জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের প্রথম কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্মেলন
২৩ ডিসেম্বর, ১৯৭২ সাল
আহ্বায়ক কমিটির বক্তব্য
সাথী সভাপতি
অতিথিবৃন্দ
বাংলাদেশের দূর দূরান্ত থেকে আগত সাথী ভাই বােনেরা,
আপনারা বিপ্লবী অভিনন্দন গ্রহণ করুন।
বিপ্লবের মৃত্যু নেই, বিপ্লব অনিবার্য।
জনতাকে অভুক্ত রেখে শান্তিতে ঘুমাবার কথা বলা, অস্ত্র হস্তান্তরের পর অস্ত্র ব্যবহারের প্রয়ােজনীয়তাকে উপেক্ষা করা বা অপ্রয়ােজনীয় বলে উল্লেখ করা শাসক ও শােষক শ্রেণীর একটা কৌশল মাত্র। আমাদের অতীত ইতিহাস প্রমাণ করে, রাজনীতির প্রয়ােজনে রক্তচক্ষুর শাসন ও শােষণ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য অস্ত্রই যেখানে একমাত্র অবলম্বন, বিপ্লবী চেতনার জন্ম এবং বিপ্লব সেখানেই অবশ্যম্ভাবী। তাই যত চেষ্ট করাই হােক না কেন, যত সহজ পন্থার কথাই উল্লেখ করা হােক না কেন, আর যত নির্যাতনের হুমকিই দেওয়া হােক না কেন অস্ত্র দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশ ও জাতির জন্য বিপ্লব অনিবার্য। বিপ্লবীর মৃত্যু হতে পারে কিন্তু বিপ্লবের মৃত্যু নেই।
বাংলাদেশের বিপ্লবী জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন এবং রায় নিয়ে মাত্র কিছুদিন আগে বাংলার মাটিতে আত্মপ্রকাশ ঘটে একটি রাজনৈতিক দলের, নাম জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল। ব্যক্তি বিশেষের নিছক খেয়াল নয় বরং ঐতিহাসিক প্রয়ােজন মেটানাের তাগিদ ও মেহনতী জনতার দাবির ফলই জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল। অধিকার বঞ্চিত নির্যাতিত মানুষের মতামত নিয়ে একটি দলের আত্মপ্রকাশ পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম। কোন নেতা সৃষ্টির জন্য নয় বা ক্ষমতা আরােহণ করে নেতৃত্ব কায়েমের জন্য এ দলের জন্ম হয়নি বরং ভবিষ্যতের অনিবার্য সামাজিক বিপ্লব সংঘটনে এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র বাস্তবায়নে বিপ্লবের সহায়ক শক্তি হিসেবে এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের জন্যই জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের এই অভ্যুদয় ।
আত্মপ্রকাশের মাত্র চব্বিশ দিন গত হয়েছে। এর মধ্যেই বাংলাদেশের প্রায় সবকটি জেলায় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়েছে জনসভা। প্রতিটি সভায় আমরা দেশের মেহনতী মানুষের কাছে আমাদের বক্তব্য তুলে ধরছি। রাজনীতি সচেতন বাংলার মানুষ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের প্রতি দিয়েছে অকুণ্ঠ সমর্থন।
জুলুম প্রতিরােধ দিবস
গােটা বাংলাদেশে বিরাজ করছে এক ভয়াবহ অরাজক পরিস্থিতি। দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। সেবার পরিবর্তে ক্ষমতাসীন দল চালিয়ে যাচ্ছে জুলুমবাজি। গুপ্তভাবে হত্যা করছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে। পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিকে বিনাশর্তে
Page 478
মুক্তিদানের চক্রান্ত চলছে। পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারেও বর্তমান সরকার ব্যর্থ। এ সকল অত্যাচার, অবিচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল দুই দুইবার ‘জুলুম প্রতিরােধ দিবস পালনের জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল। অত্যাচারে জর্জরিত মানুষ সভা ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দলের ঘােষিত কর্মসূচি অনুযায়ী জুলুম প্রতিরােধ দিবস পালন করেছে ।
