বাহাত্তরের জনসমাজে সমাজতন্ত্র ও শ্রেণিসংগ্রাম যেভাবে ভীতিকর এক বিষয় হয়ে ওঠে
শ্রমজীবী জনগণকে শ্রেণীসংগ্রামে সংগঠিত করার কষ্টকর কাজকে পাশ কাটিয়ে, কিছু বাছাই করা কর্মী দিয়ে সশস্ত্র ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে দ্রুত বিপ্লব হাসিল করার তত্ত্বকে বার বার নতুন কায়দায় হাজির করা হচ্ছে। মার্কসবাদ যুগে যুগে এই তত্ত্বকে বাতিল করে এসেছে। সাম্প্রতিক অতীতে বিপ্লবী বিকাশের পক্ষে অসীম ক্ষতিকর এই ধরনের কর্মকাণ্ডের তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে। বহু আত্মনিবেদিত কর্মী হারিয়ে গেছে, প্রতিক্রিয়ার হাত শক্ত হয়েছে, শ্রেণীসগ্রাম গড়ে তােলার পথে অনেক প্রতিকূল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। ইতােমধ্যে এদের অনেকে এই পন্থার অসারতা বুঝেছেন, কিন্তু ঘাের কাটেনি।
– অমল সেন৫০৪
কমিউনিজম হলাে যৌথ মালিকানা ও যৌথ স্বার্থের সামাজিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা ও ব্যক্তিবাদমুক্ত কমিউনিস্ট চরিত্র অর্জনের তীব্র সংগ্রাম ব্যতীত চূড়ান্ত ব্যক্তিস্বার্থপরতার এই যুগে কমিউনিস্ট আন্দোলন তাই বেশি দূর এগােতে পারে না।
-মুবিনুল হায়দার চৌধুরী, কেন্দ্রীয় নেতা, বাসদ।৭০৫
মুজিব বাহিনী যেমন স্বাধীনতার নয় মাসে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে প্রধান এক চমক ছিল জাসদও তেমনি একের পর এক চমক তৈরি করে যাচ্ছিল স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে। সূচনালগ্নে জাসদের তরফ থেকে প্রধান চমক ছিল বিপ্লবের স্তর নির্ধারণকেন্দ্রিক। সে সম্পর্কে পূর্ববর্তী উপ-অধ্যায়ে আলােকপাত করা হয়েছে। তবে সেখানেই থেমে থাকেনি তারা, দ্রুত সশস্ত্র পথেও ধাবিত হয় দলটি। স্বাধীনতার মাত্র ১০ মাসের মধ্যে সমাজ বিশ্লেষণের ভিন্ন তাত্ত্বিক কাঠামাের আলােকে তারা যেমন একটি সমাজতান্ত্রিক দল’-এর ‘জন্ম দেয়- তেমনি দল গড়ার এক বছরের সামান্য কিছু পরেই তারা নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি ছেড়ে সশস্ত্র সংগ্রামের ‘লাইন’ গ্রহণ করে। তাজউদ্দীনের সবল ও সক্রিয় উপস্থিতি সত্ত্বেও
……………………………………………………………….
৫০৪) প্রয়াত কমিউনিস্ট নেতা। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাঁর বিস্তারিত রাজনৈতিক মূল্যায়নের জন্য দেখুন, অমল সেন, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন ও জনগণের বিকল্প শক্তি, কমরেড অমল সেন স্মৃতি ট্রাস্ট, ঢাকা, পৃ. ৩৩।
৫০৫) ১২ এপ্রিল ২০১৩ তারিখে ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবে বাসদের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি বিষয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে পঠিত বক্তব্য থেকে উদ্ধৃত।
Page 311
মুজিব ছিলেন পুরাে যুদ্ধকালে যাদের ভাবাদর্শিক নেতা- সেই একই সংগঠকরা ১৯৭২ সালের ২৩ ডিসেম্বর সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাসদের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্মেলনে মূল আদর্শিক দলিলে (সংযুক্তি এগারাে-এ দেখুন) শেখ মুজিবুর রহমানকে অভিহিত করেন নয়া উপনিবেশিক শক্তি হিসেবে। ঐ একই দলিলে তারা পরােক্ষে এও অস্বীকার করেন, শেখ মুজিবুর রহমান এই যুদ্ধের ভাবাদর্শিক নেতৃত্বে ছিলেন। দলিলে লেখা রয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-মেহনতী মানুষ সশস্ত্র বিপ্লবী যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল যুব সমাজের আহ্বানে।’ একই ঘােষণায় বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্রেফ ‘ভৌগােলিক স্বাধীনতা হিসেবে অভিহিত করে জাসদ এবং এর জন্য দায়ী করে যুদ্ধে ভারতের অসময়ােচিত প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ’কে!!৫০৬ অথচ মাত্র কিছু দিন আগেও জাসদ সৃষ্টির পূর্ব মুহূর্তে (ছাত্রলীগের অন্তর্কলহ যখন তীব্র, কিন্তু আনুষ্ঠানিক বিভক্তি শুরু হয়নি) তখন সিরাজুল আলম খানপন্থীরা ‘কমরেড শেখ মুজিব লাল সালাম’, ‘বিশ্বে এল নতুন বাদ – মুজিববাদ, মুজিববাদ’ ইত্যাদি শ্লোগানও দিতেন। কিন্তু যখনি মুজিব জুলাইয়ে ছাত্রলীগের মণি-মাখন-নূরে আলম সিদ্দিকীপন্থীদের সমাবেশে হাজির হলেন তখনি সিরাজ অনুসারীদের সব শ্লোগান পাল্টে যায়।
নতুন এই দলের ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল’ নাম গ্রহণও বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। জাতীয় সমাজতন্ত্র” বা “National Socialism’ সাধারণভাবে Nazism এর সমার্থক হিসেবে বিবেচ্য। হিটলারের গ্রন্থ ‘Mein Kampf’কে এই মতাদর্শের ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। উৎকট জাত্যাভিমান ও কমিউনিস্ট বিদ্বেষ ছিল নাজিদের জাতীয় সমাজতন্ত্রের ধারণার মূলকথা। এরূপ কিছু লক্ষ্যণীয় মিলকে ভিত্তি করে বাহাত্তরের বাংলাদেশে, জাসদের উৎস সংগঠন মুজিব বাহিনীর সঙ্গে নাৎসিবাদের তুলনা করতে দেখা যায় অনেককে। নাৎসিদের মূল শক্তি ছিল জঙ্গি তারুণ্য।৫০৭ মুজিব বাহিনী ও এর দ্বিতীয় প্রজন্মের অন্যান্য সংগঠনের ক্ষেত্রেও ছিল তাই।
………………………………………………………….
