You dont have javascript enabled! Please enable it! পিটার কাস্টার্স-এর সাক্ষাৎকার | গণবাহিনী - সংগ্রামের নোটবুক

পিটার কাস্টার্স-এর সাক্ষাৎকার ৬৭৬

‘গণবাহিনী গঠনে কেন্দ্রীয় যারা অনুমােদন দিয়েছে এবং বাস্তবে এটা

যারা পরিচালনা করতেন- উভয়ের সকল চিন্তা ও পরিকল্পনা এক

রকম ছিল এমন বলা যাবে না’

বাংলাদেশ আপনাকে এক রাজনৈতিক চরিত্র হিসেবেই জানে। কিন্তু আপনার জীবনের শুরুটা সম্পর্কে তেমন জানি না আমরা-

হল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলে গ্রামীণ পরিবেশে ১৯৪৯-এ আমার জন্য। আমার বাবা সেখানে একটি ছােট শহরের মেয়র ছিলেন। তিনি খ্রিস্টান ডেমােক্রেট পার্টির সঙ্গে ছিলেন। রক্ষণশীল পরিবেশে একটি বুর্জোয়া পরিবারে আমার শৈশব-কৈশাের কেটেছে। কিছুটা ইচ্ছা করেই কৈশােরের পরিবেশ থেকে দূরে গিয়ে ১৯৬৭ সালে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। প্রথমে মিউজিক নিয়ে উচ্চতর লেখাপড়া শুরু করেছিলাম। পিয়ানাে, গিটার, অর্কেস্ট্রা এসবে আকর্ষণ ছিল । ছয় মাস পরই অবশ্য আমি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করি। বাবা-মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করে এরপর আমি লেখাপড়া শুরু করি আন্তর্জাতিক আইন, আন্তর্জাতিক অর্থনীতি, রুশ ভাষা ইত্যাদি নিয়ে। এসময়টি একারণেও উল্লেখ করার মতাে যে, তখনি শুরু হয়েছে ইয়ােরােপ-আমেরিকায় যুদ্ধ বিরােধী লাগাতার বিপ্লবী বিক্ষোভ। হল্যান্ডেও সেই ঢেউ আঘাত হেনেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ গণতন্ত্রায়নের দাবিতে সেখানেও বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এসবই আমাকে প্রভাবিত করছিল। পুরােপুরি মার্কসবাদী না হয়ে গেলেও প্রগতিশীল চিন্তা আমাকে গ্রাস করে ফেলেছিল ততদিনে। ১৯৭০-এর সেপ্টেম্বরে উচ্চতর পড়াশােনার জন্য আমি যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসি।

বাংলাদেশের সঙ্গে জড়ালেন কীভাবে আপনি?

এর পেছনে সূত্র হিসেবে কাজ করেছে এ দেশের মুক্তিযুদ্ধ। ঐ সময় আমি যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ইনস্টিটিউটে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে পিএইচডি করছিলাম। আমার একাডেমিক মনােযােগের ক্ষেত্র ছিল এশিয়ার দেশগুলাে বিশেষত চীন ও ভারত। প্রলেতারীয় সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পর চীনের বৈদেশিক নীতি বিষয়ে আমাকে বিশেষ মনােযােগ দিতে হয় থিসিসের প্রয়ােজনে। পাশাপাশি এসময় আমি এমন একদল বন্ধুকে পেলাম, যাদের অনেকে ছিল জার্মান- তারা বিশ্বের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবর্তন নিয়ে গভীরভাবে ভাবনা চিন্তা করতেন। ওরা ছিল অনেক উদার ও অগ্রসর। ওদের সঙ্গে আমি তখন হাে চি মিন, চে গুয়েভারা এদের নিয়েও পড়ছি। মার্কসবাদী অর্থনীতি নিয়ে গভীর অধ্যয়নও এসময়ই। ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে শত শত প্রতিবাদ সমাবেশ হচ্ছিল এসময়। কিউবার বিপ্লব নিয়ে শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদেরও সমাবেশ

……………………………………………………….

৬৭৬) ২০১৩ সালের বিভিন্ন সময় অন্তত তিন দফায় এই সাক্ষাৎকারটি গৃহীত হয়।

Page 532

হচ্ছিলাে। এভাবে কার্যত আমি দু ধরনের শিক্ষা কাঠামাের মধ্যে তখন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি চীন-ভারতকে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে পড়ছি বিশ্বের বিপ্লবী সাহিত্য। এসময়ই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু। এর স্বপক্ষে সেখানে যেসব সংহতি কার্যক্রম শুরু হয় তাতে যােগ দিতাম। আমার সংহতির প্রাথমিক কারণ ছিল মানবিক। পাকিস্তানিদের গণহত্যায় আমার ভেতরে ঐ মানবিক প্রতিক্রিয়া ঘটে। এ ছাড়া হল্যান্ডে থাকতেই বাংলাদেশে তখনকার ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের বিষয়ে জেনেছিলাম। ইতােমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনেক বাঙালি শিক্ষার্থী ও বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়ে যায়। ওদের থেকে বাংলাদেশ সম্পর্কে আরও কিছু জানলাম। রেহমান সােবহানের সঙ্গে তখনই আমার পরিচয়। এ রকম আরও অনেকের কাছ থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে আমার আগ্রহ মেটানাের সুযােগ ঘটে। প্রায় আড়াই বছরের মধ্যে আমি পিএইচডি’র কাজও শেষ করে এনেছিলাম। ১৯৭১-এর ডিসেম্বরে ভারতীয় সৈন্যরা যখন পূর্ববাংলায় ঢুকে পড়ে আমি তখন নিউ ইয়র্কে। সােজা জাতিসংঘে চলে গেলাম। বাংলাদেশ বিষয়ে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলাের অবস্থা সরাসরি জানতে আগ্রহী ছিলাম আমি।