জনগণের সংগঠনরূপে
এত অল্প সময়ের মধ্যে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল যে গণজাগরণের সূচনা করেছে তা অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে; অন্যদিকে এ জাগরণ কাপিয়ে দিয়েছে ক্ষমতাসীন সরকারের ভিত। গণশক্তির ভয়ে ভিত ক্ষমতাসীন মহল তাই জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল সম্পর্কে অরাজনৈতিক ও অশােভন মন্তব্য করছে এবং আমাদের দলের কর্মীদের অপহরণ ও হত্যা করছে। আন্দোলনবিমুখ অন্যান্য রাজনৈতিক দলসমূহের কোন সঠিক লক্ষ্য বা কর্মসূচি না থাকায় এসব দল জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। অন্যদিকে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল কম সময়ে বেশি পরিচিত, জনপ্রিয় হয়ে জনগণের সংগঠনে পরিগণিত হয়েছে।
২৫ মার্চের আগের রাজনীতি
পঁচিশে মার্চের আগে স্বাধীনতা সম্পর্কে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলাের কী মনােভাব ছিল তা দেশবাসীর সকলের জানা। নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের ক্ষমতার মসনদে আরােহণের স্বপ্নে ছিল বিভাের। স্বাধীনতার স্বপক্ষে কথা বলার জন্য বাংলাদেশের যুবসমাজ বিশেষ করে ছাত্রলীগের কর্মীদের আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ চিহ্নিত করেছিল বিদেশী শক্তির এজেন্ট হিসেবে।
পঁচিশে মার্চ রাত্রি পর্যন্ত আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা সম্পর্কে জনগণকে কোন নির্দেশ তাে দেয়নি বরং পাকিস্তানের পক্ষে কথা বলেছিল। বস্তুত আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার জন্য তারা কোন পদ্ধতি বা প্রস্তুতি গ্রহণ করার কথা চিন্তাও করতে পারেনি। তাই বাংলাদেশের সংগ্রামী যুবসমাজকেই গােপনভাবে আওয়ামী লীগের আপসমূলক আলােচনার আড়ালে যৎসামান্য প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দলগুলাে স্বাধীনতার আন্দোলন সম্পর্কে পােষণ করতাে নমনীয় ও আপসকামী মনােভাব। পরিণামে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ব্যর্থ হয়েছিল জাতিকে সঠিক পথের নির্দেশ
দিতে। তাই কোন প্রকার নেতৃত্ব বা নির্দেশ ছাড়াই স্বতন্ত্রভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েছিল বাংলাদেশের বিপ্লবী জনতা। যুব সমাজের নেতৃত্বে কারখানার শ্রমিক, গ্রামের কৃষক, ছাত্র-জনতা স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়েছিল।
বিপ্লব অসম্পূর্ণ
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর বাংলাদেশের কৃষক শ্রমিক-ছাত্র মেহনতী মানুষ সশস্ত্র বিপ্লবী যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল যুব সমাজের আহ্বানে। প্রচণ্ড লড়াই ও প্রচুর রক্তক্ষয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ যখন তার নিজস্ব গতিতে জনযুদ্ধের রূপ নিতে যাচ্ছিল তখনই ভারতীয় সেনাবাহিনী এই যুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণের ফলস্বরূপ ১৬ ডিসেম্বর পাক সেনাবাহিনী
Page 479
আত্মসমর্পণ করে। বন্ধ হয়ে গেল আমাদের বিপ্লবী যুদ্ধ। ভৌগােলিকভাবে স্বাধীন হলাে বাংলাদেশ।
আমরা কী চেয়েছিলাম
