You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.22 | পাক-ভারত শীর্ষ বৈঠক অবাস্তব | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

পাক-ভারত শীর্ষ বৈঠক অবাস্তব

বিশ্বের কোন রাষ্ট্র পাক-ভারত শীর্ষ সম্মেলনের কথা ভাবছে কিনা জানা নেই। প্রকাশ্যে এ ধরনের কোন প্রস্তাব আসেনি। শ্রীনগরের জনৈক সাংবাদিক ছিলেন নাছােড়বান্দা। তিনি সরাসরি প্রশ্ন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীকে। কাল্পনিক প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়াই যুক্তিযুক্ত। কিন্তু শ্রীমতী গান্ধী এই চিরাচরিত পথ নেননি। তিনি বলেছেন, প্রথমে দরকার বাংলাদেশে গণহত্যার অবসান। তারপর যদি কোন রাষ্ট্র থেকে আসে পাক-ভারত শীর্ষ সম্মেলনের প্রস্তাব তখন তা বিবেচনা করে দেখবেন নয়াদিল্লী। সহজ কথায়, শর্ত সাপেক্ষে গান্ধী-ইয়াহিয়ার বৈঠকের সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেননি; প্রধানমন্ত্রী। ঢাকার সঙ্গে ইসলামাবাদের বিবাদ রাজনৈতিক। বাংলাদেশ বেছে নিয়েছে নিজস্ব পথ। তার চোখে অখণ্ড পাকিস্তান মৃত | বাস্তব সার্বভৌম বাংলাদেশ। দখলদার পাক-বাহিনীর সঙ্গে লড়ছেন মুক্তিযােদ্ধারা। চরম ফয়সালা করবেন তাঁরাই। গান্ধী-ইয়াহিয়ার বৈঠকে নির্ধারিত হতে পারে না বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। একথা সত্য, ভারতের উপর এ পড়েছে ষাট লক্ষাধিক শরণার্থীর বােঝা। যতদিন যাবে এ বােঝা তত বাড়বে। স্বদেশে এদের ফেরত পাঠাবার মুখ্য দায়িত্ব নয়াদিল্লীর। ১৯৫০ সালের নেহরু-লিয়াকত চুক্তির মত আর একটি গান্ধী-ইয়াহিয়া চুক্তি হলেই ওরা ফিরবেন না নিজেদের ফেলে আসা বাড়ী ঘরে। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে যবনিকার অন্তরালে রেখে শরণার্থীদের স্বদেশে পাঠাবার কল্পনা অলীক।
বৃহৎ রাষ্ট্রগুলাের মুখের দিকে চেয়ে আছেন প্রধানমন্ত্রী। ওরা শরণার্থীদের নিয়ে কলরব তুলছে এবং সাহায্য পাঠাচ্ছে। যারা শরণার্থী সৃষ্টির জন্য দায়ী তাদের গায়ে আঁচড় দিতে অনেকেই নারাজ। আমেরিকা এবং বৃটেনের মতিগতি সন্দেহজনক। ওরা ঢাকা-ইসলমাবাদের বিবাদকে পাক-ভারত বিরােধ বলে চালিয়ে দেবার চেষ্ট করছে। মার্কিন কর্তপক্ষ ভারত এবং পাকিস্তানকে সমভাবেই সংযম অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন। বৃটেনের রক্ষণশীল সরকারও তলে তলে হয়ত কলকাঠি ঘুরাচ্ছেন। ইয়াহিয়া সাবাড় করছেন জাতীয়তাবাদী বাঙালীকে। তাদের ঠেলে পাঠাচ্ছেন ভারতে। মানবতার খাতিরে দুর্গতদের জন্য সীমান্ত খুলে দিয়েছেন নয়াদিল্লী। ভারত এবং পাকিস্তান যে একই পর্যায়ে পড়ে না, একথা বুঝবার ক্ষমতা অবশ্যই তাদের আছে। কিন্তু তারা বুঝেও বুঝবেন না। মনে হয়, পশ্চিমী জনমতকে বিভ্রান্ত করার ষড়যন্ত্র চলছে গােপনে। এই অবস্থায় শ্রীনগরে করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে কাল্পনিক প্রশ্ন। তিনি দিয়েছেন সরাসরি উত্তর বাংলাদেশে গণহত্যার পূর্ণ অবসানের পর বিবেচিত হবে পাক-ভারত শীর্ষ সম্মেলনের কথা। যদি গণহত্যা বন্ধ হয় তবে সম্ভাব্য গান্ধী-ইয়াহিয়া বৈঠকে কি আলােচিত হবে? শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের প্রশ্ন, বাংলাদেশের ভবিষ্যতের প্রশ্ন? বাংলাদেশ সরকার ইসলামাবাদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। ওরা এখন যুদ্ধরত দুটি পক্ষ। ভারতের মধ্যস্থতার কোন সুযােগ নেই। তারপর আসে শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের প্রশ্ন। ইয়াহিয়ার কাছে পাওয়া যাবে কি তার সমাধান? সুপরিকল্পিত উপায়ে যারা বাঙালী খেদাচ্ছে তারাই কি নেবে তাদের পুণর্বাসন? শ্রীনগরে হয়ত সরল মনে কথাগুলাে বলেছেন শ্রীমতী গান্ধী। কিন্তু আন্তর্জাতিক কূটনীতি কোনদিনই সরল পথে চলে না। পশ্চিমী দুনিয়ার স্বার্থান্বেষী মহল হয়ত গান্ধী-ইয়াহিয়ার বৈঠক বসাবার জন্য উঠে পড়ে লাগবেন। এ ধরনের কোন প্রস্তাব যদি আসে তবে ওটা হবে একটা সুপরিকল্পিত ফাঁদ। তাতে পা দিলে আর রক্ষা নেই। সম্ভাব্য আলােচনা ব্যর্থ হতে বাধ্য। এই ব্যর্থতার মধ্যে রাতারাতি পাল্টিয়ে যাবে বাংলাদেশের সমস্যার প্রকৃতি। ইয়াহিয়ার বর্বরতার এবং শরণার্থীদের কথা চাপা পড়বে। প্রচারযন্ত্রে মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে পাক-ভারত বিরােধ। আসল সমস্যাকে এড়িয়ে যাবার সব ষড়যন্ত্র বানচাল করতে হবে। বাংলাদেশের ভাগ্য নির্ধারণ করবেন আওয়ামী লীগ এবং তাদের স্বাধীন সরকার। শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেবেন তারাই। সাম্প্রদায়িক এবং নরঘাতী ইয়াহিয়ার উপর আস্থা নেই কারও। বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ হােক বা না হােক কোন অবস্থাতেই চলতে পারে না পাক-ভারত শীর্ষ বৈঠক। নিজের স্বার্থের খাতিরেই ইসলামাবাদকে বর্জন করে চলা উচিত নয়াদিল্লীর। শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন ইয়াহিয়ার সঙ্গে আপােষ রফায় সম্ভব নয়। ওটা অবাস্ত ব কল্পনা। আসল পথ ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা। তা করতে পারেন মুক্তিফৌজ এবং স্বাধীন। বাংলাদেশ সরকার।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২২ জুন ১৯৭১