People of Bangladesh. The Six Point programme for autonomy for Bangladesh within Pakistan had been put forward in all sincerity by the Awami League as the last possible solution to preserve the integrity of Pakistan. Fighting the elections to the National Assembly on the issue of Six Points, the Awami League won 167 out of 169 seats from Bangladesh in a House of 313. Its electorial victory was so decisive that it won 80% of the popular votes cast. The decisive nature of its victory placed it in a clear majority within the National Assembly. The post election period was a time of hope, for never had a people spoken so decisively in the history of parliamentary democracy. It was widely believed in both wings that a viable constitution based on Six Points could be worked out. The Pakistan people’s party which emerged as the leading party in Sind and Punjab had avoided raising the issue of Six points in their election campaign and had no obligation whatsoever to its electorate to resist it. In Baluchistan, the dominant party, National Awami party, was fully committed to Six Points. In NWFP. the NAP, dominant in the Provincial Assembly, was also a believer in maximum autonomy. The course of the elections, which marked the defeat of the reactionary parties therefore, gave every reason to be optimistic about the future of democracy in Pakistan. Preparatory to the convening of the National Assembly talks were expected between the main parties in the political arena. However, whilst the Awami League was always willing, preparatory to going to the Assembly, to explain its constitutional position and to discuss alternative proposals from the other parties, it believed that the spirit of a true democracy demanded that the constitution be debated and finalised in the National Assembly rather than in secret sessions. To this end, it insisted on an early summoning of the National Assembly.

In anticipation of this session, the Awami League worked day and night to prepare a draft constitution based on Six Points and fully examined all the implications of formulating and implementing such a constitution. The first major talks over Pakistan’s political future took place between General Yahya and Sheikh Mujibur Rahman in mid-January. In this session General Yahya probed the extent of the Awami Legaue’s commitment to its programme and was assured that they were fully aware of its implications. But contrary to expectation Yahya did not spell out his own ideas about the consitution. General Yahya gave the impression of not finding anything serioulsy objectionable in Six Points but emphasised the need for coming to an understanding with the PPP in West Pakistan. The next round of talks took place between the PPP and the Awami League from 27th January, 1971 in Dacca where Mr. Bhutto and his team held a number of sessions with the Awami Lague to discuss the constitution. As in the case with Yahya, Mr. Bhutto did not bring any concrete proposals of his own about the nature of the constitution. He and his advisers were mainly interested in discussing the implications of Six Point. Since their responses were essentially negative and they had no prepared brief of their own it was not possible for the talks to develop into serious negotiations where attempts could be made to bridge the gap between the two parties. It was evident that as yet Mr. Bhutto had no formal position of his own from which to negotiate. It must be made clear that when the PPP left Dacca there was no indication from their part that a deadlock had been reached with the Awami League. Rather they confirmed that all doors were open and that following a round of talks with West Pakistani leaders, the PPP would either have a second and more substantive round of talks with the Awami League or would meet in the National Assembly whose commiltecs provided ample opportuity for detailed discussion on the constitution. Mr. Bhutto’s announcement to boycott the National Assembly therefore came as a complete surprise. The boycott desision was surprising because Mr. Bhutto had already been accommodated once by the President when he refused Sheikh Mujib’s plea for an early session of the Assembly on 15th February and fixed it,in line with Mr. Bhutto’s preference, for 3rd March. Following his decision to boycott the Assembly, Mr. Bhutto launched a campaign of intimidation against all other parties in West Pakstan to prevent them from attending the session. In this task, there is evidence that Lt. Gen. Umer, Chairman of the National Security Council and close associate of Yahya, with a view to strengthening. Mr. Bhuttto’s hand, personally pressurised various West Wing Leaders not to attend the Assembly. In spite of this display of presssure tactics by Mr. Bhutto and Lt. Gen.

Umer, all members of the National Assembly from West Pakistant,except the PPP and the Qayyum Muslim League had booked their seats to East Pakistan, for the session of 3rd March Within the QML itself, half their members had booked their seats and there were signs of revolt within the PPP where many members were wanting to come to Dacca. Faced with the breakdown of this joint front against Bangladesh, General Yahya obliged Mr. Bhutto on 1st March by postponing the Assembly, not for any finite period, but sine die. Moreover he dismissed the Governor of East Pakistan Admiral S. M.Ahsan, who was believed to be one of the moderates in his administration. The Cabinet with its component of Bengalis was also dismissed so that all power was concentrated in the hands of the West Wing military Junta. In these circumstances Yahya’s gesture could not be seen as anything but an attempt to frustrate the popular will by colluding with Mr. Bhutto. The National Assembly was the only forum where Bangladesh could assert its voice and political strength, and to frustrate this was a clear indication that Parliament was not to be the real source of power in Pakistan. The reaction to the postponement in Bangladesh was inevitable and spontaneous and throughtout the land people took to the streets to record their protest at this arbitrary act. People now felt sure that Yahya never really intended to transfer power, and was making a mockery of parliamentary politics. The popular mood fell that the rights of Bangladesh could never be realised within the framework of Pakstan, where Yahya could so blatantly frustrate the summoning of an Assembly proclaimed hy his own writ and urged that Sheikh Mujibur Rahman must go for full independence. Sheikh Mujib however continued to seek a political settlement. In calling for a programme of non-cooperation on 3rd March he chose the weapon of peaceful confrontation against the army of occuption as an attempt to bring them to their senses. This was itself a major gesture in the face of the cold blooded firing on unarmed demonstrators on the 2nd and 3rd March which had already led to over a thousand casualties. The course of the non-cooperation movement is now a part of history. Never in the course of any liberation struggle has noncooperation been carried to the limits attained within Bangladesh between Ist and 25th March. Non-cooperation was total. No Judge of the High Court could be found to administer the oath of office to the new Governor, Lt. Genral Tikka Khan. The entire civilian administration including the police and the Civil Service of Pakistan, refused to attend the office. The people stopped supply of food to the army. Even the civilian employees of the Defence establishment joined the boycott. Non-cooperation did not stop at abstention from work. The civilian administration and police positively pledged their support to Sheikh Mujibur Rahman and put themselves under his orders. In this situation the Awami League without being a formally constituted Government, was forced to take on the responsibility of keeping the economy and administration running whilst non-cooperation lasted. In this task they had the unqualified support not only of the people but the administration and business community. The latter two subordinated themselves to the directives of the Awami League and accepted them as the sole authority to solve their various problems. In these unique circumstances the economy and administration were kept going in spite of the formidable problems arising out of the power vacuum which had suddenly emerged in Bangladesh. In spite of the lack of any formal authority, Awami League volunteers in cooperation with the police maintained a level of law and order which was a considerable improvement on normal times. Faced with this demonstration of total support to the Awami League and this historic non-cooperation movement. General Yahya appears to have modified his tactics. On the 6th March. he still seemed determined to provoke a confrontation when he made his highly provocative speech putting the full blame for the crisis on the Awami League and not even referring to the architect of the crisis. Mr. Bhutto. It seems that he expected a declaration of Independence on 7th March. The Army in Dacca was put on full alert to crush the move and Li.Gen. Tikka Khan was flown to replace Lt. Yakub to signify the hardening of attitudes within the Junta. Sheikh Mujib, however, once again opted for the path of political set tlement in spite of massive public sentiment for independence. In presenting his 4-point proposal for attending the National Assembly he not only had to contain the public mood but to leave a way open for Yahya to explore this last chance for a peaceful settlement. It is now clear that Yahya and his Generals did not have the slightest intention of solving Pakistan’s political crisis peacefully but were only interested in buying time to permit the reinforcement of their military machine within Bangladesh. Yahya’s visit to Dacca was a mere cover for his plan of genocide. It now becomes clear that contingency plans for such a crisis had already begun well in advnace of the crisis. Shortly before 1st March tanks which had been sent north to Rangpur to defend the borders were brought back to Dacc. From 1st March the families of Army personnel were being sent off to West Pakistan on a priority basis along with the families of West Pakistani businessmen. The military build-up was accelerated after 1st March and continued throughout the talks up to 25th March. Members of the armed forces dressed in civilian clothes were flown in PIA commercial flights via Ceylon. C-130s carrying arms and provisions for the garrisons flew into Dacca. It is estimated that up to one division, with complementary support, was brought into Bangladesh between 1st and 25th March. To ensure security, the airport was put under strict airforce control and heavily guarded with artillery and machine-gun nets whilst movement of passengers was strictly supervised. An SSG Commando Group specially trained for undercover operations in sabotage and assassinations was distributed in key centres of Bangladesh and were probably responsible for the attacks on Bengalis in Dacca and Saidpur in the two days before 25th March to provoke clashes between locals and non-locals so as to provide a cover for military intervention. As part of this strategy of deception Yahya adopted the most conciliatory posture in his talks with Mujib. In the talks beginning on 16th Mach, he experssed regrets for what had happened and his sincere desire for a political settlement. In a crucial meeting wih Sheikh Mujib he was asked to positively state the Junta’s position on the Awami League’s 4-point piroposal. He indicated that there were no serious objections and that an ințerim constitution could be worked out by the respective Advisers cmbodying the four points. The basic points on which agreement was reached were (1) Lifting of Martial Law and transfer of power to a Civilian Governinent by a Presidential Proclamation.

(2) Transfer of power in the provinces to the majority parties. (3) Yahya to remain as President and in control of the Central

Govenment. (4) Separate sitting of the National Assembly members from East and

West Pakistan preparatory to a joint session of the House to finalise

the Constitution. Contrary to the distortions now put out by both Yahya and Bhutto the proposal for separate sittings of the Assembly was suggested by Yahya to accomodate Mr. Bhutto. He cited the practical advantage that whilst 6-points provided a viable blueprint to regulate relations between Bangladesh and the Centre its application would raise serious difficulties in the West Wing. For this reason West Wing MNA’s must be permitted to get together to work out a new pattern of relationships in the context of a Six-Point constitution and the dissolution of One Unit. Once this agreement in principle had been reached between Sheikh Mujib and Yahya there was only the question of defining the powers of Bangladesh vis-a-vis the Centre during the interim phase. Here it was again jointly agreed that the distribution of powers should as far as possible approximate to the final constitution based on ‘Six Points’. For working out this part of the interim settlement Mr. M. Ahmed, the Economic Adviser to the President was specially flown in. In his talks with the Awami League advisers he made it clear that provided the political agreement had been reached, there were no insuperable problem to working out some version of Six Points even in the interim period. The final list of the amendments to the Awami League draft which he presented as suggestions, indicated that the gap between the Government and Awami Leaguc position was no longer one of principle but remained merely over the precise phrasing of the proposals. The Awami League in its sitting of 24th March accepted the amendments with cerlain minor changes of language and there was nothing to prevent the holding of a final drafting session between the advisers of Yahya and Mujib when the interim constitution would be finalised. It must be made clear that at no stage was there any break down of talks or any indication by General Yahya or his team that they had a linal position which could not be abandoned. The question of legal cover for the transfer of power is merely another belated fabrication by Yahya to cover his genocide. He and his team had agreed that, in line with the precedence of the Indian Independence Act of 1947. power could be transferred by Presidental Proclamtion. The notice that there would be no legal cover to the arrangement raised subsequently by Mr. Bhutto and endorsed by General Yahya was never onc of contention between Sheikh Mujib and Yahya. There is not the slightest doubt that had Yahya indicated that a meeting of the National Assembly was essential to transfer power, the Awami League would not have broken the talks on such a minor legal technicality. After all as the majority party it had nothing to fear from such a meeting and its acceptance of the decision for a separate sitting was designed to accommodate Mr. Bhutto rather than a fundamental stand for the party. Evidence that agreement in principle between contending parties had been reched is provided by Mr. Bhutto’s own press conference on 25th March. It is not certain what passed in the separate session between General Yahya and Mr. Bhutto but there is evidence that deliberate falsehoods about the course of the talk with the Awami League were led to the PPP who were told that Sheikh Mujib was determined to have a showdown and was daily escalating his demands. Needless to say not the slightest indication of these misgivings had been raised in the meetings between the Awami League team and General Yahya’s advisers where amicability and optimisin prevailed to the end. Whilst hope for a settlement was being raised more ominous signs of the intentions of the army were provided by their sudden decision to unload the ammunition ships M. V. Swat berthed at Chittagong Port. Preparatory to the decision, Brigadier Mazumdar, a Bengali officer commanding the garrison in Chittagong had been suddently removed from his command and replaced by a West Pakistani. On 24th night he was flown to Dacca under armed escort and has probably been executed. Under the new command notice was given to local authorities of the decision to unload the ship inspite of the fact that the army had abstained from doing so for the last 17 days in the face of non-cooperation from the port workers. The decision to unload was a calculated provocation which immediately brought 100.000 people on the streets of Chittagong and led to massive firing by the Army to break their way out. The issue was raised by the Awami League with General Peerzada as to why this escalation was being permitted whilst talks were still going on. He gave no answer beyond a promise to pass it on to General Yahya. Following the final meeting helween General Yahya and Awami League’s advisers on 24th March where Mr. M. M Ahmed passed on his amendments, a call was awaited from General Pecrzada for a linal session where the draft could be finalised. No such call materialised and instead it was learnt that Mr. M. M. Ahmed who was central to the negoliations, had suddenly left for Karachi on the 25th morning without any warning to the Awami League team. By 11 P.M. of the 25th all preparations were ready and the troops began to take up their positions in the city. In an act of treachery unparallelled in contemporary history a programme of calculated genocide was unleashed on the peaceful and unsuspecting population of Dacca by midnight of 25th March. No ultimatum was given to the Awami League by Yahya, no curfew order was even issued when the machine guns, artillery and cannon on the tanks unleashed their reign of death and destruction. By the time the first Martial Law Proclamation issued by Lt. General Tikka Khan were broadcast the next morning, some 50.000 people, most of them without offering any resistance, and many women and children, had been butchered. Dacca had been turned into an inferno with fires raging in most corners of the city. Sleeping inhabitants who had been drawn from their homes by the fires started by the military, were machine-gunned as they tried to escape the flames. Whilst the Police, EPR, and armed volunteers put up a heroic resistance, the main vicims remained the weak, the innocent and the unsuspecting who were killed at random in their thousands. We are compiling a first hand account of the details of genocide committed by the Pakistani Army on the orders of the President of Pakistan which we will publish shortly. The scale of brutality of the action exceeds anything perpetrated in the civilised world. Yahya himself left Dacca on the night of 25th March after having unleashed the Pakistan Army, with an open licence to commit genocide on all Bengalis. His own justification for this act of barbarism was not forthcoming till 8. P.M. the next day when the world was given its first explanation for the unleashing of this holocaust. The statement was selfcontradictory and faced with positive lines. His branding of a party as traitors and outlaws, with whom he had only 48 hours ago been negotiationg for a peaceful transfer of power, bore no relationship to the situation in Bangladesh or the course of the negotiations. His promise to hand over power to the elected representatives of the people after banning the Awami League which was the sole representative of Bangladesh and held a majority of seats in the National Assembly was a mockery of the freely recorded voice of 75 million Bengalis. The crudity of the statement was clear evidence that Yahya was no longer interested in taking shelter of either logic or morality and had reverted to the law of the jungle in his bid to crush the people of Bangladesh Pakistan is now dead and buried under a mountain of corpses. The hun dreds and thousands of people murdered by the army in Bangladesh will act as an impenetrable barrier between West Pakistan and the people of Bangladesh. By resorting to pre-planned genocide Yahya must have known that he was himself digging Pakistan’s grave. The subsequent massacres perpetrated on his orders by his licensed killers on the people were not designed to preserve the unity of a nation. They were acts of racial hatred and sadism devoid of even the elements of humanity. Professional soldiers, on orders, violated their code or military honour and were seen as beasts of prey who indulged in an orgy of murder, rape, loot, arson and destruction unequalled in the annals of civilisation. These acts indicate that the concept of two countries is already deeply rooted in the minds of Yahya and his associates who would not dare commit such atrocities on their own countrymen. Yahya’s genocide is thus without political purpose. It serves only as the last act in the tragic history of Pakistan which Yahya has chosen to write with the blood of the people of Bangladesh. The objective is genocide and scorched-earth before his troops are either driven out or perished. In this time he hopes to liquidate our political leadership and public amenities and as a final act he intends to raze our cities to the ground. Already his occupation army has made substantial progress towards this objective. Bangladesh will be set back 50 years as West Pakistan’s parting gift, to a people they have exploited for twenty three years for their own benefit. This is a point of major significance to those great powers who choose to ignore this largest single act of genocide since the days of BergenBelsen and Auschwitz. If they think they are preserving the unity of Pakistan, they can forget it because Yahya himself has no illusion about the future of Pakistan. They must realise that Pakistan is dead-murdered by Yahya–and that independent Bangladesh is a reality, sustained by the indestructible will and courage of 75 million Bengalis who are daily nurturing the roots of this new nationhood with their blood. No power on earth can unmake this new nation and sooner or later both big and small powers will have to accept it into the world fraternity. It is, therefore, in the interest of politics as much as humanity for the big powers to put their full pressure on Yahya to cage his killers and bring them back to West Pakistan. We will be eternally grateful to the people of USSR and India and the freedom loving people of all the countries for the full support they have already given us in this struggle. We would welcome similar support from the People’s Republic of China,