উনিশ শত একাত্তর সালে বাংলাদেশের কৃষক, মেহনতী জনতা যে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সে যুদ্ধের লক্ষ্য কেবল ভৌগােলিক স্বাধীনতা ছিল না। স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে সকল প্রকার শােষণ থেকে মুক্ত হয়ে কৃষক রাজত্ব কায়েম করাই ছিল বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের লক্ষ্য। বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে আমাদের যুদ্ধ করতে হয়েছে তিনটি শক্তির বিরুদ্ধে। প্রথমত, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদসহ সকল সাম্রাজ্যবাদী শক্তি; দ্বিতীয়ত পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন; তৃতীয়ত পাকিস্তানি উপনিবেশিকতাবাদের প্রতিভূ বাংলাদেশের বুর্জোয়া শ্রেণী ও প্রতিক্রিয়াশীল মহল। বাংলাদেশের সুবিধাবাদী রাজনৈতিক মহল যুদ্ধকালে দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একটি অংশ মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে এগিয়ে আসে, অন্য অংশটি আন্দোলনের বিরােধিতা করে। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে অস্ত্র দিয়ে, অর্থ দিয়ে সহযােগিতা করেছিল অথচ যুদ্ধের পরিসমাপ্তির পর স্বীকৃতি, সাহায্য এবং আকাক্ষিত উন্নয়নের নাম নিয়ে এই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিবর্গ আবার বাংলাদেশকে শােষণের জন্য এগিয়ে এসেছে। আর তাদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে নয়া উপনিবেশবাদী শক্তি এবং দেশীয় বুর্জোয়া শ্রেণী ও স্বাধীনতা যুদ্ধে সমর্থনকারী সুবিধাবাদী রাজনৈতিক মহল অর্থাৎ বর্তমান.ক্ষমতাসীন দল।
স্বাধীনতা আন্দোলনের পর আমরা ভৌগােলিক স্বাধীনতা লাভ করেছি এবং উৎখাত করেছি পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসকবর্গ এবং তাদের বশংবদ বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলসমূহকে। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পর পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের শূন্যস্থান পূরণ করেছে নয়া উপনিবেশবাদী শক্তিসমূহ। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশীয় উঠতি পুঁজিপতি শ্ৰেণী, শিল্প প্রশাসক গােষ্ঠী, জোতদার মহাজন, অসৎ ব্যবসায়ী মহল; সুবিধাবাদী রাজনৈতিক টাউট ও অতি অভিলাষী সামরিক ও আধা-সামরিক চক্র। বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিয়ে এ সকল সাম্রাজ্যবাদী, নয়া উপনিবেশবাদী ও দেশীয় শােষক সম্প্রদায় বাংলাদেশের মেহনতী মানুষকে শােষণ করছে। বাংলাদেশ হয়ে ওঠেছে শােষণের একটি কেন্দ্রবিন্দু
সাম্প্রতিক সফর অভিজ্ঞতা
গ্রামবাংলার খেটে খাওয়া মানুষ অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। তাদের পেটে ভাত.নেই, পরনে কাপড় নেই। কাপড়ের অভাবে গ্রামের মা-বােনেরা ঘরের বাইরে বেরুতে পারছে না। সরকার যদিও প্রচার করে বেড়াচ্ছে, দেশের প্রতিটি আনাচে-কানাচে রিলিফ বিতরণ করা হয়েছে; কিন্তু মানুষের কাছে রিলিফের কণামাত্রও গিয়ে পৌঁছায়নি। এসব রিলিফ সামগ্রী আত্মসাৎ করেছে স্থানীয় এম.সি.এ এবং আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক টাউটরা। সারা বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে আজ হাহাকার। অথচ এই গ্রামগুলাে ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আশ্রয়স্থল। গরিব কৃষকরা অভুক্ত থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের খাদ্যের ব্যবস্থা করেছে। শত্রুসৈন্যদের খবর আদান-প্রদান করেছে। নিজেদের জীবনের বিনিময়ে
