You dont have javascript enabled! Please enable it! অপারেশন ইউএনও- ৭১ - সংগ্রামের নোটবুক
অপারেশন ইউএনও-‘৭১
ভদ্রলােক জীবনটা শুরু করেছিলেন একজন গ্রাম্য স্কুলের শিক্ষক হিসেবে। কি জীবন সায়াহ্নে কর্মজীবন থেকে অবসর নেয়ার সময় তার নাম বর্তমান শতাব্দীর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নামের তালিকাভুক্ত হয়ে গেছে। জীবনের অনেকগুলাে বছর তিনি সংঘাতবহুল এই বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার সব চেয়ে দুরূহ কাজে ব্যয় করেছেন। তারই প্রচেষ্টায় এক সময় বিশ্বের কোটি কোটি শরণার্থী স্ব-স্ব দেশে প্রত্যাবর্তনে সক্ষম হয়েছে। অথচ তিনি নিজেই দেশের বিরাজমান পরিস্থিতিতে স্বীয় মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন না। একটা বাস দুর্ঘটনায় আকস্মিকভাবে জ্যেষ্ঠ পুত্রের মৃত্যু হলে তার শেষ জীবনটা আরও করুণ হয়ে দাঁড়ায়। আদিতে ব্রহ্মদেশীয় নাগরিক এই জ্বলােকের নাম উথান্ট। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে ইনিই। ছিলেন সমগ্র বিশ্বের সবচেয়ে কর্মব্যস্ত ব্যক্তিত্ব। কৌশলগত কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে পাকভারত যুদ্ধে রূপান্তরিত করার লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর তৎকালীন পাকিস্তানের বিমান বাহিনী। হঠাৎ করে একযােগে ভারতের দুটি বিমান ঘাঁটিতে হামলা করলে দ্রুত যুদ্ধের ব্যাক্তি লাভ করে এবং ঢাকার আকাশেও শুরু হয় বিমানযুদ্ধ। আজকের নিবন্ধের চাঞ্চল্যকর ঘটনাগুলোর শুরুটা এখান থেকেই। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উ থান্ট এ সময় পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি লক্ষ করে ভারত ও পাকিস্তান উভয় সরকারকে এই মর্মে অনুরােধ করলেন যে, যুদ্ধবিধ্বস্ত ঢাকা নগরীতে নিরপরাধ সিভিলিয়ান আর বিদেশী নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্যে একটা নিরপেক্ষ এলাকা নির্দিষ্ট করা হােক। এই নিরপেক্ষ এলাকায় ভারতীয় জঙ্গী বিমান বােমাবর্ষণ করবে না এবং দখলদার সেনাবাহিনীও কোনাে আক্রমণ করবে না। উ থান্ট-এর আবেদনে উভয় দেশ সম্মত হলে আন্তর্জাতিক রেডক্রস আর জাতিসংঘ-এর নিয়ন্ত্রণে ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হােটেলকেই নির্দিষ্ট করা হলাে নিরপেক্ষ এলাকা হিসেবে।
বেশ কিছুসংখ্যক বিদেশী নাগরিক ছাড়াও ১৪ ডিসেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সর্বশেষ সিভিলিয়ান সরকার পদত্যাগ করার পর গভর্নর ডা, মালেক সদলবলে এই হােটেলেই আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। এখানে একটা কথা উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিক সাহায্য প্রদানকারী সংস্থাগুলাে বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের মােটামুটিভাবে দুভাগে চিহ্নিত করেছিল। প্রথমত সীমান্ত অতিক্রমকারী প্রায় এক কোটি শরণার্থী এবং দ্বিতীয়ত দেশের অভ্যন্তরে বাস্তুচ্যুত অগণিত নাগরিক। ভারত এসব বিদেশী সংস্থাগুলাের প্রদত্ত সাহায্য ভারত সরকারের মাধ্যমে বন্টনে বাধ্য করেছিলেন। এই সাহায্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ১৯ কোটি ২৯ লাখ ডলারে। অন্যদিকে এসব সংস্থাগুলাে প্রথমদিকে পাকিস্তানের তৎকালীন জঙ্গী সরকারের মাধ্যমেই সাহায্য বিতরণ শুরু করেছিল। কিন্তু অচিরেই দেখা গেল যে, বিদেশ থেকে প্রেরিত এসব সাহায্য পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বাস্তুহারাদের পরিবর্তে নিজেদের প্রয়ােজনে সবটুকু ব্যয় করছে। ফলে জাতিসংঘ অচিরেই জাতিসংঘ পূর্ব পাকিস্তান সাহায্য সংস্থা” (ইউ এন ই পি আর ও) সংক্ষেপে ইউনিপ্রাে’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করে নিজেদের কর্মচারী প্রেরণ করল।
হানাদার বাহিনী জোর করেই যানবাহন ব্যবহার করল। জাতিসংঘের পদ্রপাের্টে আগত মােট ১০৬ জন কর্মচারী ইউনিপ্রাে’র অধীনে বাংলাদেশে বাস্তুহারাদের মধ্যে সাহায্যে বিতরণের কর্মসূচিতে নিয়ােজিত হয়েছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেলে এদের যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছিল তার হিসাবটা নিম্নরূপ :
১. স্টিমার ডুবিতে দুজন ক্যাপ্টেন নিহত এবং ৪ জন মারাত্মকভাবে আহত।
২. ঢাকা বিমানবন্দরে দুটি হালকা ধরনের বিমান সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত।
৩. জাতিসংঘের ভাড়া করা ৪টি মালবাহী টাগ নদীতে নিমজ্জিত।
৪. জাতিসংঘের ভাড়া করা ১টি মালবাহী টাগ নিখোঁজ।
৫. গােটা চারেক লঞ্চ সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত।
৬. উল্লেখযােগ্য সংখ্যক মােটরযান ও ট্রাক বিনষ্ট।
এখানে বলতে হয় যে, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পশ্চাদপসরণরত হানাদার বাহিনী প্রায়ই শক্তি প্রয়ােগ করে জাতিসংঘের যানবাহন ব্যবহার করায় এসব গাড়িগুলাে গেরিলাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিল। পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি লক্ষ করে ১০৬ জন কর্মচারীর মধ্যে ৬৯ জনকে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে ব্যাঙ্কক ও সিঙ্গাপুর পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং ৩ ডিসেম্বর নাগাদ উ থান্ট-এর নির্দেশে কর্মসূচি সাময়িকভাবে স্থগিত ঘােষণা করা হয়। শুধু তাই-ই নয়, এ সময় জাতিসংঘের বিভিন্ন এজেন্সির অধীনে বাংলাদেশে কর্মরত সমস্ত কর্মচারী এবং অন্যান্য বিদেশী নাগরিকদের নিরাপত্তার খাতিরে দেশের বাইরে সরিয়ে নেয়ার জন্যে সেক্রেটারি জেনারেল জরুরি নির্দেশ প্রদান করেন। ঢাকায় জমায়েত হওয়া এ ধরনের লােকের সংখ্যা দাঁড়ালাে জাতিসংঘের ২৪০ জনসহ ৪৭৪ জনে। এদের মধ্যে রাশিয়া, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ ১৭টি দূতাবাসের ৮৭ জন কর্মচারী ও ৮০ জন পােষ্য রয়েছেন। স্থানীয়ভাবে এই মর্মে সিদ্ধান্ত নেয়া হলাে যে, প্রথম সুযােগেই ৪৩৭ জনকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হবে। তবে কোনাে অবস্থাতেই বাকি ৩৭ জন কর্মচারী ঢাকা ত্যাগ করবেন না। এদের বিস্তারিত পরিচয় নিম্নরূপ :
১. জাতিসংঘের কর্মচারী : ১৯ জন।
২. ইউনিসেফ এর কর্মচারী : ১২ জন
৩. বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডাক্তার :
৩ জন ৪. আইএলও’র কর্মচারী : ১ জন।
৫. ইউ এন এইচ সি আর প্রতিনিধি :