USA, France and Great Britain and others. Each in their own way should exercise considerable leverage on West Pakistan; and were they to exercise this unfluence, Yahya could not sustain his war of aggression against Bangladesh for a single day longer. Bangladesh will be the eighth most populous country in the world. Its only goal will be to rebuild a new nation from the ashes and carnage left behind by Yahya’s occupation army. It will be a stupendous task because we are already one of the world’s poorest nations. But we now have a cause and a people who have been hardened in the resistance, who have shed their blood for their nation and won their freedom in an epic struggle which pitted unarmed people against a modern army. Such a nation cannot fail in its task of securing the foundation of its nationhood. In our struggle for survial we seek the friendship of all people, the big powers and the small. We do not aspire to join any bloc or pact but will seek assistance from those who give it in a spirit of goodwill free from any desire to control our destinies. We have struggled far too long for our self-determination to permit ourselves to become anyone’s satellite. We now appeal to the nations of the world for recognition and assistance-both material and moral in our struggle for nationhood. Every day this is delayed a thousand lives are lost and more of Bangladesh’ vital assets are destroyed. In the name of Humanity act now and earn our undying friendship. This we now present to the world as the CASE of the people of Bangladesh. No nation has a greater right to recognition, no people have fought harder for this right. A final word to our erstwhile brothers in West Pakistan. Before God we tried to preserve this nation of Pakistan in spite of the oppression, neglect and servitude inflicted on us by your rulers these 23 years. But your Leaders could neither tolerate the idea of sharing power with us nor would they let go of us sufficiently to let us control our own destinies. As a result, today, you—the people of West Pakistan are silent spectators to the genocide. being committed on the people of Bangladesh by your rulers. By their acts of mass murder in Bangladesh the name of Pakistan will rank with the Mongols, the Huns and the Nazis in the history books. On your conscience you will carry till eternity the curse of our murdered wives, our dishonoured sisters, our slaughtered children. But more destructive to you, you will carry till eternity the curse of this army of butchers with yur for years to come. By God’s grace and our unconquerable spirit every last man of this army of occupation will either be driven out or destroyed by the people of Bangladesh. Out of the ashes a new Bangladesh will rise committed to peace, democracy and social justice resting on secure foundations of creed, language, culture and race and held together by the shared experience of a struggle which must take its place in the epic struggles of our time. But you will be condemned to live under the bayonets of the Punjabi army. Sindhi, Pathan, Baluch and even the common man of Punjab will one day have to rise against these killers who must now hold down by military force your just aspirations. Bangladesh was your last hope for Democracy in Pakistan. In trying to suppress us you may have for years to come bound yourselves to military dictatorship. In your own interests as much as for the sake of humanity your must therefore rise in protest against this unjust war being waged by your army on the people of Bangladesh. Amercians have protested in their millions against their own government for their intervention in Viet Nam. British and French liberal opinion protested against the colonial wars waged by their governments. Now you the people of West Pakistan must voice your horror and oppose by all means at your command this attempt by your army to hold down the people of Bangladesh by force and commit genocide in the name of integration. “JOI BANGLA”

TAJUDDIN’S PLEA FOR ARMS AID Press report of Mr. Tajuddin Ahmad’s appeal on April 28, 1971 KOHIMA, April 28: The Bangladesh Prime Minister, Mr. Tajuddin Ahmad, today appealed to neighbouring countries to grant immediate recognition to Bangladesh and to give unconditional arms aid and thus help a new-born country to free itself from the clutches of a murderous army. In a message to the nation, broadcast over the Free Bangladesh Radio and monitored here, the Prime Minister urged his countrymen to drive away the invaders” who are causing bloodshed on our soil by the weapons purchased from the exploited money of our own countrymen” He said that Rangpur, Dinajpur, Faridpur, Bogra and Mymenshingh, (except Cantonment areas) had been liberated from the West Pakistan army and expressed confidence that the remaining areas would come under the Bangladesh Government shortly. Mr. Tajuddin Ahmad categorically told his countrymen that the time

was now ripe for “dividends to the untold sacrifices” made by lakhs of people in Banlgadesh. Referring to the innumerable youths, who had laid down lives for the cause of liberation the Prime Minister said their names would shine in the history of freedom fighters for all time to come. He also appealed to Bangalis residing in foreign countries to give all possible help to freedom struggle. (THE TIMES OF INDIA, New Delhi – April 29, 1971)

EVERY MAN AT HIS POST. SAYS TAJUDDIN AHMAD Text of Mr. Tajuddin’s 18-point directive on May 14, 1971 Mr. Tajuddin Ahmad, Prime Minister of Bangladesh, has issued an 18point directive outlining the tasks of the people in the liberation struggle. He has said that the people should not listen to rumours nor should they have doubts about the “ultimate victory of the people”. He says: “Let the people remember that, in war, marching forward and retreating are of equal importance. The retreat of the liberation army from one point should not give the people the impression that we have abandoned our war against the Pakistan occupation forces”. In the struggle, people are not divided on the basis of parties, religion or classes. “We are united as Bengalis, and our enemies look at us that way. When they burn villages, shoot people or destroy towns, they attack us as Bengalis, not caring for our religion or politics” “No Bengali employee should co-operate with the enemy; employees of all ranks should act according to the directive of the Bangladesh Government. In areas occupied by the enemy, they should work under the guidance of the popular representative and use their discretion as circumstances demand” At Their Posts Mr. Ahmad says: “Employees of Government and semi-Government organizations who have taken shelter elsewhere will be considered as holding their posts and are expected to help the Bangladesh Government and the Mukti Fauj according to their capacity” Officers and men of the military and para-military organizations, whether they are in service or retired, should immediately report for duty at the nearest liberation army unit and “should in no circumstances” allow themselves to be exploited by the enemy “nor should they co

operate with the enemy”. The directive says “only the Bangladesh Government and none else has the right to collect taxes, revenues and duties. It should be remembered that a paisa collected by the enemy will be used to kill you and your children. So anybody who will pay taxes to the enemy or help them in the matter will be considered by the Bangladesh Government as an enemy of the nation and will be punished accordingly”. Employees in the communication and transport system “should not cooperate with the enemy. At the first opportunity, they should vacate along with their means of transport, the enemy-held areas”. Proper attention should be paid to the food and commodity needs of the people and in this matter the people should be encouraged to produce more. “The people should remember that dependence on imported food or articles will be suicidal. There should be greater emphasis on farm produce, reliance on local available goods and production in cottage industry’ Under Watch The directive says that “in our national crisis, our number one enemies are those who are blackmarketers, profiteers, hoarders and thieves. They should be kept under watch and should be dealt with severely if necessary”: It adds: We should also be ever cautions about another kind of antisocial and criminal elements who are acting as traitors. They should be marked, because they are our bitterest enemy. In the name of religion and a united country, they are trying to mislead the simple people. They are really the agents of the West Pakistan vested interest”

EMERGENCE OF BANGLADESH Meanwhile, the Bangladesh Government has declared that all members of the former National Assembly will henceforth be called members of Parliament or MPs and those elected to the former provincial Assembly will be known as MLAs. The Awami League, in a directive published in the Party’s weekly Jai Bangla, has directed all Mps and MLAs to stay in their respective areas and help the liberation struggle. “If it appears absolutely impossible for an elected representative to stick to his constituency, he should move to the nearest liberation army unit and supervise training and arrange supplies for liberation fighters”, the party directive says. The MPs, and MLAs who have gone on the other side of the border into India should immediately act according to the Party directive. The

Awami League high command has ordered people who are young or middle-aged and have taken shelter in India should immediately enlist themselves for military training. “Those who have taken shelter in refugee camps on the other side of the border to save their lives should always keep it in mind that this is only a temporary arrangement. They have not gone to India for permanent settlement”. PTI adds from Mujibnagar ; Mr. A. H. Kamaruzzaman, Minister for Relief and Rehabilitation, yesterday announced the setting up of a liaison office to ensure “proper distribution of all available resources”. (THE STATES MAN, New Delhi-May 15, 1971)

FREEDOM AT ALL COSTS : TAJUDDIN Report of Mr. Tajuddin Ahmad’s interview with all India Radio on June 2, 1971 The Bangladesh Prime Minister, Mr. Tajuddin Ahmad said in Mujibnagar today that Bangladesh “is sovereign and independent and its people will defend its separate and free entity at all costs”. In an interview with All-India Radio, Mr. Ahmad reiterated “our irrevocable commitment to a policy of friendship for all, especially our neighbours irrespective of variations in the response of world Powers to our present difficulties. “Beyond this it is not possible to define too rigidly the foreign policy of a two-month-old State”, Mr. Tajuddin said in reply to a question. He added: “There are encouraging developments and no final judgment need be made on the long-term developments.”

EMERGENCE OF BANGLADESH The Prime Minister said that any attempt, if made, to instal a puppet government in Dacca, will certainly be abortive for “no collaboration between the killers and the quislings will be tolerated by the people of Bangladesh who are struggling for securing and protecting their independence” Asked about Pakistan Government’s claim that Sheik Mujibur Rahman had been taken to Dacca and that he had urged the people to co-operate with the army, Mr. Ahmad said: “We do not know where exactly Sheikh Sahib has been detained by the Pakistan Government. But the claim that has urged the people to co-operate with the army of Pakistan should be rejected with utmost contempt. The claim is preposterous’

Mr. Ahmad said his Government had approached the United States for intervening for a political settlement. “We should like to make it absolutely clear to everyone that there is no room for compromise within the framework of Pakistan, Banlgadesh is soverign and independent and we shall defend its separate and free entity at any cost” Big Powers’ silence Asked what was his Government’s feeling about the silence or ambivalence of big Powers, especially the U.S.A., the United Kingdom and the Soviet Union, Mr. Ahmad replied ; “Our friendship for all” policy shall continue to guide our foreign policy irrespective of the variations in the response of world powers to our present difficulties. He said the work of the emissaries sent by his Government abroad was bearing fruit in creating favourable lobbies in these areas and in organising public opinion in favour of Bangladesh. Asked about the present functioning of his Government, Mr. Tajuddin said, it never lost contact with the vast rural areas of Bangladesh and “we are in contact with cities and towns in occupied areas through our local leadership cadres. We have set up an administrative machinery for the areas within our control as well as a centralised command for all operations aimed at driving the enemy out. Questioned about the reported activities of the Leftist forces in Bangladesh, Mr. Ahmad said that as far as Bangladesh was concerned” we do not know of any problem of Leftist forces. Only the other day a nationwide election was held and the people of Bangladesh rose as one man in support of their demands. And also all people, irrespective of their political opinions, and all patriotic elements are rallying together to give their unstinted support for the cause of the independence of Bangladesh He added: “Maulana Bhashani of the National Awami Party and other patriotic leaders and elements have already held out their unqualified support to the struggling people and the Bangladesh Government and demanded its recognition by other countries” (THE TIMES OF INDIA, New Delhi – June 3. 1971)

