নিশ্চয়ই সত্য বিজয়ী হবে
সব রচনারই উৎস দায়িত্ববােধ, দায়িত্ব-চেতনা। নিজের দেশের প্রতি,
নিজের যুগের প্রতি, সেইসঙ্গে নিজের বিবেক ও লেখক সত্তার প্রতিও এ
দায়িত্ব বর্তায়।
-আবুল ফজল, লেখক, শিক্ষাবিদ।১
১৯৯৫ সালে ‘অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধ, কর্নেল তাহের ও জাসদ রাজনীতি’ নামে একটি গ্রন্থ লিখি আমি। ঢাকার শাহবাগের আজিজ মার্কেট’ কেন্দ্রিক আড্ডার গােড়াপত্তনকারী পাঠক সমাবেশ সে গ্রন্থ প্রকাশ করে। ১৯ বছর পর অনুরূপ বিষয়ে আবার এই লেখা। প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু কেন? তারই ব্যাখ্যা হিসেবে শুরুতে দু’টি কথা বলে নেওয়া জরুরি। কারণ শিরােনাম ভিন্ন হলেও উভয় প্রচেষ্টার পেছনে রয়েছে অনেক অভিন্নতা। জাসদ ও আবু তাহেরকে নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয় আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে।
তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনশাস্ত্রে পড়ছি। ডিপার্টমেন্টের চেয়েও ব্যস্ত বেশি মধুর কেন্টিনে। দেশের টুটি চেপে ধরে আছে তখন সামরিক জান্তা। আর আমরা কিছু তরুণ ভাবছি জান্তার কবল থেকে দেশকে উদ্ধারের দায়িত্ব কেবল আমাদেরই। ফলে মনােযােগের পুরােটা লুফে নেন জেনারেল এরশাদ।
মিছিল-মিটিং ছাড়াও এ সময়, সামরিক স্বৈরাচারের শেষের দিকে, সংগ্রামের আরেকটি ফ্রন্ট খুলে যায় সাংবাদিকতা। অনেকগুলাে সাহসী সাপ্তাহিক চুম্বকের মতাে আকর্ষণ করছিল। মিনার মাহমুদ ছিলেন এই রকম এক ক্যাম্পের কমান্ডার। যুক্ত হয়ে গেলাম এমনি এক গ্রুপে । ইতােমধ্যে অনার্সের রেজাল্ট বেরিয়েছে, এমএও শেষ এবং এরশাদও বিদায় নিলেন। পার্টির আবেদন ততদিনে ফুরিয়ে গেছে। মনে হচ্ছিলাে তাবৎ এস্টাবলিশমেন্টকে মােকাবেলায় কলমই যথেষ্ট।
এই সময়ই নিঃশঙ্কচিত্ত লে. কর্নেল তাহেরের দিকে দৃষ্টি পড়ে। হায়! লরেন্স লিফশুলজ (Lawrence Lifschultz)-এর ক্ষুদ্র পুস্তিকাটি (TAHER’S LAST TESTAMENT : Bangladesh The Unfinished Revolution) ছাড়া আর তেমন কোনাে উপকরণই নেই! শুরু হলাে জাসদ ও আবু তাহেরকে নিয়ে অনুসন্ধানপর্ব। তারই খসড়া হিসেবে তেজগাঁও থেকে প্রকাশিত দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকায় ৫০কিস্তিতে একটি লেখা বের হলাে। কাগজটির সম্পাদক তখন মতিউর রহমান চৌধুরী। সম্পাদকীয় বিভাগের জালাল আহমেদ ও শামসুদ্দোহা শােয়েবের আগ্রহ ছিল খুব। বােধহয় দৈনিকের ঐ ধারাবাহিকটি নতুন প্রজন্মের প্রকাশনা সংস্থা ‘পাঠক
………………………………………….
