বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ৬ই সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার, ২০শে ভাদ্র, ১৩৮০
বঙ্গবন্ধুর আলজিয়ার্স যাত্রা
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ আলজিরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনের যোগদানের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করবেন। আলজিয়ার্স বিভিন্ন দেশ থেকে আগত রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানদের যে সম্মেলন হবে বঙ্গবন্ধু সেই সম্মেলনের বিশিষ্ট অতিথি। সংবাদে প্রকাশ, আলজিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ারি বুমেদীন বঙ্গবন্ধুকে আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। ইতিপূর্বে বঙ্গবন্ধুর আলজিরিয়ায় যাওয়া নিয়ে জল্পনা-কল্পনা হলেও সম্মেলন শুরুর দিনে বঙ্গবন্ধু যাননি। কেন যাননি -তা নিয়ে আমরা আমাদের মতামত কয়েকদিন আগের লেখা একটি সম্পাদকীয়তে প্রকাশ করেছিলাম। আমরা অভিমত প্রকাশ করেছিলাম যে, জোট নিরপেক্ষ দেশ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে স্বীকার করে নেওয়ার পরই শুধু বঙ্গবন্ধু সম্মেলনে যোগদান করতে পারেন। স্বীকৃতি দেবার পূর্বে বঙ্গবন্ধু আলজেরিয়ায় গমন করলে স্বাভাবিকভাবেই পদ্ধতিগত অসুবিধায় পড়তেন। সে কারণে বঙ্গবন্ধু অপেক্ষা করেছেন আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির। গতকালের সংবাদে প্রকাশ, আনুষ্ঠানিকভাবে জোট নিরপেক্ষ দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এবং এর পরই বঙ্গবন্ধুর আলজেরিয়ায় গমন করার সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়েছে। ইতিপূর্বের এক সম্পাদকীয়তেও আমরা বলেছি এবারের জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তার চাইতেও উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানদের গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর যোগদান। সম্মেলন শুরুর প্রথম পর্যায়েই আমরা জেনেছি যে, সম্মেলন অনুষ্ঠানের চত্বরে বাংলাদেশের ভবন মঞ্জুর করা হয়েছে এবং সম্মেলন কক্ষে আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিও শোভা পাচ্ছে। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা নিঃসন্দেহ যে, এবারের জোটনিরপেক্ষ সম্মেলন এর বাংলাদেশ ও তার মহান নেতার প্রতি যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশকে তারা জোট নিরপেক্ষ দেশ হিসেবে নীতিগতভাবে মেনেও নিয়েছিলো। শুধু আনুষ্ঠানিকতা ও পদ্ধতিগত অসুবিধার দরুণ বঙ্গবন্ধু যথাসময়ে সম্মেলনে যেতে পারেননি। শেষ অবধি বঙ্গবন্ধু সম্মেলনে যোগদান করেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের খ্যাতনামা নেতৃবৃন্দ সম্মেলনে তাদের গুরুত্বপূর্ণ অভিমত ব্যক্ত করবেন। বিশ্বের যেসব দেশ আজো জোটভুক্ত হয়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের করালগ্রাসে নিজেদেরকে বিলিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে তাদের মুক্তি অধিকারের সঙ্গে জোট নিরপেক্ষ জাতিসমূহ একাত্ম ঘোষণা করবেন। উন্নত দেশসমূহ অনুন্নত ও উন্নতশীল দেশগুলোর সাহায্যে সর্বাত্মকভাবে এগিয়ে আসবেন। সর্বোপরি মানবতার স্বপক্ষে জোট নিরপেক্ষ জাতি এদের বজ্রনিনাদ ঘোষণা জানাবেন এই মহা-সম্মেলন থেকে। বাংলাদেশ জোটনিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতিতে বিশ্বাসী। কারো পকেটে থেকে দেশের অগ্রগতি তারা কামনা করে না। স্বনির্ভরতাই বাংলাদেশের মুখ্য আদর্শ। এবারের জোটনিরপেক্ষ গোষ্ঠীতে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিরই একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। এ বিজয়কে আমাদের টিকিয়ে রাখতে হবে । এ বিজয়কে আরও সংহত করতে হবে।
