জুন ৫, ১৯৭০ শুক্রবার ঃ দৈনিক ইত্তেফাক
আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ঐক্যজোটে যাইবে না : গতকাল বৃহস্পতিবার পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে সাধারণ সম্পাদকের রিপাের্ট পেশকালে পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেন, আগামী নির্বাচনে আমরা কোন নির্বাচনী ঐক্যজোটে যাইব না। নির্বাচনী ঐক্যজোট সম্পর্কে আমাদের এবং বিভিন্ন দেশে আরাে অনেকের অভিজ্ঞতা খুব প্রীতিকর নয়। বিশেষ করিয়া যেখানে জনসাধারণ তাদের পছন্দমত প্রতিনিধি ও দল বাছাই করার সুযােগ পাইতেছে সেখানে নির্বাচনী ঐক্যজোট একটি বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করিবে। তার মানে এই নয় যে, আমরা দেশের অন্যান্য গণতন্ত্রকামী লােকদের সঙ্গে কোন যােগাযােগ রাখিতে চাই। আগেই বলিয়াছি, দেশের রাজনৈতিক ধারা যদি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে না আগায়, তাহা হইলে আমাদের আন্দোলনের পথে আগাইতে হইবে এবং সে পথে চলিতে গিয়া দেশের অন্যান্য গণতন্ত্রকামী মানুষের সুযােগ ও সাহচর্যকে আমরা স্বাগত জানাইব। অতীতেও আমরা বহুবার তার পরিচয় দিয়াছি। শুধু তাই নয়, সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে এবং দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আমরা সবসময়ই তাদের সহায়তা ও উপদেশকে স্বাগত জানাই। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ তাহার রিপাের্টে বলেন, আমাদের মূল লক্ষ্য হইল জনসাধারণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করা। নির্বাচনে অংশগ্রহণ তার একটি পন্থা মাত্র। যদি এ পন্থা অবলম্বনের সুযােগ আমাদের না দেওয়া হয় অর্থাৎ যদি নির্বাচন বানচাল করা হয় কিংবা নির্বাচিত পরিষদকে সুষ্ঠুরূপে কাজ সম্পন্ন করার সুযােগ না দেওয়া হয় তাহা হইলে আমাদের আন্দোলনের পথে আগাইয়া চলিতে হইবে। সে জন্যই প্রয়ােজন আমাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সর্ববিধ অঙ্গ সজীব ও সতেজ রাখা।
জনাব তাজউদ্দিন আহমদ তাহার রিপাের্টে বলেন যে, ভাষার দাবি হইতে শুরু করিয়া যে কোন স্বাধীন নাগরিকের যে সব তার জন্মগত অধিকার স্বাধীন নাগরিক বলিয়া পরিচয় লাভ করার পরও সে সব অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জোর সংগ্রাম চালাইতে হইতেছে। বহু আন্দোলন, বহু কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার, বহু মৃত্যুর বিনিময়ে কিছু দাবির স্বীকৃতি আদায় করা সম্ভব হইয়াছে। কিন্তু আমাদের বাঁচা মরার দাবি ৬-দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন ও অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এখনও বাকি রহিয়াছে। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেন, যারা আমাদের দেশপ্রেম ও আনুগত্য সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করিয়া আসিতেছেন, তাদের দেশপ্রেম ও আনুগত্য কোনদিন পরীক্ষা করিয়া দেখা হয় নাই। আজ সে সব পরীক্ষার সময় আসিয়াছে। সমানভাবে বাঁচার অধিকারের দাবি নিয়া আমরা আমাদের ৬-দফা কর্মসূচি পেশ করিয়াছি। এই দাবি গ্রহণ করার মধ্যেই রহিয়াছে দেশপ্রেম, দেশানুগত্যের প্রমাণ। যারা তা অগ্রাহ্য করে তাদের দেশপ্রেম সম্পর্কে কি আমরা সন্দেহ প্রকাশ করতে পারি না! জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেন যে, যুগ যুগ ধরিয়া বঞ্চিত ও নিষ্পেষিত হইয়া দেশের মেরুদন্ড কৃষক ও শ্রমিকের দুরবস্থা আজ ভয়াবহ রূপ ধারণ করিয়াছে। দেশের সম্পদের অংশীদার তারা হইতে পারেন নাই, ন্যায্য অংশ হইতে তাহাদের বঞ্চিত রাখা হইয়াছে। ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্য তাহাদের জীবন দুর্বিষহ করিয়া তুলিয়াছে। জনাব তাজউদ্দিন বলেন যে, শ্রমিকের দাবি ও শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের বিরােধিতার সঙ্গে সরকারী বিরােধিতা যুক্ত হইয়াছে। যেখানেই শ্রমিক তার ন্যায্য দাবির জন্য আন্দোলন করেন, সেখানেই তাঁকে রাজরােষে পড়িয়া নির্যাতন ভােগ করিতে হয় এবং অনেক স্থানেই চরম শান্তি গ্রহণ করিতে হয়। জনাব তাজউদ্দিন তাহার রিপাের্টে বিগত দুই বৎসরে আওয়ামী লীগ সংগঠনের তৎপরতা ও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিশদ বিবরণ দেন।
সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ-ইতিহাসের পাতা থেকে – সিমিন হোসেন রিমি