৫০৬) এই সংগঠকরাই মাত্র এক বছর আগে স্ব-ইচ্ছায় ভারতীয় গােয়েন্দা সংস্থার তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন ‘মুজিববাদ’ কায়েমের জন্য! মুজিব বাহিনীর এই সংগঠকরা যখন যুদ্ধ শেষে ভারতীয় সংশ্লিষ্টতার নতুন ব্যাখ্যা দিচ্ছেন তখন তাদের পূর্বতন ভূমিকার কোনাে ব্যাখ্যা দেননি বা জবাবদিহিতা করেননি। ফলে অন্যান্য বামপন্থীদের সন্দেহ ও বিস্ময়ের উদ্রেক না হয়ে উপায় ছিল না।
৫০৭) ১৯৩৩ সালে নাৎসিরা জার্মানির রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে তাদের তথাকথিত ‘জাতীয় সমাজতন্ত্র কায়েম করে। ১৯৩৩ সালে এ দলকে একমাত্র আইনানুগ দল ঘােষণা করা হয়। তবে ১৯৪৫ সালে নাৎসি জার্মানির পতনের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় সমাজতন্ত্র ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। নামে সমাজতন্ত্রী হলেও এ দল ইয়ােরােপে সমাজতন্ত্রীদেরই অধিক ক্ষতি করে বলে শেষােক্তদের অভিযােগ ছিল। দেখুন, হারুনুর রশীদ, রাজনীতিকোষ, মাওলা ব্রাদার্স, ১৯৯৯, ঢাকা, পৃ. ১৩৭-১৩৮।
Page 312
প্রতিষ্ঠার স্বল্পকাল পরেই ‘গণবাহিনী’ নামে সশস্ত্র শাখা গড়ে তােলে জাসদ। মুজিব বাহিনীর অপর অংশও ‘রক্ষীবাহিনীর মাধ্যমে আরও সশস্ত্র রূপে বিকশিত হওয়ার সুযােগ পায়। এসব অভিজ্ঞতা ছিল নাৎসিদেরই অনুরূপ। নাৎসিরাও Gestapo (জার্মান শব্দ ‘Geheime Staatspolizei’-এর সংক্ষিপ্ত রূপ) নামে একটি ঝটিকা বাহিনী গঠন করেছিল এবং তার সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সদস্যদেরও গােপন যােগাযােগ ছিল- যেমনটি ছিল গণবাহিনীর সঙ্গেও। যদিও Gestapo-এর চরিত্র ছিল যেখানে আক্রমণাত্মক সেখানে গণবাহিনীর ধরন ছিল অপেক্ষাকৃত আত্মরক্ষামূলক। তবে এসব বিতর্ক এড়াতেই বােধহয় জাসদ বা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল কখনাে তার নামের ইংরেজি ভাষ্য হিসেবে National Socialist Party লিখত না বরং লিখত Jatiya Samajtantrik Dal (JSD)। এ ছাড়া জাসদের সঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য National Socialist Party-র কোনাে ধরনের ভ্রাতৃপ্রতিম যােগাযােগ সূত্রও লক্ষ্য করা যায় না।৫০৮ তবে মুখ্য নেতৃত্ব যে সচেতনভাবেই ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল’ নাম গ্রহণ করেছিল তার প্রমাণ মেলে দলটির শুরুর সময়কার একজন তাত্ত্বিক মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর সাম্প্রতিক এক ভাষ্যে। ২০১২ সালের আগস্টে ঢাকার পাশে সাভারের গণবিশ্ববিদ্যালয়ে বাসদের।সাত দিনব্যাপী এক শিক্ষা শিবিরে বক্তৃতা দিতে গিয়ে জনাব হায়দার জাসদ গঠনকালীন সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন,
‘এখানে প্রথম যখন এলাম (পশ্চিমবাংলা থেকে), জাসদের সঙ্গে- তৈরি হয়নি জাসদ তখনও। একটা পিরিয়ডে সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে পরিচয় হলাে, খালেকুজ্জামানের সঙ্গেও পরিচয় হলাে। এই পরিচয়ের এক পর্যায়ে সিরাজুল আলম খানের মােটরসাইকেলে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াই। হঠাৎ দেখি কাগজে নতুন পার্টির আবির্ভাব। বললাম, এটা কি নাম দিলেন- এটা তাে জার্মান ফ্যাসিস্ট পার্টির নাম, ন্যাশনাল সােস্যালিস্ট পার্টির নাম। বললেন, না- এ দেশে জাতীয়তাবাদের যে তীব্র বাস্তবতা এখানে এভাবে যদি নাম না দিই তাহলে আমাদের দাঁড়াতে দেবে না।…আমিও এর মধ্যে ঢুকি।৫০৯
………………………………………………………………
৫০৮) তবে লক্ষ্যণীয়, উইকিপিডিয়াতে ‘non-european National Socialist Party (not related to Nazis)’-এর যে তালিকা রয়েছে (পর্যবেক্ষণ তারিখ ২৫.১২.১২) তাতে সাতটি দলের মধ্যে জাসদের নামও রয়েছে। এই তালিকার চারটি দলই ভারতীয় । দেখুন,
http://en.wikipeia.org/wiki/National_Socialist_Party
৫০৯) জনাব মুবিনুল হায়দার চৌধুরী কীভাবে জাসদে যুক্ত হন এবং কীভাবে পরে জাসদ থেকে বেরিয়ে বাসদ গড়ে তােলেন সে বিষয়ে অন্যত্র বিবরণ রয়েছে। বর্তমানে যে বক্তৃতার উল্লেখ
Page 313
মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর উপরিউক্ত বক্তৃতায় এও বিস্তারিত বিবরণ ছিল যে, তাত্ত্বিকভাবে কীরূপ অপ্রস্তুত অবস্থায় জাসদ সংগঠকরা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ডাক দিয়েছিলেন সেদিন এবং কীভাবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে এসইউসি-আই দলটির তাত্ত্বিক দলিলপত্র এনে সে সংকট মােকাবেলায় ভূমিকা রাখছিলেন তিনি। তবে প্রথম কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্মেলনের কয়েক সপ্তাহ পরই ১৯৭৩ সালের ১৪ জানুয়ারিতে, দলের ঘােষণাপত্র প্রকাশকালে জাসদ নিজেকে ‘মার্কসবাদী দল হিসেবে দাবি করে জানায়, বাংলাদেশে ইতােমধ্যে ধনতান্ত্রিক বিকাশ ঘটে গেছে, ফলে এখানে বিপ্লবের স্তর হবে সমাজতান্ত্রিক। এ বিষয়ে ইতােমধ্যে কিছুটা আলােকপাত করা হয়েছে। জাসদ সেসময় বাংলাদেশের উৎপাদন পদ্ধতি বিশ্লেষণ করে যেসব তাত্ত্বিক অনুসিদ্ধান্ত হাজির করে তা ছিল সংক্ষেপে নিম্নরূপ :
– জাতীয় বুর্জোয়াদের দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এখানে একটি বুর্জোয়া রাষ্ট্র কায়েম হয়েছে। এ বুর্জোয়া রাষ্ট্র সম্ভবপর আপেক্ষিক দ্রুততার সঙ্গে দেশে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটানাের চেষ্টা করছে।
– বাংলাদেশের জাতীয় আয়ে শিল্পের অবদান ৮ শতাংশ এবং কৃষির অবদান ৫৮শতাংশ। এই দুটিই কেন্দ্রীয় খাত। শিল্পের ক্ষেত্রে বলা যায়, তার চরিত্র তথা উৎপাদন সম্পর্কের বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণরূপে ধনতান্ত্রিক।
– অন্যদিকে কৃষিতে মুষ্টিমেয় লােকের হাতে ক্রমে দেশের বেশিরভাগ জমি কেন্দ্রীভূত হতে থাকা, গ্রামের অধিকাংশ লােকের ক্রমে সর্বহারা ও অর্ধ-সর্বহারা স্তরে নেমে আসার হার বৃদ্ধি পাওয়া, জমি পুঁজি বিনিয়ােগের উপায় হিসেবে রূপান্তরিত হওয়া, মালিক-মজুর সম্পর্কের ভিত্তিতে উৎপাদন হওয়া এবং সর্বোপরি কৃষিজাত উৎপাদন জাতীয় পুঁজিবাদী বাজারের পণ্যে পর্যবসিত হওয়া- এসব নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে, বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে পুঁজিবাদী অর্থনীতি।
– এই ধনতান্ত্রিক বিকাশধারাকে সংহত করাই হচ্ছে মুজিববাদী সরকারের উদ্দেশ্য। এই ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থাই বর্তমানে দেশের ও জনজীবনের সমস্ত সমস্যার মূল কারণ। ফলে বিপ্লবের আঘাতে এই ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করে তার পরিবর্তে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে সর্বহারা ও গরিব চাষীর সুদৃঢ়
………………………………………………………………..