১। আবুল ফজল, কৈফিয়ৎ’, শেখ মুজিব: তাঁকে যেমন দেখেছি, আগামী প্রকাশনী, ১৯৭৮, ঢাকা, পৃ. ৩। উল্লেখ্য, শেখ মুজিবুর রহমান শাসনামলে আবুল ফজল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন।
Page 14
সমাবেশ’-এর স্বত্ত্বাধিকারী সাহিদুল ইসলাম বিজু’র নজরে পড়েছিল। একদিন বললেন, আমি এটা বই আকারে ছাপবাে। প্রকাশের পরই দ্রুত নিঃশেষ হয়ে গেল বইটি। বিজুর জন্য এডভেনচারটি ছিল বাণিজ্যিকভাবে স্বস্তির।
কিন্তু লেখকের অস্বস্তি তখন থেকেই। নানান সূত্র থেকে মন্তব্য পেতে থাকলাম। একদল বলতেন, এত সংক্ষিপ্ত কেন? দ্বিতীয় মত ছিল অতি তীব্র, বিষয়টি ক্রিটিক্যালী দেখলে ভালাে হতাে। চিরতরুণ এবং চিরকুমার আহমদ ছফা তখন আজিজ মার্কেটের দোতলায় বসতেন। সেখানে আড্ডা দিতে যেতাম। তিনি নিজেও জাসদের ইতিহাসের এক চরিত্র। কিন্তু একদিন প্রসঙ্গ উঠতেই ধমক দিলেন, সাতই নভেম্বর সফল হলে কী হতাে ভেবেছেন? কী লিখেছেন এসব!’ এভাবেই ব্যবসা সফল হলেও প্রথম বই’ অতি নবীন এক লেখকের আত্মবিশ্বাসকে উল্টো বরং দুর্বল করে দিল। সেই থেকে জাসদ নিয়ে আগ্রহের আরেক দফা গােড়াপত্তন। আরেক অভিযাত্রা। সুনির্দিষ্টভাবে বললে মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর নিয়ে আরও গভীর অধ্যয়ন ও অনুসন্ধানের তাগিদ তৈরি হলাে। ধীরে ধীরে উপলব্ধি হচ্ছিলাে নেহায়েত ছেলেমানুষী হয়ে গেছে প্রথম দফা। ইতিহাসের রণক্ষেত্রে নানান যােগসূত্র আরও খতিয়ে দেখা দরকার।
ইতােমধ্যে সাংবাদিকতা, শিক্ষকতা, গবেষণা আর জীবনযুদ্ধের নিরন্তর টানাপােড়েন। এস্টাবলিশমেন্ট চেপে ধরেছে হরহামেশা। গণঅভ্যুত্থানের এক দশকের মধ্যে রাজনীতি তাে বটেই, সাংবাদিকতাকেও খেয়ে ফেলে বাংলাদেশের ‘গণতন্ত্র।’ফলে তারুণ্যের সে-ই প্রথম প্রেম- অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ঝাঝালাে আবেদন কিছুটা ফিকে হয়ে গেছে বইকি।
তারপরও মাঝে মাঝে ‘আনসার বিদ্রোহ’, ‘যশাের কারা বিদ্রোহ’ ইত্যাদি নানা বিষয়ে কাজ করেছি। কিছু তার প্রকাশিত হয়েছে, কিছু তার রাষ্ট্রের থাবায় পড়েছে। কিন্তু প্রথম প্রকাশনার সেই অতৃপ্তি বরাবরই তাড়া করেছে একান্ত মুহূর্তে। বিশেষত অনেক বন্ধুর অনুরােধ পিছু ছাড়েনি। পুরানাে বইটির কপিও হারিয়ে গিয়েছিল। বিজু একদিন ফটোকপি এনে দিলেন। ভাবলাম, পুরাে বই না পারি, একটি অধ্যায় নিয়ে জানিয়ে দিই না কেন- আমি কী ভাবছি, কী দেখছি এবং কী পাচ্ছি। সেই ভাবনা থেকেই প্রথম বইটির নবম অধ্যায়ের সম্প্রসারিত রূপ বর্তমান গ্রন্থ। ‘মুজিব বাহিনী ও সিরাজুল আলম খানের নিউক্লিয়াস’-এ রকম একটা নাম ছিল তখন ঐ অধ্যায়ের; আয়তন ছিল ছয় পাতা। আর এখন হয়েছে প্রায় ৫০০ পাতা! আসলে জাসদের ইতিহাস এমনি এক আদিঅন্তহীন কাহিনী মনে হয় আমার কাছে বিশেষ করে দলটির যাদুকরি সংগঠক সিরাজুল আলম খানের জীবন ও কর্ম । যদিও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সাহিত্য তার রাজনৈতিক তৎপরতার প্রতি উপযুক্ত মনােযােগ দিয়েছে