পূর্ববাংলা স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পর আমার বাঙালি বন্ধুরা তখন দেশে ফিরতে শুরু করেছে। ভারতীয় হস্তক্ষেপে দেখলাম বামপন্থীরা উদ্বিগ্ন। ততদিনে বাংলাদেশের বামদের বিষয়ে আমার একধরনের সহানুভূতি তৈরি হয়ে গেছে। ওদের কাছে জানালাম- আমি বাংলাদেশে যাবাে। ওরা উৎসাহ দিল । একজন তার বাড়িতে থাকার নিমন্ত্রণও দিয়ে রাখলাে।

১৯৭৩-এর জানুয়ারিতে, ৭ কিংবা ৮ তারিখে আমি বাংলাদেশে আসি। এই প্রথম এশিয়ার একটা দেশে আসা। ওয়াশিংটন থেকে দিল্লি। তারপর সড়ক পথে কলকাতা-বেনাপােল হয়ে ঢাকা। স্বাধীনতাপ্রাপ্ত নতুন দেশটির অনেক গ্রাম ও নগরে ঘুরেছি আমি ঐ সফরে। এসময়ই আমার মনে হয়েছে-এখানে শােষিত শ্রেণীসমূহের বিপ্লবী সংগ্রামের জরুরি প্রয়ােজন এবং তার সম্ভাবনাও দেখেছিলাম আমি। চে গুয়েভারার আন্তর্জাতিকতাবাদও এসময় আমাকে প্রভাবিত করে থাকবে। তিন মাসের সেই সফরের মধ্য দিয়ে আমার মাঝে এখানকার বিপ্লবী সংগ্রামে অবদান রাখার অপ্রতিরােধ্য দৃঢ়তা তৈরি হয়ে যায়। বলা যায়, শারীরিক, মানসিক, সাংস্কৃতিক অনেক ধরনের পরিবর্তনই ঘটে গেল আমার মাঝে ঐ সফরের মধ্য দিয়ে। প্রায় পুরাে দেশ ঘুরলাম। ইতােমধ্যে গরমকাল চলে এল। আপাতত সফর সমাপ্ত করে এপ্রিলে হল্যান্ডে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম ।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে নিশ্চয়ই প্রধান মনােযােগ ছিল আপনার? কী

দেখতে পেলেন?

আমার জন্য এটা ছিল পুরােপুরি এক ভিন্ন সংস্কৃতির জনপদ। বাংলাদেশে তখন প্রচুর রাজনৈতিক ঘটনা ঘটছিল। আমি সবার সঙ্গেই দেখা করছিলাম। বিশেষ করে বামপন্থী সবার সঙ্গে। তখন নির্বাচন হচ্ছিল এ দেশে। দেখছিলাম সরকারের প্রতি জনসমর্থন পাল্টে যাচেছ। নানামুখী সফর ও সাক্ষাৎ থেকে লেখালেখির প্রচুর রসদও পেলাম আমি। ইতােমধ্যে বলেছি, এপ্রিলে শেষ হয়েছিল আমার প্রথম সফর। আমি এই আস্থা। পেয়েছিলাম যে, বাংলাদেশে কাজ শুরু করতে পারবাে আমি। বাস্তবে প্লেনে বসেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বাংলাদেশেই কাজ করবাে আমি এবং সেটা হবে রাজনৈতিক

Page 533

পরিবর্তনের জন্য কাজ। ১৯৭৩-এর জুলাইয়ে ওয়াশিংটনের পাঠ চুকিয়ে দিলাম। হল্যান্ড গেলাম তারপর। বাংলাদেশের ওপর লেখালেখির মধ্য দিয়ে ইতােমধ্যে সেখানে সাংবাদিক হিসেবে আমার পরিচয় দাঁড়িয়ে গেল। আরও কাজের তাগিদও আসছিল। ঐ বছরই সেপ্টেম্বরে আবার বাংলাদেশে এলাম। ততদিনে চে’র জীবন আমাকে গভীরভাবে আছন্ন করে ফেলেছে। দক্ষিণ আমেরিকায় এবং বিশ্ব বিপ্লবী আন্দোলনে তার ভূমিকা ও অবদান; তার পদ্ধতি- আমার সিদ্ধান্ত গ্রহণকে প্রভাবিত করছিল। চে’র বিপ্লবী আন্তর্জাতিকতাবাদই আমার মাঝে মূল অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল।

আপনি তাে রাজনৈতিক কাজের জন্যই বাংলাদেশকে বেছে নিয়েছিলেন? সাংবাদিক পরিচয় কেন?

রাজনীতির জন্যই সাংবাদিকতাকে একটা কাভারেজ হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম। রাজনৈতিক কাজের জন্য নিশ্চয়ই প্রকাশ্যে আমি অনুমােদন পেতাম না। তাছাড়া বাংলাদেশে প্রচুর সামাজিক তদন্ত প্রয়ােজন ছিল আমার। এখানকার সমাজ বিন্যাস, শ্রেণী বিন্যাস ইত্যাদি বােঝার ক্ষেত্রেও সাংবাদিক পরিচয় প্রয়ােজন ছিল। সাংবাদিক হিসেবে একটা ছদ্মনামও নিয়েছিলাম। ঐ নামেই আমি হল্যান্ডের কাগজগুলােতে লিখতাম। বাংলাদেশে এসময় প্রচুর বিদেশি সাংবাদিক আসত। যেহেতু আমি প্রথম থেকে এখানে ব্যাপক সফরের মাধ্যমে অনেককিছু জানতাম সে কারণে বিদেশি সাংবাদিকরাও শুরুতে আমার কাছে আসত প্রাথমিক ধারণার জন্য। এখানকার গ্রামীণ শ্রেণী কাঠামােটি ততদিনে আমি বুঝে নিয়েছিলাম ।

দ্বিতীয় দফায় আপনি কতদিন ছিলেন এখানে? মূলত কী করেছেন তখন?