জয় আমাদের সুনিশ্চিত ঃ তাজউদ্দিন আহমদ জাতির উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের বেতার ভাষণ জুন ১৩, ১৯৭১ বাংলাদেশ বেতার থেকে প্রচারিত আমার প্রিয় দেশবাসী ভাইবােনেরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একাদশ সপ্তাহ শেষ হয়েছে। এই সংগ্রামের মাধ্যমে আমাদের বীর নরনারী অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে স্বাধীনতা লাভের দুর্জয় সংকল্প প্রকাশ করেছেন। নিরস্ত্র জনসাধারণের উপর বিশ্বাসঘাতকতামূলক আক্রমণ চালিয়ে দ্রুত জয়লাভের ভরসা করেছিল শত্রুরা, কিন্তু বীর মুক্তি-সংগ্রামীরা তাদের সে কল্পনাকে ধুলিসাৎ করে দিয়েছে। বিপুলসংখ্যক শত্রু সৈন্য হতাহত হওয়ায় আমাদের প্রতিরক্ষামূলক অভিযানের সাফল্য যেমন প্রমাণিত হয়েছে তেমনি প্রমাণিত হয়েছে ইসলামাবাদের শাসকচক্রের মারাত্মক হিসেবের ভুল। তারা ভেবেছিল যে সর্বাত্মক ভীতি প্রদর্শন ও নির্বিচারে হত্যা করে বাংলাদেশকে পদানত রাখা যাবে। স্বাধীনতা লাভে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ জাতির সংকল্প বিনাশের এ সব পরিকল্পনা কাজে লাগেনি। দখলদারী শত্রুরা এক নিদারুণ অবস্থায় পড়েছে। তাদেরকে লােক ও রসদ আনতে হয় বিমানপথে কয়েক হাজার মাইল দূর থেকে। আমাদের মুক্তিফৌজ আবার প্রত্যহ আক্রমণ চালিয়ে শত্রুর সরবরাহ ও যােগাযােগ ব্যবস্থার গুরুতর বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। সৈন্য ও অস্ত্রবলে শত্রুরা কয়েকটি জেলা শহর ও ছাউনি এলাকা পুনর্দখল করেছে বটে। কিন্তু এ ধরনের যুদ্ধে এটা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি নয়। শত্রুর যা লাভ হয়েছে তা আবার ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জনসাধারণের ক্রমাগত অসহযােগিতার ফলে। হানাদারদের ভীতি প্রদর্শন ও প্রলােভন সত্ত্বেও কোথাও কোন বেসামরিক শাসন ব্যবস্থার লক্ষণ নেই। কল-কারখানার চাকাও ঘােরেনি। সর্বস্তরের মানুষের সামগ্রিক অসহযােগিতার ফলে হানাদারগণ যে চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে তার থেকে উদ্ধার পাওয়া বৈদেশিক সাহায্য ছাড়া তাদের পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু তাদের সাহায্যের আবেদন কোন দেশে সাড়া জাগাতে পারেনি। তারা এখন বাজার থেকে উঠিয়ে নেবার নামে বিনিময় মূল্য না দিয়েই একশ ও পাঁচশ টাকার নােট জমা দিতে জনসাধারণকে বাধ্য করেছেন। এতে তাদের অর্থনৈতিক দেউলিয়াপনার স্বীকৃতিই যে শুধু মিলছে তা নয়, সাধারণ মানুষকে লুট করে ইসলামাবাদের শূন্য তহবিল পূরণের জঘন্য কারসাজিও প্রকাশ পাচ্ছে। কায়িক ও নৈতিক শক্তির তুলনায় শত্রুপক্ষ নিজেকে খুব বেশি জড়িয়ে ফেলেছে। এটাই নিঃসন্দেহে তার ধ্বংসের কারণ হবে।

পশ্চিম থেকে পুবে এসে এই বিদেশী সৈন্য যা দখল করেছে তা তারা আয়ত্তে রাখতে পারবে না। সুপরিকল্পিত হত্যা, লুণ্ঠন ও ধর্ষণের নীতি গ্রহণ করে তারা নিজেদেরকে চিহ্নিত করেছে মানুষের শত্রু ও সভ্যতার শত্রু রূপে। তাদের আর জনসাধারণের মাঝে রয়েছে ঘৃণার সমুদ্রের ব্যবধান। এই কারণেই আমাদের গৃহীত গেরিলা পদ্ধতির আক্রমণে শত্রুপক্ষের এত ক্ষতি হচ্ছে। শত্রুরা যেখানে যাচ্ছে সেইখানেই তারা মারাত্মক নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিচ্ছে। এর একটা কারণ এই যে, শত্রুর মনে ভয় ঢুকেছে। তারা ভয় পেয়েছে। কারণ, তারা জানে যে তারা হারছে। ইসলামাবাদের ঔপনিবেশিক সৈন্যবাহিনীকে বীরত্বের সঙ্গে বাধা দেবার জন্য বাংলাদেশের জনসাধারণকে আমি অভিনন্দন জানাই। তাদের সাহস ও আত্মত্যাগ পৃথিবীর সকল দেশের স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষের হৃদয়কে নাড়া দিয়েছে এবং তাদের শ্রদ্ধা অর্জন করেছে। শত্রুপক্ষের সৈন্যবাহিনী সংখ্যায় বিপুল এবং উন্নত ধরনের অস্ত্রশস্ত্রে আদ্যপান্ত সজ্জিত। এ সত্ত্বেও মুক্তিবাহিনী তাদেরকে শাস্তি দিতে সক্ষম সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রত্যহ বহুসংখ্যক তরুণ সামরিক শিক্ষা নিতে এগিয়ে আসছে। এরা একটা আদর্শের জন্য লড়াই করছে। নিজের দেশ শাসন করার অনস্বীকার্য অধিকার ও সম্মানের সঙ্গে নিজ বাসভূমে বেঁচে থাকবার জন্য এরা লড়াই করছে, এরা লড়ছে দেশের মাটির জন্য, লড়ছে নিরপরাধ জনসাধারণকে হত্যার প্রতিশােধ নেবার জন্য। লড়ছে মা, বােনদের বেইজ্জতির প্রতিকারের জন্য। আর পশ্চিম-পাকিস্তানী সৈন্যরা যুদ্ধ করছে ঔপনিবেশিক সুবিধা রক্ষার জন্য। এক দিকে লুণ্ঠনের পাশবিক রূপ, অন্য দিকে একটি জাতির স্বাধীনতা লাভের সর্বাত্মক আকাঙ্ক।

এই যুদ্ধে জয় যে আমাদের হবে তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। গত কয়েক সপ্তাহের ঘটনায় সারা পৃথিবীর মর্মাহত মানুষের কাছে বাংলাদেশের জনসাধারণের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের মারাত্মক ষড়যন্ত্রের পরিচয় উদঘাটিত হয়েছে। এই ষড়যন্ত্রের মূল কথা হচ্ছে ব্যাপক গণ-হত্যার মাধ্যমে একটি জাতিকে ধ্বংস করা। সুপরিকল্পিতভাবে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি, ত্রাসের রাজত্ব চালিয়ে ও পােড়ামটি নীতি অবলম্বন করে বিপুলসংখ্যক বাঙ্গালিকে ভারতে ঠেলে দেওয়া ও দুনিয়ার কাছে তাদেরকে অনুপ্রবেশকারী আখ্যা দেওয়া। বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। বর্তমান অর্থনৈতিক ভিত্তি ধ্বংস করা এবং ভবিষ্যৎ উন্নয়নের পথ রােধ করা। এ সবের উদ্দেশ্য হল একটি, পশ্চিম-পাকিস্তানের সামরিক প্রভু ও পুঁজিপতিদের কাছে বাঙ্গালিদেরকে সম্পৰ্ণরূপে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দাসে পরিণত করা। উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য যে সব পন্থা তারা গ্রহণ করেছে তাকে বর্বরতা বললে যথেষ্ট বলা হয় না। পাশবিক বললেও পশুদের প্রতি অন্যায় করা হয়। তবে এ সব উদ্দেশ্য ও পন্থা থেকে আমাদের শত্রুর প্রকৃতি অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বোেঝ যায়। পৃথিবীর মানুষ বুঝুন অন্য কোন কারণে নয়, বর্বর একনায়কত্বের বিরুদ্ধে আমরা গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করছি। মানব জাতির একটি বিরাট অংশ এ দেশের এক ন্যায্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পক্ষে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করেছেন। আমরা সেই দাবি প্রতিষ্ঠার জন্যে সংগ্রাম করছি। পাকিস্তান বলতে যা বােঝাতে সেখানে সামরিক বাহিনী, আমলাতন্ত্র ও বড় ব্যবসায়ীদের একটি ক্ষুদ্র গােষ্ঠী যারা সবাই পশ্চিম পাকিস্তানী, এতকাল দেশের সংখ্যাগুরু পূর্বাঞ্চলকে শাসন করে এসেছে। এক ঐতিহাসিক নির্বাচনে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ সর্বসম্মতভাবে যে রায় দিয়েছে তাতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে তারা তেইশ বছরের এই ঔপনিবেশিক দাসত্বের অবসান ঘটানাের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

সংখ্যালঘু শাসকচক্রের প্রতিনিধি ইয়াহিয়া ও ভুট্টো গত ডিসেম্বরে এই নির্বাচনী রায় মেনে নিতে কার্যতঃ অস্বীকার করেন। আমাদের শাসনতান্ত্রিক দাবির জবাবে তারা কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতারণামূলক আলােচনা চালাবার পরে সে আলােচনার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি বা ব্যর্থতা ঘােষণার আগেই পঁচিশ মার্চ রাতে বাংলাদেশের নিদ্রিত মানুষের উপর ট্যাঙ্কের আক্রমণ চালালেন। এর পরবর্তী ঘটনা ইতিহাসের অন্তর্গত। এখন আমরা জানি চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ বােঝাই সৈন্য আমদানি করার জন্য যত দিন সময়ের প্রয়ােজন ছিল শুধু ততদিনই আলােচনা চলেছে। বাংলাদেশের চির নিরস্ত্র বেসামরিক জনগণকে হত্যা করার অনেককাল পরে এই অত্যাচারের কৈফিয়ত হিসাবে বাঙ্গালির হাতে অবাঙ্গালি নিধনের কাহিনী উদ্ভাবন করা হয়। ইয়াহিয়ার ক্রমাগত অসংলগ্ন ও পরস্পর বিরােধী মিথ্যা-ভাষণের একটি হল শেখ মুজিব তাকে ঢাকায় গ্রেপ্তার করতে চেয়েছিলেন। অথচ ঢাকায় তিনি সর্বক্ষণ তার জেনারেলদের নিরাপদ আবেষ্টনীর মধ্যে বাস করছিলেন। পঁচিশ মার্চ রাতে সামরিক বাহিনীর কাপুরুষােচিত আক্রমণে ছাত্র, শিক্ষক, বস্তিবাসী, শ্রমিক, রিকশাওয়ালা এবং বাঙ্গালি সৈন্য, পুলিশ, সীমান্ত রক্ষীদেরকে ব্যাপকভাবে হত্যা করা হয়। এখন বলা হচ্ছে, শেখ মুজিবের লােকেরা ছাব্বিশ মার্চ সকালে ঢাকা ও চট্টগ্রাম দখল করার পরিকল্পনা করেছিল। সে পরিকল্পনায় বাধা দেবার জন্য এই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু সমগ্র দেশবাসীর বিরুদ্ধে ইয়াহিয়া যে সামরিক তৎপরতা চালিয়েছেন তাকে আগাম ব্যবস্থা হিসাবে গণ্য করা চলে না। এ সব মিথ্যা এতই অপটু যে তা দিয়ে পৃথিবীর কাছে প্রকৃত সত্য গােপন করা যায়নি, আর সে সত্য হচ্ছে এই যে, দেশের সংখ্যাগুরু মানুষের আত্ম-শাসনের অধিকার। অস্বীকার করাই হচ্ছে পশ্চিম-পাকিস্তানী সৈন্যদের প্ররােচনাহীন সামরিক তৎপরতার কারণ। বাংলাদেশে আজ অশুভ শক্তির যে তাণ্ডব চলছে তাতে বৃহৎ শক্তিবর্গের দায়িত্ব অনস্বীকার্য। পাকিস্তানকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য দিয়ে এবং তার ব্যবহারের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে তা তারা পাকিস্তানের একনায়কত্ববাদী শাসনের প্রতিষ্ঠা এবং পুঁজিবাদী হামলাতান্ত্রিক সামরিক চক্রের অভ্যুত্থানের সহায়তা করেছেন।

গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের অধিকার ক্ষুন্ন করে তারা এই চক্রের পত্তন ও ফ্যাসিবাদী সামরিক শক্তির বিকাশ ঘটিয়েছেন। তাদেরকে আগে উপলব্ধি করতে হবে যে, ইয়াহিয়া খানের হাতে আজ যে রক্ত লেগেছে তার দাগ তাদের হাতকেও স্পর্শ করেছে। আমেরিকার জনসাধারণও আজ বুঝতে পেরেছেন যে, তাদের দেয়া অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্যের ফলেই বাংলাদেশে এই ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হতে পেরেছে। বৃহৎ শক্তিবর্গের কাছে বাংলাদেশের নির্যাতিত মানুষের নামে আমার আবেদন, গণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে তারা যেন রক্তপিপাসু সামরিক অধিনায়কত্ববাদকে আর শক্তিশালী না করে তােলেন। তাদের কাছে আমার আবেদন, বাংলাদেশ থেকে দখলদার সামরিক বাহিনী তুলে না নেওয়া পর্যন্ত তারা যেন প্রত্যক্ষভাবে অথবা বিশ্বব্যাংক বা বিশ্বঅর্থ তহবিলের মাধ্যমে ইসলামাবাদ সরকারের বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক কাঠামাে সারিয়ে তােলার চেষ্টা না করেন। এ কথায় কারাে যেন সন্দেহ না থাকে যে, ইসলামাবাদকে কোনরকম সাহায্য দেবার অর্থ পাকিস্তানের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করা এবং সে শক্তি বাংলাদেশের মানুষকে দমন করার কাজেই শুধু ব্যবহৃত হবে। সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা চালিয়ে ও পােড়ামাটি নীতি অনুসরণ করে বাংলাদেশকে জনশূন্য করার যে চক্রান্ত করেছে পাকিস্তান তার কয়েকটি দিক আছে। বাঙ্গালি অবাঙ্গালি বিরােধ সৃষ্টি করে তারা সে উদ্দেশ্য হাসিল করতে চেয়েছিল এখন ইচ্ছাকৃতভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার চেষ্টা করে তারা তাই সিদ্ধি করতে চাচ্ছে। কিন্তু দেশবাসী জানেন যে, আমাদের সংগ্রাম জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বাংলাদেশের সকল মানুষের সংগ্রাম এবং আজ যারা সাম্প্রদায়িতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেশের পরিবেশ কলুষিত করার চেষ্টা করছে তারা শত্রুর চর ছাড়া আর কিছু নয়।

