You dont have javascript enabled! Please enable it! পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনে তাজউদ্দীন আহমদ - সংগ্রামের নোটবুক

পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনে তাজউদ্দীন আহমদ

মুসলিম লীগের উদারপন্থী অংশের সংগঠক হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ ও তার সহকর্মীগণ পাকিস্তানের জন্মের অনতিবিলম্বে অনুধাবন করেন যে, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশের ঔপনিবেশিক শাসন হতে পূর্ব বাংলার মানুষ মুক্তি পেলেও আর একটি ঔপনিবেশিক শাসনের নিগঢ়ে বাধা পড়েছে। এর প্রভাব পড়ে রাষ্ট্র, সমাজ, সংস্কৃতি অর্থনীতি সকল ক্ষেত্রে। ফলে তারা মুসলিম লীগ রাজনীতির বিপক্ষে বিকল্পধারায় সংগঠিত হয়ে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ক্রমশ সােচ্চার হয়ে ওঠেন। এইলক্ষ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তােলার প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। একাদিক্রমে গড়ে ওঠে গণআজাদী লীগ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, আওয়ামী মুসলিম লীগ, যুবলীগ প্রভৃতি রাজনৈতিক ও অর্ধরাজনৈতিক সংগঠন। তাজউদ্দীন আহমদ ও তার সহকর্মীরা গণআজাদী লীগ নামক একটি উদার গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল গঠন প্রচেষ্টার পাশাপাশি ভাষা আন্দোলন।

এবং উল্লিখিত অপরাপর প্রাথমিক উদ্যোগের সঙ্গেও যুক্ত হন। ১৯৫৩ সালে যুক্ত হন মূলধারার রাজনীতিতে। যুক্তফ্রন্ট গঠন, ‘৫৪-র নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং নির্বাচন পরবর্তীতে বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন:

যেমন সার্বজনীন। ভােটাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি, সামরিক শাসনবিরােধী আন্দোলন, আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন, ৬ দফা প্রণয়ন এবং ৬ দফাভিত্তিক আন্দোলন পরিচালনা প্রভৃতি প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি মৌলিক এবং

প্রায় ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারণের মত গুরুত্বপূর্ণ কাজে সম্পৃক্ত হন । ভাষা আন্দোলনে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে সূচনা হয় ছয়। দফা দাবির মধ্য দিয়ে তা স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের শীর্ষ বিন্দুতে উপনীত হয়। এবং একটি

সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অনুপ্রেরণা জোগায়। নিমে ঐতিহাসিক এই সংগ্রামের প্রধান প্রধান অভিঘাতগুলাে আলােচনা করা হলাে।

পূর্ব বাংলায় স্বায়ত্তশাসনের দাবিসম্বলিত রাজনীতির সূত্রপাত

বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসের প্রায় সবটুকু স্থান দখল করে আছে। স্বায়ত্তশাসনকেন্দ্রিক আন্দোলন। বঙ্গদেশকেন্দ্রিক রাষ্ট্রীয় সীমানা প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগে বারবার পরিবর্তিত হয়েছে। এই জনপদের ইতিহাস

যতটা প্রাচীন রাষ্ট্রচিন্তায় স্বায়ত্তশাসনের ধারণা ততটা পুরনাে নয়। বস্তুত প্রাচীন ও মধ্যযুগে কখনাে কখনাে কোনাে কোনাে শাসক স্বাধীন সত্তায় শাসন কাজ পরিচালনা করলেও গণমানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের

ধারণা স্বীকৃত ছিল না। ব্রিটিশ-শাসিত ভারতবর্ষে লর্ড রিপনের শাসনামলে (১৮৮০-১৮৮৪ খ্রি:) রাষ্ট্রচিন্তায় সর্বপ্রথম স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের ধারণা স্থান লাভ করে। ততদিনে অবশ্য সর্বভারতীয় আঙ্গিকে ভারতবাসীর

রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। এই প্রচেষ্টা ক্রমশ সংঘবদ্ধ হয়ে শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী সংগ্রামে পরিণত হলে কিছু কিছু ক্ষমতা স্থানীয় পর্যায়ে ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৩৫ সালে

ভারত শাসন আইনে সর্বপ্রথম সীমিত পরিমাণে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা রাখার মধ্য দিয়ে এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু। ১৯৩৭ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর এটি কার্যকর হয়। এই নির্বাচনে পূর্ব বাংলায় সর্বভারতীয়

দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের পাশাপাশি শের-ই-বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের (১৮৭৩-১৯৬২) নেতৃত্বাধীন কৃষক প্রজা পার্টি অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করে। ১৯২৯ সালে আবদুর রহিম (১৮৬৭-

১৯৫২) নামক একজন অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি বিচারপতির উদ্যোগে ‘নিখিলবঙ্গ প্রজা সমিতি’ নামে এই দলটির আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। প্রজা সমিতি মূলত পূর্ব বাংলার গ্রামগুলােতে কৃষকদের মধ্যে কাজ শুরু করে ।

কিন্তু হিন্দু জমিদার, দাদন ব্যবসায়ী, মহাজন, বর্ণহিন্দু ও উচ্চ মধ্যবিত্তশাসিত পূর্ব বাংলায় ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত প্রজা সমিতি তেমন কোনাে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি মূলত আর্থ-সামাজিক অবস্থানের কারণে। তবে

১৯৩৫ সালে ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে সংগঠনটির নাম পরিবর্তন করে করা হয় কৃষক প্রজা পার্টি এবং এর কর্মসূচি ও স্লোগান নির্ধারিত হয় কৃষকদের অনুকূলে। ফজলুল হক দলটির সভাপতি নির্বাচিত হয়ে এটাকে

সাধারণ মানুষের নিকট জনপ্রিয় করে তুলতে সচেষ্ট হন। এর অন্যতম জনপ্রিয়

—————-

১৪৯.Enayetur Rahim, Provincial Autonomy in Bengal (1937-1943) (Rajshahi : The Institute of Bangladesh Studies,

1981), p. 59. ১৫°. Ibid., pp. 59-60.

————-

স্লোগান হয় লাঙ্গল যার জমি তার’ ।১৫১ ফলে ভূমির অধিকারহীন কৃষককুলের অনেকেই এই দলের প্রতি আকৃষ্ট হন বটে, কিন্তু জমিদার ও তালুকদাররা ধীরে ধীরে এই সংগঠন ত্যাগ করেন।১৫২ ফজলুল হকের

সহজ সরল মেলামেশা এবং সাধারণ আটপৌরে ভাষায় কৃষকদের সমস্যার কথা তুলে ধরার কারণেও অতি অল্প সময়ের মধ্যে এই দলটি পূর্ব বাংলায় তৃণমূল পর্যায়ে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৩৭ সালে নির্বাচনের

প্রাক্কালে এর যে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করা হয় তা ছিল অনেক বেশি উদার এবং স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এক ধরনের যুগান্তকারী কর্মসূচি বিশেষ। ১৫৩  এতে যেমন প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের প্রতি গুরুত্ব। দেয়া

হয়, তেমনি ঋণ-জর্জরিত ভূমির অধিকারহীন কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতি অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়। পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক বিকাশের ইতিহাসে এর তাৎপর্য উল্লেখ করার মতাে। এর ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে

রাজনৈতিকভাবে সংঘবদ্ধ হওয়ার প্রয়ােজনীয়তা অনুভূত হয়। এভাবে উচ্চ ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণী প্রভাবিত মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের বাইরে কৃষক প্রজা পার্টি অসাম্প্রদায়িক আদর্শ। নিয়ে বাংলার রাজনীতিতে তৃতীয়

একটি ধারার সংযােজন করে। এটি কৃষক সাধারণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অধিকারহীনদের একটি সংগ্রামের সূত্রপাত ঘটায়। সাধারণ মানুষের এই জাগরণের প্রেক্ষিতে প্রজা পার্টি ১৯৩৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব

বাংলায় খুব ভাল ফল করে।** স্বতন্ত্র সদস্যদের মধ্যে ২১ জন মুসলিম লীগে এবং ১৬ জন প্রজা পার্টিতে যােগ দেয়ায় ২৫০ সদস্যের প্রাদেশিক পরিষদে প্রধান তিনটি বড় দল কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও প্রজা পার্টির সদস্য

সংখ্যা হয় যথাক্রমে ৬০, ৫৯ ও ৫৫ জন। কংগ্রেস সরকার গঠনে। কিংবা কোয়ালিশনে আগ্রহ না দেখানাের কারণে পরিশেষে এ.কে. ফজলুল হক মুসলিম লীগের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেন। দু দফায় ফজলুল

হক ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকে থাকেন। এ সময়ের মধ্যে তিনি নির্বাচনী ইশতেহারের আলােকে অতি দ্রুত কতিপয় আইন প্রণয়ন অথবা বিল উত্থাপন করেন। যেমন—ঋণসালিশি বাের্ড, প্রজাস্বত্ব আইন, মহাজনী

আইন প্রভৃতি কৃষক

————–

১৫১ কামরুদ্দীন আহমদ, পূর্ব বাংলার সমাজ ও রাজনীতি (ঢাকা: ইনসাইড লাইব্রেরী, ১৩৭৬ বঙ্গাব্দ), পৃ. ২৯। ১৫২, ঐ, পৃ. ৩০। ১৫৩ আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর (ঢাকা খােশরােজ

কিতাবিস্তান, ১৯৯৯), পৃ. ৮৬। জিন্নাহ্র চৌদ্দ দফার অনুকরণে ইশতেহারটি প্রজা সমিতির চৌদ্দ দফা’ নামে প্রকাশিত হয়। ১৫৮ মুহম্মদ আব্দুর রহিম ও অন্যান্য, বাংলাদেশের ইতিহাস (ঢাকা : নওরােজ কিতাবিস্ত নি,

দ্বিতীয় সংস্করণ), পৃ. ৫৫৬। Se Enayetur Rahim, op.cit., p. 91.

———–

কল্যাণমূলক বিধি পাস করান। এ ছাড়া কলকাতা মিউনিসিপ্যাল আইন। সংশােধনপূর্বক পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা, প্রাথমিক শিক্ষা আইন অনুসারে স্কুল বাের্ড ও মাধ্যমিক শিক্ষা বাের্ড গঠনের জন্য পরিষদে বিল

উত্থাপন১৫৬, প্রাথমিক শিক্ষকদের ন্যূনতম বেতন নির্ধারণ এবং জেলা স্কুল বাের্ড থেকে প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলােতে সরবরাহের ব্যবস্থাও করেন। ১৫৭রাজবন্দিদের মুক্তিদানের বিষয়টি ছিল

নিঃসন্দেহে ফজলুল হক মন্ত্রিসভার আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশ।১৫৮” শ্রমিক১৫৯  ও দোকান কর্মচারিদের কল্যাণে পৃথক পৃথক আইন প্রণয়ন করেন। স্বল্প সময়ের মধ্যে ফজলুল হক মন্ত্রিসভার নেতৃত্বে যেন একটা বিপ্লব

সংঘটিত হয়। এতে তাদের আস্থা ও কর্মদক্ষতা বেড়ে যায়। ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভা যে সব যুগান্তকারী আইন প্রণয়ন বা বিল আনয়ন করে তার সবগুলােই ছিল গ্রাম বাংলার অবহেলিত ঋণগ্রস্ত ও শােষিত

মানুষের অনেকখানি স্বার্থের অনুকূলে । এই মন্ত্রিসভা আইন প্রণয়ন করে মানুষের যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত বঞ্চনার তাৎক্ষণিক প্রতিকার হয়তাে করতে পারেনি, কিন্তু এগুলাের মাধ্যমে কৃষিভিত্তিক বাংলার অর্থনৈতিক ও

সামাজিক সমস্যাগুলােকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়। এরই ফলে বাংলায় সাধারণ মানুষের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে অনুভূত হয়। কাজেই বলা যেতে পারে সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনৈতিক

চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রে এই আলােড়ন বাংলার ইতিহাসে একটি ‘নীরব বিপ্লব’ কিংবা অভিঘাতবিশেষ।১৬২

পরবর্তীকালে পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলায় স্বায়ত্তশাসনের জন্য যে সকল আন্দোলন গড়ে ওঠে সেগুলাের প্রণােদনার মূলে কাজ করে ফজলুল হক মন্ত্রিসভার আমলে গৃহীত এসব কর্মসূচি। অবশ্য এ কথা পূর্বেই

উল্লিখিত হয়েছে। যে, এ ধরনের পরিবর্তন প্রয়াসের গুরুত্ব পূর্ব বাংলার মুসলমানরা অনুধাবনে ব্যর্থ। হয় এবং মুসলিম লীগের কৃত্রিম জাতীয়তাবাদ দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে পাকিস্তান। আন্দোলনে সমর্থন দান করে।

————–

১৫৬. মুহম্মদ আবদুর রহিম ও অন্যান্য, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৬২ । ১৫৭ কামরুদ্দীন আহমদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪১। ***. Enayetur Rahim, op.cit., pp. 129-130. ১৫৯ কামরুদ্দীন আহমদ, প্রাগুক্ত,

পৃ. ৪১। ১৬০ মুহম্মদ আবদুর রহিম ও অন্যান্য, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৫৯। ১৬১. কামরুদ্দীন আহমদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৮। ১৬. মুহম্মদ আবদুর রহিম ও অন্যান্য, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৫৯-৫৬০।

——

গণ আজাদী লীগ (১৯৪৭) ও তাজউদ্দীন আহমদ

পূর্ববর্তী অধ্যায়ে উল্লিখিত হয়েছে যে কামরুদ্দীন আহমদ (১৯১২-১৯৮২), তাজউদ্দীন আহমদ (১৯২৫-১৯৭৫), মােহাম্মদ তােয়াহা (১৯২২-১৯৮৭), অলি আহাদ, মােহাম্মদ শওকত ও অন্যান্য ঢাকাকেন্দ্রিক

উদারপন্থী নেতা-কর্মীরা পাকিস্তান কাঠামােতে পূর্ব বাংলার শােষিত হওয়ার বিষয়টি পূর্বাহেই অনুধাবন করেন। তারা মুসলিম লীগের ওপর সম্পূর্ণরূপে আস্থা হারিয়ে উদার ও অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ধারা গড়ে তা

েলার প্রচেষ্টা চালান। এ ধরনের একটা প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায় ‘Peoples Freedom League’ নামক একটা অনানুষ্ঠানিক রাজনৈতিক বলয় গঠনের মাধ্যমে । নতুন এই উদ্যোগের উৎপত্তি ও প্রকৃতি

সম্পর্কে তাজউদ্দীন আহমদের সূত্র হতে নিরােক্ত তথ্য জানা যায়: ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসেই কামরুদ্দীন সাহেব, তােহা, অলি আহাদ, আমি এবং আমাদের গ্রুপের অন্যরা ঠিক করেছিলাম যে সাম্প্রদায়িক কোন

রাজনীতি আমরা আর করবাে না এবং সে ধরনের কোন প্রতিষ্ঠানের সাথেও যুক্ত থাকবাে না। কাজেই মুসলিম লীগ রাজনীতি না করাই ছিল সিদ্ধান্ত। জুলাই মাসেই আমরা কামরুদ্দীন। সাহেবের বাসায় “Peoples

Freedom League” নামে একটি গ্রুপ গঠন। করি । এর মধ্যে ছিলাম আমি, অলি আহাদ, তােহা এবং কামরুদ্দীন সাহেব ছিলেন। প্রধান উদ্যোক্তা। এই সময় আমরা গ্রুপ গঠন করার জন্য যে কর্মীদেরকে

জমা করেছিলাম তাদের সাথে সমস্ত দিন ধরে আলােচনা চলেছিল । এই আলােচনাকালে অনেকেই আসা যাওয়া করেছিল। এদের মধ্যে আহমদ বজলুর রহমান, নুরুল ইসলাম চৌধুরী ছিল অন্যতম। এইসব আলা

েচনার মাধ্যমে মােটামুটি কিছু তত্ত্বগত আলােচনা হয়েছিলাে এবং একটা গ্রুপ মােটামুটি দাড়িয়েছিলাে, কিন্তু কোন কমিটি Formed হয়নি। | Peoples Freedom League গঠনের ব্যাপারে

কামরুদ্দীন আহমদের উৎস। হতেও জানা যায় । ১৬৩এতদুদ্দেশ্যে তারা একটা ইশতেহার প্রকৃতির কতিপয় নিয়মনীতি প্রণয়ন করেন । এগুলাের পক্ষে জনমত গড়ে তােলার জন্য বিভিন্ন জেলায় মুসলিম লীগের

স্বপক্ষের কর্মীদের নিকট পাঠিয়ে দেয়া হয়।১৬৪  এর শিরােনাম দেয়া হয় ‘আশুদাবি কর্মসূচ আদর্শ’ । এতে যেসব বিষয় উল্লেখ করা হয়, তা সে সময়ের জন্য অনেকখানি প্রাগ্রসর চিন্তা-চেতনার পরিচায়ক। তারা নতুন

রাষ্ট্রে মানুষের

————–

১৬৩ বদরুদ্দীন উমর, ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ কতিপয় দলিল, দ্বিতীয় খণ্ড (ঢাকা বাংলা একাডেমী, ১৯৯৫), পৃ. ২৯২-২৯৩। ১৬৪ কামরুদ্দীন আহমদ, বাংলার মধ্যবিত্তের বিকাশ, দ্বিতীয় খণ্ড (ঢাকা ইনসাইড লাইবেরী,

১৩৮২ বঙ্গাব্দ), পৃ. ৯৭।

অর্থনৈতিক মুক্তি, ন্যায্য ভূমি সংস্কার, নাগরিক অধিকার, মাতৃভাষার মাধ্যমে মানুষকে শিক্ষিত করে তােলার মতাে মৌলিক বিষয়গুলােকে এতে অন্তর্ভুক্ত করেন। এ ছাড়াও আশুদাবি কর্মসূচি আদর্শতে’

সমসাময়িক রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রসঙ্গ, তেভাগা বিল ইত্যাদির মতাে বিষয় অন্তর্ভূক্ত করা হয় । তাজউদ্দীন আহমদ ও তার সহকর্মীরা এই কর্মসূচি এমনভাবে প্রণয়ন করেন যা দেখে ধারণা জন্মে তারা | যেন গঠিতব্য পূর্ব

বাংলার রাষ্ট্রীয় মুলনীতির রূপরেখা প্রণয়নে আত্মনিয়ােগ করেন।১৬৫

অর্থাৎ পূর্ব বাংলা যেন একটি সম্পূর্ণ আলাদা রাষ্ট্রীয় একক- এটাই তাদের ধারণা। এর একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হতে পারে, তখন পর্যন্ত উদার ঐ রাজনৈতিক গােষ্ঠীটি পূর্ব বাংলার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সুনিশ্চিত হতে পারেনি।

হয়তাে তাদের ধারণা জন্মে যে, | পাকিস্তানের দুই অংশে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে, যার ফলে পূর্ব বাংলাকে একটি রাষ্ট্রীয় একক হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। |১৬৬ এ ক্ষেত্রে তাজউদ্দীন

আহমদের একটা কেন্দ্রীয় ভূমিকা লক্ষ্য করা যায় । রাজনৈতিক জীবনের সূচনালগ্ন হতেই পত্রিকা সম্পাদনা, বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার বিষয়ে স্মারকলিপি, লিফলেট ও নােট লিখন, পরিকল্পনা প্রণয়ন প্রভৃতি বিষয়ে তিনি

গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন যা পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে। এছাড়াও অত্যন্ত বস্তুনিষ্ঠভাবে৬৮ সমকালীন ঘটনাবলির চিত্র তার ডায়েরিতে লিখে রেখে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। এ সম্পর্কে বাংলাদেশের বিশিষ্ট

ইতিহাসবেত্তা মুনতাসীর মামুন যথার্থই লিখেছেন: ১৬৯ উল্লিখিত প্যাটার্নে একটা অনড় শৃঙ্খলাবােধ দেখার মতাে। এ থেকে ঐ যুবকের দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। যিনি সাধারণ গ্রামের সাধারণ কৃষক পরিবারের

সন্তান বটে। ঢাকা শহরও বড়সড় বর্ধিষ্ণু গ্রামের মতাে কিন্তু তিনি গ্রাম্যতামুক্ত। তার চিন্তায় জীবনযাপনে উঠতি নাগরিক বুর্জোয়ার চরিত্রগত মিল আছে। সারাটা দিন যার কর্মবহুল এবং নির্দিষ্ট সময়ে যে নির্দিষ্ট কাজটি

করে । এই প্যাটার্ন যিনি মানেন তিনি কর্মজীবী ও পরিশ্রমী হয়ে ওঠেন। পরবর্তীকালে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করতে পারতেন তার একটা কারণ যৌবনের সেই

কর্মপদ্ধতি।

——————-

১৬৫ বদরুদ্দীন উমর, পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, প্রথম খণ্ড (ঢাকা: জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ১৯৯৫), পৃ. ১৮।

১৬৭ ওয়াহিদুজ্জামানের সাক্ষাৎকার, ৩ এপ্রিল, ১৯৯১। ১৬৮ মুনতাসীর মামুন, তাজউদ্দিন আহমদের ডায়েরী, এক তরুণের রাজনীতিবিদ হয়ে। ওঠা, জনকণ্ঠ, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০০০। ১৬৯ ঐ, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০০০।

——-

তার ডায়েরি থেকে এবং কামরুদ্দীন আহমদসহ অপরাপর রাজনৈতিক ব্যক্তি কর্তৃক লিখিত সূত্র হতে পূর্ব বাংলার এ সময়ের রাজনৈতিক বিকাশ সম্পর্কে একটা ধারণা লাভ করা যায় । এ থেকে গণআজাদী লীগের

‘আশুদাবি কর্মসূচি আদর্শ’, ভূমি সংস্কার এবং রাজনৈতিক দল গঠনে তাজউদ্দীন আহমদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তি সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক জন্মের মাত্র ৭ দিন

পূর্বে ঢাকাস্থ মুসলিম লীগের উদারপন্থী তরুণ কর্মীদের সম্মেলন আহ্বানের মাধ্যমে দল গঠনের একটা উদ্যোগ গৃহীত হয়। তাজউদ্দীন আহমদ গঠিতব্য দলের নামকরণ প্রস্তাব করেন, ইস্ট পাকিস্তান। ইকোনােমিক

ফ্রিডম লীগ।১৭০ বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, যখন বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে রাজনীতি চর্চা তেমন একটা প্রসার লাভ করেনি এমন। পরিস্থিতিতে তাজউদ্দীন আহমদের মতাে একজন তরুণ সংগঠক অর্থনীতির সাথে

সম্পর্ক রেখে দলের নামকরণ প্রস্তাব দেন। এছাড়াও সামষ্টিক উন্নয়নের জন্য ভূমির রাষ্ট্রীয়করণের মতাে একটি জটিল বিষয়ও তার চেতনায় স্থান লাভ করে । প্রেক্ষিত বিচারে এটা কেবল প্রাগ্রসরই নয়, বরং আজকের

বিশ্ব রাজনীতিতেও অতি আধুনিক। বস্তুত অল্প বয়সেই তাজউদ্দীন আহমদের রাজনৈতিক পরিপক্বতা আসে। তিনি অনুধাবন করেন যে, অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া রাজনৈতিক স্বাধীনতার কোনাে অর্থ থাকে না।

পরবর্তীকালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার মানুষকে যে আন্দোলন করতে হয় তার মূল বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই । বস্তুত তাজউদ্দীন আহমদের মধ্যে যে রাজনৈতিক দর্শনের উৎপত্তি ঘটে।

তা সার্বজনীন কল্যাণের নিমিত্তে বিপ্লবী চেতনাপ্রসূত। প্রাথমিক রাজনৈতিক জীবনের একটা স্তর পর্যন্ত তিনি এমনসব ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন যারা পরবর্তীকালে পূর্ব বাংলায় সমাজতান্ত্রিক

আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরিতে তাদের নাম ঘুরে-ফিরে এসেছে এবং তাতে প্রয়াশই সমাজতন্ত্রের বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। তবে তিনি। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন এমন কোন

প্রমাণ পাওয়া যায় না। যাহােক গণআজাদী লীগ গঠনের কাজ সহজ ছিল না। কেননা সরকার এ সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য নানা ধরনের চেষ্টা চালায়। তাছাড়াও সমকালীন সমাজ বাস্তবতা এই ধরনের আমূল

পরিবর্তনকারী আন্দোলন গড়ে

————-

ডায়েরী, ৭ আগস্ট, ১৯৪৭ এবং ড. মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস (ঢাকা: ষ্টুডেন্ট ওয়েজ, ১৯৯২), পৃ. ৪৩। ১ তাজউদ্দীন আহমদের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা জীবনের সহপাঠী বাহাউদ্দিন চৌধুরী

বলেন: “বামপন্থীদের দিকে তাজউদ্দীন সাহেবের সবসময়ই একটা সহানুভূতি ছিল। কিন্তু তিনি কখনই কমিউনিস্ট পার্টিতে যােগ দেন নি।” সাক্ষাৎকার ২৬ অক্টোবর, ১৯৯০।

—-

তােলার জন্য উপযুক্ত ছিল না। অন্ততপক্ষে তরুণ তাজউদ্দীন আহমদের পর্যবেক্ষণে সেটাই ধরা পড়ে। তার মতে বাংলায় গণআন্দোলনের বড় বাধা হচ্ছে। মানুষের ভূমিকেন্দ্রিক মানসিকতা এবং ধর্মভিত্তিক

সমাজব্যবস্থা।১৭২ পাকিস্তানের জন্মের তিন বছরের মধ্যেই তার মাথায় এই ধারণা অনেকটা তত্ত্বের ন্যায় স্থান করে নেয় ।১৭৩ যেভাবে পাকিস্তান কাঠামােতে পূর্ব বাংলাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় সেটা তাজউদ্দীন আহমদ ও

তার রাজনৈতিক সহকর্মীরা মেনে নিতে পারেননি। সম্ভবত সে কারণে ১৪ আগস্টে পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক জন্মের একদিন পর তাজউদ্দীন আহমদের লিখিত ডায়েরিতে পাকিস্তান, জিন্নাহ এ ধরনের কোনাে শব্দের

ব্যবহার দেখা যায় না। শুধু তাই নয় প্রকাশিত ডায়েরিগুলাের কোথাও পশ্চিম পাকিস্তানের। ব্যাপারে কোনাে শব্দ বা প্রসঙ্গ তিনি উল্লেখ করেন নি। বরং ১৪ আগস্টের একজন নিস্পৃহ পর্যবেক্ষক হিসেবে আয়ােজিত

অনুষ্ঠানমালা ও পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে ডায়েরিতে তিনি যা লিখেন প্রচ্ছন্নভাবে তাতে অনেকটা পাকিস্তানবিরােধী মনােভাব ফুটে ওঠে।১৭৪ বস্তুত পাকিস্তানের জন্মকাল হতেই রাষ্ট্রের বিভিন্ন নীতির। প্রশ্নে পূর্ব

বাংলার রাজনীতি সচেতন উদার অংশটি বিরােধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় । বিভিন্নভাবে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনে সরকার রীতিমতাে বেসামাল হয়ে পড়ে। এই প্রেক্ষাপটে মােহাম্মদ আলী

জিন্নাহ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রথম ঢাকা সফরে এলে উপস্থিত জনতার মধ্যে কেবল উচ্ছ্বাসের অভাবই পরিলক্ষিত হয় না, উপরন্তু তার ছবি ছিড়ে ফেলা, বিরােধী স্লোগান দেয়া এবং বােমা বিস্ফোরণের মতাে

ঘটনাও ঘটে।১৭৫ এই সময় তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যদের উদ্যোগে নতুন সংগঠন Peoples Freedom League গড়ে তােলার মধ্য দিয়েও তাদের পাকিস্তান কাঠামাের বিরােধিতার বিষয়ে ইঙ্গিত

পাওয়া যায় । এই সংগঠনটি গড়ে তােলার ক্ষেত্রে তাজউদ্দীন আহমদ মুখ্য ভূমিকা পালন করেন বলে তার এবং কামরুদ্দীন আহমদের সূত্র হতে জানা যায় । আশুদাবি

————

১৭২, ডায়েরী, ৪ আগস্ট, ১৯৪৭।

বিচ্ছিন্নভাবে কোন আন্দোলন সম্ভব নয়। এতে ঘটনার পর ঘটনা জড়িয়ে আন্দোলন নিস্তে জ হয়ে যায় । সমাজের কাঠামাে এবং ব্যবস্থার যে কোন নির্দিষ্ট অংশ থেকে অন্যায় নির্মূল করার। চেষ্টা সমস্যাটিকে আরাে

জটিলতার দিকে নিয়ে যায়। এতে সংস্কারকরা কয়েকজনের দ্বারা পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের শিকারে পরিণত হন। তাই একই সাথে জোরালাে আঘাত এবং আমূল পরিবর্তন এই অবস্থার সমাধান বলে মনে হয়।”ঐ, ২৫ মে,

১৯৫০।

“পরিবেশ খুবই পীড়াদায়ক। ব্যবস্থাপনা বাজে। লােকজন না বসে শুধু ছােটাছুটি করছে।” ডায়েরী, ১৫ আগস্ট, ১৯৪৭। ১৭ই মুনতাসীর মামুন, ইয়াহিয়া খান ও মুক্তিযুদ্ধ (ঢাকা: সময় প্রকাশন, ২০০১), পৃ. ১৩১।

কর্মসূচি আদর্শ’ জুলাই মাসে ইংরেজিতে এবং আগস্ট মাসে বাংলায় প্রকাশ করা হয় । এটির সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন তাজউদ্দীন আহমদ। কিভাবে। তাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়ন করবেন সেসব বিষয়ে

তারা একাদিক্রমে। আলােচনা চালিয়ে যান। তিনি ডায়েরিতে এ বিষয়ে মাঝেমধ্যেই লিখে রেখেছেন।

যেমন:১৭৭

বেলা আড়াইটায় বৃষ্টি একটু থামলে কামরুদ্দীন সাহেবের কাছে গেলাম। সেখানে আমাদের দলের ব্যাপারে আলাপ হলাে । দুভাবে আমাদের কর্মসূচি পালন করা যায়: জনমত সৃষ্টি করে সরকারকে বাধ্য করা এবং

আমাদের জন্য ক্ষমতা দখল করা । এটা প্রায় আমাদের সকলের কাছে পরিষ্কার হওয়া উচিত কোন হঠকারী কাজ করা। যাবে না।

১৯৪৭ সালের ২৬ নভেম্বর নাগাদ তারা এই নতুন দলের জন্য একটা কার্যালয় খােলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং দায়িত্ব বণ্টন করেন । তাজউদ্দীন আহমদ প্রচারের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন।১৭৮ নিয়মিত রাজনৈতিক আলােচনা ও

পাঠাভ্যাসের জন্য একটি পাঠচক্র খােলারও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। দল গঠনের এই পর্যায়ে পাঠচক্রের মাধ্যমে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে মৌলিক আলােচনার প্রতি তাজউদ্দীন আহমদ বেশ গুরুত্ব প্রদান করেন।

কিন্তু তাদের দল গঠনের কার্যক্রম নানা কারণে ব্যাহত হতে থাকে । কেননা *Peoples Freedom League-কে সমকালীন আর একটি সংগঠন Antifascist Peoples Freedom

League-এর সঙ্গে অভিন্ন মনে করে সরকার একদিকে ক্রমাগত তাদের বিরুদ্ধে গােয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করে, অন্যদিকে মুসলিম লীগের গুণ্ডাদের এর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। এমতাবস্থায় তারা দলের ইংরেজি

নামের পরিবর্তে বাংলা নাম- গণআজাদী লীগ ব্যবহার করতে শুরু

করেন।

বিশৃঙ্খল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তাজউদ্দীন আহমদ ও তার সহকর্মীরা একটি বিকল্প রাজনৈতিক পথ অনুসন্ধানের প্রায় সব চেষ্টাই করেন। এমতাবস্থায়

———

১৭৬, ডায়েরী, ১৪ আগস্ট, ১৯৪৭। ১৭৭, ঐ, ৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭। ১৭৮ ঐ, ২৬ নভেম্বর, ১৯৪৭।

|44n | পাঠচক্রটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা মাঝে মাঝে অর্থনীতিবিদ ও মৌলিকত্বসম্পন্ন রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অধ্যাপকদের নিয়ে ক্লাস করবাে, বিশেষ করে সমাজতান্ত্রিক ও ভারতীয় অর্থনীতি বিষয়ে।” ঐ। ১৮

বদরুদ্দীন উমর, ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ: কতিপয় দলিল, প্রথম খণ্ড, পৃ. ২৯৩।

১৯৪৮ সালে মার্চের ৩ তারিখে নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়াতে গণআজাদী লীগের একটি গুরুত্বপূর্ণ সমাবেশ হয়। তাজউদ্দিন আহমদ, কামরুদ্দীন আহমদ, আলমাস, আওয়াল, শামসুজ্জোহা, শামসুল হক, আজিজ আহমদ,

আলম, হযরত আলী, মহিউদ্দিন, শওকত ও অন্যদের উপস্থিতিতে বিদ্যমান সার্বিক পরিস্থিতির ওপর আলােকপাত করা হয়। এরপর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, চলতি নানা অব্যবস্থাপনা ও সংকট নিরসনে সরকার ব্যর্থ

হলে তাদের বিকল্প কর্মসূচির আলােকে মন্ত্রিসভার পতন ঘটানাের চেষ্টা করা হবে। স্বতন্ত্র দল গঠনের কাজ এগিয়ে নেয়ার জন্য তারা কিছু কিছু নীতিগত সিদ্ধান্তে উপনীত হন। এগুলাের মধ্যে অন্যতম ছিল সদ্য গঠিত

পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখা, টাঙ্গাইল সম্মেলনে যােগদান না করা, ঢাকাস্থ কেন্দ্রীয় সরকারের নিম্নতর গ্রেডের কর্মচারীদের দাবির প্রতি সমর্থন দান, আয়করবিরােধী প্রচারণায় যােগদান না

করা, দোকানদারদের বিক্রয়করবিরােধী আন্দোলনকে সমর্থন দান প্রভৃতি। কিন্তু তাদের এই প্রচেষ্টা সফল হয়নি মূলত তাদের চেয়েও বৃহত্তর আঙ্গীকে পর্যায়ক্রমে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এবং পূর্ব পাকিস্তান

আওয়ামী মুসলিম লীগের ন্যায় রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে ওঠার কারণে। এছাড়াও সরকারের বিভিন্ন নীতি ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে ঢাকাকেন্দ্রিক যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তাতে তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যরা গুরুত্বপূর্ণ

ভূমিকা পালন করার কারণেও স্বতন্ত্রভাবে সংগঠিত হওয়ার কাজটি বাধাগ্রস্ত হয়।

ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের অত্যল্পকালের মধ্যে উদার গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী ভাবধারায় একটি রাজনৈতিক দল গঠন করা নিঃসন্দেহে দুরূহ কাজ ছিল। তাদের নতুন দল গঠনের ব্যাপারটি কতদূর

এগিয়েছিল শেষ পর্যন্ত জানা যায় না । তাজউদ্দীন আহমদের ১৮ এপ্রিল ১৯৪৮ থেকে ৯ অক্টোবর ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত সময়কালের ডায়েরিটি পাওয়া যায় না, বিধায় এ সম্পর্কে জানার কোনাে উপায় নেই। অন্যদিকে

গণআজাদী লীগ গঠনের প্রধান উদ্যোক্তা কামরুদ্দীন আহমদ এ সময়কার রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের ওপর যে গ্রন্থ লিখেছেন তাতে তাদের এই উদ্যোগের পরিণতি সম্পর্কে পরিষ্কার তেমন উল্লেখ নেই। তবে এক স্থানে

তিনি লিখেছেন যে, ১৯৫০ সাল নাগাদ গণআজাদী লীগকে ‘সিভিল লিবারটিজ লীগে’ পরিণত করা হয়, যা মূলত অভিযুক্ত রাজনৈতিক নেতা কর্মীদেরকে আদালতে আইনী সহযােগিতা প্রদান করতাে। তাজউদ্দীন

আহমদ এক সময়ে নিজ এলাকায় বন বিভাগের দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে

——–

১৮২, ডায়েরী, ৩ মার্চ, ১৯৪৮। ১৮৩ ঐ, ১৫ এপ্রিল, ১৯৪৮।

৬০

বন কর্তৃপক্ষের রােষানলে পড়েন। কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করলে সিভিল লিবারটিজ লীগ তাকে আইনি সহযােগিতা প্রদান করে।১৮৪ গণআজাদী লীগের পরিণতি সম্পর্কে মুল্যায়ন করতে গিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ একটি সাক্ষাৎকারে বলেন সংগঠনটির কাজকর্ম তেমন কিছু হয়নি। তবে এই সংগঠনের আওতায় তারা পূর্ব বাংলার আর্থিক জীবন সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিতে কিছু চিন্তা-ভাবনা করেছিলেন।১৮৫ গণআজাদী লীগ ক্ষুদ্রায়তনের একটি ক্ষীণায়ু সংগঠন হলেও কেন্দ্রশাসিত পাকিস্তান রাজনীতির বিরুদ্ধে এটা ছিল সীমিত গণ্ডির মধ্যে প্রথম রাজনৈতিক প্রচেষ্টা। সেদিক থেকে এর ঐতিহাসিক তাৎপর্য অস্বীকার করা যায় না। তাছাড়া সংগঠনটি যে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আত্মবিকাশের চেষ্টা করে তা নিঃসন্দেহে পূর্ব বাংলার মানুষের আর্থ-সামাজিক মুক্তির দিক নির্দেশনা বিশেষ । যেমন ‘আশুদাবি কর্মসূচি’র ভূমিকাতে বলা হয়:১৬

দেশের স্বাধীনতা ও জনগণের স্বাধীনতা দুইটি পৃথক জিনিস। বিদেশি শাসন হইতে একটি দেশ স্বাধীনতা অর্জন করিতে পারে; কিন্তু তাহার অর্থ এই নয় যে, সেই দেশবাসীরা স্বাধীনতা পাইল। রাজনৈতিক স্বাধীনতার কোন মূল্যই নাই, যদি স্বাধীনতা জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি আনয়ন না করে? কারণ অর্থনেতিক মুক্তি ব্যতীত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতি সম্ভব নয়। সুতরাং আমরা স্থির করিয়াছি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য আমরা সংগ্রাম চালাইয়া যাইতে

থাকিব। সুতরাং পূর্ব বাংলার স্বার্থের প্রশ্নে গণ আজাদী লীগ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে যে দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করে তা নিঃসন্দেহে এতদঞ্চলের মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দিক নির্দেশনাবিশেষ। | অন্যদিকে এ সময় বিভিন্ন অব্যবস্থাপনা ও ভ্রান্তনীতির কারণে মুসলিম লীগ। সরকারের বিরুদ্ধে প্রথমে ঢাকাকেন্দ্রিক যে গণআন্দোলন গড়ে ওঠে তাতে তাজউদ্দীন আহমদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ সম্পর্কে তার ডায়েরি থেকে জানা যায়:১৮৭

দুপুর সাড়ে ১২টায় কামরুদ্দীন সাহেবের বাসায় গেলাম। মুজিব, শওকত, শামসুজ্জোহা ও অন্য ২ জন সেখানে ছিল। তারা চলে গেলে আমরা আমাদের

—————-

১৮৪ কামরুদ্দীন আহমদ, বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ১৪৯। ১৮৫ বদরুদ্দীন উমর, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৯৩। ১৮৬ উদ্ধৃত: বদরুদ্দীন উমর, পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, প্রথম খণ্ড, পৃ. ১৭। ১৮ণ ডায়েরী, ২০ ডিসেম্বর, ১৯৪৭।

———–

ব্যাপারে কথা বললাম। খাদ্য সমস্যার ব্যাপারে আমার অভিমত হচ্ছে নিয়ন্ত্রণ এবং জেলাসমূহে কর্ডন ১৮৮ প্রিহরা) প্রত্যাহার করে সীমান্তে প্রহরা জোরদার করা, প্রচারণার মাধ্যমে সরকারের প্রচার বিভাগ কর্তৃক জনগণকে মজুতদারিতে অনুৎসাহিত করা, খাদ্য সংকটের মিথ্যা ভীতি দূর করা এবং বেপরােয়াভাবে ধান বিক্রি না করতে জনগণকে বােঝানাে । বিকেল সাড়ে ৩ টায় বলিয়াদি ভবনে বিরােধী। এম,এল,এ-দের সভায় যােগদান করলাম। মােহাম্মদ আলী, ডাঃ মালেক ও অন্যান্য প্রায় ১৬ জন এম,এল, এ. উপস্থিত। আমাদের পক্ষে কামরুদ্দীন সাহেব, মুজিব, শওকত, শামসুজ্জোহা, আলমাস, আউয়াল, আজিজ আহমদ, মহিউদ্দিন, আতাউর রহমান, কফিল উদ্দিন চৌধুরী, কাদের সরদার, মতি সরদার উপস্থিত। [এরা এম.এল.এ. না হওয়া সত্ত্বেও পরিস্থিতির চাহিদায় বিরােধিদলীয় এম.এল, এদের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। সভা রাত ৮ টা পর্যন্ত চলল। আগামী কালকের সভায় খাদ্য সমস্যা, পাট সমস্যা, ইত্তেহাদ সমস্যা, সংসদ সচিব, মন্ত্রীদের বেতন ইত্যাদি প্রসঙ্গে আলােচনা হবে। আমরা তাদের নিকট জানতে চেয়েছিলাম ভবিষ্যৎ নেতা কে হবেন? তারা সােমবার সন্ধ্যায় তা জানাবার প্রতিশ্রুতি দিলেন।… রাত সাড়ে ৮ টায়। শওকত, মহিউদ্দিন, মুজিব, আমি একটি গাড়ি নিয়ে পলাশী ব্যারাক, এস,এম, হল নীলক্ষেত ব্যারাক, এফ.এইচ.এম, হল ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল হােষ্টেল, নিমতলি মেস প্রভৃতি স্থানে ইত্তেহাদ বিলি করলাম । পরদিন বর্ধমান ভবনে গত দিনের স্থগিত সভার বিভিন্ন বিষয়ে আলােচনা শুরু হয়। সেখানে তাজউদ্দীন আহমদ চলতি নানা সংকটের ওপর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বক্তব্য রাখেন, যা উপস্থিত সকলের মনােযােগ আকর্ষণ করে।** সংসদ সদস্য না হয়েও তাজউদ্দীন আহমদ সেদিন যে যুক্তি ও বৈঠকী বাল্পটুতার পরিচয় দেন এবং সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, তা বস্তুত ভবিষ্যতে তার একজন সুদক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান হওয়ার ইঙ্গিত বহন করে । তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি ও সমসাময়িক রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সূত্র হতে জানা যায় নিজে ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও ছাত্র রাজনীতির চেয়ে তিনি জাতীয় এবং পেশাজীবী সংগঠনের প্রতি বেশি আগ্রহী ছিলেন। অন্যদিকে তাজউদ্দীন আহমদের