৫১০) রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বর্তমানে বিরােধী অবস্থানে থাকলেও বাসদের অপর একটি গ্রুপের নেতা খালেকুজ্জামানদের তৈরি একটি দলিলেও (জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ গড়ে ওঠার পটভূমি, মার্চ, ২০১৩, ঢাকা, পৃ. ৪) এরূপ বক্তব্য রয়েছে যে, মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর মাধ্যমে এসইউসি-আই থেকে প্রাপ্ত বইপত্রই জাসদের অভ্যন্তরে মতাদর্শিক সংগ্রাম চালাতে তাদের সাহায্য করেছিল। ১৯৭৩-এ ঐরূপ সংগ্রামের ফলেই জাসদের অভ্যন্তরে একটি বিপ্লবী দল গড়ে তােলার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
Page 314
মৈত্রীর ভিত্তিতে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রবর্তন ছাড়া বাংলার শােষিত মানুষের মুক্তি নাই।৫১১
জাসদের এই তাত্ত্বিক দাবি দেশব্যাপী পরিবর্তন-আকাক্ষী তরুণ সমাজকে পুরানাে বামধারাসমূহের- যারা দেশে ‘গণতান্ত্রিক বিপ্লব’-এর জন্য কাজ করছিল-তাদের থেকে সরিয়ে আনতে কার্যকর প্রমাণিত হয়।৫১২ এসময় জাসদ দেশব্যাপী ‘ঘেরাও আন্দোলন’ নামের গণবিক্ষোভের ডাক দেয়- যা কার্যত সরকারের সঙ্গে দলটিকে সংঘর্ষের দিকে নিয়ে যায়। ঘেরাও আন্দোলনের পরিকল্পনার আগেই ১৯৭৪ সালের ৩০ জানুয়ারি এবং ৮ ফেব্রুয়ারি দু’ দফায় প্রতিবাদ কর্মসূচি ও হরতাল পালন করে জাসদ দেশজুড়ে আন্দোলনমুখী জঙ্গী অবস্থা তৈরি করে। ৮ ফেব্রুয়ারির হরতাল শেষে জাসদ তাদের ২৯ দফা’র সকল দাবি মেটানাের জন্য সরকারকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়। ৯ ফেব্রুয়ারি দৈনিক গণকণ্ঠে আট কলাম জুড়ে হেডলাইন ছিল- ‘শেষ সময় : ১৫ মার্চ’; পাশাপাশি এও বলা হয়, ১৫ মার্চের মধ্যে দাবি না মানলে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম শুরু হবে।’
এসময়, পুরাে তিয়াত্তর জুড়ে জাসদের প্রধান তৎপরতা ছিল প্রায় প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও জনসভা করা। জলিল, রব, শাজাহান সিরাজ প্রমুখ এসব সভায় বক্তৃতা দিতেন এবং প্রচুর লােকসমাগম হচ্ছিল তাতে। কিন্তু চুয়াত্তরের শুরু থেকে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির এই ধারায় কেন্দ্রীয় জাসদের আগ্রহ কমে আসে। এসময় জাসদের মুখপত্র গণকণ্ঠের লেখনিতেও লক্ষ্যণীয় পরিবর্তন দেখা যায়। ভিয়েতনাম যুদ্ধের নায়ক গিয়াপের ‘জনযুদ্ধ’, ‘ঘাটি এলাকা’ ইত্যাদি সংক্রান্ত লেখা এবং পার্টি গঠন’ সম্পর্কে মাও সেতুঙের বিশাল বিশাল লেখা
……………………………………………………………….
৫১১) বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও বিপ্লবের পর্যায় সম্পর্কে খসড়া থিসিস (৭৪- এর থিসিস নামে পরিচিত), জাসদ, ১৯৭৪, ঢাকা, পৃ. ২০-৩০।
৫১২) এ সময় বিশেষভাবে সিপিবি ঘরানা থেকে অভিযােগ ওঠে, জাসদ দেশের বামপন্থী রাজনীতিকে বিভ্রান্ত করার জন্য মাঠে নেমেছে। আলােচনার জন্য দেখুন, নজরুল ইসলাম, জাসদ রাজনীতি : একটি নিকট বিশ্লেষণ, প্রাচ্য প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৮১। সিপিবি প্রথম থেকে জাসদের প্রতি ছিল আক্রমণাত্মক। জাসদ নেতৃবৃন্দ যখন মুজিবকে বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান তখন সিপিবি’র মুখপত্র ‘একাতায় এর ব্যাখ্যা দিয়ে লেখা হয় (১ জুন ১৯৭২) : আ স ম রবের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ এবং তার সমর্থক শ্রমিক লীগের অনুসারীরা যেসব নীতির কথা বলছে তাকে আপাতদৃষ্টিতে বামপন্থী- এমনকি মার্কসবাদী চরিত্রের মনে হলেও প্রকৃত প্রস্তাবে এদের অবস্থান প্রগতি বিরােধী মহলকে শক্তি যােগাবে । শ্রেণিসংগ্রামের নামে এরা আসলে এমন এক মুহূর্তে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নেমেছে যখন জাতীয়করণের মতাে কর্মসূচি দক্ষিণপন্থী দলগুলাে কর্তক তীব্রভাবে সমালােচিত হচ্ছে।
উল্লেখ্য, সিপিবি এসময় ন্যাপ (মােজাফফর)-এর সঙ্গে মিলে ‘স্থিতিশীলতা ও দেশ পুনর্গঠনের স্বার্থে’ আওয়ামী লীগের সঙ্গে ‘ঐক্যবদ্ধ হতে চাচ্ছিল । যা ১৯৮০ সালে এসে তাদের তৃতীয় কংগ্রেসে ‘অদূরদৃষ্টি সম্পন্ন নীতি হিসেবে মূল্যায়িত হয়। দেখুন, সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ৭ মার্চ ১৯৮০, ঢাকা।
Page 315
ধারাবাহিকভাবে ছাপা হতে থাকে কাগজটিতে। অথচ মাত্র কয়েক বছর আগেও ঢাকায় স্থানীয় মাওবাদী ছাত্রসংগঠনগুলাে ছাত্রলীগের এ অংশের চক্ষুশূল ছিল । বস্তুত এসময় জাসদের কর্মকাণ্ড থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তারা সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে নেমে পড়ার পথ খুঁজছিল৫১৩ এবং ১৯৭৪ সালে ১৭ মার্চ ঢাকায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলীর বাসভবন ঘেরাওয়ের ফলে সৃষ্ট ঘটনাবলি তাদের সেই সুযােগ করে দেয়। ওই ঘেরাওকালে দেশের অন্যত্রও অন্তত ২৯টি জায়গায় দলটির সশস্ত্র ‘কিছু ঘটানাের পরিকল্পনা ছিল বলে উল্লেখ পাওয়া যায়।৫১৪ আসলে ১৯৭৪ সালের মার্চে ঢাকায় দলের এক বর্ধিত সভায় জেলা প্রতিনিধিরা। মত প্রকাশ করেন যে, ঢাকায় একটি টোকেন ঘটনা না ঘটালে সারা দেশে ঘেরাও আন্দোলন শুরু করতে অসুবিধা হবে।৫১৫ এর ফলেই ১৭ মার্চের ‘টোকেন ঘটনার পরিকল্পনা নেয়া হয় এবং পরিকল্পিত রূপ পেয়ে সেটি আর কার্যত ‘টোকেন থাকেনি বরং অনুমান করা হয়, ১৭ মার্চ অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে জাসদ নেতৃত্ব স্পষ্টভাবেই গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ছেদ টানতে চাইছিলেন।৫১৬
……………………………………………………………..