Page 480
মুক্তিসংগ্রামীদের আশ্রয় দিয়েছে। আজ স্বাধীনতার কণামাত্র সুফলও ভােগ করার সুযােগ হয়নি গ্রামীণ মানুষদের।
শ্রমিক অসন্তোষ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা
সুষ্ঠু শ্রমনীতির অভাবে বাংলাদেশের সর্বত্র শ্রমিক অসন্তোষ চরমে উঠেছে। শিল্পাঞ্চলে আঞ্চলিকতার প্রশ্ন তুলে ক্ষমতাসীন মহল শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে আত্মঘাতী হানাহানির বিষ ছড়িয়ে দিয়ে বিপ্লবী শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে ভাঙ্গন ধরানাের অপচেষ্টায় লিপ্ত। শ্রমিক শােষণের প্রতিক্রিয়াকে অব্যাহত রেখে এবং শ্রমিকে শ্রমিকে দাঙ্গা বাধিয়ে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল রাজনৈতিক ফায়দা লুটবার ব্যর্থ চেষ্টায় রত। অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষতার বড় বড় বুলি আওড়ানাের অন্তরালে ক্ষমতাসীন দলের সাম্প্রদায়িক মনােভাবাপন্ন অংশ মুসলিম লীগ গঠন ও সাম্প্রদায়িক অশান্তি সৃষ্টি করছে এবং সরকার প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে মদদ যােগাচ্ছে তার পেছনে।
মুক্তিযােদ্ধারা অবহেলিত
দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য যারা হাতে তুলে নিয়েছিল মারণাস্ত্র; দীর্ঘ নয়টি মাস যারা নিজের জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছে শত্রুর বিরুদ্ধে সেসব অকুতােভয় মুক্তিযােদ্ধা আজ আবহেলিত- ক্ষমতার আসনে বসে ক্ষমতাসীন দল ভুলে গেছে তাদের। যুদ্ধকালীন মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য কোন সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। সমাজের এক উচ্ছিষ্ট অংশের মতাে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে এই মুক্তিযােদ্ধার দল।
জীবনযাত্রা ব্যাহত
সরকার সমস্ত লাইসেন্স, পারমিট তার দলীয় সদস্যদের মধ্যে বিতরণ করার ফলে দেশের ব্যবসায়ীমহলকে বাধ্য হয়ে তিন-চারগুণ চড়া দামে পণ্য বিক্রি করতে হচ্ছে। সরকারের এই ঘূণ্য নীতির ফলে দেশের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীমহল এক অনিশ্চয়তার শিকারে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে কালােবাজারী মুনাফাখাের অসৎ ব্যবাসায়ীমহল দিন দিন ফুলে ওঠছে। ফলে জনসাধারণের স্বাভাবিক জীবন যাত্রা হচ্ছে ব্যাহত। জিনিসপত্রের ক্রয়ক্ষমতা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।
মুদ্রাস্ফীতি
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের পর মাত্র তিনদিনের মধ্যে বাংলাদেশের মুদ্রামান হ্রাস, অসামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যাংক রিজার্ভ কারেন্সী চালু এবং উৎপাদনের সঙ্গে যােগাযােগহীন ফিনান্সিয়াল পলিসি বর্তমান সরকারের অযোেগ্যতাই প্রমাণ করে। আজ সারা দেশে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি। সারা দেশ ছেয়ে গেছে কালাে পয়সায়। তাই অর্থনীতির দিক থেকে বাংলাদেশ আজ দেউলিয়া।
সরকার পরিকল্পনা গ্রহণে ব্যর্থ
যে কোন দেশের জন্য কোন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হলে সে দেশের (১) ভৌগােলিক এবং (২) মানুষের মন-মানসিকতা ও প্রয়ােজন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা আবশ্যক।।ক্ষমতাসীন সরকারের সঙ্গে জনগণের কোন আত্মিক সম্পর্ক নেই, ছিল না কখনাে। তাই বাংলাদেশের মানুষ কী চায়, কী তার প্রয়ােজন এবং এ প্রয়ােজন মেটানাের পক্ষে বাধা কী, এ সকল দিক সঠিকভাবে বিচার বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা আওয়ামী লীগ সরকারের
