ফেব্রুয়ারি ২৪, ১৯৭০ মঙ্গলবার ঃ দৈনিক ইত্তেফাক
শোষণমুক্ত সমাজ গড়িয়া তােলার জন্য ৬-দফার পক্ষে রায় দানের আহ্বান ঃ চাঁদপুর, ২৩ ফেব্রুয়ারি। প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব। তাজউদ্দিন আহমদ গত শুক্রবার এখানে বিরাট জনসভায় বক্তৃতাকালে বলেন যে, বাংলার জনগণের ভােটের স্বাধীনতা অর্জিত হইলেও গত বাইশ বৎসর ধরিয়া এ দেশের ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষ শুধু দুঃসহ বঞ্চনা, অন্তহীন অবিচার, সীমাহীন বৈষম্য, শোষণ আর লুণ্ঠনের তীব্র করাঘাতে জর্জরিত হইয়া আসিয়াছে। তাই তিনি আজ একটি শােষণমুক্ত সমাজ গড়িয়া তােলার জন্য আওয়ামী লীগের প্রচেষ্টায় শরিক হইয়া ৬-দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে রায় দানের জন্য জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ গণ-বিরােধী কার্যকলাপের জন্য পিডিপি প্রধান জনাব। নূরুল আমিনের তীব্র সমালােচনা করিয়া বলেন, জনাব আমিন আজ মুখে গণতন্ত্রের বড় বড় বুলি আওড়াইতেছেন, কিন্তু ১৯৫৪ সালের আগে মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে কেন ৭ বছর ৩৪টি আসনের উপ-নির্বাচন ঠেকাইয়া রাখিয়াছেন ? জনাব তাজউদ্দিন বলেন যে, জনাব নূরুল আমিনের শাসনামলে ৩৫টি শূন্য আসনের মাত্র ১টিতে উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং উহাতে আওয়ামী লীগ নেতা। জনাব শামসুল হক জয়লাভ করেন। অতঃপর সেদিনের সেই গণ-বিরােধী সরকার আর কোন উপ-নির্বাচন হইতে দেয় নাই বলিয়া উল্লেখ করিয়া আওয়ামী লীগ।
সম্পাদক বলেন, এইভাবেই গণতন্ত্রের টুটি টিপিয়া হত্যা করা হয়। পিডিপি । প্রধানের উদ্দেশ্যে জনাব তাজউদ্দিন আরও বলেন, ১৯৫২ সালে কে আমার ভাইয়ের বুকে গুলি চালাইয়াছিল, কাহারা ১৯৫৪ সালের সালের যুক্তফ্রন্টের ২১দফার পক্ষে প্রদত্ত জনগণের রায়কে বানচাল করিয়াছিল, কেন আপনারা শতকরা। ৯৭ ভাগ জনসমষ্টির সেই নিরঙ্কুশ রায়কে মানিয়া নিতে পারেন নাই ? কেন। আপনার মুরব্বিরা ৯২(ক) ধারা জারি করিয়াছিল, কেন সাড়ে ৩ হাজার আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হইয়াছিল ? জবাব দিন, এই জুলুম। আপনারা সেদিন কেন চালাইয়াছিলেন ? আজ আপনাদের মুখে গণতন্ত্রের বুলি। শুনিলে হাসি পায়। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেন যে, সর্বস্বপণ করিয়া স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার সময় দেশবাসী আশা করিয়াছিল তাহারা পূর্ণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার পাইবে—স্বপ্ন দেখিয়াছিল সুখে-স্বাচ্ছন্দে খাইয়া পরিয়া বাচিতে পারিবে, ছেলে-সন্তানের শিক্ষা-দিক্ষার ব্যবস্থা হইবে। কিন্তু এই দুর্ভাগা দেশের ভাগ্যবিড়ম্বিত গণ-মানুষের যে আশা ভাঙ্গিয়া খান খান হইয়া গিয়াছে—সেই সােনালী স্বপ্ন একটি বিরাট মিথ্যায় পর্যবসিত হইয়াছে। তিনি আরও বলেন যে, প্রকৃতপক্ষে বাংলার জনগণের ভােটেই স্বাধীনতা অর্জিত হইয়াছে। গত বাইশ বছর ধরিয়া তাহারা সকলের প্রতি সম-অধিকার আর সম্প্রীতির উদার হস্ত প্রসারিত করিয়া ধরিয়াছে আর বিনিময়ে পাইয়াছে শুধু দুঃসহ বঞ্চনা, অন্তহীন অবিচার, সীমাহীন বৈষম্য, শশাষণ আর লুণ্ঠনের সুতীব্র কষাঘাত।
বেদনা বিক্ষুদ্ধ কণ্ঠে জনাব তাজউদ্দিন জিজ্ঞাসা করেন “এজন্যই আমরা স্বাধীনতা চাহিয়াছিলাম?” বক্তৃতায় তিনি আরও বলেন যে, দেশবাসী যাতে স্বাধীনতার ফল ভােগ করিতে পারে সে জন্য স্বায়ত্তশাসন আদায় ও শশাষণ মুক্ত সমাজ গড়িয়া তােলার জন্য আওয়ামী লীগ বছরের পর বছর ধরিয়া আপােসহীন সংগ্রাম চালাইয়া আসিতেছে। আর এ জন্য শহীদ সােহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবসহ দলের অগণিত নেতা ও কর্মীকে জেল-জুলুম নির্যাতনের অসংখ্য অগ্নিপরীক্ষা পার হইয়া আসিতে হইয়াছে। কিন্তু। আওয়ামী লীগ চরমতম দুর্যোগের মুহূর্তে জনগণের সঙ্গে বেঈমানী করে নাই, জনতার নিকট হইতে সরিয়া যায় নাই। তিনি আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের। ৬-দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে রায় দানের জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।
সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ-ইতিহাসের পাতা থেকে – সিমিন হোসেন রিমি