You dont have javascript enabled! Please enable it! বাদিয়াখালী ব্রিজ ধ্বংস - সাদুল্লাপুর থানা আক্রমণ ও বিপর্যয় - সংগ্রামের নোটবুক
বাদিয়াখালী ব্রিজ ধ্বংস
ভূমিকা
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন গাইবান্ধা-ফুলছড়ি ঘাট সড়কের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। কারণ উত্তরবঙ্গে যুদ্ধরত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অস্ত্র-গােলাবারুদসহ যুদ্ধের অন্যান্য সরঞ্জামাদি নৌপথে ফুলছড়ি ঘাটে এসে পৌছাতাে এবং পরবর্তী সময় এ রাস্তা দিয়ে গাইবান্ধা হয়ে অন্যান্য বেইসে সাপ্লাই হতাে। গাইবান্ধা শহর থেকে ১০ কিলােমিটার দক্ষিণে এ রাস্তার উপর অবস্থিত ব্রিজটি কৌশলগত দিক থেকে ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এ ব্রিজটি ধ্বংস করে দিলেই সড়কপথে গাইবান্ধা থেকে ফুলছড়ি এবং বােনারপাড়ার সাথে যােগাযােগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে যেত। তাই পাকিস্তান সেনাবাহিনী এ ব্রিজটিকে সার্বক্ষণিকভাবে পাহারায় রাখত। গাইবান্ধা এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর যােগাযােগ ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা এ ব্রিজটিকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। মাহবুব এলাহী রঞ্জুর কোম্পানি প্রাথমিকভাবে এ ব্রিজটিকে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে রুস্তম আলী খন্দকারের কোম্পানি পুনরায় ব্রিজটিতে আক্রমণ করে এবং মােটামুটি সফল হয়।
যুদ্ধের সংগঠন
ক, পাকিস্তান সেনাবাহিনী: পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নেতৃত্বাধীন ২০ ২৫জন রাজাকার ব্রিজটিকে সার্বক্ষণিক পাহারায় রাখত।
খ, মুক্তিবাহিনী: আনুমানিক ৫০জন। অধিনায়ক: রুস্তম আলী খন্দকার; উপ-অধিনায়ক: গৌতম চন্দ্র মােদক; উপদল অধিনায়ক: সামসুল আলম, মহসীন, শহিদুল, এনামুল, সাজু, ফারুক, জুবেল, ছানা; অন্যান্য সদস্য: বন্দে আলী, ফজলু, ঠাণ্ড, ছােট নুরু, হামিদ প্রমুখ।
যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা
বাদিয়াখালী ব্রিজটি ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে অধিনায়ক রুস্তম আলী, মজিবুল হক ছানা ও মহসীন আলীকে ব্রিজটি দিনের বেলায় রেকি করার দায়িত্ব দেন। একাধিকবার রেকি করার পর তারা নিশ্চিত হলেন যে, ব্রিজটির দুই ধারে ২টি করে মােট ৪টি বাংকার আছে, যেখানে দাড়িয়ে রাজাকাররা ভারি অস্ত্রসহ পাহারায় থাকে। বাংকারগুলাের উপর খড়ের চাল ছিল। রেকি গ্রুপের রিপাের্টের উপর ভিত্তি করে ১৯৭১ সালের ১৭ অক্টোবর রাত আনুমানিক ১টা ৩০ মিনিটের দিকে মুক্তিযােদ্ধারা কাতলামারী থেকে পায়ে হেঁটে ব্রিজের কাছাকাছি এসে অবস্থান গ্রহণ করেন। অধিনায়ক স্পেশাল টাস্ক গ্রুপের অধিনায়ক মহসীনকে তার কাজ বুঝিয়ে দিয়ে আনুমানিক ২টার দিকে ব্রিজের নিকটবর্তী বাংকারগুলাের দিকে গুলিবর্ষণ শুরু করেন। একই সাথে গর্জে ওঠে অন্যান্য মুক্তিযােদ্ধার এলএমজি, এসএলআর ও স্টেনগান। শত্রুপক্ষও পাল্টা গুলিবর্ষণ শুরু করে। এভাবে প্রায় আধা ঘণ্টা গুলিবিনিময়ের পর বগুড়ার সারিয়াকান্দির মুক্তিযােদ্ধা ফারুক এবং সুন্দরগঞ্জের মুক্তিযােদ্ধা রাজা ক্রলিং করে ব্রিজের কাছাকাছি গিয়ে শত্রুর বাংকারের উপর গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন। ফলে বাংকারের উপরিভাগে আগুন ধরে যায় এবং শত্রুদল প্রাণ ভয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং ব্রিজটি মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে। অতঃপর মুক্তিযােদ্ধা মহসীন, সামসুল আলম, সাজু, শহিদুল, ছানা, জুবেল, ফজলু প্রমুখ ব্রিজের উপর এক্সপ্লোসিভ স্থাপন করে আংশিকভাবে ব্রিজটি ধ্বংস করেন। সফলতার কারণ নিখুঁত পর্যবেক্ষণ দলের অধিনায়ক ব্রিজটি ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে একাধিকবার দিনে ও রাতে রেকি করেন এবং শত্রুর বিভিন্ন অভ্যাস সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হন। সুষ্ঠু পরিকল্পনা রেকি গ্রুপের প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে মুক্তিযােদ্ধারা বাংকারের কাছাকাছি।