বলে মনে হয় না। এমনকি সম্প্রতি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখিত যেসব গবেষণাগ্রন্থ নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে তুমুল আলােচনা চলছে সেগুলাের কোনাে কোনােটির নির্ঘণ্টে তাঁর নামটিও নেই! এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে Gary J. Bass এবং Srinath Raghavan এর যথাক্রমে The Blood Telegram ও 1971: A Global
Page 15
History of the Creation of Bangladesh এর উল্লেখ করছি। এসব লেখকরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখতে যেয়ে আন্তঃদেশীয় অনেক মহাফেজখানার সাহায্য নিয়েছেন- যা তাঁদের গ্রন্থকে তথ্যপূর্ণ করেছে এবং অসামান্য স্বীকৃতি এনে দিয়েছে। কিন্তু সিরাজুল আলম খানের কোনাে তথ্য তাঁরা পাননি। কারণ তিনি তাে মহাফেজখানায় সংরক্ষণের মতাে কোনাে তথ্য কোথাও রেখে যাননি! তাঁকে অনুসন্ধানের যে দায় রহস্যময়তার ছলে তিনি পুরােপুরি সাংবাদিক, গবেষক ও ইতিহাসবিদের দিকে ঠেলে দিয়েছেন সে চ্যালেঞ্জ আজও কেউ পেশাদারিত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছে বলে দেখা যায় না।
কেবল সিরাজুল আলম খান ও তাঁর কর্মীবাহিনীর প্রতি সচেতন উদাসীনতাই নয়- বাংলাদেশের রাজনৈতিক সাহিত্য, একাত্তর ও একাত্তর-পরবর্তী ঘটনাবলিকে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির আলােকে বিচার-বিশ্লেষণ করতেও কম আগ্রহী। যদিও ঘটনাবলির কৌতূহলােদ্দীপক সূত্রগুলাে রয়েছে সেখানেই। চলতি অনুসন্ধান সেদিকে অধিক মনােযােগী হতে চেয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, চলতি কাজের অংশ হিসেবে আমি যখন লাইব্রেরিতে জাসদের মুখপত্র হিসেবে দৈনিক গণকণ্ঠের ‘৭৫ পূর্ব পুরানাে কপিগুলাে দেখছিলাম- তখন মাসের পর মাস ঘেঁটেও ঐ কাগজে কখনাে কোনাে উপলক্ষ্যে সিরাজুল আলম খানের নাম বা ছবি বা কোনাে লেখা দেখিনি, অথচ তিনিই দলটির প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক। এসব রহস্য তাৎপর্যময় বৈকি!
জাসদ ও সংশ্লিষ্ট ইতিহাস অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হলাে লরেন্স লিফশুলৎজের বাংলাদেশ : দ্যা আনফিনিশড রেভলুশন।’ লিফশুলৎজের নাতিদীর্ঘ ঐ পুস্তিকা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের এক উত্তাল সময়ের অসামান্য ডকুমেন্টেশন । কিন্তু একই সঙ্গে সেই সময়ের ইতিহাস অনুসন্ধানে এই ডকুমেন্টেশন এক মনস্তাত্ত্বিক ও জ্ঞানগত প্রতিবন্ধকতাও। ঘটনাবলির বয়ানে লিফশুলজ প্রচুর আবেগও মিশিয়ে দিয়েছেন- যা ঐ সময়ের ইতিহাস অনুসন্ধানে বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও তাবৎ পাঠককে অন্ধকে হাতি দেখানাের মতাে দশকের পর দশক পথ দেখিয়ে চলেছে। এন্থনি মাসকারেণহাসসহ আরও কয়েকজন বিদেশি লেখকও পঁচাত্তরকেন্দ্রিক অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার বয়ানে একইভাবে পথনির্দেশক’-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে আছেন। এসব ঐতিহাসিক কুহক থেকে বের হওয়া যে কোনাে নবীন অনুসন্ধানকারীর জন্য সহজ নয়- বর্তমান লেখকের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