প্রায় এক বছর ছিলাম। এ দফায় এখানকার সমাজ বিশ্লেষণের জন্য আমাকে তথ্য সংগ্রহ করতে হয়েছে। পল্লি এলাকায় ব্যাপক সফর করি আমি। গ্রামীণ শ্রেণী-সম্পর্কের ওপর তুলনামূলক গবেষণা করেছিলাম আমি। যেগুলাের সঙ্গে একাডেমিক জগতের তথ্য-উপাত্ত মিলিয়ে দেখতে হয়েছে এবং যা আমাকে এখানকার শ্ৰেণী-সম্পর্ক বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌছতে সহায়তা করেছে। আমার মূল রাজনৈতিক দলিল তৈরির জন্য কাজ করতে হয়েছে এসময়। চুয়াত্তরের মাঝামাঝি এ বিষয়ে লেখা শুরু করেছিলাম আমি। তারপর বিভিন্ন পার্টির সঙ্গে কথা বলছিলাম। ওদের দলিলগুলাে সংগ্রহ করেছি। জাসদ, হারা পার্টি, অন্যান্য মাওবাদী পার্টির দলিল দেখেছি।

সিপিবি?

ওদেরটাও দেখেছি। তবে ওদের আমার প্রথম থেকে অপ্রয়ােজনীয় মনে হয়েছে।

মাওবাদীদের অবস্থানই সঠিক মনে হচ্ছিল আপনার কাছে?

ওরা অনেকে লড়ছিল। বিশেষত সর্বহারা পার্টি। কিন্তু তাদের অনেকের মাঝে অতিমাত্রায় অস্ত্রবাদিতা দেখেছি। মাওবাদী রণনীতি ও রণকৌশল নিয়ে গভীর প্রশ্ন ছিল আমার। বাংলাদেশের ভৌগােলিক ও ঐতিহাসিক বিশেষত্ব তাদের কাছে যথাযথ মনােযােগ পাচ্ছিলাে না। গণভিত্তি ছাড়াই জনযুদ্ধ করার চেষ্টা ছিল।

Page 534

জাতীয় রাজনীতির চেহারাটা তখন কেমন ছিল?

এসময় উদীয়মান বুর্জোয়ারা দেশটি শাসন করছিল । তাদের একধরনের প্রগতিশীল ভঙ্গি ছিল। কিন্তু ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে এরা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করছিল। তাছাড়া সরকার সমাজতন্ত্রের কথা বললেও- ঐসময়ের গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামাে রয়ে গিয়েছিল একেবারে স্বাধীনতার পূর্বের আদলে। জোতদাররাই ছিল প্রধান শ্রেণী। বাংলাদেশের সমাজ কাঠামাে ও ক্ষমতা কাঠামাে মাও সেতুঙয়ের সময়কার চীনের মতােই ছিল। বিশেষত পল্লি এলাকায়। এখানকার সমাজ বিশ্লেষণে মাওয়ের পর্যবেক্ষণগুলােই সঠিক মনে হচ্ছিল। তবে বাড়তি একটা ব্যাপার ছিল- উদীয়মান একদল বুর্জোয়ার উত্থান। যারা নানান ধরনের ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে সম্পদ সংগ্রহ করে যাচ্ছিল। স্বাধীনতার পর শ্ৰেণী বৈরিতা কমার বদলে আরও বাড়ছিল- সেটাও আমার চোখে পড়ে। বিশেষ করে গরিব চাষিদের সংখ্যা বাড়ছিল। তবে মুক্তির আকাক্তা ছিল প্রবল। রাজনৈতিক দায়িত্ব ছিল একে ধারণ করা।

বাংলাদেশ সফরের একেবারে শুরুর সময়ের কোনাে ইন্টারেস্টিং ঘটনা কি আপনার মনে পড়ে?

ভাসানীর সঙ্গে সাক্ষাৎকার। তিয়াত্তরের সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয়বার বাংলাদেশে আসার পরই আমি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলাম কাগমারী গিয়ে। তিনি এই বিদেশি সাংবাদিককে ১৫ মিনিট সময় দিলেন। কিন্তু পুরাে সময়টা কথা বললেন বামপন্থী মত ও পথ নিয়ে। আমি জানি না কেন তিনি এটা করেছিলেন। সেখানে মেনন ও অন্যান্য ন্যাপ নেতাদেরও দেখেছি।

কিন্তু জাসদকে কেন আপনি বেছে নিলেন বিপ্লবী সংগ্রামের মঞ্চ হিসেবে এখানে তাে আরও অনেক বামপন্থী দল ছিল তখন? একই প্রসঙ্গে জানতে চাইছি, জাসদের সঙ্গে আপনার সম্পর্কের ধরনটি কীরূপ ছিল?