—————

১৮৮ খাদ্যশস্যের সংকট দেখা দিলে ব্রিটিশ আমলে এ ব্যবস্থায় এক জেলা হতে অন্য জেলায় খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হতাে। তাজউদ্দীন আহমদ চলতি খাদ্য সংকটের সমাধানের জন্য এই প্রথার বিরােধিতা করে বক্তব্য রাখেন। ১৮. “সভায় খাদ্য নীতি সম্পর্কে আমি আমার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করলাম। এসময় অলি আহাদ অনাবশ্যক এবং উদ্ধতভাবে কথার মাঝখানে বাধা দিলে উপস্থিত সবাই বিরক্ত হলেন। এরপর আমি সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত একা ওয়েটিং রুমে বসে থেকে মন্ত্রিপরিষদের বিরুদ্ধে অভিযােগ করলাম। সবাই আমার অভিযােগের বৈধতার প্রশংসা করলেন এবং সকল বক্তব্য মনােযােগ দিয়ে শুনলেন ।” ডায়েরী, ২১ ডিসেম্বর, ১৯৪৭।

ছাত্র রাজনীতি সম্পর্কে উপলব্ধি ছিল অত্যন্ত মৌলিক । কোনাে দলের বা নেতার পকেট-শক্তি হওয়া থেকে ছাত্র রাজনীতিকে মুক্ত করার প্রতি তিনি গুরুত্বারােপ করেন। ছাত্রাবস্থায়ই তিনি নিজ গ্রাম এলাকায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। সুযােগ পেলেই সাধারণ মানুষকে তিনি রাজনীতির বিষয়ে সচেতন করে তােলার জন্য চেষ্টা করতেন। পাকিস্তানের জন্মের অল্প পরে নিজ এলাকার গােসিঙ্গা হাইস্কুল মাঠে শ্রোতাদের অনুরােধে একই জনসভায় দুবার বক্তৃতা করেন। এই বক্তৃতায় তার রাষ্ট্রচিন্তার প্রতিফলন স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। তিনি বলেন:১৯১

আমি পর্যায়ক্রমে ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে কথা বললাম। আমাদের একটা জনগণের রাষ্ট্র গঠন করা উচিত । দুর্নীতি ও ঘুষ শক্ত হাতে বন্ধ করতে হবে। মানুষ খােলা মনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সব কিছু দেখতে এবং বুঝতে শিখুক। একটা সুখী রাষ্ট্র গঠনে সহযােগিতা করার জন্য সকলকে আবেদন জানালাম। দেশের কাজে হিন্দুদেরও এগিয়ে আসা উচিত যে, পাকিস্তান তাদের নিজেদেরই দেশ। অফিসার, মাধ্যমিক শিক্ষক, প্রাথমিক শিক্ষকদের ন্যূনতম বেতন ৫০ টাকা ও পাট শ্রমিকদের

বেতন ৪০ টাকা হওয়া উচিত। তার এই ধরনের রাষ্ট্রচিন্তার ওপর আলােকপাত করতে গিয়ে মুনতাসীর মামুন। যথার্থই বলেছেন যে, “জনগণের রাষ্ট্র’ শব্দ দুটো বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। সে কারণেই সম্ভবত ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রের নামকরণ করেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। এছাড়াও শিক্ষক ও পেশাজীবীদের মজুরির ব্যাপারে যে বক্তব্য রাখেন তা বাস্তবায়নের একটা সুযােগ আসে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর। সে জন্যই তিনি বারবার সুষম বণ্টনের কথা উচ্চারণ করেন এবং দেশকে পরিকল্পিত অর্থনীতির দিকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন।১৯২ যাহােক, অল্প সময়ের মধ্যেই তাজউদ্দীন আহমদ উপলব্ধি করেন যে, পাকিস্ত নি অর্জনে পূর্ব বাংলার মানুষের স্বাধীনতা আসেনি এবং পাকিস্তান কাঠামােতে। এখানকার মানুষের আর্থিক মুক্তিলাভ কোনভাবেই সম্ভব নয়। পরবর্তীকালে বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রামে যেসব নেতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাদের অনেকের চেয়ে তিনি বহু পূর্বেই এই উপলব্ধিতে উপনীত হন।

——————-

ঐ, ৪ আগস্ট, ১৯৪৭। ঐ, ৩ নভেম্বর, ১৯৪৭। মুনতাসীর মামুন, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২৬। ডায়েরী, ২৯ মার্চ, ১৯৪৮।

১৯৩

ছাত্রলীগ গঠনে তাজউদ্দীন আহমদের ভূমিকা

বিভাগােত্তর পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারের আদর্শ ও নীতির বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হওয়ার লক্ষ্যে সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের বাইরে একটি অপেক্ষাকৃত উদার ছাত্র সংগঠন গড়ে তােলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। উদ্যোক্তাদের মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন অন্যতম। এ বিষয়ে প্রথম প্রচেষ্টার সূত্রপাত হয় ১৯৪৭ সালের ৬ আগস্ট নাজির লাইব্রেরিতে এক আলােচনা সভায় । তাজউদ্দীনের ভাষ্য অনুযায়ী অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন হাবিবুর রহমান, তাসাদ্দক, আজিজ আহমদ, মহিউদ্দিন, ওয়াদুদ পাটোয়ারী, শামসুদ্দিন, আওয়াল প্রমুখ । ছাত্রদের ঢাকা নগর কমিটি গঠনের উদ্দেশ্যে ১৯৪৭ সালের ৮ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ.এইচ.এম. হলের সম্মেলন কক্ষে একটি সভা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রস্তাবিত সভায় অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধকরণের প্রতি গুরুত্বারােপ করা হয়। তাজউদ্দীন আহমদ ঐ দিনই ছাত্রদের সংগঠিত করার কাজে নেমে পড়েন। এ সম্পর্কে তার ডায়েরির অংশবিশেষ উল্লেখ করা যেতে পারে:১৯৪

হাফিজল্লাহ কটেজে ইসমাইলের সঙ্গে দেখা হলাে। তাকে ৮ আগস্ট বিকেল ৪টায় এফএইচ, এম, হলের সভায় তার স্কুলের ছাত্রদের নিয়ে আসতে বললাম। তার কাছে নগর ছাত্রলীগ গঠনের প্রয়ােজনীয়তা ব্যাখ্যা করলাম। সে আমাকে কথা দিল অন্যান্য স্কুল যেমন কলেজিয়েট, সেন্ট গ্রেগরিস, ইসলামিয়া, হামিদিয়া ও নবকুমার

ইনস্টিটিউশনের ছাত্রদেরও সংগঠিত করবে। নতুন এই উদ্যোগের প্রতি দ্রুত ভাল সমর্থন পাওয়া যায় । ১৯৪৭ সালের ৮ আগস্ট বিকেল ৪টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে ছাত্রলীগ গঠনের উদ্দেশ্যে যথারীতি নির্ধারিত ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। বক্তারা নতুনভাবে ছাত্রদের সংগঠিত হওয়ার প্রয়ােজনীয়তা ও গুরুত্বের বিষয়ে আলােকপাত করেন।১৯৫

৩০ আগস্ট নাজির লাইব্রেরিতে গঠিতব্য ছাত্র সংগঠনের আনুষঙ্গিক বিষয়ে আলােচনার জন্য এক ঘরােয়া সভা হয়। কয়েকজন প্রধান ছাত্রনেতার উপস্থিতিতে তাজউদ্দীন আহমদ গঠিতব্য দলের নামের সঙ্গে ‘মুসলিম’ শব্দটি না রাখার পক্ষে জোরালাে যুক্তি উপস্থাপন করেন।১৯৬ এ বিষয়ে কোনাে কোনাে ছাত্রনেতার আপত্তির কারণে কোনাে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয় নি।

————-

১৯৪ ঐ, ৬ আগস্ট, ১৯৪৭। ১৯৫ ঐ, ৮ আগস্ট, ১৯৪৭। ১৯৬ ঐ, ৩০ আগস্ট, ১৯৪৭।

ধর্মের ভিত্তিতে যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের উৎপত্তি, তার আনুষ্ঠানিক জন্মলাভের মাত্র ১৫ দিনের মাথায় মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে একটি অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন গড়ে তােলার প্রচেষ্টা পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে তার সাহসিকতা এবং উদার অসাম্প্রদায়িকতার আর একটি অতি তাৎপর্যপূর্ণ উদাহরণ। এর মাধ্যমে বস্তুত পাকিস্তান সৃষ্টির আদর্শকেই অনেকটা অস্বীকার করা হয়। | ৩১ আগস্ট ফজলুল হক হলে ছাত্রলীগের নগর কমিটি গঠনের উদ্দেশ্যে সমাবেশেও প্রচুর ছাত্র সমাগম হয়। কিন্তু সরকার সমর্থক ছাত্র ও গুণ্ডারা গােলযােগ বাধিয়ে সভা পণ্ড করে দেয়। অবশ্য এক পর্যায়ে হামলাকারীরা প্রচণ্ড মার খায় । তাজউদ্দীন আহমদ ঐ দিনের ডায়েরিতে এই বিষয়ে একটু বিস্তারিত লিখে রাখেন।১৯৭

তাজউদ্দিন আহমদ, মােয়াজ্জেম, শামসুদ্দিন ও আরাে কয়েকজন ছাত্রনেতা ছাত্রসভায় উক্ত হামলার প্রতিবাদ জানাবার জন্য মন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী (১৯০১-১৯৯২) এবং নুরুল আমীনের (১৮৯৩-১৯৭৪) সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। যে ট্রাকে করে গুণ্ডারা ছাত্র সভায় আক্রমণ করেছিল তার নং (B.G.D-629) তাজউদ্দীন আহমদ লিখে রেখেছিলেন এবং সেই সূত্রে তারা জানতে পারেন যে ট্রাকটি ছিল সরকারের সিভিল সাপ্লাই বিভাগের। যেহেতু সরকারের প্রচ্ছন্ন সহযােগিতায় এই হামলা করা হয়েছিল তাই মন্ত্রী নুরুল আমিন ছাত্র নেতাদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করেননি বা তাদের অভিযােগের প্রতিকারের বিষয়ে আগ্রহ দেখাননি। বস্তুত সরকার চায়নি যে, এত দ্রুত কোনাে বিরােধী শক্তি সংগঠিত হােক। একই উদ্দেশ্যে ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর আহুত যুব সম্মেলনেও গুণ্ডারা হামলা চালায়। তারা নানা ধরনের বিরুদ্ধ প্রচার ও উস্কানিমূলক কাজ অব্যাহত রাখে। ( পরিশেষে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠিত হয়। ছাত্রদের জন্য একটি নগর কমিটি গঠনের লক্ষ্যে তাজউদ্দীন আহমদ যথেষ্ট তৎপর ছিলেন। কিন্তু পরে কোনাে অজ্ঞাত কারণে | মুসলিম ছাত্রলীগ গঠনের পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে তার ডায়েরিতে উল্লেখ | নেই । যেদিন মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করা হয় সেদিন তাজউদ্দীন আহমদ ঢাকাতে

————-

১৯৭ ঐ, ৩১ আগস্ট, ১৯৪৭। ১৯৮ ঐ, ২ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭। ১৯৯, ঐ, ৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭। ২০০ সায়েরা সালমা বেগম, “বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ছাত্রলীগ (১৯৪৮১৯৭১): মূলধারা পর্যালােচনা” অপ্রকাশিত এমফিল থিসিস, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ২০০১, পৃ. ৩৩।

৬৫

থাকা সত্ত্বেও তাতে যােগদান করেননি। এর সম্ভাব্য কারণ কি হতে পারে তা আজ সঠিক করে বলা দুষ্কর। তবে তাজউদ্দীন আহমদ একটি সাক্ষাৎকারে বলেন:২০১

আমি নিজে আগে রাজনীতি করতাম কিন্তু ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে বিশেষ যুক্ত ছিলাম । আমি সরাসরি মুসলিম লীগ রাজনীতিই করতাম। দেশভাগের পর অবশ্য আমাদের মতাে অনেক মুসলিম লীগ কর্মী আবার নতুন কবে ঢাকাতে এসে। পড়াশােনা আরম্ভ করেছিলাে। আমিও করেছিলাম কিন্তু তখনাে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে | বিশেষভাবে জড়িত না হয়ে আমি সরাসরি রাজনীতিতেই নামার চেষ্টা করি । ছাত্র সংগঠনটির সাম্প্রদায়িক নামকরণ হওয়ার কারণেও হয়তাে তিনি এবং তার বন্ধুরা তাতে যােগদানের আগ্রহ বােধ করেননি। বরং ১৯৪৮ সালের ১৫ এপ্রিল গণআজাদী লীগের গৃহীত ৬টি সিদ্ধান্তের একটিতে স্পষ্টভাবে লিখিত হয় যে, মুসলিম ছাত্রলীগের সঙ্গে তাদের কোনাে সম্পর্ক থাকবে না।২০২ এ বিষয়ে। মােহাম্মদ তােয়াহা কর্তৃক প্রদত্ত তথ্যেও দেখা যায় সাম্প্রদায়িক নামকরণের প্রশ্নেই তাজউদ্দীন আহমদ, মােহম্মদ তােয়াহা ও অন্যরা পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগে যােগদান করেননি।২০৩ তবে তাদের ঘনিষ্ঠ অলি আহাদ মুসলিম ছাত্রলীগে যােগদান করে গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হন।

১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বিকেলে ফজলুল হক হল মিলনায়তনে নাজমুল করিমের সভাপতিত্বে এক কর্মিসভার মাধ্যমে মুসলিম ছাত্রলীগের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ঘটে। নাঈমউদ্দিন আহমদকে আহ্বায়ক করে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এবং অলি আহাদকে আহ্বায়ক করে ঢাকা শহর মুসলিম ছাত্রলীগ গঠিত হয় । ১৪ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটি।২০৪ ১৯৪৯ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথম বার্ষিক সম্মেলনে সংগঠনটির স্থায়ী কমিটি গঠিত হয় ।

—————–

২০১, বদরুদ্দীন উমর, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৯৩। ২০. ডায়েরী, ১৫ এপ্রিল, ১৯৪৮। [২০৩. সায়েরা সালমা বেগম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৫-৩৬। [২০৪ নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কার্যকরী কমিটির অন্যান্য সদস্যরা হলেন: ১. নঈমউদ্দিন আহমদ (রাজশাহী): আহবায়ক, ২. আবদুর রহমান চৌধুরী (বরিশাল), ৩. শেখ মুজিবুর রহমান (ফরিদপুর), ৪. সৈয়দ নুরুল আলম (ময়মনসিংহ). [৫. আজিজ আহমেদ (নােয়াখালী), ৬. আবদুল কুদুস চৌধুরী (চট্টগ্রাম), ৭. নুরুল কবির |(ঢাকা সিটি), ৮, অলি আহাদ (ত্রিপুরা), ৯, আবদুল আজিজ-১ (কুষ্টিয়া), ১০. আবদুল | আজিজ-২ (খুলনা), ১১. দবিরুল ইসলাম (দিনাজপুর), ১২. আবদুল মতিন (পাবনা), ১৩. মফিজুর রহমান (রংপুর), ১৪. নওয়াব আলী (ঢাকা), Md. Abul Kashem, “History of the Student Movement in East Bengal and East Pakistan (now Bangladesh), 1947-1969: An Analytical Study”, Unpublished

——–

উপরিউক্ত আলােচনায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠনের ক্ষেত্রে প্রাথমিক উদ্যোগের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টিকে কেবলমাত্র গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কিন্তু যেহেতু বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ছাত্রলীগের একটি গৌরবােজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে সেহেতু এর উৎপত্তিগত প্রেক্ষাপট ও আদর্শিক। বিষয়ে কিঞ্চিৎ আলােচনার দাবি রাখে।

উপমহাদেশের রাজনৈতিক বিকাশের ইতিহাসে ছাত্র-আন্দোলনের একটি বিশিষ্ট ভূমিকা আছে। ১৯০৫ সালের বঙ্গবিভাগের পর কংগ্রেস ও অন্যান্য দলের পক্ষ থেকে এর বিরুদ্ধে যে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তােলা হয় তাতে সাড়া দিয়ে ছাত্ররাও ‘এন্টি সার্কুলার সােসাইটি” নামক একটি সংগঠনের আওতায় সরকারবিরােধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে থাকার কারণে এ ধরনের আন্দোলনে মুসলমান ছাত্রদের উপস্থিতি তেমন লক্ষ্য করা যায়।

। তবে ভারতীয় রাজনীতিতে ক্রমশ সাম্প্রদায়িকতা প্রবেশ করলে মুসলিম লীগ। রাজনীতির ন্যায় মুসলিম ছাত্রদেরকেও সংগঠিত করার প্রয়ােজনীয়তা অনুভূত হয় । এই চাহিদার প্রেক্ষিতে ১৯৩৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর কলকাতায় নিখিলবঙ্গ মুসলিম ছাত্র সমিতি গঠিত হয়। এর সভাপতি ও সম্পাদক নির্বাচিত হন যথাক্রমে খান বাহাদুর আসাদুজ্জামান এবং আবদুল ওয়াসেক। অতঃপর মিশ্ৰধারার ভাবাদর্শে ১৯৩৬ সালের ডিসেম্বরে লক্ষ্ণৌতে ছাত্র ফেডারেশন নামে সর্বভারতীয় আর একটি ছাত্র সংগঠন গড়ে ওঠে। এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতি ও প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন যথাক্রমে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও জওহরলাল নেহরু। বস্তুত ছাত্র ফেডারেশন গান্ধীবাদী, কংগ্রেসপন্থী, সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগপন্থী এবং বামপন্থী তথা কমিউনিস্টপন্থী ছাত্রদের সমবায়ে গঠিত সাম্রাজ্যবাদবিরােধী সম্মিলিত সংগঠনে পরিণত হয়। এই ঘটনা উপমহাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে মাইলফলকবিশেষ । তবে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও ভাবাদর্শের প্রশ্নে অচিরেই সংগঠনটির মধ্যে বিরােধ উপস্থিত হলে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস স্বতন্ত্র ধারায় নিজ নিজ ছাত্র সংগঠন গড়ে তােলার প্রতি গুরুত্বারােপ করে। ফলে ছাত্র ফেডারেশন

———-

Ph.D. Thesis, Department of History, Jadavpur University, India, 1992, p. 449. এ ছাড়াও দেখুন, বদরুদ্দীন উমর, পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তকালীন রাজনীতি, প্রথম খণ্ড, পৃ. ১৫৫। ২০৫. আবুল কাশেম, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক পটভূমি: একটি পর্যালােচনা’ Rajshahi University Studies. Part-A, Vol. 23-24, 1995-1996, Pp. 2-3.

১৯৪০ সাল নাগাদ সম্পূর্ণরূপে একটি কমিউনিস্ট সমর্থিত ছাত্র সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।২০৬

১৯৩৬ সালের শেষ নাগাদ নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশনের অংশ হিসেবে বঙ্গীয় ছাত্র ফেডারেশন প্রতিষ্ঠিত হয়। এর সভাপতি ও সম্পাদক নির্বাচিত হন। যথাক্রমে কে,এম, আহমদ এবং কালীপদ মুখােপাধ্যায়। ১৯৪০ সালে নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশন বিভক্ত হয়ে গেলে বঙ্গীয় ছাত্র ফেডারেশনেও বিরােধ উপস্থিত হয়। একই সঙ্গে বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্র সমিতিতেও মূল রাজনীতির ন্যায় আদর্শ ও নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সূত্রপাত ঘটে।২০৭ এর প্রতিক্রিয়া আজাদ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লক্ষ্য করা যায়।২০৮ এতদসত্ত্বেও অবিভক্ত বাংলায় মুসলিম লীগের আদর্শায়িত ভাবধারায় ছাত্রসমাজ সংগঠন ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করে। এর বাস্তব কারণ ছিল, ১৯৩৮ সালে বাংলা ও পাঞ্জাব ব্যতীত সকল প্রদেশে কংগ্রেস সরকার গঠন করে ঐগুলােতে বিদ্যা মন্দির শিক্ষা পদ্ধতি, শ্রীপদ্ম মনােগ্রামের ব্যবহার, হিন্দীকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রচেষ্টা, জাতীয় সংগীত হিসেবে বন্দেমাতরম গাওয়া প্রভৃতি কারণে মুসলিম ছাত্ররা বিক্ষুদ্ধ হয়। তারা কংগ্রেস সরকারের এ ধরনের কাজকে সাম্প্রদায়িক আদর্শ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা বলে মনে করে এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। এমতাবস্থায় বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল ওয়াসেক, জহিরুদ্দীন, শামসুর রহমান, সাহাবউদ্দীন, নূরউদ্দীন আহমদ, সালেহ আহমদ প্রমুখ নেতা বাস্তবসম্মতভাবে নিজেদেরকে সংগঠিত করার প্রতি গুরুত্বারােপ করেন।২০৯ কিন্তু বঙ্গীয় মুসলিম লীগ অচিরেই আকরম খাঁ ও আবুল হাশিম রক্ষণপন্থী ও উদারপন্থী গ্রুপে বিভক্ত হওয়ার প্রেক্ষিতে মুসলিম ছাত্রলীগেও বিভক্তি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ভারত বিভক্তির পূর্বেই কলকাতা ও ঢাকার মুসলিম ছাত্রলীগের উদার অংশটির মধ্যেও বিভক্তি দেখা দেয়। ঢাকার ছাত্রকর্মীরা পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেন বটে, কিন্তু অচিরেই অনুধাবন করেন যে, এর ফলে নবাব পরিবার ও অবাঙালি নেতৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এদের ওপর আবুল হাশিমের প্রভাব ছিল। অন্যদিকে কলকাতাস্থ উদারতাবাদী ছাত্র নেতাদের মধ্যে আবুল হাশিমের প্রতিপক্ষ হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর সমর্থক

————-

২০. সায়েরা সালমা বেগম,প্রাগুক্ত, পৃ. ৯-১০, ১৭। ২০৮. Md. Abul Kashem, op.cit., p. 27. ২০৯ সায়েরা সালমা বেগম, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯-২০।

ছিলেন। ২১০ ভারত বিভক্তির পর কলকাতা থেকে এরা ঢাকায় এসে পুনর্গঠিত হতে চেষ্টা করেন । | পাকিস্তানের জন্মের পর পূর্ব বাংলার ছাত্র সংগঠন ও ভাবাদর্শের প্রতি দৃষ্টি দিলে বিভাজনটা হয় এমন: সরকার সমর্থক মুসলিম ছাত্রলীগ- এই অংশের নেতাদের মধ্যে শাহ আজিজুর রহমান, সালেক ও অন্যরা ছিলেন নেতৃস্থানীয় । সরকারবিরােধী কিন্তু মধ্যপন্থী অংশটির নেতৃত্ব দেন শেখ মুজিবুর রহমান, নঈমুদ্দীন আহমদ ও অন্যরা। এরা ছিলেন সােহরাওয়ার্দী সমর্থক। খােদ ঢাকার ছাত্রনেতা ও সংগঠকরা ছিলেন অপেক্ষাকৃত উদারতাবাদী এবং আবুল হাশিমের সমর্থক। এদের মধ্যে শামসুল হক, শামসুদ্দীন, তাজউদ্দীন আহমদ, মােহাম্মদ তােয়াহা, অলি আহাদ ও অন্যরা উল্লেখযােগ্য। এছাড়াও ছিল কমিউনিস্ট পার্টি সমর্থিত ছাত্র ফেডারেশন ও কংগ্রেস পার্টি সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের কর্মকাণ্ড।

ভারতবর্ষের আধুনিক ইতিহাসের রাজনৈতিক বিকাশে ছাত্রদের একটি অগ্রণী ভূমিকা বরাবরই লক্ষ্য করা যায়। স্বাভাবিকভাবে অবিভক্ত বাংলা এবং পরবর্তীকালের পূর্ব বাংলার ইতিহাসও এর ব্যতিক্রম নয়। পাকিস্তানের জন্মের সময় হতে ঢাকার ছাত্রনেতারা করণীয় বিষয়ে সাময়িক দোদুল্যমান অবস্থায় পতিত হয়। এই অবস্থা কাটিয়ে উঠে তারা যখন পুনর্গঠিত হওয়ার চেষ্টা করে, ঠিক তখন ভারত বিভক্তির পর কলকাতা থেকে বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ঢাকায় এসে ওয়ার্কার্স ক্যাস্প কিংবা যুব সম্মেলনের ব্যানারে পুনর্গঠিত হতে সচেষ্ট হয়। অনতিবিলম্বে এই প্রচেষ্টা সরকারবিরােধী ছাত্রনেতা-কর্মীদের সমর্থনে বৃহত্তর পরিসর লাভ করে এবং উল্লিখিত ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ আত্মপ্রকাশ করে । যে ছাত্ররা পাকিস্তান আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল তাদের নেতৃত্বেই পাকিস্তানের জন্মের মাত্র ৬ মাস পরে সরকারবিরােধী পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাকে নিঃসন্দেহে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করা যায় । সংগঠনটির উদ্দেশ্য, আদর্শ ও দাবির প্রতি দৃষ্টি দিলে দেখা যায় যে, কেবলমাত্র শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়েই এটি সীমবাবদ্ধ থাকেনি, স্পষ্টত রাজনৈতিক অঙ্গীকারও ব্যক্ত হয় এতে।২১১ পরবর্তীতে এই সংগঠনটি পূর্ব বাংলার অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এখান থেকেই পূর্ব বাংলার

———

২১০ অলি আহাদ, জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-১৯৭৫ (ঢাকা: বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সােসাইটি, তা বি), পৃ. ৩৬-৩৭। ২৯ ২১১. বদরুদ্দীন উমর, ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ: কতিপয় দলিল, প্রথম খণ্ড (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১৯৯৫), পৃ. ১৭৩-১৭৪।

স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেক নেতার রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত।

হয়।

ভাষা আন্দোলনে তাজউদ্দীন আহমদ

মুসলিম লীগের রাজনৈতিক কাঠামাে ও ভাবাদর্শিক বৃত্তের বাইরে প্রতিষ্ঠিত প্রথম সংগঠন মুসলিম ছাত্রলীগের জন্ম সময়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলাে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত। তবে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নটি একেবারে নতুন ছিল না। বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের মধ্যভাগ থেকে ভারতবর্ষে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে বিতর্ক শুরু হয়। কংগ্রেসের হাইকমান্ড থেকে হিন্দীকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করা হলে তার বিপরীতে মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে উর্দুর সপক্ষে একই দাবি উচ্চারিত হয়।২১২ রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে হিন্দী-উর্দু বিতর্কের প্রেক্ষিতে ১৯৩৭ সালের ২৩ এপ্রিল, দৈনিক আজাদ পত্রিকায় সম্পাদকীয় নিবন্ধে বাংলাকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপিত হয়। এতে বলা হয় ভারতবর্ষের মােট জনসংখ্যার মধ্যে ৭ কোটি ৩০ লাখ মানুষ বাংলায় কথা বলে, এত বিপুলসংখ্যক মানুষ অন্য কোনাে ভাষায় কথা বলে না।২১৩ এরূপ প্রেক্ষাপটে ১৯৪৭ সালের আগস্টে পাকিস্তান নামক একটি ধর্মসম্প্রদায়ভিত্তিক রাষ্ট্রের আবির্ভাব দৃশ্যমান হলে এই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষার প্রসঙ্গটিও শিক্ষিত জনগােষ্ঠী, বুদ্ধিজীবী ও ছাত্রদের মধ্যে আলােচ্য বিষয়ে পরিণত হয়। প্রথমে লেখক-বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় সংবাদপত্রের পাতায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার পক্ষে কলম ধরেন ।২১৪ ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক একটি জনগােষ্ঠীর জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লেখকবুদ্ধিজীবীদের তত্ত্বগত এই প্রচেষ্টার সঙ্গে বৃহত্তর পরিসরে রাজনৈতিক সংযােগ ঘটার পূর্বেই বাংলার ছাত্রসমাজ এর দ্বারা আন্দোলিত হয়। অর্থাৎ ভাষা আন্দোলন সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, কিন্তু তা অচিরেই একটি জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দাবিতে রূপান্তরিত হয়। এরপর পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনেই ভাষা বিতর্ক শুরু হয়ে যায়। রাষ্ট্রটির অবাঙালি নেতারা যে ঔপনিবেশিক দৃষ্টিতে পূর্ব বাংলাকে দেখতেন তার প্রথম উদাহরণই হলাে তাদের মুখের ভাষাকে বাঙালির ওপর চাপিয়ে দেয়ার

———

২১২. আতিউর রহমান ও লেনিন আজাদ, ভাষা অন্দোলন প্রেক্ষিত ও বিচার (ঢাকা: ইউ.পি.এল, ১৯৯০), পৃ. ৩৪। ২১৩, ঐ, পৃ. ৩৬ এবং অলি আহাদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩২। ২১৪ দেখুন, বশীর আল হেলাল, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৯), পৃ. ১৮৫-১৯৭।

৭০

প্রয়াস । ব্রিটিশ আমলে যে শ্ৰেণীটি ইংরেজি ভাষা শিখেছিল, সেই শ্রেণীটি উন্নতি করেছিল; শাসককুলের কৃপা পেয়েছিল । অবাঙালি শাসিত পাকিস্তানের সূচনাতেই তাই যথেচ্ছভাবে বাংলা ভাষার সঙ্গে উর্দু শব্দের ব্যবহার শুরু হয়ে যায়।২১৫ বস্তুত উর্দু হিন্দি ও সংস্কৃতজাত একটি ভারতীয় ভাষা যে ভাষায় পাকিস্তানের এক নগণ্যসংখ্যক (৩.২৭%) মানুষ কথা বলে। অথচ বাংলা ভাষায় কথা বলে পাকিস্ত েিনর মােট জনগােষ্ঠীর ৫৬.৪০% নাগরিক। এই স্বল্পসংখ্যক প্রভুস্থানীয় শাসকশ্রেণীর মুখের ভাষাকেই বাঙালির ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। এমনিতেই পাকিস্তানের দু অঞ্চলের মধ্যে সাদৃশ্যের চেয়ে বৈসাদৃশ্যই ছিল প্রকট, ভাষার প্রশ্নে তা আরাে বেড়ে যায় । ভৌগােলিক দূরত্বের চেয়ে অনেক বেশি বেড়ে যায় মানসিক দূরত্ব ও অবিশ্বাস। শাসকগােষ্ঠীর পক্ষ থেকে আন্দোলনকারীদের ‘ভারতীয় চর’, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ প্রভৃতি আপত্তিকর অভিযােগ তুলে দুঃশাসন চাপিয়ে দেয়ার অপপ্রয়াস চালানাে হয়। অন্যদিকে বাঙালিরাও রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে ক্রমাগত সােচ্চার হয়ে ওঠে, ক্রমশ তা রাজনৈতিক দাবিতে রূপান্তরিত হয়। উল্লেখ্য নতুন এই বিতর্ক শুরু হওয়ার কিছু পূর্বে তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্যরা ‘আশুদাবি কর্মসূচি আদর্শ’-তে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ও শিক্ষার বাহন করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করেন। সদ্যগঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলাকে গ্রহণ করার দাবি জানায় । মূলত ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাস থেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে পূর্ব বাংলায় একটি জনমত গড়ে উঠতে শুরু করে। ঐ বছর ২ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ব বাংলার মন্ত্রী ও সাহিত্যিক হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরীর সভাপতিত্বে একটি অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাসেম (১৯২০-১৯৯১) এবং অপর কয়েকজন শিক্ষক ও ছাত্র মিলে গঠন করেন সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘তমদ্দুন মজলিস’। ভাষার দাবিতে গড়ে ওঠা এটিই প্রথম সংগঠন। এর উদ্যোগে ধীরে ধীরে এ ব্যাপারে জনমত গড়ে উঠতে শুরু করে । ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত এক প্রচারপত্রে জিজ্ঞাসিত হয় পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু? এই প্রচার পুস্তিকাতে বাংলাকে পূর্ব বাংলার [পূর্ব পাকিস্তান) শিক্ষার বাহন ও আইন। আদালতের ভাষা করার দাবি জানানাে হয়। তমদুন মজলিস’ এর ভাষা সংক্রান্ত প্রস্তাবের পাল্টা প্রস্তাব আসে একই বছর ২৭ নভেম্বর করাচীতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলন থেকে। সেখানে উপাচার্য জিয়াউদ্দিনের মতই বলা হয়—উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এ খবর ঢাকায় পৌছালে শিক্ষিত সচেতন মহলে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এরই প্রেক্ষিতে ৬ ডিসেম্বর বাংলা ভাষার দাবিতে ঢাকায়

————-

২১৫ অলি আহাদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩২।

———–

ছাত্র বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয় এবং নগরীর প্রধান প্রধান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আগত ছাত্রদের এক সভা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় থেকে তাজউদ্দীন আহমদ ও তার রাজনৈতিক সহকর্মীরা ভাষা আন্দোলনে নেতৃস্থানীয় | ভূমিকা পালন করেন । ভাষা আন্দোলনের উদ্যোগ সম্পর্কে ১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর তাজউদ্দীন আহমদ ডায়েরিতে লিখেন:২১৬

বেলা ২ টায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের সভায় যােগ দিলাম। বাংলা রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত দাবির পক্ষে ফরিদ আহসান, মুনির চৌধুরী প্রমুখ বক্তৃতা করলেন। অধ্যাপক কাশেম সভাপতিত্ব করলেন। সভা শেষ হলাে তিন টায়। সভার পর মন্ত্রীর বিরুদ্ধে

বিক্ষোভ মিছিল হলাে । উক্ত সভায় উপরিউক্ত দুজন ছাড়াও বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আবদুর রহমান, কল্যাণ দাশগুপ্ত, এ. কে. এম. আহসান, এস, আহমদ ও অন্যরা। রাষ্ট্রভাষার দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এটিই ছিল প্রথম শিক্ষক ও ছাত্রদের সভা।২১৭ | পাকিস্তানের জন্মের পর পরই কিছু অব্যবস্থাপনাজনিত সমস্যা ও শাসকগােষ্ঠীর বাঙালি-বিদ্বেষী মনােভাব পূর্ব বাংলার সচেতন মহলকে অসন্তুষ্ট করে তােলে । ভাষার দাবিতে তা তীব্র উত্তেজনায় পরিণত হয়। আর এ ধরনের পরিস্থিতির হাত হতে রক্ষা পাওয়ার জন্যেই সরকার সম্ভবত ১৯৪৭ সালে ১৩ ডিসেম্বর হতে পরবর্তী ১৫ দিনের জন্যে ঢাকায় বিভিন্ন সভা-সমাবেশের ওপর ১৪৪ ধারার আওতায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে। আন্দোলন দমনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে তাজউদ্দীন আহমদসহ অন্য নেতাদের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করা হয়।২১৮ তবে এ ধরনের হয়রানিমূলক মামলার প্রতিবাদ করার জন্য তারা খাজা নাজিমুদ্দীনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।২১৯

এমতাবস্থায় ছাত্রদের উদ্যোগে গড়ে ওঠে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি। ১৯৪৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি কমিটির কয়েকজন সদস্য মন্ত্রী ফজলুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জানতে চান মুদ্রা, ডাকটিকেট, মানি অর্ডার ফরম ইত্যাদিতে বাংলা ভাষা ব্যবহার না করার কারণ কী? তিনি এর জবাবে বলেন বস্তুত এটা

————-

২১৬. ডায়েরী, ৬ ডিসেম্বর, ১৯৪৭। ২১. বদরুদ্দীন উমর, পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, প্রথম খণ্ড, পৃ. ৩১। ২১৮ ডায়েরী, ৮ জানুয়ারি, ১৯৪৮।

—-

ভুলবশত হয়েছে ।২২০ কিন্তু ততদিনে বিষয়টি মফঃস্বলের কোনাে কোনাে শহরেও ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে। ১১ জানুয়ারি যানবাহন ও যােগাযােগ মন্ত্রী আবদুর রব নিশতার সিলেট সফরে গেলে সিলেট মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি আবদুস সামাদের নেতৃত্বে একটি ছাত্র প্রতিনিধিদল তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান।২২১ | ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ নাগাদ ঢাকাতে এটি আরাে ঘনীভূত হয় । তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি থেকে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে ভাষা আন্দোলনের তৎপরতা সম্পর্কে জানা যায়।২২২

সকাল ৯ টায় নাঈমউদ্দিন সাহেব ও অলি আহাদ এলেন। তাদের সাথে ১০ টা পর্যন্ত বাংলা ভাষা প্রশ্নে পাকিস্তান গণপরিষদের ভূমিকা নিয়ে আলােচনা করলাম … বিকেল ৪ টায় তমদুন মজলিস অফিসে গেলাম। সেখানে অধ্যাপক কাশেম, ইনসানের ওয়াহেদ চৌধুরী, অলি আহাদ ও অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। বাংলা ভাষার উপর পাকিস্তান গণপরিষদের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ২৮,২,৪৮ তারিখে ধর্মঘট ঘোষণা।

করা হতে পারে কিনা সে সম্পর্কে তাদের সঙ্গে আলােচনা হলাে। উল্লেখ্য, ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয় । এই অধিবেশনের শুরুতেই বিরােধী কংগ্রেস দলের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের (১৮৮৬-১৯৭১) পক্ষ থেকে দুটি সংশােধনী প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। এর একটিতে বছরে অন্তত একবার পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশন ঢাকায় অনুষ্ঠানের এবং দ্বিতীয়টিতে উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকেও গণপরিষদের অন্যতম ভাষা করার প্রস্তাব দেয়া হয়। অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনে প্রথম প্রস্তাবটি নাকচ হয়ে যায় এবং তৃতীয় দিন অর্থাৎ ২৫ ফেব্রুয়ারিতে দ্বিতীয় প্রস্তাবটির বিষয়ে আলােচনা হয়। এক পর্যায়ে গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ভাষা। সংক্রান্ত প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে তুমুল হট্টগােল বেধে যায়। প্রস্তাব উত্থাপনকারীদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কটাক্ষ ও বিরােধিতা করে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান।

——–

২২০ বদরুদ্দীন উমর, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৭। ২২১, নওবেলাল, ২২ জানুয়ারি, ১৯৪৮। ২২. ডায়েরী, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮।

* পরিষদের খসড়া নিয়ন্ত্রণ প্রণালীর ২৯ নং খারায় পরিষদের প্রত্যেক সদস্যের উর্দু বা ইংরেজিতে বক্তৃতা করার বাধ্যবাধকতা ছিল । এমতাবস্থায় ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাবটি 1981: “That in the sub rule (1) of rule 29, the word “English” in line 2. -the words or OBengalee” be inserted.” দেখুন, বশীর আল হেলাল, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩০।

ভারতের প্ররােচনায় হিন্দু বিছিন্নতাবাদীরা এই প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন বলে মন্ত ব্য করেন ।২২৪ | লিয়াকত আলী ও শাসকগােষ্ঠী কর্তৃক এ ধরনের সাম্প্রদায়িক বক্তব্য সম্ভব। হয় প্রধানত এ কারণে যে, পরিষদে মুসলমান সদস্যরা সকলেই ছিলেন সরকারি মুসলিম লীগ দলের সমর্থক এবং তারা দলগতভাবে বাঙালি-অবাঙালি নির্বিশেষে সকলে সমস্বরে প্রস্তাবটির নিন্দা এবং বিরােধিতা করেন। দ্বিতীয়ত প্রস্তাবটি যারা উত্থাপন এবং এর সমর্থনে বক্তৃতা করেন তারা সকলেই ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ এবং কংগ্রেস দলভুক্ত। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক এই আন্দোলনকে শুধুমাত্র শাসকগােষ্ঠীই সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে পরিণত করেনি। বরং এই আন্দোলন যখন পূর্ব বাংলার সচেতন মানুষেরা গড়ে তােলার চেষ্টা করে তখন এটাকে সাম্প্রদায়িকভাবে চিহ্নিত করা হয়। আন্দোলনরত কোনাে কোনাে ব্যক্তির পক্ষ থেকেও। ২ মার্চ ছাত্রদের অনুকরণে মূল রাজনৈতিক দল ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সমন্বয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। প্রথমে এই কমিটিতে একমাত্র হিন্দু সদস্য অজিত গুহ (১৯১৪-১৯৬৯)-এর নাম প্রস্তাবিত হয় । কিন্তু পরিশেষে তার নাম বাদ দেয়া হয় এই অজুহাতে যে, তিনি যেহেতু হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত, গণপরিষদে একজন হিন্দু এই প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন এবং হিন্দু সদস্যরা তা সমর্থন করেছেন, তাই শাসকগােষ্ঠীর নিকট এটি হিন্দুদের চক্রান্ত বলে চিহ্নিত হয়েছে । সুতরাং কোনাে হিন্দু ব্যক্তিকে সংগ্রাম কমিটিতে রাখা হলে আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে কেউ কেউ মন্তব্য করেন। অজিত গুহ প্রগতিশীল লেখক সংঘের একজন শক্তিশালী সদস্য হিসেবে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তমুদ্দন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবুল কাশেম অজিত গুহের নাম কমিটিতে না রাখার প্রস্তাব দেন। অজিত গুহ বলেন ভাষা আন্দোলন যেহেতু একটি গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক আন্দোলন, সেহেতু তার নাম সংগ্রাম কমিটিতে থাকলে ভালো হয়। এবং এ ব্যাপারে কোনাে সাম্প্রদায়িক চিন্তা স্থান পাওয়া উচিত নয়। যাহােক। অজিত গুহকে সংগ্রাম কমিটিতে রাখা হয়নি ।

