You dont have javascript enabled! Please enable it! দারিয়াপুর ব্রিজ ধ্বংস - সিংগড়িয়া রেলসেতু আক্রমণ - রসুলপুরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্যাম্প আক্রমণ - সংগ্রামের নোটবুক
দারিয়াপুর ব্রিজ ধ্বংস
গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ থানার একটি গ্রাম দারিয়াপুর। মুক্তিযুদ্ধকালীন। পাকিস্তানি সৈন্যরা রেললাইনের পাশাপাশি সড়কপথও ব্যবহার করতাে। গাইবান্ধা-সুন্দরগঞ্জ সড়কের উপর দারিয়াপুর ব্রিজটির অবস্থান। সুন্দরগঞ্জ যাওয়ার জন্য এ ব্রিজের উপর দিয়েই পাকিস্তানি সৈন্যরা বেশি যাতায়াত করতাে। কৌশলগত কারণেই ব্রিজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ব্রিজটি রক্ষা করার জন্য শক্র উভয় পাশে পাহারারত ছিল। সমস্ত সুন্দরগঞ্জ থানার জনগণকে রক্ষা করা এবং মুক্তিযােদ্ধাদের নিরাপদ রাখার জন্য মুক্তিযােদ্ধারা এ ব্রিজটি ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেন। সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে মাহবুব এলাহী রঞ্জুর নেতৃত্বে তার কোম্পানি ২ ভাগে বিভক্ত হয়ে ব্রিজের উত্তর প্রান্ত থেকে শক্রর অবস্থানে আক্রমণ করে। রাত ১২টা থেকে ভাের ৩টা পর্যন্ত তুমুল যুদ্ধের পর শত্রু পশ্চিম দিকে পলায়ন করে। ব্রিজটি শত্রুমুক্ত হওয়ার পর ব্রিজটিতে চার্জ লাগিয়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়। মুক্তিযােদ্ধারা ঐ অপারেশন শেষ করে সুন্দরগঞ্জের দিকে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার পথে মাঠেরহাট নামক স্থানে শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হন। উভয়পক্ষে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এতে প্রায় ৭-৮জন মুক্তিযােদ্ধা মারাত্মক আহত হন।
সিংগড়িয়া রেলসেতু আক্রমণ
ভূমিকা পাকিস্তানি সেনাদের নিধন করার উল্লেখযােগ্য একটি অভিযান সিংগড়িয়া ব্রিজ আক্রমণ। সিংগড়িয়া এলাকায় এ অভিযানটি পরিচালিত হয় কোম্পানি অধিনায়ক রুস্তম আলী খন্দকারের নেতৃত্বে। এ যুদ্ধটি এতই সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়েছিল যে এর খ্যাতি ও নৈপুণ্য ঐ অঞ্চলে কিংবদন্তিতে পরিণত হয়। যুদ্ধের স্থান অভিযানটির স্থান ফুলছড়ি রেলওয়ে স্টিমারঘাট ও বােনারপাড়া জংশনের মাঝে ভরতখালী রেল স্টেশনের অনতিদূরে সিংগড়িয়া রেলসেতু এলাকায়। যুদ্ধের সংগঠন।
ক. পাকিস্তান সেনাবাহিনী: ২০জন
খ. মুক্তিবাহিনী: আনুমানিক ১ কোম্পানি। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধাদের নাম – কোম্পানি অধিনায়ক: রুস্তম আলী খন্দকার; কোম্পানি উপ-অধিনায়ক: গৌতম চন্দ্র মােদক; প্লাটুন অধিনায়ক সামসুল আলম, মহসীন আলী মণ্ডল, নাজিমুদ্দীন ও এনামুল; অন্যান্য সমন্বয়কারী: আব্দুল জলিল তােতা, ইকরামুল হক, তছলিম, আলী আনিসার ও বন্দে আলী। যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা সিংগড়িয়া রেলসেতুটি একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বিধায় সেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সার্বক্ষণিক প্রহরার ব্যবস্থা রাখতাে। ২০জনের ১টি রাজাকার দল ভারি অস্ত্রসহ ব্রিজ এলাকায় বাংকারের ভিতর ডিউটি করতাে এবং পাশেই ছিল তাদের বিশ্রাম এলাকা। ঈদুল ফিতরের ২ দিন আগে রুস্তম আলী খন্দকার তাঁর কোম্পানিকে ৪ ভাগে বিভক্ত করে ব্রিজের উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে অবস্থান গ্রহণের নির্দেশ দেন। উপদল ৪টি সামসুল আলম, মহসিন, নাজিমুদ্দীন ও এনামুলের নেতৃত্বে অধিনায়কের নির্দেশিত অবস্থানে লুক্কায়িত অবস্থায় অপেক্ষা করতে থাকে। পরদিন বিকাল ৫টা ১০ মিনিটের সময় ৪টি উপদল একই সাথে শত্রুর অবস্থানের উপর গুলি বর্ষণ শুরু করে। মুক্তিবাহিনীর চতুর্মুখী আক্রমণের ফলে শত্রু দিশাহারা হয়ে একপর্যায়ে বাংকার থেকে পলায়নের চেষ্টা করে।
