স্পষ্ট কথা বলুন নয়াদিল্লী
অখণ্ড পাকিস্তান মৃত। স্বাধীন বাংলাদেশ বাস্তব। তার সার্বভৌমত্বের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা সংগ্রামী জনতার চরম লক্ষ। এই মৌল পশ্নে কোন আপােস নেই। বারবার ঘােষণা করছেন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। এদের নৈতিক সমর্থন দিয়েছেন নয়াদিল্লী। সংসদের একত্রিশে মার্চের প্রস্তাবে রয়েছে তার নথীভুক্ত প্রমাণ। এদিকে ক্রমবর্ধমান শরণার্থীর ভারে ভারত দিশাহারা। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঘটছে অবস্থার পরিবর্তন। সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের মাত্রা বেড়ে চলেছে সেখানে। পাক-সৈন্যদের সঙ্গে হাত মিলাচ্ছে ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দলগুলাে। প্রাণের দায়ে এবং প্রলােভনে তাদের সঙ্গে সহযােগিতা করছে এক শ্রেণীর বিপথগামী মানুষ। ফলে বাড়ীঘর ছেড়ে পালাবার হিড়িক পড়েছে পূর্ব বাংলায়। ইয়াহিয়ার বাঙ্গালী খেদা অভিযান সার্থক হতে চলেছে। ভারতের কূটনৈতিক তৎপরতা আপাততঃ ব্যর্থ। তার প্রচার বৃহৎ রাষ্ট্রগুলাের মনে তেমন কোন দাগ কাটে নি। ছােট ছােট রাষ্ট্রও মুখ বুজে বসে আছে। শরণার্থী নিয়ে পশ্চিম ইউরােপ কিছুটা হৈ-চৈ করছে। যারা শরণার্থী সৃষ্টির জন্য দায়ী তাদের আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে অনেকেই নারাজ। প্রায় সাত মাস আগে পূর্ব বাংলায় হয়ে গেছে সাইক্লোন। রাষ্ট্রসঙ্ সাহায্য পাঠিয়েছিলেন পাকিস্তানে। এই সাহায্যের মধ্যে ছিল বিভিন্ন ধরনের যানবাহন। ইয়াহিয়া এগুলাে ব্যবহার করেছেন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমনে। প্রামাণ্য তথ্য হাতে থাকা সত্ত্বেও এই রাষ্ট্রসঙ্ঘ বাংলাদেশের সাহায্য পাঠাতে চান আবার ইয়াহিয়ার কাছে। যদি এগুলাে আসে তবে অবশ্যই তা ব্যবহৃত হবে ইসলামবাদের মারণযজ্ঞে। বহির্বিশ্বের এই অবাঞ্ছিত পায়তারা দিবালােকের মতই স্পষ্ট।
মন্ত্রীদের বিদেশ সফরে পাঠাচ্ছেন নয়াদিল্লী। তারা বাইরের সরকারগুলােকে কি বলছেন? সােভিয়েট রাশিয়া চায় না পাকিস্তানের অখণ্ডত্বের অবিলুপ্তি। বৃটেনের শাসক মহলে পাক-দরদ উচ্চগ্রামী। আমেরিকা নিঃসন্দেহে ইসলামাবাদের বন্ধু। আরব রাষ্ট্রগুলাে তথাকথিত ঐশ্লামিক মােহে আচ্ছন্ন। সবার লক্ষ্য ঢাকা এবং ইসলামবাদের মধ্যে একটা গোঁজামিল। অনেকে ভাবছেন কনফেডারেশনের কথা। ইয়াহিয়া খান অনমনীয়। বাংলাদেশে তিনি চান ইসলামাবাদের নিরঙ্কুশ প্রতিষ্ঠা। তার পরিণতি গােটা পাকিস্তানে পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠতার অবসান। কোন গোঁজামিল মানবেন না স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। আর এই গােজামিলের মধ্যে ফিরতে পারবেন না অধিকাংশ শরণার্থী। ভারতীয় দূতেরা বাংলাদেশের মৌল প্রশ্ন কি তুলে ধরবেন বিদেশী রাষ্ট্রনায়কদের সামনে? তারা কি স্বীকার করবেন সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্তিত্ব? তা যদি না করেন তবে শরণার্থী সমস্যার চূড়ান্ত ফয়সালা আসবে কোন পথে? বিদেশ সফর অন্তে কি আশ্বাস নিয়ে ফিরবেন মন্ত্রীরা? চোখের সামনে রয়েছে লক্ষ লক্ষ প্যালেস্টাইন শরণার্থী। গত বাইশ বছরেও হয় নি। তাদের সমস্যার সমাধান। এক পা দু’পা করে ভারত কি এ দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে?