৫১৩) জাসদ থেকে সৃষ্ট খালেকুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন বাসদ এই ঘটনাকে অভিহিত করেছে। ‘গণআন্দোলন ও পেটি বুর্জোয়া রাজনীতিকে বিপ্লবী সংগ্রামে উত্তরণ ঘটানাের যান্ত্রিক প্রচেষ্টা হিসেবে। দেখুন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ গড়ে ওঠার পটভূমি, পূর্বোক্ত।
৫১৪) আশরাফ কায়সার, বাংলাদেশে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, মাওলা ব্রাদার্স, ১৯৯৫, ঢাকা, পৃ. ৪৩; আশরাফ কায়সার তার তথ্যের স্বপক্ষে জাসদ নেতা মাহবুবুর রব সাদীর গ্রন্থ বাংলাদেশের সামাজিক বিকাশ ও সমাজ বিপ্লব’ থেকে উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন। তবে বর্তমান লেখকের সঙ্গে ২০১২ সালের ২৯ অক্টোবর এক সাক্ষাৎকারে মাহবুবুর রব সাদী জানিয়েছেন, বিভিন্ন জেলায় উল্লেখযােগ্য কিছু ঘটানাের পরিকল্পনা থাকলেও কেবল হবিগঞ্জে এবং খুলনায় পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হয়। হবিগঞ্জে একজন যুবলীগ নেতা (আবদুল মতিন) নিহত হন এবং শেষােক্ত জেলায় (কামরুজ্জামান টুকুর নেতৃত্বে একটি থানা আক্রান্ত হয় । সাদী নিজে ১৭ মার্চের মিছিলে ছিলেন না। তবে তিনি বলেছেন, সেদিন যা ঘটেছে তা পরিকল্পিত এবং আরও বড় কিছুও ঘটতে পারত। খােদ মেজর জলিলও নিহত হতে পারতেন।’ উল্লেখ্য, এসব অভিজ্ঞতার আলােকেই মাহবুবুর রব সাদী কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম ব্যক্তি হিসেবে জাসদে পদ্ধতিগতভাবে ভিন্নমত তুলে ধরেছিলেন। যদিও দল ছেড়ে যাননি। জাসদ ভেঙে যখন বাসদ সৃষ্টি হয় তখন সাদী জাসদে থেকেই নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। তার ভাষায় ‘মাহবুব-মান্না-আখতারদের বের করে দেয়া ছিল তখনকার জাসদ নেতাদের সুস্পষ্ট ষড়যন্ত্র।
৫১৫) নজরুল ইসলাম, আগামীদিনের বাংলাদেশ ও জাসদ রাজনীতি, অনন্যা, ২০১৩, ঢাকা, পৃ. ১০৬।
৫১৬) জাসদের অভ্যন্তরে এই সময়কার পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মাহমুদুর রহমান মান্না দাবি করেছেন, “সিরাজুল আলম খানের ভূমিকা সেদিন সামগ্রিক প্রক্রিয়ার মূল নেতা হিসেবে মুখ্য ছিল না। ১৭ মার্চ [১৯৭৪] মনসুর আলীর বাড়ি ঘেরাওয়ের পর গণআন্দোলনের ছেদ ঘটিয়ে তাকে বিপ্লবী আন্দোলনে রূপান্তরের বক্তব্যের সঙ্গে যদিও তিনি একমত ছিলেন [যা জাসদের মূল লাইনের পরিপন্থী ছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে কয়েক বার তিনি গণসংগঠন বাদ দিয়ে গণবাহিনীতে যােগ দেওয়ার বিরােধিতা করেছেন।’ মান্না অবশ্য এও দাবি করেছেন যে, ১৭ মার্চে নিপীড়নের ঘটনা ছিল গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেকের মতাে। মিথ্যা ইতিহাসের ওপর জাতি দাঁড়াতে পারে না, পূর্বোক্ত।
Page 316
ঐদিনটি ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। স্বভাবত কঠোর কোনাে রাজনৈতিক কর্মসূচির জন্য এই দিনকে বাছাই করার মধ্যেই এক ধরনের উস্কানি ছিল। বিকালে জাসদ যখন উদ্বিগ্ন ঢাকার পল্টন ময়দান থেকে সমাবেশ শেষে মিছিল নিয়ে মিন্টো রােডে মন্ত্রিপাড়ায় রওনা হয় তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলী বাড়িতে ছিলেন না। তারপরও জাসদ নেতৃবন্দ তার কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার। উদ্দেশ্যে সেখানে অবস্থান করতে থাকে। এটা ছিল তাদের দেশব্যাপী ঘােষিত ‘ঘেরাও আন্দোলন’-এর সূচনালগ্ন। মিন্টো রােডে পৌছে এক পর্যায়ে মেজর জলিল ও আব্দুর রবের নেতৃত্বে বিক্ষোভকারীরা মন্ত্রীর বাসভবনের সামনে বসে পড়েন। প্রকৃতিতে তখন প্রায় সন্ধ্যা। এ সময় আইন প্রয়ােগকারী সংস্থা বাধা প্রদান করে, মিছিলকারীরাও হিংসাত্মক হয়ে ওঠে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এসময় মিছিলকারীদের দিক থেকেই কর্তব্যরত আইন প্রয়ােগকারী সংস্থার লােকজনের উপর প্রথম গুলিবর্ষণ হতে দেখা যায়। কয়েকজন আহত হয়। এতে। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে কর্তব্যরত আইন প্রয়ােগকারী সংস্থার সদস্যরাও মিছিলকারীদের উপর গুলিবর্ষণ করে। জাসদের মুখপত্র দৈনিক গণকণ্ঠের ভাষ্য অনু্যায়ী তাতে ১১ জন নিহত হয়। যদিও তারা মাত্র চারজনের পরিচয় জানাতে সমর্থ হয়। আর সরকারি প্রেসনােট অনুযায়ী মারা যায় তিনজন।৫১৭ নিহতদের অন্যতম ছিলেন বরিশাল বিএম কলেজের জিএস জাফর।
১৭ মার্চের ঘটনার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে শিগগির জাসদ ‘সাম্যবাদ’ নামে। একটি সার্কুলারের প্রথম সংখ্যা প্রচার করে। সার্কুলারে বলা হয়- এটা হলাে ‘বিপ্লবীদের মুখপত্র। সেখানে ১৭ মার্চে রক্ষীবাহিনীর গুলিবর্ষণে ৫০ জন নিহত হয় বলে দাবি করা হয় এবং হামলার জন্য সরকারকে দায়ী করা হয়।
ঘটনাটি যে একেবারে অপরিকল্পিত ছিল না তার প্রমাণ হিসেবে দেখা যায়, ঐদিন পল্টন থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ির উদ্দেশ্যে যাওয়ার সময়ই আ স ম রব। ঘােষণা করেছিলেন, “আজ ডাইরেক্ট এ্যাকশন শুরু হলাে। এমনকি জনসভা ও ঘেরাওয়ের পূর্বদিন ঢাকায় প্রস্তুতিমূলক যে মশাল মিছিল হয় তাতেই জাসদকর্মীদের পুরােপুরি নতুন একটি শ্লোগান দিতে দেখা যায়- ‘আগামীকালের ঘােষণা – জনযুদ্ধের সূচনা।’ খােদ ১৭ মার্চের দৈনিক গণকণ্ঠেও যে জাসদ ঘটনার ইঙ্গিত দিয়েছিল তা অবশ্য সেদিন সকালেও অনেক রাজনৈতিক ভাষ্যকার বুঝতে পারেননি। পত্রিকাটিতে এদিন জনসভা সংক্রান্ত রিপাের্টটি ছিল নিম্নরূপ :
…………………………………………………………………
৫১৭) বিস্তারিত দেখুন, মেহাঃ রােকনুজ্জামান, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ও বাংলাদেশের রাজনীতি, মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০০৫, পৃ. ৬০-৬২।
Page 317
আজ পল্টনে জাসদের জনসভা :
শােষিত জনতার ২৯টি দাবি আদায়ের জন্য প্রত্যক্ষ
সংগ্রামের কর্মসূচি দেওয়া হবে
স্টাফ রিপাের্টার : আজ ১৭ মার্চ, ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে জাসদের জনসভা। শােষিত, নির্যাতিত, মেহনতী মানুষের মুক্তি তথা শােষক ও শােষণ নির্মূল করার প্রত্যক্ষ কর্মসূচি ঘেরাও আন্দোলনের মাধ্যমে ব্যাপক সংগ্রামের সূচনা ঘটবে। শােষিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে।…আজকের দিনটি তাই জাতীয় জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।…জনতার শােষণ মুক্তির । সংগ্রামের ইতিহাসে ১৭ মার্চ ১৯৭৪ এক অযুত সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের ইঙ্গিত বহন করে শােষিত মেহনতী জনতার সম্মুখে আজ সমাগত। ঐতিহাসিক সতেরােই মার্চ স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে অস্থিরতম দিনগুলাের যবনিকা ঘটাবে।…৫১৮
বস্তুত ঘটেছিল উল্টোটি। চুয়াত্তরের ১৭ মার্চ বাংলাদেশের রাজনীতিক ইতিহাসকে নতুন এক অস্থিতিশীল অধ্যায়ে প্রবেশ করিয়ে দেয়। পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীকে উদ্দেশ্য করে সেদিনের গুলির ঘটনা সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে জাসদ নেতা নূর আলম জিকু বলেছেন, পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীকে লক্ষ্য করে বিনা উস্কানিতে তৎকালীন ছাত্রনেতা আ ফ ম মাহবুবুল হকসহ আরও অনেকে স্টেনগান দিয়ে ব্রাশফায়ার শুরু করেন।৫১৯
স্বভাবত এ ঘটনার পর রক্ষীবাহিনীসহ সরকারের পুরাে সশস্ত্র কাঠামাে রাজনৈতিক বিরুদ্ধমতের ওপর অভিযান শুরুর বাস্তব বৈধতা পেয়ে যায় । সংবিধানের দ্বিতীয় সংশােধনীর পর যার জন্য অপেক্ষা করছিল শাসকরা। সংঘাতের এই নতুন তরঙ্গেও উভয়পক্ষে মুজিব বাহিনীর সংগঠকরাই নেতৃত্ব দেন। ১৮ মার্চ তােফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক প্রমুখের নেতৃত্বে রাজধানীতে শাসকদলের মিছিল বের হয় এবং দুপুর ১২টায় মিছিলের একাংশ গিয়ে জাসদ অফিস পুড়িয়ে দেয়। জাসদ-ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও এভাবে প্রকাশ্যে অগ্নিসংযােগ করা হয়৫২০ পাশাপাশি সারা দেশে কয়েকশত নেতা-কর্মীকে
…………………………………………………………….