Page 481
নেই। তাই স্বাভাবিকভাবে আজ পর্যন্ত সরকার যতগুলাে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সব পরিকল্পনা অবাস্তব প্রমাণিত হয়েছে এবং পরে বাতিল ঘােষিত হয়েছে। কোন ব্যাপারেই সরকার এখনাে সঠিক পরিসংখ্যান নিতে পারেনি। তাই কর্মক্ষেত্রে পদে পদে সরকার তার ব্যর্থতা প্রমাণ করে যাচেছ। গত এক বছরের খতিয়ান দেখে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়, বর্তমান সরকার যে পরিকল্পনাই গ্রহণ করুক না কেন বাস্তব ক্ষেত্রে তা ব্যর্থ হতে বাধ্য।
পররাষ্ট্রনীতি প্রসঙ্গে
সরকার যদিও ঘােষণা করে থাকে যে তারা জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করছেন, কিন্তু বাস্তবে বর্তমান সরকার সরাসরি পুতুল সরকারে পরিণত হয়েছে। যেখানে শক্তির ভারসাম্য রক্ষা করাই পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি হওয়া উচিত ছিল সেখানে বর্তমান সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সরকারের পররাষ্ট্রনীতি চরমভাবে ব্যর্থ। জাতিসংঘে বাংলাদেশ আজও পায়নি তার ন্যায্য আসন। জাতিসংঘে আসন পাওয়ার জন্য বাংলাদেশের যে দরকষাকষি চলছে তা প্রতিটি বাঙালির জন্য অপমানজনক।
যুদ্ধবন্দি ও আটক বাঙালি প্রসঙ্গে
যারা জাতি হিসেবে বাঙালি জাতিকে এবং দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য অস্ত্র ধরেছিল সেসব আটক পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে বিনা বিচারে ছেড়ে দেওয়ার এক অশুভ পাঁয়তারা চলছে। পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। যুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশের মানুষ সারা পৃথিবীর কাছ থেকে যে সম্মান অর্জন করেছিল, মাত্র একটি বছরের ব্যবধানে আমরা তা হারিয়ে ফেলেছি। আন্তর্জাতিক বিশ্বে আজ আমাদের স্থান এত নিচে।
অর্থনীতি ও যােগাযােগ ব্যবস্থা
আওয়ামী লীগ সরকার মুখে বলছে আইনের শাসন, কিন্তু কার্যত দেশে চালু হয়েছে এক ব্যক্তির শাসন। প্রশাসন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যক্তিপূজার মাত্রা মধ্যযুগের নৃপতিদেরও ছাড়িয়ে গেছে । absolute power corrupts absolutely বাংলাদেশের অবস্থা বর্তমানে এই। গণতন্ত্রের নামাবলি গায়ে দিয়ে চলছে ব্যক্তিপূজার মহােৎসব— যার আশ্রয় হচ্ছে ফ্যাসিবাদ।
এদিকে জাতীয় অর্থনীতি একেবারে বিপর্যস্ত। ভয়াবহ বেকারসমস্যা পূর্বতন সমস্ত রেকর্ড ছড়িয়ে গেছে। কলকারখানাগুলােতে উৎপাদন হচ্ছে না। একদিকে খুচরা যন্ত্রপাতি ও প্রয়ােজনীয় কাঁচামালের অভাব, অন্যদিকে সমাজতন্ত্রবিরােধী ব্যক্তিবর্গের হাতে জাতীয়করণকৃত কারখানার প্রশাসনভার অর্পণের ফলে উৎপাদনের পরিমাণ অনেক নিচে নেমে গেছে। সুতরাং নতুন কর্মসংস্থানের দ্বার রুদ্ধ করেই পুরাতন শ্রমিকরা ছাঁটাইয়ের সম্মুখীন হচ্ছে দিন দিন। শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। পাক আমলে আওয়ামী লীগ নেতারা ক্রুগ মিশন পরিকল্পনা নিয়ে হইচই করতাে। কিন্তু আজ এ ব্যাপারে তারা আশ্চার্যজনকভাবে নিগ্রুপ। ভয়াবহ বন্যা সমস্যা আমাদের জাতীয় অর্থনৈতিক প্রগতির পথে প্রধান বাধা হওয়া সত্ত্বেও এ ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। যােগাযােগ ব্যবস্থা এখনও মান্ধাতার আমলের । একটি দেশ কতটুকু উন্নত তা
