You dont have javascript enabled! Please enable it! 1952 | পঞ্চাশ দশকে আমরা | এম আর আখতার (মুকুল) | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪  - সংগ্রামের নোটবুক

পঞ্চাশ দশকে আমরা | এম আর আখতার (মুকুল) | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪ 

এ বছর শীতের দাপটটা ছিলো বেশি। গত বছর দশেকের মধ্যে বোধ হয় এমন কড়া শীত আর পড়েনি। তাই সন্ধ্যার পর বাইরে যাওয়া একেবারে বন্ধই করে দিয়েছিলাম। কিন্তু মাঝে মধ্যে পুরানো বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে আড্ডা দিতে ইচ্ছে করছিলো যেভাবে বিনা নোটিশে আমার সমবয়েশী বন্ধু-বান্ধবরা চিরকালের জন্য হারিয়ে যাচ্ছে, তাতে আমি নিজেও একটু সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছি বৈকী! অল্পদিনের ব্যবধানে প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা মোহাম্মদ সুলতান, কবি হাসান হাফিজুর রহমান, সাংবাদিক এহতেশাম হায়দার চৌধুরী, বেতারের এককালীন সংবাদপাঠক সৈয়দ রেদোয়ানুর রহমান, প্রাক্তন ছাত্রনেতা ওয়াদুদ পাটোয়ারী প্রমুখের মৃত্যুর পর আমার মনে এ ধরনের একটা প্রতিক্রিয়া হওয়া স্বাভাবিক।
গেলো ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে একদিন সকালে বড় ছেলেকে ডেকে বললাম, ‘অনেকদিন তোর ফয়েজ চাচাকে দেখি না। যা’তো একটু খোঁজ নিয়ে আয়, ভদ্রলোক কেমন আছে?’

ব্যতিক্রমধর্মী চরিত্র ফয়েজ
একটা ব্যতিক্রমধর্মী চরিত্রের জন্য ফয়েজ আহমদ নিজেই নিজের পরিচয়। আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগে ইনি ‘আন্ডার গ্রাউন্ড’ পাসপোর্টের ব্যবস্থা করে মওলানা ভাসানীর সহযাত্রী হিসাবে বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যোগদানের জন্য গিয়েছিলেন। ইনি কোন বিশেষ রাজনৈতিক দলের কর্মকর্তা না হয়েও জীবনের অনেকগুলো বছর হাসিমুখে কারান্তরালে কাটিয়েছেন। আজ থেকে প্রায় ৩৫ বছর আগে ‘মাসিক হুল্লোড়’ কাগজের সম্পাদক হিসাবে সাংবাদিকতায় হাতে খড়ি হওয়ার পর প্রায় ২৫ বছর পর্যন্ত সাংবাদিকতা করেও ইনি একজন বেকার সাংবাদিক। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ইনি নিয়মিত প্রোপাগান্ডামূলক প্রতিবেদন লিখেও কোন পারিশ্রমিক গ্রহণ করেননি, কিংবা নাম প্রচার করতে দেননি। ফয়েজ আহমদ রাজনৈতিক সচেতন একজন প্রতিষ্ঠিত কবি-সাহিত্যিক ও বেকার সাংবাদিক। এ’র সবচেয়ে বড় পরিচয় হচ্ছে ইনি চিরকুমার এবং ঢাকার উচ্চ মহলে বিবাহিত মধ্যবয়সী মহিলাদের মধ্যে বিশেষ জনপ্রিয়। সবশেষে ফয়েজ আহমদ একজন অকৃত্রিম বন্ধু।
ঘন্টা খানেক পরে আমার ছেলে ফয়েজ সাহেবের খবর নিয়ে এলো। দোতালার বাসায় শীতের সকালে ভদ্রলোক কনিষ্ঠ ভ্রাতার পুত্র-কন্যারা পরিবেষ্টিত অবস্থায় চা খাচ্ছেন আর সামনে দাঁড়িয়ে ‘স্যুট’ পরিহিতি তাঁর প্রিয় বিরাট এ্যালসেসিয়ান কুকুরটা আনন্দে লেজ নাড়াচ্ছে। প্রভুভক্ত কুকুরটা নাকি সন্ধ্যা হলেই শীতের জ্বালায় কাঁদতে শুরু করে। তাই ফয়েজ সাহেব পুরানো ছেঁড়া গরম কাপড় কেটে কুকুরটার জন্য ‘রাতের পোশাক’ বানিয়ে দিয়েছেন। এখন নাকি জন্তুটা রাতে আর কাঁদাকাটি করে না।
দিন কয়েক পরে রাত ন’টার দিকে আমার বাসায় ফয়েজ এসে হাজির হলেন। চেয়ারে বসে নাকে এক গাদা নস্যি ডুকিয়ে সাদা দাঁতগুলো বের করে একটা অমায়িক হাসি দিয়ে বললেন, ‘তুই নাকি আমার খোঁজ কচ্ছিস?’
অনেক রাত পর্যন্ত দুই বন্ধুতে গল্প হলো। বিদায় নেয়ার আগে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বললো, ‘তুই আজকাল খুবই আনসোশ্যাল হয়ে যাচ্ছিস? মধ্যে-মধ্যে দু’একটা পার্টিতে গেলেও তো পারিস? লোকজনের সঙ্গে মিশলে চারদিকে কি ঘটছে অন্ততঃ সেটুকু তো জানতে পারবি? তোর লেখার জন্যও কাজে লাগতে পারে? বিচিত্রার শাহাদৎ চৌধুরীর নববর্ষের পার্টিতে কিন্তু আসিস? তোর বড় ভাই-এর আসার কথা আছে।’
কথা ক’টা বলে হন হন করে বন্ধুবর নিচে নেমে গেলো। শেষ পর্যন্ত ফয়েজের কথা রেখেছিলাম। ইংরেজী নববর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত শাহাদৎ-এর পার্টিতে যেয়ে হাজির হলাম। ঢাকার বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক ছাড়াও মন্ত্রী থেকে শুরু করে অফিসার ও কূটনীতিবিদ, এমনকি সদ্য কারামুক্ত রাজনীতিবিদ পর্যন্ত সস্ত্রীক এই সান্ধ্য-কাম-নৈশ পার্টিতে এসে হাজির হয়েছেন।
আমার কেন জানি আজ একটা কথা মনে হচ্ছিলো। গত ১০/১২ বছরের রাজনৈতিক উত্থান-পতনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, ‘আমরা যাঁরা দেশের মধ্যবিত্ত আর বিত্তশালী শ্রেণী অন্তর্ভূক্ত হয়েছি, ঘুরে-ফিরে তাঁরাই ক্ষমতার অংশীদার হচ্ছি। ব্যাপারটা অনেকটা টাকার এপিঠ ওপিঠের মতো। যে দল বা গোষ্ঠী যে শ্লোগান দিক না কেন, আমাদের সমস্যাটা হচ্ছে এ-দফায় কাদের ক্ষমতার অংশীদার করবো?

কালের নীরব সাক্ষী
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর যাঁরা ক্ষমতার অধিকারী হলেন, তাঁরা সত্তরের নির্বাচিত এবং তাঁরা ছিলেন নিম্ন-মধ্যবিত্ত আর পেটি-বুর্জোয়া শ্রেণীর। এসময় ক্ষমতাসীনদের উপর জোতদার শ্রেণীর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। ক্ষমতাসীনরা ব্যুরোক্রেসী ছাড়া আরও কাউকে ক্ষমতার অংশীদার করতে অস্বীকার করলেন। এরই বহিঃপ্রকাশ হিসাবে বৃহৎ শিল্প জাতীয়করণ হলেও কৃষি আয়কর আরোপিত হলো না।
এরপর অত্যন্ত দুঃখজনক আর শোকাবহ ঘটনার মাঝ দিয়ে যে দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠী স্বল্পকালীন সময়ের জন্য ক্ষমতাসীন হলেন, তাঁরা কাদের ক্ষমতার অংশীদার করবেন তা নির্ধারণের আগেই ক্ষমতাচ্যূত হলেন। এরা জাতির জন্য একটা ‘টুপির নমুনা’ রেখে গেলেন।
এরপর বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের শ্লোগানধারীদের সমর্থনে যাঁরা ক্ষমতায় এলেন, তাঁরা ত্বড়িৎ সিদ্ধান্ত নিলেন যে, অন্ততঃ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের সমর্থকদের ক্ষমতার অংশীদার করা যাবে না। এই ত্বড়িৎ সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে আমরা চাঞ্চল্যকর ঘটনাবলী অবলোকন করতে সক্ষম হয়েছি। এরা নব্য শিল্পপতিদের পৃষ্ঠপোষকতা করলেও শিল্প বি-জাতীয়করণে সাহসী হলেন না। কিন্তু ব্যবসায়ীদের জন্য অঢেল সুযোগ-সুবিধার সৃষ্টি করে তা পুষিয়ে দেবার চেষ্টা করলেন। এরা মুখে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে শ্লোগান উচ্চারণ করলেও দক্ষিণ আর বামপন্থীদের একই প্ল্যাটফরমে জমায়েত করলেন। উপরন্তু ব্যুরোক্রেসীর সঙ্গেও একটা সমঝোতা করলেন এবং জোতদার শ্রেণীকে সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যে ভূমি সংস্কারের প্রচেষ্টা করলেন না। কিন্তু এতো করেও শেষ রক্ষা হলো না। একটা ‘ভয়াবহ’ ঘটনার মাঝ দিয়ে এর পরিসমাপ্তি হলো।
বর্তমানে একটা ‘অন্তবর্তীকালীন অবস্থা’ চলছে। এখন হচ্ছে ‘বেসামরিক সরকার গঠন তথা গণতন্ত্রে উত্তরণের প্রক্রিয়া।’ তবে বেসামরিক সরকার গঠনের প্রাক্কালে একটা ‘পূর্ব শর্ত’ আরোপিত হয়েছে। তা হচ্ছে, প্রস্তাবিত উপ-জেলা নির্বাচনের মাধ্যমে গ্রাম-বাংলায় যে ‘কুলাক’ এবং নব্য ধনীর অবস্থান সুদৃঢ় হতে চলেছে, তাঁদের ক্ষমতার অংশীদার হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। তাই পরবর্তী বেসামরিক সরকার গঠনের পর কারা কারা ‘ক্ষমতার অংশীদার’ হবেন আর কারা কারা ভবিষ্যতের আশায় অন্ততঃ কিছুদিনের জন্য বিরোধী দলের অবস্থান করবেন সেটুকুই হবে লক্ষণীয়। আমাদের করণীয় কিইবা থাকতে পারে! আমরা তো কেবল কালের নীরক সাক্ষী!

কমরেড সুলতান
যাক যা বলছিলাম। ইংরেজী নববর্ষের সেই পার্টিতে এক কোণায় আমরা ক’জনা বসে জোর আড্ডায় মেতে উঠেছিলাম। বিষয়টা ছিলো কমরেড মোহাম্মদ সুলতানের আকস্মিক মৃত্যু। বাঙালী সমাজের একটা চিরাচরিত অভ্যাস রয়েছে। তা’ হচ্ছে, কেউ মারা গেলে সঙ্গে সঙ্গে আমরা পরলোকগত ব্যক্তিত্বের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠি এবং দরদ উথলে উঠে। সুলতান সম্পর্কে আলোচনায় আমরা তখন এরকম একটা অবস্থায় পৌঁছে গেছি। এমন সময় পার্টির ‘হোস্ট’ অর্থাৎ উদ্যোক্তা শাহাদৎ চৌধুরী এসে আমাদের আড্ডায় যোগ দিলেন। হঠাৎ করে তিনি বললেন,‘একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছেন, যাঁরা আজ থেকে প্রায় তিন যুগ আগে সক্রিয়ভাবে ৫২-র ভাষা আন্দোলন করেছিলেন, মাত্র বিশ বছরের ব্যবধানে তাঁরাই কিন্তু মোটামুটিভাবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। অথচ ৫০ দশকের গোড়ার দিকে বাংলাদেশ কি ধরনের প্রতিকূল পরিবেশ ছিলো, আর তার মধ্যেও আপনারা কিভাবে আন্দোলন গড়ে তুলেছেন সে কাহিনী তো অন্ধকারের মধ্যে রয়ে গেলো যদি চান লিখতে পারেন—আমরা বিচিত্রায় ছাপাবো।’
আজকের এই লেখার এটাই হচ্ছে ভূমিকা আর পূর্বকথা।

পঞ্চাশের দাঙ্গা
আজ থেকে প্রায় ৩৪ বছর আগেকার কথা। দিনাজপুর জেলে ১ বছর কারাজীবন কাল জেল থেকে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর আইন অধ্যয়নের জন্য ১৯৫০ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারী যখন ট্রেনে ঢাকার ফুলবাড়িয়া রেল স্টেশনে নামলাম, তখন কলকাতার দাঙ্গার প্রতিক্রিয়া হিসাবে ঢাকাতেও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে। কারফিউ-এর জন্য রেল স্টেশনেই আটকে পড়লাম।
দিনাজপুরের কলেজ জীবনের বন্ধু জোতদার-তনয় আবদুর রহমান চৌধুরী, রামসাগরের বিত্তশালী পরিবারের মতিউর রহমান আর দিনাজপুর শহরের লালবাগের চামড়ার ব্যবসায়ীর পুত্র আবদুল হককে সঙ্গে করে রিকশায় ঢাকার বকশী বাজারের ১১ নং জয়নাগ রোডের ইকবাল হলে (১ নং) পৌঁছলাম তখন প্রায় ১০টা বাজে। রাস্তায় দেখলাম দাঙ্গাবিধ্বস্ত ঢাকা শহর প্রায় জন-মানবশূন্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তখন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। তাস খেলা আর আড্ডা মারা ছাড়া কিছুই করণীয় নেই। এখানেই শাহ মোহাম্মদ আজিজুর রহমান, চট্টগ্রামের এ্যাডভোকেট আহম্মদ সোবহান, বরিশালের মরহুম ইমাদুল্লাহ লালা প্রমুখের সঙ্গে পরিচয় হলো। কাজেই খাজা দেওয়ানে একটা মেসে থাকতেন তিন বন্ধু। শেখ মুজিবুর রহমান, মোল্লা জালাউদ্দীন আর আবদুল হামিদ চৌধুরী। মাঝে-মধ্যে এই মেসেও আড্ডা মারতে যেতাম। সে যুগে মুসলমান ছাত্রদের দুটো প্রতিষ্ঠান ছিলো। শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে খাজা নাজিমউদ্দীন সমর্থন নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ। আর নঈমউদ্দীন আহম্মদ—শেখ মুজিবের নেতৃত্বে সোহরাওয়ার্দীর সমর্থক পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ। অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগের উপ-দলীয় রাজনীতির প্রেক্ষিতে এই দু’টি ছাত্র লীগের জন্ম হয়েছিলো।
যাহোক, সপ্তাহখানেক ঢাকায় থাকার পর একেবারে হাঁপিয়ে উঠলাম। আব্বা তখন বরিশালের সদর ডিএসপি। তাই ফেব্রুয়ারীর তৃতীয় সপ্তাহে একদিন বাদামতলী ঘাট থেকে বরিশাল রওয়ানা হলাম। রাত সাড়ে তিনটা নাগাদ বরিশাল পৌঁছলাম। কিন্তু স্টীমার আর ঘাটে লাগানো হলো না—মাঝ দরিয়াতে নোঙ্গর করলো। কারণ জিজ্ঞেস করে জানলাম যে, দিন কয়েক আগে বরিশালে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়েছে। শহরে এখন কারফিউ চলছে। তাই ঘাটে স্টীমার ভিড়ানো যাবে না।
বরিশালের যোগাযোগ ব্যবস্থাটা সত্যিই এক দুরূহ ব্যাপার। ‘বাংলার ভেনিস’ বলে পরিচিত এ জেলায় ১ ইঞ্চি পরিমাণ রেলওয়ে লাইন নাই। সকাল ৮টায় কারফিউ ছাড়ার পর এহেন বরিশাল জেলায় যখন প্রথম পদার্পণ করলাম, তখন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাক্ষেত্র এ জেলার আকাশ-বাতাস সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কলুষিত হয়ে গেছে।
বরিশালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য প্রত্যক্ষভাবে কারা দায়ী সে বিতর্কমূলক প্রশ্নের অভ্যন্তরে না গিয়েও এটুকু বলা চলে যে, অর্থনৈতিক বৈষম্যই এর মূল কারণ। তবে একটা কথা বলা যায় যে, সেদিন যাঁরা নিজেদের উপ-দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের জন্য ইন্ধন যুগিয়েছিলেন, তাঁদের বেশ ক’জনা পরবর্তীকালে প্রগতিশীল রাজনীতির অঙ্গনে বিচরণ করছেন।
একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ১৯৫০ সালে বরিশালের অঞ্চল বিশেষ ব্যাপকভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। তৎকালীন কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ সরকারের তফসিলী মন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল বরিশালে স্বীয় এলাকা সফর করার পর করাচীতে প্রত্যাবর্তন না করে সরাসরি কলকাতায় পাড়ি জমালেন। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান বরিশালে সামরিক বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দেন এবং নিজেই উপদ্রুত অঞ্চল সফর করেন।