এখনও অনেকে, বিশেষত বাংলাদেশের বামপন্থী আন্দোলনের অনেকে ভাবেন, ১৯৭৪-৭৫ সময়ে জাসদ নেতৃত্বের সঙ্গে আমার বােধহয় অনেক নিবিড় যােগাযােগ ছিল। আসলে বাংলাদেশে আমার মতাে করে কাজ শুরুর আগে আমি নেদারল্যান্ডের অনেক গণমাধ্যম থেকে নতুন দেশটিতে সাংবাদিক হিসেবে কাজের অনেক এসাইনমেন্ট পেয়েছিলাম। করছিলামও সেগুলাে। ফলে সকলের সঙ্গেই দেখা হতাে আমার। জাসদের অনেক নেতার সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছি; নানান বিষয়ে আলােচনা করেছি।

রব ও জলিলের সঙ্গে ১৯৭৩-এর ফেব্রুয়ারিতে প্রথম সফরের সময়ই দেখা হয়েছিল। ঐ দলের অন্যদের সঙ্গে প্রথমবার কোনাে যােগাযােগ ঘটেনি। বৈধ দল হিসেবে তাদের সঙ্গে যােগাযােগ করা সহজই ছিল। তবে জাসদের সঙ্গে আমার সম্পর্কের ধরনটি সম্পর্কে কিছু বিভ্রান্তি আছে। আসলে কাজ শুরুর প্রথম বছরেই আমি নিজের মতাে করে দেশটির আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে এখানকার জন্য উপযােগী একটি বিপ্লবী রণকৌশল বিকশিত করার তাগিদ বােধ করছিলাম । সে বিষয়ে আগেই বলেছি।

এসময় বাংলাদেশের মার্কসবাদী-লেনিনবাদী অনেক গােপন বামপন্থী দল রণকৌশল হিসেবে চীনা ধাঁচের গেরিলা যুদ্ধের পথ অনুসরণ করছিল। কিন্তু আমি মনে করতাম এবং

Page 535

এখনও করি, এরূপ প্রায় সমতল একটি ভূ-ভাগের জন্য ঐ কৌশল উপযােগী নয়। আমার বিবেচনায় বাংলাদেশের বিপ্লবী সফলতার সবচেয়ে সম্ভাবনাময় পথ হলাে গণঅভ্যুত্থান। এরূপ কৌশলের প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে ঐ সময় আমি দলিলও তৈরি করেছিলাম। সামরিক নীতি-কৌশল সম্পর্কিত এইরূপ একটি দলিল ছিল “battle hunger or armed dedication. ঐসময় আমি জাসদের রাজনীতি সম্পর্কে সমালােচনামূলক পর্যালােচনাও দাঁড় করিয়েছিলাম। তিয়াত্তর-চুয়াত্তরে তারা যেভাবে শহরকেন্দ্রিক শক্তি সমাবেশের কৌশল নিয়েছিল আমি তার বিপদ সম্পকে বিস্তারিত লিখেছিলাম।

ঐ সময় প্রকাশিত জাসদের খসড়া থিসিসে দলটি বাংলাদেশে বিপ্লবের স্তর নির্ধারণ করেছিল ‘সমাজতান্ত্রিক। তার সমালােচনা করে আমি লিখেছিলাম, এখানে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য কাজ করতে হবে। অর্থাৎ বিপ্লবের স্তর নিয়ে ওদের সঙ্গে একমত ছিলাম না আমি। বিপ্লবের স্তর সমাজতান্ত্রিক বলা মানে এখানে যে মধ্যবর্তী শ্ৰেণীগুলাে ছিল তাদের ভূমিকাকে অগ্রাহ্য করা। এই ভাবনাটিই পরে ‘সর্বহারা ঐক্যের ইশতেহার’ নামে একটি দলিলে বিস্তারিতভাবে প্রকাশিত হয় এবং তার ভিত্তিতেই আমি এবং আমার কমরেডদের সম্পৃক্তিতে পঁচাত্তর নাগাদ বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক কাজ শুরু হয়।

তবে এও স্বীকার করতে হবে, জাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির গােপন সদস্য কর্নেল আবু তাহেরের সঙ্গে আমার একটি বিশেষ সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব ছিল। নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশে আমি তখন আমার ভাবনার মিত্র খুঁজছিলাম। বাংলাদেশের জন্য উপযােগী বিপ্লবী রণকৌশল নিয়ে আমাদের মাঝে অনেক আলােচনা হতাে। আমাদের বন্ধুতুটি বিকশিত হয়েছিল কারণ এখানে বিপ্লবের পথ যে বিপ্লবী অভ্যুত্থান বা গণ-অভ্যুত্থানমূলক- সে বিষয়ে আমাদের ভাবনায় মিল ছিল। তবে দীর্ঘ আলাপ শেষে বুঝেছিলাম গণ-অভ্যুত্থান। বলতে তাহের ও আমি যা ভাবছি তা অভিন্ন নয়। সৈনিকদের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের আগে কৃষক সমাজে সংগঠন ও রাজনীতির ক্ষেত্রে কতটা মনােযােগ ও শক্তি ব্যয় করা উচিত এ নিয়ে আমাদের চিন্তায় স্পষ্ট ভিন্নতা ছিল।

তখনকার বামপন্থী চিন্তাবিদ বদরুদ্দীন উমর-এর সঙ্গেও আপনার সম্পর্ক ছিল বলে জানা যায়?

বদরুদ্দীন উমরের সঙ্গে ঐরূপ সম্পর্ক বিকশিত হওয়ার কোনাে উপলক্ষ তৈরি হয়নি। বাংলাদেশে রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরুর মুহূর্ত থেকে তাকে আমি উচ্চমূল্য দিতাম। বাংলাদেশের রাজনীতি ও সংস্কৃতি নিয়ে তার লেখাগুলাে দেশটি সম্পর্কে আমার ধারণা লাভে প্রাথমিকভাবে সাহায্য করে। কিন্তু ১৯৭৪ সালে সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকায় উমর এক প্রবন্ধে লেখেন, যেহেতু আপাতত এখানে কোনাে বিপ্লবী পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই সে কারণে বামপন্থীদের উচিত এখানকার শাসক শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ‘সৎ পুঁজিপতিদের সাহায্য করা। বিষয়টি আমাকে বিমূঢ় করে তােলে এবং তার একটি প্রতিক্রিয়া লিখি আমি একই কাগজে ১৯৭৪ সালের ১৪ জুলাই। তখন থেকে আমি ভাবতাম তার দৃষ্টিভঙ্গি এখানকার বামপন্থীদের প্রকৃত শত্রু থেকে প্রয়ােজনীয় নজর সরিয়ে নেবে। ঐ লেখার পর থেকে বদরুদ্দীন উমর আমাকে বিদেশী চর’ হিসেবে চিহ্নিত করতে শুরু করেন।

Page 536

আবু তাহেরের সঙ্গে সুনির্দিষ্টভাবে আপনার যােগসূত্র তৈরি হয় কখন এবং কীভাবে?