১ জন এবং ৬. দলীয় নেতা মি. পল মার্ক : ৪৩৭ জন বিদেশী নাগরিককে ঢাকার বাইরে পাঠাতেই হবে। এই পল মার্ক ছিলেন জাতিসংঘের অ্যাসিস্টেন্ট সেক্রেটারি জেনারেল। ঢাকার অবস্থা স্বাসরুদ্ধকর হয়ে দাঁড়ালে পল মার্ক-এর একমাত্র চিন্তা হচ্ছে নির্দেশ মােতাবেক কীভাবে ৪৩৭ জন বিদেশী নাগরিককে দেশের বাইরে পাঠানাে যাবে। শুরু হলাে রেডিও ওয়েরলেস’-এর মাধ্যমে নিউইয়র্ক, ব্যাঙ্কক ও দিল্লীর মধ্যে ঘন ঘন যােগাযােগ ও কথাবার্তা। ৩ ডিসেম্বর পল মার্ক খবর পাঠালেন যে, ঢাকার সঙ্গে স্থল ও জলপথে সমস্ত যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। একমাত্র ভরসা বিমান-পথ। কিন্তু আজ থেকে ঢাকা বিমানবন্দরে বােমাবর্ষণ শুরু হয়ে গেছে এবং প্রথম দিনেই ইউনিপ্রাে’-র দুটো বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। ঢাকার সঙ্গে সমস্ত বাণিজ্যিক বিমান সার্ভিস বন্ধ। সেক্রেটারি জেনারেল উ থান্ট-এর ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় কানাডা সরকার এই অপারেশনের জন্য একটা সি-১৩০ বিমান দিতে সম্মত হলাে।
বিমানটি তখন ঢাকা থেকে আকাশপথে আড়াই ঘণ্টার দূরত্বের ব্যাঙ্কক বিমানবন্দরে অবস্থান করছিল। অবিলম্বে উ থান্ট পাকিস্তান ও ভারত সরকারের নিকট এই মর্মে অনুরােধ করলেন যে, বিদেশী নাগরিক ও জাতিসংঘের কর্মচারী বহনকারী এই বিমানটির নিরাপদে যাতায়াত নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ৫ ডিসেম্বর ঢাকার স্থানীয় সময় ১০.৩০ থেকে ১৮.৩০ পর্যন্ত তেজগাঁও বিমান বন্দর ও পার্শ্ববর্তী এলাকা এবং ঢাকার আকাশে যুদ্ধ বিরতি কার্যকর রাখা হােক। পাকিস্তান সরকার ৪ ডিসেম্বর সম্মতি জানালেও ভারত সরকার উত্তর-পূর্ব ভারতীয় দুর্গম এলাকায় অবস্থিত এয়ার ফোর্স ইউনিটগুলাের সঙ্গে এতদসম্পর্কিত প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা নিতে অপারগ হওয়ায় তিনটি পক্ষই যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবিত সময় ২৪ ঘন্টা পিছিয়ে নিতে রাজি হলাে। এদিকে পল মার্ক হিসাব করে দেখলেন যে, একটিমাত্র সি-১৩০ বিমানে এতগুলাে লােকের স্থান সঙ্কুলান হবে না। তাই রেডিও ওয়ারলেস’-এ তিনি বারবার দ্বিতীয় চার্টার্ড বিমানের অনুরােধ জানালেন। ফলে জাতিসংঘ প্যান এ্যাম’-এর একটি ৭০৭ বােয়িং চার্টার্ড করল। দ্বিতীয় বিমানটি ৭ ডিসেম্বর ঢাকায় অবতরণ করবে। হঠাৎ করে ৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সেক্রেটারি জেনারেলকে এই মর্মে অবহিত করলাে যে, যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবিত সময় কমিয়ে দিতে হবে এবং তা হবে ৬ ডিসেম্বর স্থানীয় সময় ১০.৩০ থেকে ১২.৩০ মি. পর্যন্ত। সঙ্গে সঙ্গে জাতিসংঘের সদর দফতর থেকে ব্যাঙ্ককে অবস্থানরত কানাডীয় সি-১৩০ বিমানের নিকট সংশােধিত সময়সূচি পাঠাননা হলাে।