খয়রাতি জাহাজ
কলকাতা আর জলপাইগুড়িতে দাঙ্গা প্রশমিত হবার দিন দুয়েকের মধ্যে বরিশালের অবস্থা শান্ত আকার ধারণ করলো। এর সপ্তাহ খানেকের মধ্যে পাক-ভারত সমঝোতার ভিত্তিতে বরিশালের সংখ্যালঘু উদ্বাস্তু নিয়ে যাওয়ার জন্য কলকাতার খিদিরপুর থেকে চারটা স্টীমার এসে হাজির হলো। আমরা এসবের নাম দিয়েছিলাম ‘খয়রাতি জাহাজ’। অর্থাৎ এসব স্টীমার যেসব সংখ্যালঘু উদ্বাস্তু ওপরের হাতছানিতে চলে যাচ্ছেন, তাঁদের জন্য কোন পয়সা লাগবে না।
এতগুলো বছর পরেও সেদিনের কথা আমার স্পষ্ট মনে রয়েছে। কাজী বাহাউদ্দীন (বর্তমানে পাসপোর্টের মহাপরিচালক) আর ক্রীড়া সংগঠক জাহাঙ্গীরসহ আমরা জনাকয়েক আগেই স্টীমার ঘাটে হাজির হলাম। চেয়ে দেখলাম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হাজার হাজার নর-নারী তাঁদের প্রাণপ্রিয় জন্মভূমি আর যৌবনের লীলাক্ষেত্র পেছনে ফেলে এক অজানার আহ্বানে সীমান্তের ওপারে পাড়ি জমাতে চলেছেন। এদের অধিকাংশই জানে না যে, ওপারে তাঁদের জন্য কি ধরনের সমাদর অপেক্ষা করছে। বাপ-দাদা চৌদ্দপুরুষের ভিটা-মাটি ছেড়ে এক মরীচিকার পেছনে যেয়ে এরা ছিন্নমূলে পরিণত হলো।
শিয়ালদা থেকে শুরু করে পশ্চিম বাংলার পথে-প্রান্তরে যুগের পর যুগ ধরে এরা চৈত্রের ঝরাপাতার মতো ঘুরে বেড়িয়েছে। এদের একদল বসতি স্থাপন করেছে কালাপানির দেশ আন্দামানে। আর একদল গিয়েছে মধ্য ভারতের অভিশপ্ত দন্ডাকারণ্যে। বছরের পর বছর ধরে অনিশ্চিত জীবন যাপন করতে যেয়ে, এসব ছিন্নমূল পরিবারের কত নারী যে সতীত্ব বিসর্জন দিয়েছে, কত বৃদ্ধ যে বিনা-চিকিৎসায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন, কত সন্তান যে শিক্ষার আলোক থেকে বঞ্চিত হয়েছে আর কত শিক্ষিত যুবক বেকারত্বের অভিশাপে তিলে তিলে দগ্ধ হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
হঠাৎ স্টীমারের বিকট হুইসেলে শব্দে সম্বিৎ ফিরে এলো। তাকিয়ে দেখলাম এক নম্বর খয়রাতি জাহাজটা নোঙ্গর তুলতে শুরু করেছে। স্টীমারের চাকা দুটো প্রবলভাবে পানি কাটতে লাগলো। পানির বুকে বিরাট তোলপাড় করে স্টীমারটা রওয়ানা হলো। মনে হলো আমি যেন বাস্তুত্যাগীদের মনের গহনের তোলপাড়টাই দেখতে পাচ্ছি। হঠাৎ বিরাট জোরে সমস্বরে স্টীমারের লোকগুলো ডুকরে কেঁদে উঠলো—‘মা, মাগো।’ অশ্রু সজল নয়নে নারিকেল গাছে ঘেরা নদীর পাড়টার দিকে তাকিয়ে রইলো। ধীরে ধীরে তাঁদের চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে গেলো। ইতিহাসের পাতায় আমরা শুধু নীরব দর্শকের ভূমিকায় অভিনয় করলাম।
এ জনাকীর্ণ বিশ্বে এসব বাস্তুহারার দল কোথায় যে হারিয়ে যাবে, তা কে বলতে পারে! কোন বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় হয়তো দন্ডাকারণ্যের নিবিড় জঙ্গলের এক উদ্বাস্তু শিবিরের পর্ণকুটিরে কোন বৃদ্ধ কিংবা বৃদ্ধা তাঁর নাতি-নাতনীদের মায়ায় ঘেরা আর ছায়ার ঢাকা নদী মাতৃক বাংলার তাঁদের আদি জন্মভূমির কাহিনী শোনাবে। আর নতুন বংশধরেরা রূপকথার মতোই অবাক বিস্ময়ে সে-সব কাহিনী শুনবে।
দাঙ্গা প্রশমিত হবার সঙ্গে সঙ্গে বরিশালে বসন্ত রোগ মহামারী আকারে দেখা দিলো। বাংলাদেশের ইতিহাসে এধরনের মহামারী আর হয়নি বললেই চলে। স্কুল-কলেজ, হাট-বাজার ও সিনেমা হল বন্ধ করার পরেও যখন দেখা গেলো যে, মহামারী বেড়েই চলেছে, তখন জেলা প্রশাসন কর্তৃপক্ষ ১৪৪ ধারা জারী করলেন। এতেও পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় কারফিউ জারী হলো। বসন্ত রোগে এতো লোক মারা যেতে লাগলো যে, শেষ পর্যন্ত কবর দেয়াই মুশকিল হয়ে পড়লো। লোকজনকে সাবধান করার জন্য কর্তৃপক্ষ রাস্তা দিয়ে লাশ নিয়ে যাবার সময় ঘন্টা বাজাবার ব্যবস্থা করলেন।
সমগ্র বরিশাল শহরটাই একটা ভৌতিক শহরে পরিণত হলো। একদিন দুপুরে ঘন্টার শব্দ শুনে আমাদের আলেকান্দার দোতলা বসার জানালার একটা কপাট খুলে যে দৃশ্য দেখলাম, তাতে শিউরে উঠলাম। একটা ঠেলা গাড়িতে ত্রিপল দিয়ে ঢাকা ৮/১০টা হিন্দু-মুসলমানের লাশ। সামনে একজন আর পেছনে দু’জন ধাঙ্গর মুখে গালপাট্টা বেঁধে ঠেলাগাড়িটা ঠেলছে। আর বেশ কিছু আগে একজন চৌকিদার লাঠির মাথায় লাগানো ঘন্টাটা ঠুং ঠুং করে বাজিয়ে হেঁটে চলেছে। পরে সব লাশ আর কবর দেয়া বা শ্মশানে নেয়া সম্ভব হয়নি। বিরাট গর্ত করে এসব লাশগুলো কোন রকমে পোঁতা হয়েছিলোম মাত্র। বেসরকারী হিসাবে শুধুমাত্র বরিশাল শহর ও পার্শ্ববর্তী কয়েকটা থানায় বসন্তের মহামারীতে প্রায় দশ হাজার লোকের মৃত্যু হয়েছিলো।

আবার ঢাকায়
আবার ঢাকায় ফিরে এলাম। কোন রকম বার্ষিক পরীক্ষা ছাড়াই দ্বিতীয় বর্ষ আইন ক্লাসে উত্তীর্ণ হলাম। বিলম্বে স্নাতক পরীক্ষার ফল প্রকাশ আর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য এক রকমভাবে বলতে গেলে সে বছর প্রথম বর্ষ আইনের কোন ক্লাসই হয়নি। এটা এমন একটা সময় যখন সর্বত্র শুধুমাত্র সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা। প্রগতিশীল মহল তখন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন। বামপন্থী শত শত হিন্দু মধ্যবিত্ত কর্মী দাঙ্গার জের হিসাবে সীমান্তের ওপারে পাড়ি জমিয়েছেন। বাকিরা হয় কারাগারে না হয় পলাতকের জীবন যাপন করছেন। ক্ষমতাসীন সরকার যে কোনরকম বিরোধী দল গঠনের উপর খড়গ-হস্ত। ঢাকায় আওয়ামী লীগ যাতে জনসভা আহ্বান না করতে পারে, সেজন্য ১৪৪ ধারার যথেচ্ছ প্রয়োগ আর নিরাপত্ত আইনে গ্রেফতার হচ্ছে। এটা এমন একটা সময় যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে যেয়ে বলেছেন,‘হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হচ্ছেন, হিন্দুস্তানের লেলিয়ে দেয়া কুকুর।’
এর কিছুদিন পরেই এলো সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের নির্বাচন। অবশ্য এর আগেই আততায়ী গুলিতে লিয়াকত আলী নিহত হয়েছেন। নাজিমউদ্দীন প্রধানমন্ত্রী আর পূর্ব বাংলার মূখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন নুরুল আমীন। এদিকে এই নির্বাচনকে উপলক্ষ্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয়তাবাদী আর বামপন্থী নীতির সমর্থক ছাত্রদের মোর্চা গঠিত হলো। ইকবাল হলের জন্য কোন পৃথক কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়ন না থাকায় আমরা তখন সলিমুল্লাহ হলের ‘এটাচ্ড’ ছাত্র। হলের আসন্ন নির্বাচনের সহ-সভাপতির পদে প্রার্থী মনোনয়নের জন্য পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের সমর্থক আর প্রগতিশীল ছাত্রদের যুক্ত বৈঠক হলো। ছাত্র লীগের ‘নমিনি’ ছিলেন কাজী গোলাম মাহবুব (বর্তমানে এডভোকেট) আর আমাদের ‘নমিনি’ মুস্তাফা নূর-উল-ইসলাম (বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক)। অনেক বাদানুবাদের পর মেসার্স অলি আহাদ, হাবীবুর রহমান শেলী (বর্তমানে বিচারপতি), বরিশালের ইমাদুল্লাহ লালা, রংপুরের জাহেদুল হক চৌধুরী মঞ্জু (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার) ও তোফাজ্জল হোসেন প্রধান তুফুল, দিনাজপুরের আবদুল হক ও মতিউর রহমান, ময়মনসিংহের হাসান হাফিজুর রহমান, চট্টগ্রামের আবদুস সাত্তার, কুমিল্লার আনোয়ারুল হক, বগুড়ার গাজীউল হক, পাবনার তাসিকুল আলম এবং কে, জি, মুস্তাফা প্রমুখের সমর্থনে ছাত্র লীগ ও বামপন্থীদের সম্মিলিত ফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী হলেন মুস্তাফা নূর-উল-ইসলাম। চীপ হুইপ কুমিল্লার মেধাবী ছাত্র অলি আহাদ।
বিরোধী দলের মনোনীত প্রার্থী সৈয়দ মকসুদ আলী (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ অধ্যাপক) এবং চীফ হুইপ সিলেটের জনাব এস, এম, আলী (বর্তমানে বিদেশে একজন প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক)। গোপনে আমাদের সমর্থন দিলো ছাত্র ফেডারেশন। আর বিরুদ্ধ পক্ষকে সমর্থনের জন্য এগিয় এলো নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ, ইসলামিক ব্রাদার হুড আর তমদ্দুন মজলিস।
একদিন রাতে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে আমাদের নির্বাচনী অফিসের কোণায় দেখলাম একজন ছাত্র মাথা নীচু করে এক মনে পোস্টার লিখছেন। প্রথমে ব্যাপারটা তত লক্ষ্য করিনি। রাত দু’টার দিকে কিছু পোস্টার লাগিয়ে সুলতান, মঞ্জু, মতিউর রহমান আর আমি যখন নির্বাচনী অফিসে ফিরে এলাম, তখনও দেখলাম ছেলেটার পোস্টার লেখার বিরতি নেই। সে রাতে আমরা নির্বাচনী অফিসেই ঘুমালাম। ভোরের অন্ধকার থাকতেই দরজা খোলার শব্দে ঘুম ভাঙতেই দেখলাম। সারারাত ধরে একনাগাড়ে পোস্টার লিখে ছেলেটা চলে গেলো। পরে জেনেছিলাম এঁর নাম সাদেক খান। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের ছাত্র এবং ছাত্র ফেডারেশনের বিশিষ্ট কর্মী। পুলিশ ও’কে খুঁজে বেড়াচ্ছে বলে পলাতকের জীবন-যাপন করছেন। পরবর্তীকালে কিছুদিন কারাগারেও ছিলেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এঁর উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। ইনি রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে বর্তমানে ব্যবসায়ে লিপ্ত।
সলিমুল্লাহ হলের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বি দু’টো দলের মধ্যে একটা অলিখিত চুক্তি হয়েছিলো। ওরা আমাদের ‘কম্যুনিস্ট’ বলবে না, আর আমরা ওদের নুরুল আমীনের দালাল বলবো না। তখনকার দিনে মাদ্রাসার ছাত্রদের উচ্চ শিক্ষার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ ব্যবস্থা ছিলো। এদের সংখ্যা ছিলো সম্ভবতঃ ১৩৭ জনের মতো আর এঁদের সবারই সলিমুল্লাহ হলে ভোটাধিকার ছিলো। তাই এসব ছাত্রদের ভোট নষ্ট করার জন্য আমরা গোপন ব্যবস্থায় একজন মওলবী-মার্কা ছাত্রকে সহ-সভাপতির পদে প্রতিদ্বন্দ্বিনতা করার জন্য দাঁড় করিয়ে দিলাম। ভদ্রলোকের কোন ক্যাবিনেট সদস্য নেই। উনি একাই শুধু সহ-সভাপতির পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। আমরা চাঁদা তুলে উনার জন্য একটা ভাড়া করা মাইকেরও ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। কিন্তু এতো করেও বুঝি শেষ রক্ষা হলো না।
নির্বাচনের দিন ভোট শুরু হবার পর হঠাৎ করে দেখলাম, একটা প্রচারপত্রে আমাদের ‘কম্যুনিস্ট’ আখ্যায়িত করে ‘বিপ্লবী মুস্তাফা নূর-উল-ইসলাম মন্ত্রীসভাকে ভোট দিয়ে হাজং কৃষকদের হত্যার জবাব দিন’ বলে ছাত্রদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারলাম যে, এই প্রচারপত্র বিরোধী পক্ষ থেকে ছাপানো হয়েছে। এ অবস্থায় আমাদের নেতারা নির্বাচনে পরাজয় একরকম মেনে নিয়ে হতাশ হয়ে পড়লো। ভোটের বিরতির সময় মোহাম্মদ সুলতান, হাসান হাফিজুর রহমানকে সঙ্গে করে চীপ হুইপ অলি আহাদের কাছে যেয়ে হাজির হলাম। একরকম জিদ করেই তাঁর কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে দৌড়ালাম ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের সামনে ক্যাপিটাল প্রিন্টিং প্রেসে। বহু অনুনয় করে ঘন্টা খানেকের মধ্যে কয়েক লাইনের একটা প্রচারপত্র ছাপালাম।

‘রাষ্ট্রভাষা উর্দু চাই’
‘আরবী হরফে বাংলা চাই’
‘মকসুদ আলী মন্ত্রীসভা জিন্দাবাদ’