শক্রর এসব চরকে আমরা ক্ষমা করবাে না। সামরিক বাহিনীর ছত্রছায়ায় যে সব সমাজবিরােধী লুটতরাজ ও অত্যাচার-উৎপীড়ন চালাচ্ছে, তাদেরকে সমুচিত শাস্তি দেওয়া হবে। লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুকে ভারতের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে তার অর্থনীতির উপর চাপ সৃষ্টি করতে পাকিস্তান সক্ষম হয়েছে। যে বিপুলসংখ্যক যুদ্ধপীড়িত নিমূল নরনারী ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে তাদের ভরণপােষণের জন্য ভারত যা করছে তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। আন্তর্জাতিক সাহায্যের জন্য জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের বিবৃতিতে বাংলাদেশের গণ-হত্যা ও পাশবিকত্বের প্রচণ্ড পরােক্ষ স্বীকৃতি রয়েছে। দুঃখের বিষয় এই বিলম্বিত আবেদন সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক সাহায্যের পরিমাণ অপ্রতুল, এর উপর বর্ষাকাল আগত। মহামারিতে অবর্ণনীয় দুর্দশা হচ্ছে। মানুষের। ভারত একাই এই সমস্যার ভার বহন করছে। অবশ্য বিশ্ব বিবেক যে নাড়া খেয়েছে তার পরিচয় সম্প্রতি পাওয়া যাচ্ছে। অত্যাচারিত হয়ে যারা বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে চলে গেছে এবং দেশের অভ্যন্তরে যারা দুর্ভিক্ষে পীড়িত হচ্ছে তাদের জন্য আমরা সকল দেশের মানুষের কাছে সকল প্রকার সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছি। তবে এই সাহায্য সামগ্রী যাতে হানাদার সরকারের হাতে না পড়ে সে ব্যবস্থা তাদেরকে করতে হব। নইলে এই সাহায্য সামগ্রী ব্যবহৃত হবে। নিরপরাধ মানুষ হত্যার কাজে। আমি এ কথা সবাইকে জানাতে চাই যে, বাংলাদেশের শরণার্থীরা দেশে ফিরে আসতে উদ্গ্রীব। তাদের প্রত্যাবর্তনের সময় ত্বরান্বিত করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের তরুণেরা বিপুলসংখ্যায় মুক্তিবাহিনীতে যােগ দিচ্ছে। তারা জানে যে, স্বজনদের দেশে ফিরিয়ে আনার এটাই একমাত্র উপায়।

বর্বর শক্তির জোরে যারা তাদেরকে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছে তাদের মর্জির উপর নির্ভর করে নয়। বাংলাদেশ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, পঁচিশ মার্চ থেকে বাংলাদেশের যে সকল নাগরিককে তাদের ঘর-বাড়ি, জমি-জমা ও বিষয় সম্পত্তি থেকে বেআইনীভাবে উৎখাত করা হয়েছে, মুক্ত স্বদেশে তার সবই তাদেরকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। বাংলাদেশের গণ-প্রজাতন্ত্রী সরকারকে স্বীকৃতি দেবার জন্য আমরা পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানাচ্ছি। জনসাধারণের স্বাধীন ইচ্ছার ভিত্তিতে গঠিত এই সরকারই দেশের একমাত্র প্রতিনিধি। পশ্চিম-পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করে আমাদের জনগণ স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছে। আমাদের জনসাধারণ যে নির্যাতন ভােগ করছে, তার তুলনা পৃথিবীর ইতিহাসে খুব বেশি নেই। কিন্তু শুধু সে জন্য নয়, আমাদের প্রতিনিধিত্বমূলক চরিত্রের জন্যেই আমরা স্বীকৃতি দাবি করছি। আমাদের সংগ্রাম সম্পর্কে যে সমস্ত সরকার এখনও কোন স্থির মনােভাব গ্রহণ করেন নি, যারা মাত্র মুখে এর প্রতি সমর্থন দিয়েছেন এবং যারা এর বিরােধিতা করছেন তাদের সবাইকে আমি জানাতে চাই যে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে এবং সাড়ে সাত কোটি মানুষের ইচ্ছাশক্তিতে সেই স্থান তার স্থায়ী হবে। মানব জাতির বৃহৎ এই অংশকে স্বীকৃতি না দেওয়া কি যুক্তিসংগত ? অথবা এ সব রাষ্ট্রের স্বার্থের অনুকূল ? বাংলাদেশের মুক্তি-সংগ্রামের জন্য পৃথিবীর সকল দেশের কাছে আবার আমি অস্ত্র সাহায্যের জন্য আবেদন জানাচ্ছি। যে সব মুসলিম ও আরব ভাইরা এখনও বাংলাদেশের গণ-হত্যার নিন্দা করে উঠতে পারেন নি, তাদের কাছে আমার একটি বিশেষ নিবেদন আছে। ইয়াহিয়ার সৈন্যরা বাংলাদেশে ইসলামি ন্যায় নীতির জন্য যুদ্ধ করছে এ রকম ধারণা তাদের পক্ষে এক দুর্ভাগ্যজনক ভ্রান্তি। জনসাধারণের ইচ্ছা ও মানব অধিকারকে বর্বরােচিতভাবে দমন করে তিনি ইসলামের দোহাই দিচ্ছেন।

যে সংহতি নিজে ভেঙেছেন শকুন দিয়ে মুসলমানের লাশ খাইয়ে, এখন তিনি ইসলামের নামে সেই সংহতি বজায় রাখার চেষ্টা করছেন। মুসলিম রাষ্ট্রসমূহে আমাদের সংগ্রাম সম্পর্কে নীরবতার অর্থ ঔপনিবেশিকতাবাদ ও বর্বরতার নিন্দা থেকে বিরত থাকা। আরবরা স্মরণ করে দেখুন, কিভাবে মুসলিম তুর্কীদের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তারা মুক্তি সংগ্রাম করেছিলেন। পশ্চিম-পাকিস্তানী ঔপনিবেশিকতাবাদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই তারই অনুরূপ। যে পর্যন্ত না শত্রু শেষ হয় বা তারা দেশের মাটি থেকে সরে যায় ততদিন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে বাংলাদেশের মানুষ বদ্ধপরিকর। ঔপনিবেশিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশসমূহের সংগ্রামকে আমরা যেভাবে সমর্থন করেছি, আমাদের সংগ্রামকেও সেভাবে সমর্থন করার জন্য আমরা তাদের কাছে আবেদন জানাই। বৃহৎ শক্তিবর্গের কাছে আমাদের আবেদন দূরদৃষ্টির হিসাব ফেলে ন্যায় ও গণতন্ত্রের পক্ষ সমর্থন করুন। দশ লক্ষ লােকের হত্যা ও পঞ্চাশ লক্ষ লােকের বিতাড়ন কোন সরকারের ঘরােয়া আমােদ বলে বিবেচিত হতে পারে না। আপনাদের দেওয়া সাহায্য যেন আর বাংলাদেশের শান্তিকামী স্বাধীনতাপ্রিয় ও গণতন্ত্রী মানুষের প্রতি কৃত অন্যায়কে আরও বাড়িয়ে না তােলে। বরঞ্চ ইসলামাবাদের উন্মাদ শাসক চক্রের শুভবুদ্ধি জাগ্রত করার চেষ্টায় আপনাদের প্রভাব প্রয়ােগ করুন। বাংলাদেশের জনসাধারণের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। নিরাপত্তা বিধান ও মুক্তি সাধনের ব্যবস্থা অবলম্বন করুন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের এই সংগ্রাম দেশের পুষ্পপত্রের মত মাটি থেকে উদ্ভূত। যে অসহনীয় রাজনৈতিক সম্পর্ক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশ ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রকে বিপর্যস্ত করছিল সেই সম্পর্কের অবসান ঘটাবার জন্য জনসাধারণের ইচ্ছা থেকেই এর উৎপত্তি। একে ভারতের প্ররােচনা বলে পাকিস্তান যে প্রচারণা চালাচ্ছে তা তার সুপরিচিত কৌশল। বাংলাদেশের সকল দাবি সম্পর্কেই এ রকম প্রচারণা হয়েছে, এতে আর কেউ কান দিচ্ছে না। এটা বলা দরকার যে, জাতিগত প্রয়ােজনের ভিত্তিতে আমাদের আন্দোলন গড়ে ওঠেনি।

কোন সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত গােষ্ঠীর বিরুদ্ধেও এই আন্দোলন নয়। বাংলাদেশের যে সব নাগরিকের ভাষা বাংলা নয়, তাদের কাছে আশা করব যে, তারা যেন শক্রর সঙ্গে হাত না মেলান অথবা নিজেদেরকে যেন হানাদার শাসক গােষ্ঠীর সগােত্র বিবেচনা না করেন। আমরা জানি অনেক পশ্চিম-পাকিস্তানী সৈন্যকে বিশেষ করে সিন্ধী, বালুচী ও পাঠান সৈন্যকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনেক লজ্জাজনক ও নিষ্ঠুর কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। আমি তাদের কাছে আবেদন জানাই তারা যেন এ রকম অমানবিক কাজ করতে অস্বীকার করে সৈনিকের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখেন এবং অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে আমাদের পাশে এসে দাড়ান। আমাদের মুক্তিফৌজ এখন শক্রর মৃত্যুর ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে বাংলাদেশের জলায়, জঙ্গলে, নদীতে, পথে প্রান্তরে। রক্ত দিয়ে তারা আমাদের জাতিগত পরিচয়ের চিহ্ন অঙ্কন করেছে। যে নতুন রাষ্ট্রে আমাদের ভবিষ্যৎ নিহিত তার জন্যে সংগ্রাম করছে। তারা। তাদের সাহস, আত্মােৎসর্গ ও কষ্ট স্বীকারের ক্ষমতা সকল মুক্তিযােদ্ধার কাছে। আদর্শ স্বরূপ হয়ে রইবে। তাদের সাফল্য আসলে তাদের আত্মিক বলের জয়। এত কম উপকরণ নিয়ে এত নিষ্ঠুর শক্তিশালী শত্রুর বিরুদ্ধে আর সংগ্রাম হয় নি। আমি তাদেরকে জানাতে চাই যে, সারা জাতির চিত্তে তারা বিরাজ করছে এবং প্রতিটি মানুষ তাদের সাফল্যের জন্য প্রার্থনা করছে। বীর দেশবাসী, এই সংগ্রামে আপনারা দুঃখ বরণ করেছেন, গৌরবও অনুভব করেছেন। এই দ্বৈত ধারায় আপনাদের বল বেড়েছে, শক্রর শক্তি কমেছে। তার নৈতিক ও আর্থিক শক্তি বিনষ্ট। তার উপস্থিতি বিকৃত। আমাদের কষ্টের কাল সংক্ষেপ করার জন্য একযােগে সকল ক্ষেত্রে শত্রুকে আক্রমণ করতে হবে রপ্তানি।

দ্রব্য, পণ্য দ্রব্য যেন শক্রর হাতে না পড়ে আপনাদেরকে তা দেখতে হবে। যে সব বিশ্বাসঘাতক শত্রুর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে তাদেরকে শাস্তি দিতে হবে। যে মুক্তিফৌজ দেশের বাতাসকে কলুষমুক্ত করছে তার সঙ্গে একাত্মতা রক্ষা করতে হবে। আমার আপনার এ সংগ্রামে সংগ্রামী সাথীদেরকে সাহায্য করুন। সাম্প্রদায়িক ও দলীয় সম্প্রীতির বিনাশে শত্রুর চরদের কার্যকলাপ সম্পর্কে সতর্ক হােন এবং নিজেদের ন্যায্য লক্ষ্য ও অবশ্যম্ভাবী বিজয় সম্পর্কে আস্থা রাখুন। জয় আমাদের সুনিশ্চিত। জয় বাংলা।

BANGLADESH PM’S PLEA FOR AID, RECOGNITION Bangladesh Prime Minister Mr. Tajuddin Ahmad’s appeal to Nations, dated June 13, 1971 Bangladesh Prime Minister Tajuddin Ahmad, today called upon the Big Powers, “in the name of the wronged people of Bangladesh”, not to “interfere”, in favour of a “blood-thirsty Pakistan against the forces of democracy” “I urge them also not to try to prop up the crumbling economic base of the oppressive Government at Islamabad either, directly or through the World Bank and the IMF, unless it withdraws its occupation army of Bangladesh. Let there be no doubt anywhere that aid given to Islamabad now will be sucked, in cynical and devious ways, into its war machine and used to hold down the people of Bangladesh”, Mr. Ahmad said in a broadeast to the nation from the Swadhin Bangla Betar Kendra. Renewing his appeal to the wold for arms for the freedom fighters of Bangladesh, Mr. Ahmad said they were fighting for democracy against a brutal dictatorship to uphold the freely expressed wishes of a vast section of mankind for a just political and economic order. Appealing to the nations of the world to accord recognition to the People’s Republic of Bangladesh, the Prime Minister said this Government alone represented legitimacy” in our land, founded, as it is upon the freely expressed will of its people. Our people have completely repudiated the colonial rule based in West Pakistan and are now fighting to defend their freedom”, he said. Appeal to Arabs Mr. Ahmad said “their case for recognition was based on this rather then on their suffering which had few parallels in history” I should like to assure those who have taken no position on our struggle or been only lukewarm towards it or opposed it outright, that the People’s Republic of Bangladesh is on the map of the world and the determination of its 75-million people will keep it there” “Is it rational in the interest of the nations to ignore so vast a section of mankind?” he asked. In a special word to those in other Muslim and Arab countries who had not yet found it possible to condemn the mass slaughter in Bangladesh, the Prime Minister said “It is a tragic error on their part to think that Yahya’s hordes are waging a war of Islamic righteousness in Bangladesh. Their silence, therefore, condones colonalism and barbarism, their moral in some cases barely concealed. Material support to

