You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.06 | জীইয়ে রাখা চলে না বাংলাদেশ সমস্যা | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

জীইয়ে রাখা চলে না বাংলাদেশ সমস্যা

হিসেব ভুল করেছেন কেন্দ্রীয় সরকার। বাংলাদেশের লড়াই-এর তিন মাস কেটে গেছে। ইয়াহিয়ার উপর তৈরী হয়নি উল্লেখযােগ্য অর্থনৈতিক চাপ। সৌদী আরব, ইরান এবং তুরস্ক ইসলামাবাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে। আরব রাষ্ট্রগুলাে নীরব। সােভিয়েট রাশিয়া এখনও মনঃস্থির করতে পারেনি। ওয়াশিংটন সরবরাহ করছে অস্ত্রশস্ত্র। তাঁদের নিষেধাজ্ঞা কার্যতঃ অচল। ইয়াহিয়া চাচ্ছেন আরও মার্কিন বােমারু বিমান। ওয়াশিংটন কি করবেন জানা যায়নি। তাদের মতিগতি সন্দেহজনক। ফ্রান্স নিশ্চিত বসে নেই। পাকিস্তান তার কাছ থেকেও পাচ্ছে সমরসম্ভার। ইউরােপে অস্ত্রের বাজার গরম। দালালদের মাধ্যমে সেখানে অস্ত্র কেনা সম্ভব। এই গােপন পথেও পা দিয়েছে পাকিস্তান। টাকা জোগাচ্ছে সৌদী আরব এবং কুয়ায়েট। বৃটেনের বেকরকারী মহল ইয়াহিয়া-বিরােধী হৈ-চৈ করছেন তাদের আন্দোলন সরকারের মনে রেখাপাত করবে কিনা, বলা মুস্কিল। কানাডা এবং হল্যান্ড অস্ত্র দেবে না পাকিস্তানকে। তাদের প্রভাব খুবই সীমিত। জঙ্গী শাসকেরা বংলাদেশ সমস্যার সাময়িক ফয়সালায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। দ্রুততালে চলছে তাদের সমর প্রস্তুতি। ধাপে ধাপে সৈন্যর সংখ্যা বাড়ছে। ওদের অস্ত্রের অভাব নেই। চীন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে বসেই আছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের পাঁয়তারা রহস্যময়। যারা বাংলাদেশ সফর করেছেন, তারা বলছেন, অবস্থা মােটেই স্বাভাবিক নয়। কিন্তু বিশ্বসভা সেখানে সুরু করতে যাচ্ছেন উন্নয়নমূলক কাজকর্ম। এমনকি বিশ্ব-ব্যাঙ্কের মূল্যায়নের সঙ্গে মিলছে না রাষ্ট্রসঙ্ঘের মূল্যায়ন। এর পর মার্কিন-প্রভাবিত বিশ্ব-ব্যাঙ্ক ডিগবাজী খেলেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই।
গত তিন মাস ধরে বহু ঢাকঢােল পিটিয়েছেন নয়াদিল্লী। বিদেশে সাধারণ মানুষের মনে জেগেছে খানিকটা আলােড়ন। যারা ক্ষমতায় আসীন, তাঁদের মন কতখানি গলেছে তার নেই কোন হদিশ। জয়প্রকাশের মূল্যায়নের সঙ্গে খাপ খাচ্ছে না পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বরণ সিং এর মূল্যায়নের। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ক্রমেই অধৈর্য হয়ে পড়েছেন। বিরূপ সমালােচনা উঠলেই তিনি তিরিক্ষী মেজাজ দেখাচ্ছেন। ভারতীয় জনতা দিশাহারা। তারা বুঝতে পারছেন না কেন্দ্রীয় সরকারের মতিগতি। শরণার্থীর সংখ্যা ছাপিয়ে গিয়েছে। ইয়াহিয়ার আটাশে জুনের বেতার বক্তৃতার পর রাজনৈতিক সমাধানের আশা ভেস্তে গেছে। পাক-শাসকদের দৃষ্টিতে মুজিবর আসামী। তার বিচারের তােড়জোড় অবশ্যই চলবে। এ-অবস্থায় শরণার্থীরা ফিরবেন না স্বদেশে। পশ্চিমী পাক-সুহদরা হয়ত আবার উপদেশের ঝাপি খুলবেন। ওরা হয়ত বলবেন—আর হাঙ্গামার দরকার কি? শরণার্থীদের