বেলা দেড়টা নাগাদ এই প্রচারপত্র আমরা ভোটারদের মধ্যে বিলি করে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে ধন্বন্তরির মতে কাজ হলো। বিপক্ষের মাইক থেকে ‘অজ্ঞাত দুষ্কৃতিকারীদের’ বিরুদ্ধে সমানে বিষোদগার হলো। সন্ধ্যায় নির্বাচনী ফলাফলে দেখা গেলো স্বল্প ভোটের ব্যবধানে আমাদের প্রার্থী মুস্তাফা নূর-উল-ইসলাম বিজয়ী হয়েছেন। সলিমুল্লাহ হল নির্বাচনে এটাই হচ্ছে গ্রগতিশীল ছাত্রদের প্রথম বিজয়। ফজলুল হক হলে আগে থেকেই আমাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত। অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ডাঃ গোলাম মওলা (মরহুম) ও ডাঃ মঞ্জুর হোসেন (মরহুম) ছাত্রদের নেতৃত্ব দান করছিলেন। ঢাকা কলেজ ও জগন্নাথ কলেজে মোটামুটিভাবে প্রগতিশীল চিন্তাধারার মেধাবী ছাত্রদের আগমন হয়েছে। আর ঢাকা চারুকলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমিনুল ইসলাম, বিজন চৌধুরী মুর্তজা বশীর, দেবদাস চক্রবর্তী, কাইয়ুম চৌধুরী, কিবরিয়া প্রমুখ সবাই আমাদের সমমনা। এ প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ জয়নুল আবেদীন আর শিক্ষক কামরুল হাসানসহ সমস্ত শিক্ষাবিদরা মুক্ত ও পরিচ্ছন্ন চিন্তাধারার অধিকারী। এঁরা সবাই ছিলেন মানব-প্রেমে উদ্বুদ্ধ।

যুব লীগ ও শিল্প সাহিত্যের অঙ্গনে
এ সময় আমরা দল বেঁধে পূবর্ পাকিস্তান যুব লীগের কর্মী হিসাবে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। এর পাশাপাশি সাহিত্য, সাংবাদিকতা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও আমাদের প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হলো। তখন পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের সভাপতি ডক্টর কাজী মোতাহের হোসেন আর সম্পাদক হচ্ছে কবি ফয়েজ আহমদ। সহ-সভাপতি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, বেগম সুফিয়া কামাল ও গনি হাজারী। পাটুয়াটুলীর লয়াল স্ট্রীটের সওগাত প্রেসে ঢাকার প্রগতিশীল কবি-সাহিত্যিকদের নিয়মিতভাবে আসর বসতো। যাঁরা এসব বৈঠকে যাতায়াত করতেন, তাঁদের মধ্যে কবি শামসুর রাহমান, কবি হাসান হাফিজুর রহমান, সাইয়িদ আতিকুল্লাহ, সিকান্দার আবু জাফর, আব্দুল গনি হাজারী, মুস্তাফা নূর-উল-ইসলাম, সমালোচক খালেদ চৌধুরী, আব্দুল গফফার চৌধুরী, অগত্যা সম্পাদক ফজলে লোহানী, সরদার জয়েনউদ্দীন, তসিকুল আলম খান, কবি হাবিবুর রহমান, কবি আতোয়ার রহমান, আলাউদ্দীন আল আজাদ, কবি গোলাম রহমান, শহীদ সাবের, বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অজিত গুহ, লায়লা সামাদ, আনিসুজ্জামান, মুর্তজা বশীর, এম, আর, আখতার, আনিস চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক, কামরুল হাসান প্রমুখ অন্যতম।
সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বুলবুল ললিতকলা একাডেমীর তখন জন্ম হয়েছে। এছাড়া প্রগতিশীল মনোভাবাপন্ন প্রখ্যাত কন্ঠশিল্পী কলিম শরাফী, কাজী শাজাহান হাফিজ, শেখ লুৎফর রহমান, মাহবুব হাসানত (রহমান), আফসারী খানম তখন সঙ্গীত জগতে প্রতিষ্ঠিত। গণসঙ্গীতে এ সময় উদীয়মান শিল্পী হচ্ছেন আলতাফ মাহমুদ আর আব্দুল লতিফ। এ দু’জনেই বরিশালের কৃতি সন্তান। বাহান্নোর ভাষা আন্দোলনের পর বরিশালের আর এক কৃতি সন্তান আব্দুল গফফার চৌধুরীর লেখা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি’ গানের সুর দান করেছিলেন এই আলতাফ মাহমুদ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এই প্রতিভাবান শিল্পী তাঁর জীবন আত্মাহুতি দিয়েছেন। ভাষা আন্দোলনের পর আর একটি অনন্য সাধারণ ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়্যা নিতে চায়’ গানের কথা ও সুর হচ্ছে আব্দুল লতিফের। তৎকালীন যুব সম্প্রদায়ের মাঝে এই গান দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো।
১৯৫১ সালের আর একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান কর্তৃক গণপরিষদে উত্থাপিত খসড়া শাসনতন্ত্রের মূলনীতি সংক্রান্ত রিপোর্ট। পূর্ব বাংলা থেকে এই রিপোর্টের চরম বিরোধিতা করা হয়। মোটামুটিভাবে ঢাকা জেলা বার সমিতি এবং হাইকোর্ট বার এসোসিয়েশনের আইনজীবীরা এই ‘বিপিসি’ রিপোর্টের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। কমরুদ্দীন আহম্মদ (পরবর্তীকালে যুক্তফ্রন্টের দফতর সম্পাদক ও রাষ্ট্রদূত) এবং আতাউর রহমান খাঁন প্রমুখ এ আন্দোলন নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তৎকালীন পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকা এ ব্যাপারে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়। ১৯৫১ সালেই আততায়ীর হাতে লিয়াকত আলী খান নিহত হন বলে প্রস্তাবিত শাসনতন্ত্রের মূলনীতি সংক্রান্ত রিপোর্ট ধামাচাপা পড়ে যায়।
এই সময় আমি ১১, জয়নাগ রোডের ইকবাল হল থেকে ব্যারাক ইকবাল হলে উঠে মোহাম্মদ সুলতানের আতিথ্য গ্রহণ করলাম। তখন আমরা দু’জনে একেবারে হরিহর আত্মা। সুলতান একই সঙ্গে এম, এ-তে রাষ্ট্র বিজ্ঞান ও আইন ক্লাসের ছাত্র। আর আমি শুধু আইন অধ্যয়ন করি। অবসর সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর স্টলে চুটিয়ে আড্ডা মারি আর রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কে আলোচনা করি। এই মধুর স্টলেই একদিন আলাপ হলো কবি হাসান হাফিজুর রহমানের সঙ্গে। জীবনে যত আড্ডাবাজের সঙ্গে আলাপ হয়েছে, তার মধ্যে ইতিহাসের ছাত্র খান শামসুর রহমান খান তওফিকের (জনসনদা) পর হাসান হাফিজুর রহমান অন্যতম। প্রতিদিন সন্ধ্যায় আইন ক্লাস করার নামে যখন মধুর স্টলে হাজির হতাম, তখন দেখতাম সন্ধ্যা আরতি করেই মধু বাকির খাতা বের করে বসতো। হিসাব লিখতে লিখতে মধু চিৎকার করে উঠতো, ‘আরে ওই বলাই, আউজগা হাছন সা’বে আইছিলো?’ বলাই-এর তরফ থেকে উত্তর এলো, ‘হ’ যেমন লাগে একবার দেখছিলাম।’ অমনি মধু তার বাকীর খাতায় হাসান সাহেবের নাম লিখলো সোয়া দু’টাকা। একদিন মধুকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলাম। মধু নির্বিকারভাবে যা বললো, তাতে হতভম্ব হয়ে গেলাম ‘দেখেন মুকুলদা, কেডা আইলে কত খায়, তা’ আমাগো জানা আছে। ধরেন—সা’বে আইলে চাইর আনার বেশি খাইবো না। আর হাছন সা’বে আইলে তার লগে কমে এক হালি লোক থাকবো। হের লাইগাই তো’ সোয়া দুই টাকা লিখখা রাখলাম। আর হাছন সা’বে তো’ জিগাইবো না কবে কি খাইছে।’
হাসান তখন মাক্কুশা মাজারের কাছে ৪৫ নং নাজিমউদ্দীন রোডে থাকতো। দিন কয়েক ওকে মধুর স্টলে না পেয়ে একদিন ওর বাসায় যেয়ে হাজির হলাম। তখন সকাল দশটা বাজে। আমাকে দেখেই খুশীতে ঝলমল করে উঠলো। ‘এইতো একটু আগে বাড়ি থেকে ট্রেনে এসে নামলাম। একটা জমি বিক্রী করে এলাম। হোটেল রেস্টুরেন্টের বাকী-বকেয়া শোধ করার পর একটা পত্রিকা বের করার ইচ্ছে আছে।’ সেদিন সারাটা দিন হাসান আমাকে ছাড়লো না। দুপুরে রায় সাহেব বাজারের ইসলামিয়া রেস্টু্রেন্টে খেয়ে আমরা চললাম সওগাত প্রেসে। উদ্দেশ্য হচ্ছে হাসান তার বন্ধু-বান্ধবদের সিনেমা দেখাবে। কবি হাবিবুর রহমান আর আনিস চৌধুরীকে সওগাত প্রেসে পাওয়া গেলো। আমরা চারজন রূপমহল সিনেমা হলে ‘কাকন তলা লাইট রেলওয়ে’ ছবি দেখে কাঠের দোতলা হোটেলের বিকালের নাস্তা করলাম। সব খরচই হাসান হাফিজুর রহমানের। পকেটে পয়সা থাকলে এরকম দেদার খরচ করতে আর কাউকে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
কবি হাসান হাফিজুর রহমান এখন প্রয়াত। কিন্তু তাঁর অমর অবদান হচ্ছে, তিনি ছিলেন দাঙ্গা-বিরোধী সংকলন দাঙ্গার পাঁচটি গল্পের প্রকাশক আর পুঁথিপত্র প্রকাশনীর বিখ্যাত সংকলন ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’র সম্পাদক।
১৯৫০ আর ১৯৫১ এই দু’টো বছর আমার জীবনে খুবই অস্থিরতার মধ্যে কেটেছে। এসময় আমাকে রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন অধ্যয়ন করার পর দিনের বেলায় রাজির জন্য চাকরি করতে হয়েছে। অথচ আমার ইচ্ছে ছিলো শুধু আইন পড়বো আর ছাত্র রাজনীতি করবো। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা আর হলো না। এই দু’বছরে আমি অনেকগুলো চাকুরী করেছি। এসবের মধ্যে এ, জি, অফিস, সিভিল সাপ্লাই একাউন্টস, ও দুর্নীতি দমন বিভাগ অন্যতম। এছাড়া কয়েক মাস টিউশনীও করেছি। শেষ পর্যন্ত ‘পাকিস্তান পোস্ট’, পাকিস্তান টু-ডে’ আর মাহমুদ আলীর ‘সাপ্তাহিক নওবেলাল’ পত্রিকাতেও চাকুরী করলাম।
ঘটনাচক্রে আবার আমি বেকার হয়ে পড়লাম। তাই পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগের একজন সক্রিয় সদস্য হয়ে উঠলাম। এখানে একটা কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে যুব লীগ কোন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ছিলো না। এটা ছিলো যুব সম্প্রদায়ের একটা ‘প্ল্যাটফর্ম’ মাত্র। তাই সিলেটের মাহমুদ আলীর মতো রাজনীতিবিদ এর সভাপতি হতে পেরেছিলেন আর এর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন অলি আহাদ। যুব লীগের অফিস ছিলো ৪৩/১ যোগীনগরে কমরেড তোয়াহা সাহেবের বাসায় নীচের তলায়। তখন রোজই সুলতানকে সঙ্গে করে নিয়মিতভাবে যুব লীগের অফিস যাতায়াত করতাম। এখানেই একদিন দু’জন কিশোর এসে উপস্থিত হলো। এঁরা দু’জনেই নাকি যুব লীগের সদস্য। পাতলা একহারা গড়নের ছেলেটার সঙ্গে আলাপ করে দু’চারটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতেই দেখলাম সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে খুবই সচেতন আর রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কেও ভালো পড়াশোনা রয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কে প্রচুর জ্ঞান। ইনিই হচ্ছেন বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও দেশের চিন্তাশীল সাহিত্যিক ডক্টর আনিসুজ্জামান। আর একজন এঁর অকৃত্রিম বন্ধু চিরকুমার এ্যাডভোকেট আহম্মদ হোসেন। বর্তমানে অনেক ক’টা সমাজ সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত।
অবশেষে যুব লীগ সংগঠনের জন্য আমাকে উত্তরবঙ্গে পাঠানো হলো। যুব লীগের ম্যানিফেস্টো আর অন্যান্য কাগজপত্র নিয়ে ট্রেনে দিনাজপুর রওয়ানা হলাম। এরপর রংপুর সফর করে রাজশাহীতে হাজির হলাম। এখানেই আমার পুরানো বন্ধু দিনাজপুরের সন্তান এস, এ, বারি এটি’র সঙ্গে যোগাযোগ হলো। আতাউর রহমান (মরহুম) ও একরামুল হক তখন ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ (ইউ, জি) থাকায় বারির মাধ্যমে রাজশাহীর কর্মীদের সঙ্গে গোপনে বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। রাজশাহীর রাজনৈতিক পরিবেশ তখন খুবই উত্তপ্ত। কেননা এর আগেই রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের খাপড়া ওয়ার্ডে গুলি করে নিরস্ত্র রাজবন্দীদের হত্যা করা হয়েছে। আর নাচোল থানায় প্রতিশোধের জন্য দারোগাসহ পুরো পুলিশ পার্টিকে সাঁওতালরা জীবন্ত পুঁতে ফেলায় শুরু হয়েছে এক বলগাহীন সন্ত্রাসের রাজত্ব। জেল-জুলুম. হত্যা ও ধর্ষণে কত কৃষক পরিবার যে নিশ্চিহ্ন হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
আমি রাজশাহীতে যখন হাজির হলাম তখন নাচোল হত্যা মামলার শুনানী শুরু হয়েছে। প্রধান আসামী একজন শিক্ষিতা মহিলা। নাম কমরেড ইলা মিত্র। স্বামী কমরেড হাবু মিত্র পলাতক। ইলা মিত্র সীমান্ত স্টেশনে রোহপুরে সশস্ত্র পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। এরপর পুলিশ হেফাজতেও ইলা মিত্রের ওপর যে ধরনের পাশবিক অত্যাচার হয়েছে, তা’ ভাষা প্রকাশ করা যায় না। বন্ধুবর বারিকে বললাম, যেভাবে হোক একবার চর্মচক্ষুতে এই রূপ কথার নায়িকাকে দেখতে হবে। রাজশাহী শহর থেকে মাইল তিনেক দূরে কোর্ট এলাকা। দু’জনের একটা টমটমে কোর্টে যেয়ে হাজির হলাম। তারপর বহু কষ্টে কোর্টে ঢুকে আসামীর এজলাসে ইলা মিত্রকে দেখলাম। পাশের রাখা ‘স্ট্রেচার।’ চারদিকে গোয়েন্দা বিভাগীয় লোকের ভিড় আর কোর্টের প্রতিটি দরজায় দাঁড়িয়ে সশস্ত্র পুলিশের দল। এ মামলা চলাকালীন পুলিশ হেফাজতেই জনা তিনেক সাঁওতাল কৃষকের মৃত্যু হয়েছিলো। ইলা মিত্র যাবজ্জীবন কারাদন্ড লাভ করেন।
বছর তিনেক পরে যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক বিজয়ের পর শেরে বাংলা ফজলুল হক পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অসুস্থ ইলা মিত্রকে দেখতে যান এবং ডাক্তারদের পরামর্শে চিকিৎসার জন্য ইলা মিত্রকে ‘প্যারোলে’ কলকাতায় যাওয়ার অনুমতি প্রদান করেন। এরপর কমরেড মিত্র আর কোনদিন বাংলাদেশে আসেননি। তবে তিনি সিপিআই নমিনী হিসাবে পশ্চিমবঙ্গ পরিষদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। আবার পরবর্তীকালে সিপিএম-এর কাছে নির্বাচনে পরাজয়ও বরণ করেন।
যা’হোক, উত্তরবঙ্গে যুব লীগের সাংগঠনিক সফর শেষে দিন কয়েক পরে ঢাকায় ফিরে এলাম। যুব লীগ নেতা ইমাদুল্লাহ লালার কাছে রিপোর্ট পেশ করলাম। বাংলাদেশের প্রগতিশীল আন্দোলনে যাঁদের অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকার কথা তাঁদের মধ্যে বরিশালের কৃতি সন্তান ইমাদুল্লাহ লালা ও কুমিল্লা দেওয়ান মাহবুব আলী অন্যতম।
পঞ্চাশের দাঙ্গা-বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ‘বিপিসি’ আন্দোলন, বাহান্নের ভাষা আন্দোলন এবং চুয়ান্নোর সাধারণ নির্বাচনে এঁরা দু’জনেই বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। ইমাদুল্লাহ লালা ভাই ছিলেন একজন সাচ্চা বামপন্থী কর্মী। তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিলো অপরিসীম। চুয়ান্নোর সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশের হুলিয়া জারী হলে, যুক্তফ্রন্ট প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারণার জন্য দক্ষিণ বাংলার দুর্গম অঞ্চলে গমন করে নির্বাচন সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত প্রকাশ্যে আর ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেননি। ১৯৫০ সালে লালা ভাইকে প্রথম ঢাকায় ১১ নম্বর জয়নাগ রোডে দেখেছিলাম। গলায় বিরাট একটা তাবিজ ঝুলিয়ে কাবলী পাজামা পরে সেদিন তিনি ব্যাডমিন্টন খেলছিলেন। পরে আলাপ হলো অদ্ভূত আর অপূর্ব ব্যক্তিত্ব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন অধ্যয়ন করতে এসেছিলেন। কিন্তু বরিশালের আঞ্চলিক ভাষা তিনি ছাড়তে পারেননি। দিব্যি সবার সামনে বিনা সংকোচে বরিশ্যাইল্যা উচ্চারণে কথা বলে চলেছেন।
ভাষা আন্দোলনের সময় অলি আহাদ গ্রেফতার হবার পর লালা ভাই যুব লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরই আমলে দেশের সর্বত্র যুব লীগ সম্প্রসারিত হয়েছিলো। চুয়ান্নোর সাধারণ নির্বাচনে যুব লীগের বিরাট কর্মী বাহিনী যুক্তফ্রন্টের পক্ষে প্রচার কার্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। এসময় প্রায় আটশ’ প্রগতিশীল কর্মীকে আটক করবার জন্য গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী হলে সবাই ঢাকা থেকে উধাও হয়ে গেলো। জনাব তোয়াহা যুক্তফ্রন্টের নমিনেশন পাওয়ায় সপরিবারে নোয়াখালীতে গেলে ৪৩/১ যোগীনগরের সমস্ত বাড়িটাই খালি হয়ে রইলো। উপরের তলায় তোয়াহা সাহেবের পরিবারও নেই, নীচের তলায় যুব লীগের অফিসও খালি।

