ডিসেম্বর ২২, ১৯৭০ মঙ্গলবার ঃ দৈনিক ইত্তেফাক
নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলই শাসনতন্ত্র রচনা ও সরকার গঠনের ক্ষমতা রাখে। পিপলস পার্টির সহযােগিতা ছাড়া শাসনতন্ত্র রচনা বা কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করা যাইবে না বলিয়া লাহােরে জনাব ভূট্টো যে উক্তি করিয়াছেন, পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি জনাব তাজউদ্দিন আহমদ গতকাল এক বিবৃতিতে তাহার সমালােচনা করিয়া বলেন যে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিরঙ্কুশ। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল শাসনতন্ত্র রচনা ও সরকার গঠনের পূর্ণ ক্ষমতা রাখে এবং এই ধরনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েমের জন্যই জনসাধারণ সংগ্রাম করিয়াছে। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ তাহার বিবৃতিতে বলেন, পিপলস পার্টির সক্রিয় সহযােগিতা ভিন্ন কোন শাসনতন্ত্র রচিত হইতে, কিংবা কোন কেন্দ্রীয় সরকার গঠিত হইতে পারিবে না বলিয়া জনাব জুলফিকার আলি ভুট্টোর বরাতে প্রকাশিত বক্তব্য সঠিক নয়। পাঞ্জাব এবং সিন্ধু আর ক্ষমতার ভিত্তি’ নয়। ক্ষমতার এই ধরনের ভিত্তির বিরুদ্ধেই জনগণের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিচালিত হইয়াছে। জনসাধারণ সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যই ভােট দিয়াছে—যে গণতন্ত্রে ক্ষমতা জনগণের হাতে ন্যস্ত থাকে এবং এক ব্যক্তির এক ভােট’ নীতির ভিত্তিতে পরিষদ গঠিত হয়। এই পদ্ধতিতে পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দল শাসনতন্ত্র রচনার এবং কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনার সম্পূর্ণ ক্ষমতা রাখে। বর্তমানে নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ অনুরূপ দল রূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছে এবং জনগণের ম্যান্ডেট লাভ করিয়াছে । নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল অন্য দলের সহযােগিতা গ্রহণ করিয়া বা করিয়া কাজ চালাইতে পারে। এই ধরনের সহযােগিতা গ্রহণ করা বা না করা। আওয়ামী লীগের উপর নির্ভরশীল। আওয়ামী লীগের দলীয় নীতি ও কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ভিত্তিতেই এই ধরনের সহযােগিতার প্রশ্ন উঠিতে পারে। আওয়ামী লীগের নীতি ও কর্মসূচি শােষণমুক্ত এক নতুন সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করা।
কোন এক বিশেষ প্রদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা অন্যান্য প্রদেশের প্রতিনিধিদের তুলনায় বিশেষ মর্যাদা বা শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করিতে পারে না। এই ধরনের দাবির অর্থ হইবে অতীতের সংকীর্ণতায় প্রত্যাবর্তন। অতীতে কেন্দ্রীয় সরকারকে পশ্চিম পাকিস্তানের কতিপয় এলাকার ক্ষমতাসীন কোটারির স্বার্থ সংরক্ষণে ব্যস্ত দেখা গিয়াছে। পাকিস্তানের জনসাধারণ এই ধরনের অতীত কার্যকলাপকে বাতিল করিয়া দিয়াছে। উন্নততর ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হইতে হইলে আমাদের এই ধরনের দাবি পরিহার করিতে হইবে। কারণ ইহা অহেতুক এবং ক্ষতিকারক বিতর্ক সৃষ্টি করে। পাকিস্তানের জনগণের ইচ্ছা বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগ স্বীয় দায়িত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন আছে এবং এই ব্যাপারে কোন তৎপরতাই বাদ দিবে না। শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাই আওয়ামী লীগের লক্ষ্য ও ঘােড়াশাল (ঢাকা), ২০ ডিসেম্বর। পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দিন আহমদ আজ এখানে এক বিরাট জনসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে দেশের দুই-দুইটি নির্বাচনে শান্তি ও শৃংখলার সহিত ভােটদান করায় বাংলার মানুষের উচ্ছসিত প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, স্বার্থান্বেষী মহলের হাজারাে অপপ্রচার, প্ররােচনা এবং প্রলােভনকে উপেক্ষা করিয়া বাংলার মানুষ ৬-দফার পক্ষে সুষ্পষ্ট রায় দান করিয়া গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও গণতন্ত্র প্রীতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করিয়াছেন।
নির্বাচনকালে শান্তি ও শৃংখলা বজায় রাখিয়া বাংলার মানুষ বিশ্বের ইতিহাসে নিয়মতান্ত্রিক এবং শান্তিপ্রিয়তার এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করিয়াছেন বলিয়া তিনি মন্তব্য করেন। তিনি জনসাধারণকে স্বার্থান্বেষী মহলের দুরভিসন্ধি সম্পর্কে সতর্ক থাকার আহ্বান জানাইয়া বলেন যে, নির্বাচনে কায়েমী স্বার্থবাদীদের এজেন্টরা ধরাশায়ী হওয়ার পর ইহারা জনসাধারণ, বিশেষ করিয়া শ্রমিকদের মধ্যে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ােত্তর রক্তক্ষয়ী বিভেদ সৃষ্টির মত পুনরায় বিভেদ সৃষ্টির অপচেষ্টায় লিপ্ত হইয়াছে। তিনি আরও বলেন যে, কায়েমী স্বার্থবাদীদের কারসাজিতে বাজারে নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি এবং মূল্য বৃদ্ধি করিয়া দেশে একটি অঘটন ঘটাইতে প্রয়াস পাইতেছে। তিনি কায়েমী স্বার্থবাদী মহলকে আগুন লইয়া খেলা করিয়া দেশকে এক মহাবিপর্যয়ের মধ্যে নিক্ষেপ না করার আহ্বান জানান। আওয়ামী লীগ সম্পাদক দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘােষণা করেন যে, আওয়ামী লীগ হালুয়ারুটির দল নহে। আওয়ামী লীগের প্রত্যেক এম.এন.এ. ও এম.পি.এ, ৬-দফা আদায়ের সংগ্রামে অটল রহিয়াছে এবং যে কোন মূল্যেই তাহারা ৬-দফা দাবি প্রতিষ্ঠা করিতে দেশবাসীর নিকট ওয়াদাবদ্ধ। ইহার সহিত তাহার দলের কোন সদস্যই বিশ্বাসঘাতকতা করিবে না বলিয়া তিনি ঘােষণা করেন।
সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ-ইতিহাসের পাতা থেকে – সিমিন হোসেন রিমি