বর্তমান গ্রন্থটিকে পুরানাে গ্রন্থের নতুন সংস্করণ নয় বরং পুরােদস্তুর এক পুনর্পাঠ হিসেবে গ্রহণ করতে অনুরােধ করব। জানি না পুরানাে বইয়ের অন্য অধ্যায়গুলাে নিয়ে এমনতর কিছু কখন লেখা হবে। যদি প্রাত্যহিক জীবন তেমন অনুমতি দেয় কোনাে দিন! বিশেষত এই পর্বে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থান, ৭ নভেম্বরের সিপাহী অভ্যুত্থান, সেনাপতি ও রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা সম্পর্কে পুনর্পাঠ ও পুনর্ভাবনার কিছুই বলা হয়নি। ইতিহাসের ঐ পর্যায়ে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ কীভাবে ধ্বংসের কিনার থেকে ফিরে আসতে পারলাে- আদৌ পেরেছিল কি না- সেটাও গুরুত্বপূর্ণ এক বিবেচনা। পরিকল্পনা রয়েছে, বর্তমান গ্রন্থের সঙ্গে ধারাবাহিকতা রেখে পরবর্তী দুটি খণ্ডে সেসব বিষয়ে আলােকপাত করা হবে।
Page 16
আমাদের ইতিহাসে মুজিব বাহিনী, জাসদ, রক্ষীবাহিনী এবং বিশেষভাবে বহিঃশক্তির
ভূমিকা কিংবা অতীত ভূমিকার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিশ্চিতভাবে ১৯৭৫ সালের আগস্টে শেষ হয়ে যায়নি। যেমনটি শেষ হয়েছে এই গ্রন্থের শেষ অধ্যায় ও শেষ বাক্য। যে কারণে তিন খণ্ডে প্রকাশিতব্য আমার লেখার প্রথম খণ্ড’ হিসেবেই বর্তমান বিবরণকে বিবেচনার জন্য সবিনয় অনুরােধ জানাচ্ছি। তবে প্রথম খণ্ডকে একটি পুরােপুরি স্বতন্ত্র অনুসন্ধান হিসেবে মূল্যায়নেরও সুযােগ থাকছে।
বহু বছর আগে লিখিত একটি গ্রন্থের ছয় পৃষ্ঠা আয়তনের একটি অধ্যায়ের পুনর্পাঠ ও পুনর্লিখন এই গ্রন্থ। ইতিহাসের ঐ কালপর্ব সম্পর্কে আগের ও পরের গ্রন্থে। লেখকের দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হয়তাে সকলের চোখে পড়বে। প্রথম গ্রন্থের অসম্পূর্ণতা থেকে নতুন করে দায় তৈরি হয়েছিল জাসদের রাজনীতি ও আবু তাহেরের বিপ্লবী প্রচেষ্টার পূর্বাপর খতিয়ে দেখার। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমান গ্রন্থে আমার সর্বশেষ পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একই বিষয়ে দেশের মূলধারার প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসের দূরত্ব লক্ষ্য করবেন পাঠক। এক্ষেত্রে নিঃসঙ্গ হয়েও বলবাে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চালু ইতিহাসে- এর রচয়িতারা যা লিখেছেন, ভাবীকালে তা, আরও গভীর প্রশ্নের মুখে পড়বে বলেই মনে করি।