পঁচাত্তরের সৈনিক অভ্যুত্থানের নেতা শহীদ আবু তাহেরের সঙ্গে যােগাযােগ ঘটে ১৯৭৪ সালে। তিনি অসুস্থ হয়ে কোনাে এক সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সেখানেই আমাদের দেখা হয়। সেনাবাহিনীকে উৎপাদনমুখী শক্তিকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তােলার বিষয়ে তাঁর ভাবধারার কথা আগেই শুনেছিলাম। চুয়াত্তরের মাঝামাঝি দেখা হয়। তাঁর নিজস্ব কিছু দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। প্রথম সাক্ষা্তকারেই তাকে আমার প্রকৃত এক বিপ্লবী মনে হয়েছে। সে আসলে বুলিবাগিশ ছিল না। সে কাজের লােক ছিল এবং অনুশীলনে আগ্রহী ছিল। বলা যায়, প্রথম সাক্ষাতের পর আমি তাঁর সম্পর্কে আরও আগ্রহী হয়ে উঠি। আমরা নিয়মিতই আলাপ করতাম। পঁচাত্তরের মাঝামাঝি পর্যন্ত এভাবে চলেছে। ওনার বাসায়, ওনার ভাইয়ের বাসায় বৈঠক হতাে। আমরা ঐকমত্যে পৌছেছিলাম, এখানে বিপ্লবের ধরন হবে রাশিয়ার মডেলে। চীনের মডেলে নয়। যদিও এখানকার পল্লি সমাজের গঠন চীনের মতােই ছিল। কিন্তু এখানে বিপ্লব হবে গণঅভ্যুত্থানমূলক।

আবু তাহেরের সঙ্গে আমার দৃষ্টিভঙ্গির প্রচুর পার্থক্যও ছিল এবং সেই পার্থক্যও ছিল মৌলিক। তাহের মনে করতেন গণঅভ্যুত্থান হবে মূলত ঢাকাভিত্তিক, শহরভিত্তিক। শহরভিত্তিক সামরিক প্রস্তুতিকে গুরুত্ব দিতেন তিনি। গ্রামীণ কৃষি মজুরদের সংগঠিত করার কাজকে তিনি গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন না। আমার কাছে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ মনে হয়েছিল। আমার বিবেচনায় এরাই হবে গণঅভ্যুত্থানের মূলশক্তি। তাহের যা ভাবছিলেন সেটা নিয়ে উনি কাজ করে যাচ্ছিলেন। যেহেতু আমাদের চিন্তায় পার্থক্য ছিল। সে কারণে আমিও পৃথকভাবে কাজে নামার কথাই ভেবেছি। স্বতন্ত্রভাবে কাজের বাস্তবতা তৈরি হয় এভাবেই। তারপরও তাকে আমি একজন সত্যিকারের বিপ্লবী মনে করতাম এবং এখনও করি। তবে তখনি মনে হচ্ছিল সামাজিক বিপ্লবের জন্য তার প্রস্তুতিতে অনেক অপূর্ণাঙ্গতা রয়ে যাচ্ছে।

সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে যােগাযােগ ছিল না আপনার?

দেখা হয়েছিল। কিন্তু তিনি আমাকে খুব বেশি আকর্ষিত করেননি। আমার মনে হয়েছে তার মাঝে চিন্তার গভীরতা কম। তবে সমাজে তার ব্যাপক ইমেজ ছিল।

সিপাহী অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি ও গণবাহিনীর কার্যক্রম সম্পর্কে তো আপনি তো জানতেন?

আমি জানছিলাম। গণবাহিনীর কাজ সম্পর্কে আমি অবহিত ছিলাম। এর সংগঠকরা দ্রুতলয়ে এগােচ্ছিলেন। কিন্তু দলটির মাঝে লাইনগত সমস্যা ছিল। গ্রামে সংগঠন করার কাজকে তারা প্রধান গুরুত্বপূর্ণ কাজ মনে করত না। এটাকে পাশ কাটিয়ে নগরভিত্তিক গেরিলা দল গড়ে তােলাকেই তারা সবচেয়ে জরুরি কাজ মনে করত। গণবাহিনী গঠনে দলের কেন্দ্রীয় যারা অনুমােদন দিয়েছে এবং বাস্তবে এটা যারা পরিচালনা করতেন – উভয়ের সকল চিন্তা ও পরিকল্পনা এক রকম ছিল এমন বলা যাবে না। এডভেনচারিস্ট লাইন প্রাধান্য পাচ্ছিল। গ্রামে ওদের সাংগঠনিক ভিত্তি ছিল অতি দুর্বল। আমি প্রথমে মনে করেছিলাম ওদের ভুল রণকৌশল সংশােধন করাতে ভূমিকা রাখবাে। অর্থাৎ ভূল রণকৌশল সম্পর্কে বিতর্ক করাই কর্তব্য মনে করেছিলাম। আমাদের বিবেচনায় তখন কোন একটি পার্টি গঠনের চেয়েও জরুরি প্রয়ােজন ছিল বামদের ঐক্য। জাসদ ও

Page 537

সর্বহারা পার্টির মাঝামাঝি থেকে আমরা তখন তাদের কাছাকাছি আনারও চেষ্টা করেছি । কিন্তু জাসদের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে মতাদর্শিক বিতর্কের সুযােগ ছিল না। ফলে গণবাহিনীর সকল বিষয় অবহিত থাকার পরও আমার মাঝে ওদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার ব্যাপারে দোদুল্যমানতা কাজ করতাে।

আপনি তখন কী করলেন?