.. কেন্দ্রীয় সরকার কি চোখে দেখছেন সামগ্রিক পরিস্থিতি? ইয়াহিয়ার উপর যদি কোন বিশ্ব চাপ আসে তবে তার ফলশ্রুতি হবে সীমিত। ইসলামাবাদের শাসন কাঠামাের আওতায় হয়ত চেষ্টা চলবে একটা আপােষ রফার। তাতে সংগ্রাম থামবে না। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি আওয়ামী লীগ এবং তাদের সরকার বসবেন।
কোন আপোেষ আলােচনায়। মুষ্টিমেয় ধর্মান্ধ সমর্থন জানাবে ইয়াহিয়া খানকে। স্বার্থান্বেষীরা করবে একটা লােকদেখানাে কসরত। তাতে পাওয়া যাবে না সমস্যার স্থায়ী সমাধান। শরণার্থীরা যেখানে আছেন। সেখানেই থাকবেন। প্রতিদিন তাদের সংখ্যা বাড়বে। এই অবস্থায় ভারতের মনে থাকতে পারে না কোন দ্বিধা। ধরে নিতে হবে অখণ্ড পাকিস্তান মৃত এবং স্বাধীন বাংলাদেশ বাস্তব। এই মৌল সত্যের উপর নির্ধারিত হওয়া উচিত কেন্দ্রীয় সরকারের ভবিষ্যৎ নীতি। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দানের প্রশ্ন। আর ঝুলিয়ে রাখা চলে না। শুধু স্বীকৃতিই যথেষ্ট নয়, তার সঙ্গে থাকবে সামরিক সাহায্য দানের অকুণ্ঠ প্রতিশ্রুতি। তবেই ঘটবে পূর্ববাংলায় ইসলামাবাদের শাসনের অবসান এবং সার্বভৌম বাংলাদেশের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা। একাজ সম্পূর্ণ হবার পরই শরণার্থীরা ফিরতে পারবেন স্বদেশে। হয়ত এতে আছে যুদ্ধের ঝুঁকি। শরণার্থীদের বােঝা ঘাড়ে নিয়ে ধুকে ধুকে মরার চেয়ে এ ঝুঁকি নেওয়া অনেক ভাল। কারণ তার মধ্যে পাওয়া যাবে অন্ধকার থেকে আলােকে যাবার বাস্তব উদাম। নয়াদিল্লী মাথা উঁচু করে দাঁড়ালে বৃহৎ শক্তিগুলােও তাকে বেশী ঘটাতে সাহস পাবে না। তাদের কাছে ভারতের গুরুত্ব পাকিস্তানের চেয়ে বেশী। ইসলামাবাদের খাতিরে অবশ্যই তারা নয়াদিল্লীর বন্ধুত্ব হারাতে চাইবে না। প্রধানমন্ত্রীর অস্পষ্ট কথাবার্তায় অধৈর্য হয়ে পড়েছেন ভারতের জনতা। বিদেশী রাষ্ট্রগুলােও নিচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বলতার পূর্ণ সুযােগ। আসল সমস্যা চাপা দিয়ে তারা শরণার্থীদের দুঃখ-দুর্দশাটাই বড় করে দেখছে। ফলে সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছে। সংশয়ের অবসান ঘটান দরকার। কেন্দ্রীয় সরকার বলুন—স্বাধীন বাংলাদেশ বাস্তব। তার পূর্ণ প্রতিষ্ঠার মধ্যেই নিহিত শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের উপায়। গণতন্ত্র, মানবতা এবং জাতীয় স্বার্থের খাতিরেই ভারতকে দিতে হবে বাংলাদেশ সরকারকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি। সঙ্গে সঙ্গে সামরিক সাহায্য। প্রথম সুযােগ নষ্ট করেছেন নয়াদিল্লী। আর বিলম্বের সময় নেই। ইয়াহিয়া যদি যুদ্ধ চান তবে তার রণসাধ অবশ্যই মিটাতে হবে। নইলে জটিলতা বাড়বে। ভারত ইচ্ছা করলেও যুদ্ধ এড়াতে পারবে না। ঘর গুছিয়ে। ইয়াহিয়াই তার ঘাড়ে চাপাবে লড়াই।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৮ জুন ১৯৭১