৫১৮) দৈনিক গণকণ্ঠ, ১৭ মার্চ ১৯৭৪, ঢাকা।
৫১৯) মােহাঃ রােকনুজ্জামান, পূর্বোক্ত।
৫২০) জাসদ কার্যালয়ে আগুন লাগানাের রিপাের্টটি দৈনিক বাংলার বাণীতে ছাপা হয় এভাবে : নেতারা পালিয়ে যান : কেউ হতাহত হননি। জাসদের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ভস্মীভূত
স্টাফ রিপাের্টার
গতকাল দুপুর বারটার দিকে একটি বিরাট জঙ্গী শােভাযাত্রা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের কেন্দ্রীয় দফতরে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এতে কেউ হতাহত হয়নি। জাসদ নেতারা বিক্ষুব্ধ শােভযাত্রা দেখে পালিয়ে যান।…গতকাল সার্কিট হাউস
আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে একটি সভা ডাকা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন সংসদ সদস্য গাজী গােলাম মােস্তফা…সভা শেষে একটি বিরাট শােভাযাত্রা শহর প্রদক্ষিণে বের হয়। মিছিলের অগ্রভাগে অন্যদের মধ্যে ছিলেন গাজী গােলাম মােস্তফা, তােফায়েল আহমেদ ও আবদুর রাজ্জাক।…জিপিও অফিসের সামনে আসতেই
মিছিলের একটি অংশ জাসদের সাইনবাের্ড দেখে আক্রোশে ফেটে পড়ে এবং সেখানে ঢুকে পড়ে। তারপরই জাসদ অফিস থেকে আগুনের ধােয়া বের হতে দেখা যায় ।…দৈনিক বাংলার বাণী, ১৯ মার্চ ১৯৭৪, ঢাকা।
Page 318
আটক করা হয়। গণকণ্ঠের সম্পাদক কবি আল মাহমুদও গ্রেফতারের হাত থেকে রেহাই পাননি।৫২১ গণকণ্ঠ ঘােষণা দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া না হলেও এর প্রকাশনার জন্য জরুরি যন্ত্রপাতি খুলে নিয়ে যায় সরকারের আধা-সামরিক বাহিনী। এ দফায় ১৩ দিন বন্ধ থাকে পত্রিকাটি। সর্বগ্রাসী এই আক্রমণের মুখে ‘আত্মরক্ষার্থে জাসদের নতুন সাংগঠনিক পরিচয় হয়ে ওঠে গণবাহিনী।৫২২
………………………………………………………………
৫২১) ১৯৭৪ সালের মার্চে মিন্টো রােডের এই ঘটনা ও তার প্রতিক্রিয়া কাকতালীয়ভাবে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল স্বস্ত্রীক লর্ড মিন্টোর ওপর ১৯০৯-এর নভেম্বরে আহমেদাবাদে চরমপন্থী বিপ্লবীদের বােমা হামলার কথা ! আলােড়ন সৃষ্টিকারী ঐ ঘটনায় অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে [ভাইসরয় ও গভর্নর জেনারেল অব ইন্ডিয়া; ১৮৪৫-১৯১৪] মিন্টো বিপ্লবীদের ওপর ব্যাপকভাবে প্রশাসনিক নিপীড়ন জারি করেছিলেন এবং যার আওতায় বিপিন চন্দ্র পাল, অরবিন্দ ঘােষ প্রমুখ আটক হন।
৫২১) ১৯৭৪ সালের ১৮ মার্চ সােমবার আল মাহমুদ আটক হন। আটক করেই তার বিরুদ্ধে চারটি মামলা দায়ের করা হয়। প্রায় এক বছর কারাগারে থাকতে হয় তাকে। মুক্তি পাওয়ার পর তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগে যােগ দেন। পরবর্তীকালে জাসদের সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতা লক্ষ্য করা যায় নি আর। আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কবির মুখ’-এ জাসদ গণকষ্ঠের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার আদ্যপান্ত উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, কারাগার থেকে মুক্তির পর একদিন শেখ মুজিবুর রহমান তাকে ডেকে নিয়ে শিল্পকলা একাডেমিতে চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। মুজিব চাইছিলেন না আল মাহমুদ আর কোনাে গণমাধ্যমে ফিরে যান। ততদিনে অবশ্য গণকণ্ঠও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। উল্লিখিত গ্রন্থে এমনও ইঙ্গিত মেলে, কারাগারে থাকাকালেই তার সঙ্গে জাসদের সম্পর্ক শীতল হতে শুরু করে এবং তার একজন নিকটাত্মীয় আমলা [এইচ টি ইমাম]ও তার মুক্তি ও চাকরির ব্যাপারে সরকারকে প্রভাবিত করেছিলেন, দেখুন, আল মাহমুদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৫১-২৬৭। উল্লেখ্য, আল মাহমুদ আটক থাকাবস্থায় কবি নির্মলেন্দু গুণ ঐ কাগজের তৃতীয় প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী সংখ্যায় বন্দি মানুষের গান’ নামে আলােড়ন সৃষ্টিকারী একটি কবিতা লিখেছিলেন।
৫২২) ১৯৭৪-এর মার্চের উপরােক্ত ঘটনাবলি এবং তার উত্তেজক পরবর্তী অধ্যায়কেই গণবাহিনীর কার্যক্রম শুরু আনুষ্ঠানিক সময় হিসেবে বর্তমান লেখায় উল্লেখ করা হলেও বিচ্ছিন্ন আকারে যে এই বাহিনীর তৎপরতা আরও অনেক আগেই জেলা পর্যায়ে শুরু হয়ে গিয়েছিল তার বিবরণ সপ্তম অধ্যায়ে বিস্তারিতভাবেই রয়েছে। তবে সম্প্রতি ২০১৪ সালের জুলাইয়ে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শরীফ নুরুল আম্বিয়া এই বাহিনীর সৃষ্টিকাল সম্পর্কে দাবি করেছেন, ১৯৭৫ সালে মুজিব কর্তৃক সংসদীয় রাজনীতির অবসানের পরই কেবল বিপ্লবী গণবাহিনী গঠন করা হয়। দেখুন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার জন্য দায়ী অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রকারীরা’, ৭ জুলাই, প্রথম আলাে, ঢাকা।
Page 319
এভাবেই মুক্তিযুদ্ধ শেষে মুজিব বাহিনীর অব্যবহৃত অস্ত্র ব্যবহারের নতুন করে সুযােগ তৈরি হয়। নতুন আরেক সশস্ত্র যুগে প্রবেশ করে বাংলাদেশ। অতীতে পূর্ববাংলা মাওবাদীদের গ্রামীণ শ্রেণি-সংগ্রাম দেখেছিল, এবার শুরু হলাে তার নতুন আরেক রূপ। নবপর্যায়ের ত্রিমুখী (রক্ষীবাহিনী-গণবাহিনী-নকশাল) এই শ্রেণিযুদ্ধ জেলা পর্যায়ে কীরূপ আধা-গৃহযুদ্ধাবস্থা তৈরি করেছিল সেটাই অনুসন্ধান। করা হয়েছে সপ্তম অধ্যায়ের শুরুতে অনেকগুলাে জেলার কেসস্টাডির আলােকে ।
উল্লেখ্য, জাসদ ও ছাত্রলীগের নেতৃস্থানীয় সংগঠকদের মাঝে কেবল শরীফ নুরুল আম্বিয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী না থাকা অবস্থায় তাঁর বাড়ি ঘেরাওয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে পূর্বাহ্নে আপত্তি তুলেছিলেন। এর বাইরে দলের এই কর্মসূচির বিরুদ্ধে ঢাকার বাইরে সবচেয়ে সংগঠিত প্রতিবাদ হয় চট্টগ্রামে ‘বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাত্রলীগ সমন্বয় কমিটির পক্ষ থেকে। তারা ১৮ মার্চ এক বৈঠকে পূর্বদিনের ঢাকার কর্মসূচিকে ‘হঠকারিতা হিসেবে মূল্যায়ন করে। এমনকি সেখানে তখনকার মেধাবী ছাত্রনেতা গােফরানুল হক৫২৩ এই হঠকারিতার প্রতিবাদে জাসদই ত্যাগ করেন। চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের এই ভূমিকার কারণে অন্তত একবছর কেন্দ্রের সঙ্গে তাদের যােগাযােগ বন্ধ ছিল। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ ঐ কর্মসূচি নিয়ে আপত্তি শুনতে প্রস্তুত ছিলেন না। অন্যদিকে ঐ সময়কার জাসদের এক তরুণ সংগঠক লিখেছেন, ১৭ মার্চের সভা শেষে মিছিল কোন দিকে যাবে অনেক নেতা-কর্মীই তা জানতেন না।৫২৪
স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়িতে হামলার সিদ্ধান্তটি আসলে কার?