গণবাহিনী যখন চূড়ান্ত কার্যক্রমের দিকে এগােচ্ছে- তখন আমার ও আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সামনে প্রশ্ন ছিল আমরা কি করবাে? আমাদের তাে কিছু না করে উপায় ছিল না। তখন আমরা আলাদা সংগঠন করে ফেলেছি। পঁচাত্তরের শুরু থেকে আমরা স্বতন্ত্র উদ্যোগ নিতে শুরু করি। জাসদের কিছু কর্মী তখন আমাদের সঙ্গে চলেও এসেছে। সর্বহারা পার্টিরও কিছু কর্মী এসেছিল। দীর্ঘ ধারাবাহিক বৈঠকের পর সর্বহারা ঐক্য আন্দোলন নামে কাজ করতে শুরু করি আমরা। এটা ছিল এক ধরনের গণসংগঠন। আমরা নিজেদের পার্টি বলতাম না। ভাবতাম এটা একটা অন্তর্বর্তীকালীন অবস্থা।

তবে আমাদের অগ্রসর সংগঠকরা কেন্দ্রীয় বিকাশ গ্রুপ’ নামে একটি কাঠামাের সদস্য ছিলেন। আমাদের কাজের কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারণী কাঠামাে বলা যায় একে। আমি যে পলিটিক্যাল লাইনের বিকাশ ঘটিয়েছিলাম সেটাই ওখানে গৃহীত হলাে। মূল ডকুমেন্টটা ইংরেজিতে ছিল। পরে সেটা বাংলাও করা হয়। এপ্রিল থেকে আমাদের আনুষ্ঠানিক বৈঠক ইত্যাদি শুরু হয়। নােয়াখালী, বরিশাল ইত্যাদি জায়গায় বেশ ভালােভাবে কাজ শুরু হলাে। আরও কিছু পকেটে। আর পুরাে রাজনৈতিক কার্যক্রম যাতে সরাসরি সরকারের চোখে না পড়ে তার জন্য আমরা একটা এনজিও-এর মাধ্যমে শিক্ষা বিষয়ে কাজেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তাছাড়া গ্রামীণ পরিসরে ভূমিহীন কষকদের রাজনৈতিকভাবে সচেতন করার জন্য নিরক্ষরতা দূর করারও প্রয়ােজন ছিল। পাওলাে ফেইরীর আদর্শ থেকে এটা করা হয়। আমাদের ঐ এনজিও’র নাম ছিল বাংলাদেশ অর্গানাইজেশন ফর ফাংশনাল এজুকেশন বা বিওএফই। তবে আমাদের সাংগঠনিক কাজ ভালােভাবে শুরু হয় পচাত্তরের আগস্টে, আর ডিসেম্বরেই আমরা আটক হয়ে যাই।

এর আগের একটি বিষয় জানতে চাইছি- গণবাহিনীকে আপনি কীভাবে সহায়তা দিয়েছিলেন?

তাদের আমার তরফ থেকে কোনাে ধরনের বস্তুগত সহায়তা গ্রহণের আহ্বান জানানাে হয়নি বা প্রদান করা হয়নি।

আমরা কি এটা বলতে পারি, জাসদের অভ্যন্তরে মতাদর্শিক বিতর্কে পরাজিত হয়েই আপনাকে পৃথক সাংগঠনিক কাজে নামতে হয়?

এটা জয়-পরাজয়ের ব্যাপার ছিল না। ১৯৭৪-৭৫ সালে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সঠিক বিপ্লবী মতাদর্শ ও কৌশল নির্ধারণপূর্বক একটি দলিল তৈরি করেছিলাম আমরা। যাতে আমার ব্যাপক সংশ্লিষ্টতা ছিল। তাকে কেন্দ্র করে অনেক বাম দলের কর্মীরা একত্রিত হতে শুরু করেছিল। তারই অভিব্যক্তি ঘটেছিল ‘সর্বহারা ঐক্য আন্দোলন নামে। এই দলের উল্লেখযােগ্য সংখ্যক সদস্য ইতােমধ্যে জাসদে কাজের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ ছিলেন । প্রায় সমসংখ্যক পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টিরও অনুসারী ছিলেন। আমাদের সকলের মধ্যে

Page 538

একটা সাধারণ ঐকমত্য ছিল- জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য কাজ করবাে আমরা, আর ঐ মুহূর্তে পল্লি সমাজের আধা-সর্বহারা বা ভূমিহীন কৃষকদের রাজনৈতিক সচেতনতায়নই হবে মূল কাজ। সাংগঠনিক ভিত্তি শক্তিশালী না করে গেরিলা যুদ্ধ সম্প্রসারিত করা- যা করে যাচ্ছিলাে তখন অনেকে, আমরা তার সমালােচক ছিলাম। কর্নেল তাহেরের রাজনীতিকেও আমরা প্রশ্ন করেছিলাম ঐ অবস্থান থেকেই। এ বিষয়ে আমাদের UICKCUS FTA few-On Insurrection – Battle Hunger or Armed Dedication?”

তার মানে কি জাসদকে সঠিক মতাদর্শিক ধারায় আনার কাজে যথেষ্ট সময় দিয়েও ব্যর্থ হয়েছিলেন আপনি?

