মে ২৩, ১৯৭০ শনিবার ঃ দৈনিক ইত্তেফাক
আগামী নির্বাচনে মীরজাফরদের চিরতরে উৎখাত করুন ঃ জাঙ্গালিয়া, ঢাকা, ২১ মে। পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দিন আহমদ আগামী নির্বাচনে পশ্চিম-পাকিস্তানের পুঁজিপতিদের দালাল এবং এ-দেশীয় মীরজাফরদের বাংলার বুক হইতে চিরতরে উৎখাত করার জন্য বাংলার জাগ্রত জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানাইয়াছেন। তিনি আরও বলেন, বাংলার বঞ্চনা ও দুঃখ-দুর্দশার জন্য এই মীরজাফররাই দায়ী। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেন, বাঙ্গালির অধিকার প্রতিষ্ঠা ও স্বার্থ আদায়ের জন্য কোন রাজনৈতিক দল সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করিয়াছেন এবং কোন রাজনৈতিক দল ধর্ম ও পাকিস্তান ধ্বংসের ধুয়া তুলিয়া বাংলার আসল প্রসঙ্গকে চাপা দেওয়ার প্রয়াস পাইয়াছে—বাস্তবের কষ্টি পাথরে তাহা যাচাই করার জন্য জনসাধারণের প্রতি অনুরােধ জানান। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ তাহার ভাষণে বাংলার অধিকারহারা মানুষের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা, স্বায়ত্তশাসন, ভাষা, জনগণের ভােটাধিকার, জনসংখ্যার ভিত্তিতে বাংলার প্রতিনিধিত্বের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান সহ অন্যান্য নেতা ও কর্মীর নিরবচ্ছিন্ন ত্যাগ-তিতিক্ষার ইতিহাস এবং সমকালীন অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ভূমিকার উল্লেখ করিয়া বলেন, আইয়ুবমমানেম খানের অত্যাচার-নিপীড়নের দশকে বাংলার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী হিসাবে ফাঁসী কাষ্ঠে ঝুলিবার মুহূর্ত গণিতেছিলেন।
আওয়ামী লীগ নেতা জনাব তাজউদ্দিন, মওলানা মওদুদী ও জামাতে ইসলামী, চৌধুরী মােহাম্মদ আলি, নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান, কাইয়ুম খান এবং তাহাদের এ দেশীয় দোসরদের তীব্র সমালােচনা করেন। মওলানা মওদুদীর সমালােচনা করিয়া তিনি বলেন, মওলানা মওদুদীই একদিন কায়েদে আযমকে “কাফেরে আযম” এবং পাকিস্তানকে কুফুরীস্থান’ বলিয়া অভিহিত করিয়াছিলেন। তিনি জানান, পাক-ভারত উপমহাদেশের কোন মানুষ মওলানা মওদুদীর সেদিনের ভূমিকার কথা বিস্মৃত হয় নাই। জামাতে ইসলামী কর্তৃক ৬-দফা ইসলাম ও পাকিস্তান বিরােধী প্রচারণার জবাব দান প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ৬-দফা দাবি প্রতিষ্ঠিত হইলে পশ্চিম-পাকিস্তানী পুঁজিপতিদের শােষণ বাংলার বুকে চিরতরে বন্ধ হইয়া যাইবে। তাই ইহাদের এ দেশীয় ভাড়াটিয়া এজেন্টরা ৬-দফার বিরুদ্ধে আজ এত বেসামাল হইয়া পড়িয়াছে এবং নানারকম ধর্মীয় জিকির ও ফতােয়া জারি করিয়া বাংলার ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির কাজে আত্মনিয়ােগ করিয়াছে। তিনি ইহাদের ভাওতা সম্পর্কে সতর্ক থাকার জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানাইয়া বলেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময় হইতে এ পর্যন্ত বাংলার মানুষ ইহাদের সকল ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করিয়া দিয়াছে। ভবিষ্যতেও বাংলার জাগ্রত মানুষ ইহাদের ভাঁওতাবাজিতে বিভ্রান্ত হইবে না বলিয়া তিনি উল্লেখ করেন। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ জামাতে ইসলামীর নির্বাচনী কর্মসূচিতে ৩০ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফের সিদ্ধান্তের সমালােচনা করিয়া বলেন যে, ইহারাই মাত্র কয়েকদিন পূর্বে আওয়ামী লীগের ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাইয়াছে যে, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করিলে নাকি রাষ্ট্র অচল হইয়া পড়িবে।
এখন ৩০ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করিলে রাষ্ট্র কিভাবে চলিবে তাহা তিনি জিজ্ঞাসা করেন। আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, শােষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে অত্যাবশ্যক দ্রব্যাদি উৎপাদনের কলকারখানা জাতীয়করণের কথায় যাহারা ইসলাম বিপন্নের ধুয়া তুলিয়াছেন ইহারাই আবার তাহাদের নির্বাচনী কর্মসূচিতে ভারি কল-কারখানা রাষ্ট্রায়ত্ত আনয়নের প্রতিশ্রুতি দেন কোন ইসলামের বিশ্বাসে ? বাংলার জনসাধারণ ইহাদের অন্তঃসারশূন্য গালভরা প্রতিশ্রুতিতে ভুলিবে না বলিয়া তিনি উল্লেখ করেন। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ পূর্ব-বাংলাকে শােষণের বিরুদ্ধে একই পাকিস্তানে বাঙ্গালি মুসলমান ভাইদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমান শােষকদের হৃদয়হীন শোষণের বিরুদ্ধে বাঙ্গালি মুসলমানদের প্রতি বে-ইনসাফীর বিরদ্ধে ফতােয়া জারি করার জন্য জামাতে ইসলামী ও তথাকথিত ইসলাম দরদীদের প্রতি উপদেশ দেন।
সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ-ইতিহাসের পাতা থেকে – সিমিন হোসেন রিমি