সিমেন্ট সঙ্কট নিরসন করুন
সিমেন্টের অভাব দিনকে দিন তীব্র হয়ে উঠছে। সারা দেশের সরকারি-বেসরকারি সকল ধরনের নির্মাণকার্য মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে হতে এখন বন্ধই হয়ে গেছে। আর অন্যদিকে গৃহ ও অন্যান্য নির্মাণ কাজে নিয়োজিত হাজার হাজার দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। বেকার শ্রমিকরা পরিবার-পরিজনদের নিয়ে এক দুঃসহ দুর্দশাগ্রস্ত পরিস্থিতিতে পড়ে কালাতিপাত করতে বাধ্য হচ্ছেন।
বস্তুতঃ সিমেন্ট সংকটটা দেশ স্বাধীন হবার পর থেকেই অনুভূত হতে থাকে এবং তা আজ সাংঘাতিক ধরনের তীব্র আকার ধারণ করেছে। স্বাধীনতার আগে এদেশের সিমেন্ট প্রতিবস্তা ১২ থেকে ১৩ টাকা বিক্রি হতো। স্বাধীনতার পর পরেই তার দাম সতেরো-আঠারোতে দাঁড়ায়। এরপর থেকেই দিন দিন সিমেন্টের দাম বাড়তে থাকে ক্রমশঃ। বায়াত্তুরের মাঝামাঝিতে যখন সিমেন্ট প্রতিবছর প্রায় তিরিশ টাকাতে দাঁড়ায়, তখন টি,সি,বি’র মাধ্যমে ভারত সহ অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করা হতে থাকে এবং সরকারিভাবে প্রতি বস্তা সিমেন্টের দাম আঠারো টাকা বেঁধে দেওয়া হয়। শোনা যায়, এখন কালোবাজারে প্রকাশ্যভাবে প্রতি বস্তা সিমেন্ট পঞ্চান্ন থেকে পঁয়ষট্টি টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আর তার ফলে অতি স্বাভাবিক ভাবেই বন্ধ হয়ে গেছে সকল পর্যায়ের সরকারি বেসরকারি নির্মাণকার্য -দুঃসহ জেলার মধ্যে পড়েছেন নির্মাণ শ্রমিকরা তাদের পরিবার পরিজনদের নিয়ে। অন্যদিকে সিমেন্ট সংকট টেনে নিয়ে এসেছে সারাদেশের সকল বড় ছোট শহরেই মারাত্মক আবাসিক সংকট। একদিকে পল্লী এলাকায় মারাত্মক খাদ্য সংকটে দিশেহারা হয়ে প্রতি দিন বিপর্যস্ত মানুষেরা পাড়ি জমাতে শুরু করেছেন শহরের দিকে। সাধারণ মেহনতী মানুষের বাসস্থান সংকটের ক্ষেত্রে তো এখনও এদেশে কোনো মহল ভাবছেন এমন প্রমাণ তো নেই-ই, তার সাথে সাথে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সমাজের গৃহ সংকট তথা বাসস্থান সংকটের আবর্তেই তীব্র হয়ে উঠছে। খোদ রাজধানী নগরীতেই সংকট তীব্রতর থেকে আরও কিছু বললেও অত্যুক্তি হবে না। সিমেন্ট এবং অন্যান্য নির্মান সামগ্রী অভাবেই এক দিকে যেমন নতুন বাড়িঘরের নির্মাণকার্য বন্ধ -তেমনি বন্ধ হয়ে রয়েছে পুরনোগুলোর সংস্কারও। কাজেই দেড়শো টাকার বাড়ির ভাড়া উঠেছে তিনশোতে। নির্মাণ কাজ বন্ধ হবার ফলে যেমন বিপর্যস্ত শ্রমিক সমাজ, তেমনি মধ্যবিত্তরাও।
তাছাড়াও সরকারের বার্ষিক পরিকল্পনা অধীনে গৃহ, সড়ক, সেতু প্রভৃতি যেসব নির্মাণ কাজ হবার কথা, সেগুলো ও এখন ব্যাহত। আর এর ফলশ্রুতি হিসেবেই পল্লী এলাকায় এ আকালের দিনের খাদ্য সংকট তীব্র হতে বাধ্য। কেননা, সড়কের অভাবে বা সেতুর জন্য পরিবহনের ক্ষেত্রেও মারাত্মক অচলাবস্থা দেখা দিতে বাধ্য। সিমেন্টের এহেন অভাবের পরিপ্রেক্ষিতেই চলতি বছরে উন্নয়ন পরিকল্পনার লক্ষ্য অর্জন করাও সম্ভব হবে না বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমতাবস্থায়, এই সংকট দূরীকরণের জন্য জরুরিভিত্তিতে কার্যক্রম গ্রহণ করা উচিত। ছাতকের সিমেন্ট কারখানাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার সাথে সাথে এই সময়কালের অভাব দূরীকরণে বিদেশ থেকে সিমেন্ট আমদানি করে তা যথাযথভাবে বন্টনের ব্যবস্থা করা হোক।