জাসদের মধ্যে অনেক সংগঠকের মাঝেই ‘৭৪-‘৭৫ নাগাদ নানা ধরনের বিভ্রান্তি, প্রশ্ন, অসন্তুষ্টি কাজ করছিল। আমি সেটাকে বিতর্ক আকারে আরও উসকে দিতে চেয়েছিলাম। অনেকগুলাে রাজনৈতিক দলিল লিখে এই কাজটি করা হয়। বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে এই দলের ভুল লাইনের সংশােধন হওয়া দরকার ছিল। যেজন্য জাসদের খসড়া থিসিসের বিপরীতে আমি একটি দলিল তৈরি করেছিলাম- ‘wrong line is the main problem’ নামে । জাসদের খসড়া থিসিসে এমন কিছু বিষয় ছিল যা আমার বিবেচনায় ছিল ভুল।

আদর্শগতভাবে জাসদে আপনি প্রধান ভুলটি কী দেখছিলেন?

বাংলাদেশে তখন পুজি ও শ্রমের দ্বন্দ্ব প্রধান ছিল না। যেমনটি বলছিল জাসদ। আসলে তা ছিল ট্রেডার ও মহাজনী পুঁজির সঙ্গে কৃষি ও শিল্প সমাজের উৎপাদিকা শক্তির দ্বন্দ্ব। জাসদ বিপ্লবের গণতান্ত্রিক স্তরকে অগ্রাহ্য করে যেতে চাচ্ছিল।

১৯৭৫-এর কিছু তারিখ ও ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে বার বার আলােচিত হয়। আপনিও সেগুলাের সাক্ষী। ৩ নভেম্বর থেকে ৭ নভেম্বরের মাঝের ঘটনাবলির আসলে নায়ক ও প্রতি-নায়ক কারা? কী ঘটেছিল সেই দিনগুলােতে?

আপনি আমাকে ঐসব ঘটনাবলির সাক্ষী বলেছেন। বাস্তবতা হলাে, জেলে গিয়েই কেবল। আমি পূর্ণাঙ্গভাবে ঐ দিনগুলাের সত্যিকারের কাহিনী জেনেছি। যখন বাইরে ছিলাম, তখনি ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু তখন যেভাবে জেনেছি তার মাঝে প্রচুর গুজব, প্রচুর অনুমান যুক্ত ছিল। ঢাকা তখন প্রকৃতই গুজবের শহর ছিল। যেহেতু সাংবাদিক হিসেবেও আমার কাজ বরাবরই আমি চালিয়ে গিয়েছি। সে কারণে আটক হওয়ার পর জেলে আমি ঐ দিনগুলাের পুঙ্খানুপুংখ বিবরণ সংগ্রহ করি। ঐসব অভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত শত শত জনকে আমি কারাগারে পেয়ে গিয়েছিলাম । ১৯৭৭ সালে মুক্তি পাওয়ার পর স্মৃতি থেকে ঐসব কাহিনী নিয়ে লিখতে চেষ্টা করেছি। বিশেষত ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থান সম্পর্কে। সেটা এখনাে প্রকাশিত হয়নি।

এতে কোনাে সন্দেহ নেই, তেসরা নভেম্বরের অভ্যুত্থানটি একটা প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের অধিক কিছু ছিল না। খালেদা মােশাররফের নেতৃত্বে ঐ ঘটনার মূল চরিত্র ছিল বিমান বাহিনীর কিছু অফিসার। অভ্যুথানটি তখনকার ঢাকার মধ্যবিত্ত সমাজে এই ধারণা দিয়েছিল যে, এর মাধ্যমে বাকশাল সমর্থকরা আবার রাষ্ট্র ক্ষমতা পুনর্দখলের চেষ্টা চালাচ্ছে। ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানও অনুরূপ এক প্রাসাদ ষড়যন্ত্র । ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান ঐ দুটির তুলনায় একেবারে পৃথক চরিত্রের। এটা ছিল উর্দি পরা নির্যাতিত কৃষক

Page 539

সন্তানদের ব্যাপকভিত্তিক বিদ্রোহ- যার নেতৃত্বে ছিলেন আবু তাহের। এই অভ্যুত্থান রাষ্ট্রযন্ত্রকে পুরােপুরি অকার্যকর করে দিয়েছিল। কিন্তু যেহেতু এই অভ্যুত্থান দেশের অন্যান্য নির্যাতিত শ্রেণীগুলাের সঙ্গে সঠিক সমন্বয় গড়ে তুলতে পারেনি এবং অভ্যুত্থানের নেতারা আগে থেকেই যে কাজে অবহেলা করেছিলেন সে কারণেই তা ব্যর্থ হয়। তাহের বাংলাদেশের বিপ্লবীদের জন্য যেমন বিরাট অনুপ্রেরণা – তেমনি তার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন থাকা উচিত।

আপনার আটক ও বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলুন-

১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বরে সামরিক আদালতের ঐ বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। আমাদের আটক করা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ৮ ডিসেম্বর এলিফ্যান্ট রােড থেকে। মাঝখানের সময়টিতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতাে নিয়মিত। সিপাহী অভ্যুত্থানের ব্যর্থতার পর থেকে আমাদের উপর নজরদারি করা হচ্ছিল- সেটা বুঝতে পারছিলাম। আমরা তখন জাসদ

নই- পৃথক সংগঠনে। তারপরও নজরদারি হচ্ছিল। আমরাও তখন সতর্ক হতে শুরু করলাম- যদিও আগে থেকে আমাদের এক্ষেত্রে দারুণ গাফিলতি ছিল। যাই হােক নজরদারির পর থেকে রাজনৈতিক কাগজপত্র সরিয়ে ফেলতে শুরু করলাম। প্রচুর প্রচার-পুস্তিকা ছিল, যেগুলাে সরানােও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ৬ ডিসেম্বর স্পেশাল ব্রাঞ্চে আমাকে ডাকা হলাে। হলিডে কাগজে যেসব লেখা লিখেছিলাম সেগুলােকে কেন্দ্র করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলাে। আবার ছেড়েও দেওয়া হলাে। একদিন পরই আবার আটক করা হলাে। তারপর শুরু হলাে মামলা ও বিচার। দীর্ঘ আট মাস পর চার্জশীটের সংবাদ প্রকাশিত হয়।