Islamabad puts them on the side of dictatorship and its well-document ed crimes of arson, loot, rape and murder”. Mr. Ahmad said “I want the Arabs to recall how they once fought to free themselves from the colonial rule of the Turks who were Muslims. Our struggle against West Pakistan-based colonialism is exactly analogous to their struggle against the Turks not very long ago”. Support sought Reminding the foreign countries that the people of Banlgadesh had vowed to continue the war till the enemy was liquidated or forced to withdraw from their soil, Mr. Ahmad urged the nations of Asia, Africa and Latin America to support their struggle in the same way as, we supported their struggle against colonialism and imperialism. We say to the Big Powers “Please step out of the strait-jacket of your short-sighted prudence and come out on the side of justice and democracy”. “You cannot regard massacres involving 75-million people and forcing five million to move out of their homes into another country as the private amusement of any government. Do not use your aid to aggravate the monumental wrong done to a peace and freedom-loving democratic people, Instead, use the lever to bring the paranoiacs in Islamabad to their senses”, he added. Mr. Ahmad said the war of liberation was now in its 11th week and the valiant freedom fighters had put despair into Yahya’s heart. The staggering casualty figure of the West Pakistan army testified to the success of the defensive operations. The twin methods of massive terror and murder had not succeeded in breaking the will of a nation determined to fulfil its destiny in freedom. The usurping enemy, on the other hand was in a hopeless mess. He said the refusal of the people to co-operate had resulted in an economic crisis which the military junta could not resolve without foreign aid. They had now resorted to demonetization of Rs. 100 and Rs. 500 currency notes without paying their value. This was not only a plain admission of their economic desperation but a shameless attempt to rob the people of what was theirs in order to replenish the void in Islamabad’s coffers. Right cause Congratulating the people of Banlgadesh on their heroic resistance, the Prime Minister said in the new phase of their struggle, the freedomfighters were better organized and their ranks were swelling with new recruits. And they had a cause Their inalienable right to govern them

selves and live with dignity in their own land. The aim of the genocide, driving out the people of Bangladesh. the climination of the intellectual and political leadership and the destruction of the present economic base was a complete political and economic subjugation of the Bengalis to the military lords and capitalists of West Pakistant, he said. “lo say that the methods employed by them (West Pakistan) to achieve their objectives is barbarous is inadequate. To call them bestial is a little unfair to some beasts”. “These methods and these objectives, however make absolutely clear the nature of our enemy and the cause we are fighting for. We want the world to understand that we are fighting for nothing less than our existence as a nation”, Mr. Ahmad added. Mr. Ahmad also accused the Big Powers of having “a large share” in the tragedy that was being perpetrated in Bangladesh today. He said the Big powers assisted the rise of dictatorship and in the setting up of a capitalist-bureaucratic-military obligarchy in Pakistan by giving it arms and economic aid without regard to the manner of their use. U.S. accused Without naming the Big Powers, the Prime Minister said they let this obligarchy grow at the expense of democratic Bangladesh. They must now recognize that the blood that stains Yahya’s hands” is also on their hands. It is being realized by Americans themselves that the economic and military aid given to Pakistan by their country made possible the carnage in Bangldesh” The Prime Minster complimented India for her efforts to shelter several million evacuees from Bangladesh who had fled following the Pakistani army’s plan of depopulating Bangladesh through systematic massacres and a ruthless scorched earth policy. The Pakistani plan had succeeded in creating for India the problem of looking after the evacuees, which had constituted an undoubted strain on the economy. Mr. Ahmad said “We are grateful to India for what she has been doing to relieve the distress of this mass of uprooted war-scarred men, women and children who have been forced to throw themselves on her generosity”

Rain, Epidemics Mr. Ahmad added “I however, note with regret that even after the appeal of UN Secretary-General U Thant, which did not come a day too soon and which was the first indirect recognition of the situation created by the continuing terror and genocide in Bangladesh, the offer of help has not been commensurate with the dimension of the problem” “And now the monsoon and epidemics have added to the already unbearable distress of the evacuees” he said. The Prime Minister, however, assured all concerned that the evacuees were keen to come back home and were actively trying to hasten the day of their return by joining the liberation forces. This was the only way they could return home. “I also solemnly promise that those citizens of Bangladesh who have been unlawfully dispossessed of their houses, land and other property since 25 March will have these restored to them on thier return” he said. Sounding a note of caution about the attempts of Gen. Yahya Khan to whip up communal tension like the one he had done between Bengalis and non-Bengalis’ Mr. Ahmad said in this, Yahya’s aim was to weaken the liberation movement by destroying their unity and to distract the world’s attention from the genocide committed by his army in Bangladesh. But his machinations would not succeed because the people regarded the present struggle as one of every Bengali irrespective of class. community or crecd, he added.

জাতির উদ্দেশ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদের বেতার ভাষণ (৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত) প্রিয় দেশবাসী ও সংগ্রামী সাথীবর্গ, আপনাদের উদ্দেশ্যে গতবার আমার বক্তব্য পেশ করার পরে পৃথিবীতে অনেক কিছু ঘটে গেছে। হানাদার বাহিনীর সঙ্গে জীবনমরণ সংগ্রামে লিপ্ত বাংলাদেশের জনসাধারণের কাছে সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য ঘটনা হল এই যে, সামরিক শাসকচক্রের পশ্চিম পাকিস্তানী ক্ষমতার ভিত্তিতে ভাঙন ধরেছে এবং বাংলাদেশে তাদের মুষ্টিমেয় নিরাপদ এলাকার উপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে এসেছে। তাদের অর্থনীতিকে বানচাল করার জন্য আমাদের দৃঢ় নীতি, জলে-স্থলে আমাদের মুক্তিযােদ্ধাদের উজ্জ্বল সাফল্য এবং আমাদের প্রতিরােধের ক্রমবর্ধমান শক্তি ও গভীরতা—শক্রর সম্পূর্ণ পরাজয়ের দিনটিকে নিশ্চিতরূপে এগিয়ে নিয়ে এসেছে। এ সত্ত্বেও ধৈর্য ও সাহসের প্রয়ােজনীয়তার উপরে আমি জোর দিতে চাই। শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য এবং এই নিষ্ঠুর যুদ্ধের অবসানে দেশের পুনর্গঠনের জন্য এই গুণ দুটি অর্জন করা আজ আমাদের জন্য অত্যাবশ্যক। বিশ্বে ক্ষমতার ভারসাম্যের ক্ষেত্রে সম্প্রতি তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে। এই ভারসাম্যের উপর ভরসা করে শত্রুপক্ষ যা লাভ করতে চেয়েছিল, তাতে তারা সফল হতে পারে নি। এর নবতম প্রমান ভারত-সােভিয়েট মৈত্রী চুক্তি। বর্তমান সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজেদের শক্তির যে বিস্ময়কর পরিচয় আমরা লাভ করেছি, নিঃসন্দেহে আমরা তারই উপর নির্ভর করি। তবে যে সব মহলে আগে শুধু সতর্কতার মনােভাব দেখা দিয়েছিল, সেখান থেকে যখন সমর্থনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তখন আমাদের সন্তোষের কারণ ঘটে বৈ কি! কোন কোন দেশের সরকার এখনও অবশ্য নীতিবিবর্জিত ভূমিকা পালন করছে—যদিও সে সব দেশের জনসাধারণ আমাদের প্রতি দ্বিধাহীন সমর্থন জ্ঞাপন করেছে। আমরা শুধু আশা করব যে, এ সব দেশের জনসাধারণ ও তাদের প্রতিনিধিদের আচরণের এই অসংগতি শীঘ্রই দূর হবে। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর লক্ষ্য যে বাংলাদেশের জনগণের ধ্বংসসাধন, সে বিষয়ে আর কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। সুতরাং, তারা যে জনগণকে ত্রাণসামগ্রী ঠিকমত পৌছে দেবে, সে কথা বিশ্বাস করার মত লােক পৃথিবীতে বেশি নেই। তবু বাংলাদেশের মানুষের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যে সাহায্য দিয়েছেন, পাকিস্তান সরকারের মাধ্যমে তা দখলীকৃত এলাকায় বিলি করার ব্যবস্থা সংগত বিবেচনা করেছেন জাতিসংঘ। বিগত ঘূর্ণিঝড়ের পরে রিলিফের জন্য যেসব হেলিকপ্টার, জলযান ও অন্যান্য যানবাহন এসেছিল, পাকিস্তান সরকার নির্বিকারচিত্তে সে সব ব্যবহার করেছে বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধেই। দুর্গত মানুষের জন্য নির্দিষ্ট বহু সামগ্রী দখলদার সৈন্যদের প্রয়ােজনে ব্যবহৃত হচ্ছে। জাতিসংঘের সেবাদলে একদল যােগাযােগ বিশেষজ্ঞ এসেছেন উন্নত ধরনের যন্ত্রপাতি নিয়ে, এতে পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর রণকৌশলে যে সাহায্য হবে, তাতে সন্দেহ নেই। এই অবস্থায় ত্রাণকার্যের মানবতাবাদী উদ্দেশ্য বিপর্যস্ত হবার ঘােরতর আশঙ্কা রয়েছে। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল যদি পৃথিবীর এই অংশে বিশ্ব-প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে চান তাহলে তাকে এমন ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে ত্রাণকার্যের নামে নিষ্ঠুর প্রহসন অনুষ্ঠিত না হয়। ব্যাপক হত্যাকান্ড ও লুণ্ঠনের মাধ্যমে শত্রুপক্ষের প্রকাশ্য বর্বরতার পরিচয় আমরা পেয়েছি। মাঝে মাঝে আপােসের কতকগুলাে প্রস্তাবের মাধ্যমে তার গােপন ছলনার পরিচয়ও আমরা পাচ্ছি। এইসব প্রস্তাব চালু করার উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণকে বিভ্রান্ত করা এবং আমাদের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের আপােসহীন সংকল্পকে দুর্বল করে দেওয়া। শত্রুপক্ষ আপােস চাইতে পারে দুটি কারণে ঃ হয় সে দুর্বল, না হয় সে আমাদের জন্য ফাঁদ পেতেছে—যে ফাদ সম্পর্কে আমাদের হুঁশিয়ার থাকতে হবে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন আসন্ন। এই পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক জান্তার কৌশল হল বাংলাদেশে বেসামরিক শাসন প্রবর্তনের ভান করা। ঘৃণ্য টিক্কা খানের আসনে বেসামরিক ক্রীড়নক বসানাে এবং জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন কয়েকজন ধিকৃত বাঙ্গালিকে জাতিসংঘে প্রতিনিধিরূপে পাঠানাে—এসবই তার ছদ্ম-আবরণ। সে মিথ্যা আশা করে যে, এতে অব্যাহত সামরিক শাসন এবং বাংলাদেশে গণ-হত্যা ও জনমত দলনের নিষ্ঠুর সত্যকে ঢাকা দেওয়া যাবে। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের কিছুসংখ্যক প্রতিনিধির আসন বাতিল করে আর কিছুসংখ্যকের আসন বজায় রেখে ইয়াহিয়া কাকে ধোকা দিতে চাইছেন ? তিনি এমন ভান করছেন যে, যাদের আসন বাতিল হয়নি, তারা বুঝি তার চক্রান্তের সমর্থক। জনসাধারণের সুস্পষ্ট অভিপ্রায়ই জাতির নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতার উৎস। তারা কোন ক্ষমতা দখলকারীর আজ্ঞাবাহী নন এবং তার উদ্ভাবিত ফন্দিফিকিরে তাদের কোন সম্পর্ক নেই। গত জুলাই মাসের সম্মেলনে এম.এন.এ. ও এম.পি.এ.রা বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য অবিরাম সংগ্রামের প্রতিজ্ঞা পুনরায় ঘােষণা করেন।

জনপ্রতিনিধিদেরকে বিচার করার হাস্যকর প্রচেষ্টা কিংবা তাদের বিষয়-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার প্রয়াস—তাদের প্রতিজ্ঞা টলাতে পারবে না। বাংলাদেশের গণ-হত্যায় যে বিশ্ববাসী শিউরে উঠেছে, তারাই এখন লক্ষ্য করছে যে, জনগণের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে কারারুদ্ধ করে সামরিক আদালতে গােপন বিচারের আয়ােজন হয়েছে এবং তার পক্ষসমর্থনের জন্য খলনায়ক ইয়াহিয়া সন্দেহজনকভাবে আইনজ্ঞ চাপিয়ে দিয়েছেন। পৃথিবীর মানুষ তাই আবার ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। পাকিস্তানী শাসকচক্রের মিথ্যা ভাষণে এবং তাদের কলঙ্ক-মােচনের কলাকৌশলে কেউ প্রতারিত হবে না। বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রসঙ্গে আমি পৃথিবীকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, সাড়ে সাত কোটি মানুষের ভালবাসা মেখে তাদের সুখের স্বপ্ন যিনি দেখেছিলেন দস্যুদের কবলে পড়ায় তিনি আজ বন্দি জীবন যাপন করছেন। তার বিচারের প্রহসনের বিরুদ্ধে অন্যান্য দেশের সরকার ও জনগণ এবং আইন বিশেষজ্ঞসহ নানা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে সক্রিয় করে তােলার সর্বপ্রকার চেষ্টাই করেছে। বাংলাদেশের সরকার ও জনসাধারণ। কিন্তু বর্বর চক্রের অন্ধ ঔদ্ধত্যের উপর এর তেমন প্রতিক্রিয়া ঘটেনি। তবে দেশবাসীকে আমি প্রতিশ্রুতি দিতে চাই যে, বিচারের নামে যারা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণনাশের ষড়যন্ত্র করছে, পরিণামে শাস্তি পেতে হবে তাদেরকেই। আর ইসলামাবাদের উপর যে সব সরকারের কিছুমাত্র প্রভাব আছে, শেখ সাহেবের মুক্তি সাধনের জন্য তাদের কাছে আমি আবার আবেদন জানাই। পাকিস্তান সরকারের কর্মরত কূটনীতিবিদেরা সম্প্রতি দলে দলে গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করেছেন। এতে আমাদের শক্তির প্রমাণ ঘটেছে এবং অন্যান্য দেশের সরকারের পক্ষে আমাদেরকে স্বীকৃতি দানের আরেকটি কারণ যুক্ত হয়েছে। আসলে স্বীকৃতি লাভ হল মুক্তিযুদ্ধের দ্রুত ও সফল পরিসমাপ্তির সরূপ সােপান। বর্বর শক্তির দ্বারা যারা গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ আজ অস্ত্র ধারণ করেছে। আমাদের জনসাধারণ যেভাবে অত্যাচারিত হয়েছে, বােধহয় আর কোন জাতির ভাগ্যে এমন ঘটেনি। সুতরাং যারা গণতন্ত্রের অনুসারী এবং আমাদের প্রতি মানবিক সহানুভূতিসম্পন্ন, তাদের কাছ থেকে আমরা অনেক প্রত্যাশা করি।

পশ্চিম-পাকিস্তানী সামরিক চক্রের নিষ্পেষণের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি আমাদের জীবনে আবার এক নিষ্ঠুর আঘাত হেনেছে। তা হল সাম্প্রতিক বন্যার তান্ডবলীলা। বাৎসরিক দুঃখের বন্যায় বাংলাদেশের বহু অঞ্চল আজ প্লাবিত। এই প্লাবন পশ্চিমপাকিস্তানের মানবতাবিরােধী শােষণনীতির প্রতি এক সুস্পষ্ট অভিযােগ—কেননা, এই শাসক গােষ্ঠীই বাংলাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করেনি। এ কথা আজ পরিষ্কার যে, বাঙ্গালিরা নিজেদের নিয়তির ভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান হবে না। বাঙ্গালির দুঃখের ব্যাপকতা ও গভীরতা আজ মানবীয় পরিমাপশক্তির বাইরে। তবু আমি বাংলার অজেয় প্রাণশক্তিতে বিশ্বাসী। তাই আমার দৃঢ় প্রত্যয়—ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও যুদ্ধের সর্বনাশের উপরে বাংলার এই প্রাণশক্তির জয় অবশ্যম্ভাবী। পরিশেষে, যাদের সাহস আত্মােৎসর্গ ও সাফল্য সারা জাতিকে গৌরবে পূর্ণ করেছে এবং মহান ভবিষ্যতের আশায় উজ্জীবিত করেছে, সেই মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য কামনা করি সকল শক্তি। বর্তমান সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনসাধারণ নিজেদের ঐক্যকে সুদৃঢ় করেছে। এই ঐক্যই যেন আমাদের শক্তির চিরকালীন উৎস হয় ।