তবে হামলার পরিকল্পনা যার বা যাদেরই হােক আওয়ামী লীগ ও রক্ষীবাহিনীর নীতিনির্ধারকদের জন্য এই পরিস্থিতি একটি সুযােগ হিসেবে আবির্ভূত হয়। জাসদ যতই ‘সমাজতন্ত্র’-এর দাবিতে এভাবে জঙ্গী রূপ নিচ্ছিল শেখ মণিসহ মুজিবের পাশের রক্ষণশীলদের জন্য ততই আশীর্বাদ হিসেবে আবির্ভূত হয় তা। কারণ সেটা জাসদকে উপলক্ষ্য করে সকল ধারার বামপন্থী ভিন্নমতের উপর ঝাপিয়ে পড়তে সুযােগ করে দিচ্ছিল। মুজিব বাহিনীর দু’ তরফ থেকে এইরূপ ধারাবাহিক উপলক্ষ্য তৈরি ও সুযােগ গ্রহণের সম্মিলিত ফল হয়েছিল এই, দেশে দু-আড়াই বছরের মধ্যে হাজার হাজার পরিবর্তন-আকাক্ষী তরুণকে জীবন দিতে হয়। সমাজতন্ত্র ও শ্রেণিসংগ্রাম পুরােপুরি এক ভীতিকর বিষয় করে তােলা হয় জনসমাজে। নতুন এই পরিস্থিতি জাসদ, অন্যান্য বামপন্থী শক্তি, শেখ মুজিবুর রহমানসহ কেউই আসলে সামাল দিতে পারেনি বরং এ থেকে
…………………………………………………………………
৫২৩) যিনি তখন চট্টগ্রাম-উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। চট্টগ্রামের সেই সময়কার আরেক ছাত্রনেতা সাহাবউদ্দীন সাথী সাক্ষাৎকারে এই তথ্য প্রদান করেছেন।
৫২৪) দেখুন, মহিউদ্দিন আহমদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৭৮। খালেকুজ্জামানরা ১৭ মার্চ’-এর ঘেরাওকে অভিহিত করেছেন ‘হঠকারী এক পদক্ষেপ হিসেবে- যা জাসদকে ‘গণবিচ্ছিন্ন করে ফেলে। দেখুন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ গড়ে ওঠার পটভূমি, পূর্বোক্ত।
Page 320
চূড়ান্ত সুযােগ গ্রহণ করে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন শক্তি, যারা পূর্ববাংলার যেকোনাে ধরনের সমাজতান্ত্রিক রূপ পরিগ্রহ করার ঘােরতর বিপক্ষে ছিল এবং যারা প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষে সংশ্লিষ্ট ছিল মুজিব বাহিনী গঠনে; এবং নতুন পরিস্থিতির স্রষ্টা ও আপাতদৃষ্টিতে প্রধান প্রধান প্রতিপক্ষ উভয়ে ছিল মুজিব বাহিনীজাত। এভাবে কার্যত ‘১৬ ডিসেম্বর’-এর আগে যেমন বিদেশি হস্তক্ষেপে স্বাধীনতা সংগ্রামকে ‘অপহৃত’ হতে দেখা যায়- ঠিক তেমনি ‘১৬ ডিসেম্বর’-এর পরে অপহৃত হয় সমাজতন্ত্রের সংগ্রামও। ফলে উপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামােই জারি থাকে বাংলাদেশ’ নামে; নতুন রূপে; আরও আক্রমণাত্মক আকারে; তবে পুরানাে ঢঙে।
সেই সময়কার জাসদের গুরুত্বপূর্ণ নেতা আ স ম আবদুর রব অবশ্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৭ মার্চের ভূমিকার উপরিউক্ত ব্যাখ্যা মেনে নিতে একেবারেই প্রস্তুত নন। সুদূর নিউ ইয়র্কের সুপরিচিত বাংলা কাগজ সাপ্তাহিক ঠিকানায় নিম্নোক্ত প্রশ্নোত্তর রূপে তিনি এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেন :
ঠিকানা : অনেকে বলেন, স্বাধীনতার পরপর আপনারা জাসদ করলেন, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে আন্দোলন করলেন,।স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও করলেন, কেউ কেউ মারা গেলেন। এ সবের কারণেই নৈরাজ্য সৃষ্টি হলাে এবং বঙ্গবন্ধু মারা গেলেন-
আ স ম রব : রিলিফ, কম্বল, টিন এগুলাে কি আমরা চুরি করেছিলাম? লুণ্ঠনের প্রতিবাদ হবে না? সম্পদ লুণ্ঠনের প্রতিবাদ। করবে না জনগণ? প্রতিবাদের জন্য ইনিসিয়েটিভ লাগে। (১৭ মার্চ) আমরা ইনিসিয়েটিভ নিয়েছিলাম। অল্টারনেটিভ ছিল না। আমরা বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম- না মেরে ফেলার জন্য এটা করেছিলাম। সেই মােটিভ জানতে হবে। অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করার অর্থ হচ্ছে- অন্যায় থেকে বিরত রাখা। আপনি আরও অন্যায় করেন এবং ধ্বংস হয়ে যান তার জন্য তাে প্রতিবাদ করা হয়নি।… ৫২৫
মাঠপর্যায়ে সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে তাড়া করতে তৎকালীন শাসক এলিটদের জন্য ১৭ মার্চ ছিল এক তাৎপর্যময় উপলক্ষ- তা ইতােমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৭ মার্চের ঘটনার দুই দিন পর শেখ মুজিবুর রহমান মস্কো যান ‘চিকিৎসার জন্য। এই সফর ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যময় এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের আরেকটি মােড় পরিবর্তনকারী ঘটনা। ক্ষমতায় থাকাকালে মুজিব ১৭ বার বিদেশ সফর করেছিলেন। তার মধ্যে মস্কো গিয়েছিলেন দু’দফা। সর্বশেষ
………………………………………………………………
৫২৫) বিস্তারিত দেখুন,
http://www.bostonbanglanews.com/index.phpoptions_com_content&view=article&id=14719%3A2012-08-19-10-42-39&catid=35%3A2010-10-11-16-49-
55&Itemed=138
Page 321
এই দফায় সেখানে তার ব্রঙ্কাইটিসের চিকিৎসা হয় এবং ২১ দিন পর ৯ এপ্রিল প্রথমে দিল্লি এবং তারও তিন দিন পর ঢাকায় ফেরেন তিনি। এসময় ঢাকায়। মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিকে জাসদ কর্তৃক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাওয়ের ঘটনার তীব্র সমালােচনা করতে দেখা যায়। ২২ মার্চ নিজস্ব মুখপত্র সাপ্তাহিক একতায় জাসদের ১৭ মার্চের কার্যক্রমকে তারা দেশদ্রোহীতামূলক হিসেবে অভিহিত করে এবং জনগণের স্বার্থেই এর মােকাবেলা করা দরকার বলে অভিমত ব্যক্ত করে।
এ পর্যায়ে উদীয়মান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সামাল দিতে শেখ মুজিব এক ধরনের ভারসাম্যের নীতি নিয়েছিলেন বলেই প্রতীয়মান হয়। জাসদের ঘেরাও আন্দোলনের পূর্ব মুহূর্তে ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি পাকিস্তানও গিয়েছিলেন। তার আগের দিনই পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। ভারসাম্যের এই নীতির মাঝে নানান স্ববিরােধী লক্ষণও ছিল। দিল্লি ও মস্কো সফর করার কিছুদিন পর তাজউদ্দীন আহমদকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়া হয়। আবার মুজিবের লাহাের সফরের কিছুদিন পরই প্রভাবশালী মুসলিম লীগ নেতা সবুর খানকে গ্রেফতার হতে দেখা যায়। এসব বিপরীতমুখী পদক্ষেপ স্ববিরােধী বার্তা দিচ্ছিল। ফলে, অভ্যন্তরীণ ফ্রন্টে নিয়ন্ত্রণ হারাতে বসা মুজিবকে রক্ষায় প্রভাবশালী বহিঃশক্তিসমূহ কেউই এসময় শেষপর্যন্ত এগিয়ে আসেনি।
দেশের মানুষ এসময় বিক্ষুব্ধ না হলেও তাদের মাঝে অস্থিরতার যথেষ্ট কারণ ঘটেছিল। ৯ জুলাই ১৯৭৪ বাংলাদেশ অবজারভার রিপাের্ট করে, ১৯৬৯-৭০ থেকে ১৯৭৩-৭৪ সময়ে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেছে শতকরা ১৮৪ ভাগ। এসময়কার দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতির অসহনীয় ঊর্ধ্বগতি, তার কাঠামােগত উৎস ও রাজনৈতিক তাৎপর্য সম্পর্কে পরের উপ-অধ্যায়ে আলােচনা করা হয়েছে। এ পর্যায়ে শুধু এটাই উল্লেখ করা হচ্ছে যে, মুজিব ইতােমধ্যে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে (১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ) শিল্প-ব্যাংক-বীমা ইত্যাদি জাতীয়করণের যে নীতি ঘােষণা করেন তাতে ছিল প্রচণ্ড রকম বিভ্রান্তি ।
প্রথমত, দেখা গেল পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ববাংলার শিল্পপতিদের উদ্যোগগুলাে (যা ছিল এ অঞ্চলের শিল্পের প্রায় ৮৫ ভাগ) রাষ্ট্রায়ত্তকরণ করা হলেও ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলাে তা থেকে বাদ থাকে। যেমন বিশাল চা খাতে ব্রিটেনের নাগরিকদের বিনিয়ােগ কোনােভাবে সরকারি হস্তক্ষেপের শিকার হয়নি।৫২৬
………………………………………………………………..