Page 482
নির্ভর করে তার যােগাযােগ ব্যবস্থার উপর। অনুন্নত যােগাযােগ ব্যবস্থার জন্যে শহর ও গ্রামাঞ্চলের মধ্যে ব্যবধান দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে।
সাম্রাজ্যবাদের খপ্পরে বাংলাদেশ
বাংলাদেশ সরকার সাম্রাজ্যবাদের পক্ষপুটে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামে সােভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের ফলে যে অসময়ােচিত ছেদ পড়েছিল আমাদের বিপ্লব, তার ফলে স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশ সােভিয়েত-ভারত ব্লকে ঢুকে পড়েছিল। ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক সাহায্যের পথ ধরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ থাবা বিস্তার করেছে দেশের বুকে। ফলে বাংলাদেশ সরকার মার্কিনীদের নিকট আত্মসমর্পণ করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশকে নিয়ে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের মধ্যে শুরু হয়েছে এক অশুভ প্রতিযােগিতা এবং বাংলাদেশকে তারা ব্যবহার করছে দাবার ঘুটির মতাে।
আজ দেশের রাষ্ট্রযন্ত্র প্রতিক্রিয়াশীলদের কুক্ষিগত। সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সহ-অবস্থানকারী উঠতি ধনিক শ্রেণীর প্রতিভূ বর্তমান সরকার এখনাে ক্ষয়িষ্ণু সামন্তবাদী সমাজ কাঠামােকে টিকিয়ে রাখার ষড়যন্ত্র করে চলেছে। তাই আজকের সংগ্রাম হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ, নয়া উপনিবেশবাদ ও তাদের দেশীয় প্রতিনিধি উঠতি ধনিক শ্রেণী ও সামন্ত প্রভুদের বিরুদ্ধে। যারা তাদের কায়েমী স্বার্থের ভিত মজবুত করার জন্য আত্নসমর্পণ করেছে সাম্রাজ্যবাদের কাছে। সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে উৎখাত করতে হবে সাম্রাজ্যবাদের আশ্রয়স্থিত সরকারকে। এজন্যে কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের শ্রেণী সচেতন করে তাদের মধ্য থেকে সত্যিকারের নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে।
সংবিধান প্রশ্নে
বাংলাদেশ সরকার নতুন সংবিধান চালু করেছেন। আমরা আগেই বলেছি- এ সংবিধান একটি অকেজো সংবিধান। প্রতিক্রিয়াশীল ধনিক শ্রেণীর সংবিধান মেহনতী মানুষের আশা আকাক্ষার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। কিন্তু সংবিধানহীন একটি রাষ্ট্র চলতে পারে না। তাই আওয়ামী লীগ সরকার প্রদত্ত এই বাজে সংবিধানকে আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান হিসেবে গণ্য করি। আগামী দিনে সফল সামাজিক বিপ্লবের পর কৃষক-শ্রমিক- মেহনতী মানুষের সত্যিকার প্রতিনিধিদের প্রদত্ত সংবিধান চালু হলেই মেহনতী মানুষ মুক্তির নিশ্চয়তা পাবে।
নির্বাচন প্রসঙ্গে
জ্ঞানে অজ্ঞানে নির্বাচন বাংলাদেশের মানুষের কাছে একটা ম্যানিয়া হয়ে দাড়িয়েছে। নির্বাচনকে দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা যায়। প্রথমত, নির্বাচনকে ক্ষমতা দখলের অস্ত্র হিসেবে, দ্বিতীয়ত, সংগঠনের বক্তব্যকে ব্যাপক জনগণের কাছে পৌছে দিয়ে আন্দোলনের পর্যায় হিসেবে নির্বাচনকে গ্রহণ করা যায়। ১৯৩৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচনে জনগণ ভুল রায় দিয়েছে একথা বলা অন্যায় হবে। প্রতিটি নির্বাচনে জনতার রায় ছিল সঠিক। তবে জনগণের দায়িত্ব পালন করার দায়িত্ব নিয়ে যারা ক্ষমতার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে তারাই জনগণকে ধোঁকা দিয়েছে। নির্বাচনের সময় বড় বড় ওয়াদা এবং ক্ষমতায় গিয়ে তা বেমালুম ভুলে গিয়ে জনগণকে ধােকা দেওয়াই হলাে নির্বাচনে জয়লাভকারী দলগুলাের ইতিহাস।