আমার সংসার ও অতিথিরা
পিতা-মাতাকে খুশী করার জন্য এসব ঘটনায় মাস আষ্টেক আগে বড় দু’ভাইকে রেখে আমি বগুড়ায় বিয়ে করেছি। এরপর ঢাকায় ফিরে এসে ১৯৫৩ সালের ২৪ ডিসেম্বরে মাসিক পঁচাত্তর টাকা বেতনে দৈনিক ইত্তেফাকের বার্তা বিভাগে যোগ দিয়েছি। একদিন হঠাৎ করে আমার জীবন সঙ্গিনী ঢাকায় এসে হাজির হলেন। পঁচাত্তর টাকার সাব এডিটরের চাকরিতে ঢাকায় স্বামী-স্ত্রীর বসবাস অসম্ভব ব্যাপার—এ কথা ওকে বোঝাতেই পারলাম না। শেষ পর্যন্ত তোয়াহা সাহেবের বাসাটা ব্যবহার করতে শুরু করলাম। বাসাটাতে প্রয়োজনীয় সব কিছুই রয়েছে। তাই নতুন সংসার পাতার জন্য আমার কোন খরচই করতে হলো না। তখন ঢাকায় চালের মণ দশ টাকা আর টাকায় চারটা ইলিশ মাছ পাওয়া যেতো। তরি-তরকারী খুবই সস্তা। একরকমভাবে সংসার চালিয়ে নিলাম। তবুও সংসারে সচ্ছলতার জন্য আমার স্ত্রী বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থায় একটা চাকরি নিলো।
সে রাতের কথার আমার স্পষ্ট মনে রয়েছে। মাঝ রাতে দারুণ বৃষ্টি হলো। তখন ‘ইত্তেফাক’ অফিস ছিলো নয় নম্বর হাটখোলা রোডে। নাইট ডিউটি দিয়ে রাত তিনটার পর পায়ে হেঁটে যোগীনগর রওয়ানা হলাম। চারদিক একেবারে নিশ্চুপ অন্ধকার। সমগ্র শহরটা ঘুমিয়ে রয়েছে। মাঝে মাঝে পুলিশের বাঁশীর শব্দ আর দূর থেকে কুকুরের ঘেউ ঘেউ আওয়াজ ভেসে আসছে। বাসার ভিতরে ঢোকার মিনিট পাঁচেক পরেই আবার দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেলাম। বিরক্তিতে মনটা ভরে উঠলো। কিন্তু নীচের তলায় এসে বাইরের দরজা খুলতেই চমকে উঠলাম। সামনে একদল পুলিশ সঙ্গে একজন দারোগা সাহেব দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
আমাকে দেখেই দারোগা সাহেব বললেন, ‘যুব লীগ অফিস সার্চ করার জন্য ওয়ারেন্ট নিয়ে এসেছি।’
জবাব দিলাম, ‘বেশ তো’ আপনারা ডিউটি করবেন তাতে আমার বলবার কিইবা থাকতে পারে?’
আমি পরিষ্কারভাবে দারোগা সাহেবকে বুঝিয়ে বললাম যে, আমি হচ্ছি ছা-পোষা মানুষ। প্যারামাউন্ট প্রেসে চাকরি করি আর সস্ত্রীক উপরের তলায় ভাড়ায় থাকি। নীচের তলায় যুব লীগওয়ালারা কি করে তা’ জানার আমার সময় কোথায়?
লক্ষ্য করে দেখলাম, পাড়ার দু’জন লোককে সাক্ষী হিসাবে আনা হয়েছে। দারোগা সাহেবের হুকুমের সঙ্গে সঙ্গে একজন কনস্টেবল বিরাট একগোছা চাবি বের করে যুব লীগ অফিসের তালা খুলতে চেষ্টা করলো। মিনিট কয়েক প্রচেষ্টার পর তালা খুলে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে সাদা পোশাকের ডি, আই, বি’র লোকটা ভিতরে ঢুকে কাগজপত্র ঘাটতে শুরু করলো। আমি আস্তে করে দারোগা সাহেবকে ভদ্রলোকের পরিচয় জিজ্ঞেস করে বললাম, ‘সার্চ করার কাজটা আপনি করলে ভালো হতো। ওনার গায়ে খাকি পোশাক নাই কি না?‘ আমার কথায় কাজ হলো। ‘ডি, আই, বি’ একটা চেয়ার টেনে বসলেন আর দারোগা সাহেব টেবিলের কিছু কাগজপত্র নাড়াচাড়া করে বললেন, ‘কিছুই তো পাওয়া গেলো না।’ এই বলে সার্চ ওয়ারেন্টটা টেবিলের ওপর রেখে ‘নাথিং ফাউন্ড’ লিখে দিলেন। আমরা সব ক’জন দস্তখত করলাম।
পুলিশের লোকজন চলে যাবার পর বাইরের দরজা বন্ধ করে ভিতরের সিঁড়ির কাছে আসতেই বুকটা চমকে উঠলো। একতলায় পিছনের ঘর থেকে অন্ধকারের মাঝে লালা ভাই বেরিয়ে এলেন। বললেন, ‘কি কও? এইবার মোর কপালডা ভালোই। আইজ রাইতেওই মুই বরিশ্যাল থাইক্যা আইছি। কাউরে না দেইখ্যা পিছনের ঘরে হুইতত্যা আছিলাম।’
সকালে আর লালা ভাই-এর সঙ্গে দেখা হলো না। বোধ হয় ফজরের আজানের আগেই অন্ধকারের মধ্যে উধাও হয়ে গেছেন।
চুয়ান্নোর সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের টিকিটে তোয়াহা সাহেব জয়লাভ করে ঢাকায় সপরিবারে ফিরে এলেন, আমি দক্ষিণ যৌশুন্ডিত বাসা ভাড়া করে উঠে গেলাম। তবুও প্রায়ই যুব লীগ অফিসে যেতাম। এর মধ্যে লালা ভাই আইন পরীক্ষাও দিয়েছেন। কিছুদিন পরে হঠাৎ করে যুব লীগ অফিসেই শুনলাম যে, লালা ভাই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন।
এর কিছুদিন পরে একদিন বিকেলে যুব লীগ অফিসে বরিশালের দুই কৃতি সন্তান মুহম্মদ ইমাদুল্লাহ লালা ভাই আর আলতাফ মাহমুদকে পেলাম। দু’জনেই উদারমনা ও প্রগতিশীল মনোভাবাপন্ন এবং দুখী মানুষের জন্য নিবেদিত প্রাণ। আমাকে দেখে লালা ভাই যুব লীগ অফিস সার্চ করার ঘটনার কথা বলে অট্টহাস্যে ফেটে পড়লেন। পকেট থেকে হলুদ গোল্ড ফ্লেক সিগারেটের প্যাকেট বের করে আমাকে একটা দিয়ে বললেন, ‘প্যাকেটটা একটুক আগে একজনে দিছে। তাই হবাইরে খাওয়াইতাছি।’
এর মধ্যে আমাদের আড্ডায় বগুড়ার নৃত্যশিল্পী নিজামুল হক এসে হাজির হলেন। লালা ভাই বললেন, ‘তোর বড় ভাই গাজীউল আমার বন্ধু হইলে কি হইবে, লা তুইও একটা ভালো সিগারেট খাইয়া যা।’
আড্ডা দিতে দিতে হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘লালা ভাই আপনেও নাকি হেই কারবার করছেন?’ আবার অট্টহাস্যে ফেটে পড়লেন। বললেন, ‘হ’ মুই এহন বুর্জোয়া।’
বিদায় নেয়ার সময় ঘুর্ণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি যে, এটাই হবে আমাদের শেষ দেখা। যখন মিটফোর্ড হাসপাতালে তাঁকে দেখতে গেলাম, তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। দুরারোগ্য বসন্তরোগে পূর্ব বাংলার যুব সমাজের নয়নমণি আর ইহ জগতে নেই। তাঁর স্ত্রী তখন অন্তঃসত্ত্বা।
আজকের দিনে যাঁরা প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে নিজেদের দাবি করেন, তাঁরা কিন্তু ক্ষণিকের তরেও লালা ভাই কিংবা নওগাঁর ডাক্তার মঞ্জুরের (বিপ্লবদা) কথা মনে করেন না। ‘ইমাদুল্লাহ পাঠাগারকে’ কি পুনরুজ্জীবিত করা যায় না?
বরিশালের ইমাদুল্লাহ লালার মতো দিনাজপুরের দবিরুল ইসলাম ও এ্যাডভোকেট গোলাম রহমান, নওগাঁর ডাঃ মঞ্জুর, রাজশাহীর আতাউর, মাদারীপুরের ডাঃ গোলাম মওলা, পাবনার সেলিনা বানু ও শাহজাহান, ঢাকার কমরুদ্দীন আহম্মদ আর কুমিল্লার দেওয়ান মাহবুব আলীর মতো বহু নিবেদিতপ্রাণ তো বিস্মৃতির অন্তরালে দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে।

উত্থানের দিনলিপি
একাত্তর সাল পর্যন্ত পূর্ব বাংলার প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কুমিল্লার দেওয়ান মাহবুব আলী। ফর্সা, শীর্নদেহ আর ক্ষুদ্র অবয়বের এই দেওয়ান সাহেব এক বিত্তশালী পরিবারের সন্তান হয়েও আজীবন মেহনতী মানুষের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে দেওয়ান মাহবুব একটা প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসাবে দিল্লীতে গিয়েছিলেন। আকস্মিকভাবে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। দিল্লীতেই দেওয়ান সাহেবের কবর হয়েছে। পঞ্চাশ দশকে যাঁরা এদেশে প্রগতিশীল রাজনীতি করেছেন, তাঁরা কেমন করে দেওয়ান সাহেবের পাতলা ঠোঁটের সেই ছোট্ট মিষ্টি হাসিটা ভুলতে পেরেছেন?
যাক যা’ বলছিলাম। পঞ্চাশের ফেব্রুয়ারীতে ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর আমরা বাহান্নোর ফেব্রুয়ারীতে একটা অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক ভাষা আন্দোলনের জন্য মাত্র চব্বিশ মাস অর্থাৎ দু’বছরের সময় পেয়েছিলাম। এটুকু সময়ের মধ্যে ছাত্র ও যুব সমাজ থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদদের চিন্তাধারার মধ্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার পেছনে যে নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা করা হয়েছিলো তার উল্লেখ তো’ কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। এ সময়ের মধ্যে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সাংবাদিকতায় যে মুক্তবুদ্ধি ও পরিচ্ছন্ন মতাদর্শের প্রবর্তন হলো তারও তো’ সঠিক ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, ধর্মের জিগির উত্থাপন করে এবং উপমহাদেশে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মধ্যে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামে দেশটা সৃষ্টি করা হয়েছিলো। এর মাত্র সাত মাস পরে আটচল্লিশের মার্চ মাসে প্রথম ভাষা আন্দোলনে ঢাকায় ছাত্রদের শোভাযাত্রা রায় সাহেব বাজার এলাকায় পৌঁছুলে স্থানীয় অধিবাসীরাই পিটিয়ে দিয়েছিলো। আবার পঞ্চাশ সালে ঢাকায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘঠিত হয়েছিলো। সেই ঢাকায় বাহান্নোর ভাষা আন্দোলনে গুলিবর্ষণের পর স্থানীয় অধিবাসীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে সহযোগিতা করেছিলো তা’ অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এটা কিভাবে সম্ভব হয়েছিলো তা’ বিস্ময়ের কথা।
এই স্বল্পকালীন সময়ের মধ্যে টাঙ্গাইলের উপ-নির্বাচনে মুসলিম লীগের পরাজয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের নেতৃত্বে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী ধর্মঘট, রাজশাহী ও দিনাজপুরে ছাত্র আন্দোলন, পূর্ব বাংলায় রেলওয়ে ধর্মঘট, হাজং কৃষকদের ওপর গুলিবর্ষণ, পুলিশ ধর্মঘট, দিনাজপুর জেলে রাজবন্দীদের ওপর লাঠিচার্জ, ঢাকা জেলে রাজবন্দীদের দীর্ঘস্থায়ী অনশন ধর্মঘট, রাজশাহী জেলে খাপড়া ওয়ার্ড নিরস্ত্র রাজবন্দীদের ওপর গুলিবর্ষণ, নাচোলে কৃষক আন্দোলন, প্রস্তাবিত শাসনতন্ত্রের খসড়া মূলনীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ সময় বিরোধী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ গঠিত হয়েছে এবং ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর আয়োজিত প্রতিটি জনসভা হয় গুন্ডা বাহিনীর হামলায় নষ্ট করা হয়েছে না হয় ১৪৪ ধারা জারী করা হয়েছে। সরকার জন-নিরাপত্তা আইনে ব্যাপক ধর-পাকড় অব্যাহত রেখেছে। এটা এমন একটা সময় যখন রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তীর উদ্যোক্তাদের গ্রেফতারী পরোয়ানা ভয়ে পালিয়ে বেড়াতে হতো। কিন্তু এর মধ্যেও পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের জন্ম হয়েছে এবং তমদ্দুন মজলিস তার বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। এটা এমন এক সময় যখন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে জন-নিরাপত্তা আইনে পূর্ব বাংলা থেকে বহিষ্কার করে ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারী করা হয়েছে। তবুও বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে যেয়ে এবং শেষ পর্যন্ত নদী বক্ষে নৌকার ওপরে পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগ সৃষ্টি করা হয়েছে।
অত্যাচার চিরকালই মানুষের সুপ্ত শক্তির বহিঃপ্রকাশের সহায়ক। এক কথায় বলতে গেলে পঞ্চাশ দশকের প্রারম্ভে এটাই ছিলো পূর্ব বাংলার প্রকৃত অব্স্থা। আমরা এই পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করাটা চ্যালেঞ্জ হিসাবে গ্রহণ করেছিলাম।
অবশ্য দল বা গোষ্ঠী হিসাবে স্ব স্ব ক্ষেত্রে যেসব সংগঠন কর্মতৎপর ছিলো, তাদের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, খেলাফতে রব্বানী পর্যন্ত তমদ্দুন মজলিস, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগ, পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগ, পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ এবং গোপন সংগঠন ছাত্র ফেডারেশন ও কম্যুনিস্ট পার্টি অন্যতম। এরই প্রেক্ষাপটে শুরু হলো বাহান্নোর ভাষা আন্দোলন।