—-

২২৪ হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পা), বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, প্রথম খণ্ড (ঢাকা তথ্য মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, ১৯৮৫), পৃ. ৫৪-৫৮। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত ১৫ খণ্ডে এসব দলিল প্রকাশিত হয়েছে। এরপর এই উৎসটি শুদুমাত্র দলিলপত্র বলে উল্লেখ করা

২২৫, বদরুদ্দীন উমর, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬১।

মুসলিম লীগের বাঙালি পরিষদ সদস্যদের দ্বারা ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাবের নিন্দা জানানাে এবং রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটিতে অজিত গুহের মতাে সংস্কৃতিবান ব্যক্তির নাম অন্তর্ভুক্ত করার বিরােধিতা সত্ত্বেও সাধারণ বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও ছাত্র সমাজ ভাষা আন্দোলনকে অসাম্প্রদায়িক আন্দোলন হিসেবে। বিবেচনা করে। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সাহসী ও দেশপ্রেমিক ভূমিকাকে তারা স্বাগত জানায়। এ থেকে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রতি শাসকগােষ্ঠীর ক্ষোভ জন্মে। প্রতিশােধপরায়ণ শাসকগােষ্ঠীর ইঙ্গিতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সূচনাতেই বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী তাকে অতি নির্মমভাবে হত্যা করে। ভাষা আন্দোলনের গােড়া থেকেই তাজউদ্দীন আহমদের সম্পৃক্তির বিষয়ে জানা যায় । এ বিষয়ে তার লিখিত ২ মার্চ ৪৮ তারিখের ডায়েরির অংশবিশেষ উল্লেখ করা যেতে পারে:

আড়াইটায় নাঈমউদ্দিন সাহেব এলেন। তার অনুরােধে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের জন্য একটা প্যাম্ফলেটের খসড়া করলাম। সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টায় এফ.এইচ.এম, হলে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সর্বদলীয় এক সভায় গেলাম। কামরুদ্দীন সাহেব সভাপতিত্ব করলেন। শামসুল হক, শামসুদ্দিন, সরদার ফজলুল করিম, তােয়াহা, অলি আহাদ, আজিজ আহমদ, নাঈমউদ্দিন, অধ্যাপক কাশেম, মিস লিলি খান, আনােয়ারা খাতুন, তফাজ্জল আলী, এটিএম, হক, আলী আহমদ মহিউদ্দিন, ওয়াদুদ, শওকত, আওয়াল, মাহবুব, নুরুল আলম, শহীদুল্লাহ, অজিত বাবু, ওয়াহেদ চৌধুরীসহ আরাে

অনেকে উপস্থিত ছিলেন। গণপরিষদের সিদ্ধান্ত এবং মুসলিম লীগের বাংলা ভাষাবিরােধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তােলার উদ্দেশ্যে এই বৈঠকে গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, তমুদ্দন মজলিস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রবাস এবং পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রত্যেকটি থেকে দুজন করে সদস্য নিয়ে একটি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। আহ্বায়ক মনােনয়ন করা হয় শামসুল আলমকে। সংগ্রাম কমিটি ঘন ঘন বৈঠকে মিলিত হয়ে কর্মসূচি নির্ধারণ

করে।২২৭

| সংগ্রাম কমিটির সিদ্ধান্ত মােতাবেক ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সারা পূর্ব বাংলায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সর্বাত্মক সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। কর্মসূচি সফল করার জন্য অন্যান্যদেরকে সঙ্গে নিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।২২৮ এ সময় তিনি মােহাম্মদ তােয়াহা ও সরদার ফজলুল করিমের সঙ্গে

————

২২৭. বশীর আল হেলাল, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫৪। ২২৮ “সকাল ৭টায় ধর্মঘটের পক্ষে কাজ করতে বেরিয়ে প্রথমে গেলাম এফ.এইচ.এম হলে । তােয়াহা সাহেব এবং আমি একসঙ্গে কাজ করছি। রমনা পােষ্ট অফিসের কাছে তােয়াহা সাহেব ও অন্য কয়েকজন পুলিশ কর্তৃক আটক হলেন। আমি গ্রেফতার এড়াতে

৭৫

মিলিতভাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন ।২২৯ তবে সরকার আন্দোলন দমনের জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিল। পুলিশ আন্দোলনকারী ছাত্রদের ওপর নির্যাতন চালায় এবং অনেককে গ্রেফতার করে। ফলে পরিস্থিতি উত্তেজনাকর হয়ে ওঠে। এমতাবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিক্ষোভ সমাবেশে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়। এর একটি হলাে তাৎক্ষণিকভাবে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের নিকট গিয়ে এই নির্যাতনের প্রতিবাদ করা, অন্যটি যে সব নির্বাচিত বাঙালি প্রতিনিধি মাতৃভাষার মতাে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থরক্ষা করতে ব্যর্থ হবেন তাদেরকে অবিলম্বে পদত্যাগের আহ্বান জানানাে।

| এই দিনের ধর্মঘট কর্মসূচিতে ছাত্রদের সাথে বেশ কিছুসংখ্যক সচিবালয় কর্মচারী ও রেল কর্মচারি যােগদান করে। ফলে ভাষা আন্দোলন সীমিতভাবে হলেও ছাত্রদের গণ্ডি অতিক্রম করে সর্বজনীন মাত্রা লাভ করে । নেতৃস্থানীয়। ব্যক্তিরা ব্যপকভাবে গ্রেফতার বরণ করলেও তাজউদ্দীন আহমদ গ্রেফতারি এড়িয়ে ভাষা আন্দোলনকে অব্যাহত রাখতে সচেষ্ট থাকেন। এ বিষয়ে স্মৃতিচারণে তিনি।

বলেন: ২৩০

সরদার ফজলুল করিম ও আমি সেদিন বেশ কিছুক্ষণ একসাথে ছিলাম। তিনি আমাকে নেতাদের সাথে ঘুরতে নিষেধ করেছিলেন। কারণ তার ধারণা ছিলাে যে, কিছু নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ও ছাত্র তাড়াতাড়ি গ্রেফতার হয়ে নাম অর্জনের চেষ্টা করবেন এবং ফলে সকলে সেইভাবে গ্রেফতার হলে আন্দোলন বানচাল হবে। কাজেই

গ্রেফতার যাতে না হই তার জন্য সাবধান থাকতে হবে । তার এই কৌশল যথার্থ ছিল, কেননা সকলে প্রথম দিনেই বন্দি হয়ে গেলে পরবর্তীতে আন্দোলনকে বেগবান করা যেত না।”

১১ মার্চের পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ শহরের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১৩ মার্চ পর্যন্ত পূর্ণ ধর্মঘট পালিত হয় । ঐ দিন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম উপকমিটির একটি বৈঠক হয় যাতে তাজউদ্দীন আহমদ উপস্থিত থাকেন। আলােচনা শেষে ১৫ মার্চ পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় । ১৪ মার্চ পূর্ব বাংলার সর্বত্রই ধর্মঘট পালিত হয়। উল্লেখ্য, ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, কুমিল্লা, যশাের, খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর প্রভৃতি বড়

———–

সক্ষম হলাম । একটু পরে তােয়াহা সাহেবকে পুলিশ ছেড়ে দিলাে । ১২টায় নাঈমউদ্দিনের সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সভা হলাে।” ডায়েরী, ১১ মার্চ, ১৯৪৮।

সরদার ফজলুল করিম, সেই সে কাল কিছু স্মৃতি কিছু কথা (ঢাকা: প্যাপিরাস, ২০০২), পৃ. ৪৬। ২৬০ বদরুদ্দীন উমর, ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ: কতিপয় দলিল, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ২৯৬। ২৩৯ কামরুদ্দীন আহমদ, বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ, প্রথম খণ্ড, পৃ. ১১৩।

শহরে ১১ মার্চ থেকেই সীমিত পর্যায়ে হলেও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে কর্মসূচি পলিত হতে দেখা যায়।২৩২ এদিকে ১৪-১৬ মার্চ পর্যন্ত ঢাকায় হরতাল কর্মসূচি উত্তরােত্তর তীব্রতর হয়ে সর্বাত্মক ও জঙ্গিরূপ ধারণ করে। আন্দোলনকে অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে তাজউদ্দীন আহমদ ও মােহাম্মদ তােয়াহা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। প্রথম সারির অন্যান্য নেতা সংগঠকরা গ্রেফতার বরণ করায় তাদের কাধেই এই পর্যায়ে মূল দায়িত্ব এসে যায় । তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি থেকে এ বিষয়ে জানা যায় । তিনি লিখেছেন

১৪.২.১৯৪৮:

সকাল সাড়ে ৭ টায় তােয়াহা সাহেবের সঙ্গে এফ,এইচ,এম, হলে গেলাম। রেলওয়ে ধর্মঘটের পক্ষে কাজ করার জন্য কালু ও হেদায়েতকে টঙ্গি ও কুর্মিটোলা পাঠানাে হলাে।… সােয়া ৮ টায় প্রেস থেকে ২ টা রিসিট বই নিয়ে ৯ টায় তফাজ্জল আলীর কাছে গেলাম। কর্মীদের বিভিন্ন এম.এল.এ. এর কাছে পাঠানাে হচ্ছে। এরপর কর্মী। ও এম্বুলেন্সের জন্য ডা. করিমের কাছে গেলাম । মূলত তােয়াহা সাহেব ও আমার চাপের ফলে আগামীকাল (১৫.৩.৪৮) সাধারণ ধর্মঘট ডাকার সিদ্ধান্ত নেয়া হলাে।

১৫.২.১৯৪৮:

সকাল সাড়ে ৬ টায় বেরিয়ে প্রথমে এফ.এইচ.এম, হলে গেলাম। বৃষ্টির জন্য বাইরের বা হলের কোনাে কর্মীই বের হলাে না। তােয়াহা সাহেব ও আমি প্রথমে হলের কর্মীদের একত্রিত করলাম। তারপর আমি রমনা পােস্ট অফিস থেকে নীলক্ষেত ও পলাশী ব্যারাক এলাকায় পিকেটিংয়ের কাজ দেখতে বেরুলাম। এরপর গেলাম ডা, করিমের কাছে। তিনি তার এম্বুলেন্স কোর ও কর্মীবাহিনী নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। সেখান থেকে জগন্নাথ হােষ্টেল, তারপর আগামাসি লেন মেসে গেলাম এবং কর্মীদের বের করলাম। সচিবালয়ে এবং রমনা এলাকার অন্যান্য অফিসের বাঙালি অফিসাররা পূর্ণ ধর্মঘট করলেন। সাড়ে ১১ টায় রেলওয়ে কর্মীরা ধর্মঘটে

যােগ দিলেন। এ দিনও বিপুলসংখ্যক বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করা হয় এবং দুপুর ১২ টায় মেডিক্যাল কলেজ গেটে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিকেল ১-৩ টা পর্যন্ত সভা চলে এবং তারপর পরিষদ ভবনের সামনে। একটি বিরাট বিক্ষোভ সমাবেশ হয়। সন্ধ্যা নাগাদ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ চত্বরে তাজউদ্দীন আহমদ বিক্ষোভ সমাবেশ অব্যাহত রাখতে নেতৃত্ব দেন। কিন্তু

——–

২৩২. দেখুন, বশীর আল হেলাল, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬৬-২৭০।

ইতােমধ্যে দুপুর নাগাদ সংগ্রাম কমিটির অপরাপর নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ৮ দফাভিত্তিক একটি চুক্তিতে উপনীত হতে বাধ্য হন।২৩৩ চুক্তি করার জন্য খাজা নাজিমুদ্দীনের পক্ষ থেকে ১৫ মার্চ সকালে প্রস্তাব আসে। কামরুদ্দীন আহমদ প্রস্তাব পাওয়ার পর আলােচনার জন্য তােয়াহা, তাজউদ্দীন ও অন্যান্য নেতার খোঁজে লােক পাঠান। কিন্তু তােয়াহা ও অন্য অনেকে চুক্তি না করার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। কারণ আন্দোলন তখন আর শুধু ঢাকাতে সীমাবদ্ধ ছিল না। ঐ মুহূর্তে চুক্তি করলে আন্দোলনকারীদের প্রতি অবিচার করা হয় । তাই যাতে চুক্তি করতে সরকার পক্ষ পিছু হটে আসে সেজন্য ৭ দফাভিত্তিক একটি দাবি উত্থাপন করা হয়।২৩৪ কিন্তু পরিস্থিতি এত জটিল হয়ে ওঠে যে, ঐ সকল দাবি না মেনে সরকারের কোনাে উপায় ছিল না। তিনি যাতে চুক্তি না সই করেন সে উদ্দেশ্যে মােহাম্মদ তােয়াহা সর্বশেষ অস্ত্র হিসেবে খাজা নাজিমুদ্দীন ও মুসলিম লীগ সরকারের জন্য চরম অবমাননাকর একটি শর্ত ৮ নং দফা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে বলে দাবি জানান। তিনি বলেন যে, খাজা নাজিমুদ্দীন স্বহস্তে লিখে দেবেন, তিনি ইতঃপূর্বে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে অসত্য বিবৃতি দিয়েছেন এবং সেজন্য তিনি দুঃখিত।২৩৫ এতদসত্ত্বেও পরিশেষে ১৫ মার্চ ৮ দফাভিত্তিক চুক্তিটি সম্পাদিত হয়।২৩৬ চুক্তির শর্ত মােতাবেক ভাষা আন্দোলনের কারণে যে সকল বন্দি কারাগারে ছিলেন তাদের মুক্তিদানের ব্যবস্থা করা হয় । কিন্তু বন্দিরা, ভাষা আন্দোলনের কারণে বন্দী নন যেমন- কাজী গােলাম মাহবুব, শওকত আলী ও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য রনেশ দাশগুপ্তকে ছাড়া মুক্তি গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান । ফলে সরকার তাদেরকেও মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।২৩৭ এতেই বুঝা যায় যে, ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন কতটা তীব্র আকার ধারণ করে এবং সরকার কেমন অসহায় হয়ে পড়ে। সরকার বিপাকে পড়ার আর একটি কারণ ছিল, ১৯ মার্চ মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকায় আগমনের কর্মসূচি নির্ধারিত হয়েছিল । খাজা নাজিমুদ্দীন সম্ভবত জিন্নাহর ঢাকা আগমনের পূর্বেই যেনতেনভাবে এই সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ হয়ে ওঠেন। কিন্তু আন্দোলন এমন তুঙ্গে ওঠে যে, সাধারণ ছাত্ররা ঐ চুক্তি মানতে রাজি ছিল না। তাদের চাপের মুখে নেতৃবৃন্দ ১৬

—–

২৩৩, কামরুদ্দীন আহমদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১৫-১১৬। ২৩. ঐ, পৃ. ১১৬ ।

২৩ই

ঐ।

২৩৬, দলিলপত্র, প্রথম খণ্ড, পৃ. ৭৭ ও বশীর আল হেলাল, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৭২।

অলি আহাদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৭। . Md. Abul Kashem, op.cit., p. 118.

মার্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘটের কর্মসূচি দিতে বাধ্য হন।২৩৯ ১৫ মার্চ একদিকে সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে যখন খাজা নাজিমুদ্দিন চুক্তিবদ্ধ হন, অন্যদিকে তখন তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যদের নেতৃত্বে আন্দোলন অনেকটা জঙ্গিরূপ ধারণ করে। এ থেকে বুঝা যায় ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন কেবলমাত্র ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে নি । বাঙালি সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারিরাও এতে যােগ দেয়। ফলে আন্দোলনের মাত্রা ও পরিধি বিস্তৃত হয়ে কিছুটা গণআন্দোলনের চরিত্র লাভ করে ।

আন্দোলনকে জঙ্গিরূপ দেয়ার পশ্চাতে কমিউনিস্ট সদস্যদের প্রভাব ছিল বলে অলি আহাদ ও তাজউদ্দীনের সূত্র থেকে জানা যায়। আন্দোলনকারীরা যেমন সম্পাদিত চুক্তি মানতে রাজি ছিল না, তেমনি সরকার প্রকাশ্য দমন-পীড়ন ও গােপন অপতৎপরতা বৃদ্ধি করে। নেতা কর্মীদের নানাভাবে ভয়ভীতি ও চাপ প্রয়ােগ করা হতে থাকে। স্বয়ং তাজউদ্দীন আহমদ ও আরাে কেউ কেউ সরকারের লেলিয়ে দেয়া গুণ্ডাদের আক্রমণের মুখে পড়েন। | ১৯ মার্চ মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ব বাংলায় আসেন। আন্দোলনকারীদের প্রত্যয় জন্মেছিল জিন্নাহ সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে সুবিচার করবেন। কিন্তু তিনি শুরুতেই একমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করাসহ আন্দোলনকারীদের সরাসরি রাষ্ট্রের শত্রু বলে বক্তৃতা করেন।২৭৪

যে উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহকে সংবর্ধনা দেয়ার আয়ােজন করা হয়েছিল তার এ ধরনের বক্তব্য ও আচরণের কারণে তা সম্পূর্ণরূপে নিস্পৃহতায় পরিণত হয় এবং তার সম্মানে নির্মিত তােরণ ভেঙে ও ছবি ছিড়ে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটানাে হয়। তিনি ২১ তারিখের জনসভা ও ২৪ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে একই ধরনের অনমনীয় প্রকৃতির বক্তৃতা করেন যা প্রতিবাদের সম্মুখীন হয়। ২৪ মার্চ সন্ধ্যায় মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ ছাত্রদের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সাথে এক সাক্ষাৎকার দেন এবং আলােচনার শুরুতেই আন্দোলনকারীদেরকে আক্রমণ করে কথা বলেন। ফলে

——–

২৩৯ ডায়েরী, ১৫ মার্চ, ১৯৪৮। ২৪০ দেখুন, ঐ। ২৮১, অলি আহাদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৭। এ বিষয়ে তাজউদ্দীন আহমদের ১৭ মার্চ, ১৯৪৮ তারিখের ডায়েরী দেখুন । ২৪. ডায়েরী, ১৭ মার্চ, ১৯৪৮। ২৪৩ বদরুদ্দীন উমর, পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, প্রথম খণ্ড, পৃ. ৯৬। ২৫. ডায়েরী, ২১ মার্চ, ১৯৪৮। ২৪৫ বদরুদ্দীন উমর, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৬।

আলােচনার পরিবেশ নষ্ট হয়ে যায় । তিনি নাজিমুদ্দীনের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিকে ‘একতরফা’ ও ‘জোর করে করিয়ে নেয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করেন।২৪৬ আরাে বলেন একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের জন্য একাধিক রাষ্ট্রভাষা ক্ষতিকর২৪৭ এবং পৃথিবীর কোনদেশে একাধিক রাষ্ট্রভাষা নেই ।২৪৮ এর প্রতিবাদে প্রতিনিধিদলের নেতৃবৃন্দ। ইতিহাস ও চলতি বিশ্ববাস্তবতার আলােকে নানা উদাহরণসহ যুক্তি তুলে ধরেন। তরুণ মেধাবী এই প্রতিনিধিদলের সদস্যদের ক্ষুরধার যুক্তির নিকট মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ অপমানিত বােধ করেন এবং এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি উচ্চগ্রামে পৌছে। কিন্তু জিন্নাহ কোনাে যুক্তিই শুনতে চাননি। তিনি বলেন। “তােমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হওয়া উচিত উর্দু’। পরিশেষে সংগ্রাম কমিটির বিক্ষুব্ধ। সদস্যরা কোনভাবে একটি স্মারকলিপি জিন্নাহকে দিয়ে আসেন। এই প্রতিনিধিদলে তাজউদ্দীন আহমদ উপস্থিত থেকে সমস্ত ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন। প্রতিনিধিদলে অন্যদের মধ্যে ছিলেন শামসুল হক, কামরুদ্দীন আহমদ, আবুল কাশেম, লিলি খান, মােহাম্মদ তােয়াহা, আজিজ আহমদ, অলি আহাদ, নাঈমদ্দীন আহমদ, শামসুল আলম এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম। | জিন্নাহ ঢাকা ত্যাগ করার পর রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির একটি বৈঠক হয়। শামসুল হক আহ্বায়কের পদে ইস্তফা দেন। কারণ তার মতে আন্দোলনটি তখন। এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, নতুন কমিটি গঠনের প্রয়ােজনীয়তা দেখা দেয়। তিনি কাগজপত্র মােহাম্মদ তােয়াহার নিকট বুঝিয়ে দেন। আবদুল মান্নান হন অস্থায়ী আহ্বায়ক। একই বছর ১৭ নভেম্বর রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আর একটি বৈঠক বসে আতাউর রহমানের সভাপতিত্বে । এতে উপস্থিত ছিলেন কামরুদ্দীন আহমদ, শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, আবদুল মান্নান, আজিজ আহমদ, আবুল কাশেম, আনসার আলী ও অন্যান্যরা। এরপর ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গটি কিছু সময়ের জন্যে স্তিমিত হয়ে পড়ে। এতদসত্ত্বেও ৪৮

———-

২৪৬, ঐ, পৃ. ৯৯। ২৪৭, অলি আহাদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৩। ২৪৮ বদরুদ্দীন উমর, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৯। ২৪৯ অলি আহাদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫২। ২৫০ ঐ, পৃ. ৫৩, ২৫. ডায়েরী, ২৪ মার্চ, ১৯৪৮।

২৫৩, বদরুদ্দীন উমর, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৯। ২৫৮ মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, তৃতীয় বর্ধিত সংস্করণ), পৃ. ৭৪-৭৫।

৮০

এর ভাষা আন্দোলন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বাঙালিদের প্রথম সম্মিলিত প্রতিরােধ প্রয়াস হিসেবে এর গুরুত্ব অনস্বীকার্য। | এরপর প্রতি বছর ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হতে থাকে। তবে ১৯৪৮-১৯৫১ পর্যন্ত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে তেমন কোনাে নতুন উদ্যোগ দেখা যায়নি। অন্যদিকে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে নানা চক্রান্ত অব্যাহত থাকলেও রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে সরাসরি বাংলাবিরােধী কোনাে মন্তব্য কেন্দ্রীয় অথবা প্রাদেশিক সরকার কর্তৃক এই সময়ের মধ্যে উচ্চারিত হয়নি। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে বেশ সতর্কতার সঙ্গেই যতদিন সম্ভব নিশ্ৰুপ থাকার কৌশল গ্রহণ করেন।২৫৫ এমতাবস্থায় পরবর্তী রাষ্ট্রভাষা দিবসগুলােতে বাংলা ভাষার দাবিতে কিছু কিছু কর্মসূচির বিষয়ে জানা যায়। ১৯৪৯ সালের ১১ মার্চ প্রথম বার্ষিকীতে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ‘আরবী হরফ চাই না’ স্লোগান দিয়ে দলবদ্ধভাবে ছাত্ররা ঢাকায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ঐ বছর ১০ মার্চের পূর্ব থেকেই ঢাক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিম বেতনভূক কর্মচারীদের আন্দোলন শুরু হয়েছিল। ছাত্ররা তা। সমর্থন করায় পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এমতাবস্থায় ১০ মার্চ রাতে ফজলুল হক হলের ছাত্রদের একটি সভা হয় এবং তাতে দবিরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদ উদ্ভূত পরিস্থিতির ওপর বক্তৃতা করেন। এতে তাজউদ্দীন আহমদ ও রুহুল আমিনকে কর্ম পরিষদের প্রতিনিধি মনােনয়ন করা হয়।২৫৬ ১২ মার্চ ছিল পূর্ব বাংলা ব্যবস্থাপক পরিষদের বাজেট অধিবেশনের দ্বিতীয় দিন । সেদিন ছাত্ররা ঢাকা শহরে মিছিল করে। কিছুসংখ্যক ছাত্র পরিষদ ভবনের সামনে ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই, আরবী হরফ চাই না’ ইত্যাদি স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। বিক্ষোভ প্রদর্শনকারী ছাত্রদের মধ্যে থেকে সৈয়দ আফজাল হােসেন, মৃণাল কান্তি বাড়রী, বাহাউদ্দিন চৌধুরী, ইকবাল আনসারী, আবদুস সালাম এবং এ.কে.এম. মনিরুজ্জামান চৌধুরীকে পুলিশ গ্রেফতার করে। পরদিন ১৩ মার্চ ঢাকা হলের একটি সভায় খুব অল্পসংখ্যক ছাত্রনেতা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকাকালেও হলে থাকার পক্ষে মত দেন। কিন্তু পরিস্থিতি ঘােলাটে হয়ে উঠলে সেদিনই দুপুরে সলিমুল্লাহ হলে সংগ্রাম পরিষদের আর একটি জরুরি বৈঠকে স্থির হয় যে, অধিকাংশ ছাত্র হল ত্যাগ করে চলে গেলে নেতারা সকলকেই হল ছেড়ে যেতে বলবেন । ১৪ তারিখ সকালে ঢাকা হল প্রাঙ্গণে তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্য কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ছাত্র একত্রিত হয়ে স্থির করেন, যেভাবে সকলে হল ত্যাগ।

———————

২৫৫ বদরুদ্দীন উমর, পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, তৃতীয় খণ্ড (চট্টগ্রাম: বইঘর, ১৯৮৫), পৃ. ১২৯। ২৫* বদরুদ্দীন উমর, পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তকালীন রাজনীতি, প্রথম খণ্ড, পৃ. ১৬০।

করার জন্য প্রস্তুত তাতে নেতাদের পক্ষেও আর হলে থাকা সঙ্গত হবে না । এরপর তারা সকলেই হল ত্যাগ করেন।২৫৭ মূলত এই পর্যায়ে ছাত্র আন্দোলন থেমে যায় । ছাত্র আন্দোলনের সাময়িক স্থবিরতার বিষয়ে সাপ্তাহিক নওবেলাল ২৪ মার্চ ১৯৪৯ তারিখে ‘ছাত্র আন্দোলনে গলদ কোথায়?’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে আলােকপাত করে। কোনাে কোনাে ছাত্র নেতাকে এজন্য দায়ী করা হয় । তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরিতেও এ বিষয়ে কিঞ্চিৎ ইঙ্গিত রয়েছে।২৫৮ | ১৯৫০ সালে রাষ্ট্রভাষা দিবস তেমন গুরুত্বসহকারে পালিত হয় বলে জানা যায় না। কিন্তু ১৯৫১ সালের রাষ্ট্রভাষা দিবস বার্ষিকীর পূর্বে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ১১ মার্চ দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে মুসলিম ছাত্র লীগের খালেক নওয়াজ খানের সভাপতিত্বে ধর্মঘটী ছাত্র-ছাত্রীদের এক সভা হয়। বক্তারা রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে ১৯৪৮ সালে সরকার কর্তৃক প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি পালন না করায় প্রাদেশিক সরকারের তীব্র নিন্দা, ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকদের প্রতি সাবধান বাণী উচ্চারণ, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা এবং পূর্ব বাংলার স্বার্থরক্ষা করতে ব্যর্থতার অভিযােগে পরিষদ সদস্যদের পদত্যাগ দাবি করেন। সেই সভাতেই আবদুল মতিনকে আহবায়ক করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয় । তাজউদ্দীন আহমদ এই কমিটির অন্যতম সদস্য মনােনীত হন।৬০ ১৯৫১ সালের ১৩ মার্চ নবগঠিত বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয় মকসুদ আহমদের সভাপতিত্বে । এতে তাজউদ্দীন আহমদসহ প্রায় সকল সদস্য উপস্থিত হন। ঐ বৈঠকে গৃহীত কয়েকটি সিদ্ধান্তের মধ্যে অন্যতম ছিল ইংরেজি ভাষায় একটি স্মারকলিপি প্রণয়ন করে তা পাকিস্তান গণপরিষদ সদস্যদের নিকট প্রেরণ করা। ২৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ অফিসে ১৩ তারিখে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়ন করার জন্য হাবিবুর রহমান শেলীর সভাপতিত্বে আর একটি সভা হয়। এই সভাতে পূর্ব সিদ্ধান্ত মােতাবেক স্মারকলিপির খসড়া উপস্থাপিত হয়।

ইতােমধ্যে ১৯৫১ সালের ২৭ ও ২৮ মার্চ দুদিনব্যাপী সম্মেলনের মধ্য দিয়ে পুর্ব পাকিস্তান যুবলীগ গঠিত হলে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রাণ প্রাচুর্য দেখা দেয় ।

—————

২৫৭, ঐ, পৃ. ১৬১। ২৫৮ ডায়েরী, ১৪ মে, ১৯৪৯ । ২৫* পাকিস্তান অবজার্ভার, ১২ মার্চ, ৫১ এবং নওবেলাল, ১৫ মার্চ, ১৯৫১। * সদস্যরা হলেন: হাবিবুর রহমান শেলী, বদিউর রহমান, মাকসুদ আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ, আনােয়ারুল হক, মােশারফ হােসেন, আবদুল ওদুদ, নুরুল আলম, সালাউদ্দিন, রুহুল আমীন চৌধুরী ও অন্যান্য । বদরুদ্দীন উমর, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩০। ২৬ ঐ, পৃ. ১৩১ এবং ডায়েরী, ২৫ মার্চ, ৫১।

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে যুবলীগ সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব গ্রহণ করে। প্রসঙ্গত। উল্লেখ্য, ১৯৪৮ সালে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকা ত্যাগের পর উল্লিখিত নানা কারণে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নটি আপাতত চাপা থাকে। কিন্তু তখনও ৪৮-এর ভাষা আন্দোলন পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে যে অভিঘাত হানে তার অনুরণন থেমে যায়নি। এখানে স্পষ্ট করে বলা দরকার যে, এ সময় পাকিস্তানের রাজনীতির প্রতি দৃষ্টি দিলে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। একদিকে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হওয়ার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি শুরু হয়। ধারাবাহিকভাবে অনেকগুলাে ঘটনা ঘটে। এগুলাের মধ্যে ১৯৪৮ সালের এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত টাঙ্গাইল উপনির্বাচন, ১৯৪৯ সালের ২৩ মার্চ আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম, ১৯৫০ সালের শেষদিকে বিকল্প খসড়া মূলনীতি প্রস্তাব আন্দোলন, ১৯৫১ সালের মার্চে যুবলীগ গঠন প্রভৃতির মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলায় রাজনৈতিক বােধ ও বিকাশের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামাে গড়ে ওঠে। পর্যায়ক্রমে এগুলাের একটি পরের ঘটনাটিকে ত্বরান্বিত করে। অন্যদিকে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর অকস্মাৎ মৃত্যু, লিয়াকত আলী খানকে হত্যা প্রভৃতি ঘটনার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নেতৃত্বশূন্যতা প্রকট হয়ে ওঠে। এই দুইয়ের সম্মিলনে ১৯৪৮ উত্তর-পূর্ব বাংলায় রাজনৈতিক বিকাশ ত্বরান্বিত হয়। এই বিকাশ সাধারণভাবে দৃষ্টিগ্রাহ্য না হলেও পূর্ব বাংলার স্বতন্ত্র স্বার্থবােধের বিষয়টি পরিস্ফুট হয়ে ওঠে যা অনতিবিলম্বে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় স্পষ্ট রূপ পরিগ্রহ করে। এই পর্যায়ের রাজনৈতিক বিকাশের বিষয়টি বদরুদ্দীন উমরের পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি নামক গ্রন্থে কিছুটা হলেও বিস্তৃত। হয়েছে। ভারতীয় গবেষক M.B.Nair তার Politics in Bangladesh(A Study of Awami League: 1949-58) গ্রন্থে এই পর্যায়ের রাজনৈতিক বিকাশের বিষয়ে সম্যক আলােকপাত করেছেন। বস্তুত পূর্ব বাংলায় উল্লিখিত রাজনৈতিক বিকাশ না হলে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন একটি নিষ্পত্তিকারী ঘটনায় পরিণত হতে পারতাে না। তাই সবদিক দিয়েই ১৯৫১ সালের মার্চ মাস থেকে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি জোরালাে হয়ে ওঠে। | ১২ এপ্রিল বদিউর রহমানের সভাপতিত্বে এবং ১৭ এপ্রিল তাজউদ্দীন। আহমদের সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির দুটি সভা হয় । উল্লিখিত স্মারকলিপি সম্পর্কে গণপরিষদে সংক্ষিপ্ত নােটিশ প্রদান করার অনুরােধ জানানাের জন্য সংবিধান সভার কিছুসংখ্যক পূর্ববঙ্গীয় সদস্যের নিকট টেলিগ্রাম পাঠানাের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সে মর্মে আবদুল মতিন সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ। থেকে গণপরিষদে পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের কয়েকজন সদস্যের নিকট

টেলিগ্রাম প্রেরণ করেন।২৬২ কিন্তু দুঃখের বিষয় কোনাে পরিষদ সদস্য এ বিষয়ে কোনাে নােটিশ প্রদান বা আলােচনা করেননি। লিয়াকত আলী নিহত হওয়ার পর ইতােমধ্যে খাজা নাজিমুদ্দীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। তিনি ১৯৫২ এর জানুয়ারি মাসে নুরুল আমীনের সভাপতিত্বে পল্টন ময়দানের জনসভায় মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর ন্যায়ই উচ্চারণ করেন যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, কারণ একাধিক রাষ্ট্রভাষা থাকলে কোনাে রাষ্ট্র শক্তিশালী হতে পারে না।২৬৩ তিনি বেমালুম ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চে তার সম্পাদিত চুক্তির কথা ভুলে যান । নাজিমুদ্দীনের ভাষা সম্পর্কিত ঐ ধরনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ উক্তি সমগ্র পূর্ব বাংলার সচেতন মানুষকে হতভম্ব ও বিক্ষুব্ধ করে তােলে। ফলে ভাষা আন্দোলন অবিলম্বে আবার জঙ্গিরূপ ধারণ করে।২৬৪ এর প্রতিবাদ করা হয় ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট, বিক্ষোভ সমাবেশ, মিছিল ও বক্তৃতার মাধ্যমে।

ভাষা আন্দোলন ১৯৫২ সালে এসে সর্বব্যাপী ও জাতীয় আন্দোলনের চরিত্র ধারণ করে। রাজনৈতিক দল ও নাগরিকদের পক্ষ থেকেও এবার বিপুল সাড়া পাওয়া যায়। ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরিতে ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিকর্মী ও রাজনীতিবিদদের এক বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি এবং পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অন্যতম সহ-সভাপতি কাজী গােলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে একটি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। এর সদস্য সংখ্যা কত ছিল সে বিষয়ে মত পার্থক্য রয়েছে। অলি আহাদ তার স্মৃতিচারণমূলক প্রাগুক্ত গ্রন্থে ২৮ জনের নাম উল্লেখ করলেও ৩ ফেব্রুয়ারি (১৯৫২) তারিখে প্রকাশিত সৈনিক পত্রিকায় বলা হয় যে, ৪০ জন সদস্য নিয়ে

২২৬. বদরুদ্দীন উমর, পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তত্ত্বালীন রাজনীতি, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ১৩৮। ২৩৩, বশীর আল হেলাল, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০৯-৩১০। ২৫ মােহাম্মদ তােয়াহা এ সম্পর্কে বলেন যে, নাজিমুদ্দিন ঐ ধরনের উক্তি না করলে ২১ ফেব্রুয়ারি নাও ঘটতে পারতাে’ । ঐ, পৃ. ৩১০। ২৬. রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী (সম্পা.), বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ: প্রাসঙ্গিক দলিলপত্র (ঢাকা: জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ১৯৯৮), পৃ. ১৪১। ২৬ “১৯৫২ সন ১৯৪৮ সন নয়। এবার হিন্দু কে, কমিউনিস্ট কে, কংগ্রেস এ নিয়ে কথা উঠলাে না। এবার সকল বাঙ্গালী যেন এক হয়ে দাঁড়ালাে।” কামরুদ্দীন আহমদ, পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ১৫৬-১৫৭। * M.B. Nair, Politics in Bangladesh A Study of Awami League 1949-58 (New Delhi: Northern Book Centre, 1989), p. 72.