রাজনীতির কোথায় শেষ এবং ইতিহাসচর্চার কোথায় শুরু সেই ব্যবধান ও ব্যাকরণটুকু অনেক সময় আমাদের রাজনৈতিক সাহিত্যে সযত্নে এড়িয়ে যাওয়া হয়- সমকালীন বাগাড়ম্বরের সঙ্গে তাকে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখতে গিয়ে। এভাবে মেঠো রাজনীতির স্বার্থে ইতিহাসচর্চার বিকৃতি ঘটিয়েছেন বাংলাদেশের তারকা ইতিহাসবিদ্রা। তবে নতুন প্রজন্ম ওখানে আটকে থাকবে না বলেই বােধ করি। প্রশংসা করার মতাে পেশাদার একটি ভঙ্গী রয়েছে তাদের। বিশেষ করে অতীতের বিপ্লবী প্রচেষ্টাগুলাের শিক্ষা, প্রাসঙ্গিকতা, পরিণতি ও ভ্রান্তিগুলাে খুঁজে দেখার আগ্রহ নিশ্চয়ই জারি থাকবে ভবিষ্যৎ তারুণ্যের মাঝেও।
পাশাপাশি অতীতে তথাকথিত সমাজতন্ত্রের নামে কী কী বিধ্বংসী প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে এ দেশে এবং কারা নবীন দেশটিকে সমাজতন্ত্রের নামে বাঘের পিঠে সওয়ার করে দিয়েছিল- তারও নিকাশ না করে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক পথানুসন্ধান হবে আরেকপ্রস্ত বােকামি। অন্যকোন রূপ ধরে এবং অন্যকোন মতাদর্শকে কেন্দ্র করে আসন্ন দিনগুলােতে একই ধরনের প্রকল্প-প্রচেষ্টা হবে না, এমন কোনাে নিশ্চয়তা নেই। নির্মোহ রাজনৈতিক সাহিত্য এক্ষেত্রে বিরাট সতর্কতামূলক ভূমিকা রাখতে পারে।
ভুলে গেলে চলবে না- দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জাতিসত্তাগুলাের মধ্যে বাঙালি সর্বপ্রথম নিজের রাষ্ট্রচিহ্ন তৈরি করতে পেরেছে। এটা পুরাে অঞ্চলের জন্যই অনন্য। এক অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতার আবেগবর্জিত, নৈর্ব্যক্তিক সত্য ইতিহাস রচনা এখন বাংলাদেশের ইতিহাসবিদূদের সামনে মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে হাজির হয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ মােকাবেলার যে দৈন্যতা- তার বিশেষ যােগ রয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী আর্থসামাজিক দিশাহীন অবস্থারও। উল্লিখিত ব্যর্থতার কারণেই বােধকরি বাংলাদেশের আবির্ভাবের চার দশক পরও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য নিপীড়িত জাতিগুলাের সামনে তার উত্থান ভবিষ্যতের জন্য কোনাে রাজনৈতিক শিক্ষা আকারে
Page 17
হাজির হতে পারেনি- যেমনটি আশা কিংবা আশঙ্কা করা হয়েছিল। ফলে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে এবং যুদ্ধ পরবর্তী গৃহযুদ্ধ সম্পর্কে অনুসন্ধান বহুদিন ধরেই গুরুত্বপূর্ণ এক মননশীল কর্তব্য আকারে রয়ে গেছে আমাদের সামনে।
চলতি প্রচেষ্টায় আমার পর্যবেক্ষণে অনেক ‘ভুল’-এর সন্ধান পাওয়া স্বাভাবিক। আমি নিজেও সম্ভাব্য ভুলগুলাে শুধরাতে রাজনীতির তৎকালীন কুশীলবদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি। কেউ কেউ তাঁরা রাজনীতি ছেড়ে বহুদূরের নির্বিঘ্ন এক ব্যক্তিগত জীবনে আছেন। অনেকে আবার রাজনীতিতে থেকেও বাহাত্তর-তিহাত্তর থেকে বহু দূরে। স্বেচ্ছামূলক এসব ‘দূরত্ব’ ভেঙ্গে ইতিহাসের সঙ্গে কথােপথনে আমি তাঁদের রাজি করাতে পারিনি। এই ব্যর্থতা একান্তই আমার। তবে একই কারণে ‘ভুল’গুলাের দায় কিছুটা তাদের ওপরও নিশ্চয়ই বর্তায়। এই গ্রন্থ প্রকাশের পরও বাংলাদেশের ঐ সময়ের ইতিহাস নিয়ে চলতি অনুসন্ধান জারি থাকবে। কারণ এর মাঝে এখনও বিস্তর অসম্পূর্ণতা রয়ে গেছে। এ প্রক্রিয়ায় সম্ভাব্য ‘ভুল’গুলােও অদূর ভবিষ্যতে হয়তাে শােধরাতে পারবাে- যদি সংশ্লিষ্টদের মুখ খুলতে রাজি করাতে পারি ।