এরপর পূর্ব বাংলার ঘটনাপঞ্জী নিম্নরূপ :
২৬ জানুয়ারী, ১৯৫২ : পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী নাজিমউদ্দীন পল্টন ময়দানে মুসলিম লীগের আয়োজিত জনসভায় ঘোষণা করলেন ‘উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা হবে।’

৩০ জানুয়ারী, ১৯৫২ : ভাষার প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীনের উক্তির বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের পূর্ণ ধর্মঘট, প্রতিবাদ সভা ও রমনা এলাকায় বিক্ষোভ-মিছিল।

ঢাকা বার লাইব্রেরীতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে কর্মী সম্মেলনে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠন।’ তৎকালীন আওয়ামী লীগের কাজী গোলাম মাহবুব আহ্বায়ক নির্বাচিত। কর্মপরিষদের প্রথম বৈঠকে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে ২১ ফেব্রুয়ারী পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদের বাজেট অধিবেশন ছিলো বলেই, এই দিনটা হরতালের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছিলো।

৪ ফেব্রুয়ারী, ১৯৫২ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বানে রাজধানীতে ছাত্র-ধর্মঘট ও গাজীউল হকের সভাপতিত্বে কলা ভবনে প্রায় দশ হাজার ছাত্রের প্রতিবাদ সভা এবং ছাত্রদের প্রতিবাদ মিছিলের শহর প্রদক্ষিণ। প্রদেশব্যাপী ২১ ফেব্রুয়ারী হরতালের কর্মসূচীর প্রতি সমর্থন ও প্রচার।

২০ ফেব্রুয়ারী, ১৯৫২ : পূর্ববঙ্গ সরকার কর্তৃক আকস্মিকভাবে ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারী এবং সভা ও শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষণা।
পরিস্থিতির মোকাবিলায় নবাবপুরে আওয়ামী লীগ অফিসে জনাব আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের জরুরী বৈঠক। মোট পাঁচজন যথাক্রমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি গোলাম মওলা, ফজলুল হক হল ইউনিয়নের সহ-সভাপতি শামসুল আলম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আব্দুল মতিন, পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগের সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদ এবং মোহাম্মদ তোয়াহা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে জোরালো বক্তব্য উপস্থাপন করলেন। এঁরা বললেন, এভাবে বার বার সরকারের দমননীতি মুখ বুঁজে আর সহ্য করা যায় না। বৈঠকের সভাপতি জনাব আবুল হাশিম ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে ও বিপক্ষে ভোট গ্রহণ করেন। ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার বিপক্ষের দল ভোটে জয়লাভ করেন। ফলাফল ১১-৪ ভোট এবং একজন ভোটদানে বিরত। এই একজন হচ্ছেন বামপন্থী নেতা মোহাম্মদ তোয়াহা। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কম্যুনিস্ট পার্টি এ মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলো যে, ভাষা আন্দোলন উপলক্ষে সরকারের সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে আইন ও শৃংখলাজনিত পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে নুরুল আমীন সরকার এই অছিলায় আসন্ন প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দিতে পারে। তাই ১৪৪ ধারা ভাঙা বাঞ্ছনীয় হবে না। উপরন্তু আওয়ামী লীগের অনুরূপ সিদ্ধান্তের প্রতি নিষ্ঠাবান থাকতে হবে। সেদিন কম্যুনিস্ট পার্টির নির্দেশেই মোহাম্মদ তোয়াহা ভোটদানে বিরত ছিলেন।
বৈঠকের পর সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের উদ্যোগে কয়েকটি ঘোড়ার গাড়িতে করে ঢাকায় নতুন করে প্রচার করা হয় যে, ’২১ ফেব্রুয়ারীর হরতাল প্রত্যাহার করা হয়েছে।’
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃস্থানীয় ছাত্ররা রাত প্রায় বারোটার সময় ফজলুল হক হল ও ঢাকা হলের মধ্যবর্তী পুকুরের পাড়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য জমায়েত হলেন। এই বৈঠকে নিম্নোক্ত ১১ জন ছাত্রনেতা উপস্থিত ছিলেন। :
১) গাজীউল হক (বর্তমানে প্রখ্যাত আইনজীবী)
২) হাবিবুর রহমান শেলী (বর্তমানে বিচারপতি)
৩) মোহাম্মদ সুলতান (মরহুম)
৪) এম আর আখতার মুকুল (স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের চরমপত্র খ্যাত এবং অত্র নিবন্ধের লেখক)
৫) জিল্লুর রহমান (আওয়ামী লীগের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক)
৬) আব্দুল মোমিন (আওয়ামী লীগের প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী)
৭) এস, এ, বারি এ,টি (বিএনপির প্রাক্তন উপ-প্রধানমন্ত্রী)
৮) কমরুদ্দীন শহুদ (বর্তমানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক)
৯) আনোয়ারুল হক খান (একাত্তর মুজিবনগর সরকারের তথ্য সচিব)
১০) মঞ্জুর হোসেন (মরহুম ডাক্তার) এবং
১১) আনোয়ার হোসেন (পরিচয় অজ্ঞাত)

পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারী ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে এই বৈঠকে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই বৈঠকে কলা ভবনে কিভাবে সভা পরিচালনা করতে হবে তারও কৌশল নির্ধারণ করা হয়। যেভাবেই হোক গাজীউল হককে এই সভার সভাপতিত্ব করতে হবে। প্রস্তাবক হবে এম আর আখতার মুকুল আর প্রস্তাব সমর্থন করবেন কমরুদ্দীন শহুদ। ভোর রাতে কিংবা সকালে গাজীউল হক গ্রেফতার হলে, এম আর আখতার মুকুল সে দায়িত্ব পালন করবেন। সে আমলের সবচেয়ে প্রতিশ্রতিশীল যুবনেতা অলি আহাদকে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের পুরোভাগে আনতে না পারার পিছনে দু’টো কারণ রয়েছে। প্রথমতঃ তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নন (এম, কম ক্লাসে তাঁর ভর্তির আবেদনপত্র রাজনৈতিক কারণে বাতিল করা হয়) এবং দ্বিতীয়তঃ তিনি হচ্ছেন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সদস্য। এই পরিষদ ১৪৪ ধারা না ভাঙার পক্ষে মত প্রকাশ করছে।

একুশে ফেব্রুয়ারী
২১ ফেব্রুয়ারী, ১৯৫২ : সকাল থেকেই দলে দলে ছাত্ররা বিভিন্ন স্কুল কলেজ থেকে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে জমায়েত হতে শুরু করলো। বেলা এগারোটা নাগাদ কলা ভবনের চত্বরে প্রায় তিরিশ হাজারের মতো ছাত্র-ছাত্রী জমায়েত হলো। এ সময় একটা টেবিলে দাঁড়িয়ে আমি পূর্ব সিদ্ধান্ত মোতাবেক সভার সভাপতি হিসাবে গাজীউল হকের নাম প্রস্তাব করলাম এবং কমরুদ্দীন শহুদ সেই প্রস্তাব সমর্থন করলো। গাজীউল লাফ দিয়ে টেবিলে উঠে সভার কাজ শুরু করলেন। চারদিকে তখন তুমুল উত্তেজনা আর কলা ভবনের সামনের পিচ-ঢালা রাস্তার ঐপাশটায় হাজার কয়েক পুলিশ ও টিয়ার-গ্যাস স্কোয়াড হুকুমের প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে।
সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের পক্ষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক (মরহুম) ১৪৪ ধারা না ভাঙার জন্য এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আব্দুল মতিন ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে বক্তব্য রাখলেন। সবশেষে গাজীউল হক ১৪৪ ধারা ভাঙার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানালেন।
সভা শেষ হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে সিলেটের আব্দুস সামাদ (বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতা) সত্যাগ্রহের প্রস্তাব উত্থাপন করলেন। প্রস্তাবে তিনি বললেন, দশজন করে একেক দলে রাস্তায় যেয়ে ১৪৪ ধারা ভাঙতে হবে। প্রস্তাবটি তুমুল করতালির মধ্যে গৃহীত হলো। এরপর দশজনের মিছিল একটার পর একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোহার গেট দিয়ে বেরিয়ে স্বেচ্ছায় গ্রেফতার বরণ করতে শুরু করলো। গ্রেফতারের সংখ্যা এতো বেড়ে গেলো যে, ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থান সংকুলান হলো না। তাই পরের দিকে পুলিশ গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের দল বেঁধে বসে উঠিয়ে ভাওয়ালের জঙ্গলের দিকে নিয়ে ছেড়ে দিলো।
এ সময় কলা ভবনের চত্বরের ছাত্রদের তাড়িয়ে দেয়ার জন্য আকস্মিকভাবে পুলিশ কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ শুরু করলে উত্তেজনা চরমে ওঠে। একই সঙ্গে পুলিশ যথেচ্ছভাবে লাঠিচার্জ আরম্ভ করে। ফলে ছাত্ররাও অবিরাম ইট-পাটকেল ছুঁড়তে শুরু করলো। প্রায় ঘন্টা দুয়েক পর্যন্ত এই অবস্থা চলতে থাকে। এ সময় একটা টিয়ার গ্যাস শেলে গাজীউল হক আহত ও অজ্ঞান হয়ে পড়লে আমি আর জুলমত আলী খান (বর্তমানে বিএনপি’র যুগ্ম-সম্পাদক) গাজীকে ধরাধরি করে আর্টস বিল্ডিং-এর দোতলায় রেখে আসি।
ছাত্ররা নিজেদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য কলা ভবন ও মেডিকেল হাসপাতালের মধ্যবর্তী দেয়ালটা ভেঙে ফেললো এবং ধীরে ধীরে মেডিকেল কলেজের ব্যারাক হোস্টেলের চত্বরে জমায়েত হতে শুরু করলো। ছাত্র নেতাদের অধিকাংশই তখন গ্রেফতার হয়ে গেছেন। কেউ কেউ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। আবার জনা কয়েক ইতিমধ্যেই আহত হয়েছেন। তবুও মেডিকেল কলেজের ব্যারাক হোস্টেলের সামনের রাস্তায় ছোট-খাটো ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ অব্যাহত থাকলো।
এদিকে বেলা তিনটায় প্রাদেশিক পরিষদের বাজেট অধিবেশনে মন্ত্রী ও পরিষদ সদস্যদের যাতায়াতের জন্য পুলিশের ওপর রাস্তা পরিষ্কার রাখার নির্দেশ এলো। আজকের জগন্নাথ হলই সেদিনকার পরিষদ ভবন। তাই অতিরিক্ত পুলিশ আমদানী করে মেডিকেল হোস্টেল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও পরিষদ ভবন এলাকা ‘বিপদ মুক্ত’ করার প্রচেষ্টা শুরু হলো। কিন্তু ছাত্ররা তা করতে দিবে না। বেলা দু’টা নাগাদ হাজার হাজার ছাত্র আবার জমায়েত হলো মেডিকেল ব্যারাক হোস্টেল এলাকায়। পুলিশের লাঠিচার্জ আর ছাত্রদের ইষ্টক বৃষ্টি বেড়েই চললো। এ সময় ছাত্ররা মেডিকেল হোস্টেল আর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে দু’টো মাইকের ব্যবস্থা করায় কর্মীদের নির্দেশ দেয়ার সুবিধা হলো। গাড়িতে মন্ত্রী বা পরিষদ সদস্য দৃষ্টিগোচর হলেই ছাত্ররা আরও বেশি মারমুখো হয়ে উঠলো। ছাত্রদের ইষ্টক বৃষ্টির সামনে পুলিশের পক্ষে নিরাপদে রাস্তায় দাঁড়ানো মুশকিল হয়ে পড়লো। তাই পুলিশ কয়েক দফায় মেডিকেল হোস্টেলের গেটের মধ্যে ঢুকে বেপরোয়া লাঠিচার্জ ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করলো। কিন্তু উল্টো দিকের বাতাসের জন্য টিয়ার গ্যাস কার্যকরী হলো না এবং ছাত্রদের নিক্ষিপ্ত ইটের দরুণ পুলিশ বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হলো। এসময় মেডিকেল হোস্টেল এলাকায় পরিচিত মুখের মধ্যে মাহবুব জামাল জাহেদী এবং মেডিকেলের ছাত্র নেতা গোলাম মওলা, মঞ্জুর হোসেন ও বদরুল আলমকে দেখতে পাই। ডাঃ মওলা (মাদারীপুর), ডাঃ মঞ্জুর (নওগাঁ) এবং ডাঃ বদরুল (ঢাকা) এই তিনজনেই আর ইহজগতে নেই।
একুশে ফেব্রুয়ারী বেলা ঠিক তিনটা দশ মিনিটের সময় আকস্মিকভাবে একদল সশস্ত্র পুলিশ হোস্টেলের গেটের মধ্যে প্রবেশ করে গুলিবর্ষণ করলো। ঘটনাস্থলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আব্দুল জব্বার ও রফিকউদ্দীন নিহত হলো। রাস্তায় পড়ে থাকা গোটা কয়েক অছাত্রের লাশ পুলিশ ট্রাকে নিয়ে গেলো। সে রাতেই হাসপাতালে গুরুতররূপে আহত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র আবুল বরকত ও বাদাতমলীর একটা প্রেসের কর্মচারী সালামের মৃত্যু হলো। হাসপাতালে আহতের সংখ্যা ৯৬ জন। এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার, যেখানটায় এখনকার শহীদ মিনার রয়েছে ঠিক ও জায়গাটাতে কিন্তু গুলিবর্ষণ হয়নি। ব্যারাক মেডিকেল হোস্টেলের সামনে এখনকার মেডিকেলের ‘আউটডোর-এ’ ঢোকার গেটের দিকে মুখ করে দাঁড়ালে ঠিক গেটের ডান পাশটা হচ্ছে গুলিবর্ষণের স্থান। প্রথম শহীদ মিনার এখানেই তৈরি করা হয়েছিলো।
একুশে ফেব্রুয়ারী পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনা আমার এখনও স্পষ্ট মনে রয়েছে। সে দিন ছিলো বৃহস্পতিবার। বেলা তিনটার দিকে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা মেডিকেল হোস্টেলের গেটের কাছে রাস্তায় একটা জীপ আটক করলো। এই জীপে তৎকালীন প্রাদেশিক পূর্তমন্ত্রী দিনাজপুরের হাসান আলী যাচ্ছিলেন। ত্বড়িৎ গতিতে পুলিশ হাসান আলীকে উদ্ধার করে এবং লাঠিচার্জ করে ছাত্রদের রাস্তা থেকে পিছু হটতে বাধ্য করে। কিন্তু এর মধ্যেই জীপের চাকার পাম্প ছেড়ে দেয়া হয়েছে। হোস্টেল এলাকা থেকে দেখতে পেলাম এ্যাংলো পুলিশ সার্জেন্ট মুখে চোঙ্গা লাগিয়ে কি যেনো বলছে। মাইকের আওয়াজে তা বোঝা গেলো না। এরপর হাতের লাল পতাকাটা উপরে উঠিয়ে পুলিশকে ইশারা দিলো। সার্জেন্ট চোঙ্গা দিয়ে যা’ বলেছিলো, সেটাই ছিলো ছাত্রদের প্রতি হুঁশিয়ারী। আর লাল পতাকার ইশারা ছিল গুলিবর্ষণের ইশারা।
রাস্তার ওপাশটায় একটা স্টেশনারী দোকান ছিলো। তারই পিছনে অবস্থান করছিলো একদল সশস্ত্র পুলিশ। হঠাৎ দেখি ওরা ‘ডবল মার্চ’ করে হোস্টেলের গেটের ভিতরে কয়েক গজ পর্যন্ত ঢুকে ছাত্রদের গুলিবর্ষণ করলো। তখন সময় হচ্ছে বেলা তিনটা বেজে দশ মিনিট। মুহূর্তে আমি বিকট জোরে চিৎকার করে উঠলাম ‘গুলি—সবাই মাটিতে শুয়ে পড়ুন।’ মাথাটা উপুড় করে ঘাসের ওপর শুয়ে পড়লাম। বাতাসে কয়েক মিনিট পর্যন্ত গুলির শব্দ শুনলাম না। গুলি শেষ হবার পর যখন মাটি থেকে উঠে দাঁড়ালাম, তখন সমস্ত এলাকাটা একটা রণক্ষেত্রের মতো মনে হচ্ছিলো। চারদিকে শুধু আহতদের করুণ ক্রন্দন। দৌড়ে ইমারজেন্সীতে গেলাম। সঙ্গে আমার জনা চারেক অপরিচিত মেডিকেল ছাত্র। ইমারজেন্সীর লোকজন আর আমরা সবাই ‘স্ট্রেচার’ নিয়ে দৌড়ালাম। দিনাজপুরের এক পরিচিত মেডিকেলের ছাত্র তালুকদার আমার পিঠে একটা বিরাট রেডক্রসওয়ালা কাপড় সেপ্টিপিন দিয়ে লাগিয়ে দিলো। বেলা চারটা নাগাদ আমরা দুটো লাশ ‘স্ট্রেচারে’ এনে ইমারজেন্সীই এক কোণায় রাখলাম।
ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে এ সময় চাকরিরত ইংরেজ ডাক্তার এলিংসনের কথা না লিখলে অন্যায় করা হবে। গুলি হওয়ার খবর পেয়ে ইনি দৌড়ে এসে যেভাবে সেদিন অপারেশন থিয়েটারে একটার পর একটা অপারেশন করেছিলেন তা’ অতুলনীয়। ডাক্তার এলিংসন না থাকলে সেদিন নিহতদের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেতো এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তবুও অপারেশন থিয়েটারে আবুল বরকত ও সালামের মৃত্যু হলো।
এদিকে গুলিবর্ষণের খবর দাবাগ্নির মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে সরকারী ও বেসরকারী অফিস আদালত থেকে শুরু করে দোকান-পাট আর যানবাহন চলাচল সবকিছুই বন্ধ হয়ে গেলো। একুশে ফেব্রুয়ারীর আসল হরতাল শুরু হলো বিকেল চারটা থেকে। রেডিওর শিল্পীরা পর্যন্ত স্টুডিও থেকে বেরিয়ে এলো। চারদিকে যেন কবরের নিস্তব্ধতা। স্রোতের মতো মানুষ শুধু এগিয়ে চলেছে হাসপাতালের দিকে। মুখে সবার বিষাদের ছায়া আর চোখে আগুনের স্ফূলিঙ্গ। শোকাভিভূত জনতা শ্রদ্ধা জানায় ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি।
সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, গুলিবর্ষণের জায়গা থেকে মাত্র এক ফার্লং দূরে পরিষদ ভবনে তখন অধিবেশন চলছে। বিরোধী দলের তিনজন মুসলিম সদস্য রংপুরের খয়রাত হোসেন, ঢাকার আনোয়ারা বেগম ও কুমিল্লার আহমদ আলীসহ বহু সদস্যদের সোচ্চার প্রতিবাদ সরকার পক্ষ অগ্রাহ্য করলো। খয়রাত হোসেন কর্তৃক উত্থাপিত গুলিবর্ষণ সম্পর্কিত মূলতবী প্রস্তাব পরিষদের প্রত্যাখ্যান হলো।
এমন সময় পাবনার মুসলিম লীগ দলীয় সদস্য মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ উত্তেজিতভাবে বললেন, ‘জনাব স্পীকার সাহেব, প্রশ্নোত্তরের পূর্বে আমি আপনার কাছে একটি নিবেদন করতে চাই। যখন দেশের ছাত্ররা, যারা আমাদের ভাবী আশা ভরসার স্থল, পুলিশের গুলির আঘাতে জীবন লীলা সাঙ্গ করেছে, সেই সময় আমরা এখানে বসে সভা করতে চাই না। প্রথমে ‘ইনকোয়েরী’ তারপর হাউস চলবে…..’
এরপর শুরু হলো স্পীকার ও তর্কবাগীশের বাদানুবাদ। মওলানা সাহেব আরও বললেন, ‘লীডার অব দি হাউস আগে গিয়ে দেখে এসে বিবৃতি দেবেন, তা’ না হলে আমরা হাউস চলতে দেবো না। সেখানে কি অবস্থা হয়েছে আগে জানতে চাই……..। আপনার অর্ডার বুঝি না, আপনার অর্ডার মানবো না।’
স্পীকার পরিষদের বিধি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করলে, মওলানা সাহেব বললেন, ‘যে কোন এ্যাকশন নিতে পারেন। আমাদের দাবি লীডার অব দি হাউস গিয়ে দেখে এসে বলুন পরিস্থিতি কি?’
পরিশেষে মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ পরিষদে তাঁর শেষ বক্তব্য রাখলেন, ‘যখন আমাদের বক্ষের মানিক, আমাদের রাষ্ট্রের ভাবী নেতা ৬ জন ছাত্র রক্ত শয্যায় শায়িত, তখন আমরা পাখার নীচে বসে হাওয়া খাব এ আমি বরদাশত করতে পারি না। আমি জালেমের এই জুলুমের প্রতিবাদে পরিষদ গৃহ পরিত্যাগ করছি এবং মানবতার দোহাই দিয়া আপনার মাধ্যমে সকল মেম্বারের কাছে পরিষদ গৃহ ত্যাগের আবেদন জানাচ্ছি।’ (পূর্ব পাকিস্তান ব্যবস্থাপক পরিষদের বিবরণী ২১-২-৫২) এরপর বিরোধী দলীয় সদস্যরা পরিষদ কক্ষ ত্যাগ করেন। দিন কয়েকের মধ্যে মওলানা তর্কবাগীশসহ বেশ ক’জন পরিষদ সদস্য নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হলেন।