নভেম্বর ১৮, ১৯৭১

পবিত্র ঈদ-উল ফিতর উপলক্ষে দেশবাসীর প্রতি। বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদের বাণী আমাদের দেশে এবার ঈদ এসেছে অত্যন্ত মর্মান্তিক পরিবেশে। দখলকৃত এলাকায়। শত্রু সৈন্যের তান্ডব চলছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থেকে বিচ্যুত হয়ে শরণার্থী হয়েছেন। মুক্ত এলাকায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি চলছে শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য। রক্তের বিনিময়ে মানুষ মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রাম করছে। এবার ঈদে আনন্দ মুছে গেছে আমাদের জীবন থেকে। আছে শুধু স্বজন হারানাের শােক, দুর্জয় সংগ্রামের প্রতিজ্ঞা ও আত্মত্যাগের প্রবল সংকল্প । গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও আমার পক্ষ থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধা ও জনসাধারণকে ঈদ উপলক্ষে আমি আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। ঈদের যে আনন্দ আজ আমরা হারিয়েছি তা আমাদের জীবনে পুনপ্রতিষ্ঠিত হবে সেদিনই, যেদিন আমরা দেশকে সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত করব। আমি আপনাদেরকে আশ্বাস দিচ্ছি যে, যথাসর্বস্বপণ করে যে স্বাধীনতা সংগ্রামে আমরা আজ লিপ্ত, তার চূড়ান্ত সাফল্যের দিনটি নিকটতর হয়ে এসেছে। সেই মুহূর্তটিকে এগিয়ে আনার সংগ্রামে আমরা সকলে যেন নিস্বার্থভাবে নিজেদের নিয়ােগ করতে পারি, এই ঈদে তাই হােক। আমাদের প্রার্থনা। (নভেম্বর ১৮, ১৯৭১ বাংলাদেশ বেতার থেকে প্রচারিত)

নভেম্বর ২৩, ১৯৭১

জয় আমাদের কব্জায়

জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব। তাজউদ্দিন আহমদের বেতার ভাষণ দেশবাসী সংগ্রামী ভাইবােনেরা, গত সেপ্টেম্বর মাসে আপনাদের কাছে আমাদের মুক্তি সংগ্রামের পর্যালােচনা করেছিলাম। তারপর আড়াই মাস কেটে গেছে। এর মধ্যে আমাদের সাফল্য এসেছে নানাদিক থেকে। দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ যে সর্বক্ষেত্রে তীব্রতর হয়েছে, সে কথা শক্ৰমিত্র নির্বিশেষে সকলেই স্বীকার করেছেন। মুক্তিবাহিনী এখন যে কোন সময়ে যে কোন জায়গায় শত্রুকে আঘাত করতে পারে; এমনকি শত্রুর নিরাপদ অবস্থানের কেন্দ্রে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে তাকে বিমূঢ় করে দিতে পারে। জলে-স্থলে চমকপ্রদ অগ্রগতি ঘটেছে মুক্তিবাহিনীর। নদীপথে হানাদাররা বিপর্যস্থ, মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর প্রায় অকেজো, বাংলাদেশের বিস্তৃত অঞ্চল শক্রমুক্র। ক্রমেই অধিকতর এলাকায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কার্যকর প্রশাসন চালু হচ্ছে। আর সৈন্য, সামগ্রী ও মনােবল হারিয়ে শত্রুপক্ষ হতাশায় ততই উন্মাদ হয়ে উঠছে। একদিকে রণক্ষেত্রে শত্রুর বিপর্যয় ঘটছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ইসলামাবাদের দুষ্কৃতিকারীরা আজ দিশেহারা ও কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। নিজেদের ভবিষ্যত সম্পর্কে সংশয় ও ভীতির উদ্রেক হয়েছে তাদের মনে।

বাংলাদেশের জনগণের অপরিমেয় দুর্দশা ঘটাবার সঙ্গে সঙ্গে তারা পশ্চিম পাকিস্তানকেও টেনে নিয়ে গেছে। অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও রাজনৈতিক ভাঙনের মুখে। এখন তারা চায় ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে একটা আন্তর্জাতিক সংকট সৃষ্টি করতে। তারা আশা করে যে, এমন একটা যুদ্ধ হলে বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামের থেকে পৃথিবীর দৃষ্টি অন্যদিকে নিবদ্ধ হবে, মুক্তিবাহিনীর হাতে তাদের পরাজয়ের গ্লানি গােপন করা যাবে এবং এমন একটা পরিস্থিতির উদ্ভব হবে যাতে তাদের পৃষ্ঠপােষকেরা হস্তক্ষেপ করার সুযােগ পাবে। কিন্তু আমি প্রত্যয়ের সঙ্গে বলছি যে, এর একটি উদ্দেশ্যও সিদ্ধ হবে না বরঞ্চ এতে তাদের ভ্রান্তি, অপরাধ ও আত্মঘাতের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে মাত্র এবং পরিণামে তাদের আত্ম-বিনাশ সুনিশ্চিত হবে। সামরিক শাসকচক্র আত্মহত্যার যে-ব্যবস্থাই করে থাকুক না কেন আর এই উপমহাদেশের জন্য যে ব্যবস্থাই বিশেষ বিশেষ রাষ্ট্রের মনঃপুত হােক না কেন, বাংলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহণযােগ্য ব্যবস্থা একটিই—আর তা হল পূর্ণ। স্বাধীনতা। ইতিহাসের অন্যতম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে প্রতিদিন প্রমাণিত হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতার সংকল্প আর সে স্বাধীনতা রক্ষার শক্তি। দখলদার সৈন্যবাহিনীর বিনাশ অথবা সম্পূর্ণ অপসারণের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। ইতিহাস মানুষকে অন্ততঃ এই শিক্ষা দিয়েছে যে, জনসাধারণের ইচ্ছাশক্তির পরাজয় নেই—এমনকি, এক বিশ্বশক্তির সমর সম্ভার দিয়েও জনগণের মুক্তিসংগ্রাম দমন করা যায় না। এশিয়ায় গণতন্ত্রের প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে কোন কোন পাশ্চাত্য দেশের নিরাসক্তি লক্ষ্য করার মত। মনে হয় মানুষ হিসাবে মানুষের মর্যাদার চাইতে এখানে তারা সরকারের স্থিতিশীলতার গুরুত্ব দেন বেশি। এটা শােচনীয়, কিন্তু ভারতকে অর্থসাহায্যের বিনিময়ে বাংলাদেশের শরণার্থীদেরকে সেখানে স্থায়িভাবে বসবাসের প্রস্তাব যখন কোন রাষ্ট্র উত্থাপন করেন, তখন আমরা শিউরে না উঠে পারি না। এই প্রস্তাবে গণহত্যা ও তার ফলাফলকে নীরবে মেনে নেওয়া হয়েছে, পর্বতপ্রমাণ অবিচার ও অন্যায়কে বিনাবাক্যে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে এবং ভবিষ্যতে গণহত্যা ও ব্যাপক বাস্তুত্যাগের পথ প্রশস্ত করা হয়েছে। পাকিস্তানী সন্ত্রাসের ফলে। যারা ছিন্নমূল হয়েছেন, তারা অস্থাবর সম্পত্তি নন যে, অর্থের বিনিময়ে তাদেরকে হাতবদল করা হবে।

সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে নিজ বাসভূমে ফেরার জন্মগত অধিকার তাদের আছে এবং তারা সেখানে সেভাবেই ফিরে আসবেন আর আমি। বলছি যে, তার খুব বেশি দেরি নেই। ঠিক এই সময়ে এই উপ-মহাদেশে তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি বিশেষ দল পাঠিয়ে প্রেসিডেন্ট নিক্সন কি উদ্দেশ্য সাধনা করতে চান ? তার দেশের কূটনীতিবিদ ও আইন সভার সদস্যেরা অবগত নন এমন কি নতুন তথ্য তিনি জানতে ইচ্ছুক ? দশ। লক্ষ বাঙ্গালিকে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা এবং প্রায় এক কোটি মানুষকে বাস্তুত্যাগে। বাধ্য করা সত্ত্বেও পাকিস্তান সরকারকে তার প্রশাসন নিন্দা করেননি। এখন তথ্য সংগ্রাহক পাঠিয়ে কি ফল তারা লাভ করতে চান, জানি না। তবে এতে আমাদের সংকল্পের কোন ব্যত্যয় হবে না। সে সংকল্প হল দেশকে শত্রুমুক্ত করে নিজেদের অভিপ্রেত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। অশ্রু ও রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতার জন্য আমরা লড়ছি, সে স্বাধীনতা লাভের। দিনটি নিকটতর হয়েছে। কিন্তু তার জন্য আরও আত্মত্যাগ, কষ্ট স্বীকার ও জীবন দানের প্রয়ােজন হবে। স্বাধীনতার ধারণা অশেষ অর্থগত। স্বাধীনতার তাৎপর্য নির্ভর করে যুদ্ধাবস্থায় এর জন্য আমরা কি মুল্য দিই এবং শান্তির সময়ে এর কি। ব্যবহার করি, তার উপরে। শক্রসংহারের প্রতিজ্ঞা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে তাই শহীদের। রক্তের উপযুক্ত সমাজ গঠনের প্রতিজ্ঞাও আমাদেরকে নতুন করে নিতে হবে। বাংলাদেশের শহরে ও গ্রামে তরুণেরা যে যুদ্ধে লিপ্ত, তা বিদেশী দখলদারদেরকে বিতাড়িত করার সংগ্রাম এবং অসাম্য ও সুবিধাভােগের অবসান ঘটানাের সংগ্রাম।

আমাদের আজকের সগ্রাম সে দিনই সার্থক হবে, যে দিন আমরা বঙ্গবন্ধু প্রতিশ্রুত ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হব। সমাজের যে ভবিষ্যত রূপ তখন বাংলাদেশের জনসাধারণ প্রত্যক্ষ করবেন সেখানে সকল সমানাধিকারের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন গঠিত হবে এবং উন্নয়ন ও পরিপূর্ণতার সাধারণ লক্ষ্যে উপনীত হবার প্রয়াসে সকলে অংশগ্রহণ করবেন। বাংলাদেশের জনসাধারণের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজও পাকিস্তানের সামরিক চক্রের হাতে বন্দি হয়ে রয়েছেন। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস তাকে মুক্ত করার একমাত্র উপায় হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে হানাদার সৈন্যদের নিক্রমণের সকল পথ রুদ্ধ করে দেওয়া। তা করবার শক্তি আমাদের আছে এবং আমরা তাই করতে যাচ্ছি। জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে আমরা চরম আঘাত হানব আর তখনই জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্রুর সত্যের মুখােমুখি হবেন। বাংলাদেশের জনগণের কাছে আমার আহ্বান : মুক্তিসংগ্রামের বর্তমান পর্যায়কে চূড়ান্ত স্তরে নিয়ে চলুন। যে সব সরকারী কর্মচারি, রাজাকার, পুলিশ বা অন্যান্য ব্যক্তি বিবেকের নির্দেশের বিরুদ্ধে হানাদারদের কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন, তারা সামরিক চক্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সুযােগ গ্রহণ করুন। শত্রু পক্ষের সঙ্গে যারা স্বেচ্ছায় হাত মিলিয়েছেন, তাদেরকে আমি শেষবারের মত বলতে চাই? বিশ্বাসঘাতকতার পথ পরিহার করুন। অনুতাপহীন বিশ্বাসঘাতকদের আর তাদের বিদেশী প্রভুদের পরিণতি একই হবে—আর তা হল গ্লানিকর মৃত্যু, হাজার হাজার মুক্তিসেনা আজ শত্রুকে ঘিরে রেখেছে, তার অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছে। সকলে প্রস্তুত থাকুন ঃ গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আহ্বানে চরম মুহূর্তে যেন সর্বশক্তি দিয়ে শত্রুকে একযােগে চরম আঘাত করতে পারেন। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে যারা সাফল্যের বর্তমান স্তরে নিয়ে এসেছেন, সেই বীর শহীদ, অকুতােভয় যােদ্ধা ও সংগ্রামী জনগণকে আমি সালাম জানাই।

An address to the nation broadcast by Mr. Tajuddin Ahmad, Prime Minster of the People’s Republic of Bangladesh, on 5th. September, 1971.