আড় নিশ্চিত করেন এবং অন্ধকারের সুবিধা নিয়ে শত্রুর বাংকারের কাছাকাছি গিয়ে গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন যা শত্রুকে বাংকার ছাড়তে বাধ্য করে। সাহসিকতা মুক্তিযােদ্ধা ফারুক তার নিজের জীবন বাজি রেখে শত্রুর বাংকারের কাছাকাছি গিয়ে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে অসীম সাহসিকতার পরিচয় দেন এবং নিজ দলের সহজ বিজয় নিশ্চিত করেন। গােপনীয়তা কঠোর গােপনীয়তা রক্ষা করে চুপিসারে দলটি কাতলামারী থেকে ব্রিজ এলাকায় পৌছায় এবং অবস্থান নেয়, যা প্রহরাধীন শত্রুপক্ষ আঁচ করতে পারেনি।
উপসংহার
বাদিয়াখালী ব্রিজ আক্রমণটি ছিল রুস্তম কোম্পানির একটি সফলতম অভিযান। এ আক্রমণের সফলতা গাইবান্ধা এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সড়কপথের যােগাযােগ ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দিয়ে তাদেরকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করেছিল।
সাদুল্লাপুর থানা আক্রমণ ও বিপর্যয়
সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহের এক রাতে একবার সাদুল্লাপুর থানা আক্রমণ করা। হয়। তখন থানা থেকে কোনাে সশস্ত্র প্রতিরােধ আসে নি। থানাতে থাকা অবাঙালি ও বাঙালি পুলিশদের কয়েকজন মারা যায় এবং অন্যরা পালিয়ে যায়। থানা থেকে ১৯টি ৩০৩ রাইফেল এবং প্রচুর গুলি হস্তগত হয়। সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে আবারও রাতে সাদুল্লাপুর থানা আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়। পূর্বেকার মতাে এবারও থানায় অবস্থানরত অবাঙালি পুলিশদের পক্ষ থেকে কোনাে প্রতিরােধ আসে নি। বরং তারা মুক্তিযােদ্ধাদের উপস্থিতি টের পেয়ে পালিয়ে যায়। এবারও ১৬টি ৩০৩ রাইফেল এবং প্রচুর। গুলি উদ্ধার করা হয়। মুক্তিযােদ্ধারা রেইড শেষে মােল্লার চর হাইড আউটে ফিরে আসতে থাকেন। তখন ভােরের আলাে কেবল ফুটতে শুরু করেছে। মুক্তিযােদ্ধারা যখন বল্লমজাড় গ্রামের মধ্য দিয়ে ফিরছিলেন, তখন শত্রুর অ্যামবুশে পড়ে যান। মুক্তিযােদ্ধারা হঠাৎ ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। অসংগঠিত এমন অবস্থায়ও কিছু মুক্তিযােদ্ধা প্রতিরােধ গড়ে তােলেন। এয়ারম্যান বাদশা ১টি এলএমজি নিয়ে। এবং আনসারের ১জন মুক্তিযােদ্ধা আরেকটি এলএমজি নিয়ে অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শন করে শত্রুর উপর আক্রমণ অব্যাহত রাখেন। অন্যরাও শত্রুর উপর গুলিবর্ষণ চালিয়ে যান। এ প্রতিরােধ শত্রুকে সাময়িক বিভ্রান্তিতে ফেলে। এ সুযােগে মুক্তিযােদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করেন। মুক্তিযােদ্ধাদের পশ্চাদপসরণে গ্রামবাসী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাহায্য করে। এয়ারম্যান ইসলামউদ্দিন, এয়ারম্যান ওমর ও করপােরাল আশরাফ একটি বাড়িতে আশ্রয় নিতে গেলে শত্রুর এলএমজি’র গুলি তাদের উপর পড়ে এবং ৩জনই গুলিবিদ্ধ হন। গ্রামের লােকজন তাদের একটা ঘরের মধ্যে লুকিয়ে রাখে। এ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন ফজলুর রহমান রাজা।
তার দলে প্রায় ১১০জন মুক্তিযােদ্ধা ছিল। ৮জন বিমানসেনা – করপােরাল আবদুস সালাম, করপােরাল। আলী আশরাফ, করপােরাল আবদুল মতিন, করপােরাল আনােয়ার হােসেন, করপােরাল আবদুর রশিদ, এয়ারম্যান ইসলামউদ্দিন, এয়ারম্যান ওমর ফারুক এবং এয়ারম্যান রুহুল আমিন বাদশাও ছিলেন এ দলে। অপ্রস্তুত অবস্থায় আক্রান্ত মুক্তিযােদ্ধারা মারাত্মক বিপদের মধ্যে পড়ে সমূহ ক্ষতির সম্মুখীন হন। এয়ারম্যান ইসলামউদ্দিন ও এয়ারম্যান ওমর ফারুক ঘটনাস্থলেই শহিদ হন। করপােরাল আলী আশরাফ গুলিবিদ্ধ হয়ে আহতাবস্থায় শক্রর হাতে বন্দি হন।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – পঞ্চম খন্ড