৩১ জানুয়ারিতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়।২৬৮ ১ ফেব্রুয়ারি। আজাদ পত্রিকাতেও ৪০ জনের কথা উল্লেখ করা হয়। নবগঠিত এই কমিটি ৫াত্রদের ঘােষিত কর্মসূচিকে সমর্থনদান করে । সর্বদলীয় এই সম্মেলনে কয়েকটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। একটি প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত বিবৃতিটির নিন্দা জানিয়ে তা প্রত্যাহার করে নেয়ার দাবি জানানাে হয়। আরাে বলা হয় “পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু জনসাধারণের ভাষা বাংলাই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা আর পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের জনসাধারণ যদি উর্দুকে তাদের সাধারণ ভাষা বলে স্বীকার করেন তবে উর্দুও অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হবে।” আর একটি প্রস্তাবে অবিলম্বে জননিরাপত্তা আইন প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল রাজবন্দির মুক্তিদানের দাবি জানানাে হয়। দাবিসমূহ বাস্ত বায়নের জন্য কতিপয় কর্মসূচি নির্ধরিত হয়। এগুলাে ছিল ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে ছাত্রধর্মঘট, সভা ও শােভাযাত্রা, ২১ ফেব্রুয়ারি সমগ্র পূর্ব বাংলায় সাধারণ। হরতাল, সভা ও বিক্ষোভ মিছিল। ৩৯ ভাষা আন্দোলন পরিচালনার জন্য গঠিত উভয় কমিটির আহ্বানে ঢাকায় ১১ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি পতাকা দিবস ও অর্থ সংগ্রহ দিবসে অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া যায়। অনেক মহিলা স্বর্ণালংকার দিয়েও ভাষা আন্দোলনে উৎসাহ প্রদান করেন।

২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের বাজেট অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা ছিল । অধিবেশনে প্রাদেশিক পরিষদ কেন্দ্রের নিকট যাতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য প্রস্তাব পাঠায়, সে বিষয়ে চাপ দেয়ার জন্য ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী সাধারণ হরতাল আহ্বান করা হয়। আহূত কর্মসূচি ভণ্ডুল করার লক্ষ্যে সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি অকস্মাৎ ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। আন্দোলনরত ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা সরকারের এই ঘােষণা চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে । ছাত্রনেতাদের কেউ কেউ বিভিন্ন দমননীতি ও চক্রান্তের কথা উল্লেখ করে বলেন, সরকারের এই ঘােষণাকে এখনই মােকাবিলা না করতে পারলে কোনদিন আর মাথা তুলে দাঁড়ানাে যাবে না। কিন্তু কিভাবে তা বাস্তবায়ন করা যায় তা নিয়ে কমিটি দুটো এক প্রকার সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ে । ছাত্রনেতারা ২০-২১ তারিখের সারারাতই প্রায় এ বিষয়ে বিক্ষিপ্ত আলাপ-আলােচনা করেন। পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সাধারণ ছাত্রসভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার পক্ষে এক প্রকার উত্তেজনা সৃষ্টি হয় । ১০ জন ১০ জন করে ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় নেমে আসে, অনতিবিলম্বে যা উত্তাল জনসমুদ্রে পরিণত হয় ।

২৬৮ বশীর আল হেলাল, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩২৩-৩২৪।

ঐ, পৃ. ৩২৪। ঐ, পৃ. ৩৪৬।

৮৫

বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে রফিক উদ্দিন আহমদ (ছাত্র) ও আবদুল জব্বার (দর্জি) নামক দুজন ঘটনাস্থলেই শহীদ হন, গুলিবিদ্ধ হন অনেকে আহতদের মধ্যে আবুল বরকত (ছাত্র) হাসপাতালে গিয়ে শহীদ হন।২৭১‘ ছাত্রদের ওপর এ ধরনের হামলা চালানাের প্রতিবাদে সাধারণ মানুষও তাদের সঙ্গে যােগ দেয়। অন্যদিকে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন পুলিশি দমনের পক্ষে বক্তৃতা করেন। এর প্রতিবাদ করেন খােদ সরকার দলীয় সদস্য আবুল কালাম শামসুদ্দীন (১৮৯৭-১৯৭৮) ও মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ (১৯০০১৯৮৬)। সরকারের পক্ষ থেকে মৃতদেহ সরিয়ে ফেলার কারণে ২২ ফেব্রুয়ারি গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এতে হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত হলে একটি সংক্ষিপ্ত সভায় যুবলীগের সম্পাদক মহম্মদ এমাদুল্লাহ বলেন যে, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। অতঃপর মিছিল বের হলে সর্বস্তরের অগণিত নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ শহরের বিভিন্ন স্থান হতে খণ্ড খণ্ড মিছিলসহযােগে একত্রিত হয়। ২২ তারিখে ধর্মঘট ডাকা না হলেও উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে আন্দোলন আপনাআপনি ধর্মঘট অপেক্ষা কঠোর রূপ ধারণ করে। ঢাকার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অচল হয়ে যায়। হাইকোর্টের নিকট বিক্ষোভ মিছিলের ওপর পুলিশ গুলি চালালে শফিউর রহমান নামক হাইকোর্টের একজন পিয়ন নিহত হন। ক্রুদ্ধ জনগণ ঐদিন সরকার সমর্থিত মনিং নিউজ ও আজাদ পত্রিকার অফিস পুড়িয়ে দেয়। অহিউল্লাহ নামক ৮/৯ বছরের একজন বালকও পুলিশের গুলিতে শহীদ হন।২৭৮ ২১ তারিখেই গুলিবিদ্ধ হন আবদুস সালাম নামক ইডেন বিল্ডিংয়ের একজন পিয়ন । তিনি অবশ্য মারা যান ১৯৫২ সালের ৭ | এপ্রিল।২৭৫ | ২৩, ২৪ ও ২৫ ফেব্রুয়ারিও হরতাল পালিত হয়। শহরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে ইতােমধ্যে সরকার সামরিক বাহিনী মােতায়েন করে। এ পর্যায়ে আন্দোলন জেলা শহরগুলােতেও ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে সরকার আন্দোলনের চাপে পড়ে অনির্দিষ্টকালের জন্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ

২৭১. ঐ, পৃ. ৩৬৭। ২. মযহারুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৮), পৃ. ১৩৩। ২৭৩ রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৩। ২৭ ড. মাে. মাহবুবর রহমান, বাংলাদেশের ইতিহাস ১৮৪৭-১৯৭১ (ঢাকা: সময়। প্রকাশন, ১৯৯৯), পৃ. ৯৮। ভাষা আন্দোলনের শহীদের পরিচয় জানার জন্য দেখুন অত্র গ্রন্থের পৃ. ৯৭-৯৮ । | ২৭ বশীর আল হেলাল, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৩৭।

গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়।২৭৬ আন্দোলনের চাপের মুখে সরকার ২২ তারিখেই প্রাদেশিক পরিষদে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার। প্রস্তাব গ্রহণ করে গণপরিষদে তা পাঠানাের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। আজাদ। সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে মুসলিম লীগ। পার্লামেন্টারি পার্টি থেকে পদত্যাগ করেন। এভাবে ছাত্র জনতার সম্মিলিত সর্বাত্মক অভ্যুত্থানের ফলে ভাষা আন্দোলন নৈতিক বিজয় লাভের মাধ্যমে একটি। নবচেতনার জন্ম দেয় যা বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি রচনায় সহায়ক হয়।

সূচনাপর্ব হতে ভাষা আন্দোলনের প্রতিটি স্তরে তাজউদ্দীন আহমদ সক্রিয়। অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু ২০ বা ২১ তারিখের ঘটনাবলির সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত হতে। পারেননি। এর কারণ হচ্ছে তিনি যুবলীগে যােগদানের সময় থেকে পুলিশি গ্রেফতারি এড়ানাের জন্যে শ্রীপুরের একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সঙ্গে জড়িত। হন। একই উদ্দেশ্যে তিনি গাজিউল হককেও ঐ বিদ্যালয়ে নিয়ে যান । দিনে স্কুল। করে বিকেলের দিকে ঢাকায় ফিরে রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতেন। ১৯৫১-১৯৫৩ সাল পর্যন্ত তিনি এভাবে আসা-যাওয়া করতেন ঢাকা ও শ্রীপুরের। মধ্যে। দুর্নীতিজনিত কারণে প্রধান শিক্ষক অপসারিত হওয়ার পর তাজউদ্দীন আহমদ কিছুদিন শ্রীপুর হাই স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বও পালন। করেন। ২০ ফেব্রুয়ারি তিনি স্কুল থেকে বাড়ি যান এবং সেখান থেকে ২১ তারিখ। দুপুরে ঢাকায় ফিরে আসেন। ঢাকায় ফেরার পর বিকেল থেকে তাজউদ্দীন। আহমদ ঘটনাবলির সঙ্গে জড়িত হন। তখন অবশ্য কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব অকার্যকর হয়ে যায় এবং অনেকটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে একের পর এক ঘটনা ঘটে চলে; যাকে । জনবিক্ষোভ বলা যেতে পারে । তিনি ঢাকায় ফিরে বিভিন্ন জনের সঙ্গে যােগাযােগ অথবা খোজ-খবর সংগ্রহ করাসহ, আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। মােহাম্মদ তােয়াহার তিন তলাবিশিষ্ট বাসার যে অংশে যুবলীগের অফিস ছিল। সেখানে তাজউদ্দীন আহমদ থাকতেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ২২ ও ২৩ তারিখে। ভাের রাতে পুলিশ যুবলীগ অফিস ঘেরাও করে এবং আপত্তিকর কাগজপত্র খুঁজতে। থাকে। তাজউদ্দীন আহমদ ২ দিনই পালিয়ে গ্রেফতার এড়াতে সক্ষম হন। ২৫ ফেব্রুয়ারি বিকেলে মেডিকেল কলেজ হােস্টেলে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম। কমিটি এবং কামরুদ্দীন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখের নেতৃত্বাধীন সিভিল

২৭৬ রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৪। ২৭৭ ঐ, পৃ. ১৪৩।

সিমিন হােসেন রিমি ও দলিলউদ্দীনের রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০০০। ২৭ ডায়েরী, ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২।

লিবারটিস কো-অর্ডিনেশন কমিটির একটি যৌথ বৈঠক হয়। বৈঠকে সভাপতিত্বে করেন আতাউর রহমান খান। উপস্থিত অন্যান্য ব্যক্তিরা ছিলেন, তাজউদ্দীন আহমদ, কামরুদ্দীন আহমদ, শামসুল হক, মােশতাক আহমদ, এম.এ.রহিম, এম,এম, হক, কে.এস.হাই, শামসুদ্দীন আহমদ এম.এল.এ ও অন্যান্যরা।২৮০ এতে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।২৮১ তাজউদ্দীন আহমদ ঐ দিন। সার্বিক বিষয় সংক্ষেপে তার ডায়েরিতে লিখে রাখেন।২৮২

এরপর ব্যাপকভাবে নেতাকর্মীদের ধরপাকড় শুরু হয়। প্রায় সকলে আত্মগােপন করেন। ৭ মার্চ শান্তিনগরের একটি বাসাতে বৈঠকরত অবস্থায় নেতাদের পুলিশ গ্রেফতার করে। নেতৃবৃন্দ গ্রেফতার হয়ে যাওয়ার পর কমিটি পুনর্গঠনের প্রয়ােজনীয়তা পরিলক্ষিত হয়। এ জন্য ১৪ মার্চ একটি বৈঠকে আলােচনার পর আতাউর রহমান খানকে আহবায়ক নির্বাচন করে একটি কমিটি পুনর্গঠিত হয়।২৮৩ ১৯৫৩ সাল হতে ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা শুরু হয় । ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথম রাষ্ট্রভাষা দিবসের জন্য ব্যাপক কর্মসূচির কথা। জানা যায় । ২১ ফেব্রুয়ারির প্রথম বার্ষিকীতে ফজলুল হক হলে ছাত্র স্বেচ্ছাসেবকদের এক বৈঠকে সর্বাত্মক কর্মসূচি পালনের লক্ষ্যে রেল ধর্মঘট করানাের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় । ঐ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্যে ২০ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে তিনটায় তাজউদ্দীন আহমদ ও গাজিউল হক ঢাকার রেল ওয়ার্কশপে পিকেটিং করার জন্যে চলে যান। পরবর্তী বছরগুলােতে সরকারের দিক থেকে ভাষার ব্যাপরে মারাত্মক রকমের বাড়াবাড়ি না করায় ভাষা আন্দোলনের বিষয়টি শহীদদের স্মরণ ও অনুপ্রাণিত হওয়ার বিষয়ে পরিণত হয় ।

১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হয় ১৯৫২ সালে ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি ব্যাপক রক্তপাত ও আত্মদানের মাধ্যমে চূড়ান্ত স্তরে উন্নীত হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সরকারকে ইতঃপূর্বে এতবড় বিদ্রোহের সম্মুখীন হতে হয়নি। গণঅভ্যুত্থান দমনের ক্ষেত্রে সরকার সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। মূলত ২১ তারিখ থেকে পরবর্তী সপ্তাহকালব্যাপী ঢাকাতে কোনাে সরকার ছিল না বলে স্বয়ং নুরুল আমিন স্বীকার করেন। তাজউদ্দীন আহমদ পরবর্তীকালে ১৯৭২ সালে

——–

২৮০ বদরুদ্দীন উমর, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪০৫। ২৮. ঐ, পৃ. ৪০৫। ২৮২, ডায়েরী, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২। ২৩. বদরুদ্দীন উমর, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৫৬।

ঐ, পৃ. ৫৮২। বদরুদ্দীন উমর, ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ কতিপয় দলিল, প্রথম খণ্ড, পৃ. ১৪২ ।

২৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে প্রদত্ত একটি সাক্ষাঙ্কারে মন্তব্য করেন যে, ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন বছরের পর বছর ধরে পাকিস্তানি চক্রের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম করতে বাঙালিকে উদ্বুদ্ধ করেছে যার পরিণতিতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ত্বরান্বিত হয়।২৮৬ প্রসঙ্গত ভাষা আন্দোলনকে অন্তত চারটি স্তরে ভাগ করা যায় বলে কোনাে কোনাে গবেষক উল্লেখ করেছেন। প্রথমটি ছিল ১৯৪৮ পূর্ব লেখক-বুদ্ধিজীবীদের নেতৃত্বে সংঘটিত তত্ত্বগত স্তর, দ্বিতীয় ও তৃতীয়টি ছিল যথাক্রমে ৪৮ ও ৫২-এর ভাষা আন্দোলন। ৫২ পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে যে সব চক্রান্ত করা হয়েছিল তার বিরুদ্ধে চতুর্থ স্তরের ভাষা আন্দোলন পরিচালিত হয়। এই পর্যায়ে আন্দোলনটি সুস্পষ্টভাবে বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষের মাধ্যমে রাজনৈতিক চরিত্র ধারন করে।২৮৭ এর মধ্য দিয়ে একটা উদার, ধর্মনিরপেক্ষ, জীবনধর্মী, মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ত্বরান্বিত হয়। বস্তুত ভাষা আন্দোলন ছিল ধর্মীয় সংস্কৃতিনির্ভর সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের ধারণার বিরুদ্ধে দেশজ সংস্কৃতির উদ্বোধন ও প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, সর্বোপরি প্রগতিশীলতায় ঋদ্ধ। এর পুরােভাগে ছিল ছাত্রসমাজ যার সর্বাপেক্ষা বেশি অংশ ছিল প্রগতিশীল ভাবধারায় বিকশিত। আরাে বলা হয়, ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা ভাষার পক্ষে যে জোরালাে বক্তব্য দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন, সে মূহূর্তে তিনি শুধু ভবিষ্যতের বাঙালি জাতীয়তাবাদের পূর্বাভাসই দেননি, সে সময় তার মতাে আর কেউ বাঙালির ভবিষ্যৎও দেখতে পাননি। বস্তুত ভাষা আন্দোলনের পর পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে উদার ও

——–

২৮৬ দৈনিক পূর্বদেশ, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২। ** ডক্টর আবুল কাশেম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, উন্মেষ (বার্ষিক সংকলন ২০০০-২০০১, বাংলাদেশ মুক্তিযােদ্ধা সংসদ, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রাতিষ্ঠানিক কমান্ড), পৃ. ৩২-৩৩। ২৮৮ সফর আলী আকন্দ (সম্পা.), বাঙালীর আত্মপরিচয় (রাজশাহী: ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৯১), পৃ. ১৯০। ২৮* একটি হিসেবে দেখা যায় ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের ২৮.৫৮% ছিল ছাত্র ফেডারেশনের সদস্য। এক্ষেত্রে যুবলীগের ২৯.০৩%। এখানে উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, ছাত্র ফেডারেশনের অনেক নেতা-কর্মীই যুবলীগে অন্তর্লীন ছিল। মুসলিম, ছাত্রলীগের অবস্থান ছিল তৃতীয়, ১৮.২৮%। আবুল কাশেম, বাংলাদেশের ছাত্র ইউনিয়ন। প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক পটভূমি একটি পর্যালােচনা Rajshahi University Studies Official Journal of the University of Rajshahi, Part-A, Arts and Law, Vol. 23-24, 1997, p. 17. ** ডক্টর আবুল কাশেম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৪।

প্রগতিশীল ভাবাদর্শিক বাতাবরণ সৃষ্টি হয় যা ষাটের দশকে গ্রহণ বর্জনের মাধমে বিকশিত হয়ে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মূল ভাবাদর্শে পরিণত হয় ।

ভাষা আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সােপানস্বরূপ। এরই মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলার মানুষ প্রথম উপলব্ধি করে যে, পশ্চিম পাকিস্তান আর পূর্ব বাংলার স্বার্থ এক নয়। পূর্ব বাংলার সকল ধর্ম, পেশা ও সম্প্রদায়ের মানুষ এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে অনেকটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে। চালিকা শক্তি হিসেবে অবশ্য ছাত্র সমাজের ভূমিকা ছিল অন্যতম। যে সকল ছাত্রনেতা বাঙালির এই আন্দোলন সংগঠিত করতে অবদান রাখেন তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। তার সমসাময়িক রাজনৈতিক ব্যক্তিরাই পরবর্তীকালে সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এবং পরিশেষে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। | ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের পর যেসব আন্দোলন ও সংগঠনের উৎপত্তি হয় যার ভিত্তিতে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন সর্বাত্মক ও জাতীয়তাবাদী চরিত্র ধারণ করে সেগুলাে সম্পর্কে এখানে সংক্ষেপে আলােচনা করা আবশ্যক।

টাঙ্গাইল উপনির্বাচন

প্রাথমিক পর্যায়ের ভাষা আন্দোলনের উত্তপ্ত পরিস্থিতির অল্প পরে সরকার ১৯৪৯ সালের ২৬ এপ্রিল দক্ষিণ টাঙ্গাইল উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখ ঘােষণা করে। ১৯৪৬ সালে আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (১৮৮০-১৯৭৬) দক্ষিণ টাঙ্গাইল নির্বাচনে করটিয়ার জমিদার ও অন্য দুজন প্রার্থীকে পরাজিত করে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচনী ক্রটির অভিযােগে সরকারের এক আদেশে ফলাফল বাতিল এবং ১৯৫০ সাল পর্যন্ত বিজয়ী মওলানা ভাসানী ও পরাজিত খুররম খান পন্নীসহ অপর দুজন প্রার্থীর নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার যােগ্যতা বাতিল করা হয় । এমতাবস্থায় ১৫০ নং চক মােগলটুলি পার্টি অফিসের কর্মীরা নিজেদের মধ্যে নানা প্রকার মতাদর্শিক পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও উদীয়মান তরুণ নেতা শামসুল হককে প্রার্থী মনােনয়ন দিয়ে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রতিযােগিতার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অন্যদিকে মুসলিম লীগ সরকার পূর্ব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে খুররম খান পন্নীকে পুনরায় তাদের প্রার্থী মনােনয়ন দেয়। তাকে বিজয়ী করে আনার জন্য সরকার নানা চক্রান্তও শুরু করে। এটা ছিল উভয়পক্ষের জন্যে চ্যালেঞ্জ বিশেষ । অবশ্য এক অর্থে এটা ছিল একটি অসম নির্বাচনী যুদ্ধ । কারণ খুররম খান পন্নী ছিলেন ঐ অঞ্চলেরই একজন জমিদার । তদুপরি স্বয়ং পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনসহ

——-

২৯১ বদরুদ্দীন উমর, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮০।

৯০

বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রী সরকারি সাহায্য ও অর্থ নিয়ে খুররম খান পন্নীর সমর্থনে প্রচারণায় নামেন। অন্যদিকে শামসুল হক পন্নী পরিবারের একজন সাধারণ প্রজার সন্তান মাত্র। তার পক্ষে সম্বল প্রায় কপর্দকহীন মােগলটুলির কর্মী বাহিনী। টাঙ্গাইল উপনির্বাচনেও কামরুদ্দীন আহমদ প্রধান সমম্বয়কের ভূমিকা পালন করেন। এ বিষয়ে তিনি লিখেছেন:২৯৩

টাকার জন্য আলমাছ ৮০০ টাকা ও আমি কয়েকজনের নিকট থেকে ৫০০ টাকা। নিয়ে টাঙ্গাইলে পেীছি । এছাড়া নির্বাচনী ক্যাম্পের জন্যে শামসুল হকের বাড়ি থেকে কয়েক মণ চাল দিয়ে গিয়েছিলাে তার ছােট ভাই নুরুল হক। সর্বজনাব আলমাছ। আলী, আওয়াল, শামসুজ্জোহা, খন্দকার মােশতাক আহমদ, তাজুদ্দীন আহমদ, শওকত আলী, হযরত আলী শিকদার ও আজিজ আহমেদ সবাই নির্বাচনে দিনরাত

খেয়ে দেয়ে খেটেছেন। খােদাবক্স মােক্তার সাহেব সবার দেখাশােনা করতেন। আমার একটা ভরসা ছিল বাবু রণদাপ্রসাদের সাহায্য । কিন্তু হামিদুল হক চৌধুরী পূর্ব থেকেই তার বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। তাছাড়া মুসলিম লীগ সে বাড়িতে ক্যাম্প করে বসে আছে। সুতরাং সেদিক থেকে যে সাহায্যটা আমি আদায় করতে পারতাম তা হল না। নুরুল আমীন সাহেব নিজে নির্বাচনী অভিযানের ভার

নিয়েছিলেন। শামসুল হক নিজে এই নির্বাচনে প্রচণ্ড পরিশ্রম করেছিলেন। অন্যদিকে নুরুল আমিন ভােটে মুসলিম লীগের প্রার্থীকে জেতানাের জন্যে গাড়ি ভর্তি করে খাদ্যশস্য নিয়ে যান। অথচ দুর্ভিক্ষের সময়ও ঐ এলাকার মানুষ বহুদিন সরকারের পক্ষ থেকে কোনাে সাহায্য পায়নি। ফলে মানুষের ধারণা হয়। সরকারের চাল থাকা সত্ত্বেও তা সরবরাহ না করে তাদেরকে না খাইয়ে মারা হয়েছে। ফলে তাদের মতামত সরকারের বিপক্ষে চলে যায়। এছাড়াও খুররম খান পন্নীর নৈতিক পদস্খলন সম্পর্কে প্রচার করে পন্নীর স্ত্রী শামসুল হকের পক্ষে মূল্যবান সহযােগিতা দেন।

সরকারের গণবিরােধী চরিত্র ও মােগলটুলি পার্টি অফিসের উল্লিখিত কর্মীসংগঠকদের৯৫ অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে শামসুল হক ঐ নির্বাচনে বিপুল ভােট ব্যবধানে বিজয়ী হন। এর মাধ্যমে মুসলিম লীগ থেকে বের হয়ে আসা নেতাকর্মীরা সরকার সমর্থক মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে একটি অর্থপূর্ণ বিজয় লাভ

—————-

২৯২, কামরুদ্দীন আহমদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২৯। ২৯৩, ঐ, ১২৯। ২৯৫, ঐ, পৃ. ১৩০। ২৯৫ “শামসুল হক Independent Candidate হলেও মুজিবুর রহমান, কামরুদ্দীন আহমদ, তাজউদ্দিন প্রভৃতি বেশ কিছুসংখ্যক ভালাে কর্মীর সমর্থন তার ছিল ।” বদরুদ্দীন উমর, ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ কতিপয় দলিল, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ২৮৪ ।

করেন। পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে জমিদার, সামন্ত প্রভুদের কর্তৃত্ব যে ক্রমশ লােপ পাচ্ছে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে । রক্ষণশীল সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকা ৬ মে ১৯৪৯ তারিখে এ বিষয়ে টাঙ্গাইল উপনির্বাচন’ নামক একটি নিবন্ধে নিলিখিত মন্তব্য প্রকাশ করে: ২৯৬

টাঙ্গাইলের সবচেয়ে জাঁদরেল প্রভাবশালী জমিদারকে, যার পূর্ব পুরুষ কলেজ ও অন্যান্য মহান প্রতিষ্ঠান করেছেন- তাদের সামান্য একজন নিঃস্ব কর্মী। পরাজিত করেছেন। সুতরাং জমিদারী বা তালুকদারী শাসন যে চলবে না তা বলাই বাহুল্য। আজাদ (দৈনিক পত্রিকা বলেছে যে, নির্বাচন সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেছে। আমরা বলি- এ নির্বাচন সভাপতিসহ লীগ নেতাদের প্রতি দৃঢ় অনাস্থা জানিয়েছে। আরও জানিয়েছে বিনা খেসারতে জমিদারী প্রথা

উচ্ছেদই জনগণ চায়। টাঙ্গাইল উপনির্বাচন লােকের চোখ খুলে দিয়েছে ।। | সৈনিক পত্রিকার এ মন্তব্য ছিল যথার্থ । কেননা বাংলার ভূমির অধিকারহীন কৃষকরা দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে আসছিল। পাকিস্ত নের জন্মের পর পরিস্থিতি আরও পরিবর্তিত হয় । তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যরা এ ব্যাপারে ‘আশুদাবি কর্মসূচি আদর্শতে দিক নির্দেশনাও দেন। রাজনৈতিক দল হিসেবে মুসলিম লীগের মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দেয় এই উপনির্বাচন। অন্যদিকে সরকার গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও জনগণের অধিকারের প্রতি কতটা বিরূপ ও অসহিষ্ণু ছিল তার প্রমাণ মেলে শামসুল হকের বিজয়কে বানচাল করে দেয়ার মাধ্যমে। বিষয়টি ছিল এমন: ১৯৪৯ সালে মওলানা ভাসানী মার্চ মাসে তার মুরিদানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ভারতের আসামে গমন করেন। কিন্তু আসাম সরকার তাকে বন্দি করে ধুবড়ি কারাগারে পাঠিয়ে দেয় । শামসুল হকের নির্বাচনী কর্মী হযরত আলী মওলানার স্বাক্ষরিত একটি প্রচারপত্র সংগ্রহ করেন যাতে শামসুল হকের পক্ষে ভােট দেয়ার আহ্বান জানানাে হয়েছিল । এটির ক্রটি ছিল রীতি অনুযায়ী প্রচারপত্রটিতে কারা কর্তৃপক্ষের কোনাে অনুমতিজ্ঞাপক সীলমােহর ছিল না। এই আবেদনের কিছু কপি প্রতিপক্ষের হাতে গিয়ে পৌঁছে। এরই ভিত্তিতে কর্তৃপক্ষ অভিযােগ আনয়ন করে যে, শামসুল হকের পক্ষে ভােট আদায়ের জন্য মওলানা ভাসানীর স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে । অতএব তা অবৈধ পন্থায় করে নির্বাচনকে প্রভাবিত করা হয়েছে।” তিন সদস্যবিশিষ্ট বিশেষ ট্রাইব্যুনাল তাদের প্রথম বৈঠকেই নির্বাচনী ফলাফল স্থগিত করে এবং মামলাটির নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত শামসুল হকের ব্যবস্থাপক সভার

————

২৯৬ বদরুদ্দীন উমর, পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, প্রথম খণ্ড, পৃ. ১৮৬। ২৯৭ ঐ, পৃ. ১৮৭।

আসন গ্রহণ নিষিদ্ধ করে দেয়। পরে ১৯৫০ সালে নির্বাচনী ফল বাতিল করে দেয়া

টাঙ্গাইল উপনির্বাচন ছিল মুসলিম লীগ সরকারের নিকট একটি টেস্ট কেস। এই নির্বাচনে মুসলিম লীগের পরাজয়ের মাধ্যমে তারা তাদের অবস্থান বুঝে নেয় । এরই প্রেক্ষিতে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত ৩৪টি আসন শূন্য হলেও মুসলিম লীগ সরকার। আইন লংঘন করে এই সকল আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠান থেকে বিরত থাকে। অন্যদিকে সচেতন সাধারণ মানুষের নিকটও বিষয়টি স্পষ্ট হয় এবং তারা অল্প পরিমাণে হলেও বুঝতে সক্ষম হয় যে, মুসলিম লীগ ও তার সরকার যেমন গণতন্ত্রবিরােধী তেমনি পূর্ব বাংলার মানুষের অধিকারের প্রতি বিদ্বিষ্ট। তাদের ধারণা হয়, পাকিস্তান রাষ্ট্রটি প্রকৃতপক্ষে তাদের কোনাে আশা-আকাক্ষারই। সহায়ক নয় । স্বায়ত্তশাসন, সুশাসন, নাগরিক অধিকার, মৌলিক অধিকার, ন্যায্য বণ্টন ব্যবস্থা, গণতান্ত্রিক মূল্যবােধ এসব আদর্শিক বিষয়ে মুসলিম লীগ সরকারের কোনাে মাথা ব্যথা নেই। কাজেই বাঙালিদের উপলব্ধি জন্মে যে, এসব বিষয় তাদেরকে আন্দোলনের মাধ্যমে আদায় করে নিতে হবে। এ জন্য প্রয়ােজন। নিজেদের সংগঠন।

গণতান্ত্রিক যুবলীগ ও আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা এবং তাজউদ্দীন আহমদ

বস্তুত পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের সময় হতে বঙ্গীয় মুসলিম লীগ রাজনীতিতে যে মেরুকরণ শুরু হয় তাতে দলটির অপেক্ষাকৃত উদারপন্থীরা ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়ে। মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হয়ে প্রথমেই বিরােধী শক্তিকে দমন করতে সচেষ্ট হন। এক্ষেত্রে মুসলিম লীগের পুনর্গঠনের প্রকৃতি সম্পর্কে বলা হয় যে, কেবল তারাই দলটির সদস্য হতে পারবে যারা। সরকার এবং এর রাজনীতি ও কর্মসূচিকে দ্বিধাহীন সমর্থন দেবে। অবিভক্ত বঙ্গীয় মুসলিম লীগে আকরম খাঁ-খাজা নাজিমুদ্দীন গ্রুপের সঙ্গে সােহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম ও অন্যদের যে দ্বন্দ্ব ছিল তার জের ধরে উপরিউক্ত প্রেক্ষাপটে শেষােক্তদেরকে দলের সকল কাজ-কর্ম হতে দূরে সরিয়ে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়। এমনকি বিরােধীদেরকে ১৯৪৮-১৯৪৯ সময়কালে দলের সদস্যপদেও

————-

২৯৮ অলি আহাদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭০। ২৯৯ M.B. Nair, op.cit. Pp. 52-53.

স্থান দেয়া হয়নি। যাদের প্রচেষ্টা ছাড়া পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হতে পারতাে না তাদেরকে এভাবে দমিয়ে দেয়ার চেষ্টা স্বভাবতই পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক আবহাওয়াকে তপ্ত করে তােলে। এর প্রেক্ষিতে তারা বিকল্প ধারায় সংগঠিত হতে সচেষ্ট হন। এ বিষয়ে ১৯৪৭-১৯৪৯ সনের মধ্যে বিরােধীরা মােগলটুলি পার্টি অফিস, কামরুদ্দীন আহমদের জিন্দাবাহার লেনের বাসা এবং নারায়ণগঞ্জের ওসমান আলী চৌধুরীর বাড়িতে বহুবার মিলিত হন। প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও বাঙালিবিরােধী মনােভাব এবং বিহারী পাঞ্জাবি অফিসারদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া বাঙালি অফিসারদের শংকিত করে। সরকারের নানা অব্যবস্থাপনা ও গণবিরােধী নীতি সচেতন সাধারণ মানুষকেও রুষ্ট করে তােলে। এ সময় এতদঞ্চলের আর্থিক শৃঙ্খলাও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং অবাঙালি ব্যবসায়ী দ্বারা বাঙালি ব্যবসায়ীদের স্বার্থ ক্ষুন্ন হওয়ার আশংকা দেখা দেয়। পূর্ব বাংলায় যখন এ ধরনের সরকারবিরােধী মনােভাব সৃষ্টি হয় এবং গণভিত্তিসম্পন্ন বিকল্প রাজনৈতিক দল গড়ে তােলার প্রস্তুতি চলতে থাকে তখন অকস্মাৎ মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যুজনিত কারণে কেন্দ্রের নেতৃত্ব শৈথিল্য এই কাজকে সহজ করে দেয়। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম পাকিস্তানের রাজনীতিতে নয়া মেরুকরণের সূত্রপাত ঘটায় । মত ও পথের ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও মােগলটুলি পার্টি অফিসের নেতা-কর্মীরা সম্মিলিতভাবে একটি বিকল্প ধারার রাজনীতি গড়ে তােলার কাজে আত্মনিয়ােগ করেন। এরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্মের মাধ্যমে। ১৯৪৯ সনের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হলেও এই উদ্দেশ্যে কাজ শুরু হয় পাকিস্তানের জন্মের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই । এর প্রাথমিক উদ্যোগের সঙ্গেও তাজউদ্দীন আহমদ সম্পৃক্ত হন।

উদ্যোগের সূচনাতে শামসুল হক মুসলিম লীগের রক্ষণশীল ও উদারপন্থী গ্রুপের মধ্যে সমঝােতার জন্য একটি সম্মেলন ডাকার প্রস্তাব দেন। অন্যদের সঙ্গে এ বিষয়ে কোনাে আলােচনা না করে তার হঠাৎ এ ধরনের প্রস্তাবে তাজউদ্দীন আহমদ, কামরুদ্দীন আহমদ ও অন্যান্যরা যারা একত্রে কাজ করতেন তারা। শামসুল হকের প্রতি সন্দেহ পােষণ করেন । প্রস্তাবটি সময়ােপযােগী হলেও তাদের ধারণা জন্মে তিনি বস্তুত নেতৃত্ব কজা করার জন্যই এই উদ্যোগ গ্রহণ। করেছেন। দেশ বিভাগের প্রাক্কালে তিনি আবুল হাশিমের সঙ্গে বেশ কিছুদিন

———–

৩০০° Ibid., p. 52. ৩০১. Ibid., pp. 54-55.

Shyamali Ghosh, The Awami League 1949-1971 (Dhaka: Academic Publishers, 1990), pp. 4-5. ৩০৩ ডায়েরী, ২২ জুলাই, ১৯৪৭।

বর্ধমানে থেকে যাওয়ার কারণে ঢাকার বিপদগ্রস্ত নেতা কর্মীদের সঙ্গে তার কোনাে যােগাযােগ ছিল না। এ সম্পর্কে তাজউদ্দীন আহমদ লিখেন:৩০৪

শামসুল হক সাহেবের গতিবিধি দেখে আমি সত্যিই আশ্চর্য হলাম । কতদিন ধরে আমরা প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়ছি। আমাদের অবস্থান যখন নাজুক, তখন তাকে দেখা যায়নি। এখন আমরা যখন পরিস্থিতি সামাল দিয়ে ফেলেছি তখন তিনি এলেন এবং আমাদের সঙ্গে আলাপের তােয়াক্কা না করে তিনি। সমঝােতার জন্যে সভা ডাকলেন। আমার কাছে মনে হলাে, তিনি।

ক্ষমতালােভী এবং যে কোনভাবে তিনি প্রধান হতে চান। আলােচনান্তে কর্মী সম্মেলনের তারিখ নির্ধারিত হয় ২৪ আগস্ট, ১৯৪৭।৩০৫ কর্মী সম্মেলনের প্রস্তুতি এবং নতুনভাবে সংগঠিত হওয়ার ব্যাপারে একটি রূপরেখা প্রণয়নের জন্য উদ্যোক্তারা একটি আলােচনায় মিলিত হন। তাজউদ্দীন আহমদ এতে সক্রিয় ও সৃজনশীল ভূমিকা পালন করেন। এ সম্পর্কে তার ডায়েরি থেকেও জানা যায়:৩০৬

বেলা দেড়টায় মেনিফেস্টো তৈরি সংক্রান্ত সভায় যােগ দিলাম। সভায় এসে দেখলাম এস,এ আশরাফ, নাজমুল করিম, তােয়াহা, তাসাদুক, আজিজ আহমেদ, অলি আহাদ, বাহাউদ্দিন উপস্থিত । মেনিফেস্টো গ্রহণ ও মুসলিম লীগের ভেতরের একটি পার্টির নামে প্রকাশ করার ব্যাপারে দু’একটা ছােট খাটো পরামর্শ ছাড়া তেমন

গুরুত্বপূর্ণ মতামত কেউ দিলেন না । এ পর্যায়ে পার্টির নামকরণের বিষয়ে পারস্পরিক প্রাথমিক আলােচনা হয়। এ বিষয়ে তাজউদ্দীন আহমদ ডায়েরিতে লিখেন:৩০৭

তােয়াহা সাহেব, নুরুল ইসলাম চৌধুরী ও অন্যান্যরা পরামর্শ দিলেন আমাদের দলের নাম হােক ‘পাকিস্তান পিপলস ফ্রিডম লীগ’ । আমরা করলাম- ‘ইস্ট

পাকিস্তান ইকোনােমিক ফ্রিডম লীগ’ ।। কিন্তু দলের নামকরণ ও অন্যান্য বিষয়ে তখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হয় নি। | অন্যদিকে নানা কারণে সম্মেলন ২৩ ও ২৪ আগস্টের পরিবর্তে ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় । তাজউদ্দীন আহমদ কর্মী সম্মেলনকে

————-

৩০৪. ঐ, ২২ জুলাই, ১৯৪৭। ৩০৫ ঐ, ৩১ জুলাই, ১৯৪৭। ৩০৬ ঐ, ৫ আগস্ট, ১৯৪৭। ৩০৭ ঐ, ৭ আগস্ট, ১৯৪৭,

৯৫

সফল করার জন্যে সচেষ্ট হন।৩০৮ নির্ধারিত দিনে চট্টগ্রাম ব্যতীত পূর্ব বাংলার সকল জেলা থেকে প্রায় ৫ শত প্রতিনিধি সম্মেলনে উপস্থিত হয়। অনেক বাধাবিপত্তি ও সরকারের দমননীতি উপেক্ষা করে সম্মেলনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক। যুবলীগ গঠিত হয় ১৯৪৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর । তদুক আহমদ চৌধুরীকে সভাপতি করে ২৫ সদস্যবিশিষ্ট পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠিত হয়। তাজউদ্দীন আহমদ এই সম্মেলনের যাবতীয় আয়ােজনের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও অনেকের ইচ্ছাকে উপেক্ষা করে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হননি। এটি গড়ে তােলার ক্ষেত্রে শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, কামরুদ্দীন। আহমদ, মােহাম্মদ তােয়াহা, অলি আহাদ ও অন্যরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তীকালে নানা ঘটনাপ্রবাহে এই সংগঠনটিই আওয়ামী মুসলিম লীগ। গঠনের ভিত্তিভূমি হিসেবে কাজ করে এবং ১৯৪৯ সনের ২৩ জুন তা আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ ও তার গণআজাদী লীগের কর্মীরা এতে যুক্ত হননি মূলত, সংগঠনটির সাম্প্রদায়িক নামকরণের প্রশ্নেই ।

| এতদসত্ত্বেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরবর্তীকালে যেহেতু আওয়ামী লীগ। মূল রাজনৈতিক ধারায় পরিণত হয় এবং এতদঞ্চলের মানুষের স্বায়ত্তশাসন, স্বাধিকার আন্দোলন সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদান করে তাই এখানে। সংগঠনটির উৎপত্তির ক্ষেত্রে পরবর্তী ঘটনাবলি সম্পর্কে আলােচনা আবশ্যক। | টাঙ্গাইল উপনির্বাচনের পরেই ১৯৪৯ সালের মে মাসে মওলানা ভাসানী আসামের ধুবড়ি কারাগার হতে মুক্তি পেয়ে ঢাকায় আসেন এবং জনৈক আলী আমজাদের বাসায় ওঠেন। সেখান কিছুদিন অবস্থান করে মুসলিম লীগের প্রতি ক্ষুব্ধ নেতা কর্মীদের সঙ্গে আলােচনাক্রমে তিনি একটি বিকল্প রাজনৈতিক ধারা। সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। এ ব্যাপারে তারা একটি সম্মেলন করতে সম্মত হন। এ সময় জনৈক দবিরুল ইসলামের মামলা পরিচালনার জন্যে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে ঢাকায় আনা হয়। মামলা শেষ হওয়ার পর তিনি। করাচী প্রত্যাবর্তন করতে চাইলে শওকত আলী ও অন্যরা পূর্ব বাংলায় বিকল্প ধারার রাজনীতি গড়ে তােলার জন্যে তাকে স্থায়ীভাবে ঢাকায় থেকে যাওয়ার জন্য। অনুরােধ জানান। এমতাবস্থায় সােহরাওয়ার্দী মুসলিম লীগের প্রতি বিক্ষুব্ধ ঐ সকল নেতা কর্মীকে সীমান্ত প্রদেশের মতাে আওয়ামী লীগ সংগঠন গড়ে তােলার

৩০৮ ঐ, ১৮ আগস্ট, ১৯৪৭। ৩০৯ অলি আহাদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৯। ৩১০ বদরুদ্দীন উমর, ভাষা আন্দোলন সঙ্গ কতিপয় দলিল, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ২৫৩।

পরামর্শ দেন। তারা বিষয়টি নিয়ে ভাসানীর সঙ্গে আলােচনা করেন।৩১২ কাজেই নেতা কর্মীরা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর সঙ্গে পরামর্শক্রমে মুসলিম লীগের বিকল্প শক্তি হিসেবে উদারনৈতিক একটি রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।৩১৩

কিন্তু মুসলিম লীগ সরকার কোনাে বিরােধী শক্তিকে মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল । লিয়াকত আলী খান খােলাখুলিভাবে ঘােষণা করেন যে, পাকিস্তানে কোনাে প্রতিপক্ষকে সহ্য করা হবে না। অন্যদিকে মুসলিম লীগের প্রতি। সােহরাওয়ার্দীর ক্ষোভের যথেষ্ট ব্যক্তিগত কারণ ছিল। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান রাজনৈতিক আক্রোশবশত ১৯৪৮ সালের শেষার্ধে সােহরাওয়ার্দীর গণপরিষদের পদ বাতিল করে দেন। ওদিকে ভারত সরকারও তার ব্যক্তিগত ব্যাংক একাউন্ট এবং মােটর গাড়িটি পর্যন্ত ‘সিজ’ করে নেয়। এক প্রকার কপর্দকহীন অবস্থায় হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী পাকিস্তানে পদার্পণ। করেন। সুতরাং তার দিক থেকে মুসলিম লীগের বিপক্ষে রাজনৈতিক দল গঠন করা ছাড়া কোনাে উপায় ছিল না। তার মতে ততদিনে মুসলিম লীগ একটি ফ্যাসিবাদী সংগঠনে পরিণত হয়েছিল। ইতােমধ্যেই অবশ্য নতুন দল গঠনের কাজ অনেকখানি এগিয়ে নেন ভাসানী।” তৎকালীন ঢাকার রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে পুরান ঢাকার রােজ গার্ডেনে ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন সম্মেলনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় । প্রায় ২৫০-৩০০ সদস্যের উপস্থিতিতে নির্দিষ্ট দিনেই সম্মেলন শুরু হয়। এই সম্মেলনে গণআজাদী লীগের উল্লিখিত গ্রুপটি ব্যতীত তৎকালীন পূর্ব বাংলার প্রায় সকল নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি উপস্থিত হন। এতে ছাত্র ও বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত হন। উল্লেখ্য, শেখ মুজিবুর রহমান ও হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন না।৯৮ শেখ মুজিবুর রহমান তখন কারাগারে বন্দি ছিলেন । মওলানা ভাসানীকে সভাপতি, শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক, শেখ মুজিবুর

————-

৩১২, ঐ।

৩১৩. কামরুদ্দীন আহমদ, পূর্ব বাংলার সমাজ ও রাজনীতি, পৃ. ১১৩। ৩১* ঐ, পৃ. ১১১। ৩১৫ অলি আহাদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮০। ৩১৬. কামরুদ্দীন আহমদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১২। ৩১৭ বদরুদ্দীন উমর, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫৪। ৩১৮ M.B. Nair, op.cit., pp. 58-59.