পাকাপাকিভাবে বসিয়ে দাও ভরতের মাটিতে। তার জন্য কিছু অর্থ সাহায্য করা যাবে। এ ধরনের রসিকতা অস্বাভাবিক নয়। ওদের সামরিক স্ট্র্যাটেজী আলাদা। দু’দিন আগেই হােক, আর পরেই হােক আমেরিকাকে ছাড়তে হবে ভিয়েৎনাম। তারপর হয়ত পাকিস্তানকে সামনে রেখে গড়ে উঠবে পশ্চিমী সামরিক জোটের প্রতিরক্ষা লাইন। চীনের হাত থেকে ইসলামাবাদকে ছিনিয়ে আনার জন্য পূর্ববাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষকে সাগরের জলে ভাসিয়ে দিতেও তারা রাজী। প্রয়ােজনের তাগিদেই আমেরিকা এবং পশ্চিমী দুনিয়া পাক-জঙ্গীশাহীকে ডুবাবে না, ভাসিয়ে রাখবে। ভারতের সামনে মহাদুর্দিন আসন্ন।
শরণার্থীর বােঝা নিয়ে সে ধুকছে। তার অর্থনৈতিক কাঠামাে ক্রমেই নুইয়ে পড়ছে। সামনে দেখা যাচ্ছে না কোন সমাধানের পথ। দুনিয়ার বিবেকে সুড়সুড়ি দেবার কসরৎ প্রায় ব্যর্থ। আর্থিক চাপে পাকিস্তানকে ধরাশায়ী করার আশা নিস্ফল। ইয়াহিয়া খান আগের চেয়ে বেশী উদ্ধত এবং বেপরােয়া। পশ্চিমী শক্তিগুলাে এবং আমেরিকার গােপন আস্কারা না থাকলে ইসলামাবাদের পক্ষে এতখানি দুঃসাহসী হয়ে ওঠা সম্ভব ছিল না। নয়াদিল্লীর দুর্বলতা বুঝে ফেলেছে সবাই। কোন হুমকী তার গ্রাহ্য করছে না। প্রধানমন্ত্রী গান্ধী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বরণ সিং হুঙ্কার দিয়েছিলেন বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে কেউ এগিয়ে না এলে ভারত নেবে তার নিজস্ব পথ। দুনিয়ার প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলাে তাতে কান দেয়নি। তার হয়ত মনে করছে ভারতের নিজস্ব কোন পথ নেই। নয়াদিল্লী এখন কি করবেন? তার মাথার উপর রয়েছে শরণার্থীর বােঝা। বেশী দিন নিষ্ক্রিয় থাকলে ওটা হয়ত হবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। বাংলাদেশের উপর ইয়াহিয়া পাকাপাকিভাবে বসতে পারলে এ অঞ্চলের রাজনৈতিক রূপান্তর ঘটবে।
নিরপেক্ষ এবং বন্ধুভাবাপন্ন বাংলাদেশের বদলে দেখা দেবে সাম্প্রদায়িক এবং ভারত বিরােধী পূর্ব পাকিস্ত নি। চীন, পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান— এই তিন বৈরীর মাঝখানে পড়বে ভারত। প্রতিরক্ষা খাতে তার ব্যয় বাড়বে। উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলাে সঙ্কুচিত হয়ে আসবে। তীব্র হয়ে উঠবে রাজনৈতিক এবং সামাজিক অশান্তি। এই ফাঁদ এড়াবার উপায় খুঁজে বার করা অবশ্য প্রয়ােজন। বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি এবং মুক্তিফৌজকে সামরিক সাহায্য দান ছাড়া অন্য কোন পথ খােলা নেই। ভারতের বাহুবলের প্রয়ােগ নিশ্চিত হয়ে উঠলেই টনক নড়বে স্বার্থান্বেষী পশ্চিমী রাষ্ট্রগুলাের। তারা তখন বােঝার চেষ্টা করবে—এশিয়ার শান্তি এবং পশ্চিমী স্বার্থের জন্য কার বন্ধুত্ব বেশী প্রয়ােজন—ভারতের, না পাকিস্তানের? ওরা রাখতে চাইবে দুটিকেই। নয়াদিল্লীর পক্ষে তখন শর্ত আরােপ হবে সহজ। তাতে বাঁচবে ভারত এবং বাঁচবে বাংলাদেশ।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৬ জুলাই ১৯৭১