জানুয়ারি ২২, ১৯৭০ বৃহস্পতিবার ঃ দৈনিক ইত্তেফাক
বঞ্চনা ও বৈষম্যের অবসানই ৬-দফার লক্ষ্য ও স্টাফ রিপাের্টার। গত রবিবার চরসিন্দুর আওয়ামী লীগের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত জনসভায় আওয়ামী লীগ নেতা জনাব তাজউদ্দিন আহমদ ৬-দফা কর্মসূচি প্রণয়নের পটভূমিকা বিশ্লেষণ করিয়া বলেন যে, বঞ্চনা ও বৈষম্যের অবসান ঘটাইয়া ন্যায় ও ইনসাফের ভিত্তির উপর পাকিস্তানের সংহতিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই ৬-দফা প্রণয়ন করা হইয়াছে। তিনি আরও বলেন, স্বাধীনতার পর হইতে বাঙ্গালি যুবকরা সৈন্য হওয়ার উপযুক্ত নয় বলিয়া প্রচার করিয়া আমাদের নৈতিক চরিত্রকে দুর্বল করিয়া দেওয়ার প্রয়াস পাওয়া হইয়াছে। মুহুর্মুহু করতালির মধ্যে জনাব তাজউদ্দিন আহমদ ঘােষণা করেন, বিগত সেপ্টেম্বরের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় দেখা গিয়াছে যে, অবহেলিত বাংলার জোয়ানরাই লাহাের রক্ষা করিয়াছে বুকের তাজা রক্ত দিয়া। তিনি আরও বলেন, ১৭ দিনের যুদ্ধই প্রমাণ করিয়াছে যে, বাঙ্গালি বীর যােদ্ধার জাতি এবং দেশপ্রেমিক মাতৃভূমি রক্ষার জন্য তাহারা যে কোন ত্যাগ স্বীকার করিতে প্রস্তুত। তিনি বলেন, লাহাের রক্ষার ব্যাপারে বাঙ্গালির এই সাহস ও আত্মত্যাগ পশ্চিম পাকিস্তানের জনসাধারণের নিকটও প্রশংসিত হইয়াছে। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ জনসংখ্যার ভিত্তিতে বাংলাদেশ হইতে সেনাবাহিনীতে লােক নিয়ােগের জন্য দাবি জানান। তিনি বলেন, দেশের উভয় অংশকে সমানভাবে শক্তিশালী করিয়া তুলিলে দেশ যে কোন সময় যে কোন শত্রুর মােকাবিলা করিতে পারিবে। আপদকালে তাহাকে আমেরিকা, রাশিয়া বা চীনের সাহায্যের জন্য তাকাইয়া থাকিতে হইবে না।
জনাব তাজউদ্দিন আহমদ পূর্ব-বাংলার স্বার্থের প্রশ্ন উঠিলে কিভাবে ইহাকে ধর্মের নামে ও পাকিস্তান ধ্বংসের নামে বিগত ২২ বৎসর ধরিয়া ধামাচাপা দেওয়া হইয়াছে। তাহার এক দীর্ঘ ইতিহাস বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, যখন পূর্ব বাংলার করালগ্রাসী বন্যা প্রতিরােধের দাবি ওঠে, যখন বাংলার ভুখানাঙ্গা মানুষের কর্মসংস্থানের দাবি ওঠে, যখন যমুনার উপর সেতু নির্মাণের দাবি ওঠে অথবা স্বায়ত্তশাসনের দাবি ওঠে, তখনই এই দাবির সম্মুখে ইসলামকে আনিয়া খাড়া করা হয়। তিনি জিজ্ঞাসা করেন ৭ কোটি বাঙ্গালির বাঁচার দাবি উঠিলেই ইসলাম আর জাতীয় সংহতির দোহাই দেওয়া হয় কেন ? পূর্ব-বাংলার অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ে যখন পশ্চিম পাকিস্তানে কল-কারখানা, ইমারত আর রাওয়ালপিন্ডি-ইসলামাবাদে রাজধানী গড়িয়া ওঠে, বাজেট বহির্ভূত অর্থ হইতে যখন তারবেলা-মঙ্গলা বাঁধ নির্মিত হয়, তখন ইসলাম ও পাকিস্তান ধ্বংসের স্লোগান কোথায় থাকে। তিনি এই তথাকথিত ইসলাম দরদীদের সম্পর্কে সচেতন থাকার জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানান। আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রাণের দাবি স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে বানচাল করার জন্য আজ অনেকে অনেকরূপে মাঠে নামিয়াছেন।
তিনি ইহাদের সম্পর্কেও সতর্ক থাকার আহ্বান জানান। তিনি বাংলার দাবি আদায়ের উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগের পতাকাতলে সমবেত হইয়া সংগ্রাম করার জন্য সকলের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযােগ্য যে, এইদিন জনাব তাজউদ্দিন আহমদ উল্কাযােগে সকালে ঘােড়াশাল পৌছিলে স্থানীয় শ্রমিকগণের পক্ষ হইতে তাহাকে ও তাহার সহকর্মীগণকে বিপুলভাবে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। এই উপলক্ষে ঘােড়াশাল স্টেশনের নিকট এক শ্রমিক সভারও আয়ােজন করা হয়। জনাব তাজউদ্দিন শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার প্রতি আওয়ামী লীগের সমর্থনের আশ্বাস দান করেন। গত গণ-আন্দোলনের মুখে দীর্ঘ কারাভােগ হইতে মুক্তিলাভের পর আওয়ামী লীগ নেতা জনাব তাজউদ্দিনের ঘােড়াশাল ও চরসিন্দুর সফর ইহাই প্রথম।
সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ-ইতিহাসের পাতা থেকে – সিমিন হোসেন রিমি