রহমানকে যুগ্ম সম্পাদক এবং ইয়ার মােহাম্মদ খানকে কোষাধ্যক্ষ করে ৪০ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়।৩১৯

সম্মেলনে শামসুল হক ‘মূল দাবি’ নামক একটি পুস্তিকা আকারে ছাপানাে বক্তব্যে কর্মসূচিবিষয়ক কতকগুলাে প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এগুলােই সম্মেলনের পর সামান্য পরিবর্তিত আকারে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের খসড়া ম্যানিফেস্টো, হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯৩৭ সাল থেকে কৃষক প্রজা পার্টি, আবুল হাশিমের মেনিফেস্টো ও গণআজাদী লীগের আশুদাবি কর্মসূচি আদর্শ ইত্যাদিতে যে সকল বিষয় উল্লিখিত হয়, ঐগুলােই কমবেশি আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম ম্যানিফেস্টোতে স্থান পায়। ৩২০ | এই সংগঠনটি ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর ১৯৫৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে দলের নাম হতে ‘মুসলিম’ শব্দটি উঠিয়ে দিয়ে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকলের প্রবেশের জন্যে পথ উন্মুক্ত করে দেয়। পরবর্তীকালে এই দলটিই বাঙালির মুক্তির আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে প্রধান নেতৃত্বদানকারী সংগঠনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তাই ভারতের ইতিহাসে যেমন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, সােভিয়েট ইউনিয়নের ইতিহাসে বলশেভিক পাটি, চীনের ইতিহাসে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি তেমনি বাংলাদেশের ইতিহাসে আওয়ামী লীগ বাঙালির জাতীয় মুক্তির আন্দোলনে প্রধান রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।

জাতীয় মহাসম্মেলনে তাজউদ্দীন আহমদের ভূমিকা

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হওয়ার পূর্বেই একই বছর মার্চ মাসে পাকিস্তানের সংবিধান রচনার উদ্দেশ্যে মূলনীতি কমিটি গঠিত হয়েছিল। ১৯৫০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর মুলনীতি কমিটি রিপাের্ট প্রকাশ করে ।৩২৯ একই সাথে ভারত স্বাধীন হয়ে ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি জাতিকে তার সংবিধান উপহার দেয়। ভারত যখন এই কাজটি সম্পন্ন করে, পাকিস্তান তখন কেবলমাত্র সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে একটি খসড়া মূলনীতি ঘােষণা করে, যা কেবল শাসনতন্ত্র রচনায় কিছু বিতর্ক ও জটিলতারই জন্ম দেয়। এতে পাকিস্ত নিকে কঠোর এককেন্দ্রিক ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয় ।

———–

৩১৯ Tbid., p. 59. ৩২° Shyamali Ghosh, op.cit., p. 4, এই দলিলের জন্য দেখুন, ড. আবুল কাশেম (সম্পা.) বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও আওয়ামী লীগঃ ঐতিহাসিক দলিল (ঢাকা: জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ২০০১), পৃ. ১৫-৩০। * ডায়েরী, ৩০ সেপ্টেম্বর, ১৯৫০।

বিভাগপূর্ব ভারতে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের রাজনীতির মধ্যে মূল পার্থক্য ছিল, মুসলিম লীগ যেখানে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি করেছিল সেখানে কংগ্রেস দাবি করেছিল ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার। কিন্তু প্রথম থেকে পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী ক্রমাগত প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ধারণা পরিত্যাগ করে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসনের দিকে ঝুঁকতে থাকেন।৩৭* ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে প্রদেশগুলাে স্বায়ত্তশাসনের যে সমস্ত সুবিধা ভােগ করে আসছিল সেগুলােকেও খর্ব করা হয় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর হতে।২৫ তারা গণপরিষদকে পাশ কাটিয়ে শাসনকার্য চালিয়ে যেতে থাকে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫০ সন পর্যন্ত সময়ের মধ্যে আইন পরিষদের মােট অধিবেশন হয় ৮ টি, যার স্থায়িত্বকাল মাত্র ৪১ দিন এবং উপস্থিতির গড় হারও ছিল হতাশাব্যঞ্জক।২৬ ফলে ১৯৫০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর যখন সংবিধানের মূলনীতি খসড়া প্রকাশিত হয় তখন সমগ্র পূর্ব বাংলায় এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এমনকি সরকারের তলপিবাহক মুসলিম লীগও এর বিরােধিতা করে। পাকিস্তানের সংবিধান রচনার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী নির্দেশিত নীতিগুলোে°২৮ পূর্ব বাংলায় বিতর্কের ঝড় তােলে। | তাজউদ্দীন আহমদ ও তার সঙ্গীরা এই আন্দোলন সংগঠিত করেন এবং জনমত গঠনের মাধ্যমে আর একটি বিকল্প খসড়া মূলনীতি প্রস্তাব প্রণয়ন করতে সক্ষম হন। তাজউদ্দীন আহমদ এই আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা কামরুদ্দীন আহমদের সান্নিধ্যে থেকে একজন সৃজনশীল সংগঠক হিসেবে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার ডায়েরি ও কামরুদ্দীন আহমদের সূত্র হতেও এ বিষয়ে জানা যায়। কামরুদ্দীন আহমদ লিখেছেন:৩২৯

পাকিস্তান অবজার্ভার-এর সম্পাদক ও সহ-সম্পাদক আবদুস সালাম এবং জহুর হুসেন চৌধুরী মূলনীতি নির্ধারণ কমিটির রিপাের্ট আলােচনা করার জন্যে মুসলিম লীগ ছাড়া বাকি সব পার্টির লােককেই নিমন্ত্রণ করেন। অবজার্ভার অফিসে

—————-

৩২২ কামরুদ্দীন আহমদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৫। ৩২. আনিসুজ্জামান, মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপর (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ২০০০), পৃ. ১৪। ৩২৮. ঐ, পৃ. ১৪। ৩২৫ কামরুদ্দীন আহমদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১১ এবং প্রফেসর সালাহউদ্দিন আহমদ ও অন্যান্য, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৭।

* ড. নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস ১৯৪৭-১৯৫৮’, প্রফেসর সালাহউদ্দিন আহমদ ও অন্যান্য, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৭। এ বিষয়ে আরাে দেখুন, উ, মাে. মাহবুবর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৬। ২৭ অলি আহাদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০০।

ড. নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৭-৪৮। * কামরুদ্দীন আহমদ, বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ১৩৩।

সবাই বসে। যাঁরা খুব উৎসাহী ছিলেন তাঁদের নাম করা যায়- সর্বজনাব তাজুদ্দীন আহমদ, অলি আহাদ, সাখাওয়াৎ হােসেন, আবদুল ওয়াদুদ, সৈয়দ মােহাম্মদ আলী, তাসাদুক আহমদ, আবদুল মতিন প্রমুখ। সভায় আমাকে কনভেনর করে একটি কমিটি করে দেয়া হয়। কমিটির নাম দেয়া হলাে-কমিটি অব এ্যাকশান ফর

ডেমােক্র্যাটিক ফেডারেশন। ১৯৫০ সালের অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে Committee of Action for Democratic Constitution গঠন করা হয়। তবে তাজউদ্দীন আহমদ রিপাের্ট পেশের পর অর্থাৎ অক্টোবর মাসের ১ তারিখ থেকেই সতীর্থ রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সঙ্গে প্রস্তাবিত মূলনীতি নিয়ে আলােচনা শুরু করেন। বিকল্প খসড়া আন্দোলনের সূচনা থেকে পরবর্তী এক মাসে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত অন্তত দশদিন এ্যাকশন কমিটির বৈঠক বসে এবং তিনি প্রায় সবগুলােতে উপস্থিত থাকেন। পরিশেষে বিরােধীদের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত মােতাবেক এ্যাকশন কমিটি একটি বিকল্প মূলনীতি খসড়া প্রস্তাব প্রণয়ন করতে সক্ষম হয় । ঐ সম্মেলনের নাম দেয়া হয় জাতীয় মহাসম্মেলন (Grand National Convention)। তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি থেকে জানা যায় উক্ত মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৫০ সালের নভেম্বর মাসের ৪ ও ৫ তারিখে।৩৩৩

| মূলনীতি কমিটির রিপাের্ট-বিরােধী আন্দোলনে মুসলিম লীগের যােগদানের কারণ, প্রস্তাবিত মুলনীতি খসড়াতে, তাদের মতে, রাষ্ট্রকে ইসলামীকরণের বিষয়ে সুস্পষ্ট ইঙ্গিতের অনুপস্থিতি।৩৩৪ অন্যদিকে উদার গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিবিশেষ এই রিপাের্টের বিরুদ্ধে ক্ষুদ্ধ হওয়ার কারণ এতে আইন পরিষদে পূর্ব বাংলার জনসংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের বিধান এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রশ্নে কোনাে নির্দেশনা ছিল না। তদুপরি প্রস্তাবিত সংবিধানকে দেখা হয়েছে অত্যন্ত সাম্প্রদায়িক ও সংকীর্ণ অর্থে।৩৫ বস্তুত পাকিস্তান আমলে আর কোনাে ইস্যুতে পরস্পর বিপরীত মেরুর দলগুলাে এত কাছাকাছি আসেনি । Action Committee প্রস্তাবিত রিপাের্ট প্রত্যাখ্যানপূর্বক প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত

————

৩৩০ ডায়েরী, ৪ অক্টোবর, ১৯৫০। ৩৩৯ ঐ, ১২ অক্টোবর, ১৯৫০। খসড়া মূলনীতি প্রস্তাব পেশের পর পূর্ব বাংলায় এর বিরুদ্ধে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তাতে তাজউদ্দীন আহমদ সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। নিমলিখিত তারিখগুলােতে তিনি এ বিষয়ে ডায়েরীতে লিখেন, ৪, ১২, ১৩, ১৮, ১৯, ২১, ২৬, ২৮ অক্টোবর এবং ১, ৪, ৫ নভেম্বর, ১৯৫০। ৩৩২, কামরুদ্দীন আহমদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৪। ৩৩. ডায়েরী, ৪ ও ৫ নভেম্বর, ১৯৫০। *. ড. মাে. মাহবুবর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫০।

৩৩৫

ঐ।

১০০

করার লক্ষ্যে একটি বিকল্প দিক নির্দেশনা দান করে। এ বিষয়ে জনমত গঠনেও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় । ৩ নভেম্বর ১৯৫০, Action Committee ইংরেজিতে “Will Jonab Liaquat Ali khan answer the following Questions?” শীর্ষক একটি লিফলেট প্রচার করে। এতে প্রস্তাবিত সুপারিশমালায় কতগুলাে মৌলিক বৈষম্যের কথা তুলে ধরা হয়। অন্যদিকে Action Committee-এর তৎপরতার বিষয়ে তাজউদ্দীন আহমদ ১৩ অক্টোবর ডায়েরিতে লিখেন:

আওয়ামী মুসলিম লীগ অফিস থেকে একটি পতাকা নিয়ে এলাম । সাড়ে ৪ টায় আতাউর রহমান সাহেবের সভাপতিত্বে মিটিং শুরু হলে হাফিজুর রহমান, কুষ্টিয়ার শামসুদ্দীন সাহেব, খয়রত হােসেন এম.এল.এ, রফিক, ওয়াদুদ, শামসুল হুদা (সেন্ট্রাল ক্লাব) বক্তব্য রাখলেন। কামরুদ্দীন সাহেব প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং তা গৃহীত হয়। সভা সােয়া ৬ টায় শেষ হয়েছে। সভায় বুদ্ধিজীবীদের প্রধানত বড় ধরনের সমাবেশ হয়েছিল এবং এটিই ছিল প্রধান আকর্ষণ । কামরুদ্দীন সাহেব, আতাউর রহমান সাহেব, রফিক, মানিক মিয়া, তােয়াহা সাহেব প্রমুখের সঙ্গে সাখাওয়াত হােসেন সাহেবের বৈঠকখানায় বসলাম এবং ৯ টা পর্যন্ত

কথাবার্তার পর যার যার গন্তব্যে চলে গেলেন। উল্লেখ্য, বুদ্ধিজীবীরাও লিয়াকত আলীর প্রস্তাবিত মুলনীতির তীব্র বিরােধিতা করেন এবং আন্দোলনে যােগ দিয়ে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারে তত্ত্বগত ভিত্তি রচনা করেন। মূলনীতি প্রশ্নে পূর্ব বাংলায় ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দেয়ায় প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান কতিপয় বাঙালি বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বুদ্ধিজীবীরা তাকে জানান, শাসনতন্ত্রে পূর্ব বাংলার জন্য স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা না। থাকলে তিনি যেন তা অনুমােদন না করেন । পূর্ব বাংলাকে কেবল প্রদেশ হিসেবে নয় বরং একটি স্বতন্ত্র স্বয়ংসম্পূর্ণ অঞ্চল হিসেবে গ্রহণ করে অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দেয়ার দাবিও জানানাে হয়। এতদুদ্দেশ্যে পূর্ব বাংলার জন্য একটি মুদ্রা, বাণিজ্য ও শুল্কনীতি আবশ্যক। পূর্ব বাংলার জনসংখ্যা পাকিস্তানের মােট জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হিসেবে সুযােগ ও সম্পদের সুষম বণ্টন চায় । অবশ্য প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক বিষয়ে অঞ্চল দুটোর মধ্যে সমপর্যায়ের স্বাভাবিক সহযােগিতার প্রয়ােজনীয়তা অনস্বীকার্য। আর সেভাবেই অঞ্চল দুটোর মধ্যে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সুদৃঢ় সম্পর্ক থাকতে পারে। তবে তা হতে হবে। পারস্পরিক লেনদেনের ভিত্তিতে। কাজেই সংবিধানে এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট স্বীকৃতি না থাকলে তা পূর্ব বাংলার মানুষের জন্য গ্রহণযােগ্য হবে না।

কামরুদ্দীন আহমদ, পূর্ব বাংলার সমাজ ও রাজনীতি, পৃ. ১১০-১১১।

এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজনীতিবিদ ও প্রগতিবাদী বুদ্ধিজীবীরা পূর্ব | বাংলার স্বতন্ত্র স্বার্থের ব্যাপারটি তুলে ধরেন। বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে লিয়াকত আলী খানের এ সাক্ষাৎ ঘটে Grand National Convention হয়ে যাওয়ার পরে।৩৩৮ মূলত পাকিস্তানের সমগ্র বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় এ সময় নাগাদ কেন্দ্রীয় শাসনপন্থী ও প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনপন্থী—এই দুদলে বিভক্ত হয়ে পড়েন। বিত্তশালী শিল্পপতিরা, প্রথম গণপরিষদের অধিকাংশ সদস্য, আমলা আর জমিদার শ্রেণী, অর্থাৎ যারা দেশের সুবিধাভােগী গােষ্ঠী ছিলেন তারা অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভুত একটি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিষয়ে তৎপর হন। অন্যদিকে কৃষক আর শােষিত জনসাধারণের আস্থা ব্যক্ত করা হয় স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে। অনুরূপভাবে অপেক্ষাকৃত সমৃদ্ধ প্রদেশ করাচী ও পাঞ্জাব কেন্দ্রীকরণের পক্ষে অবস্থান নেয় । কিন্তু পূর্ব বাংলা, সিন্ধু, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন সমর্থন করে।৩৩৯

১৯৫০ সালের ১৮ অক্টোবর Democratic Action Committee-এর বৈঠকে বিকল্প মূলনীতির রাষ্ট্র ও সরকার গঠন সম্পর্কিত নীতি নির্ধারণ সম্পন্ন হয়। এতে তাজউদ্দীন আহমদ, আবদুস সালাম (১৯১০-১৯৭৭), আতাউর রহমান, কামরুদ্দীন আহমদ, আবুল কাশেম ও অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।৩৪০ বিকল্প খসড়া মূলনীতি প্রণয়নের বৈঠকগুলােতেই কেবল তাজউদ্দিন আহমদ উপস্থিত থাকতেন না, বরং কামরুদ্দীন আহমদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হিসেবে এর Drafting | এর কাজসহ অতিরিক্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫০ সালের ১৯

অক্টোবরে লেখা ডায়েরিতে উল্লেখ আছে যে, তিনি ঐদিন কামরুদ্দীন আহমদের ডিকটেশন অনুযায়ী নতুন খসড়া সংবিধান লেখার কাজ সম্পন্ন করেন।”৩৪১( পরিশেষে ২৩ অক্টোবর শওকত হােসেনের বাসায় এ্যাকশন কমিটির বৈঠকে মােহাম্মদ তােয়াহা, আবদুস সালাম, আতাউর রহমান, এইচ রহমান, ইদ্রিস, অলি | আহাদ, তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্যদের উপস্থিতিতে বিকল্প মূলনীতি খসড়া প্রস্ত | বি গৃহীত হয়।৩৪২ গৃহীত বিকল্প মূলনীতি খসড়া প্রস্তাব সম্পর্কে খুঁটিনাটি | আলােচনার জন্যে শওকত হােসেনের বাসায় ২৬ ও ২৮ অক্টোবর পর্যালােচনা বৈঠক

বসে। এখানে উল্লেখ্য যে, বিকল্প খসড়া মূলনীতির অধিকাংশ বৈঠক শওকত | হােসেনের বাসায় অনুষ্ঠিত হতাে। বৈঠক দুটিতে তাজউদ্দীন আহমদসহ Action

———

৩৩৮ ঐ, পৃ. ১১০। ৩৩৯ ঐ, পৃ. ১১১। ৩৪০ ডায়েরী, ১৮ অক্টোবর, ১৯৫০। ৩. ঐ, ১৯ অক্টোবর, ১৯৫০। ৩৪২, ঐ, ২৩ অক্টোবর, ১৯৫০।

Committee-এর গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সকল সদস্য উপস্থিত হন। ৩৪৩ অক্টোবর মাসের শেষে বিশেষ ভুক্তিতে তাজউদ্দীন আহমদ এ বিষয়ে ডায়েরিতে লিখেন যে, মাসের শুরু থেকেই মৌলিক নীতি নির্ধারণী কমিটির রিপাের্টের বিরুদ্ধে পুরাে দেশময় উত্তপ্ত পরিবেশ ও অসন্তুষ্টি বিরাজমান। ৩৪৪ ১ নভেম্বর Action Committe-এর বৈঠকে সর্বোচ্চসংখ্যক সদস্য উপস্থিত হন এবং বিকল্প মূলনীতি খসড়া প্রস্তাবের সার্বিক বিষয়ে আলােচনা সমাপ্ত হয়। উপস্থিতদের মধ্যে ছিলেন আতাউর রহমান, এস, হােসেন, এ. কাশেম, ইদ্রিস, আবদুস সালাম, মহিউদ্দিন, কফিল উদ্দিন চৌধুরী (১৮৯৯-১৯৭২), কামরুদ্দীন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ, আর, রহমান, অলি আহাদ, মানিক মিয়া, ওয়াদুদ, আজিজ আহমদ, এম.জি. হাফিজ, এম.এ. রহিম, এন, ইসলাম ও অন্যরা। পূর্ব সিদ্ধান্ত মােতাবেক ১৯৫০ সালের ৪ ও ৫ নভেম্বর Grand National Convention অনুষ্ঠিত হয় । তার আগে ৪ নভেম্বর সকালে কামরুদ্দীন আহমদের নির্দেশক্রমে তাজউদ্দীন আহমদ সংশােধনীগুলাে সাজিয়ে লিখেন।৩৪৬ দুই দিনের সম্মেলনে অনেক গ্রুপ-উপগ্রুপ, বাক-বিতণ্ডা হয় বটে, তবে তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্যরা যে ধরনের প্রস্তাব উপস্থাপন করেন সেটি সামান্য পরিবর্তিত হয়ে গৃহীত হয়। সম্মেলনে সিলেট জেলা কমিটির পক্ষ থেকে আবদুস সামাদের একটি সংশােধনী প্রস্তাব গৃহীত হয় । ৩ নং অনুচ্ছেদে সেটা গৃহীত হয়ে হয় সংযুক্ত পাকিস্তান হবে একটি স্বাধীন সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’।”৩৪৭

মহাসম্মেলনকে কেন্দ্র করে ৩ টি কমিটি তাদের নিজ নিজ খসড়া প্রস্তাব প্রণয়ন করে। যেমন-হামিদুল হক চৌধুরী, শাহ আজিজুর রহমান ও অন্যান্যদের নিয়ে মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে একটি, আওয়ামী মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে আতাউর রহমান, রফিকুল হােসেন, মানিক মিয়া, নুরুল ইসলাম ও অন্যরা প্রণয়ন করেন অন্য একটি। তৃতীয়টি প্রস্তুত করেন কামরুদ্দীন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ, মােহাম্মদ তােয়াহা ও অন্যরা। তিনটি কমিটির রিপাের্ট পেশের পর দেখা যায়, গণপরিষদে যে মূলনীতি রিপাের্ট সরকার পেশ করেছে তা পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক মহলের নিকট কোনভাবেই গ্রহণযােগ্য নয়। অবশ্য সূক্ষ বিশ্লেষণে

———-

. ঐ, ২৬ ও ২৮ অক্টোবর, ১৯৫০। ৩৮৮ ঐ, ৩১ অক্টোবর, ১৯৫০। ৩৯ ঐ, ১ নভেম্বর, ১৯৫০।

ঐ, ৪ নভেম্বর, ১৯৫০। | কামরুদ্দীন আহমদ, পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ১৩৫। | সংশােধনীটি হলাে: 3. A United states of Pakistan shall be a sovereign socialist Republic”

এগুলাের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্যও ছিল।৩৪৮ তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি থেকে জানা যায় মহাসম্মেলনে আওয়ামী মুসলিম লীগপন্থীরা বিকল্প মূলনীতি খসড়া প্রস্ত বি গ্রহণের ক্ষেত্রে কামরুদ্দীন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যদের নিকট হেরে যায়। অর্থাৎ তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্যদের প্রস্তাবটিই গৃহীত হয়। বিকল্প খসড়া মূলনীতি প্রস্তাব গ্রহণ সম্পর্কে তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি হতে নেতাদের মত পার্থক্যের বিষয়ে কিঞ্চিৎ জানা যায়:৩৪৯

সভার কাজ শুরু হল সাড়ে ৭ টায় । সাড়ে ৮ টার দিকে সভার তৃতীয় পাঠ শেষ। হল । এ্যাকশন কমিটি বিলুপ্ত ঘােষণা করে নতুন আরেকটি কমিটি গঠন করা হল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সদস্যরা এ নিয়ে হৈ চৈ করতে লাগল । প্রস্তাব পাশের পর রাত ১২ টায় সম্মেলন শেষ হল । রাত ১ টায় হলে ফিরলাম। সম্মেলনে অনেক মানুষের উপস্থিতি ছিল এবং এদের অধিকাংশ ঢাকা শহরের বাসিন্দা হলেও অবশ্যই তারা বিভিন্ন জেলা থেকে আগত। প্রাণবন্ত ও ধারালাে আলােচনা হয়েছে। আওয়ামী লীগের বিশেষ করে শামসুল হক, রফিক এবং মানিক মিয়ার ভূমিকা প্রশংসনীয় ছিল না। ব্যক্তিগতভাবে হেরে গিয়ে তারা তাদের সহযােগিদের বােঝানাের চেষ্টা করেছিলেন যে, এই পরাজয় আওয়ামী লীগের । এতে নিঃসন্দেহে ভুল বােঝাবুঝির সৃষ্টি হয়

এবং জনাব আতাউর রহমানসহ আওয়ামী লীগ একদিকে অবস্থান নেয় । এখানে উল্লেখ করা আবশ্যক যে, বিকল্প খসড়া মূলনীতি হিসেবে যেটি গৃহীত হয় তাতে ছিল ৭৮ টি অনুচ্ছেদ এবং কতিপয় উপ-অনুচ্ছেদ।৩৫০ ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহার ২১ দফায় উল্লেখ করা হয় তাতে মূলত বিকল্প খসড়া মূলনীতি প্রস্তাবের প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। এতে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে রেখে অন্য সকল বিষয় প্রদেশের হাতে দেয়ার জন্য বলা হয় । প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির শাসন একনায়কতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক হতে পারে বিবেচনা করে বিকল্প এই প্রস্তাবে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার প্রতি গুরুত্বারােপ করা হয়। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ ১৯৬৬ সালে ৬ দফায় যেসব নীতি গ্রহণ করে তা মূলত ১৯৫০ সালে তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্য কর্তৃক প্রণীত বিকল্প। মূলনীতি খসড়া প্রস্তাবের সারবস্তু। ১৯৬৬ সালে ৬ দফায় শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র কেন্দ্রের হাতে রাখার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল । বিকল্প খসড়া মূলনীতির আইনগত কোনাে বৈধতাই ছিল না। কিন্তু পাকিস্তানের কায়েমি শাসক গােষ্ঠীর

——–

৩৪৮ ঐ, পৃ. ১৩৩-১৩৪। ৩৪. ডায়েরী, ৫ নভেম্বর, ১৯৫০। ৩৫০ দলিলপত্র, প্রথম খণ্ড, পৃ. ১৬০-১৬৭।

বিরুদ্ধে তা আন্দোলনের পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে। সম্ভাবনাময় এ জনগােষ্ঠীটির কতিপয় নেতাকে শাসনতন্ত্র রচনার ব্যাপারে সচেতন ও সমৃদ্ধ করে। এর মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলা ১৯৫০ সালেই পাকিস্তানের উপনিবেশ হয়ে থাকতে অস্বীকৃতি জানায়।৩৫১ নানা দূরভিসন্ধিমূলক আচরণের মাধ্যমে পাকিস্ত নের কেন্দ্রীয় শাসক-এলিটরা যখন সংবিধান রচনায় অহেতুক কালক্ষেপণ এবং তজ্জনিত কারণে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছিলেন তখন পূর্ব বাংলার বাঙালি তরুণরা অল্প সময়ের প্রস্তুতিতে গ্রান্ড ন্যাশনাল কনভেনশনে মিলিত হয়ে একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংবিধানের উপযােগী প্রস্তাবনা রাখতে পেরেছিলেন। এই প্রস্ত বিনার মূল উপজীব্য বিষয়গুলাে হলাে: যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতির শাসন, সংসদীয় গণতন্ত্র, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন, ভাষা ও সংস্কৃতির স্বীকৃতি ইত্যাদি। বাস্তবিক অর্থেই গ্রান্ড ন্যাশনাল কনভেনশনের এই প্রস্তাব ছিল একটি বিকল্প সংবিধান। মূলনীতি কমিটির খসড়া রিপাের্টের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলাব্যাপী যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তারই প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ১৯৫০ সালের ২১ নভেম্বর অন্তর্বর্তীকালীন রিপাের্টটি প্রত্যাহার করে নেন।৩৫২

১৯৫০ সালে প্রস্তাবিত খসড়া মূলনীতির বিরুদ্ধে কার্যত সমগ্র পূর্ব বাংলা একতাবদ্ধ হয়। এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে পুর্ব বাংলার বিরােধীদলসমুহ পারস্পরিক বােঝাপড়ার মাধ্যমে সরকারবিরােধী আন্দোলনে একটা কার্যকর সহযােগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টির নজির স্থাপন করে। এর আইনগত কোনাে বৈধতা না থাকলেও বাঙালির স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনে এর তাৎপর্য অপরিসীম। বলা যেতে পারে স্বাধিকার আন্দোলনের ভাবাদর্শিক ভিত্তি এরই মধ্য দিয়ে রচিত হয়ে যায় । তাজউদ্দীন আহমদ এই আন্দোলনের একজন গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তি হিসেবে এটি প্রণয়নে সৃজনশীল ও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

যুবলীগের (১৯৫১) প্রতিষ্ঠা ও তাজউদ্দীন আহমদ

প্রস্তাবিত খসড়া মূলনীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন না থামতেই পাকিস্তানের রাজনীতিতে এক নয়া মেরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। উক্ত আন্দোলনের প্রেক্ষিতে অনুভূত হয় যে, যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে সংহতি প্রতিষ্ঠা করা দরকার। এরই ফলে ১৯৫১ সালের ২৭ ও ২৮ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তান যুব সম্মেলন ডাকা হয়।

———–

৩৫১ কামরুদ্দীন আহমদ, পূর্ব বাংলার সমাজ ও রাজনীতি, পৃ. ১১০। ৩৫২, ড. মাে. মাহবুবর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৩।

১০৫

তাজউদ্দীন আহমদদের গ্রুপটি এই সম্মেলনে যােগদান করেন। পরিশেষে গঠিত হয় যুবলীগ নামক একটি সংগঠন।

| যুবলীগ গঠনের প্রধান উদ্যোক্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী মাহমুদ নুরুল হুদার (১৯১৬-১৯৯৬) সূত্র হতে যুবলীগের উৎপত্তি সম্পর্কে যে তথ্য পাওয়া যায়। তাতে দেখা যায় যে, পাকিস্তানের দুজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের। বিরাগভাজন হয়ে একটি বিকল্প চিন্তা-ভাবনা শুরু করেন।৩৫৩ এদের একজন হচ্ছেন মিস ফাতিমা জিন্নাহ, অন্যজন মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মােহাম্মদ নােমান জুবেরী। ১৯৫০ সালে এ দুজনের মধ্যে মাঝে মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হতাে। তারা তরুণ-যুব সম্প্রদায়কে নিয়ে পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক মূল্যবােধে সমুজ্জ্বল একটি বিরােধী রাজনৈতিক ধারা সৃষ্টির জন্য বিস্তর আলােচনা করেন। পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের যুবনেতাদের সঙ্গে যােগাযােগ করা হলেও একমাত্র পূর্ব বাংলায় এই পরিকল্পনা সফল করা সম্ভব হয়। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে যােগদানের আমন্ত্রণ পান মিস ফাতিমা জিন্নাহ । পূর্ব বাংলায় তার আগমনকে সামনে রেখে যুবলীগ গঠনের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলে। মাহমুদ নুরুল হুদার সঙ্গে এই সময় নােমান জুবেরীর ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ থাকার কারণে তিনি পূর্ব বাংলায় যুবলীগ গঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ১৯৫০ সালের অক্টোবরে তিনি আনােয়ার হােসেন, আবদুর রউফ ও জহুর হােসেন। চৌধুরীকে নিয়ে এই কাজ শুরু করেন। ১৯৫০ সনের ডিসেম্বর মাসে নুরুল হুদাকে সভাপতি এবং আনােয়ার হােসেনকে সম্পাদক করে একটি অভ্যর্থনা কমিটি গঠন করা হয়।৩৫৪ ১৯৫১ সালের জানুয়ারির মধ্যেই বিভিন্ন মত ও পথের যুবকদের সমন্বয়ে এই উদ্যোগ বেশ গতি লাভ করে।

| তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি থেকে জানা যায় যে, ২০ নভেম্বর (১৯৫০) পর্যন্ত তারা নতুন দল গঠনের বিষয়ে আলােচনা অব্যাহত রাখেন। কিন্তু কোনভাবেই তাদের পক্ষে এ ধরনের গণভিত্তিসম্পন্ন একটি দল গড়ে তােলা সম্ভব হয়নি। এমতাবস্থায় তারা মুসলিম ছাত্রলীগ অথবা আওয়ামী মুসলিম লীগে যােগদান করবেন কিনা সে বিষয়েও ভাবতে শুরু করেন।৩৫৫ সঙ্গত কারণে যুবলীগ গঠনের ব্যাপারটি তাজউদ্দীন আহমদ ও তার সহমতপােষণকারীরা বেশ উৎসাহের সঙ্গে গ্রহণ করেন। কমিউনিস্ট পার্টির অনিল মুখার্জী আবদুর রউফের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এ ধরনের একটি সংগঠন সৃষ্টির প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেন যে,

—–

৩৫৩মাহমুদ নুরুল হুদা, আমার জীবন স্মৃতি (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১৯৯৯), পৃ. ১২৫। ৩৫. ঐ, পৃ. ২৩৮। ৩৫. ডায়েরী, ১৫ নভেম্বর, ১৯৫০ ও ৩১ ডিসেম্বর, ১৯৫০।

১৯৪৭ সালে গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল বটে, কিন্তু চলতি অবস্থায় এর সাফল্যের সম্ভাবনা অনেক বেশি।৩৫৬

যুবলীগ গঠনের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদ ও তার রাজনৈতিক সহকর্মীদের সংযােগ স্থাপিত হওয়ার পর তারাই এ ব্যাপার অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এ বিষয়ে মােহাম্মদ তােয়াহাকে অবহিত করে তাকে সম্পাদক করার প্রস্তাব দেয়া হলে তােয়াহা রাজি না হয়ে অলি আহাদের নাম প্রস্তাব করেন। শেষাবধি অলি আহাদকে যুবলীগের সম্পাদক করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।৩৫৭ অতঃপর যুবসম্মেলন করার লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি আলােচনা সভা হয় যেগুলাের সব কয়টিতেই তাজউদ্দীন আহমদ উপস্থিত ছিলেন। ৩৫৮ অন্যদিকে যুবলীগ গঠনে বাধাদানের জন্যে সরকারের বিভিন্ন গােয়েন্দা সংস্থাসহ মুসলিম লীগের গুণ্ডাদের তৎপরতার কথা জানা যায়। প্রতিকূলতার মুখে যুবলীগ গঠনের উদ্দেশ্যে সম্মেলনের তারিখ নির্ধারিত হয় ১৯৫১ সালের ২৭ মার্চ। সরকার কর্তৃপক্ষ যুব সম্মেলনের কর্মকর্তাদের জানায় যে, প্রস্তাবিত সম্মেলন স্থান বার লাইব্রেরিতে ১৪৪ ধারা জারি থাকবে। এমতাবস্থায় উদ্যোক্তারা। তাৎক্ষণিকভাবে সম্মেলনের স্থান নির্ধারণ করেন বুড়িগঙ্গার অপর তীরে অবস্থিত জিঞ্জিরা বাজারে। | তাজউদ্দীন আহমদের ১৯৫১ সালের ২৭ মার্চের ডায়েরি থেকে জানা যায় যে, সম্মেলনের সময় দুপুর আড়াইটায় নির্ধারিত থাকলেও সম্মেলন শুরু হয় সন্ধ্যা সাতটায়। প্রতিনিধিরা ছাড়াও সম্মেলন স্থলে কয়েক হাজার দর্শক-শ্রোতার উপস্থিতি ঘটে । নির্বাচিত সভাপতি সরকারের ফ্যাসিবাদী চরিত্রের কথা উল্লেখ করে তরুণ সমাজের উদ্দেশ্যে উদ্দীপনামূলক বক্তৃতা করার পর পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুস সামাদ ও গােলাম মােস্তফা পৃথক পৃথক প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। প্রস্তাবগুলাে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। রাত দশটা নাগাদ প্রথম অধিবেশন শেষ হতে না হতেই জিঞ্জিরা বাজারে পুলিশ উপস্থিত হলে পুলিশি বাধার মুখে দ্বিতীয় অধিবেশন বুড়িগঙ্গায় নৌকার ওপর করা

———–

৩৫৬ বদরুদ্দীন উমর, ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ কতিপয় দলিল, দ্বিতীয় খণ্ড (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১৯৯৫), পৃ. ৩০৬। এই”, ঐ, পৃ. ৩০৬। অথচ মাহমুদ নুরুল হুদা, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩৮-২৩৯। ৩৫৯ বদরুদ্দীন উমর, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০৭। ** বদরুদ্দীন উমর, ভাষা আন্দোল প্রসঙ্গ কতিপয় দলিল, তৃতীয় খণ্ড (ঢাকা: জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ১৯৯৫), পৃ. ১৬২-১৬৩। ৩৬৯ ঐ, পৃ. ১৬৫।

হয়। সামান্য রদবদলের পর প্রস্তাবগুলাে ম্যানিফেস্টো আকারে গৃহীত হয়। ২৭২৮ মার্চের মধ্যরাত অতিক্রান্ত হওয়ার পর যুবলীগ নামে একটি যুব সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। অতঃপর ১২৫ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ সংগঠনী কাউন্সিল গঠনের মাধমে রাত আড়াইটা নাগাদ প্রথম দিনের কর্মসূচি সমাপ্ত হয়।৩৬২ পরবর্তী দিন ২৮ মার্চ বিকেল ঠাটারী বাজারে অবস্থিত ডা. করিমের বাসাতে ৩০ জন সদস্যের এক বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের একটি কার্যকরী কমিটি গঠিত হয় । তাজউদ্দীন আহমদ কার্যকরী কমিটিতে ঢাকা জেলার সদস্য নির্বাচিত হন।৩৬৩ ড | যুবলীগের আয়ুষ্কাল খুব দীর্ঘ না হলেও প্রথমদিকে প্রচণ্ড প্রাণশক্তি নিয়ে কাজ শুরু করে। সরকার শুরু থেকেই যুবলীগের বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করে এই বলে যে, এটি কোনাে কোনাে রাজনৈতিক দলের প্রচ্ছন্ন কার্যক্রমের অংশ। তবে তখন এর সংগঠকরা যুবলীগকে অরাজনৈতিক সংগঠন বলে দাবি করেন।

যে অর্থে একটি সংগঠনকে রাজনৈতিক দল বলা যায় সে অর্থে যুবলীগ রাজনৈতিক দল ছিল না মেনে নিলেও এর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল না তা বলা যায় না। বস্তুত এটি গঠনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সক্রিয় সমর্থন ছিল। সরকার একদিকে চায়নি যে, বিপরীত ভাবাদর্শের কোনাে রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে উঠুক। তাই নানাভাবে সর্বাত্মক চেষ্টা চালায় যাতে যুবলীগ গঠিত হতে না পারে। এ ধরনের বিরাধিতামূলক কার্যাবলির মধ্য দিয়েই সরকারের অগণতান্ত্রিক ও দমনমূলক নীতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

যুবলীগ গঠনের গুরুত্ব অপরিসীম, বিশেষ করে ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন সর্বাত্মকরূপ ধারণ করে যুবলীগের নেতাকর্মীদের উদ্যোগেই । যুবলীগের কর্মকাণ্ড বেশিদিন চালিয়ে নেয়া সম্ভব না হলেও ভাষা আন্দোলনের অল্প পরে, ১৯৫২ সালের নভেম্বরে এর অন্তর্ভুক্ত ছাত্রকর্মীদের নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন নামে প্রগতিবাদী একটি ছাত্র সংগঠন গড়ে তােলা হয় । কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে

———–

৩৬২, নওবেলাল, সিলেট, ৫ এপ্রিল, ১৯৫১।

* ডায়েরী, ২৭ মার্চ, ১৯৫১। কার্যকরী কমিটির সদস্যদের নামের তালিকা: সভাপতিমহম্মদ আলী, সহসভাপতি-খায়েজ আহমদ, ইয়ার মহম্মদ, শামসুজ্জোহা, আবদুল মজিদ, দৌলুতুন্নেসা, সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদ, যুগ্ম সম্পাদক আবদুল মতিন, রুহুল আমিন, কোষাধ্যক্ষ টি,এ, চৌধুরী, সদস্য নুরুল হুদা, মােহাম্মদ তােয়াহা মতিউর রহমান, আবদুল হালিম, আবদুস সামাদ, মকসুদ আহমদ, খন্দকার গােলাম মােস্তফা, কবির আহমদ, আবদুল ওয়াদুদ, এ গফুর চৌধুরী, প্রাণেশ সমাদ্দার (শিল্পী), তাজউদ্দীন আহমদ (ঢাকা জেলা), আকমল হােসেন, মােতাহার হােসেন ও মিস রােকেয়া। অলি আহাদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৬-১০৭। ৩৬৫ নওবেলাল, ৫ এপ্রিল, ১৯৫১।

সম্পর্কিত ছাত্রনেতা মােহাম্মদ সুলতান ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন।৩৬৫ পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে প্রগতিবাদী শিক্ষিত জনশক্তি সৃষ্টিতে ছাত্র ইউনিয়ন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এই জনশক্তি পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলন, সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন

পাকিস্তানের জন্মের পর উল্লিখিত ঘটনাবলির প্রেক্ষিতে এতদঞ্চলের সচেতন মানুষের পূর্ব বাংলাকেন্দ্রিক স্বতন্ত্র স্বার্থবােধ জন্মলাভ করে। রাজনৈতিক এই প্রবণতা আরাে ঘনীভূত হয় ১৯৫৩ সালের আগস্ট মাসে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন ১৯৫৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রাদেশিক পরিষদের সাধারণ নির্বাচনের ঘােষণা দিলেন। কৃষক শ্রমিক পার্টির জনপ্রিয়তার রেশ তখনও বিদ্যমান। অন্যদিকে কতিপয় নেতা যেমন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখের যােগ্য নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দল আওয়ামী মুসলিম লীগ পূর্ব বাংলায় প্রধান রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। সীমিত পরিসরে কখনাে গােপনে কখনাে প্রকাশ্যভাবে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মকাণ্ডও বিদ্যমান ছিল। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা ছিল নিমুখী । ঠিক এরূপ পরিস্থিতিতে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের ঘােষণাকে রাজনৈতিক দলগুলাে তাদের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের এবং ক্ষমতাসীন জনবিচ্ছিন্ন মুসলিম লীগ সরকারের পতন ঘটানাের একটি সুযােগ বলে বিবেচনা করে। সম্মিলিতভাবে মুসলিম লীগের মােকাবিলা করার জন্য আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রধান দুই কর্ণধার মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী এবং কৃষক শ্রমিক পার্টির নেতা এ.কে. ফজলুল হক ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল ও পাকিস্ত নি নেজামী ইসলামী পার্টির সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট নামক একটি নির্বাচনী জোট গঠন করেন।

ইতােমধ্যে আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৯৫৩ সালের জুলাই মাসে রাজনৈতিক বিকাশের লক্ষ্যে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারণ করে। দলটি জোট নিরপেক্ষ সাম্রাজ্যবাদবিরােধী নীতি, ভূমি ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন যথা লাঙ্গল যার জমি তার নীতি বাস্তবায়নের দাবি, শিল্পায়ন ও শিল্পের জাতীয়করণ, শশাষণমুক্ত সমাজ

—-

৩৬৫ খােকা রায়, সংগ্রামের তিন দশক (ঢাকা: জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৮৬), পৃ. ১১৯।

গঠনের শপথ প্রভৃতির ন্যায় কতিপয় যুগান্তকারী নীতির ওপর গুরুত্বারােপ করে।৩৬৬ এই কাউন্সিলে দলটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন শেখ মুজিবুর রহমান। পূর্বতন সম্পাদক শামসুল হক ব্যর্থ হয়ে দলের কতিপয় নেতার বিরুদ্ধে অভিযােগ উত্থাপন করে বিবৃতি দেন।৩৬৭ ১৯৫৩ সালের ১৪ নভেম্বর ঢাকার মুকুল সিনেমা হলের এই কাউন্সিলে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়ার মতামত উত্থাপিত হয়। ৩৬৮ আগেই উল্লিখিত হয়েছে, এ ধরনের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে এসে তাজউদ্দীন আহমদ জাতীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তে উপনীত হন। ১৯৫৩ সালের ঐ কাউন্সিল অধিবেশনে তিনি। আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী মুসলিম লীগে যােগদান করেন এবং ঢাকা জেলার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, তাজউদ্দীন আহমদ কেবল তখনই আওয়ামী মুসলিম লীগে যােগদান করেন যখন সংগঠনটি তার নাম থেকে সাম্প্রদায়িক মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়।৬৯ আসন্ন প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগের একজন প্রার্থী মনােনীত হন।

যুক্তফ্রন্ট যাতে একটি অসাম্প্রদায়িক জোট হয় সে প্রচেষ্টাও তিনি করেন বলে জানা যায় । কিন্তু কৃষক শ্রমিক পার্টির নেতা ফজলুল হক সাম্প্রদায়িক দল নেজামী ইসলামী পার্টিকে বাদ দিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করতে রাজি হন নি। তিনি পূর্বেই নেজামী ইসলামীর নেতা মওলানা আতাহার আলীর সাথে ঐ বিষয়ে সমঝােতায় উপনীত হয়েছিলেন। এমতাবস্থায় তাজউদ্দীন আহমদ ও আরাে কেউ কেউ হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর সঙ্গে যােগাযােগ করেন এবং চাপ প্রয়ােগ করেন। যে, নেজামী ইসলামীর মতাে একটি সাম্প্রদায়িক দলের সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট গঠন করা ঠিক হচ্ছে না। নেজামী ইসলামীর নেতা আতাহার আলীকে এ.কে. ফজলুল হকের প্রদত্ত পূর্ব প্রতিশ্রুতির কারণে বামপন্থী সংগঠন গণতন্ত্রী দল এবং কমিউনিস্ট পার্টিকে যুক্তফ্রন্টে গ্রহণ করা হয়নি। কেননা আবুল হাশিম যিনি এক সময় তাজউদ্দীন আহমদদের মতাে তরুণ রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের অসাম্প্রদায়িক বিপ্লবী রাজনৈতিক ধারায় অনুপ্রাণিত করেছিলেন, তিনিও

———-

৩৬৬. ড. আবুল কাশেম (সম্পা.), প্রাগুক্ত, পৃ. ৫০-৫৮। ৩৬”, M.B. Nair, op.cit., p. 77. ৩৬৮ ড. আবুল কাশেম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯২।

* Shyamali Ghosh, op.cit., p. 11. ও মুজাফফর আলীর সাক্ষাৎকার, ৩ এপ্রিল, ১৯৯১।

ড.আনিসুজ্জামানের রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০০০।

১১০

খেলাফতে রব্বানীর মতাে একটি সাম্প্রদায়িক দলের প্রধান হিসেবে ঘােষণা করেন। যে, যদি যুক্তফ্রন্টে কমিউনিস্টদের অন্তর্ভুক্ত করা হয় তাহলে তাতে তিনি যােগদান করবেন না। বস্তুত পাকিস্তান রাষ্ট্রে আগমনের পর তিনি ইসলামী রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সমর্থকে পরিণত হন। অন্যদিকে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী স্বল্প শিক্ষিত ও ধর্মীয় আবরণের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও যুক্তফ্রন্টের ঐ ধরনের ডানঘেঁষা নীতিকে পুরাে সমর্থন করেননি এবং যুক্তফ্রন্টের মনােনয়নের ব্যাপারে একমত হতে পারেননি। এ কারণে তিনি ১৯৫৪ সালের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝিতে নির্বাচনী সফর ছেড়ে অনেকদিন বগুড়ায় গিয়ে চুপচাপ বসে থাকেন।৩৭২ অবশ্য তিনি তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্যদের মতাে উদারপন্থী নেতা-কর্মীদের বলেন যে, নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ বা যুক্তফ্রন্টকে অসাম্প্রদায়িকীকরণ কৌশলগত কারণে ঠিক হবে না। কারণ মুসলিম লীগ সরকার বিরােধীদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে যে অপপ্রচার করে তা হলাে এরা ইসলামবিরােধী। কাজেই সে সুযােগ মুসলিম লীগ সরকারকে না দেয়ার জন্যেই এ বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে সরকারবিরােধিতা এ সময় এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যে, বামপন্থীদলগুলােকে যুক্তফ্রন্টের অন্তর্ভুক্ত করা না হলেও তারা রাজনৈতিক বিকাশের স্বার্থে নির্বাচনের উদ্দেশ্যে গঠিত মুসলিম লীগবিরােধী কর্মী শিবিরে যােগদান করে। যেমন গণতন্ত্রী দল, কমিউনিস্ট পার্টি প্রভৃতি সংগঠনের সদস্যরাও যুক্তফ্রন্টের কর্মী বাহিনীর সঙ্গে যােগ দিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় নামে।

যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা নির্বাচনী কর্মসূচি ব্যাপকভাবে জনগণকে আকৃষ্ট করে । ২১ দফার প্রণেতা আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮-১৯৭৯) বাংলার রাজনীতি সচেতন মানুষ ১৯৩৭ সাল থেকে যে ধরনের অধিকারের স্বপ্ন দেখে এসেছে ঐ গুলােকে নির্বাচনী ইশতেহারে মূর্ত করে তােলেন। পরবর্তীকালে বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে ২১ দফা নানাভাবে ঘুরে ফিরে আসে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ নির্বাচনে জয়লাভের জন্য ভারতবিরােধী স্লোগান তােলে।৩৭৫ প্রকৃতপক্ষে এই নির্বাচন ছিল সদ্য ঘটে যাওয়া রক্তক্ষয়ী ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন, গণমানুষের ভাষা, সাহিত্য,

————

৩৭২, আব্দুল হক, লেখকের রােজনামচায় চার দশকের রাজনীতি পরিক্রমা: প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ ১৯৫৩-১৯৯৩ (ঢাকা: ইউ.পি.এল., ১৯৯৬), পৃ, ৩। ৩৭৩, ঐ, পৃ. ৪। ৩৭. ড. আনিসুজ্জামানের রেকর্ডকৃত সাক্ষাত্তার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০০০। on. Abul Kashem, “Trends in East Bengal Student Movement, 19521958′, The Journal of Social Studies, 99, January March 2003, p. 74.