এ পর্যায়ে রাজনৈতিক তথ্য সংগ্রহকারীর চলতি প্রচেষ্টায় আমার বিচিত্র অভিজ্ঞতার সামান্য অংশ শােনাতে চাই। গ্রন্থের শুরুতে, একেবারে প্রথম পাতায় আমি জাসদকে বর্তমানে একটি ক্ষয়িষ্ণু দল হিসেবে উল্লেখ করেছি। তবে এ দলের পুরানাে বিশাল কর্মী বাহিনীর সংখ্যাগরিষ্ঠই এখনও বেঁচে আছেন। ব্যাপক রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতায় তারা সমৃদ্ধ। কিন্তু বহু বিচিত্র তাদের রাজনৈতিক অবস্থান। কেউ কেউ চরম আওয়ামী লীগ বিরােধী, কেউ আবার বিএনপি বিরােধী এবং অনেকে আছেন জাতীয় পার্টিতে। জাসদ থেকে সৃষ্ট বাসদ নামে দু’টি দলেও তাঁদের অস্তিত্ব বিরাজমান। তবে নিষ্ক্রিয়দের সংখ্যাই সর্বাধিক। দীর্ঘ দু’দশক ধরে আমি এমন অনেকের সঙ্গেও সম্পর্ক রক্ষা করেছি- যাদের শরীরে রক্ষীবাহিনীর নির্যাতনের চিহ্ন এখনও মুছে যায়নি, কিন্তু এখন তারা আওয়ামী লীগের প্রবল সমর্থক, এমপি। আবার কারাে কারাে সঙ্গে আমি পরিচিত হয়েছি- যখন তারা বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক- কিন্তু জিয়াউর রহমানের শাসনামলে কারাগারে কাটিয়েছেন দীর্ঘ সময়। বলা বাহুল্য, একই ঘটনাবলির রাজনৈতিক ধারাবিবরণী দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক গরমিল আছে এদের ভাষ্যে। আবার একক ব্যক্তির ভাষ্যও পাল্টেছে বারবার। যখন তিনি রাজনৈতিক অবস্থান পাল্টেছেন। নির্মোহ ভঙ্গিতে এ রকম জটিল পরিস্থিতি মােকাবেলা দুরূহ এবং সত্যকে শনাক্ত করাও দুরূহ। যেহেতু এই অনুসন্ধানের অন্যতম ভিত্তি ছিল সাক্ষাৎকার- সে কারণে উপস্থাপিত বিবরণীতে সাক্ষাৎকার প্রদানকারীদের আবেগ-অবস্থান-বিশ্বাস ইত্যাদির পরােক্ষ ছাপ থাকা স্বাভাবিক। যদিও তার কারণে গবেষণার বস্তুনিষ্ঠতার যা কিছু ব্যত্যয় ঘটেছে- সে দায় লেখকেরই।
পরিশেষে, সেসব বন্ধুদের অভিনন্দন, যারা দশকের পর দশক ধরে যত্নের সঙ্গে সংরক্ষিত রাজনৈতিক দলিলপত্রের নিজস্ব সংগ্রহশালা আমাকে ব্যবহার করতে দিয়েছেন উদারভাবে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ইতিহাসের এ অধ্যায়কে দেখার আমার পর্যালােচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ভীষণ রকমে ভিন্নমত পােষণ করেও এ কাজে উৎসাহ দিয়েছেন; সাহায্য করেছেন। বন্ধুত্বের ঐ আধুনিকতাটুকুই আমার
Page 18
প্রেরণা। তারা নিশ্চয়ই জানবেন, আমার লেখা ইতিহাসের সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হতে চেয়েছে- এর বেশি কিছু নয়। গবেষণা সাহিত্য মাঠের রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে পারে- এটা আমি বিশ্বাস করি না। অতিক্রম-অযােগ্য সীমানায় যার যার অবস্থান। তবে মাও সেতুঙ যেমনটি বলেছেন, সত্য ও মিথ্যার লড়াইও তীব্রভাবে এক রাজনৈতিক লড়াই’, সেটা বােধহয় সত্যি এবং সে অর্থে সকল গবেষণাই এক একটি রাজনৈতিক পণ্য ও প্রকল্পও বটে।