৫২৬) উপরন্তু এসময় বঙ্গোপসাগরে তেল উত্তোলনের জন্য কয়েকটি বিদেশি কোম্পানিকে আমন্ত্রণ জানানাে হয় যার মধ্যে ইউগােশ্লাভ ও জাপানি দুটি কোম্পানি ব্যতীত বাকি সব ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ নিয়ন্ত্রিত অংশ ছয়ভাগ করে যেসব কোম্পানিকে ঐ সময় বরাদ্দ দেয়া হয় তার মধ্যে ছিল : এটলান্টিক রিফিল্ড অয়েল কোম্পানি (যুক্তরাষ্ট্র), ইউনিয়ন অয়েল অব ক্যালিফোর্নিয়া (যুক্তরাষ্ট্র, এ্যাসল্যান্ড পেট্রোলিয়াম কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্র, ক্যানাডিয়ান সুপিরিয়র অয়েল কোম্পানি (কানাডা], জাপান পেট্রোলিয়াম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (জাপান] এবং ইনা-ন্যাপথালিন হিউগােশ্লাভিয়া]। দেখুন, মফিজ চৌধুরী, বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায়, ইউপিএল, ঢাকা, ১৯৯১, পৃ. ৭৮। মফিজ চৌধুরী ছিলেন ঐসময়কার জ্বালানিমন্ত্রী। যে কমিটির মাধ্যমে এই বরাদ্দ চূড়ান্ত হয় তাতে তাজউদ্দীন আহমদও সদস্য ছিলেন। মফিজ চৌধুরীর বিবরণ থেকে এও জানা যায়, উক্ত বরাদ্দকালে ‘প্রােডাকশন শেয়ারিং সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা দিতে ভারতের জয়েন্ট সেক্রেটারি পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা এ দেশে এসেছিলেন।
Page 322
দ্বিতীয়ত, শিল্পপ্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়ত্ত করা মানেই যে সমাজতন্ত্র নয়- তা বােঝার পরও কেবল আওয়ামী লীগ নয়, কমিউনিস্ট পার্টি এবং ন্যাপ (মােজাফফর)ও তুমুল হর্ষধ্বনি তােলে এতে। সমাজতন্ত্রের পথে প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ হিসেবে মুজিব একদলীয় ব্যবস্থা ঘােষণা করলে এসব দল নিজ নিজ অস্তিত্ব বিলীন করে বাকশালে একীভূত হয়ে যায়। কিন্তু তথাকথিত এই সমাজতান্ত্রিক পদক্ষেপের পরও শােষণমূলক সামাজিক সম্পর্কের কোনাে পরিবর্তন দেখছিল না শ্রমজীবী মানুষ।
তৃতীয়ত, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলাে সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার পর তা পরিচালনার জন্য এমন একদল নির্বাহীর হাতে ছেড়ে দেওয়া হয় যাদের ‘সমাজতন্ত্র সম্পর্কে ধারণা এবং আগ্রহ কোনটাই ছিল না। ফলে দ্রুত প্রতিষ্ঠানগুলাে শিকার হয় অব্যবস্থাপনার। এতে দুই তিন দশকে গড়ে ওঠা এ জনপদের শিল্প ভিত (যার মধ্যে ছিল অন্যান্য অনেককিছুর পাশাপাশি ৭০টি পাটকল, ১৭টি চিনিকল, ৭২টি বস্ত্রকল, ৩টি কাগজকল এবং এমনকি তেলশােধনাগারও!) লােকসানে লােকসানে জাতীয় বােঝায় পরিণত হয় এবং সরাসরি তাতে লাভবান হয় কয়েকটি বিদেশী দেশ। মুজিব এক্ষেত্রে প্রচণ্ডভাবে ভুল পরামর্শের শিকার হন পরিকল্পনা কমিশনের তরফ থেকে।৫২৭ তাকেই স্বাভাবিকভাবে এসবের অব্যবস্থাপনাজনিত দুর্নামের রাজনৈতিক দায়ভার বইতে হলেও ব্যক্তিগত পর্যায়ে তার অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে নিম্নোক্ত উক্তিতে : ‘..যাকে যেখানে বসাই সে-ই চুরি করে। অবস্থাপন্ন ঘরের শিক্ষিত ছেলেদের বেছে বেছে নানা কলকারখানায় প্রশাসক বানালাম, দুদিন যেতে না যেতে তারাও চুরি করতে শুরু করলাে। যাকে পাই বলি আমি সৎ লােক খুঁজে বেড়াচ্ছি।…’৫২৮
………………………………………………………………..