৬ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে পল মার্ক নিউইয়র্কে উ থান্ট-এর নিকট জরুরি বার্তা পাঠালেন। উদ্ধারকারী কানাডীয় সি-১৩০ বিমানটি যখন আর মাত্র ৭০ মাইল (১০ মিনিটের বিমান সময়) দূরে, তখনই ভারতীয় জঙ্গী বিমানগুলাে ঢাকা বিমানবন্দরে দু’দফায় আক্রমণ করেছে এবং মাটি থেকে পাকিস্তানি বিমান বিধ্বংসী কামানগুলাে বিরামহীনভাবে গােলাবর্ষণ করেছে। এ সময় বাসে করে বিদেশী নাগরিকদের বিমান বন্দরে আনা হচ্ছিল। প্রথম বাসটা নারী ও শিশু দিয়ে বােঝাই ছিল। এরা রাস্তার পাশে একটা ট্রেঞ্চ-এ আশ্রয় নিয়েছিল। এদিকে কন্ট্রোল টাওয়ারের পরামর্শে কানাডীয় বিমানটি আবার ব্যাঙ্কক ফিরে গেছে। এই সংবাদের পর উ থান্ট জাতিসংঘে ভারতীয় স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন-এর সঙ্গে জরুরি বৈঠকে মিলিত হলেন এবং পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও কথা বললেন। শেষ পর্যন্ত উভয়পক্ষই ৭ ডিসেম্বর স্থানীয় সময় ০৮.৩০ থেকে ১২.৩০ মি. পর্যন্ত অস্থায়ীভাবে যুদ্ধবিরতির জন্যে সম্মত হলাে। এবার উ থান্ট-এর নয়া নির্দেশ হচ্ছে, এই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কানাডীয় সি ১৩০ এবং মার্কিন বােয়িং ৭০৭ দুটো বিমানই ঢাকায় উদ্ধার কাজে লিপ্ত হবে। প্রথমে যাবে সি-১৩০ বিমানটি এবং ঢাকার রানওয়ের অবস্থা সম্পর্কে পাইলটের রিপাের্টের ওপর নির্ভর করে বােয়িং ৭০৭ বিমানটি অবতরণ করবে।
প্রথম দফা ব্যর্থতার পর নয়া পরিকল্পনা
দ্বিতীয় দফায় নয়া পরিকল্পনা অনুসারে ব্যাঙ্কক থেকে সি-১৩০ বিমানটি ৭ ডিসেম্বর স্থানীয় সময় ৬.৪৫ ঘন্টায় (২৩৪৫ গ্রিন উইচ সময়) ঢাকার পথে রওয়ানা হয়। কিন্তু রেঙ্গুনের আকাশে পৌঁছার পর ঢাকার কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে জানানাে হয় যে, রানওয়ের অবস্থা সন্তোষজনক নয় বলে সি-১৩০ বিমানটিকে অবতরণ করতে দেয়া হবে না। ফলে কানাডীয় পাইলট পরবর্তী নির্দেশের আশায় এক ঘন্টা ২৬ মিনিট ধরে রেঙ্গুনের আকাশেই চক্কর দিতে থাকে এবং ঢাকার কন্ট্রোলকে অনুমতি দেয়ার জন্য চাপ অব্যাহত রাখে। ফলে ঢাকা থেকে এই মর্মে পাইলটকে জানানাে হয় যে, ঢাকার আকাশে এসে পাইলট মহােদয় ওপর থেকে স্বচক্ষে রানওয়ে পরীক্ষা করে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। সি-১৩০ বিমানটি পুনরায় ঢাকার পথে রওয়ানা হলাে। ঢাকার আকাশে ২০,০০০ ফুট এসে পৌছানাের পর পাইলট নিচে নামার মুহূর্তে দেখতে পেলেন যে, নিচে একটি ক্যারিয়ার বিমানে আগুন ধরে যাওয়ায় অবিরাম ধোয়া বেরুচ্ছে আর তার পাশ দিয়ে একটা জঙ্গী বিমান উড়ে যাচ্ছে। আর এর পরই মাটি থেকে শুরু হলাে বিমান বিধ্বংসী কামানের অবিরাম গােলাবর্ষণ। অবাক বিস্ময়ে পাইলট লক্ষ করলেন যে, এবার তাঁর সি-১৩০ লক্ষ করেই গােলা বর্ষিত হচ্ছে। বিমানের বাঁ দিকের পাশ দিয়ে একটা গােলা বেরিয়ে গেল। অথচ তার বিমানটি ভারত ও পাকিস্তানের সম্মতি মােতাবেক এয়ার করিডোের’-এর মধ্যেই রয়েছে। উপায়ন্তরহীন অবস্থায় ক্যানাডীয় বৈমানিক ‘মে ডে’ ধ্বনি বিপদসূচক সংকেত দিলেন। এমন সময় তিনি ব্যাঙ্কক কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে অবিলম্বে প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ পেলেন। অভিযানে ব্যর্থ হয়ে যখন ক্যানাডীয় সি-১৩০ বিমানটি আবার ব্যাঙ্কক বিমান বন্দরে অবতরণ করল, তখন স্থানীয় সময় দুপুর ১৩.১৫ ঘণ্টা (গ্রীনিচ সময় ৬.১৫ ঘণ্টা) এভাবেই সেদিন ঢাকা থেকে ৪৩৭ জন বিদেশী। নাগরিককে উদ্ধারের সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলাে।
