চকেরদিঘির সম্মুখযুদ্ধ
দিনাজপুর জেলার বিরল থানার দক্ষিণে ভারত সীমান্তবর্তী একটি বিরাট দিঘির পাড়ে শক্ত বাংকারে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান ছিল। এ দিঘিটি চকেরদিঘি নামে পরিচিত। ভারত থেকে মুক্তিযােদ্ধারা বাংলাদেশে সহজেই যেন অনুপ্রবেশ না করতে পারে, এ জন্য চকেরদিঘিতে ক্যাম্প করা হয়। সীমান্ত থেকে প্রায় ৫ মাইল ভিতরে ক্যাম্পটির অবস্থান। এখান থেকে তারা টহলের মাধ্যমে মুক্তিযােদ্ধাদের অপারেশন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করত। এ ক্যাম্পের অনতিদূরে দক্ষিণ দিকে দেড়-দুই মাইলের মধ্যে মুক্তিযােদ্ধাদের শক্ত অবস্থান ছিল। ভারতের হামজাপুর থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর আর্টিলারি সাপাের্টের মাধ্যমে প্রায়ই অপারেশন পরিচালনা করা হতাে। ১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর মুক্তিযােদ্ধাদের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট মােহাম্মদ সাইফুল্লাহ ও লেফটেন্যান্ট কায়সার হকের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা চকেরদিঘি শক্রর অবস্থানে আক্রমণের পরিকল্পনা নেন। উদ্দেশ্য ছিল, চকেরদিঘি দখল করতে পারলে কাঞ্চন ব্রিজ হয়ে দিনাজপুর শহরে সহজে প্রবেশের পথ সুগম হবে। | বিকাল ৫টা থেকে ভারতের হামজাপুর ক্যাম্প থেকে ভারতীয় আর্টিলারি শেলিং শুরু করে। শত্ৰু ক্ষুদ্রাস্ত্র দিয়ে তার জবাব দেওয়া আরম্ভ করলে মুক্তিযােদ্ধারা পালটা গুলি বর্ষণ শুরু করেন। সন্ধ্যার পর শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ, প্রায় ২ ঘণ্টা ব্যাপক যুদ্ধ চলে। তবে প্রায় সারারাত কখনাে কখনাে বিরতি দিয়ে পরস্পর গুলি বিনিময় চলতে থাকে। ভােররাতে ক্যাম্প ছেড়ে শক্ররা পলায়ন করতে বাধ্য হয়।
এ যুদ্ধে যারা অংশগ্রহণ করেন তাঁরা হলেন:
১. মােঃ মশিউর রহমান
২. মােঃ আব্দুল লতিফ
৩. মােঃ নজরুল ইসলাম চৌধুরী
৪. মােঃ খলিলুর রহমান
৫. মােঃ আমান উল্লাহ।
৬. শ্রী প্রভাত কুমার রায়
৭. মােঃ নুরুল ইসলাম
৮, মােঃ রমজান আলী।
৯. শ্ৰী নেবেন্দ দাস
১০. মােঃ এনামুল হক
১১. মােঃ আমিনুল ইসলাম ভুলু
১২. মােঃ ফজলুর রহমান।
১৩. মােঃ আব্দুল মােতালেব।
১৪. মােঃ কুদরত আলী
১৫. মােঃ নজরুল ইসলাম।
১৬. শ্রী দরবারু দাস প্রমুখ।
১৭. মােঃ দরমিয়ান আলী
১৮. মােঃ আবদুল গফুর প্রমুখ।
পরবর্তী সময় জানা যায়, ঐ যুদ্ধে ৬জন পাকিস্তানিদের সৈন্য নিহত হয়। এবং বহুসংখ্যক আহত হয়। সমস্ত লাশ নিয়ে শত্রু দিনাজপুর অভিমুখে চলে যায়। সেদিনের যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদেরও কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়। মুক্তিযােদ্ধা মাে. দরমিয়ান আলী ও মাে. আব্দুল গফুর শত্রুর গুলিতে আহত হন। আহতদের ভারতস্থ হামজাপুর ক্যাম্পে প্রাথমিক চিকিৎসার পর রায়গঞ্জ সামরিক হাসপাতালে পরবর্তী চিকিৎসার জন্য পাঠানাে হয়। ১জন সাধারণ ব্যক্তি শহিদ হন।
আমতলী আক্রমণ
দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দর থানার অন্তর্গত আমতলী সিঅ্যান্ডবি মােড়ে আমতলীর অবস্থান এবং এখানে শক্রর একটি শক্ত ঘাঁটি। এ ঘাঁটিটি মােহনপুর ব্রিজ থেকে ব্রহ্মপুর মাদ্রাসা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এটি দিনাজপুর-ফুলবাড়ির মধ্যে সবচেয়ে বড়াে ও শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। মাঝেমধ্যে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা ঐ ঘাটিতে আক্রমণ পরিচালনা করলেও উল্লেখযােগ্য কোনাে সফলতা লাভ করতে পারে নি। মুক্তিবাহিনী, ইপিআর ও মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে যুদ্ধ পরিকল্পনা করা হয়। এ যুদ্ধে মিত্র বাহিনীর ১জন অফিসার নেতৃত্ব প্রদান করার সিদ্ধান্ত হয়। ইপিআর সদস্য মােঃ আবদুল মান্নান ইপিআর-এর স্থানীয় অধিনায়ক হিসেবে নিয়ােজিত হন। এ যুদ্ধে ইপিআর-এর মাে. আবদুল মান্নান, মাে. মােয়াজ্জেম হােসেন ও মজিবুর রহমান অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর মুক্তিবাহিনী, ইপিআর ও মিত্র বাহিনী আমতলী সিঅ্যান্ডবি মােড়ে প্রতিরক্ষায় অবস্থানরত শত্রুর উপর দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ চালায়। উভয় পক্ষে প্রচণ্ড গুলি বিনিময় হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা আক্রমণে টিকতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হয়। তারা পিছু হটে যাওয়ার সময় মােহনপুর ব্রিজ ও আমতলী ব্রিজ ২টির প্রচুর ক্ষতিসাধন করে। এ আক্রমণে মিত্র বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সামান্য হলেও পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। শক্র প্রতিরক্ষা অবস্থানে ২৫-৩০টি মৃতদেহ ফেলে পালিয়ে যায় এবং প্রচুর গােলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিবাহিনীর হস্তগত হয়।
সরস্বতীপুর আক্রমণ
দিনাজপুর জেলায় ফুলবাড়ি থানার অন্তর্গত সাহারা নামক গ্রামের একটি এলাকা সরস্বতীপুর। ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর ইপিআর ও মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত দল দিনাজপুর-ফুলবাড়ি সড়কে চলাচলকারী শত্রুর উপর অ্যামবুশের মাধ্যমে ধ্বংস করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। গােপন সূত্রে খবর পেয়ে মুক্তিবাহিনীর ১টি দল ভারত থেকে বানাহার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। সংবাদ অনুযায়ী কোনাে শত্রুর টার্গেট না পেয়ে মুক্তিবাহিনীর দলটি ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। পথিমধ্যে সাহারা গ্রামে সেলিম উদ্দিনের বাড়িতে মুক্তিবাহিনী অবস্থান করে। মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানের খবর রাজাকারের মাধ্যমে। পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছে পৌছে যায়। কালবিলম্ব না করে রাজাকারের সহায়তায় পাকিস্তানি সৈন্যরা মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানের উদ্দেশ্যে ছুটে আসে। মুক্তিযােদ্ধারা যখন নাস্তা খাচ্ছিলেন সে সময় চারদিক থেকে শত্রু গ্রামটিকে ঘিরে ফেলে। শুরু হয় প্রচণ্ড গােলাগুলি। মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প থেকে মুক্তিযােদ্ধারা হাসলপুর গ্রামে এসে অবস্থান নিয়ে কভারিং ফায়ার প্রদান করেন। এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধা মুকছেদ আলী এবং আবদুল জলিল নেতৃত্ব প্রদান করেন। ১ ঘণ্টা যুদ্ধের পর পাকিস্তানি সৈন্যরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ যুদ্ধে ২জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। মুক্তিবাহিনীর মােজাফফর হােসেন শহিদ হন এবং ড. আমজাদ ও খতার হােসেন আহত হন।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – পঞ্চম খন্ড