গবেষণা জগতে পদ্ধতিগত অনুসন্ধান ও দৃষ্টিভঙ্গিগত নিরপেক্ষতার ওপর বরাবর জোর দেওয়া হয়। এ গ্রন্থেও তার সাধ্যমত কসরত রয়েছে। তবে তার ব্যত্যয়ও মিলবে ব্যাপক। ইতিহাস রচনার পদ্ধতি যাদের চর্চার বিষয় তারা বর্তমান গ্রন্থের উপস্থাপন পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন- এটা অস্বাভাবিক নয়। বিশেষ করে প্রচলিত গবেষণার শুরুতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিদ্যমান সাহিত্যগুলাে পর্যালােচনার যে রেওয়াজ রয়েছে এখানে তাকে হুবহু অনুসরণ করা হয়নি বরং পুরাে গ্রন্থ জুড়ে তার রেশ ছড়িয়ে আছে। এ ছাড়া উচ্চতর গবেষণায় অধ্যায়গুলাে গঠনের ক্ষেত্রে যেসব কাঠামােগত নির্দেশনা অনুসরণ করা হয় এক্ষেত্রে তারও কিছু ব্যত্যয় ঘটানাে হয়েছে। মূলত গ্রন্থটিকে সুখপাঠ্য রাখার জন্যই এসব ব্যতিক্রম। তাছাড়া এই অনুসন্ধান প্রচেষ্টার লক্ষ্য ছিল পাঠক এবং একমাত্র পাঠক- কোনাে ডিগ্রি বা প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি নয় । সে কারণে একাডেমিক নিয়ম-শৃঙ্খলা থেকে স্বাধীনতা নেয়া হয়েছে সাধ্যমত ।
ঐতিহাসিক কোনাে বিবরণই বােধহয় বিতর্কমুক্ত নয়; বর্তমান অনুসন্ধানেরও সে দাবি করার সুযােগ নেই। স্বাধীনতাযুদ্ধ ও তার পরবর্তীকালের রাজনীতি সম্পর্কে কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে বর্তমান গ্রন্থে। নিশ্চিতভাবে তা আবার অনেক নতুন প্রশ্নেরও জন্ম দিয়েছে। ভবিষ্যতে অনুসন্ধানী তথ্যের আলােকে বর্তমান পর্যবেক্ষণ
পাল্টে গিয়ে হলেও নতুন ও অমীমাংসিত প্রশ্নগুলাের উত্তর আসুক- তেমনটিই চাইবাে। যত বিলম্বই হােক- নিশ্চয়ই সত্য বিজয়ী হবে; যদিও জীবনানন্দ দাশের সে কথাও ভােলার নয় : ‘যে জিনিস অভ্যস্ত বুদ্ধি বিচার কল্পনাকে আঘাত করে- যা পরিচিত নয়, তার অপরাধ ঢের।২ হয়তাে আমিও ‘অপরাধী’ হয়ে গেলাম ।
– আলতাফ পারভেজ, ঢাকা।
পুনশ্চ : এক
মূল লেখায় যদি ভুলবশত কোন উদ্ধৃতির তথ্যসূত্র বাদ পড়ে থাকে তাহলে সংশ্লিষ্ট লেখকের নিকট।ক্ষমাপ্রার্থী। কেউ যদি এসব ভুল শনাক্ত করতে সহায়তা করেন কৃতজ্ঞ থাকবাে।
পুনশ্চ : দুই
এই পুস্তকের শেষে এমন কিছু তথ্য, দলিলপত্র সংযুক্ত হয়েছে যা মূলত অন্যান্য লেখকের পুস্তকের পরিশিষ্ট থেকে সংগৃহিত। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় আবার তুলে ধরা হচ্ছে। নির্দিষ্ট স্থানে তার স্বীকারােক্তিও রয়েছে। তারপরও সেই সব লেখকের কাছে ঋণ স্বীকার করছি।
………………………………………………..
২। জীবনানন্দ দাশ তাঁর বিখ্যাত ক্যাম্পে’ কবিতার বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযােগ খণ্ডন করতে গিয়ে এই মন্তব্যটি করেছিলেন। দেখুন, ক্লিন্টন বি সিলি, অনন্য জীবনানন্দ, অনুবাদ: ফারুক মঈনউদ্দীন, প্রথমা, ২০১১, ঢাকা, পৃ. ১২৮।
Source: মুজিব বাহিনী থেকে গন বাহিনী ইতিহাসের পুনর্পাঠ – আলতাফ পারভেজ