সে সময় অধিনায়ক রুস্তম আলী খন্দকারের নেতৃত্বে ২টি দল শত্রুর অবস্থানের উপর হামলা করে ২০জনের মধ্যে ১৯জনকে হত্যা করে। শত্রুর বাংকার থেকে মুক্তিযােদ্ধারা প্রচুর অস্ত্র ও গােলাবারুদ জব্দ করেন, যা তাদের পরবর্তী। অভিযানগুলােকে সফল করতে বহুলাংশে সাহায্য করেছিল। এখানে উল্লেখ্য যে, মুক্তিবাহিনীর চূড়ান্ত আক্রমণের সময় সাধারণ গ্রামবাসীও লাঠি, বাঁশ ও দা নিয়ে হানাদার এবং তাদের দোসরদের উপর ঝাপিয়ে পড়েছিল। এ অভিযানের খবর স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়েছিল এবং অত্র এলাকাসহ সারা দেশের মুক্তিপাগল বীর সেনাদের দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করার যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেছিল। সফলতার কারণ সুষ্ঠু পরিকল্পনা। অপারেশনের সার্থকতার মূল চাবিকাঠি ছিল এর বিস্তারিত ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা। কারণ, কোম্পানি অধিনায়ক রুস্তম আলী খন্দকার অভিযানটি চালানাের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর ঐ এলাকাবাসীর কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যাচারের চিত্র তুলে ধরে এহেন অপারেশনের প্রয়ােজনীয়তা ও গুরুত্ব বােঝানাের চেষ্টা করেন।
এবং দীর্ঘ সময় ধরে মুক্তিযােদ্ধাদের অভিযানস্থলের পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলােতে নিরাপদে থাকার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। গােপনীয়তা রাত ও দিন মিলে প্রায় ২০ ঘণ্টা অভিযান এলাকায় আত্মগােপন করে থেকে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা যে ধৈর্য ও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন, তা খুবই উৎসাহব্যঞ্জক। এ দীর্ঘ সময় ধরে গােপনীয়তা রক্ষার জন্যই তাদের অভিযানটি সফল হয়েছিল। জন সমর্থন পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ হানাদার এবং তাদের দোসরদের ধ্বংস করার জন্য মুক্তিযােদ্ধাদের পূর্ণ সমর্থন জুগিয়েছিল। যে কারণে দীর্ঘ সময় অভিযান এলাকায় থাকার পরও শক্ররা মুক্তিবাহিনীর অবস্থান। সম্বন্ধে জানতে পারে নি। উঁচু মনােবল মুক্তিযােদ্ধারা যুদ্ধ করেছিলেন তাঁদের মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার জন্য এবং তাদের দেশের জনগণকে হানাদারদের নিপীড়ন থেকে রেহাই দেওয়ার জন্য। ফলে সংগত কারণ এবং দেশের প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করে তাদের মনােবল ছিল আকাশচুম্বী। আর এ উচু মনােবলের কারণে তারা গােপনীয়তা রক্ষা করে। অপরিসীম ধৈর্যের সাথে অভিযান এলাকায় অপেক্ষমাণ ছিলেন যা তাদের বিজয়কে সহজ করেছে।
উপসংহার
সিংগড়িয়া রেলসেতু আক্রমণটি ছিল রুস্তম বাহিনীর সর্বাপেক্ষা সফল অভিযান। কারণ, এ অভিযানে নিজস্ব বাহিনীর কোনাে ক্ষয়ক্ষতি হয়নি তবে শত্রু পক্ষের ২০জনের মধ্যে ১৯জন মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত হয়। এ যুদ্ধের সফলতার খবর দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রচণ্ড ভীতির সম্মুখীন হয়।
রসুলপুরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্যাম্প আক্রমণ
গাইবান্ধা জেলার সদর থানার রসুলপুরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত স্থায়ী। ক্যাম্প ছিল। রসুলপুরে ছিল একটি সুইস গেট। ব্রহ্মপুত্র নদের তীর ঘেঁষে বাঁধের উপর এ সুইস গেটটিতে শত্রু সর্বদা প্রহরায় থাকতাে। ব্রহ্মপুত্র নদের সমান্তরালে নির্মিত বাধটি কাউনিয়া থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত প্রলম্বিত। বাধটিই ছিল যােগাযােগের বিকল্প রাস্তা। এ জন্যই সামরিক কৌশলগত দিক বিবেচনায় এ ক্যাম্পটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কেননা উত্তরে কামারজানি এবং দক্ষিণে রতনপুর ও ফুলছড়ি ক্যাম্পে তাদের যাতায়াত করতে হতাে এ বাঁধ দিয়েই। অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময় এক রাতে মুক্তিযােদ্ধারা এ ক্যাম্পে আক্রমণ। করেন। প্রায় ৩ ঘণ্টা যুদ্ধ শেষে শত্রু ক্যাম্প ছেড়ে পলায়ন করে। তারপর মুক্তিযােদ্ধারা যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য সুইস গেটটিতে এক্সপ্লোসিভ চার্জ লাগান। কিন্তু গেটটির নির্মাণ ভিত মজবুত থাকায় সম্পূর্ণ ধ্বংস করা সম্ভব হয় নি।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – পঞ্চম খন্ড