সংস্কৃতি রক্ষা সর্বোপরি আত্মনিয়ন্ত্ৰাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণভােটবিশেষ । এর ১৯ নং দফাতে বাঙালির স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার দাবির বহিঃপ্রকাশ ঘটে, যাতে পূর্ব বাংলার স্বশাসিত প্রশাসনিক কাঠামাে প্রতিষ্ঠার প্রতি গুরুত্বারােপ করা হয়। এতে কেন্দ্রের হাতে দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা ব্যবস্থা রেখে প্রদেশের হাতে বাকি সকল বিষয় ছেড়ে দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়। সব মিলিয়ে ২১ দফা পূর্ব বাংলার মানুষকে আর একবার ব্যাপকভাবে আলােড়িত করে। ১৯৫৪ সাল নাগাদ বস্তুত পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে একটি গুণগত উত্তরণ ঘটে। এ প্রসঙ্গে রাজনীতিবিষয়ক মননশীল লেখক আবদুল হকের পর্যবেক্ষণটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি লিখেছেন:৩৭৬

দেখলাম জনসাধারণ তাদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন। রাষ্ট্রীয় ও সমাজ ব্যবস্থায় তারা পরিবর্তন চায়। এই কারণেই তারা যুক্তফ্রন্টের সমর্থক। তার মানে এই নয় যে, তারা যুক্তফ্রন্টকে আদর্শ প্রতিষ্ঠান বলে মনে করে। রাষ্ট্রীয় ও সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তনের আকাক্ষা এবং লীগ (মুসলিম লীগ] তাদেরকে যুক্তফ্রন্টের সমর্থক করে তুলেছে।…এবারের নির্বাচন উপলক্ষে সবচেয়ে যে জিনিসটি লক্ষ্য করলাম তা হচ্ছে। এই যে ইসলাম ও পাকিস্তান বিপন্ন বুলি শুনে তারা ভুলতে চায় না। তাদের যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দাবি, যে ভাষা ও সংস্কৃতির দাবি, তা’ তারা ছাড়ছেনা। এটা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, পূর্ব বাংলার অধিবাসীরা এখন রাজনীতিতে ধর্মের কথা শুনতে চায় না। তাদের মধ্যে এখন ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক

আদর্শেরই বেশি প্রসার হচ্ছে এবং দ্রুত প্রসার হচ্ছে। এই নির্বাচনে ২৯ বছর বয়সী যুবক তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসেব ঢাকা উত্তর-পূর্ব আসনে শাসকদল মুসলিম লীগের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সম্পাদক প্রবীণ নেতা ফকির আবদুল মান্নানের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তাজউদ্দীন আহমদ তাকে ১৩ হাজারের অধিক ভােটের ব্যবধানে পরাজিত করতে সক্ষম হন। পূর্ব অধ্যায়ে উল্লিখিত হয়েছে যে তিনি লাভ করেন ১৯০৩৯ ভােট। অন্যদিকে ফকির আবদুল মান্নান লাভ করেন মাত্র ৫৯৭২ ভােট। মুসলিম লীগের অন্য কোনাে গুরুত্বপূর্ণ নেতা এত বিপুল ভােট ব্যবধানে পরাজিত হননি। মুখ্যমন্ত্রী ও মুসলিম লীগের প্রাদেশিক সভাপতি নূরুল আমিন স্বয়ং পরাজিত হন আর এক ছাত্রনেতা খালেক নওয়াজ খানের কাছে।”

——–

৩৭৬ আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬।

. Md. Abul Kashem, op.cit., p. 198. ৩ জাওয়াদুল করিম, মুজিব ও সমকালীন রাজনীতি (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ১৯৯১), পৃ. ৫৯।

খালেক নওয়াজ খান ও নুরুল আমিনের প্রাপ্ত ভােট ছিল যথাক্রমে ১৮০৮৬ ও ১১৪৭৯।৩৭৯

মন্ত্রী ও মুসলিম লীগের প্রথম সারির নেতাদের এভাবে পরাজিত হওয়ার মধ্য দিয়ে দলটির জনবিচ্ছিন্নতার বিষয়টি প্রমাণিত হয়। সামগ্রিক ফলাফলেও বিষয়টির প্রতিফলন ঘটে। মােট ২৩৭ টি আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২১৫ টি এবং ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ লাভ করে মাত্র ৯ টি আসন। যুক্তফ্রন্টের এই বিপুল বিজয়কে ‘রক্তপাতহীন বিপ্লব’ বলে পত্রিকাগুলােতে উল্লেখ করা হয়। ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র ৭ বছরের ব্যবধানে বাঙালির এই রায় মূলত পাকিস্ত নি সৃষ্টির আদর্শকেই অস্বীকার করার নামান্তর। এই রায় ছিল পূর্ব বাংলার মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের পক্ষে গণভােটবিশেষ। যুক্তফ্রন্টের শরীক দলগুলাের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আসন লাভ করে আওয়ামী মুসলিম লীগ । নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে আওয়ামী মুসলিম লীগের সদস্য ছিলেন ১৪০ জন, পক্ষান্তরে কে.এস.পি ও নেজামী ইসলামী পার্টির সদস্য ছিলেন যথাক্রমে ৩৪ ও ১২ জন।° ফজলুল হকের নেতত্ত্বাধীন কে.এস.পি. দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা সত্ত্বেও তাকে মন্ত্রিসভা গঠনের সুযােগ দেয়া হয় ।

অস্থির রাজনৈতিক অবস্থা ও সামরিক শাসন

অন্যদিকে অবাঙালি শাসকগােষ্ঠী শুরু থেকেই বাঙালির এই বিজয়কে সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৫৪ সালের ১৫ মে আদমজী জুট মিলে বাঙালি-অবাঙালি সংঘর্ষে । সমকালীন পর্যবেক্ষকদের মতে এটা ছিল পূর্ব পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র । এই সংঘর্ষে বিপুলসংখ্যক বাঙালি শ্রমিক নিহত হয়। কিন্তু নুরুল আমিন এ ঘটনার জন্য কমিউনিস্ট ও অন্যান্য বিরােধী শক্তিকে দায়ী করে তাদেরকে কঠোর হাতে দমনের প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেন। তবে পূর্ব বাংলার সচেতন মহলের ধারণা হয় যে, যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে প্রথমত হেয় প্রতিপন্ন করা, দ্বিতীয়ত জরুরি অবস্থা ঘােষণার পরিবেশ সৃষ্টি করাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। সে

—-

৩৭৯. Md. Abul Kashem, op.cit., p. 198. | দেখুন, Rangalal Sen, Political Elites in Bangladesh (Dhaka: University Press Limited, 1986), p. 125. ৩. আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০। ৩৮২, ঐ, পৃ. ১০।

লক্ষ্যে অবাঙালি মিল মালিকদের দিয়ে এই দাঙ্গা বাধানাে হয়।৩৮৩ উল্লেখ্য, ২ এপ্রিল মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছিল। চক্রান্তের মুখে শপথগ্রহণ করলেও মাত্র ১৫ | দিনের মাথায় এই ঘটনার পর ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার পতন ঘটে। ৩৮৪ অতঃপর ১৯৫৪ সালের ৩০ এপ্রিল প্রদেশে জরুরি অবস্থা। ঘােষণা করা হয়। নবগঠিত সরকারের বিরুদ্ধে অভিযােগ এনে বলা হয় যে, সরকার প্রদেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ ১৫ দিনে একটি সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নির্ণয় করা যায় না। শুরু থেকেই পশ্চিম পাকিস্ত েিনর পুঁজিপতি ও উচ্চাভিলাষী সামরিক ও বেসামরিক আমলারা ক্ষমতা কুক্ষিগত করার যে চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছিল, এটা ছিল তারই ধারাবাহিকতা। পাকিস্তানের রাজনীতিতে পরবর্তীকালের ঘটনাবলি সেটাই প্রমাণ করে ।

জরুরি অবস্থা ঘােষণার পর চৌধুরী খালেকুজ্জামানের স্থলে দেশরক্ষা সচিব | মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জাকে গভর্নর পদে এবং এম.এ. ইসহাকের স্থলে

এন.এম. খানকে চিফ সেক্রেটারি পদে নিয়ােগ করা হয়। এরপরই শুরু হয়। বিশৃঙ্খলা দমনের অজুহাতে সমগ্র পূর্ব বাংলায় ব্যাপক ধর-পাকড় অভিযান। ২ সপ্তাহের মধ্যে ফজলুল হককে নজর বন্দি, শেখ মুজিবুর রহমানসহ প্রায় ১১০০ জন রাজনৈতিক নেতা কর্মীকে গ্রেফতার এবং পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থানরত শহীদ সােহরাওয়ার্দীর গতিবিধির প্রতি তীক্ষ্ণ নজর রাখা হয়। লন্ডনে অবস্থানরত মওলানা ভাসানীর (বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যােগদানের জন্যে বার্লিনে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে লন্ডনে যান) স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরােপ করা হয় এবং ১৯৫৪ সালের জুলাই মাসে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘােষিত হয়। এভাবে গভর্নর ইস্কান্দার মীর্জা পূর্ব বাংলায় দমন ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম। করেন। অল্প পরে সামরিক শাসনের কূটচালে যুক্তফ্রন্টের মধে অবিশ্বাস ও ফাটল দেখা দেয়। সামরিক কর্তৃপক্ষ এর পুর্ণ সুযােগ গ্রহণ করে একাদিক্রমে তাদের ইচ্ছামত সরকার গঠন ও তার পতন ঘটাতে থাকে এবং রাজনীতির প্রতি

————

৩৮৩ যুক্তফ্রন্টের বিরুদ্ধে সরকারের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গে জনপ্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে দেখুন, আবুল কাশেম, “পঞ্চাশের দশকে পূর্ব বাংলার ছাত্র আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও | বাংলাদেশ, ২য় বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা, এপ্রিল ২০০১, পৃ. ৫৪-৫৮।

* ড. মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস (ঢাকা: স্টুডেন্ট ওয়েজ, ১৯৯২), পৃ. ৮৮। ৩৮৫, অলি আহাদ, প্রাগুক্ত, ১৮৬। ৩৮. আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১। *. ড. মাে. মাহবুবর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩১। ৩৮৮ ঐ, পৃ. ১৩০-১৩১।

সাধারণ মানুষের অনীহা জাগিয়ে তােলে। এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল বাঙালির স্বাতন্ত্রবাদী প্রবণতাকে বিভ্রান্ত ও বিনষ্ট করা । | দেশব্যাপী গভর্নরের কঠোর দমনমূলক শাসনের মধ্যেও রাজনৈতিক দল। হিসেবে আওয়ামী লীগ তার ক্রমবিকাশের ধারাকে অব্যাহত রাখে। ১৯৫৫ সালের ২১, ২২, ২৩ অক্টোবর দলটির দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৫৩ সালের জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে আওয়ামী মুসলিম লীগকে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার পক্ষে যে মতামত এসেছিল তার প্রেক্ষিতে ৩৮৯ ১৯৫৫ সালের ২২ অক্টোবর অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনে সদরঘাটের রূপমহল সিনেমা হলে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে সংগঠনের অসাম্প্রদায়িক নামকরণের জন্য দলের গঠনতন্ত্র পরিবর্তনের প্রস্তাব উত্থাপন করা হলে বিপুল আনন্দধ্বনির মাধ্যমে তা অনুমােদন লাভ করে। অসাম্প্রদায়িক নাম ধারণ করার মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলার বৃহত্তম রাজনৈতিক দলটি যে পাকিস্তানকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে গড়তে চায় তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন যে সকল প্রস্তাব গৃহীত হয় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পূর্ব বাংলার জন্যে স্বায়ত্তশাসন, অর্থনৈতিক মুক্তি ও বৈদেশিক নীতির রূপরেখা সংক্রান্ত দাবি-দাওয়া। এছাড়াও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক তৎপরতা গ্রাম-গঞ্জ পর্যন্ত সম্প্রসারিতকরণ এবং ২১ দফা বাস্তবায়নের সংগ্রাম অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে গুরুত্বারােপ করা হয়।৩৯২ ইতঃপূর্বে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির দাবিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার যে উন্মেষ ঘটে তার প্রেক্ষিতে পূর্ব বাংলার প্রধান রাজনৈতিক দলটির অসাম্প্রদায়িক নামকরণ খুবই যৌক্তিক ও প্রত্যাশিত ছিল। তদুপরি দলটিকে আরাে বিকশিত করার জন্যেও এটার প্রয়ােজনীয়তা অনুভূত হয়। কারণ হিন্দু বা অন্য সম্প্রদায়ের লােকেরা পূর্বে কংগ্রেস কিংবা কমিউনিস্ট পার্টিতে কাজ করতাে। বিগত নির্বাচনে কংগ্রেস দল বেশ কিছু আসন লাভ করলেও দলটি ক্রমাগত বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। অন্যদিকে কমিউনিস্ট পার্টিকে বেআইনি ঘােষণা করা হলে কমিউনিস্ট কর্মীরা প্রকাশ্যে কাজ করার সুযােগ হারায় । ১৯৫৬

——

৩৮৯ আবু আল সাঈদ, আওয়ামী লীগের ইতিহাস ১৯৪৯-১৯৭১ (ঢাকা: সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৩), পৃ. ৫৮। *** Shyamali Ghosh, op.cit., p. 21. এ বিষয়ে সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তব্য দেখুন, ড. আবুল কাশেম (সম্পা.), প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৫। ৩৯. আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৮। ৩৯, আবু আল সাঈদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৪। ৩৯৩ ড. নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬১।

১১৫

সাল থেকে কমিউনিস্ট কর্মীরা অন্য সংগঠনের ভিতরে অবস্থান করে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার রণনৈতিক কৌশল গ্রহণ করে। অবশ্য কমিউনিস্ট কর্মীরা তার পূর্ব হতেই আওয়ামী মুসলিম লীগের ভিতরে থেকে কাজ শুরু করেছিল।৩৯৪ এমতাবস্থায় পূর্ব বাংলার প্রধান রাজনৈতিক দলটির উপরিউক্ত পরিবর্তন বৃহত্তর জনগােষ্ঠীকে একটি রাজনৈতিক মঞ্চে আনার জন্য ছিল সময়ােপযােগী সিদ্ধান্ত । তদুপরি সংগঠনটি যে পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থা বাতিল ও অভিন্ন নির্বাচনী ব্যবস্থার পক্ষে আন্দোলন করে আসছে সেজন্যও এই পরিবর্তন প্রয়ােজন ছিল। অনেকের মতে এতদসত্ত্বেও চূড়ান্ত বিশ্লেষণে আওয়ামী লীগ ১৯৬৪ সালের পূর্বে তার অসাম্প্রদায়িক আদর্শের প্রমাণ দেয়ার সুযােগ পায়নি।৩৯৫

| ১৯৫৫ সালের এই কাউন্সিল অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের যে নতুন কার্যনির্বাহী কমিটি গঠিত হয় এর সভাপতি ও সম্পাদক পুনঃনির্বাচিত হন। যথাক্রমে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান। তাজউদ্দীন আহমদ নির্বাচিত হন সংস্কৃতি ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক। পরবর্তীকালে শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে তাজউদ্দীন আহমদ কিছুদিন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। একই সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৫৭ সাল। পর্যন্ত ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করতে থাকেন।৩৯৮। | আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়ায় ২০ জন পরিষদ। সদস্য আবদুস সালামের নেতৃত্বে পূর্ব নামকরণেই অবস্থান করেন। তারা কে.এস.পি. ও নেজামী ইসলামীকে সরকার গঠনের সমর্থন দেন। এইভাবে দলকে অসাম্প্রদায়িকীকরণ করতে গিয়ে নেতৃত্বকে দলবিভক্তির ঝুঁকি গ্রহণ করতে হয়। যুক্তফ্রন্টও এ সময় দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১৯৫৫ সালের শেষ নাগাদ পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক মেরুকরণে একদিকে আওয়ামী লীগ, অন্যদিকে কে.এস.পি, নেজামী ইসলামী ও আবদুস সালামের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী মুসলিম লীগ—এই দুই মেরুতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। অবশ্য গণতন্ত্রী দল ও কংগ্রেসের সদস্যরা আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ধারাটি

———-

৩৯৪ মণি সিংহ, জীবন-সংগ্রাম, প্রথম খণ্ড (ঢাকা: জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯১), পৃ. ১২৯ এবং ১৪০। ওর, ড, আবুল কাশেম, প্রাগুক্ত, সংকলন প্রসঙ্গে। ৩৯৬, আবু আল সাইদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৪। ৩৯”, জয় বাংলা, ৬ সংখ্যা, ১৮ জুন, ১৯৭১। ৩. সিমিন হােসেন রিমি (সম্পা.), তাজউদ্দিন আহমদ: ইতিহাসের পাতা থেকে (ঢাকা: প্রতিভাস, ১৪০৭ বঙ্গাব্দ), ফ্ল্যাপ দ্রষ্টব্য।

———-

ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক লাইন গ্রহণ করে। অন্যদিকে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতার মােহে রক্ষণশীল রাজনীতির লাইন গ্রহণ করে।৩৯৯ এভাবেই এক সময়ের অসাম্প্রদায়িক ফজলুল হক সাম্প্রদায়িক জোটের প্রধান হিসেবে এবং এককালের সাম্প্রদায়িক আওয়ামী মুসলিম লীগের সদস্যরা অসাম্প্রদায়িক আদর্শ প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

| ১৯৫৫ সালের জুন মাসে ৯২-ক ধারা প্রত্যাহারপূর্বক কেন্দ্রীয় সরকার কে.এস.পি. নেতা আবু হােসেন সরকারকে মন্ত্রিসভা গঠনের অনুমােদন দেয় ।৪০০ তখন থেকে আবু হােসেন সরকার ও ফজলুল হক কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে নানা আঁতাতের৪০১ মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়া আসা করেন। কিন্তু ২১ দফা উপেক্ষিত থেকে যায়। কেন্দ্রের সঙ্গে আঁতাত অনুযায়ী কে.এস.পি. আওয়ামী লীগ কর্তৃক উত্থাপিত অভিন্ন নির্বাচনী ব্যবস্থাকে সমর্থন না দেয়ায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা আবু হােসেন সরকারের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে নেন। ফলে আবু হােসেন সরকারের পতন হয় এবং তদস্থলে ১৯৫৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর প্রচণ্ড সংকটের মুখে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কোয়লিশন সরকার গঠিত হয়। প্রদেশে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠনের মাত্র ৫ দিনের মাথায় কেন্দ্রেও আওয়ামী লীগ ও রিপাবলিকান পার্টির কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। এর ফলে পাকিস্তানের উভয় অংশে প্রথমবারের মত আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়। এ পর্যায়ে অনেকের আশা জন্মে যে, এর মধ্য দিয়ে হয়তাে পাকিস্তানের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে যাচ্ছে। প্রদেশের ক্ষমতায় এসে আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভা ২১ দফার ভিত্তিতে দ্রুত কতিপয় যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ১৯৫৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ৫৯ জন রাজবন্দিকে মুক্তি দিয়ে ২১ দফার প্রতি আন্তরিকতার প্রকাশ ঘটায় । বাংলা ভাষার মাধ্যমে বাজেট পাস করিয়েও ২১ দফার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয় । এই

————

৩৯৯ড. মাে. মাহবুবর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩২। ৪০০ ঐ, পৃ. ১৩২।

“ফজলুল হকের গভর্নর পদ লাভ ও তার দলের মন্ত্রীসভা গঠনের অনুমতি লাভের পিছনে মুসলিম লীগকে দেয়া তাদের ২টি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি ছিল। প্রথমত পাকিস্তান গণপরিষদে পাস করার জন্য যে খসড়া সংবিধান পেশ করা হবে তা দল সমর্থন করবে । দ্বিতীয়ত আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত যৌথনির্বাচনী ব্যবস্থা ও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি সমর্থন করবেনা।” ঐ, পৃ. ১৩৩।

আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৫। ঐ, পৃ. ৩৬।

সরকার ১৯৫৬ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর হতে ১ অক্টোবরের মধ্যে কতিপয় যুগান্তকারী। প্রস্তাব গ্রহণ করে। ৪০৪ এ সময় ২১ দফা কেন্দ্র ও প্রাদেশে বাস্তবায়নের যথাসম্ভব সুযােগ আসে । ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান ব্যবস্থাপক পরিষদে প্রায় সর্বসম্মতিক্রমে একটি বেসরকারি প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই প্রস্তাব অনুযায়ী প্রাদেশিক সরকার কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক সভার নিকট দেশরক্ষা, বৈদেশিক বিষয় ও মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে রেখে সকল বিষয় প্রাদেশিক সরকারের এখতিয়ারে ছেড়ে দেয়ার সুপারিশ করে। ৪০৫ কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলাে এই প্রস্তাবে পশ্চিম পাকিস্তানে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গােলাম আলী তালপুর এই প্রস্তাবকে কমিউনিস্ট প্রভাবিত সাক্ষাৎ পরিণতি এবং ভারতের পশ্চিম বাংলার সাথে পূর্ব বাংলার সংযুক্তির অন্যতম পদক্ষেপ’ বলে বর্ণনা করেন । তিনি কঠোরহস্তে এ ধরনের প্রচেষ্টা দমনের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। অদ্ভুত ব্যাপার এই যে, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সম্মিলিত প্রস্তাবকে একজন মন্ত্রী কিভাবে হুমকি দিতে পারেন! এতেই বুঝা যায় পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক লেবাসটা কত পাতলা ছিল। প্রকৃতপক্ষে। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকচক্রের ভয় ছিল বাঙালির সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে । ১৯৫০ সাল থেকে সংবিধান প্রণয়নের জন্য যে সকল রির্পোট পেশ করা হয় তাতে উভয় অঞ্চলের জনসংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের পরিবর্তে সংখ্যাসাম্যের প্রতি গুরুত্বারােপ করা হয়েছিল । পরিশেষে ১৯৫৬ সালে যে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হয়। তাতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে দুটো ইউনিটে ভাগ করে এই ভীতি হতে তারা আপাতত মুক্ত হতে চেয়েছিলেন। তবে তারা এটাকেও নিরাপদ মনে করতে পারেননি। বছর দেড়েকের ব্যবধানে পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক আমলারা ক্ষমতা জবরদখল করলে বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের দাবি নস্যাৎ হয়ে যায় । আওয়ামী লীগ বরাবরই স্বায়ত্তশাসন ও যৌথনির্বাচনী ব্যবস্থার পক্ষে জোর দাবি জানিয়ে আসে। তাই এসব উদার ও গণতান্ত্রিক রীতিনীতি বর্জিত যে সংবিধান ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ গণপরিষদে উত্থাপন করা হয় আওয়ামী লীগ তার তীব্র

————

৪০৮ (১) প্রদেশের সরকারী কাজে যত দ্রুত সম্ভব বাংলা ভাষার ব্যবহার প্রবর্তন করা হবে, (২) ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুট করতে গিয়ে যারা শহীদ হন তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্য চট্টগ্রামে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হবে, (৩) দেশে যুক্তনির্বাচন ব্যবস্থা। প্রবর্তনের জন্য প্রস্তাব গৃহীত হয়, (৪) জননিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়।” ঐ, পৃ. ৩৮। ৪০৫ ঐ, পৃ. ৪১। ৪০৬, ঐ, পৃ. ৪১।

Shyamali Ghosh, op.cit., p. 29.

বিরােধিতা করে। কিন্তু তাতে কোনাে লাভ হয়নি। বরং ঐ সংবিধানে পূর্ব বাংলার নাম মুছে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান করা হয়। ৪০৮ উদীয়মান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। গণপরিষদে এই পরিবর্তনের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন যে, বাংলা’ শব্দটির নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্য রয়েছে। কাজেই অঞ্চলের নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান করার পূর্বে গণভােট করা আবশ্যক।৪০৯ তবে ইতিহাসের সত্যকে স্বীকার করে নিয়ে এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, পাকিস্তানের জন্মের পর হতে পূর্ব বাংলার পক্ষ থেকে বিভিন্ন বিষয়ের নামকরণের ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান শব্দটি ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।

আতাউর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিপরিষদ ১৯৫৮ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষমতায় টিকে থাকে। এরপর সমগ্র পাকিস্তানের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে প্রদেশে ব্যাপক ওলট পালট হয় যা নাটক অপেক্ষা অধিক নাটকীয়। আওয়ামী লীগের আতাউর রহমানের পরিবর্তে কে.এস.পি-এর আবু হােসেন সরকার ১৯৫৮ সালের ৩১ মার্চ রাত ১১টায় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন। এমতাবস্থায় হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী ফিরােজ খান নুনকে জানান যে, অবিলম্বে গভর্নর ফজলুল হককে বরখাস্ত করা না হলে তার দল। আওয়ামী লীগ নুন মন্ত্রিসভার প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে নেবে। কাজেই ফিরােজ খান নুন ফজলুল হককে বাংলার গভর্নরের পদ হতে বরখাস্ত করতে বাধ্য হন। ফলে তাৎক্ষণিকভাবে গভর্নর নিয়ােগ দেয়া হয় অবাঙালি মুখ্যসচিব আবদুল হামিদকে। তিনি নিয়ােগপ্রাপ্ত হয়েই আবু হােসেন সরকারকে পদচ্যুত করে আবার আতাউর রহমানকে মুখ্যমন্ত্রী পদে নিয়ােগ দান করেন। ফলে আবু হােসেন। সরকার পরদিন সকালে (১ এপ্রিল) পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। কাজেই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে (৩১ মার্চ -১ এপ্রিল ১৯৫৮) পূর্ব পাকিস্তানে তিনটি মন্ত্রিসভার উত্থান-পতন এবং একজন গভর্নরের পতন ও অন্য একজনের নিযুক্তি ঘটে। এর অনতিবিলম্বে ১৯৫৮ সালের ১৮ জুন আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিপরিষদ খাদ্য পরিস্থিতির ওপর অনাস্থা ভােটে হেরে যায়। এমতাবস্থায় ২০ জুন কে এস.পি-এর আবু হােসেন সরকার আবার ক্ষমতায় ফিরে আসেন। ২-৩ দিনের ব্যবধানে অনাস্থাভােটে এই নতুন মন্ত্রিসভারও পতন ঘটে। ফলে ২৫ জুন পূর্ব

———-

৪০৮, ড, মযহারুল ইসলাম ও অন্যান্য (সম্পা.), জাতীয় চার নেতা স্মারক গ্রন্থ (ঢাকা: জাতীয় চার নেতা পরিষদ, ১৯৯৬), পৃ. ১৫৪। ০৯. দলিলপত্র প্রথম খণ্ড, পৃ. ৪৩১। ৪১০ ড, প্রীতি কুমার মিত্র, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস ১৯৫৮-১৯৬৬, প্রফেসর সালাহউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্য (সম্পা.), প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৪। ৪১১ আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫১।

————

বাংলায় পুনরায় গভর্নরের শাসন জারি করা হয়। এর দুই মাস পরে আতাউর রহমানকে পুনরায় মন্ত্রিসভা গঠনের আহবান জানানাে হয় । তার মন্ত্রিসভা গঠনের পরে ৩০ আগস্ট বাজেট অধিবেশন শুরু হয়। এ সময় ন্যাপ দলীয় সদস্য মাহবুবুল হক (১৯২৩-১৯৭৪) স্পিকার আবদুল হাকিমের বিরুদ্ধে (স্পিকার ছিলেন কে.এস.পি-এর সদস্য) অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করলে অধিকাংশ সদস্য তাকে সমর্থন দেন। স্পিকার এমতাবস্থায় অধিবেশন স্থগিত না করে সভাকক্ষ ত্যাগ করেন। পরবর্তী সেশনে ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী (১৮৯৯-১৯৫৮) বিরােধীদলীয় সদস্যদের নিষেধ সত্ত্বেও স্পিকারের আসন গ্রহণপূর্বক অধিবেশন শুরু করলে ২১ সেপ্টেম্বর সামান্য তর্ককে কেন্দ্র করে বিরােধিদলীয় সদস্যরা তার ওপর আক্রমণ করে বসেন। শাহেদ আলী মারাত্মক আহত হন এবং ২৫ সেপ্টেম্বর তার মৃত্যু ঘটে। পাকিস্তানের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে এ এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। এ গােলযােগ কে বা কারা কোন উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করে তার চেয়ে বড় কথা হলাে এটি সংসদীয় রাজনীতি চর্চায় নেতাদের অসহিষ্ণু মনােভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। এর ফলাফল হয় ভয়াবহ । এমনিতেই পূর্ব পাকিস্ত েিনর রাজনীতিতে ক্ষমতা দখল পুনর্দখলকে কেন্দ্র করে অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয়েছিল, তারপর এই ন্যাক্কারজনক ঘটনা সংসদীয় গণতন্ত্রের কফিনে যেন শেষ পেরেক মেরে দেয়। এ ঘটনার পর নেপথ্যের চক্রান্তকারীরা বেরিয়ে আসে সামরিক উর্দি পরে । বস্তুত আসন্ন সাধারণ নির্বাচন বানচাল করার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে এই ঘটনা ঘটনানাে হয়। উপরিউক্ত রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার বেনিফিশিয়ারী হয় সামরিক ও বেসামরিক আমলাচক্র। প্রকৃতপক্ষে দুর্বল প্রকৃতির হলেও বিদ্যমান গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করে সামরিক শাসন জারির পথ প্রশস্ত করাই ছিল তাদের লক্ষ্য।”* পরবর্তীকালে জেনারেল আইয়ুব খান হয়ে ওঠেন পাকিস্তানের ভাগ্যনিয়ন্তা। তিনি প্রথমে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জাকে দিয়ে সুকৌশলে গণপরিষদ ও শাসনতন্ত্র বাতিল করিয়ে নেন। ধারাবাহিক অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে তিনি জনগণের নিকট রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের প্রতি অশ্রদ্ধা জাগিয়ে তােলেন। তারপর নিজে আবির্ভূত হন। পাকিস্তানের ভাগ্যবিধাতারূপে।৪১৫

এভাবে ১৯৫৪ সালের মার্চ মাস থেকে ১৯৫৮ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত মাঝেমধ্যেই বাধাগ্রস্ত হলেও পাকিস্তানে সংসদীয় রাজনীতি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে

————-

৪১২, ড. প্রীতি কুমার মিত্র, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৫।

৪১৩. ড. নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭১। ৪১৪. ঐ, পৃ. ৭১-৭২। ৪১৫ ড. প্রীতি কুমার মিত্র, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯০।

১২০

চলছিল। এ সময়ের মধ্যে ৭ টি মন্ত্রিসভা গঠিত হয় এবং তিনবার গভর্নরের। শাসন জারি করা হয়। ১৯৫৮ সালে বাজেটের ব্যাপারে ৪ টি মন্ত্রিসভার পতন ঘটে। পরিশেষে আইন পরিষদে এক কলঙ্কজনক ঘটনার মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলায়। তথা পাকিস্তানের এক দশকের গণতান্ত্রিক রাজনীতির সমাধি রচিত হয়।৪১৬

| পাকিস্তানের এই পর্বের রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতি লক্ষ্য করে তাজউদ্দীন। আহমদের বিশ্বাস দৃঢ়মূল হয় যে, পূর্ব বাংলা বেশিদিন পাকিস্তান কাঠামােতে থাকতে পারে না। প্রাক্তন সি.এস.পি, শামসুর রহমান খান কর্তৃক প্রদত্ত একটি তথ্য হতে এর ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তিনি এক সময় তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্যদের ন্যায় রাজনীতির সাথে কিছুটা যুক্ত ছিলেন। তিনি পরে পাকিস্তান সুপিরিয়র সার্ভিসে চাকরি গ্রহণ করেন। এর কিছুকাল পরে একদিন একটি অনুষ্ঠানে তাজউদ্দীন আহমদ ও শামসুর রহমান পাশাপাশি বসেন। কথােপথনের এক পর্যায়ে তাজউদ্দীন শামসুর রহমানকে জানান যে, দেশ প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন হয়নি। সুতরাং ভবিষ্যৎ স্বাধীন দেশের জন্য শামসুর রহমানদের ন্যায় দেশপ্রেমিক মেধাবী প্রশাসকের দরকার হবে। এটি ১৯৫২ সনের ঘটনা” যখন কেউ বাংলার স্বাধীনতার কথা চিন্তা করেছিলেন বলে জানা যায় না, তখন তাজউদ্দীন আহমদের এ ধরনের ধ্যান-ধারণা বিস্ময় উদ্রেক করে। পরবর্তীকালে ৬ দফা প্রণয়নসহ স্বাধীনতা যুদ্ধে শামসুর রহমান সত্যিই তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্যদের সঙ্গে অনেক বিষয়ে একত্রে কাজ করেন।

আওয়ামী লীগের এই সময়ের রাজনৈতিক সম্ভাবনা ও সংকট সম্পর্কেও সম্যক আলােকপাত আবশ্যক। পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে যে, দলের নাম হতে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়ার ফলে আওয়ামী লীগকে প্রথম বিভক্তির মুখে পড়তে হয়েছিল। ক্ষমতায় আসার পর সংকট সৃষ্টি হয় পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে। পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সিয়াটো’ ‘সেন্টো’ সামরিক জোটে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তিকে সমর্থন করেন। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তান। আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পাকিস্তানের উক্ত জোটভুক্তিকে মেনে নিতে পারেননি। তাই ১৯৫৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি কাগমারী। সম্মেলনের পর পররাষ্ট্রনীতি ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের আর একটি বিভক্তি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ৪১৮উক্ত ইস্যুতে মওলানা ভাসানী ১৯৫৭ সালের ১৮ মার্চ

————–

*৪১৬*, ড. মাে. মাহবুবর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৬।

” সিমিন হােসেন রিমি, তাজউদ্দীন আহমদ-আলােকের অনন্তধারা, প্রথম খণ্ড (ঢাকা: প্রতিভাস, ২০০৬), পৃ. ৩৫৩-৩৫৪। ** “কাগমারী সম্মেলনের পরেই বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে সােহরাওয়ার্দী ও ভাসানী তথা তাদের সমর্থকদের মধ্যকার কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশ্যে হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন,

———-

পদত্যাগ করেন। তিনি অবশ্য পদত্যাগপত্রে পররাষ্ট্র বিষয়ে মতানৈক্যের কথা উল্লেখ না করে বরং সরকারের অনৈসলামিক কার্যক্রম বন্ধের ব্যর্থতা এবং ২১ দফা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ না করাকে পদত্যাগের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। তকালীন রাজনৈতিক ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কেবলমাত্র পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে এই বিরােধ উপস্থিত হয়নি। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী কেন্দ্রে রিপাবলিকানদের সঙ্গে যােগ দিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন। বাঙালিরা স্বাভাবিকভাবে আশা করেছিল যে, এবার হয়তাে ২১ দফাসহ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন বাস্তবায়ন করার সুযােগ আসতে পারে । কিন্তু তার পক্ষে সেটা করা সম্ভব হয়নি। কারণ কোয়ালিশনে রিপাবলিকানরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং তারা স্বতন্ত্র নির্বাচনী ব্যবস্থাসহ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনবিরােধী ছিল। কিন্তু এসব বিষয়ে না গিয়ে সােহরাওয়ার্দী বিভিন্ন ফোরামে স্বায়ত্তশাসন, ২১ দফা প্রভৃতি সম্পর্কে স্বৈরাচারী প্রকৃতির মন্তব্য করতে থাকেন। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারে ১৯৫৭ সালে ঢাকায় পল্টন ময়দানের একটি জনসভায় তিনি বলেন যে, ১৯৫৬ সালের সংবিধানে পুর্ব পাকিস্তানকে ৯৮ ভাগ স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়েছে। অথচ তার দল আওয়ামী লীগ এই সংবিধানকে প্রত্যাখ্যান করে। তার এ ধরনের উক্তি ছিল মূলত আওয়ামী লীগের নীতি ও আদর্শবিরােধী।

| এ সময় আওয়ামী লীগের রাজনীতি পর্যালােচনা করলে দুটি ধারার সন্ধান পাওয়া যায়। একটি ধারা হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ। অন্য ধারাটি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, অলি আহাদ ও অন্যান্যরা। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক অসুস্থ হয়ে পড়লে শেখ মুজিবুর রহমানকে ঐ দলের সাধারণ সম্পাদক করা হয় মূলত হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী গ্রুপের চেষ্টায় । এমতাবস্থায় ভাসানী অলি আহাদকে সম্পাদক করতে আগ্রহী ছিলেন বলে জানা যায় । কিন্তু সেটা না হওয়া ভাসানীর। পদত্যাগের একটি কারণ বলে অলি আহাদ উল্লেখ করেন। যাহােক, পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারের জন্য দলের পক্ষ থেকে ভাসানীর প্রতি অনুরােধ জানানাে হয় । কিন্তু

—————–

পূর্ব পাকিস্তানকে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন না দিলে এবং সরকারী চাকুরী, ব্যবসা বাণিজ্য, শিল্পায়ন ও অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সংখ্যাসাম্য নীতি অনুসৃত না হলে পূর্ব পাকিস্তান ‘আস্সালামু আলাইকুম’ বলবে।” আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪০। ৪১৯ ঔ, পৃ. ২৩২। b২০ “মন্ত্রীত্ব বনাম সাংগঠনিক মতবিরােধ সম্পর্কে জনৈক সাংবাদিকের প্রশ্নের জওয়াবে। মন্তব্য করেন, আওয়ামী লীগ আবার কি? আমিই আওয়ামী লীগ। অন্য এক প্রশ্নের জওয়াবে তিনি বিস্ময়করভাবে অবলীলাক্রমে বলেন, আমিই আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টো’ ।” অলি আহাদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯২। ৪২১ ঐ, পৃ. ১৯৯।

———-

তিনি পদত্যাগপত্র পেশের কয়েকদিন পরেই তার স্বভাবজাতভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। পরিশেষে ১৭ এপ্রিল ইত্তেফাকের রিপাের্ট হতে জানা যায় যে, মওলানা ভাসানী সিরাজগঞ্জ মহকুমার সােহাগপুর গ্রামের নিকট যমুনা নদীতে একটি নৌকায় অবস্থান করছেন। ইতঃপূর্বে তিনি জানিয়েছিলেন যে, প্রধানমন্ত্রী হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর সঙ্গে আলােচনা করে পদত্যাগপত্র পুনর্বিবেচনা করবেন । প্রধানমন্ত্রী রাজি হন এবং ১৬ এপ্রিলের মধ্যে তাকে করাচী যাওয়ার অনুরােধ জানান। ভাসানীর সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দলের সমাজকল্যাণ ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক এবং মওলানার হেভাজন তাজউদ্দীন আহমদকে শেখ মুজিবুর রহমানের একটি বার্তাসহ সী প্লেনযােগে তার নিকট প্রেরণ করা হয়।৪২২তিনি শেষাবধি তার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। বরং জুন মাসের মাঝামাঝিতে গােস্বা করে বলেন: ২৩ “আমাকে না জানিয়েই এখন আওয়ামী লীগ বড় বড় সিদ্ধান্ত নিচ্ছে,

ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য মনােনীত করা হলাে, আমাকে না জানিয়েই। আমাকে কি | আর আওয়ামী লীগের প্রয়ােজন আছে?” এমতাবস্থায় তিনি নতুন দল গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। জুলাই মাসের চতুর্থ সপ্তাহে ঢাকায় পাকিস্তানের গণতন্ত্রকামী সংগঠনগুলাের একটি সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ভাসানী নতুন আর একটি রাজনৈতিক দল গঠনের প্রাথমিক কাজকর্মে অগ্রসর হন। ১৯৫৭ সালের ২৫ ও ২৬ জুলাই রূপমহল সিনেমা হলে এই সম্মেলন হয়। ২৬ জুলাই ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নামে একটি নতুন দলের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ঘটে।** মওলানা ভাসানীর এই নতুন দলে (NAP, National Awami Party) কমিউনিস্ট কর্মীদের সমাবেশ ঘটে।২৫ তাজউদ্দীন আহমদের অন্যান্য ঘনিষ্ট রাজনেতিক সহকর্মী যেমন ডা. করিম, মােহাম্মদ তােয়াহা ও অন্যান্যরা এই নবগঠিত দলে যােগদান করলেও তিনি আওয়ামী লীগে থেকে যান। তার প্রত্যয় জন্মে যে, পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক বিকাশের এই স্তরে ন্যাপ একটি বিভ্রান্ত ধারার রাজনীতিতে প্রবেশ করতে যাচ্ছে । তদুপরি জনগণের নিকট বহুল পরিচিত এবং তরুণদের নেতৃত্বে পরিচালিত উদারনৈতিক ভাবধারার বৃহত্তম দল আওয়ামী লীগের মাধ্যমেই পূর্ব বাংলার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা তথা স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়াই বাস্তবসম্মত বলে তাজউদ্দীন আহমদের প্রত্যয় জন্মে।

————

৪২২, আবু আল সাঈদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৯। **. আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৩-৪৪। ৪২৫, ঐ, পৃ. ৪৫। ৪২৫ খােকা রায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬৪। ৪২৬ ডা. করিমের রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০০০।

—–

তার এই ধরনের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা সম্পর্কে বাংলাদেশের ইতিহাসের বহু ঘটনার সাক্ষী শিক্ষাবিদ ড. আনিসুজ্জামান বলেন:৪২৭

মওলানা ভাসানী যখন আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে ন্যাপ গঠন করলেন তখন তাজউদ্দীন সাহেব আওয়ামী লীগে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, যদিও ভাসানীর। সঙ্গে ওর খুবই ঘনিষ্ঠতা ছিল। কিন্তু ওঁর একটা সন্দেহ ছিল যে, আমাদের এখানে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে উঠছে, এইটা ভাঙার একটা চেষ্টা ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের। পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে অবশ্য তাজউদ্দীন আহমদ মওলানা সাহেবের সঙ্গে একমত ছিলেন। অর্থাৎ যুদ্ধজোট বিরােধী’ এবং মার্কিন ঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতি, যেটা সােহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হয়ে চালিয়েছিলেন-এটার বিরােধী ছিলেন। কিন্তু ওঁর মনে হয়েছিল-আমি যতটুকু বুঝতে পারি যে, আওয়ামী লীগ ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করছে এবং দেশের এই জাতীয়তাবাদী শক্তি হিসেবে প্রধান সংগঠনে পরিণত হচ্ছেঠিক এমন সময় এটাকে ভাঙ্গা ঠিক হবে না। বরঞ্চ ভিতরে থেকে এসব বিষয়ে সামরিক জোট থেকে কিংবা পররাষ্ট্রনীতির অন্য কোনাে প্রসঙ্গ হােক সংগ্রাম করা ভাল । আর এর বিকল্প যেটা ছিল, যদি মােটামুটি প্রগতিশীল ভাবধারার লােকজন আওয়ামী লীগ থেকে চলে যান, তাহলে আওয়ামী লীগ অপেক্ষাকৃত দক্ষিণপন্থীদের হাতে পড়বে। কাজেই ঐ রকমের চিন্তা থেকেই উনি (তাজউদ্দীন) রয়ে গেলেন

আওয়ামী লীগে। তিনি আওয়ামী লীগে থেকেই একদিকে দলে নিজের স্থান শক্তিশালী করেন অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের বিকাশমান বৃহত্তম জাতীয়তাবাদী এই দলটিকে সঠিক পথে পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। | ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হওয়ার কিছুদিন পূর্বে তাজউদ্দীন আহমদ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র হতে একটি কৃষিবিষয়ক সেমিনার শেষে দেশে ফিরে আসেন। আওয়ামী লীগ দলীয় ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে দল তাকে উক্ত | সেমিনারে যােগদানের জন্যে প্রেরণ করেছিল।২৮ সামরিক শাসন জারির সঙ্গে সঙ্গে নেতাদের গ্রেফতার শুরু হলে তিনিও আত্মগােপন করতে বাধ্য হন। কিন্তু একেবারে চুপচাপ বসে থাকেননি । গ্রেফতার এড়িয়ে তাজউদ্দীন আহমদ দেশের বিভিন্ন জেলাতে সাংগঠনিক কাজকর্ম অব্যাহত রাখেন বলে জানা যায় । বিষয়টি সরকারের গােয়েন্দা সংস্থার নজরে আসে। অতঃপর আদালতে তার বিরুদ্ধে। একটি অভিযােগ উত্থাপিত হয়। সরকার অবশ্য এই অভিযােগ প্রমাণ করতে

————

| ৪২৭ ড. আনিসুজ্জামানের রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০০০। | ৪২৮ সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন ও সিমিন হােসেন রিমির রেকর্ডকৃত সাক্ষাঙ্কার, ২ মে, ২০০১। ***. Shyamali Ghosh, op.cit., p. 48.