Page 483
একটি সশস্ত্র সংগ্রামের পর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার কথাটি বিতর্কমূলক। বস্তুত নির্বাচনকে কী চোখে দেখা হবে তার ওপরে নির্ভর করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা না করা। যদি কেবল ক্ষমতা দখলের পর্যায় হিসেবে নির্বাচনকে গ্রহণ করা হয় তাহলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করাই শ্রেয়। কেননা নির্বাচন বুর্জোয়া ও পেটি বুর্জোয়া নেতৃত্বের সৃষ্টি করে যারা সব সময় তাদের শ্রেণী চরিত্রের খাতিরে জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে । আর যদি নির্বাচনকে জনমত গঠন, সংগঠনকে সুদৃঢ় ও আন্দোলনের পর্যায় হিসেবে গ্রহণ করা হয় তাহলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা যেতে পারে। কেননা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংগঠনের বক্তব্যকে ব্যাপক জনগােষ্ঠীর কাছে পৌছানাে এবং সংগঠনের কর্মক্ষেত্রকে দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তরে সম্প্রসারিত করে বিপ্লবী কর্মসূচিকে অক্ষুণ রাখা সম্ভবপর হয় এবং মূল কর্মসূচি অর্থাৎ সামাজিক বিপ্লবের জন্য জনমত গঠন করা যায় ।
একদিকে দেশীয় প্রতিক্রিয়াশীল গােষ্ঠীর ঢালাও শােষণ ও নির্যাতন, অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদী ও নয়া উপনিবেশবাদের কাছে ক্ষমতাসীন।সরকারের আত্মসমর্পণ জাতিকে এক চরম সর্বনাশের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। দেশে বিরাজমান এই নৈরাজ্য ও হতাশাজনক পরিস্থিতির মােকাবেলা করে শােষণমুক্ত সমাজ গঠনের জন্য একটি সফল সামাজিক বিপ্লব অপরিহার্য। এই সামাজিক বিপ্লবের নেতৃত্ব দেবে কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত ও প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের মধ্য থেকে গড়ে ওঠা নতুন নেতৃত্ব। বিপ্লবােত্তর বাংলাদেশে এই নতুন নেতৃত্বই বাস্তবায়ন করবে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র এবং একমাত্র বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে উৎখাত হবে শােষণের সর্বশেষ প্রক্রিয়া ও শক্তিসমূহ। সমাজতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থা কায়েমের মাধ্যমে গড়ে ওঠবে শােষণমুক্ত শ্রেণীহীন সমাজ। জনগণের মধ্যে যে উৎসাহ উদ্দীপনা আমরা লক্ষ্য করছি তা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। অফুরন্ত বৈপ্লবিক চেতনার অধিকারী মেহনতী জনতাকে সংগঠিত করে তাদের সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারলে বর্তমান স্বৈরাচারী সরকারকে উৎখাত করা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
আসুন, আমরা সর্বাত্মক আন্দোলনের মাধ্যমে বর্তমান ক্ষমতাসীন গণবিরােধী সরকারকে উৎখাত করার জন্য সর্বশক্তি নিয়ােজিত করি। মেহনতী জনতার জয়।অবশ্যম্ভাবী।
জয় বাংলা জয় বাংলার মেহনতী মানুষ।
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হউক।
কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির পক্ষে- আ স ম আব্দুর রব
Source: মুজিব বাহিনী থেকে গন বাহিনী ইতিহাসের পুনর্পাঠ – আলতাফ পারভেজ