ছাত্রদেরকেও চাষি ভাইদের সঙ্গে কাজ করতে হবে
শিল্পমন্ত্রী বলেছেন, একমাত্র কৃষি বিদ্যালয় এবং এখানে অধ্যায়নরত ছাত্ররা দেশের সবুজ বিপ্লবকে সার্থক করে তুলতে পারে। তিনি ছাত্রদেরকে পড়াশোনা শেষে গ্রামে গিয়ে কৃষকদেরকে আধুনিক চাষাবাদ সম্পর্কে জ্ঞান বিতরণের আহ্বান জানিয়েছেন।
আমাদের দেশ কৃষি-প্রধান। কিন্তু কৃষি-প্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও আমাদের দেশে এখনো আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ পুরোপুরিভাবে শুরু হয়নি -শুরু করা যায়নি। তদানীন্তন পাক আমলে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে কৃষি চাষাবাদের ব্যাপারেও তদানীন্তন সরকার বাংলাদেশকে বঞ্চিত করেছে বিভিন্নভাবে। ফলে তারবেলা, মঙ্গলা ইত্যাদি বাঁধ নির্মাণ এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যান্ত্রিক চাষাবাদের বিভিন্ন সরঞ্জামাদি পশ্চিমাঞ্চলের জন্য ব্যবস্থা করলেও পূর্বাঞ্চলের তার কোনো ব্যবস্থাই হয়নি। ফলে অতীতের পুরনো পদ্ধতিতে আজও এদেশে চাষাবাদ অব্যাহত রয়েছে। এমনকি এ দেশের কৃষকরা এ ব্যাপারে প্রাথমিক জ্ঞান পর্যন্ত অর্জন করতে পারেনি।
আশার কথা, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধুর সরকার সবুজ বিপ্লবের ডাক দিয়েছেন এবং সবুজ বিপ্লবকে সফল করে তোলার জন্য বিভিন্ন কর্মপন্থা গ্রহণ করে চলেছেন। সবুজ বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করার জন্য বাজেটেও অধিক অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে এবং জমিহীন কৃষকদের মাঝে জমি বন্টন, পতিত জমিতে চাষের ব্যবস্থা, কৃষিঋণ ও গভীর নলকূপ স্থাপন ও সরবরাহ ইত্যাদির ব্যবস্থা করেছেন -করে যাচ্ছেন। এখনো অভাব রয়েছে এসব আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞানের। সুতরাং চাষি ভাইদেরকে সেই জ্ঞান দান করতে হবে। সেই জ্ঞান দানের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে কৃষি বিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন দেশের সর্বাধুনিক চাষাবাদ সম্পর্কে জ্ঞানলব্ধ ছাত্র ভাইদের। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ভাইয়েরা তাদের দায়িত্বে অবহেলা করবেনই না বরং সবুজ বিপ্লব সাধনকে লক্ষ্য রেখে তাঁরা গ্রামে গ্রামে ছুটে গিয়ে দেশের বৃহৎ অংশ চাষী ভাইদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে তাদেরকে আধুনিক চাষাবাদের পূর্ণ জ্ঞান দান করবেন। আমাদেরই বাবা-চাচা দেশের শতকরা পঁচাশিজন কৃষিজীবী মানুষ আজ তাদের মুখপানে চেয়ে আছেন তাদের কাছ থেকে গবেষণালব্ধ কৃষি কর্ম সম্পর্কে জানতে এবং জ্ঞান অর্জন করতে। সুতরাং এক্ষণে সরকারকে যেমন সবুজ বিপ্লবকে সার্থক করে তোলার জন্য বিভিন্ন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে তেমনি সঙ্গে সঙ্গে যুবসমাজকেও বিশেষ করে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ভাইদেরকেও এগিয়ে আসতে হবে। তাদেরকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। তাঁরা সে ভূমিকা পালন করলে দেশের সাধারন ছাত্ররাও তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে পারবে এবং ফলে ছাত্র যুব সমাজ ও চাষী ভাইদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় সবুজ বিপ্লবও অবশ্য সার্থক হয়ে উঠবে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক