1985.03.22 | জাতীয় স্মৃতিসৌধ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২২ মার্চ ১৯৮৫
জাতীয় স্মৃতিসৌধ ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সাভারে ৮৪ একর জমির উপর দৃপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা ১৫০ ফুট দীর্ঘ এই সৌধটির গায়ে ছোট ছোট ফাটল ছাড়াও মাঝে মাঝে কালো ময়লার ছোপও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মনে করা হচ্ছে আশপাশের জমিতে ব্যক্তিগত ছোট আকারের ইটখোলা’ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি এবং স্টিল রিং রোলিং মিলের লম্বা চিমনিগুলো থেকে বেরিয়ে আসা কালো ধোঁয়া এবং নির্মাণ কাজের ত্রুটি সৌধের গায়ে এই ক্ষতিগুলো করছে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে দেশের শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পবিত্র স্মৃতির উদ্দেশে জাতির শ্রদ্ধা নিয়ে গড়ে ওঠা এই সৌধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর। এরপর তিনটি পর্যায় পার হয়ে এর কাজ শেষ হয় ১৯৮২ সালের ৩০ নভেম্বর। কিন্তু লজ্জার কথা এই যে তিনটি দীর্ঘ পর্যায়ে কাজ শেষ হওয়ার তিন বছর পার না হতেই এই সৌধের গায়ে দেখা যাচ্ছে ফাটল, জমছে ময়লা।
স্মৃতিসৌধের খুব কাছে গেলে বোঝা যায় -এর দীর্ঘ খিলান গুলো একদম সমান নয়। এর গা যথেষ্ট মসৃণ নয়। যেমন তেমন করে সিমেন্টের আস্তর দিয়ে ফাটল ঢাকার চেষ্টা পুরো স্মৃতিসৌধের সৌন্দর্য নষ্ট করছে। সৌধের নিচের তলার অবস্থাও তেমন সুবিধাজনক নয়। সেখানেও যেমন তেমনভাবে কাজ শেষ করার চিহ্ন রয়েছে। ভয়ংকরভাবে ঝুলে আছে বৈদ্যুতিক তার, ভেঙে আছে সকেট। যা যে কোন সময় যে কোনো দর্শকের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। এদিকে স্মৃতিসৌধের স্তম্ভের গায়ে চৌকোনা জায়গাটিতে বাসা বেধেছে একদল পায়রা। ফলে তাদের বিষ্ঠায় ঢেকে গেছে সৌধের গায়ে লাগোয়া লাল সিঁড়িটি। এইটুকু পরিষ্কার করার লোকও নেই কোথাও।
এ ব্যাপারে স্মৃতিসৌধের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত গণপূর্ত বিভাগের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান ছোট ছোট পাইপ বসিয়ে স্মৃতি সৌধের গায়ে সিঁড়ির মত তৈরী করে ওপরে ওঠার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ওই পাইপের ওপরেই প্রতিটি ভাগে ফাটল ধরেছে। পাইপ সরিয়ে নিলেই ফাটল আর থাকবে না। প্রশ্ন হচ্ছে পাইপ এতদিনেও সরানো হয়নি কেন? স্মৃতি সৌধের গায়ে কালো দাগের ব্যাপারে তারা জানান ওই এলাকার আশেপাশে কারখানাগুলো সরানোর ব্যাপারে তারা সাভারের ডেপুটি কমিশনারকে চিঠি দিয়েছেন। কিন্তু কোনো উত্তর আসেনি। এদিকে মিল-কারখানার ব্যাপারে সরকারের কোনো নীতিমালা না থাকায় সৌধের আশেপাশে ব্যক্তিগত জমিতে অবাধে এগুলো গড়ে উঠছে এবং ক্ষতি করছে স্মৃতিসৌধের। যদিও সরকার স্মৃতিসৌধ এলাকার চারপাশে ২৪ একর জমি নিয়ে কৃত্রিম বনভূমি তৈরির কথা ভাবছেন এবং এর দায়িত্ব গণপূর্ত বিভাগকে দেওয়া হয়েছে কিন্তু আমাদের সন্দেহ লাল ভিতের ফাঁস পার হয়ে এই পরিকল্পনা আদৌ সফল হয়ে উঠবে কিনা।
এ ব্যাপারে আমরা বিশেষজ্ঞ মহলের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান পাইপের জন্য এ ধরনের ফাটল ধরার কথা নয়। নির্মাণকাজে কোন ত্রুটিকেই তারা এর পেছনে দায়ী করেন। তারা আরো বলেন নির্মাণকাজে ভুল-ভ্রান্তির জন্য জাতীয় স্মৃতিসৌধ নিচের দিকে বসে যাচ্ছে। যদিও যেকোনো কাঠামো তৈরী হবার পর কিছুটা বসে যেতে পারে কিন্তু তা ঘটে সামগ্রিকভাবে। অথচ স্মৃতিসৌধের বেলায় এ ব্যাপারটি ঘটছে না। উদাহরণ হিসেবে তারা বলেন ঢাকা শহরে একটি বিদেশি হোটেল নয় ইঞ্চি বসে গেছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়াটি পুরো কাঠামোতে সামগ্রিকভাবে ঘটেছে।
কালো ধোঁয়ার ব্যাপারে তারা বলেন দু-এক বছর এই কল-কারখানা চলতে দিলেই স্মৃতিসৌধের গায়ে চিরস্থায়ীভাবে কালো দাগ পড়ে যাবে। এটাকে বলা হয় ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রাইম’। ধুলা, গ্যাস, ধোঁয়া থেকে এ জিনিসটি সৃষ্টি হয়। বিশেষজ্ঞ মহল এখানে উল্লেখ করেন বিদেশে বহু জায়গায় এ ধরনের ময়লা পরিষ্কারে শেষ পর্যন্ত লেজার রশ্মি ব্যবহার করতে হয়েছে। তারা সকলেই এলাকার আশেপাশে বড় গাছপালা এবং দূরে আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার ওপর জোর দেন এবং তারা বলেন এটা না হলে এই সৌধকে বাঁচানো যাবে না।
আমাদের যুদ্ধের কথা, আমাদের জানা-অজানা প্রচন্ড সাহসী যোদ্ধাদের কথা বুকে নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে এই স্মৃতিসৌধ। সোনালী অতীতের এই সৌধ বর্তমানের কাছে যেমন প্রেরণার বস্তু ভবিষ্যতের কাছেও তা যোগাবে সাহস, ঐতিহ্যের কথা, গড়ে তুলবে সাহসী, দেশপ্রেমিক, তেজোদীপ্ত মানুষ। এই স্মৃতিসৌধ আমরা কোনভাবেই নষ্ট হয়ে যেতে দিতে পারি না । তা উচিতও হবে না। আমাদের স্বপ্ন ছিল সৌধটি হবে সাদা বা লাল পাথরের। কিন্তু তা যদি আমাদের পক্ষে সম্ভব নাও হয়, তবে সৌধটি সুরক্ষিত হবে তা আমরা চাই।
[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/05/smriti-shoudho.pdf” title=”smriti shoudho”]