ঢাকায় কারফিউ
একুশে ফেব্রুয়ারী রাতের অন্ধকার নেমে আসার আগেই ঢাকায় জারী হলো কারফিউ। প্রতিটি মহল্লায় মোতায়েন হলো সশস্ত্র পুলিশ। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের তখন প্রকৃতপক্ষে কোন অস্তিত্বও নেই। সরকার-বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এই আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয় সহযোগিতা ঘোষণা না করায় কিংকর্তব্যবিমূঢ়। অবশ্য ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আগে থেকেই আটক আওয়ামী লীগের অন্যতম যুগ্ম-সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতাবোধ প্রকাশ করার জন্য ২০ ফেব্রুয়ারী থেকে আরও কয়েকজন রাজবন্দীকে নিয়ে অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। একুশে ফেব্রুয়ারী দৈনিক আজাদে এ্ই সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিলো।
সত্যিকারভাবে বলতে গেলে পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগ ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগের একাংশ ছাড়া অসংখ্য নির্দলীয় ছাত্র এই আন্দোলনের পুরোভাগে এসে দাঁড়িয়েছিলো। অথচ পরবর্তীকালে অনেক ক’টা রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী এ মর্মে দাবি করে থাকেন যে, তাঁরা গোপন স্থান থেকে নির্দেশ দিয়ে এ আন্দোলনকে সফল করে তুলেছিলেন। এর জবাবে শুধু বলবো, এসব রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী নিজেদের দলীয় ব্যর্থতা স্বীকারে অক্ষম এবং এঁদের দাবি সত্যোর অপলাপ মাত্র।
আমাদের উত্তরসূরীদের জন্য একথাও আজ বলতে হচ্ছে যে, সে আমলে বুদ্ধিজীবীদের একাংশ বাংলা ভাষার দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল থাকা সত্ত্বেও আন্দোলনের পক্ষে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারেননি এবং সক্রিয় সহযোগিতা করতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। কিন্তু গুলিবর্ষণের পর রাজনীতিবিদদের সঙ্গে পুলিশ এঁদের গ্রেফতার করার পরবর্তীকোলে এরাই ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে গুলিবর্ষণের মুহূর্ত পর্যন্ত এঁদের তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিলো না বললেই চলে। বুদ্ধিজীবীদের যাঁরা ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন বলে উল্লেখ করা হচ্ছে, ১৯৫২ সালে তাঁদের মূখ্য পরিচয় ছিলো ছাত্র হিসাবে। এঁরা সবাই ছিলেন শিক্ষার্থী। এঁদের বলিষ্ঠ ভূমিকার জন্য ছাত্র সমাজ গর্বিত।
একুশে ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যায় মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে অনেক কষ্টে জনা কয়েক ছাত্র ও যুব নেতা পরবর্তী কর্মসূচী নির্ধারণের জন্য বৈঠকের ব্যবস্থা করলো। এই বৈঠকে লক্ষ্য করে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠিত হলো। আহ্বায়ক হলেন পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগের সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদ। পরিষদের প্রথম সিদ্ধান্ত হলো ২২শে ফেব্রুয়ারী মেডিকেল হোস্টেল প্রাঙ্গণে জানাজা ও লাশ নিয়ে মিছিল। প্রতিটি ছাত্রাবাস, আজিমপুর ও পুরোনো ঢাকায় এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেয়া হলো। বিভিন্ন হলে মাইক লাগিয়ে সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করা হলো আর মাইকে শুরু হলো জ্বালাময়ী বক্তৃতা।

মুসলিম হলে মাইক
সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের মাইকের দায়িত্ব এলো আমার ওপর। দোতলার যে ঘরটাতে বসে ছাত্ররা রোজ রেডিও শুনতো, সে ঘরটাতে আমি মাইকের সামনে বসলাম এবং ভেতর ও বাইরে থেকে লাগানো হলো তালা। ভেতরে আমি শুধু একা অবিরাম ঘন্টার পর ঘন্টা বক্তৃতা করে চলেছি আর মাঝে মধ্যে আমাদের কর্মসূচী ঘোষণা করছি। হাসান হাফিজুর রহমান, মুস্তাফা নূর-উল-ইসলাম, মোহাম্মদ সুলতান, আনিস চৌধুরী, ফজলে লোহানী প্রমুখ বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ছোট-খাটো লিখিত বক্তৃতা এনে দরজার ফাঁকে দিয়ে আমাকে সরবরাহ করলো। আমি আবার সেসব বক্তৃতা দরাজ কন্ঠে মাইকে পড়ে চলেছি। ফলে বক্তৃতা দিতে আমার বিশেষ কোন অসুবিধাই হলো না। একুশে ফেব্রুয়ারী দিবাগত গভীর রাত পর্যন্ত মুসলিম হল থেকে আমি কর্মসূচীর ঘোষণা আর বক্তৃতা অব্যাহত রাখলাম। ধীরে ধীরে সমস্ত শহরে রটে গেলো যে, ছাত্ররা সলিমুল্লাহ হলে থেকে যে ঘোষণা দিচ্ছে সেটাই পালন করতে হবে।

২২শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৫২ : ভোরের দিকে মোহাম্মদ সুলতান এসে এক মর্মান্তিক খবর দিয়ে গেলো যে, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে সশস্ত্র পুলিশ ও সৈন্যবাহিনী এসে চারটা লাশ নিয়ে গেছে। মেডিকেলের ছাত্ররা সন্ধ্যা থেকেই মর্গে এসব লাশ পাহারা দিচ্ছিলো। পরদিনে এসব লাশের জানাজা হবে। কিন্তু রাত আড়াইটার দিকে কয়েকশ’ সশস্ত্র পুলিশ সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় মর্গে হামলা করে লাশগুলো নিয়ে গেছে।
আরও রোমাঞ্চকর ঘটনা হচ্ছে, মেডিকেল কলেজের জনা তিনেক ছাত্র কারফিউ-এর মধ্যে জীবনকে তুচ্ছ করে এদের অনুসরণ করলো। সকালে এসে খবর দিলো যে, লাশগুলো আজিমপুর গোরস্থানে দাফন করা হয়েছে আর ওরা কবরগুলো চিহ্নিত করে এসেছে। এইসব নাম না জানা ছাত্রদের বদৌলতে পরবর্তীকালে শহীদদের কবর জিয়ারত করা সম্ভব হচ্ছে।
২২শে ফেব্রুয়ারী সকালে সলিমুল্লাহ হলের মাইক থেকে শহীদদের লাশ নিয়ে যাওয়ার ঘটনা বর্ণনা করে নেতাদের নির্দেশে নতুন ঘোষণা করলাম যে, সকাল দশটায় মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হবে গায়েবানা জানাজা আর হরতাল অব্যাহত থাকবে।
কিছুক্ষণ পরে মাইকের ঘোষণা বন্ধ রেখে আমিও শরীক হলাম সেই ঐতিহাসিক গায়েবানা জানাজায়। সেখানে অন্যান্যদের মধ্যে এসে হাজির হলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, তৎকালীন এ্যাডভোকেট জেনারেল শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক, আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক, মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, খয়রাত হোসেন প্রমুখ। প্রায় লক্ষাধিক লোকের এই গায়েবানা জানাজার ইমামতি করলেন মওলানা ভাসানী।
কয়েকটা বাঁশের মাথায় শহীদদের রক্তাক্ত জামা-কাপড় বেঁধে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে শুরু হলো মিছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন, কার্জন হল, হাইকোর্ট, ফজলুল হক হল, রেলওয়ে হাসপাতাল, রমনা রেস্ট হাউস, রেলওয়ে ক্রসিং অতিক্রম করে যখন মিছিলের সম্মুখভাগে নবাবপুরের ঠাটারীবাজার এলাকায় তখনও মিছিলের পশ্চাদভাগ মেডিকেল হোস্টেল থেকে কেবল বেরুচ্ছে। এমন সময় হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে আগত সশস্ত্র পুলিশের একটা ট্রাক কার্জন হলের সামনের রাস্তায় হামলা করলো। এতে একজন নিহত ও বেশ ক’জনা আহত হলো। এই অবস্থায় শুরু হলো পুলিশের বেপরোয়া লাঠিচার্জ।
মিছিলটা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলো। প্রথম অংশ নবাবপুর দিয়ে এগিয়ে গেলো। আর মিছিলের আরেক অংশ পথ পরিবর্তন করে নাজিমউদ্দীন রোড দিয়ে চকবাজারের দিকে চলে গেলো। আর শুরু হলো শহরের বিভিন্ন এলাকায় ছাত্র-পুলিশের সংঘর্ষ।
এদিকে আর একদল বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা জগন্নাথ কলেজ এলাকা থেকে এসে ভিক্টোরিয়া পার্কের (বাহাদুর শাহ পার্ক) কাছে মর্নিং নিউজি পত্রিকার ছাপাখানা জুবিলী প্রেসে আগুন ধরিয়ে দিলো। মর্নিং নিউজ পত্রিকার সম্পাদক মহসীন আলী লাট ভবনে আশ্রয় নিলো। প্রায় একই সময়ে নবাবপুর রাস্তায় কয়েকটা জায়গায় গুলিবর্ষণ হলো। হাইকোর্টের কর্মচারী শফিকুর রহমান রথখোলার কাছে নিহত হলেন। শহীদ শফিকুরের স্ত্রী তখন অন্তঃসত্ত্বা।
কার্জন হলের সামনের রাস্তায় পুলিশের লাঠিচার্জের পর আমি আবার সলিমুল্লাহ হলে ফিরে এলাম মাইকে ঘোষণা করার জন্য। এটাই প্রকৃতপক্ষে ছাত্রদের কন্ট্রোলরুমে পরিণত হলো। ২২শে ফেব্রুয়ারী রাতে মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা গুলিবর্ষণের জায়গায় একটা শহীদ মিনার নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিলেন। ঢাকার মেধাবী মেডিকেল ছাত্র বদরুল আলম (পরবর্তীকালে শিশুবিশেষজ্ঞ এবং বছর তিনেক আগে প্রয়াত) ঘন্টা খানেকের মধ্যে প্রস্তাবিত শহীদ মিনারের একটা চমৎকার স্কেচ এঁকে দিলেন। ঐকান্তিক নিষ্ঠা, অদম্য উৎসাহ আর অমানুষিক পরিশ্রম করে মেডিকেল ছাত্ররা গোলাম মওলা ও মঞ্জুর হোসেনের নেতৃত্বে রাতের অন্ধকারেই নির্দিষ্ট স্থানে শহীদ মিনার নির্মাণ সমাপ্ত করলেন। সকালে মিছিলের পর মিছিল এসে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলী জানালো। অনেক মহিলা গায়ের অলংকার পর্যন্ত মিনারের পাদদেশে রেখে গেলেন।