——–

পারেনি। সামরিক শাসন জারি হওয়ার কিছু পরে তিনি একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকুরি গ্রহণ করেন।৪৩০ সে সুবাদে তিনি মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন জেলা সফরে যেতেন এবং একই সঙ্গে সাংগঠনিক যােগাযােগ রক্ষা করতেন। এ ধরনের সফর কতটা রাজনৈতিক এবং কতটা চাকরি সংক্রান্ত ছিল তা বলা মুশকিল। কিন্তু সরকারের গােয়েন্দা সংস্থা রিপাের্ট করে যে, তাজউদ্দীন আহমদ গােপনে সাংগঠনিক কাজে সারা দেশ সফর করছেন।”৪৩১

বিরাজমান রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার কারণে আইয়ুব খানের ক্ষমতাগ্রহণকে সাধারণ মানুষ এবং রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন শিক্ষিত মহলও অনেকটা আশ্বস্ত হয় । কিন্তু নেতৃবৃন্দকে যেভাবে ধরপাকড় শুরু করা হয় এবং সামরিক আইন ছাড়াও বিভিন্ন নির্যাতনমূলক আদেশের মাধ্যমে রাজনীতি চর্চাকে দমন করা হয় তা দেখে অল্প সময়ের মধ্যে সচেতন মহলের আইয়ুব খানের প্রকৃত উদ্দেশ্য বুঝতে বিলম্ব হয়নি। অচিরেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, আইযুব খান দেশ সেবার মহান ব্রত নিয়ে ক্ষমতায় আসেননি; তিনি এসেছেন বিদ্যমান ন্যুনতম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটুকুও ভেঙে দিয়ে সামরিক একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে। আবদুল হক এ বিষয়ে লিখেন:৪৩৩

এসব যে সামরিক চালবাজি, ভাল মানুষী দেখিয়ে গণসমর্থন আদায়ের কৌশল মাত্র তা পরে ক্রমে ক্রমে প্রকাশ পেয়েছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল গণতন্ত্র বানচাল করা, গণতন্ত্র বানচালের মারফত বাঙালীদের স্বাধিকার আন্দোলন দমন করা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক, অর্থনেতিক, সামরিক সর্বপ্রকার আধিপত্য চিরস্থায়ী করা । ১৯৫৮/৫৯ সালে সাধারণ নির্বাচন হলে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে এসব ক্ষেত্রে বাঙালিরা তাদের ন্যায্য হিস্যা দাবি করতাে, কিছু আদায়ও করতে পারতাে। এ সম্ভাবনাকে রােধ করা হয় এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সর্বপ্রকার আধিপত্য চিরস্থায়ী করার একমাত্র উপায় ছিল সামরিক শাসন জারি করা।

————–

৪৩০ মুনতাসীর মামুন, ‘এক তরুণের রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠা, জনকণ্ঠ, ৪ অক্টোবর, ২০০০। ৩৯ “এরপর তাজউদ্দীনের সাথে আমার আবার দেখা ১৯৬২ সালে। আমি তখন বরিশালে । তাজউদ্দীন সেই সময় সম্ভবত কোন একটা লঞ্চ কোম্পানিতে কিছুদিন কাজ করেছিল। সেই কাজের সূত্রেই ঢাকা থেকে বরিশালে গিয়ে আমার বাসায় তিন-চারদিন ছিল। পরে শুনলাম স্পেশাল ব্রাঞ্চ তার বিরুদ্ধে রিপাের্ট করেছে যে, তাজউদ্দীন বরিশাল গিয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছে।” ওয়হিদুজ্জামানের সাক্ষাৎকার, ৩ এপ্রিল, ১৯৯১। ৪৩২, ড. প্রীতি কুমার মিত্র, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯১। ৪৩৩ আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬১।

১২৫

আইয়ুব খান তার সামরিক শাসনকে বেসামরিক প্রলেপ দেয়ার জন্য ১৯৫৯ সালে মৌলিক গণতন্ত্র নামে এক অভিনব রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। এর অর্থ হচ্ছে পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল হতে মােট আশি হাজার বুনিয়াদী গণতন্ত্রী নির্বাচিত হবেন জনগণের ভােটে।৪৩৪ তাদের ভােটেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচত হবেন । এরাই হলেন সামরিক শাসক আইয়ুব খানের টিকে থাকার ভিত্তি । তৃণমূল পর্যায়ে তার ক্ষমতাকে সুদৃঢ় করাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য ।* এরাই ১৯৬০ সালে গণভােটের মাধ্যমে আইয়ুব খানকে পরবর্তী ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত করেন। সীমিতসংখ্যক BD মেম্বারকে প্রভাবিত করে অতি সহজেই তিনি এই বিজয়ের নিশ্চিত ব্যবস্থা করেন।৪৩৫ নির্বাচিত হয়ে আইযুব খান ১৯৬২ সালে নিজের জন্য। সুবিধাজনক একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করেন। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে যেটুকু স্বায়ত্তশাসনের সুযােগ রাখা হয়েছিল ১৯৬২ সালের সংবিধানে তাও কেড়ে নেয়া। হয় ।

রাজনৈতিক পুনরুজ্জীবন

আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের গােড়ার দিকে ৪৪ মাসে তার বিরুদ্ধে কোনাে প্রকাশ্য আন্দোলন সংঘটিত হতে পারেনি। তবে পরােক্ষভাবে ছাত্র, সাংবাদিক এবং কিছু রাজনীতিবিদ নানা কৌশলে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে বক্তব্য উপস্থাপন করেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই সময়ে বলতে গেলে কোনাে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডই পরিচালিত হতে পারেনি। কাজেই রাজনৈতিক নেতাদের এ সময়ের কার্যকলাপ সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। তবে বিদ্যমান বাস্তবতায় বাঙালির আত্ম অনুসন্ধানের কাল ছিল এটি। কেননা এই সময় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে না পারলেও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সরকারের নানা চক্রান্তের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ আন্দোলন থেমে যায়নি। বলা যেতে পারে এই সময় একটি প্রস্তুতি শুরু হয় লােকচক্ষুর অন্তরালে। এর ফলে ষাটের দশকের মাঝামাঝি নাগাদ সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক এলিটদের সঙ্গে জাতীয়তাবাদী উপাদানের সংমিশ্রণে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলন চূড়ান্ত আকার ধারণ করে এবং ১৯৭১ সালের। মুক্তিযুদ্ধে তা পরিব্যাপ্ত হয়।৪৩৮।

————-

৪৩৪. ড. মাে. মাহবুবর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৪-১৫৫। ৪৩৫, ঐ, পৃ. ১৫৬। ৪৩৬, ঐ, পৃ. ১৫৬। ৪৩৭ ঐ, পৃ. ১৬৩।৪৩৮ ডক্টর আবুল কাশেম, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, উন্মেষ, পৃ. ৩৫-৩৬।

——–

তাজউদ্দীন আহমদ এই সময় উল্লিখিত বেসরকারি সংস্থার ব্যবস্থাপক হিসেবে অফিস ব্যবস্থাপনা, শৃঙ্খলা, নিয়মনিষ্ঠা, ব্যক্তিত্ব প্রভৃতি ক্ষেত্রে চিত্তাকর্ষক উদাহরণ সৃষ্টি করেন।৪৩৯ এসব সৎ ও অনুকরণীয় গুণাবলির কারণে মালিক কয়েক মাসের ব্যবধানে তার বেতন ৩০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০০ টাকায় উন্নীত করেন। দাপ্তরিক নিয়ম কানুন সম্পর্কে তাজউদ্দীন আহমদের প্রখর মাত্ৰাজ্ঞানের সঙ্গে মালিকের নীতি ও কর্মচারিদের আচরণের বৈসাদৃশ্য হওয়ায় লােভনীয় ঐ চাকরিটি ছেড়ে দেন। ঘটনাটি ছিল এরকম—মালিকের এক ভাগ্নে ঐ অফিসের স্টোর কিপার পদে চাকরি করত । কেনাকাটার ক্যাশ মেমােতে ঐ ব্যক্তি টাকার অংকের হেরফের করে দুর্নীতি করত। বিষয়টি তাজউদ্দীন আহমদের নজরে এলে তাকে বরখাস্ত করেন। পরদিন জানতে পারেন যে, মালিক তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। এতে তিনি মালিককে বলেন কাজটি তিনি ভাল করেননি। ক্ষমা করতে হলে নিয়মানুযায়ী ম্যানেজারের মাধ্যমে করা উচিত। এতে মালিক লজ্জাবােধ করেন এবং তাজউদ্দীন আহমদের নিকট ক্ষমা চেয়ে বলেন যে, ভবিষ্যতে আর এমন হবে না । কিন্তু এরপরও দুবার এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে। তাজউদ্দীন আহমদ নিজেই চাকরি ছেড়ে দেন।৪৪০

ইতােমধ্যে আইয়ুব খান তার নিজের স্বার্থেই সীমিত পরিসরে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সুযােগ দেন। ১৯৬২ সালে তার নির্দেশে সংবিধান প্রণীত হওয়ার আগেই এই রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। সামগ্রিকভাবে এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিরােধী রাজনীতিও সংগঠিত হতে শুরু করে। নতুন এই উদ্যোগের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদ কিভাবে যুক্ত হন তার ইঙ্গিত মেলে শেখ মুজিবুর রহমানের ফুফাতাে ভাই মমিনুল ইসলাম খােকার স্মৃতিচারণ থেকে। তিনি এক স্থানে লিখেছেন:৪৪১

চল তাে আমার সাথে একটু নারায়ণগঞ্জের দিকে। মিয়া ভাই শেখ মুজিবুর রহমান নিজে গাড়ী চালিয়ে হামিদুল হক চৌধুরীর ভাগিনা রহিম চৌধুরীর আয়রন রডের এক বিশাল কারখানার কাছে এসে পৌছাই। সেখানে দেখি এক দ্রলােক চেয়ারে বসে কি কাজ করছেন। তার কাছে গিয়ে শেখ মুজিব বললেন ‘হয়েছে, নে চল, গাড়ীতে ওঠ’ । ভদ্রলােক বললেন আমি কাজ করছি তাে। আর আপনি কি করে জানলেন আমি এখানে? শেখ মুজিব বললেন- “আর কথা বলতে হবে না,

—————

৪৩৯ এম. এ. মােহাইমেন, স্বনির্বাচিত সভাপতি ও অন্যান্য চরিত্র (ঢাকা: পাইওনিয়ার পাবলিকেশান্স, ১৯৯১), পৃ. ৬-৭। ৪৪০ ঐ, পৃ. ৭-৮। ৪৪১ মুনতাসীর মামুন, তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরী এক তরুণের রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠা”, জনকণ্ঠ, ৪ অক্টোবর, ২০০০।

আমি লিলির কাছ থেকে শুনেই এসেছি। তারপর ঐ ভদ্রলােককে নিয়ে আমরা ঢাকায় ফিরে আসি। ঐ ভদ্রলােক আর কেউ নন। স্বাধীনতা যুদ্ধে সেই নয় মাস যিনি বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, নরপশুর বুলেট যাকে রেহাই দেয়নি। তিনি সেই সর্বজন শ্রদ্ধেয় তাজউদ্দিন আহমদ এবং লিলি ভাবী হচ্ছেন তার ভাবী স্ত্রী

জোহরা তাজউদ্দিন। মমিনুল ইসলাম খােকা ন্যাপ গঠনের অল্প পরের ঘটনা বলে এটিকে উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে তাজউদ্দীন আহমদের স্ত্রী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন বলেন, এটি ছিল ১৯৬২ সালের ঘটনা। | বাঙালির স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনের ইতিহাসে ১৯৬২ সাল মাইলফলকবিশেষ। একদিকে আইয়ুব খান কর্তৃক রাজনৈতিক সকল রীতিনীতি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে নিজের কর্তৃত্ব সর্বব্যাপী করার মানসে বিভিন্ন ধরনের দমনমূলক আইন প্রণয়ন, অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলাের পক্ষ থেকে সংগঠিত হওয়ার উদ্যমহীনতা—এই দ্বিবিধ কারণের সঙ্গে শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের গণবিরােধী নীতির প্রেক্ষিতে ছাত্র সমাজ রাজনৈতিক স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে ১৯৬১ সালের গােড়ার দিক থেকেই আন্দোলনমুখী হয়ে ওঠে। পাকিস্তানের রাজনীতিতে এই পরিবর্তনের বিষয়টি ঘটে কয়েকটি নির্ধারক কারণে। ১৯৬১ সালে শহীদ দিবস পালনকে সামনে রেখে নিষিদ্ধ ঘােষিত কমিউনিস্ট পার্টি তার ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নকে প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দেয়। এ সময় ছাত্র আন্দোলনও নিষিদ্ধ থাকার কারণে নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সতর্কভাবে অগ্রসর হতে হয়। ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে ছাত্রলীগ, ছাত্রশক্তি ও ছাত্র ফেডারেশনের একটি গােপন যৌথসভা অনুষ্ঠিত হয় ডাকসুর সহসভাপতি জাহান আরা আখতারের সভাপতিত্বে এতে প্রধানত শহীদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং এক্ষেত্রে ছাত্র ইউনিয়নের ভূমিকা ছিল মূখ্য। ছাত্র সংগঠনগুলাের এই উদ্যোগের পাশাপাশি ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনের উদ্দেশ্যে একটি কমিটি গঠনপূর্বক ৪ দিনব্যাপী একটি অনুষ্ঠানমালার আয়ােজন করা হয় ।৪৪২ একই উদ্দেশ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ২ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়ােজন করে । ফলে স্বতন্ত্র দুটো স্তর থেকে অভিন্ন কর্মসূচি পালনের ঘটনা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তােলার অনুঘটক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৬১ সনের ভাষা শহীদ দিবসে ডাকসুর উদ্যোগে আয়ােজিত একটি আলােচনাসভায় রােমান হরফে বাংলা লেখার সরকারি সিদ্ধান্ত মেনে না নেয়ার

————–

৪৪২, আবুল কাশেম, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ইতিহাস সমিতি পত্রিকা, বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতি, সংখ্যা ২৩-২৪, ১৪০২-০৪, পৃ. ১৮। ৪৪৩ ঐ, পৃ. ১৯।

বিষয়ে প্রস্তাব গৃহীত হয় । ঐ দিন সাধারণ শিক্ষার্থীরাও সে মর্মে স্লোগান দেয়। বস্তুত শিক্ষার্থীরা পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের এই জনপদের ভাষা-সাহিত্যসংস্কৃতিভিত্তিক পরিচিতির জন্য বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে লিপ্ত হয়।৪৪৪ ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে দেশদ্রোহিতার অভিযােগ এনে বন্দী করা হলে ছাত্রদের আন্দোলনে রাজনৈতিক কারণ যুক্ত হওয়ার সুযােগ আসে । ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের প্রচেষ্টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সংযােগ স্থাপিত হওয়ার পূর্বেই ছাত্রদের সম্পর্কে অতিমাত্রায় সতর্ক সরকার একদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়, অন্যদিকে রাজনৈতিক নেতাদের বন্দি করা হতে থাকে। অগণতান্ত্রিক আইয়ুব খানের সবচেয়ে ভীতি ছিল ছাত্র সমাজকে নিয়ে। তাই তিনি শিক্ষার সার্বজনীন অধিকার অস্বীকার করে শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণের নীতি অবলম্বন করেন যার মূল লক্ষ্য ছিল শিক্ষার সম্প্রসারণ হতে না দেয়া। তাছাড়াও তিনি তার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৬২ সালের গােড়ার দিকে যে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করেন। তার প্রধান প্রতিপক্ষ বিবেচনা করেন ছাত্র সমাজকে। তাই তাদেরকে শুরু থেকেই দমিয়ে রাখার নীতি অবলম্বন করেন। ৫ সঙ্গত কারণে ছাত্ররা শিক্ষা সংক্রান্ত সমস্যা এবং বিদ্যমান রাজনৈতিক দলনের বিরুদ্ধে বৃহত্তর আন্দোলনের লক্ষ্যে ১৫ দফার একটি দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু করে। শিক্ষাঙ্গনের সমস্যা ছাড়াও এসব দাবিতে জাতীয় রাজনীতির বিষয় প্রাধান্য পায়। যেমন- রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি, গ্রেফতারি পরােয়ানা প্রত্যাহার, সামরিক আদালতে সাজাপ্রাপ্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মুক্তি, রাজনৈতিক কর্মী ও বন্দিদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের আদেশ প্রত্যাহার, এবডাে ও পােডডাসহ সকল কালাকানুন বাতিল, বাক স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সংগঠিত হওয়ার অধিকার প্রভৃতি। ছাত্ররা রাজনৈতিক নেতাদের আন্দোলনে এগিয়ে আসার জন্য চাপ সৃষ্টি করে।৪৪৬ দাবি আদায়ের জন্য তারা শহরের রাস্তায় রাস্তায় সরকারবিরােধী স্লোগান দেয়। ও আইয়ুব খানের ফটো ছিড়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। কোথাও কোথাও বিরূপ পােস্টারও সেঁটে দেয়। ঢাকা শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ মফঃস্বলে যেমন রাজশাহী ও পাবনায় ছাত্র ধর্মঘট ও ছাত্র অসন্তোষের সংবাদ পাওয়া যায়। এই পর্যায়ে ছাত্র

—————

  1. Md. Abul Kashem, op.cit., p. 251. ৪৪৫ আবুল কাশেম, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১-২৩। ৪৪৬, ঐ, পৃ. ৩০। ৪৮৭ আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৫। ৪৪৮ ড. প্রীতি কুমার মিত্র, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৮।

আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ওঠে। সরকার ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শিক্ষা সচিব শরীফের নেতৃত্বাধীন কমিশন ধর্মভিত্তিক, ব্যয়বহুল, অবাস্তব সর্বোপরি গণবিরােধী রিপাের্ট পেশ করলে ছাত্র আন্দোলন সর্বাত্মক ও জঙ্গি আকার ধারণ করে। এই রিপাের্ট প্রাথমিক স্তর থেকে ইসলাম ধর্মভিত্তিক শিক্ষা এবং রােমান হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব দেয়া হয়।৪৪৯ ১৭ সেপ্টেম্বর কমিশনের রিপাের্টের বিরুদ্ধে ছাত্ররা প্রদেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট আহবান করে। ঐ দিন কার্জন হলের একটি অনুষ্ঠানে আইয়ুব খান বক্তৃতা দিতে গেলে ছাত্ররা বিদ্রোহী হয়ে স্লোগান দেয়। পুলিশের গুলিবর্ষণে ঘটনাস্থলেই তিনজন নিহত এবং আহত হয় শতাধিক। ছাত্ররা এই সময় এতটা সরকারবিরােধী হয়ে ওঠে যে, সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সামনে পেলেই নাজেহাল করতে শুরু করে। সরকারও আন্দোলন দমনের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। অনির্দিষ্টকালের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বহুসংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়। এর দ্বারা আন্দোলন দমন করা সম্ভব হয়নি। কেননা ছাত্ররা মফঃস্বলে গিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করতে থাকে। ফলে আন্দোলন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের মফঃস্বল এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ইতােমধ্যে ছাত্রদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে উচ্চ ধারণা গড়ে ওঠে। সাধারণভাবে এটি বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন নামে পরিচিত, যা বৃহত্তর আন্দোলনের অনুঘটক হিসেবে স্বীকৃত। এ বিষয়ে তৎকালীন ছাত্রনেতা কাজী। জাফর আহমদের মূল্যায়নটি তাৎপর্যপূর্ণ । তিনি বলেন:৪৫১

৬২-র ছাত্র অভ্যুত্থান, ৫২-র ভাষা আন্দোলন তথা পূর্ব বাংলার জনগণের স্বাধিকার আন্দোলনের আরেক অপেক্ষাকৃত বিকশিত ও পরিণত রূপ। এ অভ্যুত্থানের বাহ্যিক চেহারা ও ইস্যু যাই থাক না কেন, এর মূল সুর ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীভূত একচেটিয়া পুঁজিপতিদের প্রতিভু বিজাতীয় আইয়ুব শাহীর স্বৈরতান্ত্রিক ও জাতিগত নিপীড়নের শৃংখল থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা করা ।

রাজনৈতিক অঙ্গনে ততদিনে কমিউনিস্ট পার্টির মণি সিং ও খােকা রায়ের সঙ্গে আওয়ামী লীগের শেখ মুজিব ও মানিক মিয়া গােপনে একটি বৈঠকে মিলিত হয়ে আন্দোলনের একটি রূপরেখা প্রণয়ন করেন। রাজনৈতিক উত্থানের এই প্রক্রিয়া অনেকটা সহায়ক হয় আইয়ুব খান সীমিত পরিসরে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড অনুমােদন করলে। এর পিছনে অবশ্য আইয়ুব খানের উদ্দেশ্য ছিল তার শাসনকে গণতান্ত্রিক প্রলেপ দিয়ে নতুন শাসনতন্ত্রকে গ্রহণযােগ্য করে তােলা। কিন্তু উক্ত

————

৪৪৯, শিক্ষা কমিশনের রির্পোটের বিষয়ে দেখুন, আবুল কাশেম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩২-৩৮। 84. Md. Abul Kashem, op.cit., p. 267. ৪৫১ আবুল কাশেম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩১।

১৩০

শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে সচেতন মহল সােচ্চার হতে শুরু করে। সামরিক শাসনাধীনে মানুষ অতীষ্ঠ হয়ে ওঠেছিল ঠিকই, কিন্তু মত প্রকাশের সুযােগ না থাকায় তা আন্দোলনে রূপ নিতে পারছিল না। এমতাবস্থায় ছাত্রদের এই আন্দোলন মূল রাজনৈতিক দলগুলােকে পথ প্রদর্শন করে। | বিদ্যমান অবস্থায় উদীয়মান নেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্যরা নতুনভাবে দলকে সংগঠিত করতে অগ্রসর হন। তারা অন্যান্য দলের সঙ্গেও যােগাযােগ স্থাপন করেন। এরই ফল হিসেবে ১৯৬২ সালের ২৪ জানুয়ারি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কয়েকজন নেতা আতাউর রহমান খানের বাসভবনে গােপনে একটি আলােচনায় মিলিত হন। এমতাবস্থায় ১৯৬২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, আবুল মনসুর আহমদ, ফণিভূষণ মজুমদার (১৯০১-১৯৮১) ও অন্যদেরকে জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়। সংবাদপত্রের ওপর আরােপিত নিষেধাজ্ঞাও কঠোরতর হয়। ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়া, মঈদুল হাসান, কফিলুদ্দীন চৌধুরী, সৈয়দ আলতাফ হােসেন, কোরবান আলী (১৯২৪-১৯৯০) ও অন্যদেরকে বন্দী করা হয়। তারা জেলখানাতে অবস্থানকালে জানতে পারেন, শের-ই-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক পরলােকগত হয়েছেন। তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে শােক পালনার্থে এসব বন্দি জেল কর্তৃপক্ষের সহযােগিতায় কালাে ব্যাজ পরিধান। করেন। অবশ্য ঐ দিনই (২৭ এপ্রিল) জেল হতে তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তি পান। এদিকে এত দমন-পীড়ন সত্ত্বেও আন্দোলন স্তিমিত না হয়ে বরং উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। আন্দোলন খুলনা, বরিশাল, সিলেটসহ অন্যান্য জেলা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। আইযুব খান আন্দোলনের চাপে পড়ে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে নেন। এর কয়েকদিন পরেই শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন। আহমদ ও অন্যান্য কতিপয় নেতার উদ্যোগে পাকিস্তানের ৯ জন নেতা ২৫ জুন এক যৌথ বিবৃতি প্রদান করেন। ঐ বিবৃতিতে একটি নির্বাচিত সংস্থার মাধ্যমে দেশের জন্য নতুন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন, ১৯৫৬ সালের সংবিধানের মৌলিক

—————–

৪৫২. ড. প্রীতি কুমার মিত্র, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৭। ৪৫৩, ঐ, পৃ. ৯৮।

* আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর (ঢাকা: খােসরােজ কিতাব মহল, ১৯৯৯), পৃ. ৪৫১। ৪৫৫ ঐ, পৃ. ৪৫১। **. সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের রেকর্ডকৃত সাক্ষাঙ্কার, ২ মে, ২০০১। ৮৫৭, ড. প্রীতি কুমার মিত্র, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৯। ৪৫৮ দলিলপত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ১৬৫-১৬৯।

——-

মানবাধিকারগুলাে নতুন শাসনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্তকরণ, রাজনৈতিক দলের পুনরুজ্জীবন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিরাজমান বৈষম্য দূরীকরণ প্রভৃতি বিষয়ে দাবি জানানাে হয়। বিবৃতিদানকারী ঐ ৯ নেতা ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন দলের প্রবীণ ও প্রতিনিধিত্বকারী সর্বোচ্চ স্তরের ব্যক্তিত্ব।

| এদিকে আওয়ামী লীগের পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান শাখার নেতারা ১৯৬২ সনের ১১ ও ১২ আগস্ট দুদিনব্যাপী আতাউর রহমানের বাসভবনে একটি আলােচনায় মিলিত হন। আলােচনায় দলীয়ভাবে নিজেরা সংগঠিত হওয়া ছাড়াও অন্যান্য দলের সমন্বয়ে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তােলার প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয় । এক্ষেত্রে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ৪ অক্টোবর আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, জামায়াতে ইসলাম, নেজামী ইসলামী, কে.এস.পি. কাউন্সিল মুসলিম লীগ ও নুরুল আমিনের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগের একাংশের সমন্বয়ে National Democratic Front বা NDF গঠন করা হয় । NDF কোনাে রাজনৈতিক দল ছিল না। এটি ছিল প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গঠিত সরকারবিরােধী রাজনৈতিক দলসমূহের জোট। এ বিষয়ে জনমত সৃষ্টির জন্য আওয়ামী লীগ প্রদেশব্যাপী প্রচারণা কার্যক্রম পরিচালনা করে। আন্দোলন ক্রমাগত যখন বেগবান হয়ে ওঠে তখন ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বরে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী বৈরুতে একটি হােটেলে মৃত্যুবরণ করেন। সাধারণ্যে ধারণা জন্মে তাকে সরকার কৌশলে হত্যা করেছে । তার রাজনৈতিক শিষ্য ও উদীয়মান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানও এ বিষয়ে সন্দেহ। ব্যক্ত করেন।৪৬১

হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ছিলেন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সেতুবন্ধস্বরূপ। তার মৃত্যুতে সে বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়। তার মৃত্যুতে প্রকৃতপক্ষে একটি যুগের অবসান ঘটে৬৩ এবং আওয়ামী লীগে নতুন নেতৃত্ব বিকাশের পথ প্রশস্ত হয়। তিনি একজন আধুনিক গণতন্ত্রমনা রাজনীতিবিদ হিসেবে সীমিত সময়ের জন্য হলেও সমগ্র পাকিস্তান শাসন করেন। এই সময় তিনি পশ্চিম পাকিস্ত নের কোনাে কোনাে দলের সহযােগিতা গ্রহণ করেছিলেন। তাকে কেন্দ্র করে পূর্ব পাকিস্তানের প্রভাবশালী একটি রাজনৈতিক বলয় গড়ে ওঠে। ফলে তার মৃত্যুর পর

—————

৪৫৯ অমিতাভ গুপ্ত, গতিবেগ চঞ্চল বাংলাদেশ মুক্তসৈনিক শেখ মুজিব (ঢাকা: অনুপম প্রকাশনী, ১৯৯৭), পৃ. ২৫৯। ৪৬০ ড, মাে. মাহবুবর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭৬। ৪৬. অমিতাভ গুপ্ত, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০২। ৪৬২, আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৪। ৪৬৩ জাওয়াদুল করিম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬০।

এই বলয়ের প্রধান হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের প্রধান ব্যক্তি এবং তাজউদ্দীন আহমদ তার দক্ষিণ হস্ত হিসেবে আবির্ভূত হন। নতুন ধরনের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন নেতারা বের হয়ে আসেন চিন্তা, চেতনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে স্বকীয়তা নিয়ে। নবপ্রজন্মের এই নেতারা হলেন- শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম (১৯২৫-১৯৭৫), কামারুজ্জামান (১৯২৬-১৯৭৫), ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, মােশতাক আহমদ প্রমুখ। পুরনাে নেতৃত্বের অবসান এবং নতুন নেতৃত্বের আগমনের বিষয়টিকে একটু ঘুরিয়ে বলা যেতে পারে, পূর্ব-পশ্চিম সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইতঃপূর্বের নেতৃত্বের দোদুল্যমানতার অবসান ঘটে এবং একান্তই বাংলার সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে নতুন নেতৃত্বের আবির্ভাব হয়, যাদের শ্রেণীগত অবস্থান প্রােথিত ছিল পূর্ব বাংলার ভূমিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে। | যাহােক সােহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর ১৯৬৪ সালের গােড়ার দিক থেকে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে NDF ব্যাপক কর্মসূচির ভিত্তিতে পাকিস্তানে রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তােলার চেষ্টা করে। এর প্রধান দাবিগুলাে ছিল: (১) ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে পুনঃপ্রত্যাবর্তন, (২) সংসদীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা, (৩) পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, (৪) সার্বজনীন ভােটাধিকার প্রতিষ্ঠা করা, (৫) নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর সদর দপ্তর পূর্ব পাকিস্তানে স্থানান্তর ইত্যাদি। | সম্মিলিতভাবে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলাে যখন আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে শুরু করে তখন জনগণের দৃষ্টি অন্য দিকে সরানাের লক্ষ্যে সরকার পূর্ব পাকিস্তানে হানাহানির পরিবেশ সৃষ্টি করে। এ জন্য তারা বেছে নেয়। সেই পুরনাে পরীক্ষিত মানবতাবিরােধী জঘন্য অস্ত্র—সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। ১৯৬৪ সালের শুরুতেই ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরে হযরতবাল মসজিদের একটি ঘটনার প্রতিশােধ নেয়ার জন্যে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের প্ররােচনায় অল্প সময়ের মধ্যে বাংলার হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হয়ে যায় । (এসম্পর্কে পূর্ববর্তী অধ্যায়ে বিস্তারিত আলােচনা করা হয়েছে ।) এই পর্যায়ে শুধু পুনরুল্লেখ্য যে, দাঙ্গা প্রতিরােধের আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দেয়ার কারণে সরকার ‘Press and Publication Ordinance’ এর আওতায় শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্য নেতাদের হয়রানি করে । বস্তুত মুসলিম লীগের রাজনীতির বৃত্ত ভেঙ্গে আওয়ামী লীগের উৎপত্তি হয়েছিল ।৪৬৪ এর নেতারা বাস্তবসম্মত প্রজ্ঞার মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে এই দলটিকে একটি জাতীয়তাবাদী শক্তিতে পরিণত করার লক্ষ্যে সকল সম্প্রদায়ের

————

৪৬৪ই আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৪-৮৫।

জন্য প্রবেশাধিকারের পথ উন্মুক্ত করেন। সরাসরি ধর্মনিরপেক্ষতার কথা এর আদর্শ হিসেবে স্থান না পেলেও সুযােগ-সুবিধার ক্ষেত্রে কোনাে সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি বৈষম্য না করার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয় । এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই ১৯৬৪ সালে সরকারের সুপরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দমনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সর্বাত্মক চেষ্টা করে। তাই বলা যেতে পারে এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ এই প্রথম সাংগঠনিকভাবে তার অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তিকে তুলে ধরতে সক্ষম হয় ।৪৬৫ | আওয়ামী লীগের পক্ষে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা রােধে শক্তিশালী কার্যকর ভূমিকা পালন করা সম্ভব হয় মূলত এর পুনরুজ্জীবন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কারণে। ১৯৬৩ সালের ৭ এপ্রিল প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির অধিকাংশ সদস্য পুরুজ্জীবনের পক্ষে মত ব্যক্ত করেন।৬৬ সােহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর দলকে নতুন নেতৃত্বে নতুনভাবে সাজানাের প্রয়ােজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হয়। শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্য নেতা দলকে নতুন উদ্যোগে সংগঠিত করার জন্যে পুরনাে বন্ধু-বান্ধবদের সাথে যােগাযােগ শুরু করেন। অন্যদিকে নানা দল-মতের জোট NDF পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নেতৃত্ব দিতে পারবে, এমনটি অনেকেই মনে করেননি। তাই আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠিত ও পুনরুজ্জীবিত করার কোনাে বিকল্প তারা দেখতে পাননি। | ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগিশের সভাপতিত্বে তার বাসভবনে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির এক বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। তবে এই সভাতে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতাদের অনেকেই অনুপস্থিত থাকেন। ২৫ ও ২৬ জানুয়ারি দুদিনব্যাপী ওয়ার্কিং কমিটির প্রথম দিনের বৈঠকেই তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে তিনি জনগণের মৌলিক অধিকার, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং পূর্ব পাকিস্তানকে দুঃসহ বৈষম্যের কবল থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে মানুষকে রাজনৈতিক চেতনার মাধ্যমে সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করার প্রয়ােজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন। দ্বিতীয় দিন ২৬ জানুয়ারি

৪৬৫ ড, আবুল কাশেম, প্রাগুক্ত, সঙ্কলন প্রসঙ্গে, পৃ. ৪। ৪৮৫ এ, প, ১৯৪। ৪৯৭, আবদুল মমিনের রেকর্ডকৃত সাক্ষাঙ্কার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০০০। ৪৮ মযহারুল ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১০-২১১।

* Shyamali Ghosh, op.cit., pp. 81-82. এ বিষয়ে আরাে দেখুন, অমিতাভ গুপ্ত, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩১৩-৩১৪ । 34. Shyamali Ghosh, op.cit., p. 81.