My dear Countrymen and Comrades: Much has happened to the world since I spoke to you last. The outstanding events for the people of Bangladesh who are engaged in a deadly fight with the invading hordes of west Pakistan are the ruling junta’s crumbling power base in West Pakistan and the enemy’s slipping control over his few pockets of security in Bangladesh. Our determined policy of economic denial, the brilliant exploits of our guerillas on land and sea, and the growing strength and intensity of our resistance, have brought the day of his complete defeat significantly nearer. I should however like to emphasize the need for patience and fortitude – the two virtues which would be most necessary, in our circumstances, to rout the enemy finally and to rebuild the country after this cruel war is over. There have been significant shifts in the balance of power in the world. That the enemy’s attempt to cash in on this has not been successful is further evidenced by the Indo-Soviet Treaty. Bengalis undoubtedly rely on their own power, which they have discovered with amazement in the course of their struggle, but there is satisfaction to be derived from signs of support from quarters where before there was only caution. Some Governments however continue to act perversely, although the people they represent have expressed their solidarity with us in unambiguous terms. We can only hope that this gap in their responses would soon disappear. Not many in the world would rely on the Pakistan army to bring succour to the people of Bangladesh whose destruction is its undoubted policy. Yet the UN has thought it fit to channel relier given by the nations of the world to Bengalies in the occupied areas through the Pakistan Government which has had no scruplc in pressing into service reliel’ helicopters, vessels, and vehicles in its campaign of suppression against them. Much of the material meant for the distressed is being utilised to sustain the occupation troops while the communication experts, with advanced gadgets, who form part of the UN reliel’ team. confer unquestionable logistical benefits on the Pakistan army. All this gravely endangers a mission which is said to be humanitarian. If the UN Secretary General al all carcs for the prestige of the World Organisation in this part of the world, he must take all steps to prevent UN relief operations in Bangladesh from becoming a mockery. Our enemy is not only overtly barbarous, as is demonstrated by his mas

sacres and depredations, he is covert and insidious. From time to time he would float treacherous compromise formulae the purpose of which could only be to mislead our people and weaken our resolve to achieve our irreducible goal of complete independence. If the enemy seeks a compromise it must be because he is weak or because he wants to lay a trap for us against which we must be on our guard. With the session of the U.N. General Assembly in the offing the military junta has resorted to the subterfuge of creating a facade of a return to civil administration in Bangladesh. General Yahya’s replacement of the hated Tikka by a civilian stooge, the reported move to make discredited Bengalis, isolated from the people, respresent Pakistan at the U.N., are all part of the same subterfuge calculated to hide the harsh reality of continued martial Law, genocide and suppression of popular will in Bangladesh. Whom does Yahya want to impress by his elaborate show of unseating some members of the National and Provincial Assemblies while leaving others to retain their seats? The elected representatives of the nation derive their authority from the expressed will of the people and are neither subject o a usurper’s rule nor to his make-believe methods designed to produce the quite fraudulent impression that all those not unseated by him are supporters of his regime. The MNAs and MPAs in their convention last July renewed their vow to continue the struggle till Bangladesh is completely liberated and the ridiculous trials to which they are being subjected and the confiscation of their property would make no difference to their resolution. A world which has reacted with such horror to the mass murder of Bengalis and expressed such revulsion at the incarceration of their leader Sheikh Mujibur Rahman and his secret trial in a military court, with attorneys dubiously forced upon him by dictator Yahya, is not likely to be deceived by the whitewashing maneuvers and lies of the rulers of Pakistan. Speaking of the trial of the Bangabandhu, I must remind the world that while it goes about its business, a man, filled with the vision of the happiness of 75 million people who love him, is being held in captivity by thugs who happen to have him in their power. The Government and penple of Bangladesh have taken all steps to arouse other Governments. peoples, and groups, including jurists, against it. This has so far had liltle effect on the unseeing arrogance of a brutish clique. But I assure my countrymen that those who are plotting against the life of Sheikh Mujibur Rahman under cover of a so-called trial would not go unpun ished. Meanwhile, I appeal to all powers who have any influence with Islamabad to help secure the release of the Sheikh immediately. The recent mass transfer of allegiance by Bengali diplomats in Pakistan’s service to the People’s Republic of Bangladesh, underlines its strength and is one more argument in favour of our recognition by other Governments. It is easy to see that recognition is a means to an end which is a speedy and victorious conclusion to the war of liberation. The people of Bangladesh, who are up in arms against forces which want to disenfranchise them by brute force and who have suffered in body and mind as perhaps no other people have suffered, deserve a better deal from at least those who profess democracy and also show humanitarian sympathy to us. Nature, in the shape of flood, has added a cruel dimension to the already existing suffering caused by the evil deeds of the militariasts from West Pakistan. These annual waters of sorrow, which have engulfed vast areas of our land, are an indictment of the cynical policy of exploitation which neglected to provide for flood control in Bangladesh. It is clear that the problems of Bangladesh could be solved only by Bengalis taking charge of their own destiny. Human standards of measurement break down before the scale and depth of Bengali’s agony to-day, but I believe in the resilience of the Bengali soul, and feel sure that it would triumph over cyclone, flood and war. Finally, all power to the arms of our freedom fighters whose courage, self-sacrifice, and achievements fill the nation with pride and hope for a great future. The people of Bangladesh have consolidated their solidarity through the present struggle. Let this solidarity be their abiding source of strength. Joy Bangla. An address to the nation by Mr. Tajuddin Ahmad, Prime Minster of the People’s Republic of Bangladesh, broadcast on Nov. 23, 1971.

My dear countrymen and comrades, The freedom struggle in Bangladesh has achieved many successes since I spoke to you in September. The volume and intensity of our resistance against the occupation army are to-day acknowledged by friends and l’oes alike. The Mukti Bahini can now strike at the enemy at any time and at any place and surprise him at the heart of his security. It has achieved sectacular successes on land, river and sea and has crippled shipping at the ports of Mangla and Chittagong. It has wiped out the vestiges of enemy presence from district after district in Bangladesh. As more and more areas are coming under the effective adminsitrative control of the Government of the People’s Republic of Bangladesh, the enemy’s losses, in men, material and morale, are making him insane with frustration. The evil men of Islamabad are to-day bewildered by their reverses in the battle-field and the mounting international support for the cause of Bangladesh. They are now riddled with doubts and fears as to their survival. They have not only caused immeasurable suffering to the people of Bangladesh but brought West Pakistan to the brink of economic ruin and political disintegration. They are now seeking an international crisis in the form of a war with India. In this their aim is, on the one hand, to divert attention from the grim struggle for freedom in Bangladesh and to conceal their humilitions at the hands of the Muti Bahini and, on the other, to create a situation for intervention by their patrons. But they are not likely to succeed in these aims which can only carry them from Polly and crime and ruin to more folly and morc crimes and to total selfdestruction. Whatever plans the ruling junta might have for self-destruction or what ever arrangements in the sub-continent might suit some powers, the only arrangement that suits the people of Bangladesh is freedom. Our will to freedom and our ability to consolidate and perpctuate it, is daily heing tested in one of the bitterest wars of history. Freedom conceived as destruction of the occuption troops or their withdrawal from Bangladesh. is our only objective. If history has any lesson for makind. it is that a people’s will cannot be trilled with. nor can a liberation strug. gle he suppressed by the l’ire power of even a global giant. When some western nations fail to show much sensibility to the necd for democracy in Asia, where they worhip the concept of stability more than men’s dignity as man, it is bad enough. But when one of them

makes the quite soulless suggestion that India should absorb the evacuces from Bangladesh in exchange for financial support, we are appalled and outraged. The suggestion accepts without comment the consequences of genocide. seeks to freeze a situation of revolting inequity, and invites, and abets in advance. future mass killings and large scale migrations. Surely, the uprooted victims of Pakistani terror are not chattels to be disposed of in exchange for money. It is their birth right to return home in honour and dignity, and return they shall in not too distant a future. And what is the object of President Nixon’s sending a fact finding mission to the sub-continent at this time? What is it he wants to know that his country’s diplomats and legislators do not already know too well? The administration he heads failed to express any horror for the blackest crime of his time, namely, the planned extermination of a million Bengalis or for the brutal uprooting of nearly ten million human beings from their homes. Whatever the U.S. Government wishes to achieve through this move, it will not make any difference to our determination to free our country and to create the kind of society we want. The event we have been preparing for through blood and tears is positively nearer, but we must reckon with the sacrifices, deaths, and hardships that are yet to be gone through. Since freedom is an inexhaustible concept and is yet conditioned by what we do with it in war and peace, we must, as we renew our vow to destroy the enemy completely, also renew our pledge to build a society worthy of the martyrs’ blood. The young men who are fighting in the cities and villages of Bangladesh to end foreign occupation are also lighting to end privilege and injustice. The present struggle will thus be completed only by our achieving the secular-democratic-socialist order promised by Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman. The vision that impels, Bangladesh to-day is that of a society where political, economic and cultural life will be organised on the basis of the equality of all citizens, who will join in a common adventure to del velop and fulfil themselves in freedom. The Bangabandhu, the leader of the Bengalis, is still a captive of the Pakistani Generals. We are convinced that the military junta will see reason and free him only when the exit routes of the occupation ariny are cut. This is what we are now able to do and intend to do. We shall take on the enemy on land, sea and air and force upon General Yahya Khan the moment of truth he has been waiting for. I call upon the people of Bangladesh to turn this phase of the liberation war into a decisive one. All officials, razakars, members of the police

and others who have been compelled to serve the invader against their conscience must take the first opportunity to revolt. I ask all willing collaborators for the last time to reform and desist from their acts of betrayal against the country. We promise the unrepentant collaborator and his alien master the same fate death with ignominy Thousands of our guerrillas at the moment surround the enemy and menace his existense. All citizens of Bangladesh must join their strength to that of the Mukti Bahini and stay poised to deliver the occupation regime a mortal blow with their united might when the call is given for a final assault on the invader. I salute the heroic dead, the heroic freedom fighters, and the heroic people of Bangladesh who have brought the freedom struggle to its present level of success. Joi Bangla.

An address to the nation by Mr. Tajuddin Ahmad, Prime Minister of the People’s Republic of Bangladesh, broadcast on December 8, 1971.

My dear countrymen and comrades,

The Pakistani generals have plunged the sub-continent into a calmitous war. It was clear for months that they were seeking this evil consummation of their folly and crimes in Bangladesh.

The aggression against India has taken place in the background of Pakistan’s humiliating reverses at the hands of the Mukti Bahini and India’s warm-hearted support to the people of Bangladesh in their just struggle. The peril from the common enemy has brought the people of Bangladesh and India closer than ever. Our forces are now fighting shoulder to shoulder with Indian forces, and their blood is mingling with ours on our soil. This seals the bond between two peoples who are destined for friendship. The people of India had always recognised us in their hearts and now their Government has accorded formal recognition to the People’s Republic of Bangladesh. It is a tribute to the martyrs in the cause of our freedom and a trumbh for all classes of people in Bangladesh, their elected representatives, and the Mukti Bahini whose efforts, sacrifices and impregnable unity have won them diplomatic recognition as an independent and sovereign nation. It is also a triumph for the people of India whose united wish was for Bangladesh to be recognised. This is indeed a fine hour for both Bangladesh and India. This is but natural that India, the largest democracy in the world, should be the first to welcome us to the comity of independent nations. Her commitment to humanity and freedom, evident in her caring for ten million uprooted Bengalis and bearing the brunt of war to defend their democratic rights, must be regarded as a marvel of our time. We rejoice at India’s bold decision, and thank Prime Minister Indira Gandhi, the Government of India, the memebrs of the Indian Parliament, and the people of India for their historic contribution to the consolidation of our statehood. The Bengali nation owes an infinite debt of gratitude to Sreemali Gandhi’s sagacity and statesmanship. Following India Bhutan has given us recognition, and we are also grateful to the King and people of that coountry. India’s recognition of the People’s Republic of Bangladesh is a big cvent. As far as our relations with India are concerned, their foundation

will be friendship and mutual respect. The tie we have forged with the Indian people in adversity and war will endure in peace and will, I am confident, bring lasting benefits to our two nations. The joy of the people of Bangladesh is, however, darkened by a cruel irony. Sheikh Mujibur Rahman, the father of the Bengali nation, is in the prison of the enemy at this hour, when Bangladesh, his dream, has come true on the international plane. The Bangabandhu, whether away from his people or among them, is always in their hearts. He is the symbol of the consciousness that has changed the past for us and is part of the mythology that will sustain this nation in the future. And yet his absence from us now is painful. The emergence of free Bangladesh should be welcome to all progressive nations. The new state represents peaceful co-existence, non-alignment in international politics and opposition to imperialism and colonialism in all forms and is committed to democracy and a secular and socialist way of life. I invite the nations to follow the example of India and Bhutan and accept the reality of seventy-five million people. The alternative to this is flying in the face of common sense. The West Pakistan Government is being engulfed by the evil it has brought into existence. The atempts of her patrons in the UN Security Council to save her from Nemesis has so far been unsuccessful. The American resolution calling for a cease-fire in the subcontinent without attending to the root cause of the conflict in Bangladesh is, in fact, a monument to America’s blindness and perversity. China is also guilty of the same failure of judgement. The people of Bangladesh are grateful for the Soviet veto. We in Bangladesh must now complete the task assigned to us by history and drive the last nail into the coffin of a fascist state led by crazy militarists. The ring of death is fast closing round the enemy. He is in retreat everywhere and reeling under the blows of the Mukti Bahini and our ally. The hour has struck for the people of Bangladesh to rise against the invader to a man and give him the coup de grace he has earned. They must at the same time aid the liberator in every possible way, help mainlain law and order. and co-operate with the administration of the Government of Bangladesh. Let it not be said of anyone in Bangladesh. whatever his station in life, that he failed when the call came. I call upon all enemy troops and razakars to lay down their arms and surrender. They can yet save themselves by heeding this call. I also call upon all citizen of Bangladesh to avoid the temptation to take the law into their own hands. We must remember that it is the prerogative of the

state to punish offenders according to the due process of law. If a single citizen of Bangladesh is harmed or hurt because of his language or race it will be a betrayal of the ideals of the founder of the nation and the flag of free Bangladesh. Bangladesh will carry in her bosom the scars caused by the occupation army for a long time, but there is comfort and exultation in the thought that the end of the invader is come, that Bangladesh is going to be completely liberated, and that her homeless stricken children will soon return home from their sorrow and exile. As we win the war, we must prepare to win the peace. The edifice of ‘Golden Bengal’ must be laid on the ruins left by a cruel war, and everyone of her sons and daughters must take part in the exhilerating and humbling task of reconstruction and development. The revolution begun by the Bangabandhu will end only when his ideals of democracy, socialism and secularism are fully realised.