২৩শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৫২ : সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের মাইকে নেতৃবৃন্দের নির্দেশে ঢাকা শহরে হরতাল পালনের ঘোষণা দিলাম। শুধুমাত্র ঘন্টা দুয়েকের জন্য কাঁচা বাজার খোলা থাকবে। ঢাকাবাসী সানন্দে এই কর্মসূচীর প্রতি সমর্থন জানালো। সরকারী অফিস-আদালত পর্যন্ত বন্ধ থাকলো।

২৪শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৫২ : পরিস্থিতি আয়ত্ত্বে আনার জন্য মূখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীনের দ্বিতীয় দফা বেতার ভাষণ এবং শহরে ধড়-পাকড় অব্যাহত। রাতে সাত ঘন্টার কারফিউ। কিন্তু ছাত্রদের কর্মসূচী মোতাবেক দিনের বেলায় যথারীতি হরতাল পালন। ফলে অনির্দিষ্টকালের জন্য পরিষদের অধিবেশন মূলতবী ঘোষণা।

২৫শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৫২ : দৈনিক আজাদ পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক আবুল কামাল শামসুদ্দীন কর্তৃক প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক পরিষদ থেকে পদত্যাগের পর মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে সকালে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের উদ্বোধন। সলিমুল্লাহ হল থেকে ঘোষণা মোতাবেক ঢাকায় পূর্ণ হরতাল পালন। বিকেলে কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মোতাবেক বিশ্ববিদ্যালয় ও ছাত্রাবাসগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা। এইদিন নিরাপত্তা আইনে পুলিশ মওলানা ভাসানী, আবুল হাশিম, খয়রাত হোসেন, মওলানা তর্কবাগীশ, অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ চৌধুরী, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক অজিত গুহ, অধ্যাপক পুলিন দে এবং গোবিন্দ লাল মুখার্জী প্রমুখকে গ্রেফতার করে।
সন্ধ্যায় পুলিশ মেডিকেল হোস্টেলে নবনির্মিত শহীদ মিনার ধ্বংস করে দেয়। রাতে সৈন্যবাহিনী এসে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ঘেরাও করে।

২৬শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৫২ : প্রায় ২৪ ঘন্টা ঘেরাও করে রাখার পর ইকবাল হলের দিক থেকে সলিমুল্লাহ হলের পাশের দিকের দরজা ভেঙে সৈন্যবাহিনীর সহযোগিতায় পুলিশের হলে প্রবেশ এবং প্রতিটি কামরা সার্চ ও বহু ছাত্র গ্রেফতার। আমি এক জোড়া ছেড়া স্যান্ডেল পায়ে এবং পরনে ময়লা লুঙ্গি ও গায়ে গেঞ্জী পরে চশমা হাতে নিয়ে একটা বিড়ি টানতে টানতে পুলিশ ও সৈন্যদের বেষ্টনীর মাঝ দিয়ে বেরিয়ে এলাম। সে রাতে মোহাম্মদ সুলতানের ভগ্নিপতির নন্দকুমার দত্ত লেনের বাড়িতে অবস্থান করে পরদিন ঢাকা থেকে ট্রেনযোগে রংপুরের পাটগ্রামে চলে গেলাম।

২৭শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৫২ : ফজলুল হক হল এলাকা থেকে যুব লীগের সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদ ও বামপন্থী নেতা মোহাম্মদ তোয়াহাসহ আরও কয়েকজনকে পুলিশ গ্রেফতার করলো। শেরে বাংলা ফজলুল হক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোয়াজ্জেম উদ্দীন হোসেন সরকারী দমন নীতির তীব্র সমালোচনা করে বিবৃতি প্রদান করলেন।
এরপর ২রা মার্চ নারায়ণগঞ্জে পুলিশ ও জনতার সংঘর্ষে ৪৫ ব্যক্তি আহত হলো। এ সময় ক্ষমতাসীন সরকার পরিস্থিতি আয়ত্ত্বে আনার জন্য নারায়ণগঞ্জে জনৈক কনস্টেবলকে হত্যার ব্যবস্থা করে সমস্ত দোষ ভাষা-আন্দোলনকারীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে বিষোদগার করলো। উপরন্তু আকস্মিকভাবে দৈনিক আজাদের ভূমিকার পরিবর্তন হলো। পাকিস্তান অবজারভারের প্রকাশনা ১৩ই ফেব্রুয়ারী থেকে বন্ধ ছিলো। মার্চের প্রথম সপ্তাহে ঢাকার সবগুলো জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় ভাষা-আন্দোলনকারীর কার্যক্রমের তীব্র সমালোচনা শুরু হলো এবং মর্নিং নিউজ পত্রিকা আমাদের ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যায়িত করলো।
এরপর গোপন স্থান থেকে নেতৃবৃন্দ বাংলা ভাষার দাবির সমর্থনে এবং ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ৫ই মার্চ প্রদেশব্যাপী ধর্মঘট ও বিক্ষোভের কর্মসূচীর ঘোষণা করলো। প্রদেশের সর্বত্র ধর্মঘট সফল হলেও ঢাকায় আংশিকভাবে পালিত হলো। এই দিন সরকারী কর্মচারীদের হুঁশিয়ারী প্রদান করে ঢাকায় অফিসের কাজে যোগদান করানো হলো।
তবুও পরবর্তীকালে ভাষা-আন্দোলনের সাফল্য কেউই অস্বীকার করতে পারেননি। এরই প্রেক্ষাপটে ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক জয়লাভ সম্ভব হয়েছিলো আর পাকিস্তানের ১৯৫৬ সালের সংবিধানে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছিলো।
বাহান্নোর ভাষা-আন্দোলনে রাজনৈতিক সচেতন কর্মীরা ছাড়াও যেসব নাম না জানা আর নির্দলীয় ছাত্র শুধু মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার সংগ্রামে জীবনকে তুচ্ছ করে এগিয়ে এসেছিলেন আর ইতিহাসের যুগসন্ধিক্ষণে নিজেদের বলিষ্ঠ ও সময়োপযোগী অবদান রেখে গেছেন. তাঁদের অনেকেই বিস্মৃতির আড়ালে চলে গেছেন কিংবা জীবন যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে আছেন। সবাইকে জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলী আর শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনা করছি।
হাজার হাজার বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক কর্মী ও ছাত্রদের কারাগারে আটক রেখে নুরুল আমীনের মুসলিম লীগ সরকার নিজেদের বলিষ্ঠ ও সময়োপযোগী অবদান সালের বাকি সময় ব্যয় করলো। কিন্তু মুসলিম লীগের উপদলীয় কোন্দল অব্যাহত রইলো।
মাস কয়েক ধরে কলকাতায় অবস্থানের পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পাসপোর্ট প্রথা চালু হবার প্রাক্কালে আবার ঢাকায় ফিরে এলাম। আস্তানা সেই পুরানা ব্যারাক ইকবাল হল। এবার আমি আর মোহাম্মদ সুলতান দু’জনে মিলে নতুন ঢাকায় একটা বই-এর দোকান দিলাম। নাম ‘পুথিপত্র’। ঢাকা মেডিকেল কলেজ নার্সের কোয়ার্টারের পিছনে রাস্তার ওধারে একটা মসজিদের ওয়াকফ এস্টেটে মাসিক ২৫ টাকায় টিনের ছাদের এই বই-এর দোকান। তখন পুরানো ঢাকার বাংলাবাজারে প্রগতিশীল পত্রপত্রিকা ও পুস্তক বিক্রির আর একটা দোকান চালু ছিলো। নাম ‘বুক্স এ্যান্ড বুক্স’। মালিক হচ্ছেন মুস্তাফা নূর-উল-ইসলাম আর অগত্যা সম্পাদক ফজলে লোহানী।
‘পুথিপত্র’ দোকানে প্রগতিশীল ছাত্রদের যাতায়াত বেশ বেড়ে গেলো। এখানেই আলাপ আলোচনার মাধ্যমে অনেকেই উপলব্ধি করলো যে, বর্তমান অবস্থাতে প্রগতিশীল ছাত্রদের জন্য ব্যাপক-ভিত্তিতে একটা নতুন প্রগতিশীল ছাত্র প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। শেষ পর্যন্ত ১৯৫২ সালের ডিসেম্বর মাসে মোহাম্মদ সুলতানকে সভাপতি ও মোহাম্মদ ইলিয়াসকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের জন্ম হলো। (এই সংগঠন ১৯৫২ সালের ২৬শে এপ্রিলে পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন হিসাবে গঠিত হয়েছিলো)
এদিকে ছাত্র ইউনিয়ন-এর জন্মের আগে প্রস্তুতি বৈঠকগুলো ‘পুথিপত্র’ দোকানেই বসতে লাগলো। ফলে গোয়েন্দা পুলিশের নজর পড়লো আমাদের দোকানটার উপর। এতে কিছুটা আতংকিত হলাম। অকৃত্রিম বন্ধু সুলতানকে কথাটা খুলেই বললাম। ‘এসব বৈঠক অন্যত্র করার ব্যবস্থা করলে বই-এর ব্যবসাটা বাঁচাতে পারতাম।’ সুলতান জবাবে বললো, ‘ব্যবসার চেয়ে আমার কাছে রাজনীতিটাই বড়।’ (বিচিত্রা জানুয়ারী ১৯৮৪ সংখ্যা)
সুলতান আর আমার মধ্যে প্রথম মতবিরোধ হলো। বেচারা মনে কষ্ট পাবে ভেবে প্রকাশ্যে কিছুই বললাম না। গোপনে চেষ্টা করে আবদুল গনি হাজারীর মাধ্যমে দৈনিক সংবাদে সহকারী বিজ্ঞাপন ম্যানেজারের চাকরি জুটিয়ে ফেললাম। ‘পুথিপত্রের’ মালিকানা সুলতানের হাতে ছেড়ে দিয়ে ১০৫ তাঁতি বাজারে অগত্যা অফিসে উঠে এলাম। সময়টা ১৯৫৩ সালের জানুয়ারী মাস।
অগত্যা অফিসে পর পর তিনটা কামরা ছিলো। সামনে মুস্তফা নূর-উল-ইসলাম, মধ্যে ফজলে লোহানী আর সবচেয়ে পিছনের কামরায় আমার থাকার ব্যবস্থা ছিলো। তিনজনে মিলে একটা ‘মেসও’ করেছিলাম। ‘অগত্যার’ পিয়ন সুলতান ছিলো এই মেসের বাবুর্চি। অনিয়মিত ছিলাম। হঠাৎ দেখলাম লোহানী তিনজনেই ছিলাম ‘ডিফল্টার’। অর্থাৎ টাকা পয়সা দেয়ার ব্যাপারে তিনজনেই একটু বেশি অনিয়মতা করতাম। হঠাৎ দেখলাম লোহানী সাহেবের কোন পাত্তা নেই। বুঝলাম যেকোনভাবেই হোক তার হাতে কিছু টাকা এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোক আজিমপুরে কলোনীতেও তাঁর বোনের কাছে থাকতে শুরু করলেন আর প্রায়ই ‘রিটজ’ রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ সমাধা করতে লাগরেন। এ ক’দিন মেসের সঙ্গে তাঁর কোন সম্পর্কই রইলো না।
এরপর আবার মুস্তাফা সাহেব দিন কয়েক উধাও হয়ে রইলেন। বুঝলাম উনি বেতনের টাকা পেয়েছেন। ফলে সংবাদ অফিসে প্রথম মাসের বেতন পাবার পর আমিও হপ্তা খানেকের জন্য গায়েব হলাম। পকেটের টাকা শেষ হবার পর একদিন আবার ১০৫ তাঁতীবাজারে এসে হাজির হলাম। সুলতানকে আমার খাবারের ব্যবস্থা করতে বললাম। সে শুধু ইশারায় সামনের মিষ্টির দোকানটা দেখিয়ে দিলো। স্লিপ দিলে বাকিতে মিষ্টি পাওয়া যায়। মালিকের দুটো মিষ্টির দোকান। নবাবপুরের দোকানে নগদ পয়সায় টাটকা মিষ্টি আর তাঁতীবাজারের দোকানে বাকিতে গোলাপজল দেয়া বাসি মিষ্টি। এতে বাসি মিষ্টিগুলো অপচয়ের হাত থেকে রক্ষা পায়। আর বাকির যেটুকু আদায় হয় সেটুকুই লাভ।
মেসের সাহেবদের যখন এই অবস্থা তখন সুলতান কিভাবে দিন কাটায় তা জানবার জন্য মনটা অস্থির হয়ে উঠলো। শেষ পর্যন্ত সুলতানের ‘ট্রেড সিক্রেট’ আবিষ্কার করলাম। মফস্বল থেকে ‘অগত্যার’ বার্ষিক গ্রাহক হবার জন্য প্রায়েই মনি অর্ডারে টাকা আসতো। সাহেবদের অনুপস্থিতির সুযোগে সুলতান তা দিব্বি পকেটস্থ করতো। কাজের সুবিধার জন্য সুলতানের পকেটে সব সময়েই অগত্যার মানেজারে সীল মজুত। ওর দস্তখতটাও একেবারে পাকা। পিয়ন আসার সময় হলেই সুলতান পরিষ্কার জামা গায়ে অফিসের বড় চেয়ারটাতে বসে থাকতো। তাই পিয়নও কোনদিন ওকে বিন্দুমাত্র সন্দেহ করতে পারেনি।