ব্রিটিশ রয়াল এয়ার ফোর্স-এর…দুঃসাহসিক উদ্ধার অভিযান কিন্তু জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উ থান্ট মােটেই দমবার পাত্র নন। ১১ ডিসেম্বর তৃতীয় দফা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে তিনি জাতিসংঘের সমস্ত সদস্য রাষ্ট্রের কাছে গােপনে আকুল আবেদন জানালেন এদের উদ্ধার কাজের জন্যে। শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে বার্তা এল। রয়াল এয়ার ফোর্স এই দুঃসাহসিক অভিযানে সম্মত রয়েছে। আবার উ থান্ট যােগাযােগ করলেন ভারত আর পাকিস্তান সরকারকে। দুটো দেশই যথাসম্ভব নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিল। এমন সময় ঢাকার ব্রিটিশ দূতাবাস থেকে লন্ডনে খবর এসে পৌছালাে যে, তেজগাঁও বিমানবন্দর এলাকায় মােটামুটিভাবে লড়াই বন্ধ। পাকিস্তানের ঢাকাস্থ পিএএফ ইউনিটের জঙ্গী বিমানের অনেকগুলােই বিধ্বংস হয়েছে এবং বাকিগুলাে গ্রাউনডেট’ হয়ে গেছে। তাই ঢাকার আকাশ কিছুটা নিরাপদ বলা চলে।  কি সবচেয়ে বড় বিপদ হচ্ছে রানওয়ে নিয়ে। তেজগা বিমানবন্দরে রানওয়ে ছাড়াও নির্মাণাধীন কুর্মিটোলা বিমান বন্দরের রানওয়ে বােমা বর্ষণে বিরাট বিরাট গর্ত হয়ে একেবারে অকেজো হয়ে গেছে। এসব রানওয়েতে বিমান ওঠানামা করানাে একবারেই অসম্ভব। কিন্তু ব্রিটিশ রয়াল এয়ার ফোর্স এই অসম্ভবকে সম্ভব করতে চায়। সেদিনের তারিখটা ছিল ১২ ডিসেম্বর। সকালের ঘন কুয়াশার মধ্যে সিংগাপুর থেকে দুটো সি-১৩০ বিমান ঢাকার পথে রওয়ানা হলাে। দুটো বিমানেরই পাইলটের সিটে বসে দুজন দুঃসাহসিক ইংরেজ বৈমানিক। সিনিয়রের নাম স্কোয়াড্রন লিডার এলসি। তিনিই প্রথমে তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। অন্য প্লেনের পাইলটকে অভয় দিয়ে এ মর্মে জানালেন যে, এই দুঃসাহসিক অভিযানে সফলভাবে অবতরণ করতে সক্ষম হলে ওয়েলেস-এ তিনি পথনির্দেশিকা জানাবেন।
সে ক্ষেত্রে দ্বিতীয় সি-১৩০ বিমানের অবতরণ সহজতর হবে। এই ইংরেজ বৈমানিক সেদিন অসাধ্য সাধন করলেন। সি-১৩০ বিমান নিয়ে তেজগাঁও বিমানবন্দরে নামার পর রানওয়ের বিরাট বিরাট গর্তগুলাের পাশ কাটিয়ে পাইলট বিমানটিকে নিরাপদে ট্যাক্সি করিয়ে দ্বিতীয় সি-১৩০ কে অবতরণের জন্য পথনির্দেশিকা দিলেন। নিচে দাঁড়িয়ে থাকা জাতিসংঘের অ্যাসিস্টেন্ট সেক্রেটারি জেনারেল পল মার্কএর গম্ভীর মুখে মৃদু হাসি দেখা দিলাে। প্রায় ১৫০ ঘণ্টাব্যাপী এক দুঃসহ শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির অবসান হলাে। ৪৩৭ জন যাত্রী নিয়ে অবরুদ্ধ ঢাকা নগরী থেকে সি-১৩০ বিমান দুটো নীল আকাশের পূর্ব কোণ দিয়ে উড়ে চলে গেল সিংগাপুরের পানে। সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। উ থান্ট-এর প্রচেষ্টা সফল হলাে। এদিকে পলমার্ক রেডিও ওয়্যারলেস’-এ লেক সাকসেস-এর জাতিসংঘ ভবনে সেক্রেটারি জেনারেল উ থান্ট-এর কাছে বার্তা পাঠালেন ‘ফোর্থ অপারেশন বাই রয়্যাল এয়ারফোর্স সাকসেসফুল রিগার্ডস। -পল’ (রয়াল এয়ার ফোর্সের চতুর্থ প্রচেষ্টা সফল হয়েছে।-পল) (সংগৃহীত)
এম আর আখতার মুকুল

সূত্র : জয় বাংলা – এম আর আখতার মুকুল