ভুরুঙ্গামারী কলেজ রেইড
কুড়িগ্রাম জেলার সর্ব উত্তরে ভারতের আসাম রাজ্যের সীমানায় ভুরুঙ্গামারী অবস্থিত। পাকিস্তান সৈন্যরা ভুরুঙ্গামারী কলেজে শক্ত ঘাঁটি তৈরি করে অবস্থান নেয়। এখানে শত্রুর ১জন মেজরের তত্ত্বাবধানে বেশ কিছু সৈন্য অবস্থান করে। সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে মুক্তিযােদ্ধারা কলেজে পাকিস্তানি ঘাটিতে আক্রমণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। পরিকল্পনা মােতাবেক ৩টি দল প্রস্তুত করা হয়। ২টি রেইড পার্টি নিয়ে কলেজ রেইড করা হবে। অপর দলটি নিয়ে ক্যাপটেন নওয়াজেশ কভারিং ফায়ার দিবেন। পরিকল্পনা মােতাবেক শক্রর এইচএমজি পােস্টে বাংকার প্রতি ২জন এবং পুকুরের উত্তর-পূর্ব কোণায় ২জন ক্রলিং করে গিয়ে একসাথে পর পর ৩টি গ্রেনেড নিক্ষেপ করলে এইচএমজিসহ বাংকারটি উড়ে যায়। এর পরই মুক্তিযােদ্ধারা এলএমজি’র বা ফায়ার করে পূর্ব ও দক্ষিণ দিক থেকে প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ করতে করতে কলেজের মধ্যে প্রবেশ করেন। আকস্মিক আক্রমণে কলেজে অবস্থানরত পাকিস্তানিরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। শক্র গুলি ছুড়ে আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করে, কিন্তু মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণে তারা নিস্তব্ধ হয়ে যায়। এ আক্রমণে ১জন মেজরসহ ১৫-২০জন পাকিস্তানি নিহত এবং ১০১২জন আহত হয়। মুক্তিযােদ্ধারা অতি দ্রুত ফুলকুমার নদ অতিক্রম করে পূর্বনির্ধারিত নিরাপদ জায়গায় ফিরে যেতে সক্ষম হন। মুক্তিযােদ্ধাদের কোনাে ক্ষতি হয় নি।
ভুরুঙ্গামারী-জয়মনিরহাটে আক্রমণ
কুড়িগ্রাম জেলার ভুরুঙ্গামারী থানায় জয়মনিরহাট অবস্থিত। ভুরুঙ্গামারী ও জয়মনিরহাট উভয় স্থানে পাকিস্তানি সৈন্যদের ক্যাম্প ছিল। ১৯৭১ সালের ১৪ অক্টোবর ক্যাপটেন নওয়াজেশ উদ্দিনের কমান্ডে একই সঙ্গে ভুরুঙ্গামারী ও জয়মনিরহাটে মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানি সৈন্যদের ক্যাম্প আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুসারে সুবেদার আবদুল ওহাবকে তার বাহিনী নিয়ে মিত্রবাহিনীর আর্টিলারি সাপাের্টে পাকিস্তানি ঘাটির সম্মুখভাগ সরাসরি চার্জ করতে বলা হয়। হাবিলদার সােনা মিয়াকে ১ প্লাটুনের কিছু বেশি। সৈন্য নিয়ে সম্মুখভাগ ফাইটিং প্যাট্রল পার্টি হিসেবে থাকতে বলা হয়। সুবেদার শামছুল হককে ৭০জন মুক্তিযােদ্ধা দিয়ে সুবেদার ওহাবের পিছনে রিয়ার পার্টি হিসেবে রাখা হয়। জয়মনিরহাট ও রায়গঞ্জের মাঝে সিঅ্যান্ডবি সড়কে ‘কাট অফ পার্টি’ হিসেবে নায়েক আজাহার আলীর নেতৃত্বে ২০জনের ১টি মুক্তিযােদ্ধার দল সিঅ্যান্ডবি সড়কেই রায়গঞ্জ ও নাগেশ্বরীর মধ্যস্থলে ‘কাট অফ পার্টি’ হিসেবে ডিফেন্স নেয়। প্রায় ২০০ মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে সুবেদার মাযহারুল হককে জয়মনিরহাট আক্রমণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। সুবেদার আরব আলীকেও মাযহারুল হকের সাহায্যে রাখা হয়।
পরিকল্পনা মাফিক মুক্তিবাহিনী ১৩ অক্টোবর রাত ১২টার দিকে যথাযথ স্থানে পৌঁছে যায়। ১৪ অক্টোবর রাত ১টার দিকে মুক্তিবাহিনী ভুরুঙ্গামারী ও জয়মনিরহাটে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থানের উপর ব্যাপকভাবে হামলা। চালায়। মিত্রবাহিনী আটিলারির ফায়ার শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিবাহিনী ঝাপিয়ে পড়ে। উভয় পক্ষের তুমুল সংঘর্ষ ১৪ অক্টোবর সকাল ৭টা পর্যন্ত স্থায়ী হয়। উভয় স্থানে পাকিস্তানিরা চরম মার খায়। ভুরুঙ্গামারী ও জয়মনিরহাট মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এর পর শত্রুরা পালিয়ে রায়গঞ্জে পুনরায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তােলে। মেজর নওয়াজেশের সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও যােগ্য পরিচালনায় মুক্তিবাহিনীর এ সাফল্য আসে। মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের পর এ সেক্টরের ৬০০ বর্গমাইল এলাকা মুক্ত বলে ঘােষণা করা হয়। পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছ থেকে প্রচুর অস্ত্র, গােলাবারুদ উদ্ধার ছাড়াও ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ৮জন সৈন্যসহ ১জন আর্টিলারির ক্যাপটেন মুক্তিবাহিনীর হাতে বন্দি হয় ।
নাগেশ্বরী পাবলিক মিটিংয়ে হামলা
কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী থানা সদরে ডাকবাংলাে মাঠ। এ মাঠে স্থানীয় ব্যক্তিদের পাকিস্তানের পক্ষে সংহতি জোরদার করার জন্য এক জনসভার আয়ােজন করা হয়। মুসলিম লীগের নেতা ওদুদ খানের উদ্যোগে এবং সভাপতিত্বে নির্ধারিত সভা অনুষ্ঠানের সব আয়ােজন শেষ হয়। ১৯৭১ সালের ২৩ অক্টোবর প্রায় ১৫০জন লােকের সমাবেশ হয় ডাকবাংলাে মাঠে। যথারীতি সভা আরম্ভ হয়ে যায়। সভার চতুর্দিকে রাজাকারসহ কিছু শত্রু সভার নিরাপত্তায় নিয়ােজিত ছিল। এম এন এ পনির উদ্দিন আহমেদ ও অধ্যক্ষ কামরুদ্দিনের বক্তৃতা প্রদানের পালা। তারা ডাকবাংলােয় বক্তৃতা মঞ্চে যেতে উদ্যত হলে মুক্তিযােদ্ধারা গুলিবর্ষণ শুরু করেন। সভার অদূরেই জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে থাকা মুক্তিযােদ্ধারা জিএফ রাইফেল দিয়ে গ্রেনেড ছুড়ে মারেন। সঙ্গে সঙ্গে সভাস্থ নেতারা পলায়ন করে আত্মরক্ষা করে। মুক্তিযােদ্ধারা আক্রমণ শেষে নিরাপদ স্থানে ফিরে যান। পাকিস্তানিদের ৩-৪জন ঘটনাস্থলেই নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন মারাত্মক আহত হয়।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – পঞ্চম খন্ড