মডেল খালে চৌধুরী
একদিন অফিস থেকে বিকালে ১০৫ তাঁতীবাজারে এসে দেখি বাইরের ঘরে টেবিলে ডিকশনারী মাথায় দিয়ে কালো এক ভদ্রলোক ঘুমাচ্ছেন। মলিন কেশ আর শ্রান্ত চেহারায় এ ভদ্রলোক আগে কখনো দেখেছি বলে মনে হয় না। পরে আলাপ হলো। ইনিই হচ্ছেন খালেদ চৌধুরী। এক সময় ঢাকা আর্ট কলেজের ছাত্র ছিলেন। কিন্তু বেশি দিন আর্ট কলেজে তাঁর পড়াশোনা মনঃপুত হলো না। তাই হঠাৎ করে কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন। ভদ্রলোকের বই পড়ার খুব সখ। তাই এরপর তিনি ঢাকার সমস্ত পাবলিক লাইব্রেরীর সদস্য হয়ে দর্শন, ইতিহাস আর সমাজ বিজ্ঞানের দুরূহ বই পড়তে শুরু করলেন এবং কিছুদিনের মধ্যে বেশ পান্ডিত্য অর্জন করলেন। কিন্তু বেচারার পকেটে খাওয়ার পয়সা পর্যন্ত নেই। খালেদ শেষ পর্যন্ত আর্ট কলেজেই ঘন্টা ভিত্তিতে ‘মডেল’ হওয়ার কাজ নিলেন। বেশিদিন এ কাজটা তাঁর পোষালো না। একভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকাটা খুবই কষ্টকর।
কলেজ ছেড়ে দেয়ায় খালেদের জন্মদাতার মনে খুবই দুঃখ। কিন্তু ছেলেটার অভুক্ত থাকার খবর পেয়ে তাঁর পিতা ইসলামপুরের একটা হোটেলে তাঁর দু’বেলার খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। মাস শেষে খাওয়ার বিল পরিশোধের দায়িত্ব পিতৃদেবের। খালেদ তখন বন্ধু-বান্ধবদের ডেকে ইসলামপুরের সেই হোটেলে মোরগ-পোলাও খাওয়াতে শুরু করলো। শর্ত একটাই। খাওয়ার পর কয়েক শলা সিগারেট কিনে দিতে হবে। খালেদের বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে এই খবরে একেবারে হৈচৈ পড়ে গেলো। দুপুর থেকে সবাই খালি খালেদের খোঁজ করতে শুরু করলো। ফলে প্রথম মাসেই হোটেলে এক অবিশ্বাস্য রকমের বিল হলো। খালেদকে হুঁশিয়ারী করেও কাজ হলো না। পরবর্তী মাসেও একই অবস্থা। এর ফলে হিসাবে খালেদের হোটেল খাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো। আর খালেদও বাড়ির সঙ্গে সমস্ত সম্পর্কচ্ছেদ করলো।
পরিচিতদের মধ্যে ফজলে লোহানী খুবই স্নেহ করতো খালেদকে। এবং প্রায়ই নানাভাবে সাহায্য করতেন। এমনকি লন্ড্রীতে কাপড় ধোয়ার পর্যন্ত টাকা দিতেন। এখানে খালেদ চৌধুরীর সঙ্গে যখন আমার পরিচয় হলো, তখন তিনি চার্বাক দর্শন সম্পর্কে পড়াশোনা করছেন। তাঁর কথাবার্তায় আমিও চমৎকৃত হলাম। পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের বৈঠকে খালেদকে দেখলেই আমরা সবাই ভীত-সন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়তাম। সমালোচনা যে কত পান্ডিত্যপূর্ণ হতে পারে তার জ্বলন্ত প্রমাণ খালেদ চৌধুরী। কিন্তু কঠিন সংস্কৃতি-ঘেঁষা বাংলায় খালেদের সমালোচনার কষাঘাত সহ্য করার ক্ষমতা খুব কম লেখকের রয়েছে। সাহিত্য সংসদের বৈঠকের কোন নোটিশ ফয়েজ আহমদ ওকে দিতো না। কিন্তু সংসদের বৈঠকের সময় যেয়ে দেখতাম আগে থেকেই শ্রীমান ‘সওগাত’ অফিসে বসে রয়েছেন আর আমাদের দেখেই পান খাওয়া খয়েরী রংয়ের দাঁতগুলো বের করে চমৎকার একটা হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করতো, ‘আজকের আসরে কারা কারা লেখা পড়বে রে?’
খালেদের একটা ব্যাপারে ১০৫, তাঁতীবাজারে আমরা তিনজন বাসিন্দাই খুব বিরক্ত হয়ে উঠলাম। প্রতিদিন দুপুরে আমাদের অনুপস্থিতির সুযোগে খালেদ চৌধুরী যে, আমাদের শ্রীমান সুলতানকে মার্কসীয় দর্শনে দীক্ষিত করছেন, তা আমরা মোটেই আঁচ করতে পারিনি। যখন ব্যাপারটা প্রকাশ পেলো, তখন সুলতান ‘সারপ্লাস লেবার থিওরী’ সম্পর্কে খালেদের কাছ থেকে দীক্ষা নিচ্ছিলো। খালেদ চৌধুরী উদহারণ দিয়ে সুলতানকে বুঝিয়েছে যে, ওর মাইনে মাই একশ’ টাকা হওয়া উচিত। অথচ তাকে দিচ্ছে মাত্র বিশ টাকা। এর অর্থ হচ্ছে সাহেবরা প্রতি মাসে আশি টাকা করে শোষণ করছে। এটা সুলতানেরই রক্ত পানি করে কামাই করা টাকা। সমস্ত ব্যাপার শুনে আমরা হতভম্ব হয়ে গেলাম। তাইতো বলি কাজকর্মে সুলতানের আগের মতো উৎসাহ নেই কেনো। সব সময়েই আজকাল মনমরা ভাব।
শেষে খালেদ চৌধুরীকে আমাদের অনুপস্থিতিতে ১০৫ তাঁতীবাজারে আসার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারী করা হলো। এরপরেও লোহানী সাহেব গোপনে খালেদ চৌধুরীকে সাহায্য করতেন।
১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারীর আগেই বগুড়া থেকে ঢাকায় আমাদের তিন ভাইয়ের কাছে আব্বার টেলিগ্রাম এলো। ‘মাদার সিরিয়াস, কাম শার্প’। তিন ভাই দৌড়ালাম বগুড়ায় আব্বা-আম্মার কাছে। ঢাকায় থাকলে একুশের বার্ষিকীতে পুলিশ আমাদের গ্রেফতার করতে পারে আশংকায় টেলিগ্রাম করে আব্বা ছেলেদের তাঁর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন।
এবারের যাত্রাটা কি রকম ছিলো জানি না। তবে মাত্র চার মাসের মধ্যে আমি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলাম। আর ছুটির দরখাস্ত অফিসে ফেলে দিয়ে বিয়ে করতে যাওয়ার ‘অপরাধে’ সংবাদের চাকরিটা হারালাম। সবশেষে ঢাকায় ফিরে দেখি লোহানী সাহেব ১০৫ তাঁতীবাজারের ‘পজেশন’ এক দিল্লীওয়ালার কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। তাই আবার বেকার অবস্থায় যেয়ে ব্যারাক ইকবাল হলে উঠলাম।
বিয়ের সময় যে ক’টা সোনার আংটি উপহার পেয়েছিলাম, সেগুলো বিক্রি করে ইকবাল হলে দিব্বি আড্ডা মেরে কাটাতে লাগলাম। আবার ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন হলো। ১৯৫৩ সালের ২৩শে ডিসেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকের বার্তা বিভাগে যোগদান করলাম। দৈনিক সংবাদে বেতন পেতাম মাসিক ১৭৫ টাকা। আর এখন মাসিক শুধু ৭৫ টাকা। তখন ছিলাম কুমার আর এখন বিবাহিত।

মুসলিম লীগের নাভিশ্বাস
তৎকালীন লেবার ফেডারেশনের আবদুল কাদের দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পার্টটাইম বার্তা সম্পাদক। ফয়েজ আহমদ চীফ রিপোর্টার। এছাড়া বার্তা বিভাগে যশোরের আবদুল হাফিজ (বর্তমানে এ্যাডভোকেট), বরিশালের নুরুল ইসলাম (প্রাক্তন পরিষদ সদস্য) এবং অধ্যাপক বদরুল হাসান (বর্তমানে মানসিক ভারসাম্যহীনতায় ভুগছে)। সম্পাদকীয় বিভাগে আবদুল আওয়াল (মরহুম) ও ব্যবস্থাপনায় ওয়াদুদ পাটোয়ারী (মরহুম)। ১৯৫৩ সালের ২৫শে ডিসেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হলো। প্রথমদিনে লাল ব্যানারে হেডিং দিলো ‘মুসলিম লীগের নাভিশ্বাস।’
এর আগেই গেলো একটা বছর ধরে রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ দ্রুত প্রবাহিত হয়েছে। পূর্ব বাংলার সর্বত্র মওলানা ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী অজস্র জনসভার বক্তৃতা করেছেন। শেরে বাংলা ফজলুল হক এ্যাডভোকেট জেনারেলের পদত্যাগ করে কৃষক শ্রমিক পার্টি গঠন করেছেন। চারদিকে তখন শ্লোগান উচ্চারিত হচ্ছে ‘হক-ভাসানী’ এক হও।’ ১৯৫৩ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ ও কেএসপি যুক্তফ্রন্ট নামে ঐতিহাসিক মোর্চা গঠন করেছে। গণতন্ত্রী দল, নেজামে ইসলাম ও যুব লীগ যুক্তফ্রন্টের প্রতি সমর্থন প্রদান করেছে। চারদিকে জনজাগরণের সৃষ্টি হয়েছে।
দৈনিক ইত্তেফাক প্রকাশিত হওয়ার মাত্র তিন মাসের মাথায় পূর্ব বাংলার প্রথম সাধারণ নির্বাচনের দিন ধার্য হলো। দৈনিক ইত্তেফাকে আমি ছিলাম ‘মওলানা ভাসানী বিশারদ।’ অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা ভাসানী মফস্বলের যেকোন জায়গায় বক্তৃতা দিলেই সেটা লেখার দায়িত্ব ছিলো আমার। সে এক অদ্ভূত ব্যাপার। পয়সা খরচ করে প্রেস টেলিগ্রাম করার সামর্থ না থাকায় আমরা ইত্তেফাকে এক নতুন নিয়ম চালু করেছিলাম। এতে মওলানা সাহেবের সঙ্গে সফররত কোন রাজনৈতিক কর্মী মফস্বল থেকে জনসভার স্থান, তারিখ, সভাপতির নাম আর জনসভার উপস্থিত লোকের আনুমানিক সংখ্যা উল্লেখ করে একটা সংক্ষিপ্ত টেলিগ্রাম ইত্তেফাক অফিসে পাঠাতো। আমি এ টেলিগ্রাম থেকে অন্ততঃ চার কলাম নিউজ বানিয়ে ফেলতাম। আমার মোটামুটিভাবে জানাই ছিলো যে, মওলানা সাহেব কী ধরনের বক্তৃতা দেবেন। ঢাকায় বসে মওলানা ভাসানীর বক্তৃতা লিখতে কোন অসুবিধাই হতো না।
চুয়ান্নোর সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হলে সমস্ত সভ্য জগৎ স্তম্ভিত হয়ে পড়লো। মন্ত্রীসভার সমস্ত মন্ত্রীই এ নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন। ২৩৭ আসনের মধ্যে মুসলিম লীগের হ্যারিকেন মার্কা বাক্স জিতেছে মাত্র ন’টি আসনে। বাকি সবগুলো যুক্তফ্রন্টের নৌকা মার্কা জয়লাভ করেছে। ছাত্র লীগের নেতা খালেক নেওয়াজ খানের কাছে নুরুল আমীনের পরাজয় সংবাদ ইত্তেফাকে ব্যানার হেড লাইনে প্রকাশিত হলো। হেডিংটা ছিলো ‘পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশ থেকে অশুভ নক্ষত্রের কক্ষচ্যূতি’। ইত্তেফাকের তৎকালীন বার্তা সম্পাদক সিরাজউদ্দীন হোসেন এ হেডিং দিয়েছিলেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় সিরাজ সাহেব শাহাদৎ বরণ করেছেন।
১৯৫৪ সালে অত্যন্ত দ্রুত কয়েকটা ঘটনা অনুষ্ঠিত হলো। শেরে বাংলা ফজলুল হক যুক্তফ্রন্টের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে আদমজীর বাঙালী-অবাঙালী দাঙ্গায় প্রায় দেড় সহস্র লোক নিহত হলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে। শেরে বাংলার একটা বিবৃতিকে অছিলা করে দু’মাস পূর্ণ হওয়ার আগেই কলমের এক খোঁচায় যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভাকে বাতিল করে ৯২-ক ধারা মোতাবেক গভর্নরের শাসন জারী করা হয়। নিরাপত্তা আইনে সহস্রাধিক নেতা ও কর্মীকে গ্রেফতার করা হলো। নতুন গভর্নর হিসাবে ইস্কান্দার মীর্জা ঢাকায় এসেই ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করলেন। শেরে বাংলা ফজলুল হককে কেএম দাস লেনের বাসভবনে ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতার’ অভিযোগে অন্তরীণ করা হলো। অসুস্থ অবস্থায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী অপারেশনের জন্য জুরিখে গমন করলেন। আর মওলানা ভাসানী স্টকহলম-এ বিশ্বশান্তি সম্মেলনে যোগদানের পর লন্ডনে অবস্থান করছেন। আর গভর্নর মীর্জা ঘোষণা করলেন যে, মওলানা ভাসানীর মতো ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ লোক যদি পাকিস্তানে ফিরে আসে তবে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হবে। নচেৎ তাঁকে নির্বাসিতের জীবন যাপন করতে হবে।’
নিয়তির পরিহাস। পরবর্তীকালে ঘটনাচক্রে ইস্কান্দার মীর্জাই নির্বাসিতের জীবন যাপন করলেন। এমনকি বিদেশের মাটিতে তার মৃত্যু হলো আর দেশের মাটিতে মীজা সাহেবের কবর পর্যন্ত হলো না।
কেন্দ্রীয় সরকারের চক্রান্তে যুক্তফ্রন্ট আওয়ামী লীগ ও কেএসপি এই দুই দলে বিভক্ত হলো। ১৯৫৪ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু করে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত সময়কালে অব্যাহত থাকলো পার্লামেন্টারী রাজনীতির উত্থান-পতন। কখনও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এবং কেএসপি বিরোধী দলে। আবার কখনও বা আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে এবং কেএসপি ক্ষমতায় আসীন। কেন্দ্রেও একই অবস্থার সৃষ্টি হলো। আমরা হক-সোহরাওয়ার্দী বিরোধের চরম বহিঃপ্রকাশ দেখলাম।

ন্যাপের জন্ম
এমন এক পরিস্থিতিতে ৮০ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টে ১৩ জন আওয়ামী লীগ সদস্যের নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দী যখন একটা কোয়ালিশন সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং পূর্ব বাংলায় আতাউর রহমান খান যখন মূখ্যমন্ত্রী, তখন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগে ভাঙন হলো। পররাষ্ট্র নীতির ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৫৭ সালের ১৮ই মার্চ আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করলেন এবং এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি থেকে নয় জন সদস্য পার্টি ত্যাগ করলেন। ১৯৫৭ সালের ২৬শে জুলাই সৃষ্টি হলো নয়া প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ‘পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’ সংক্ষেপে ন্যাপ।
১৯৪৭ সাল থেকে দক্ষিণপন্থী মহলের বিরুদ্ধে যে জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী ও বামপন্থীরা অঘোষিত মোর্চা গঠন করে একটার পর একটা গণতান্ত্রিক আন্দোলন পরিচালিত করেছিলো, দশ বছরের মধ্যে তার পরিসমাপ্তি হলো। রাজনৈতিক মঞ্চে দেখা দিলো তিনটি গোষ্ঠী যথাক্রমে দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদী আর বামপন্থী।
১৯৫৭ সালে অনেক রাজনৈতিক পন্ডিতরা (দু’একজন ব্যতিক্রম ছাড়া) এমন ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন যে, এরপর থেকে জাতীয়তাবাদী আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে বাধ্য। কিন্তু পরবর্তীকালের ঘটনাপ্রবাহ দেখে বোঝায় যায় যে, রাজনৈতিক পন্ডিতদের সেই ভবিষ্যৎবাণী যথাযথ ছিলো না। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির চেয়েও আওয়ামী লীগের ব্যাপ্তি অনেক বেশি হয়েছে অবশ্য কম্যুনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দ আওয়ামী লীগের এই ভাঙন সমর্থন করেনি।
যা হোক, এরপর একটা গৃহীত সংবিধানের আওতায় যখন সমগ্র দেশ সাধারণ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলো, তখন ক্ষমতাসীন চক্র এই গণতান্ত্রিক পদ্ধতির জন্য আতংকগ্রস্ত হলো। তাই গত দশ বছর ধরে দেশ গণতন্ত্রের পথে যতটুকু অগ্রসর হয়েছিলো, তার পরিসমাপ্তি হলো। ১৯৫৮ সালের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে সমগ্র পাকিস্তানে জারী হলো আইয়ুব খানের সামরিক শাসন। এদের দমননীতির মুখে জাতীয়তাবাদী আর বামপন্থী সবাই নিষ্পেষিত হলো ১২ই অক্টোবর ভাসানী-মুজিব একই সঙ্গে গ্রেফতার হলেন।
এই নিবন্ধের নাম ‘পঞ্চাশ দশকের আমরা ক’জনা।’ এই আমরা কারা? পিছনে ফেলে আসা স্মৃতির মুকুর-এর সর্বত্রই তো দেখতে পাচ্ছি জাতীয়তাবাদী আর বামপন্থীরা বজ্রশপথে একত্রে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
০০০

০০০

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/05/1984.02.17-bichitra-1.pdf” title=”1984.02.17 bichitra”]