আলােচনাক্রমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, পুনরুজ্জীবিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জন্যে ৬ সপ্তাহের মধ্যে একটি গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করা হবে। এ জন্য হাফেজ হাবিবুর রহমানকে আহ্বায়ক করে ৬ সদস্যবিশিষ্ট একটি সাবকমিটি গঠিত হয় । সাবকমিটির অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ড. আলীম-উল-রাজী (১৯২৫-১৯৮৫), বেগম রােকেয়া আনােয়ার ও আব্দুর রহমান খান।৪৭১ সভায় অন্যান্য প্রস্তাবে সংসদীয় গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক সংবিধান, সার্বজনীন ভােটাধিকার, প্রত্যক্ষ নির্বাচন, পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের জন্য আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, দুই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা জোরদার, চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর সদরদপ্তর স্থানান্তর, এবডাে, রাজনৈতিক দলবিধি, নিরাপত্তা আইন বাতিল, রাজবন্দিদের মুক্তি ও হুলিয়া প্রত্যাহার, পাটের সর্বনিম মূল্য নির্ধারণ, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি দাবি জানানাে হয়।৪৭২

গৃহীত প্রস্তাবাবলি থেকে প্রতীয়মান হয় যে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ভবিষ্যতে পাকিস্তানের রাজনীতিতে একটা গুরুত্বপূর্ণ ও নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করতে যাচ্ছে। তবে এটিও স্মরণযােগ্য যে, এগুলাের প্রায় সবই যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত ছিল। অবশ্য কিছু নতুন বিষয় এতে যুক্ত হয় মূলত পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের যাঁতাকলে পিষ্ট হওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে। | পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্যে অবশেষে ১৯৬৪ সালের ৬ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের তিন দিনব্যাপী এক যৌথ কাউন্সিল অধিবেশন শুরু হয় ঢাকার গ্রীন রােডস্থ বিচারপতি ইব্রাহীমের সুবিশাল আম বাগানে। পাকিস্তানের উভয় অঞ্চল থেকে প্রায় এক হাজার প্রতিনিধি এই কাউন্সিল অধিবেশনে উপস্থিত হন। সম্মেলনে মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি, শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক এবং তাজউদ্দীন আহমদ সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। এই কাউন্সিল অধিবেশনেই পূর্ব পাকিস্তানের নামকরণ আবার পূর্ব বাংলা করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। কাউন্সিলটি নানা কারণে বাংলাদেশের ইতিহাসে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এখানে এমন কিছু দাবি উত্থাপিত হয় যা পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ বা অন্য কোনাে দল ইতঃপূর্বে আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করে নি। কাউন্সিল অধিবেশনে নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান বঞ্চনা শােষণ ও চক্রান্তের ইতিহাস উল্লেখ করে

——–

৪৭১. Ibid., pp. 81-82. ৪৭২ Ibid., p. 82.

৩, আবদুল মমিনের রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০০০। ৪৭৪ আবু আল সাঈদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৭।

১৩৫

এক জ্বালাময়ী ভাষণ দেন।৪৭৫ এই ভাষণে তিনি অব্যাহত সংগ্রাম চালিয়ে

যাওয়ার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করে বলেন, “যতদিন না পাকিস্তানের বুক থেকে | স্বার্থান্বেষী মহলের পরাজয় ঘটবে, যতদিন না এদেশে গণতান্ত্রিক সরকার কায়েম

করতে পারবাে, যতদিন না সমাজ থেকে শােষণের মুলােৎপাটন হবে, যতদিন না | দেশের প্রত্যেক নাগরিক দলমত নির্বিশেষে অর্থনৈতিক মুক্তি ও আর্থিক প্রাচুর্যের আস্বাদ গ্রহণ করতে পারবে, যতদিন না শ্রেণীবিশেষের অত্যাচার থেকে সমগ্র | দেশ ও জাতিকে মুক্তি দেয়া যাবে ততদিন আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাবাে। ন্যায়। আমাদের নীতি, আমাদের আদর্শ। জয় আমাদের অনিবার্য।” কাউন্সিল

অধিবেশনে বেশ কিছু প্রস্তাব গৃহীত হয়, যার মুল বিষয় ছিল পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রে উভয় অংশের জন্যে পূর্ণ গণতান্ত্রিক স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের জন্য যে সকল বিষয় গৃহীত হয় ঐগুলাে হলাে:৭৬ (১) সার্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে সরাসরি নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রবর্তন, (২) মৌলিক অধিকারসমূহের নিশ্চয়তা বিধান, (৩) ট্রায়াল ব্যতীত অবৈধ আটক ও ডিটেনশনের নিয়ম বাতিলকরণ, (৪) আইন ও বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ, (৫) সভা-সমিতি ও প্রচার-প্রচারণার সাহায্যে অবাধে রাজনৈতিক দল গঠন ও মত প্রকাশের অধিকার, (৬) পূর্ব পাকিস্তানে দীর্ঘ প্রত্যাশিত বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা, (৭) বাহাদুরাবাদ ঘাটের নিকট যমুনা নদীতে সেতু নির্মাণ করা যাতে উত্তরাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নতি ত্বরান্বিত হয়, (৮) রংপুর থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত যমুনা নদীর পশ্চিম তীরে বাঁধ নির্মাণ, (৯) সমুদ্র তীরবর্তী এলাকাগুলােতে নারিকেল ও সুপারি চাষের জন্য দীর্ঘ মেয়াদি সুদমুক্ত ঋণ প্রবর্তন, (১০) প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা স্তরের শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি, (১১) মাদ্রাসা। শিক্ষার সংস্কার এবং মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিতদের কর্মসংস্থানের সুযােগ সৃষ্টি, (১২) ধর্মঘট নিবারণ আইন প্রত্যাহার, (১৩) দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্যে ভূমি সংস্কার আইনকে যুগােপযােগীকরণ, (১৪) বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের জন্যে স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা ও এতদসংক্রান্তে প্রণীত দমনমূলক আইন প্রত্যাহার করা এবং (১৫) রাজবন্দিদের মুক্তিদান। পশ্চিমা শক্তিসমূহ কর্তৃক ভারতকে আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত করার প্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তার লক্ষ্যে আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত মিলিশিয়া বাহিনী গঠনের প্রয়ােজনীয়তার কথাও গুরুত্বসহকারে উল্লিখিত হয়।” একই। সঙ্গে করাচী থেকে ইসলামাবাদে রাজধানী স্থানান্তরের তীব্র বিরােধিতা করে ইসলামাবাদের পরিবর্তে ঢাকায় রাজধানী স্থানান্তর অধিক যুক্তিসঙ্গত বলে দাবি

———–

৪ ৭৫ ড. আবুল কাশেম, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯৫।

৪৭৬ Shyamali Ghosh, op.cit., pp. 88-89. ৪৭৭, Ibid, p. 89.

করা হয়। এছাড়াও বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণের পক্ষে মত ব্যক্ত করা হয়।

১৯৬৪ সালের এই কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় সাড়ে পাঁচ বছর পরে।৪৭৮ এই বিলম্বের কারণ ছিল আইয়ুব খানের সামরিক শাসন। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ১৯৬৪ সালের সম্মেলনে প্রথমবারের মতাে সম্পূর্ণরূপে একটি অসাম্প্রদায়িক, অনেকটা বাম ঘেঁষা ঘােষণাপত্র প্রণয়ন করে । ধর্ম, বর্ণ বা অন্য কোন মাপকাঠিতে নয় বরং মৌলিক মানবাধিকারের ভিত্তিতে পাকিস্তানের সকল মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা চিকিৎসা এবং কর্মসংস্থানের ওপর গুরুত্ব আরােপ করা হয়। আওয়ামী লীগ এই প্রথমবার দলের গঠনতন্ত্রে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে বিদ্যমান বৈষম্য ও বঞ্চনার অবসান সম্ভব বলে উল্লেখ করে । খনিজ, রসায়ন, অস্ত্র ও বিদ্যুতের ন্যায় কিছু বৃহৎ শিল্প কল-কারখানা পর্যায়ক্রমে জাতীয়করণের পক্ষে মত প্রকাশ করে। পাটকেন্দ্রিক ব্যবসা ও শিল্পকেও রাষ্ট্রায়ত্তকরণের কথা বলা হয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতি এবং নতুন নেতৃত্বের কারণেই এই পরিবর্তন আসে। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বিবর্তনের প্রতি দৃষ্টি দিলে দেখা যায় এই পর্যায়ে দলটি একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের ধ্যান-ধারণার দিকে এগিয়ে যায় । আওয়ামী লীগ যে সমাজতন্ত্রের কথা বলে সেটা অবশ্য মার্কসীয় সমাজতন্ত্র ছিল না। সেটা ছিল মৌলিক মানবাধিকারের ভিত্তিতে সকলের জন্য সমান সুযােগ-সুবিধা দানের ভিত্তিতে একটি সুষম বণ্টননীতি অনুসরণ করা। এ পর্যায়ে দলটি পূর্ব পাকিস্তানের সকল ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় এবং প্রায় সকল শ্রেণী-পেশার মানুষকে একতাবদ্ধ করার মতাে আদর্শিক অবস্থায় উন্নীত হয়। দলের শাসনতন্ত্র রচনার জন্য মনােনীত উপকমিটির সদস্য হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ।

কাউন্সিল অধিবেশন সমাপ্তির খুব অল্পদিনের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক সার্বজনীন। ভােটাধিকারের প্রশ্নে আইয়ুব খানের নেতিবাচক সিদ্ধান্তের কারণে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। আইয়ুব খানের ইচ্ছানুযায়ী ‘Electoral College Bill’ এ পরােক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। এর বিরুদ্ধে ১৯৬৪ সালের ১১ মার্চ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমবায়ে ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি, গঠিত হয়।

————-

৪৭৮ ড. আবুল কাশেম, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯০।৪৭৯ Shyamali Ghosh, op.cit., p. 289. ৪৮০

|৪৮০ Ibid, p. 290.

৪৮২_Ibid, p. 290, ৪৮২ Tbid, p. 291.

এই কমিটি ১৮ ও ১৯ মার্চ ২ দিনব্যাপী দাবি দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। দাবি দিবসের প্রথম দিনে ছাত্র জনতার সমাবেশে অনেককে গ্রেফতার করা হয় । এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ এবং অন্য একজন নেতা কোরবান আলী। এরপর দীর্ঘ সময় তাজউদ্দীন আহমদকে জেলে অন্তরীণ রাখা হয়। প্রাসঙ্গিক না হলেও উল্লেখ্য যে, এই সময় তাজউদ্দীন আহমদ জেলে বসে আইন বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে পাস করেন। ইতঃপূর্বে তিনি কয়েকবার প্রস্তুতি নিয়েও পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি। কারামুক্ত হওয়ার পর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি আইনজীবী হিসেবে কয়েক মাস কোর্টে যাওয়া আসা করেন। তবে তার মতাে একজন বিচক্ষণ রাজনৈতিক নেতার আইন ব্যবসার পরিবর্তে সংগঠনের কাজে আত্মনিয়ােগ করা উচিত বলে তার শুভানুধ্যায়ীরা তাকে পরামর্শ দেন। তিনিও সেটাই মনে করেন এবং রাজনীতিকে চাঙ্গা করার প্রচেষ্টা চালান। অবশ্য জীবিকার জন্য কোনাে কোনাে কোম্পানির ‘ল কনসালট্যান্ট’ হিসেবেও তিনি এ সময় কিছু কাজ করেন।

মূলত শেখ মুজিবুর রহমানের উঠতি জনপ্রিয়তা এবং তাজউদ্দীন আহমদের অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতা, মেধা ও নিষ্ঠার কারণেই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ স্বল্পতম সময়ের মধ্যে পুনরুজ্জীবিত হয়। এ ক্ষেত্রে সাংগঠনিক দায়-দায়িত্ব। ব্যাপকভাবে তাজউদ্দীন আহমদের ওপরে অর্পিত হয়। কারণ পুনরুজ্জীবিত দলের। ক্রান্তিলগ্নে সাংগঠনিক সম্পাদকের ন্যায় গুরু দায়িত্ব তাকে প্রদান করা হয়েছিল । মুজিব ও তাজউদ্দীনের যৌথ নেতৃত্বই ছিল পরবর্তীকালের সকল আন্দোলনের সাফল্যের চাবিকাঠি। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ আনিসুর রহমানের উন্নয়ন ও নেতৃত্ব সম্পর্কিত মন্তব্যটি উল্লেখ করা যেতে পারে:

আমি বেশ জোরের সঙ্গেই বলতে চাই যে, যে-রাজনৈতিক নেতৃত্ব বর্তমানে জনগণের স্ব-উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকবেন না, পরবর্তী পর্যায়ে ক্ষমতায় এলেও তারা এ কাজটি এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন না। কারণ তারা স্ব-উন্নয়নের মর্মবস্তুই বুঝতে পারবেন না। আর সে জন্যে এটিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার কৌশল

———–

৪৮৩, সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকার, ২ মে, ২০০১। ৪৮. আবদুল মমিনের রেকর্ডকৃত সাক্ষাত্তার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০০০। ৪৮৫ সিমিন হােসেন রিমি, আমার বাবার কথা (ঢাকা: সন্ধানী প্রকাশনী, ১৯৯৪), পৃ. ৬৭। চফ আতিউর রহমান, মুক্তিযুদ্ধের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন (ঢাকা: সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৭), পৃ. ১১১।

তাদের জানা থাকবে না। ক্ষমতায় আসার পর নেতৃত্ব কি করবে, তা নির্ভর করবে

আগে তারা কি করেছেন, মানুষের কাছ থেকে কতটুকু শিখেছেন, তার ওপর। দাবি দিবসের দ্বিতীয় দিনে মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান সুদীর্ঘ। অনুপ্রেরণাদানকারী ঐতিহাসিক ভাষণ দান করেন। এ সময় ছাত্ররাও পূর্ণ। উদ্যোগে আন্দোলনে নেমে পড়ে। বিক্ষোভকারী অনেক ছাত্রকে গ্রেফতার করা। হয়। ছাত্র আন্দোলন দমন করার উদ্দেশ্যে সরকার কমপক্ষে ১৪০০ টি স্কুল এবং ৭৪ টি কলেজ বন্ধ করে দেয়। অনেক ছাত্রকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন মেয়াদের শাস্তি দিয়ে বের করে দেয়া হয়। জাতীয় নেতাদের গ্রেফতার অব্যাহত রাখা হয়। সংবাদপত্রের ওপরও সরকার চড়াও হয় এবং ইত্তেফাক, সংবাদ ও আজাদ পত্রিকাকে জামানত বাতিলের উদ্দেশ্যে কারণ দর্শাও নােটিশ প্রদান করে। এ সকল দমনমূলক কার্যাবলিই প্রমাণ করে, সরকার ছাত্র ও রাজনীতিবিদদের প্রতি কতটা খড়গহস্ত হয়ে ওঠে। এতদসত্ত্বেও দমন অভিযানের মাধ্যমে আন্দোলন বন্ধ করা যায়নি।

নির্যাতনের বিরুদ্ধে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে ২৯ মার্চ জুলুম প্রতিরােধ দিবস পালন করা হয়। পল্টন ময়দানের এক জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান সরকারকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন যে, জনগণকে ভােটাধিকার না দিলে তারা সরকারকে খাজনা প্রদান বন্ধ করে দেবে। এই প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ প্রদেশব্যাপী ব্যাপক গণসংযােগে নামেন। মে-জুন ২ মাসে আওয়ামী লীগের প্রায় ৫০ টি জনসভায় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যের বিষয়ে নেতারা বক্তৃতা করেন এবং আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়ােজনীয়তার কথা বলেন। এর ফলে ব্যাপকভাবে জনগণও আওয়ামী লীগের পক্ষে সংগঠিত হতে শুরু করে।

মৌলিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আওতায় নিজের প্রণীত সংবিধানের অধীনে আইয়ুব খান ১৯৬৪ সালের জানুয়ারিতে ঘােষণা প্রদান করেন যে ১৯৬৫ সালের মে মাসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তিনি নিজের বিজয়ের ব্যাপারে সুনিশ্চিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেই এই ঘােষণা দেন। অন্যদিকে এই পরিস্থিতিতে তাকে মােকাবিলার জন্যে ১৯৬৪ সালের ২৪ জুলাই ন্যূনতম ৯ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে ন্যাপ, জামায়াতে ইসলামী, কাউন্সিল মুসলিম লীগ, নেজামী ইসলামী প্রভৃতি ধর্মভিত্তিক দলকে নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে

৪৮৭B. Shyamali Ghosh, op.cit., p.৪৮৮ Md. Abul Kashem, op.cit., p. ৪৮৯ মযহারুল ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১৪।

মােট ৫ দলের সমন্বয়ে সম্মিলিত বিরােধী দল বা Combined Opposition Party (COP) গঠিত হয়। এক্ষেত্রে মুসলিম লীগ নেতা খাজা নাজিমুদ্দীন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এবং তার বাড়িতেই COP গঠনের প্রথম বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়।* COP-এ অন্যান্য দলগুলাে ধর্মভিত্তিক হলেও আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তােলার প্রশ্নে আওয়ামী লীগ এতে যােগ দেয় । বস্তুত এর কর্মসূচি ছিল বিদ্যমান সমস্যা ও জাতীয়তাবাদী দাবি-দাওয়াভিত্তিক। COP গঠনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগের নীতি ও আদর্শ অনুযায়ী পূর্ববর্তী বিষয়সমূহকে প্রাধান্য দিয়ে ওয়ার্কিং কমিটিতে প্রস্তাব পাস করিয়ে নেয়া হয়। উদ্দেশ্য ছিল এসব বিষয়ে COP এর কর্মসূচি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করানাে। COP-এর কর্মসূচিতে এর প্রতিফলন ঘটে । এটা ছিল নিমরূপ:৪৯২ সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভােটাধিকার, জাতীয় সংসদ ও প্রাদেশিক পরিষদগুলাের হাতে আইন ও বাজেট প্রণয়নের পূর্ণ ক্ষমতাসহ সংসদীয় পদ্ধতির পুনঃপ্রবর্তন, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন, নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন, পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসান, মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের সাথে বিশেষ সম্পর্কসহ স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ, কতিপয় পরিবারের হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভুত হওয়া প্রতিরােধ তথা সাধারণ মানুষের আর্থিক উন্নতির লক্ষ্যে অর্থনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ, পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ পরিবর্তন করে ইসলাম ধর্মসম্মত পারিবারিক আইন প্রণয়ন প্রভৃতি।

এভাবে আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন প্রক্রিয়া, পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলন এবং COP এর কর্মসূচি একাকার হয়ে যায় । সম্মিলিত বিরােধী দলের পক্ষ থেকে আইযুব খানকে মােকাবিলা করার জন্যে মিস ফাতিমা জিন্নাহকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাদের প্রার্থী হিসেবে মনােনয়ন দেয়া হয় । COP এ ব্যাপারে সমগ্র পাকিস্তানে তৎপর হয়ে ওঠে। জনগণের মধ্যে বেশ সাড়া পড়ে যায় ।

| নির্বাচন হয় ১৯৬৫ সালের ২ জানুয়ারি এবং ফলাফল সরকারিভাবে ঘঘাষিত হয় ৮ জানুয়ারি । পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুব খান ২১,০১২ এবং মিস ফাতিমা জিন্নাহ পান ১৮,৪৩৪ ভােট এবং পশ্চিম পাকিস্তানে আইয়ুব খান ২৮,৯৩৯ এবং ফাতিমা জিন্নাহ পান ১০,২৫৭ ভােট। প্রদত্ত ভােটের ৬১.৩১

———–

৪৯০ ঐ, পৃ. ২২৪। **. Shyamali Ghosh, op.cit., p. 100. ৪৯২, ড. প্রীতি কুমার মিত্র, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১১-১১২।

১৪০

পান আইয়ুব খান এবং ফাতিমা জিন্নাহ পান ৩৬.৩৬ ভাগ। ফাতিমা জিন্নাহকে পরাজিত করে আইয়ুব খান পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্যে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বহাল থাকেন।

তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৬৫ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নিজ নির্বাচনী এলাকায় মিস ফাতিমা জিন্নাহ্র পক্ষে সম্মিলিত বিরােধী দলের পােলিং এজেন্ট ও সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন। তার নেতৃত্বের কারণে এবং সরকারের পক্ষে কোনাে নির্বাচনী প্রতিনিধি না থাকায় ঐ নির্বাচনী এলাকা তথা কালিগঞ্জকাপাসিয়াতে সম্মিলিত বিরােধী দল ভালাে করবে বলে পূর্বাহ্নে ধারণা করা হয়েছিল। ভােট শেষে দেখা যায় যে, মােট ২৫০ ভােটের মধ্যে বিরােধী দলের প্রার্থী মিস ফাতিমা জিন্নাহ্ লাভ করেন ১৩৪ এবং আইয়ুব খান ১০৯ ভােট। ফলাফল ঘােষিত হওয়ার পরেই তাজউদ্দীন আহমদকে গ্রেফতার করা হয় ।

নির্বাচনী ফলাফল থেকে প্রতীয়মান হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় বিরােধী রাজনীতি অধিক বিকশিত হয়েছিল। কালিগঞ্জকাপাসিয়ার নির্বাচনী এলাকায় তাজউদ্দীন আহমদের বিপুল জনপ্রিয়তা এবং আন্তরিকতার কারণে আইয়ুব খানের চেয়ে COP প্রার্থী বেশি ভােট পান। একই বছর ২১ মার্চ জাতীয় পরিষদের এবং ৫ মে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক ঘােষণা দেয়া হয় । বিগত নির্বাচনে দুর্নীতি প্রত্যক্ষ করে এমতাবস্থায় COP এর অনেক সদস্য জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকার করে। কিন্তু আওয়ামী লীগ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের সামান্যতম সুযােগও হাত ছাড়া করতে রাজি ছিল না। অবশ্য COP এর শরিক দলগুলাের তুলনায় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক ভিত্তি ছিল অনেক বেশি সুদৃঢ়। যাহােক নির্বাচনের ফলাফল পূর্বের ন্যায় রয়ে যায় । আইয়ুব খানের ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ পূর্ববর্তী পরীক্ষিত কৌশলে বিজয়ী হয়। এ পর্যায়ে সাংবিধানিকভাবে আইয়ুব খানের কর্তৃত্ব হয় নিরঙ্কুশ ও সর্বব্যাপী।

| কিন্তু তাতে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক বিকাশের কাজ বাধাগ্রস্ত হয় । নতুনভাবে অগ্রসর হওয়ার জন্য ১৯৬৫ সালের ৬ ও ৭ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। সাধারণ সম্পাদক

———–

৪৯৩, দলিলপত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ২৪৭। চ৯৫ আবদুল আজিজ বাগমার, স্বাধীনতার স্বপ্ন-উন্মেষ ও অর্জন (ঢাকা: মাওলা ব্রাদার্স, ১৯৯৯), পৃ. ৪৮।

শেখ মুজিবুর রহমান ঘােষণা করেন যে, আওয়ামী লীগ ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাবের আলােকে সার্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতির শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন অব্যাহত রাখবে ।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানের স্বতন্ত্র চেতনা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ লক্ষ্য করে অঙ্কুরেই তাকে ধ্বংস করার জন্যে আইয়ুব খান আবার পুরানাে চক্রান্তের জাল বিস্তার করতে সচেষ্ট হন এবং ভারতবিরােধী শ্লোগান তুলে জনগণের দৃষ্টি অন্যত্র সরানাের চেষ্টা করেন। পাকিস্তান সরকারের এরূপ দুরভিসন্ধির প্রেক্ষিতেই ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পাক-ভারত যুদ্ধ বেধে যায়। পরস্পর বিরােধিতার মধ্যে দিয়েই ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম। ১৯৪৮ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে ঘৃণা ও অবিশ্বাস উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পায়। সম্ভবত পাকিস্তান কাশ্মিরকে কেন্দ্র করে ১৯৪৮ সালের ঐ যুদ্ধের পর সহস্রাধিক মাইল দূরবর্তী পূর্ব বাংলার বাঙালি জনসমাজ সম্পর্কেও তাদের অবিশ্বাসের উৎপত্তি হয়। তাদের হয়তাে ধারণা জন্মে, যে কোনাে মুহূর্তে বাঙালিরা ভারতের প্ররােচনায় ভারতবর্ষে যােগ দিয়ে বসতে পারে। এই সন্দেহের আর একটি অর্নহিত কারণ এই যে, পাকিস্তান নিজেও ভারতের বিরুদ্ধে। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদদ জোগাতাে। কাজেই পূর্ব বাংলার মানুষ যখনই নিজেদের অধিকারের বা দাবির কথা জানিয়েছে, স্বায়ত্তশাসনের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছে অথবা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলছে তখনই অবাঙালি সামরিক ও বেসামরিক ঐ আমলা গােষ্ঠীটি এর পেছনে ভারতীয় চক্রান্ত’-এর গন্ধ পেয়েছে। এ কাজে কখনাে ধর্ম আবার কখনাে যুদ্ধকে ব্যবহার করা হয়েছে। ন্যায্য দাবির জন্যে আন্দোলনকারিরা তাদের নিকট একাধারে ভারতীয় চর, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’, ‘কমিউনিস্ট’ প্রভৃতি বিশেষণে অভিযুক্ত হয়েছে। এ সকল কথা তারা নিজেরা কতটা বিশ্বাস করতাে বলা মুশকিল, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে। বাঙালিদেরকে দমিয়ে রাখার জন্যে তারা এ সব শব্দের যথেচ্ছ অপব্যবহার করতাে। তারা প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্যভাবে বাংলার সম্পদ পাচার করে; পূর্ব বাংলার মানুষকে বঞ্চিত করে নিজেরা সমৃদ্ধ হয়। তাদের প্রবণতা দেখে ধারণা জন্মে, পূর্ব বাংলা বেশিদিন পাকিস্তান কাঠামাের মধ্যে থাকবে না, তাই যত পারা যায়।

———–

৪৯৫, ড. প্রীতি কুমার মিত্র, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১৫। *** G.W. Choudhury, The Last Days of United Pakistan (Dhaka: The University Press Limited, 1998), p. 90. ৪৯. Ibid, p. 24.

সম্পদ নিয়ে যাওয়াই লাভের । বস্তুত এ বিষয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি ঐ গােষ্ঠীটির মনে এক ধরনের তত্ত্বগত অবিশ্বাসের জন্ম হয়। যুদ্ধের অনেক পরে বাংলাদেশের একজন ইতিহাসবিদ মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে পরাজিত পাকিস্তানি জেনারেলদের মনােভাব জানার চেষ্টা করেন। তার পর্যবেক্ষণটি এখানে উল্লেখ | করা খুবই প্রাসঙ্গিক:৪৯৮

এ ধারণা গড়তে সাহায্য করেছে পাকিস্তানিদের প্রচণ্ড ভারত ও হিন্দু-বিদ্বেষ । তারা দেখেছে পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের মধ্যে মিল বেশি এবং পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু জনসংখ্যাও পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় বেশি। তা ছাড়া, বাঙালিরা তেমনভাবে হিন্দু/ভারত-বিদ্বেষী নয় যেমনভাবে পাকিস্তানিরা বিদ্বেষী । সে-কারণে দেখি, যেকথাটিতে কোনাে না কোনভাবে তারা গুরুত্ব দিয়েছেন আত্মজীবনীতে, তা হলাে বাঙালিদের মনমানসিকতা প্রভাবিত করেছিল হিন্দুরা । আর হিন্দুরা তাে ভারতীয়দেরই অংশ। ভারত, সবসময় পাকিস্তানের শত্রুতা করেছে, পাকিস্তানের | বিনাশ চেয়েছে। কিন্তু শিক্ষকরা বাঙালি তরুণদের বিভ্রান্ত করেছে, তাই পাকিস্তানি চেতনা বাঙালিদের মধ্যে কাজ করতে পারেনি। এবং সে-কারণে বাঙালিদের মন চলে গিয়েছিল বিচ্ছিন্নতার দিকে।

তৎকালীন আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন ব্যক্তির নিকট থেকে জানা যায় | যে, সীমিত গণ্ডির মধ্যে হলেও কেউ কেউ পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার জন্যে। চিন্তাভাবনা শুরু করেন এবং সে লক্ষ্যে কাজ করে যেতে থাকেন। ১৯৬২ সালের সরকারবিরােধী আন্দোলন শুরুর সময় হতেই ছাত্র নেতাদের মধ্যে কেউ কেউ এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেন। এ সম্পর্কে তকালীন ছাত্র নেতা আবদুর রাজ্জাক, তােফায়েল আহেমদ°° ও অন্যরা জানান যে, ১৯৬২ সালে স্বাধীন। পূর্ব পাকিস্তান নামক একটি লিফলেট তাদের হাতে আসে, যার উৎস ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তাদের মতে ১৯৬৪ সালে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ গঠিত হয় । তােফায়েল আহমদ দাবি করেন যে, এই | কর্মকাণ্ডে ছাত্র নেতা শেখ ফজলুল হক মণি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। অন্যদিকে আবদুর রাজ্জাক দাবি করেন, স্বাধীন পূর্ব বাংলা বিপ্লবী পরিষদের | উদ্যোক্তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সিরাজুল আলম খান, কাজী আরেফ আহমদ

————–

৪৯৮ মুনতাসীর মামুন, পরাজিত পাকিস্তানি জেনারেলদের দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধ (ঢাকা: সময়, | ১৯৯৯), পৃ. ৪২। ৪৯৯ মাসুদুল হক, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ‘র’ এবং “সি, আই, এ (ঢাকা: ওসমানিয়া | লাইব্রেরী, ১৯৯০), পৃ. ১৭১।

৫০০ ঐ, পৃ. ১৯১।

ও অন্যান্যরা।৫০১ এরা হচ্ছেন সমাজতান্ত্রিক আদর্শে অনুপ্রাণিত নেতা। অন্যদিকে তােফায়েল আহমদ, শেখ ফজলুল হক মণি এরা প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী ধারার অনুসারী। এখানে স্পষ্টত বুঝা যায়, বিশ্বব্যাপী দ্বিমেরু রাজনীতির ধারণা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকেও প্রভাবিত করেছে। অর্থাৎ বাংলাকে স্বাধীন করার চিন্তাভাবনা কোন ধারার অনুসারীরা প্রথমে শুরু করেন তা নিয়েও প্রতিযােগিতা লক্ষণীয়। অন্যদিকে তকালীন অন্য একজন ছাত্রনেতা আবদুল আজিজ বাগমারের ভাষ্যমতে, ১৯৬২ সালের প্রথমদিকেই তারা অস্থায়ী পূর্ববঙ্গ সরকার সংক্ষেপে ‘অপূর্ব সংসদ’ আরাে সংক্ষিপ্ত ‘অপু’ গঠন করে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার জন্যে ছাত্রদের মধ্যে কাজ শুরু করেন। তারা তাদের দলের মনােগ্রাম-অপু-১, জাতীয় সংগীত অপু-৩ ৫০৪ এবং একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অন্যান্য প্রতীকী বিষয়গুলাে নির্ধারণ করেন। তাদের সরাসরি উপদেষ্টাদের মধ্যে ছিলেন বেগম সুফিয়া কামাল, ড. আহমদ শরীফ, মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক আবদুল হাই, শওকত ওসমান ও আরাে কেউ কেউ। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে বিষয়টি অবগত ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্য দু একজন। এই উদ্যোগের সঙ্গে ছাত্রনেতা শেখ ফজলুল হক মণিও জড়িত ছিলেন। প্রথমােক্ত ও শেষােক্তদের মধ্যে একটি সংযােগ লক্ষ্য করা যায় ফজলুল হক মণির মাধ্যমে । এদিকে সামরিক, নৌ, বিমান বাহিনীর কতিপয় বাঙালি অফিসার পঞ্চাশ দশকের শেষের দিকে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেন বলে পরবর্তীকালে জানা যায়। এরই সূত্র ধরে পাকিস্তান সরকার ১৯৬৮ সালে আগরতলা মামলা দায়ের করে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যকার অমিল দেখে সমসাময়িক অনেকেই পূর্ব পাকিস্তানের আলাদা হওয়ার সম্ভাবনার ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন। মওলানা ভাসানী ১৯৫৬ সালেই বলেন স্বায়ত্তশাসনের দাবি মানা না হলে পূর্ব বাংলা পশ্চিম পাকিস্তানকে ‘আচ্ছালামু আলাইকুম জানাবে। মধ্যপঞ্চাশের দিকে একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান চীনে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি লক্ষ করেন যে, পূর্ব বাংলার প্রতিনিধিদলের সঙ্গে পশ্চিম বাংলা থেকে যাওয়া প্রতিনিধি

————–

ঐ, পৃ. ১৭২। ৫০২, আবদুল আজিজ বাগমার, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩। ৫০৩, ঐ, পৃ. ১৩। ৫০৮. ঐ, পৃ. ৩৭।

ঐ, পৃ. ১৬।

দলের এবং ভারতের উর্দুভাষী অঞ্চল এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যাওয়া প্রতিনিধিদের মধ্যে আলাদা আলাদা রকমের খাওয়া-দাওয়া এবং চলাফেরা । দেশে ফিরেই শেখ মুজিব নাকি মন্তব্য করেন, চীনে গিয়ে বুঝতে পারলাম আমাদের জাতীয়তা আলাদা।° পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার জন্যে আরাে দু একটা প্রচেষ্টার কথা জানা যায়। ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে আইয়ুব খান ক্ষমতা গ্রহণের একমাসের মধ্যে নভেম্বর মাসে ময়মনসিংহে ‘পূর্ব বাংলা লিবারেশান পার্টি নামে একটি সশস্ত্র গ্রুপের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এর তিনজন কেন্দ্রীয় সংগঠকের মধ্যে ছিলেন আবদুর রহমান সিদ্দিকী, খন্দকার ফজলুর রহমান ও আর,এ,এম, সাঈদ। প্রথমােক্ত দুজন ছিলেন আওয়ামী লীগ দলীয় এবং শেষােক্ত জন ছিলেন ন্যাপ দলীয় সদস্য। একই বছরের শেষের দিকে জামালপুর, নেত্রকোনা ও টাঙ্গাইলে সশস্ত্র এই গ্রুপের শাখা খােলা হয়। ১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারি ব্রহ্মপুত্র। নদে একটি বড় নৌকায় অনুষ্ঠিত হয় এই সশস্ত্র সংগঠনের সম্মেলন। এরপর কিছুসংখ্যক সদস্য ভারতে চলে যায় অর্থ ও অস্ত্র সংগ্রহের জন্যে। সেখান থেকে কিছু পােস্টার ও লিফলেট ছাপিয়ে এনে বিভিন্ন স্থানে তা প্রচার করা হয়। এর সঙ্গে প্রধান নেতাদের মধ্যে ফজলুল হক, হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবুর রহমনের সংশ্লিষ্টতার কিছু কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়।৫০৮

| উল্লিখিত প্রচেষ্টাগুলাের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে বৃহত্তর যােগাযােগ তেমন ছিল না বললেই চলে। এগুলাে প্রায় সবই ছিল ব্যক্তিক, বড়জোর কিছুসংখ্যক মানুষের উপলব্ধির স্তর । কিন্তু ১৯৬১ সালের শেষের দিকে এসে বিষয়টি একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করে। নিষিদ্ধ ঘােষিত কমিউনিস্ট পার্টির মণি সিং এবং খােকা রায়ের সঙ্গে এ বিষয়ে শেখ মুজিবুর রহমান ও মানিক মিয়ার আলােচনা হয়। শেখ মুজিবের যুক্তি ছিল পাঞ্জাবের বড় বড় ব্যবসায়িক ও শিল্পপতিরা যেভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে শােষণ করছে তাতে বেশিদিন তাদের সঙ্গে থাকা সম্ভব নয়। সুতরাং পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যাওয়াই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির মণি সিং ও খােকা রায় জানান, বিষয়টির সঙ্গে তারা দ্বিমত পােষণ করেন না। তবে ঐ

———–

৫০৭, আজকের সূর্যোদয়, ১৭-২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০০৪, পৃ. ১৫। ২৮. মােঃ শাহজাহান, “বাংলাদেশের স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা (১৯৬৬-১৯৭১): একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ”, অপ্রকাশিত পিএইচ.ডি. থিসিস, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ২০০২, পৃ. ১২৫-১২৬।

১৪৫

ধরনের আন্দোলন শুরু করার সময় তখনও হয়নি।৫০৯ এসব ধারাবাহিক আলােচনায় সংগ্রামের জন্য ৮ দফাভিত্তিক কর্মকৌশল প্রণীত হয়।”৫১০

অন্যদিকে শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, এ ব্যাপারে ভারতের উচ্চতম রাজনৈতিক মহলের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপনের চেষ্টা তিনি করেন। এমনকি একবার তিনি ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচীন সিনহার সঙ্গে যােগাযােগের জন্য ১৯৬২ সালে আগরতলায় গিয়েছিলেন বলেও জানা যায় । শচীন সিনহা ভারতীয় উচ্চতম রাজনৈতিক মহলের সঙ্গে শেখ মুজিবের যােগাযােগ স্থাপন করাতে চেয়েছিলেন। চীন-ভারত যুদ্ধের কারণে ভারতীয় রাজনৈতিক মহল তখন এ বিষয়ে তেমন আগ্রহ দেখায়নি। অসম্পূর্ণ যােগাযােগ, প্রতিকূল আবহাওয়া প্রভৃতি কারণে তিনি শচীন সিনহার সঙ্গে সাক্ষাৎ না করে ফিরে আসতে বাধ্য হন। সুতরাং বাঙালিদের স্বাধীনতার জন্যে সংগঠিত হওয়ার প্রচেষ্টা সম্পর্কে পাকিস্তান গােয়েন্দা সূত্রগুলাে থেকে অবগত হওয়ার ব্যাপারটি সম্পূর্ণভাবে অসঙ্গত নাও হতে পারে । পরবর্তীকালের আগরতলা মামলার ভিত্তিও এটিই। এই প্রসঙ্গে লেখকসাংবাদিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ফয়েজ আহমদ কর্তৃক প্রদত্ত তথ্য বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি লিখেছেন: ৫১২

নৌ, বিমান ও পদাতিক বাহিনীর বেশ কিছুসংখ্যক তেজী বাঙ্গালি দেশপ্রেমিক সৈনিক ও অফিসার ষাটের দশকব্যাপী এমনকি তারও পূর্ব থেকে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার একটি রূপরেখা নিয়ে বিদ্রোহ ঘােষণা করতে চলছিলেন। কিন্তু তারা জানতেন প্রধানতঃ শেখ মুজিবুর রহমান ও মওলানা ভাসানীর মতাে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কাছে কথা প্রকাশ না করলে জনগণের সমর্থন লাভ করা সম্ভব হবে না । তারা তাই প্রথমেই সরাসরি শেখ সাহেবের সাথে করাচীতে কয়েকবার যােগাযােগ করে তাকে পরিকল্পনার মূল বক্তব্য জানান এবং সমর্থন লাভের আশা প্রকাশ করেন। ন্যূনপক্ষে আটজন রাজনৈতিক ও উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা এই বিদ্রোহের পরিকল্পনার সাথে জড়িত ছিলেন।

————-

৫০৯ খােকা রায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮১-১৮৩।

৫১০ ‘ড, মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস: ১৮৩০-১৯৭১ (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ১৯৯০), পৃ. ২৩২-২৩৩।

. আবদুল মতিন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কয়েকটি প্রাসঙ্গিক বিষয় (ঢাকা: র্যাডিক্যাল এশিয়া পাবলিকেশন্স, ১৯৯৯), পৃ. ১৭৫। ৫১২, ফয়েজ আহমদ,আগরতলা মামলা শেখ মুজিব ও বাংলার বিদ্রোহ (ঢাকা: সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৭), পৃ. ১০।

তাই বাঙালির স্বাধীনতার স্পৃহাকে অঙ্কুরেই দমিয়ে দেয়ার জন্যে ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাক-ভারত যুদ্ধ বাধানােটা ছিল পাকিস্তানের পক্ষ থেকে এক ধরনের সুপরিকল্পিত ব্যাপার। মূলত এটা হচ্ছে এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতাে বিষয়। প্রথমত কাশ্মির দখল করতে পারলে তার আয়তন ও জনসংখ্যা দুই-ই যােগ হবে পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে। এর ফলে পূর্ব। পাকিস্তানের জনসংখ্যার বিপরীতে পশ্চিম পাকিস্তানের জনসংখ্যা বেড়ে যাবে।। দ্বিতীয়ত আইয়ুব খান যে সামরিক বাহিনীর ওপর নির্ভরশীল ছিলেন তা দীর্ঘদিন অব্যবহৃত হয়ে পড়েছিল । যুদ্ধের মাধ্যমে তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ দেয়ার একটি সুযােগ পাওয়া যাবে। এক্ষেত্রে তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভুট্টোর ভারতবিরােধী কিছু ইন্ধনও যুক্ত হয়। ৫১৪ | ভিন্ন একটি সূত্রমতে পাকিস্তান মার্কিন সামরিক-গােয়েন্দা সংস্থার পরিকল্পনা মাফিক ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।রাওয়ালপিন্ডির সেনা সদর দপ্তরে অবস্থিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘Military Assistance Advisory Group- MAAG’ এই যুদ্ধের পরিকল্পনা করে।১৫ আইয়ুব খান সি.আই.এ-র উৎসাহে ক্ষমতা দখল করলেও অল্প সময়ের মধ্যে মার্কিন প্রশাসনের বিরাগভাজন হন। এর প্রথম কারণ হলাে তিনি সােভিয়েত ইউনিয়নের হুমকির কারণে ষাটের দশকের গােড়ায় পেশােয়ারস্থ মার্কিন গােয়েন্দা ঘাটি বাটাভ থেকে উঠিয়ে দেন। দ্বিতীয় ঘটনা হলাে, ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধ শুরু হলে কমিউনিস্ট চীনকে প্রতিহত করার জন্য ২৮ অক্টোবর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ. কেনেডি আইয়ুব খানকে এক চিঠিতে ভারতকে সহযােগিতা দেয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু আইয়ুব খান তা অগ্রাহ্য করেন। তিনি ১৯৬৫ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে অতি আত্মবিশ্বাসী ও উচ্চাভিলাষী হয়ে ওঠেন। বস্তুত তিনি এশিয়ার উদীয়মান নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে সচেষ্ট হন এবং একই সঙ্গে আমেরিকা, চীন ও সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সমান সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। কিন্তু আইয়ুব খানের অবাধ্যতা এবং তার এ ধরনের প্রচেষ্টা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দ ছিল। না। ফলে MAAG আইয়ুব খানকে বিপাকে ফেলার জন্যে ভারতের বিরুদ্ধে

———

৫১৩ ড. প্রীতি কুমার মিত্র, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩০।

Archer K Blood, The Cruel Birth of Bamgladesh (Dhaka: The University Press Limited, 2002), p. 44. ৫১৫ মাসুদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪। ৫১৬, ঐ, পৃ. ১৪। *S. GW. Choudhury, op.cit., p. 19.

যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করে। শ্রীনগরে পাকিস্তানের অনুপ্রবেশকারী ঢুকিয়ে আইয়ুব খান ভারতকে যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলেন। ১৭ দিনব্যাপী এই যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণরূপে অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকে। শাসকচক্র অবশ্য ভারত পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে বিমান হামলা চালিয়েছে বলে প্রচার করে । ভারত তা অস্বীকার করে এবং পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মনে পাকিস্তানের প্রচারণার কোনাে প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায় নি। তবে পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি এখানকার মানুষেরা উপলব্ধি করে। পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য এতদিন ধরে কোনাে কোনাে মহল থেকে বিশেষত আওয়ামী লীগের পক্ষ হতে ক্রমাগত যে দাবি করা হয় তার যথার্থতার প্রমাণ পাওয়া যায় এই যুদ্ধে । বিপরীত পক্ষে কর্তৃপক্ষ বরাবরই প্রচার করতাে যে, পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা নির্ভর করছে পাকিস্তানের বন্ধু রাষ্ট্র চীনের ওপর। বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ইতিহাসে তাই ১৯৬৫ সালের পাকভারত যুদ্ধ চেতনার এক দুয়ার খুলে দেয়। বাঙালিরা অনুধাবন করে যদি তাদের নিরাপত্তার জন্যে পাকিস্তানের পরিবর্তে চীনের ওপর নির্ভর করতে হয় তাহলে তারা নিজেরাই তাে সে উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে । তাহলে পাকিস্তানের প্রয়ােজনটা কোথায়?৫২১

*৫১৮ মাসুদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪-৫। ৫১৯. ঐ, পৃ. ১৪। ২২ আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৪। ৫২১ Gw. Choudhury, op.cit., p. 8.

১৪৮

সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ-বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং তারপর – কামাল হোসেন