You dont have javascript enabled! Please enable it! কোদালকাটির যুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক
কোদালকাটির যুদ্ধ
ভূমিকা
কোদালকাটি এলাকাটি তৎকালীন রংপুর জেলার কুড়িগ্রাম মহকুমার (বর্তমানে জেলা) রৌমারী থানার একটি চর এলাকা। বর্তমানে এলাকাটি কুড়িগ্রাম জেলার চর রাজিবপুর থানার অন্তর্গত। মহকুমা শহর কুড়িগ্রাম থেকে কোদালকাটির দূরত্ব ৪০ কিলােমিটার। কোদালকাটির উত্তর-পশ্চিমে ব্রহ্মপুত্র নদের অপর তীরে চিলমারী বন্দর। এখান থেকে ১০-১২ কিলােমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে ভারতের মেঘালয় রাজ্য। উত্তরবঙ্গের সাথে জলপথে যােগাযােগের একমাত্র মাধ্যম তিস্তা নদী। রংপুর ও লালমনিরহাট জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চিলমারী বন্দরের কাছে ব্ৰহ্মপুত্র নদে এসে মিলিত হয়েছে। দুই নদীর এ মিলন স্থলের ঠিক পূর্ব তীরেই কোদালকাটি গ্রাম।
চর এলাকা কোদালকাটির পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলাের মধ্যে কীর্তিমা চর, পীরের চর, চরসাজাই, চর কুমারিভাঙ্গী, তারাবর, ভেলামাঝি, খারুতাজ, তেররশিপাড়া উল্লেখযােগ্য। পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান রৌমারী থানার অন্তর্গত কোদালকাটি ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর ৩৭ বেলুচ রেজিমেন্টের অপারেশনাল এলাকার আওতাধীন। এ এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়মিত সৈন্য দলের সাথে সংযুক্ত ছিল পাকিস্তান রেঞ্জার্স ও স্থানীয়ভাবে নিযুক্ত রাজাকার বাহিনী। ভারতের মেঘালয় সীমান্ত ঘেঁষা রৌমারী থানা ও রৌমারী বিওপি বরাবরই মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে থাকায় পাকিস্তানি বাহিনী প্রাথমিক অবস্থায় এ এলাকায় কোনাে ঘাঁটি তৈরি করতে পারে নি। শুধু টহল পরিচালনার মাধ্যমেই পাকিস্তানি বাহিনী এ এলাকায় তদারকি করতাে। মুক্তিবাহিনী কর্তৃক বার বার গেরিলা আক্রমণের প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ চিলমারীকে ঘিরে ব্রহ্মপুত্র নদের চরাঞ্চলে তাদের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করার চেষ্টা চালায়। ১৯৭১ সালের ২ আগস্ট ৩৭ বালুচ রেজিমেন্টের ১টি সৈন্যদল গানবােটের সাহায্যে ব্রহ্মপুত্র নদ অতিক্রম করে কোদালকাটি এলাকায় অবস্থান নেয়। পরবর্তী সময় পাকিস্তানি বাহিনী অবস্থান শক্তিশালী করার লক্ষ্যে পার্শ্ববর্তী এলাকা দখলের চেষ্টা চালায়। ২১ সেপ্টেম্বর মুক্তিবাহিনী এ এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের উপর আক্রমণ করে। পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে পরিচালিত এ যুদ্ধ কোদালকাটির যুদ্ধ নামে পরিচিত।
মুক্তিবাহিনীর অবস্থান
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম অবস্থা থেকে রৌমারী এলাকায় মুক্তিবাহিনীর একটি শক্তিশালী অবস্থান গড়ে ওঠে। রেীমারীতে বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় প্রশাসনব্যবস্থা চালু করা হয়। মুক্ত এ এলাকায় স্থাপিত হয় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ছাত্রযুবকদের জন্য প্রশিক্ষণ শিবির। এপ্রিল মাসের শেষ দিকে ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সুবেদার আফতাব হােসেন ১ প্লাটুন সৈনিক নিয়ে (আনুমানিক ৩৩জন) রৌমারীতে ক্যাম্প স্থাপন করেন। প্রাথমিক অবস্থায় সুবেদার আকবর হােসেন তার সৈন্যদল নিয়ে রৌমারী থানা দখল করেন এবং থানার অস্ত্র সহ করেন। এর পর পরই সুবেদার আফতাব হােসেন স্থানীয় যুবক ও ছাত্রদের ১৫ দিনের এক স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনী গঠনের কাজ শুরু করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই রৌমারীতে ২০০-৩০০ মুক্তিযােদ্ধার ১টি বাহিনী। গড়ে ওঠে। মে মাসের প্রথম দিকে মুক্তিবাহিনী রৌমারী এলাকা ছাড়াও চর রাজিবপুর এলাকায় প্রতিরক্ষা অবস্থান সম্প্রসারণ করে। ১৯৭১ সালের ১৫ মে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১ প্লাটুন সৈন্য রৌমারীতে সুবেদার আলতাফের কোম্পানির সাথে যােগ দেওয়ায় মুক্তিবাহিনী আরও শক্তিশালী হয় এবং এ এলাকায় একটি বড়াে। ধরনের ঘাঁটি গড়ে ওঠে। মে মাসের শেষ সময়ে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান ছিল। নিম্নরূপ:
ক. ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১ প্লাটুন সৈন্য।
খ. ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১ প্লাটুন সৈন্য।
গ. ১২জন ইপিআর সদস্য।
ঘ. স্বল্প প্রশিক্ষিত কয়েক’শ মুক্তিযােদ্ধা।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রৌমারীর পার্শ্ববর্তী কামালপুর বিওপি’তে পাকিস্তান। সেনাবাহিনীর একটি শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। ১২ জুন কামালপুর বিওপি’তে পাকিস্তানি ঘাঁটির উপর মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ পরিচালিত হয়। সে সময় থেকে চিলমারীকে ঘিরে ব্রহ্মপুত্র নদের চর এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর টহল ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। পাকিস্তানি বাহিনীর সৈন্যসমাবেশের পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিবাহিনী তাদের অবস্থান জোরদার করে। জুলাই মাসে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান দাঁড়ায় নিম্নরূপ: ক. ক্যাপটেন মােহাম্মদ আনােয়ার হােসেনের নেতৃত্বে ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১ কোম্পানি সৈন্য রৌমারী থেকে ৬ কিলােমিটার দক্ষিণে সােনাভুরী নদীর পূর্ব তীরে যাদুরচর এলাকায় অবস্থান গ্রহণ করে। কোম্পানি সদর দপ্তর ছিল যাদুরচর। সুবেদার মাে. আফতাব হােসেনের নেতৃত্বে ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১ কোম্পানি নিয়মিত সৈন্য এবং ২টি মুক্তিযােদ্ধা কোম্পানি যাদুরচর থেকে ২ কিলােমিটার দক্ষিণে রাজিবপুরে অবস্থান গ্রহণ করে। কোম্পানি সদর দপ্তর ছিল রাজিবপুরে। গ, ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, সাবেক ইপিআর ও ছাত্রদের সমন্বয়ে গঠিত। কোম্পানি রৌমারী এলাকায় অবস্থান গ্রহণ করে। প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা ও কার্যক্রম।
আরিচা ও গােয়ালন্দ থেকে উত্তরাঞ্চলে অবস্থানকারী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য খাদ্য ও রসদ বহনকারী বার্জ ও গানবােট চিলমারীর সন্নিকটস্থ তিস্তা নদীতে কয়েকবার মুক্তিবাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার ফলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গুরুত্ব অনুধাবন করে এ অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি স্থান দখল করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এ সময় এলাকায় পাকিস্তানিসেনার টহলও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। পাকিস্তানি আক্রমণের আশঙ্কার পরিপ্রেক্ষিতেই ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ২ কোম্পানি সৈন্য ও স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধা যে-কোনাে সময় পাকিস্তানি হামলা মােকাবিলায় রৌমারী ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় শত্রু প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করে সদা সতর্কাবস্থা অবলম্বন করে। বিভাজন অনুসারে ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের গ্রুপ অধিনায়ক সুবেদার আফতাব প্রথম ধাপের প্রতিরক্ষা হিসেবে চর কুমারিভাঙ্গী হতে তারাবর এলাকা পর্যন্ত তার সৈন্যদলকে সতর্কতা অবলম্বনের জন্য মােতায়েন করেন। এ সময় ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানি অবস্থান পরিবর্তন করে তেলঢালায় ফিরে গেলে একই রেজিমেন্টের ‘সি’ কোম্পানি লেফটেন্যান্ট আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরীর নেতৃত্বে এ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ ভার গ্রহণ করেন। পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ ১৯৭১ সালের ২ আগস্ট পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বালুচ রেজিমেন্ট সকাল ৬টার দিকে ৫টি গানবােট নিয়ে চিলমারী থেকে সােনাপুর হয়ে নদীপথে রৌমারীর দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। নদীপথ ভিন্ন তাদের পক্ষে রৌমারীতে পৌছানাে সম্ভব ছিল না। পাকিস্তানি বাহিনীর গানবােটগুলাে মুক্তিবাহিনীর তারাবর অবস্থানের কাছে পৌছা মাত্রই মুক্তিবাহিনীর প্রতিরােধের মুখােমুখি হয়।
এমন সময় মুক্তিবাহিনী মর্টার ও এলএমজি দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর উপর প্রচণ্ড গােলা বর্ষণ করে। মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে তারা। অগ্রসর না হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। | তারাবর অবস্থান থেকে সরে আসার পর একই দিনে পাকিস্তানি বাহিনীর সৈন্যদল কোদালকাটিকে মূল অবস্থান ধরে পার্শ্ববর্তী ভেলামাঝি, খারুতাজ, তেররশিপাড়া ও চরসাজাইয়ে সৈন্য সমাবেশ করে। উল্লেখ্য, পাকিস্তানি বাহিনী ২ আগস্ট রৌমারীর যাত্রা পথে সকালে তাদের ২ কোম্পানি সৈন্য কোদালকাটিতে নামিয়ে রেখে যায়। অন্যদিকে, ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপটেন আনােয়ার হােসেনের নেতৃত্বে ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘এ’ কোম্পানি রৌমারী অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান বহাল রাখার উদ্দেশ্যে ৮ আগস্ট কীর্তিমা চরে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এ প্রতিরক্ষা অবস্থান পর্যায়ক্রমে কোদালকাটির পীরের চর ও চরসাজাইতে সম্প্রসারণ করা হয়। ৮ আগস্ট থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এসব এলাকায় বিভিন্ন সময় পাকিস্তানি বাহিনী ‘এ’ কোম্পানির উপর নদীপথে আক্রমণের চেষ্টা চালায়। মুক্তিবাহিনী প্রতিটি আক্রমণ সফলভাবে মােকাবিলা করে।
কোদালকাটি ও পার্শ্ববর্তী এলাকার ভেলামাঝি, খারুজ, তেররশিপাড়া ও চরসাজাই – এ ৪টি এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ লাভে ব্যর্থ হয়ে এলাকার সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচার শুরু করে। খারুতাজ ও তারাবর এলাকায় অসংখ্য নিরীহ বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এ সময় মুক্তিবাহিনীর স্থানীয় অধিনায়কের কাছে ভেলামাঝি, তারাবর এলাকায়। পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়মিত টহল বন্ধের সংবাদে সুবেদার আফতাব হােসেন তার কোম্পানিকে ভেলামাঝি খাল পার হয়ে খালের উত্তর পার্শ্বস্থ ঝাউবনে। পরিখা খনন করে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করার নির্দেশ দেন। ২১ সেপ্টেম্বর প্রত্যুষে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঝাউবনে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান নির্দিষ্ট করে আক্রমণ পরিচালনা করে। এ আক্রমণে পাকিস্তান সেনাবাহিনী মর্টার ব্যবহার করে। ভাের ৪টায় পাকিস্তানি সৈন্যরা মর্টার ফায়ারের আড়ালে ফাকা মাঠ পেরিয়ে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের দিকে অগ্রসর হতে থাকলে মুক্তিবাহিনী ভারি অস্ত্রের মাধ্যমে তাদের উপর মরণপণ আক্রমণ চালায়। এ সময় উভয় পক্ষের মধ্যবর্তী ৩০০ গজ স্থান ছিল ফাঁকা মাঠ। এ ফাঁকা মাঠে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে অধিকাংশ পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয় এবং অবশিষ্টরা ছত্রভঙ্গ হয়ে এদিক-ওদিক পালিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি বাহিনী পশ্চাদপসরণ করে গানবােট নিয়ে পুনরায় চিলমারী ফিরে যায়।
