ঠাকুরগাঁও আক্রমণ
দিনাজপুর জেলার পশ্চিমে এবং পঞ্চগড় জেলার দক্ষিণে সীমান্তবর্তী জেলা ঠাকুরগাঁও। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ক্যাপটেন শাহরিয়ার রশিদের নেতৃত্বে সম্মিলিত বাহিনী ঠাকুরগাঁওয়ের দিকে অগ্রসর হয়। এ সময় পাকিস্তানি সৈন্যরা ঠাকুরগাঁও ত্যাগ করে। ঠাকুরগাঁও এলাকায় শত্রুর সাথে মুক্তিযােদ্ধাদের কোনাে সংঘর্ষ হয়নি। ঐ দিনই মুক্তিযােদ্ধারা ঠাকুরগাঁও দখল করে ঠাকুরগাঁও থেকে আরও ৩ মাইল সমুখে অগ্রসর হয়। ৪ ডিসেম্বর মুক্তিযােদ্ধারা বটতলী নামক স্থানে ডিফেন্স নেন। ৫ ডিসেম্বর সারাদিন শত্রুর পুঁতে রাখা মাইন অপসারণ করা হয়। ৬ ডিসেম্বর মুক্তিযােদ্ধারা বীরগঞ্জ আক্রমণ করেন এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধ চলে। শেষে শক্ররা বীরগঞ্জ ছেড়ে পিছনে হটে। এখানে ভারতীয় বাহিনীর ১০-১২জন সৈন্য শহিদ হন। ৭ ডিসেম্বর সম্মিলিত বাহিনী ভাতগাঁও ব্রিজের দিকে রওনা হয়। পাকিস্তান বাহিনী ভাতগাঁও ব্রিজ ধ্বংস করে রাস্তার দুই পাশে মাইন পুঁতে রেখে পশ্চাদপসরণ করে। মুক্তিযোেদ্ধারা তখন ভাতগাঁও ব্রিজের চারপাশ থেকে মাইন অপসারণ শুরু করেন।
মােহনপুর ব্রিজ ধ্বংস
দিনাজপুর জেলার সদর থানার অন্তর্গত দশ মাইলের পথে মােহনপুর ব্রিজ অবস্থিত। ২৫ মার্চের কালরাত্রীতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরােচিতাে। আক্রমণ শুরু হলে শত্রু যাতে দিনাজপুরে প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য সম্মিলিতভাবে ইপিআর ও ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট দশমাইল এবং মােহনপুর ব্রিজে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়। মােহনপুর ব্রিজের পশ্চিম অংশের উত্তরে ইপিআর এবং দক্ষিণে ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১টি কোম্পানি প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। সৈয়দপুর বা পার্বতীপুর থেকে যেন কোনাে পাকিস্তানি সৈন্য দিনাজপুর শহরে প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য মােহনপুর ব্রিজটিকে ধ্বংস করে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। | ১৯৭১ সালের ২৮ মে পরিকল্পনা অনুযায়ী কয়েক ঘণ্টা প্রচেষ্টার পর বিস্ফোরকের সাহায্যে ব্রিজটি ধ্বংস করা হয়। ১৩ এপ্রিল এ এলাকায় পাকিস্তানি। সৈন্যরা এসে পড়লে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মােহনপুর ব্রিজ যুদ্ধে ৮ নম্বর ইপিআর উইং এবং ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১টি কোম্পানির সমন্বয়ে গঠিত মুক্তিবাহিনী এযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এ যুদ্ধে আ ল ম ফজলুর রহমান নেতৃত্ব প্রদান করেন। তার সাথে ইপিআর-এর সুবেদার শহিদুল ইসলাম স্থানীয় অধিনায়ক হিসেবে যুদ্ধ। পরিচালনা করেন। ব্রিজটি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ইপিআর এবং ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিরক্ষা অবস্থানের উপর শক্র একযােগে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়।
এ আক্রমণে ইপিআর-এর অধিনায়ক সুবেদার শহিদুল ইসলাম ও মহীর উদ্দিন সরকার শাহাদতবরণ করেন এবং ইপিআর ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে ইপিআর এবং ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানিটি সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করে এবং কাটলা নামক স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে। পরবর্তী সময় কাটলা থেকে বেশ কয়েকটি অপারেশন পরিচালনা করা হয়।ঠনঠনিয়া পাড়া আক্রমণ দিনাজপুর জেলার সদর থানার ঠনঠনিয়া পাড়া একটি সীমান্তবর্তী গ্রাম। ভারত সীমান্ত থেকে ৩০০ গজের মতাে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এ ঠনঠনিয়া পাড়ায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১টি কোম্পানি ছিল। মুক্তিযােদ্ধাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা এবং স্থানীয় লােকদের উপর অত্যাচার করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। মুক্তিযােদ্ধারা তাদের নিজস্ব চলাফেরা অবাধ করতে এবং স্থানীয় জনগণকে পাকিস্তানি শক্রর অত্যাচার থেকে রক্ষা করার জন্য শক্রর অবস্থানে আক্রমণের পরিকল্পনা করেন।
১৯৭১ সালের ১৭ জুন রাতে মেজর নাজমুল হক ১টি কোম্পানি নিয়ে গন্ত ব্যস্থলের দিকে রওনা হন। কোম্পানিটি ২টি কলামে বিভক্ত হয়ে ১টি সম্মুখভাগ আক্রমণের জন্য মেজর নাজমুল হকের নেতৃত্বে এবং অপরটি সুবেদার মেজর এ রবের নেতৃত্বে বিরল-ঠনঠনিয়া সড়কের ১৫০ গজের মতাে বামে ‘কাট অফ পাটি’ হিসেবে ডিফেন্স নেয়। সিদ্ধান্ত হয়, মিত্র বাহিনীর ১১ গাের্খা রেজিমেন্ট শত্রুর অবস্থানের উপর কিছুক্ষণ মর্টার শেলিং করবে। শেলিং শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেজর নাজমুল হক শক্রর ঘাটি সরাসরি চার্জ করবেন। সুবেদার মেজর রব তার কলাম নিয়ে দিনাজপুর থেকে সাহায্যকারী পাকিস্তানি সেনাদের তার অবস্থান থেকে বাধা দেবেন এবং প্রয়ােজনে ঠনঠনিয়া পাড়া থেকে পালানাের চেষ্টা করলে তাদেরও অ্যামবুশ করবেন। ১৭-১৮ জুন রাতে পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মুক্তিবাহিনী মেজর নাজমুল হকের নেতৃত্বে স্ব স্ব অবস্থানে পৌছে যায়। রাত ১১টার দিকে মিত্র বাহিনীর ১১ গাের্খা রেজিমেন্ট শক্রর অবস্থানের উপর শেলিং শুরু করে। প্রায় ২ ঘণ্টা উভয় পক্ষে শেলিং অব্যাহত থাকে। শেলিং বন্ধ। হওয়ার পর পরই মেজর নাজমুল হক তার বাহিনী নিয়ে শত্রুর ঘাঁটির উপর আক্রমণ করেন। ৩০ মিনিটের ভয়াবহ সম্মুখযুদ্ধে ১৫জন শত্রু সৈন্য নিহত এবং আহত হয়। ২০জন। পাকিস্তানি সৈন্যরা চরমভাবে মার খেয়ে অবস্থান ছেড়ে পিছনে সরে যেতে বাধ্য হয়। অন্যদিকে, মুক্তিবাহিনীর ১জন শহিদ এবং ২জন আহত হন।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – পঞ্চম খন্ড