JOI BANGLA

ডিসেম্বর ৮, ১৯৭১ সােনার বাংলাকে গড়তে হবে জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের বেতার ভাষণ দেশবাসী সংগ্রামী ভাইবােনেরা, পাকিস্তানী সমর নায়কেরা আজ সারা উপ-মহাদেশে এক সর্বনাশা যুদ্ধ ডেকে এনেছে। বাংলাদেশে তাদের শাস্তি ও অপরাধের পরিণতি যে এ পথেই ঘটবে গত কয়েক মাস থেকেই তা বােঝা যাচ্ছিল। একদিকে মুক্তিবাহিনীর হাতে পাকিস্তানী সৈন্যদের লজ্জাজনক বিপর্যয় এবং অন্যদিকে বাংলাদেশের জনসাধারণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামের প্রতি ভারতের আন্তরিকতাপূর্ণ সমর্থন, এই পটভূমিকায় পাকিস্তান ভারতকে আক্রমণ করেছে। ভারত ও বাংলাদেশের বিপদ এসেছে একই শত্রুর কাছ থেকে। এর ফলে দুই দেশের মানুষের সম্পর্ক নিবিড়তর হয়েছে। মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় সৈনিকেরা এখন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করছে ? উভয়ের মিলিত রক্তধারায় রঞ্জিত হচ্ছে আমাদের দেশের মাটি। ইতিহাস এই দু’দেশের মানুষের যে বন্ধুত্বের পথ নির্দেশ করেছে, এই রক্তধারায় সেই মৈত্রীর বন্ধন রচিত হল। ভারতের জনসাধারণ অনেক আগেই আমাদেরকে স্বীকৃতি দিয়েছেন তাদের অন্তরে। এখন তাদের সরকার গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি জানিয়েছেন। বাংলাদেশের সর্বশ্রেণীর জনসাধারণের পক্ষে এ এক বিজয়-বিজয় তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের, আর বিজয় তাদের মুক্তিবাহিনীর। স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতি হিসাবে আমাদের কূটনৈতিক স্বীকৃতি লাভ আজ সম্ভব হল অগণিত শহীদের রক্তের বিনিময়ে, মুক্তিবাহিনীর দুঃসাহসিক তৎপরতা, অপূর্ব আত্মত্যাগ ও দুর্ভেদ্য ঐক্যের ফলে। এ বিজয় ভারতের জনসাধারণেরও বিজয়। বাংলাদেশের স্বীকৃতির বিষয়ে তাদের সর্বসম্মত অভিপ্রায় আজ বাস্তবে রূপায়িত হল। স্বাধীন জাতি হিসাবে আমাদেরকে জগৎসভায় সর্বপ্রথম স্বাগত জানিয়েছে ভারত। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের পক্ষে এটাই স্বাভাবিক। এক কোটি ছিন্নমূল বাঙ্গালির। পরিচর্যার ক্লেশ স্বীকার এবং বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য যুদ্ধের আপদ বহন আর মানবতা ও স্বাধীনতার আদর্শের প্রতি যে সুগভীর নিষ্ঠার পরিচয় ভারত দিয়েছে, তা বর্তমান কালের এক আশ্চর্য ঘটনা রূপে বিবেচিত হবে।

ভারতের এই দৃঢ়তাপূর্ণ সিদ্ধান্তে আমরা আনন্দিত। আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনের ভিত্তিমূলে এই ঐতিহাসিক অবদানের জন্য আমরা ভারতের জনসাধারণ, পার্লামেন্ট, সরকার ও প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞায় বাঙ্গালি জাতি অপরিসীম কৃতজ্ঞতা বােধ করছে। ভারতের এই স্বীকৃতি দান একটি মহৎ ঘটনা। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ভিত্তি হবে পরস্পরের জন্য মৈত্রী ও শ্রদ্ধাবােধ। বিপদের দিনে যুদ্ধের দুর্যোগের মধ্যে ভারতীয় জনসাধারণের সঙ্গে যে সম্পর্ক আমরা প্রতিষ্ঠিত করলাম, সম্পদে ও শান্তির কালে তা অক্ষুন্ন থাকবে এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তা উভয় জাতির স্থায়ী কল্যাণ সাধন করবে। ভারতের পরে ভুটান স্বীকৃতি দিয়েছে গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে। এর জন্য আমরা ভুটানের রাজা ও জনসাধারণের নিকট কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশের মানুষের এই আনন্দের মুহূর্ত তবু ম্লান হয়ে গেছে এক বিষাদের ছায়ায়। বাংলাদেশের স্বপ্ন যখন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাস্তবে রূপায়িত হল, তখন সেই স্বপ্নের দ্রষ্টা, বাঙ্গালি জাতির জনক, শেখ মুজিবুর রহমান শত্রুর কারাগারে বন্দি হয়ে আছেন। দেশবাসীর নিকটে অথবা দূরে, যেখানেই থাকুন না কেন, বঙ্গবন্ধু সর্বদাই জাগরূক রয়েছেন তাদের অন্তরে। যে চেতনা আমাদের অতীতকে রূপান্তরিত করেছে, তিনি সেই চেতনার প্রতীক। যে রূপকাহিনী ভবিষ্যতে আমাদের জাতিকে যােগাবে ভাব ও চিন্তা, তিনি সেই কাহিনীর অংশ। তবু এই মুহূর্তে তার অনুপস্থিতিতে আমরা সকলেই বেদনার্ত। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে সকল প্রগতিশীল রাষ্ট্রেরই স্বাগত জানানাে উচিত। আমাদের এই নতুন রাষ্ট্রের আদর্শ হল শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জোট নিরপেক্ষতা এবং সর্বপ্রকার সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদের বিরােধিতা করা। আমরা গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। সাড়ে সাত কোটি মানুষের বাস্তব অস্তিত্বকে স্বীকার করে ভারত ও ভুটানের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করার জন্য আমি সকল রাষ্ট্রকে আহবান করছি। পশ্চিম-পাকিস্তান সরকার যে অমঙ্গলের সূচনা করেছে বাংলাদেশে, পরিণামে তাই আজ তাকে ধ্বংস করতে চলেছে। এই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি থেকে তার পৃষ্ঠপােষকরা তাকে বাঁচাতে চেয়েছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে, কিন্তু সে প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের সংঘর্ষের মূল কারণ বিবেচনা না করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই উপমহাদেশে যুদ্ধবিরতির যে প্রস্তাব করেছে, তা মার্কিন সরকারে অন্ধতা ও বিকৃত বিচারবুদ্ধির পরিচায়ক।

চীনও একই ধরনের বিচারবুদ্ধিহীনতার পরিচয় দিয়েছে। তাই নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো প্রয়ােগ করায় সােভিয়েট ইউনিয়নের প্রতি বাংলাদেশের মানুষ কৃতজ্ঞ। ইতিহাস আমাদেরকে যে দায়িত্বভার অর্পণ করেছে, এখন তা সম্পূর্ণ করতে হবে আমাদেরকেই । উম্মত্ত যুদ্ধবাদীদের নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রকে কবর দিতে হবে আমাদেরকেই। চারপাশে মৃত্যুর জালে শত্রু জড়িয়ে পড়েছে। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রশক্তির মিলিত আঘাতে শত্রু এখন পর্যুদস্ত-পলায়নপর। বাংলাদেশের ভাইবােনেরা এখন সময় এসে গেছে—একযােগে শত্রুকে প্রবল আঘাত হানুন, এই শেষ আঘাতে তার সমাধি রচনা করুন, সকল সম্ভাব্য উপায়ে মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্য করুন। শান্তি ও শৃংখলা বজায় রাখুন, বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনের সঙ্গে সকল প্রকার সহযােগিতা করুন। ভবিষ্যত যেন এ কথা না বলে যে, চরম আহ্বান যখন এল, তখন কর্তব্যে আমাদের ক্রটি হয়েছে। সকল শত্রু সৈন্য ও রাজাকারদের কাছে আমার আহ্বান—অস্ত্র ফেলে দিন, আত্মসমর্পণ করুন। এই উপায়ে এখনও আপনারা আত্মরক্ষা করতে পারেন। সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের সকল নাগরিকের কাছে আমার আহ্বান কোন অবস্থাতেই নিজের হাতে আইন তুলে নেবেন না। মনে রাখবেন যে, অপরাধীকে আইন মােতাবেক শাস্তি দেওয়ার দায়িত্ব আপনার সরকারের এবং সে দায়িত্ব সরকার পালন করবেন। ভাষাগত বা অন্যরকম ভিন্নতার জন্য বাংলাদেশের একটি নাগরিকও যদি বিপদগ্রস্ত হন, তাহলে জানবেন, তা হবে এই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার আদর্শের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা, তা হবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার অবমাননা। দীর্ঘদিন ধরে দখলদার সৈন্যবাহিনী যে পীড়ন চালিয়েছে, তার ক্ষতচিহ্ন বাংলাদেশের সর্বত্র দেখা যাবে। তবু আশ্বাস ও আনন্দের কথা এই যে, হানাদারদের শেষ সময় এসে গেছে, বাংলাদেশের সমগ্র ভূখন্ড শত্রুমুক্ত হতে চলেছে এবং দেশের গৃহহারা নিপীড়িত সন্তানেরা দুঃখ ও নির্বাসনের কাল কাটিয়ে স্বদেশে ফিরে আসতে যাচ্ছেন। যুদ্ধজয়ের সঙ্গে সঙ্গে শান্তিকেও জয় করে আনতে হবে।

নিষ্ঠুর যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষের উপরে ‘সােনার বাংলার সৌধ নির্মাণ করতে হবে। পুনর্গঠন ও উন্নয়নের এই আনন্দদায়ক ও মহান কাজে অংশ নিতে হবে বাংলাদেশের প্রতিটি সন্তানকেই। বঙ্গবন্ধুর আরদ্ধ বিপ্লব সেই দিন শেষ হবে, যেদিন গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের আদর্শ পরিপূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হবে। জয় বাংলা। জাতির উদ্দেশ্যে ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে প্রদত্ত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদের বেতার ভাষণ দেশবাসী সংগ্রামী ভাই বােনেরা, বাংলাদেশে দখলদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তি সংগ্রাম আজ সাফল্যের তােরণে উপনীত হয়েছে। গতকাল বিকেল পাঁচটা এক মিনিটে সম্মিলিত ভারতীয় সৈন্যবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর অধ্যক্ষ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরার কাছে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খার নিযুক্ত খ অঞ্চলের সামরিক প্রশাসক হিসেবে এবং নিজের ক্ষমতাবলে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী তার অধীনস্থ পাকিস্তানী স্থল, বিমান ও নৌ বাহিনী, আধা সামরিক ও বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনীসহ বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করেছেন। পঁচিশ মার্চ বাংলাদেশের জনসাধারণের যে দুঃস্বপ্নের রাত্রি শুরু হয়েছিল, এতদিনে তার অবসান হল। বাংলাদেশে আমাদের নিজেদের কর্তৃত্ব পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হল। এত অল্প সময়ে বােধহয় আর কোন জাতির স্বাধীনতা সংগ্রাম সফল হয়নি, স্বাধীনতার জন্য এত মূল্য বােধহয় আর কোন জাতি দেয়নি। আজকের বিজয় বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের বিজয়, ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীর বিজয়, সত্য, ন্যায় ও গণতন্ত্রের নিজয়। আমরা যারা আজ স্বাধীনতার সূর্যোদয় দেখার সৌভাগ্য লাভ করেছি, আসুন, শ্রদ্ধাবনত হৃদয়ে, কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করি সেই বীর মুক্তিযােদ্ধাদেরকে যারা নিজেদের উৎসর্গ করেছেন সকলের মঙ্গলের জন্য।

পাকিস্তানের সামরিক চক্র চেয়েছিল বর্বর শক্তি দিয়ে বাংলাদেশের জনগণকে দমন করে রাখতে। হানাদারেরা দেশের মানুষকে হত্যা করেছে, পঙ্গু করেছে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়েছে, আমাদের জাতীয় সম্পদ ধ্বংস করেছে। এই দুঃসময়ে আমাদেরকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে ভারত। আর তাই পাকিস্তানী সমরনায়কদের আক্রোশ গিয়ে পড়ে ভারতের উপর। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে তারা রূপান্তরিত করে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে। পশ্চিম রণাঙ্গনে ভারতীয় সেনারা পাকিস্তানী আক্রমণ প্রতিহত করেছেন। আর পূর্ব রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মিলিতভাবে সংগ্রাম করে তারা মাত্র বারাে দিনের যুদ্ধে দখলদার সেনাদেরকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছেন। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিপর্যয় এত দ্রুতগতিতে সম্পন্ন হতে পারল ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধ্যক্ষ জেনারেল মানেকশ’র নেতৃত্ব এবং সম্মিলিত বাহিনীর অধ্যক্ষ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরার নিপুণ রণকৌশলে। এই দুই | সেনাপতির কাছে এবং ভারতের স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনীর কাছে আমরা গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। আমাদের সাফল্যের এই মুহূর্তে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে | বাংলাদেশের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা গভীর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছে। তিনি যে ভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকার ও নেতাদের কাছে আমাদের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামের ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং যে ভাবে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, ইতিহাসে তার নজীর নেই। আমাদের সংগ্রামের ফলে ভারতের জনসাধারণকে যে বিপুল ভার বহন করতে হয়েছে, সে বিষয়েও আমরা সচেতন। তাদের এই কষ্ট স্বীকার সার্থক হয়েছে। শরণার্থীরা এখন মর্যাদার সঙ্গে প্রত্যেকে নিজের ঘরে ফিরে আসবেন। আমাদের সংগ্রামের গতি দৃঢ়তাপূর্ণ সমর্থন দানের জন্য বাংলাদেশের মানুষ সােভিয়েট ইউনিয়নের কাছে গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। পােল্যান্ড এবং অন্য যে সব দেশ আমাদের ন্যায় সগ্রামকে সমর্থন করেছে, তাদের কাছেও আমরা কৃতজ্ঞ। আমরা এ কথাও ভুলিনি যে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জনগণ, সংবাদপত্র, বেতার ও টেলিভিশনের সাংবাদিকেরা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য আমাদের সংগ্রামকে যথার্থরূপে তুলে ধরে এই সংগ্রাম সফল করতে সাহায্য করেছেন।

দেশবাসী ভাইবােনেরা, বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষ হয়েছে, কিন্তু আমাদের সংগ্রাম শেষ হয়নি। আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এখনও শত্রুর কারাগারে। পাকিস্তানী শাসকদেরকে আমি আহ্বান জানাচ্ছি, তারা শেষ মুহূর্তেও অন্ততঃ শুভবুদ্ধির পরিচয় দিন, বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করুন। এই দাবি মেনে নেবার সুফল সম্পর্কে পাকিস্তানকে অবহিত করাও তার বন্ধুদের কর্তব্য বলে আমি মনে করি। বন্ধুগণ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা এল এক রক্তাপুত ভূমিতে, এবং ধ্বংসস্তুপের মধ্যে। জনগণের আশা ও আকাংখা অনুযায়ী এই দেশকে নতুন করে গড়ে তােলার দায়িত্ব এখন আমাদের সামনে। দেশের দ্রুত পুনর্গঠনের কাজে আমরা ভারতের সহযােগিতা ও সাহায্য কামনা করব। শুধু পুননির্মাণ নয়—নতুন সমাজ গঠনের দায়িত্ব আমরা নিয়েছি। সংগ্রামের কালে সমগ্র জাতির যে ঐক্য ও আত্মত্যাগের পরিচয় আমরা দিয়েছি, সেই ঐক্য ও ত্যাগের মনােভাব অটুট রাখতে হবে। তবেই গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের ভিত্তি দৃঢ় হবে। সেই নতুন আলাের পথে আজ আমরা যাত্রা করলাম। জয় বাংলা।

সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ-ইতিহাসের পাতা থেকে – সিমিন হোসেন রিমি