ওই মহামানব আসে
আমি কোনাে জবাবই দিলাম না। শুধু নীরবে ফটোটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম। চোখ ও হাত বাঁধা অবস্থায় দুই নম্বর সেক্টরের ক্র্যাক প্লাটুনের অন্যতম গ্রুপ কমান্ডার আব্দুল্লা-হেল-বাকী সাজু আর একই গ্রুপের মুক্তিযােদ্ধা আমিরুস সালাম বাবুল-এর লাশ। একাত্তরের বিজয় দিবসের মাত্র ১১ দিন আগে ঢাকার খিলগাঁও এলাকায় রেল লাইনের পাশে একটি পুলের নিচের জলাভূমিতে পড়ে রয়েছে। কী বীভৎস এই দৃশ্য। হত্যার পদ্ধতি দেখে যে কেউই বিশ্বাস করতে বাধ্য হবেন যে, এরা দুজনেই ধরা পড়েছিলেন। তাহলে এদের বন্দি করে না রেখে কাপুরুষের মতাে হত্যা করা হলাে কেন? কে এর জবাব দিবে? আর কী আশ্চর্য হত্যাকারী তৎকালীন পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দির বিচার হলাে না। বিশ্বের ইতিহাসে এ এক বিরল ঘটনা।
ভদ্রলােকের নাম এম এ বারী। ভিজিটিং কার্ডে ছাপানাে নাম আর পরিচিতির পর হাতে লেখা ছােট্ট একটি লাইন, শহীদ বাকীর পিতা’ বাটোর্ধ বয়সের ভদ্রলােক যখন ফাইলটি ঐ হাতে আমার কক্ষে ঢুকলেন, তখনও আমি একদৃষ্টে কার্ডটার দিকে তাকিয়ে রয়েছি। দ্রলােককে নিয়ে এসেছে ঢাকার খিলগাঁও-এর পাথেয় গ্রন্থ সুহৃদ কেন্দ্রের এক তরুণ যুবক-এর গর্ব শহীদ আব্দুল্লা-হেল-বাকী বীর প্রতীক হচ্ছেন এই খিলগাঁও-এর বীর সন্তান। ভদ্রলােককে অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে অভ্যর্থনা জানিয়ে বসতে দিলাম। বললাম, এবার আপনার কথাবার্তা বলতে পারেন। আর যদি কিছু কাগজপত্র থাকে তাহলে দলিল হিসেবে দেখাতে পারেন। বারী সাহেব তার ফাইলপত্র আর কাগজের বান্ডিল খুলে প্রথমেই একটা বড় সাইজের ফটো হাতে দিয়ে বললেন, “জানেন, আমার পুত্র-কন্যার মধ্যে শ্রেষ্ঠ সন্তান বাকীকে আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য উৎসর্গ করেছি?” কথা কটা বলেই দ্রলােক ফটোকপি করা ময়লা একটা গেজেট নােটিফিকেশন দেখিয়ে বললেন, “এই দেখুন সরকার আমার সাজুকে বীর প্রতীক’ উপাধি দিয়েছে। আমার অনুরােধ এবার ওর সম্পর্কে আপনি কিছু লিখুন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ ১৫ বছর পর এক শহীদ মুক্তিযােদ্ধার বৃদ্ধ পিতার এই অনুরােধ ফেলতে পারলাম না বলেই আজ সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে এই ছােট্ট প্রতিবেদন লিখতে বসেছি। বারী সাহেবকে গােটা কয়েক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতেই আবার হাতের ফাইলপত্র ঘাটতে শুরু করলেন। ভদ্রলােকের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থেকে শুধু মনে হলাে, এসব কাগজপত্র আর পারিবারিক অ্যালবামে রাখা শহীদ পুত্রের ফটোগুলােই—তাঁর জীবনের শেষ সম্বল। চোখের চশমা খুলে রুমাল দিয়ে চোখ মুছে কিছু কাগজপত্র আমার হাতে তুলে দিলেন। বেঁচে থাকলে আজ বাকীর বয়স হতাে প্রায় সাড়ে ৩৬ বছরের মতাে। কিন্তু দেশমাতৃকার শৃঙ্খলমুক্ত করার লড়াই-এ সে শহীদ হলাে মাত্র সাড়ে ২১ বছরে। ওর জন্ম ১৯৫০ সালের ১৯ জুন মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলায়। ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি উচ্চতার বাকী ছিল সুঠাম দেহের অধিকারী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে অধ্যয়নকালে বাকী বাঙালি জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ হলেও ভবিষ্যতে সৈনিক জীবনেরই ছিল তার কাম্য। তাই ১৯৭১ সালের শুরুতে এই দুরন্ত যুবক ঢাকার ক্যান্টনমেন্টে আই এস এস বি’র কমিশনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছিল। কিন্তু তৎকালীন পূর্ববাংলায় ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের পর সাধারণ নির্বাচন আর বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে অসহযােগ আন্দোলন তার মনকে দারুণভাবে প্রভাবান্বিত করল। সবশেষে ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যায় বাকীর সমস্ত চিন্তাধারায় হলাে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। প্রতিশােধ গ্রহণের উদগ্র বাসনায় সে ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে উধাও হয়ে গেল। বহু বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে আব্দুল্লা-হেল-বাকী ওরফে সাজু যেয়ে হাজির হলো দুই নম্বর সেক্টরে খালেদ মােশারফের কাছে। তাঁর দাবি একটাই—প্রশিক্ষণ দাও, লড়াই করব। বাকীর জীবনের সাধ পূরণ হলাে।
সে তখন এম টি হায়দারের ‘ক্র্যাক বাহিনীর সদস্য। একাত্তরের অবরুদ্ধ পূর্ববাংলার অভ্যন্তরে বিশেষ ঢাকার উপকণ্ঠে শুরু হলাে এদের দুর্ধর্ষ অভিযান। প্রতিটি অভিযানেই এরা বিজয়মাল্য ছিনিয়ে আনল। যুদ্ধে অসম সাহসিকতার স্বীকৃতি হিসেবে নতুন ইউনিট গঠিত হলাে। আব্দুল্লা-হেল-বাকীর নামেই নামকরণ হলাে ‘বাকী ইউনিট-সেক্টর-২। এঁদের অপারেশনের জন্য ঢাকার যেসব এলাকা নির্দিষ্ট হলাে সেগুলাে হচ্ছে : ১, তেজগাঁ, ২. রমনা এবং ৩. ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট। প্রতিটি এলাকাই সেদিন ছিল মৃত্যুপুরী। একাত্তরের ৪ ডিসেম্বর। বাংলার আকাশে সেদিন মিত্রবাহিনীর ভারতীয় বিমান। আর বাংলার মাটিতে দুর্ধর্ষ মুক্তিযােদ্ধার দল। সক্রিয় সহযােগিতার লক্ষ্যে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবারই সম্প্রসারিত হস্ত। আব্দুল্লা-হেল-বাকী গেরিলা ইউনিটে শেষবারের মতাে এসে হাজির হলাে ঢাকার উপকণ্ঠে। সহযােদ্ধাদের মধ্যে ইসমাইল হােসেন বেঙ্গল, শহীদ, শফিক, বাবুল, লুৎফর, আতিক, নান্টু, জাহাঙ্গীর, নীলু ও আরও অনেকে। আজ রাতেই আছে নির্ধারিত অপারেশন। ঢাকার খিলগায়ে তালতলায় পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে ঝাপিয়ে পড়তে হবে। বিজয় এখন বাঙালিদের হাতের মুঠোয়। হঠাৎ করেই বাকী এসে হাজির হলাে আব্বাআম্মার কাছে। ভাইবােনদের সঙ্গে কথাবার্তায় সরগরম করে তুললাে সমস্ত বাড়িটা। বেশ কিছুক্ষণ নিকটজনের সঙ্গে কাটিয়ে বিদায়ের মুহূর্তে জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা আমাদের স্বাধীনতার লড়াই এ আপনারা খুশি হয়েছেন, দেখেইতাে আমরা হয়েছি মৃত্যুঞ্জয়ী। বাবা, আজও আমাদের একটা অপারেশন আছে। এমন সময় গর্ভধারিণী-মাতা আমেনা খাতুন দরজায় দাঁড়িয়ে শুধু বললেন, বাবা সাজু, এই গ্লাসের দুধটুকু খেয়ে যা, বাবা আমার।
একদিকে মায়ের পিছু ডাক—আর একদিকে লাঞ্ছিতা মাতৃভূমির আহবান। আমেনা খাতুনের আদরের সাজু ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল। মুক্তিযােদ্ধা আব্দুল্লা-হেল-বাকী সাজু আর আমিরুস সালাম বাবুল ৪ ডিসেম্বর রাতের অভিযানে বুলেট নিঃশেষিত হওয়ায় হানাদার পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়ল। এরপর ক্যাম্প কমান্ডার ক্যাপ্টেন কাইয়ুম নারকীয় অত্যাচার করেও কোনাে গােপন তথ্য আদায় করতে পারল না। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা ধরে এঁরা দুজনেই দেশপ্রেমের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলাে। পরদিন ৫ ডিসেম্বর এলাকাবাসী শিউরে উঠল। খিলগাঁওয়ের পুলের নিচে বেয়োনেটের খােচায় ক্ষত-বিক্ষত দুই বীর মুক্তিযােদ্ধার লাশ পাওয়া গেল। এঁদের চোখ কাপড় দিয়ে আর হাত পিছন মােড়া করে দড়ি দিয়ে বাঁধা। কাপুরুষের দল আটক মুক্তিযােদ্ধাদের নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। বাকী ইউনিট-‘এর ইসমাইল হােসেন বেঙ্গল পরবর্তীকালে লিখেছেন, যেদিন বাকীর সাথে আমার শেষ দেখা সেদিনটি ছিল ৩ ডিসেম্বর। রাত তখন ৮.৩০ প্রায়। সাথে শহীদ কালাে বাবুলও ছিল। বিদায়ের প্রাক্কালে আমি তাকে যেতে বারণ করেছিলাম। সাবধানে পথ চলার কথা বলতেই তার চির স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে তিনি বলেছিলেন, “আমরা গেরিলা গেরিলারা কিছুই ভয় করে না।” মহাকালের গর্ভে এক এক করে প্রায় ৩০টি বছর গত হয়ে গেল। ১৯৮৬ সালের বিজয় দিবসের প্রাক্কালে ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হিসেবে আমার অদেখা মুক্তিযােদ্ধা শহীদ আব্দুল্লা-হেল-বাকীর বাবা-মাকে আমি কোনাে সান্ত্বনা দিতে চাই । বাকীর স্মৃতিকে বুকে নিয়েই তাে ওঁরা বেঁচে আছে। আমি শুধু কবিগুরুর ভাষায় বলতে চাই :
“ঐ মহামানব আসে,
দিকে দিকে রােমাঞ্চ লাগে
মর্ত্যধূলির ঘাসে ঘাসে।…”
[সংগৃহীত) এম আর আখতার মুকুল
সূত্র : জয় বাংলা – এম আর আখতার মুকুল