সরকারি তরফ থেকে বলা হচ্ছিল, এটা একটা ষড়যন্ত্র মামলা। ঐ সময়ে এটা ছিল এ রকম দ্বিতীয় মামলা- যেখানে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সরকার উৎখাতের অভিযােগ আনা হয়। প্রথমটি ছিল সিপাহী অভ্যুত্থানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে। আমাদের (যে মামলায় মােট ১১ জন অভিযুক্ত ছিল) বিচার প্রক্রিয়া প্রথমটির মতাে কারাগারে হয়নি। তবে কোর্টে আমাদেরও এক ধরনের লােহার খাঁচাতেই রাখা হতাে। আমাদের, অর্থাৎ সর্বহারা ঐক্য আন্দোলন’-এর নেতাদের, ঐ বিচারে (আমিসহ) ১৪ বছর করে সাজা দেওয়া হয়। সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে আমি ব্যতীত অন্যান্য যারা জেলে ছিলেন তারা ১৪ বছরের সাজা শেষ করে জেল থেকে বেরিয়ে আসেন।

এটা একটা প্রহসনের বিচার ছিল। আমার পক্ষে যুক্তি-তর্কের জন্য একজন ব্রিটিশ আইনজীবী আগ্রহ প্রকাশ করলেও তাকে কাজের সুযােগ দেওয়া হয়নি। বিচার সম্পর্কিত সকল সংবাদ সেন্সর হতাে। দেশবাসী সত্যিকারের কিছুই জানতে পারছিল না। আমাদের যেখান থেকে আটক করা হয় সেখানে সংগঠনের কিছু রাজনৈতিক দলিলপত্র পাওয়া গিয়েছিল- এটাই ছিল মামলায় প্রধান সাক্ষ্য-প্রমাণ। বাংলাদেশের এলিটরা যে সমাজ পরিবর্তনের ভাবাদর্শকে কতটা ভয় পায় সেটাই প্রমাণিত হয় ঐ মামলায় ।

রায়ের আগে-পরে আন্তর্জাতিকভাবে এবং বিশেষভাবে নেদারল্যান্ডের গণমাধ্যমে আমার মুক্তি চেয়ে লেখালেখি হচ্ছিল। অন্যদিকে রায়ের আগেই কারাগারে সামরিক আদালতের বিচার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী অনশনও চালিয়েছিলাম আমি। সামরিক কর্তৃপক্ষ তখন নির্যাতনমূলকভাবে ফোর্স ফিডিং করিয়েছিল। নেদারল্যাণ্ড সরকার এসময়

Page 540

বাংলাদেশ সরকারের ওপর আমার মুক্তির বিষয়ে চাপ প্রয়ােগ করে। এসবের মিলিত ফল হিসেবে আমাকে মুক্তি দেওয়া হয়।

জাসদ ও তাহের সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেছিল। সেটা এখন শুধুই ইতিহাস। অতীতের সেই অভিজ্ঞতাকে আপনি তাত্ত্বিকভাবে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?

এ ধরনের অভ্যুত্থান প্রশ্নে পঁচাত্তরে আমি যা ভেবেছি, এখনও তাই ভাবি। এধরনের অভ্যুত্থান বা বিদ্রোহ দুটি কারণে ঘটে। প্রথমত, সৈনিকদের নিজেদের অর্থনৈতিক, পেশাগত বা সামাজিক কোনাে দাবি নিয়ে। দ্বিতীয়ত, বৃহত্তর সমাজের রূপান্তর বা গণতন্ত্রায়নের লক্ষ্যে। যেভাবেই ঘটুক এবং যে দাবিতেই ঘটুক – তার সাফল্য নির্ভর করে এবং তার মাধ্যমে সমাজে সত্যিকারের পরিবর্তন আসতে পারে কেবল তখনি যখন ঐ অভ্যুত্থানের সঙ্গে শহুরে শ্রমিক ও গ্রামীণ দরিদ্রদের ব্যাপক বিদ্রোহ যুক্ত থাকে। অর্থাৎ অভ্যুত্থানে উর্দিধারী এবং উর্দিহীন- উভয় পরিসরের নির্যাতিতদের সম্মিলন ঘটা জরুরি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ রকম দৃষ্টান্তের অভাব নেই যে, উর্দিধারীদের নির্যাতিত অংশ শাসক এলিটদের ওপর নানান সময় অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। নানান কারণেই তাদের মাঝে বঞ্চনার বােধ তৈরি হয়েছিল। তবে যখনি তারা বিদ্রোহ করেছে- তখন পাল্টা আঘাত এসেছে।

ফলে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসেনি। সমাজে যে বিভিন্ন পেশায়, বিভিন্ন পরিসরে নির্যাতিত জনসমাজ রয়েছে তাদের মাঝে সংগ্রামের সমন্বয় ঘটানাের কাজটি এ দেশের বামপন্থীরা এখন পর্যন্ত করতে পারেনি। বুর্জোয়া রাষ্ট্রকে উচ্ছেদ করার সুযােগগুলােও তাই এখানকার নির্যাতিত শক্তিগুলাে কাজে লাগাতে পারেনি। তবে এখনও সেটা সম্ভব। যদি তারা ঐক্যবদ্ধ হন।

Source: মুজিব বাহিনী থেকে গন বাহিনী ইতিহাসের পুনর্পাঠ – আলতাফ পারভেজ