যুদ্ধের ফলাফল
কোদালকাটি অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর অনেক আক্রমণের মধ্যে ২১ সেপটেম্বর কোদালকাটির ঝাউবনে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ ছিল উল্লেখযােগ্য। এ যুদ্ধে অনেক পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। অপর পক্ষে এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর আব্দুস সামাদ ও আলতাফ হােসেন শহিদ হন এবং আব্দুল আজিজ, ইছিম উদ্দিন, রহিম উদ্দিন, গােলাম মােস্তফা, মােহাম্মদ আলী, আব্দুল জব্বার ও বক্তার হােসেন গুরুতর আহত হন। কোদালকাটির এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে এলাকায় তাদের নিয়ন্ত্রণ ভার অক্ষুন্ন। রাখে। কোদালকাটির যুদ্ধের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ কোদালকাটির যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর জয়লাভের প্রধান কারণ হলাে ২৫ মার্চের পর থেকে এ অঞ্চলে ছিল মুক্তিবাহিনীর শক্তিশালী অবস্থান। বিশেষত প্রাথমিক অবস্থা থেকে ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সুবেদার আফতাব হােসেনের এ এলাকায় ঘাঁটি স্থাপন। সাথে সাথে তার দক্ষ নেতৃত্বে ছাত্র-যুবকদের মধ্য থেকে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধা দল গড়ে ওঠে। এ সশস্ত্র প্রতিরােধমূলক অবস্থান এবং স্থানীয় জনগণের সাথে একাত্মতা কোদালকাটি যুদ্ধে জয়লাভের ভিত্তি রচনা করেছিল।
তা ছাড়া এ এলাকায় মুক্তিবাহিনীর কৌশলগত অবস্থান গ্রহণ ছিল। উন্নততর। ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপটেন আনােয়ার হােসেনের নেতৃত্বে ১ কোম্পানি সৈনিকের যাদুরচর এলাকায় অবস্থান ছিল। সুবেদার আফতাব হােসেনের নেতৃত্বে ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১টি প্ল্যাটুন, ২টি এমএফ কোম্পানি রাজিবপুর, চর কুমারিভাঙ্গী থেকে তারাবর পর্যন্ত প্রায় ১ মাইল এলাকায় শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তােলে। সুবেদার আফতাবের কোম্পানি থেকে আরও ১টি দল দক্ষিণ চরসাজাই। থেকে ভেলামাঝি খাল পর্যন্ত অবস্থান নিয়ে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানকে শক্তিশালী করে তুলেছিল। এ সামরিক কৌশলগত অবস্থান মুক্তিবাহিনীর জয়কে নিশ্চিত করেছিল। পরিশেষে বলা যায়, কোদালকাটি যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের প্রধান কারণ ছিল এলাকাটির ভৌগােলিক অবস্থান। রৌমারী, যাদুরচর, কোদালকাটি ও রাজিবপুর অঞ্চল বিশাল ব্ৰহ্মপুত্র নদ দ্বারা পাকিস্তানি বাহিনীর। আঞ্চলিক অবস্থান চিলমারী থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। এ পুরাে অঞ্চলটি ভারতের মেঘালয় সীমান্ত ঘেঁষা। পাকিস্তানি বাহিনী ২৫ মার্চের পর থেকে এ অঞ্চলে কোনাে সময় শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে পারে নি। নদী ও চর নিয়ে গঠিত এ অঞ্চলের জনগণ তাদেরকে কোনােপ্রকার সহযােগিতা করে নি। তা ছাড়া যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর সূক্ষ্ম পরিকল্পনার অভাব ছিল।
সামগ্রিক মূল্যায়ন
রৌমারী মুক্তাঞ্চলকে নিরাপদ রাখা, ব্রহ্মপুত্র নদ অববাহিকার বিস্তৃত চরাঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান শক্তিশালী করা, মুক্তিযােদ্ধাদের দেশের অভ্যন্তরে যাতায়াতের পথকে মুক্ত রাখা এবং চিলমারী পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের উপর নিয়মিত চাপ সৃষ্টির বিষয়াদী বিবেচনায় কোদালকাটির যুদ্ধ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ বলে বিবেচিত।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – পঞ্চম খন্ড