৫২৭) এ সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত ও আরও বিস্তারিত বিশ্লেষণ দেখুন, S. M. Ali, After The Dark Night, UPL, 1994, p. 108-29; Enayetullah Khan, Properties : Abandoned and Otherwise, Ibid, p. 353-55
. এ ছাড়া জাতীয়করণকৃত শিল্প ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলাে সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত দেখুন পরবর্তী উপ-অধ্যায়ে। এ বিষয়ে করাচির ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সােস্যাল এন্ড ইকোনমিক রিসার্চ-এর কিছু উপাত্ত রয়েছে সেখানে।
৫২৮) তৎকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবু ফজলের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতার সময় মুজিব উপরােক্ত মন্তব্য করেন। দেখুন, আবুল ফজল, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৮।
Page 323
কিছু কিছু ক্ষেত্রে অদক্ষতা বিপজ্জনক সব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি করে। যেমন ১৯৭৪-এর সেপ্টেম্বরে ঘােড়াশাল সার কারখানাটি অকেজো হয়ে গেলে দেশে ইউরিয়া উৎপাদন পূর্ববর্তী বছরের চেয়ে এক-তৃতীয়াংশে নেমে আসে। ১৯৭৩-৭৪ সালে ইউরিয়া উৎপাদন হয় ২ লাখ ৬৯ হাজার টন। পরের বছর হয় মাত্র ৮২ হাজার টন ৫২৯ কষি আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এতে। আবার বণ্টন ব্যবস্থার রাজনীতিকীকরণের ফলে ইউরিয়া আমদানি করেও পরে কৃষকদের কাছে সময়মতাে পৌছানাে যায়নি। অন্যদিকে পাট রপ্তানি কমে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার
ঘাটতি ছিল, ফলে প্রয়ােজনীয় ইউরিয়া আমদানিও করা যায়নি।
আশ্চর্যজনকভাবে লক্ষ্য করা যায়, মুজিব শাসনামলে যে, সমাজতন্ত্র’-এর নামে এরূপ নানান অঘটন ঘটবে তা যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় দূতাবাস গােপন প্রতিবেদনের মাধ্যমে ১৯৭০-এর জানুয়ারিতেই পূর্বাভাষ আকারে ওয়াশিংটনে জানিয়ে দিয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, ‘nationalization’ as conceived by the AL seems to us (local staff of USA) to mean Bengalization’ whereby West pakistani managers would be replaced by East Pakistanis and economic power would be shifted into local hands rather than controlled by ‘outsiders.৫৩০
অর্থনৈতিক বিপর্যকর এই সময়টিতে মুজিব বাহিনীর যে অংশ প্রধানমন্ত্রীর পাশে শক্ত অবস্থানে ছিল তারা প্রভাব বিস্তারের আন্তঃসংগ্রামে পরস্পর রাজনৈতিকভাবেও শক্তিক্ষয়ে লিপ্ত হয়। বিশেষত এ সময় শেখ মণি ও তােফায়েল আহমেদের দ্বন্দ্বের ছাপ পড়ে ছাত্রলীগের সরকার সমর্থক অংশে। ‘৭৪-এর ৩০ মার্চ ছাত্রলীগ নাটকীয়ভাবে বায়তুল মােকাররম প্রাঙ্গনে জনসভা করে দুর্নীতিবাজদের তালিকা প্রকাশ করে। ষাট ব্যক্তিকে তারা এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। এ সময় ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন মনিরুল হক চৌধুরী। তিনি ছাড়াও ঐ সভায় আরও বক্তৃতা করেন শফিউল আলম প্রধান, ইসমাত কাদির গামা, সওগাতুল আলম সেলিম ও ওবায়দুল কাদের। ওবায়দুল কাদেরই দুর্নীতিবাজদের তালিকাটি পাঠ করেছিলেন। সভায় বলা হয়, ২৯ এপ্রিলের মধ্যে দুর্নীতিবাজদের বিচার শুরু না হলে জনগণই তাদের বিচার করবে।৫৩১ উল্লেখ্য, এর কিছুদিন আগে (অক্টোবর) আওয়ামী লীগ নেতা ও প্রাক্তন মন্ত্রী মতিউর রহমানও মন্ত্রিসভার সদস্যদের ব্যাংক হিসাব ও সম্পদের বিবরণ প্রকাশের দাবি জানান। তবে
……………………………………………………………
৫২৯) ঘােড়াশাল সার কারখানা বিপর্যয় : মুষড়ে পড়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, দৈনিক বণিক বার্তা, ১৫ আগস্ট ২০১৩,
http://www.bonikbarta.com/first-page/2013/08/15/12291#sthash.bqHcP9Gi.dpuf
৫৩০) Roedad Khan, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৬৪।
৫৩১) দেখুন, দৈনিক ইত্তেফাক, ১ এপ্রিল ১৯৭৪, ঢাকা।
Page 324
বিশেষভাবে ছাত্র অঙ্গ সংগঠনের দুর্নীতি বিরােধী নাটকীয় ভূমিকা ক্ষমতাসীনদের মাঝে পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাস তীব্র করে তােলে। অনেকে একে তােফায়েল আহমেদ ও ফজলুল হক মণি’র দ্বন্দ্বের প্রকাশ হিসেবে চিহ্নিত করেন।
আওয়ামী লীগে বরাবরই ‘শক্তির উৎস হলাে ছাত্রলীগ। এসময় যুবলীগের পাশাপাশি শেখ মণি ছাত্রলীগেও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী ছিলেন। মুজিবের পাশে থাকা মুজিব বাহিনীর অবিচ্ছেদ্য চার’-এর অপরজন আবদুর রাজ্জাক তখন তােফায়েলের চেয়ে মণি’র কাছাকাছি। কিন্তু ছাত্রসংগঠনটির কর্তৃত্ব ছিল তখন শফিউল আলম প্রধানের হাতে এবং তিনি পরিচিত ছিলেন তােফায়েলপন্থী হিসেবে। ছাত্রলীগের উপরিউক্ত দুর্নীতি বিরােধী ভূমিকার এক সপ্তাহের মধ্যে (৪ এপ্রিল) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসীন হলে সাতজন ছাত্রলীগ কর্মী এক ব্রাশফায়ারে নিহত হন৫৩২ এবং এই হত্যাকাণ্ডে যুক্ত থাকার অভিযােগে শফিউল আলম প্রধান মিরপুর থেকে গ্রেফতার হন। এরপর ঢাকার স্পেশাল ৪র্থ ট্রাইব্যুনালে তার বিচার শুরু হয়। হত্যা মামলার বিচার চলাকালে ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ (সভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক) বিবৃতি দিয়ে শফিউল আলম প্রধানের পক্ষ নেয়। দুর্নীতি বিরােধী জনমত গঠনের চেষ্টায় শফিউল আলম মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন বলে ধারণা করা হচ্ছিল। পুরাে মুজিব শাসনামলে কেবল এই একটি আলােচিত হত্যাকাণ্ডই তদন্ত ও বিচারের আওতায় এসেছিল। শফিউল আলম প্রধানের গ্রেফতারের প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মিছিল বের হলে তাতে অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিরা গ্রেনেড ছুড়ে মারে। এরপরই বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায় দীর্ঘদিনের জন্য। শিক্ষাঙ্গনে ভূমিকম্পের মতাে সৃষ্ট এসব ঘটনাকে রাজনৈতিক মহল তখন বিবেচনায় নিয়েছিল মুজিব বাহিনীর সরকার সমর্থক অংশের পারস্পরিক বৈরিতার সশস্ত্র ফল হিসেবে।
উল্লেখ্য, মহসীন হল হত্যাকাণ্ডের জন্য শফিউল আলম প্রধান অভিযুক্ত হলেও ১৯৭৫ সালের আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কয়েক মাস পর তিনি ছাড়া পান এবং এখনও তিনি দিব্যি রাজনীতি করে যাচ্ছেন দেশে। মহসীন হলে সাত ছাত্রলীগ কর্মী খুনের কয়েক মাস আগে ১৯৭৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রাতে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে একই সঙ্গে আসাদ, শহীদ, মিন্টু ও মােশতাক নামে আরও চার যুবককে হত্যা করা হয়েছিল। এরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী না হলেও ছাত্রলীগ কর্মী ছিল। এও ছিল মুজিব বাহিনীর একাংশের উপদলীয় কোন্দলের
……………………………………………………………..
৫৩২) ওই নিহতরা হলেন নাজমুল হক কোহিনূর, মােহাম্মদ ইদ্রিস, সৈয়দ মাসুম আহমেদ, বশির উদ্দীন আহমেদ, জিন্নাহ, আবুল হােসেন ও রেজোয়ানুল। নিহত হওয়ার পরদিন ছাত্রাবাসে এদের কক্ষ থেকেও বিপুল অস্ত্র উদ্ধার হয়েছিল।
Page 325
জের।৫৩৩ উপরােক্ত দুটি ঘটনা দেশের প্রধান শিক্ষাপীঠের পরিবেশকে তীব্রভাবে ভীতিকর করে তােলে। অন্যদিকে এসময় শেখ মণি’র বিরুদ্ধে বিশেষত ঢাকাকেন্দ্রিক আওয়ামী পরিমণ্ডলে গাজী গােলাম মােস্তফার নেতৃত্বে আরেকটি উপদলের জন্ম হয়েছিল।৫৩৪ রেডক্রসের চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যাপক.দুর্নীতির অভিযােগ সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগরীর রাজনীতিতে তিনি তখন প্রভাবশালী ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। শাসকদলের একেবারে ক্ষমতার ভরকেন্দ্রে এসব কোন্দল যে কতটা পারস্পরিক আস্থার সংকট তৈরি করে তার একটি নজির পাওয়া যায় রক্ষীবাহিনীর তখনকার উপ-পরিচালক সারােয়ার মােল্লার সাম্প্রতিক এক ভাষ্যে।৫৩৫ যেখানে তিনি জানাচ্ছেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানকারী শক্তি যখন শেখ মণি’র বাসায় আক্রমণ করে তখন (ঐ বাসার বাসিন্দাদের তরফ থেকে) ধরে নেয়া হয়েছিল এটা রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা করছে। উল্লেখ্য, তখন এটাই অনমিত হতাে যে, রক্ষীবাহিনীর প্রতি প্রশাসনিক নির্দেশনা আসত প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব হিসেবে তােফায়েল আহমদের মাধ্যমে।
যুদ্ধোত্তর এই সময়টিতে Super-autonomous কাঠামাে হিসেবে মুজিব বাহিনীর নতুন অবয়বে বিস্তৃতি যেমন রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বহুমুখী বিভেদ, অবিশ্বাস ও সংঘাতের জন্ম দেয় তেমনি Supra-authority হিসেবে পরিকল্পনা কমিশন-এর ভূমিকাও রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রের মাঝে ব্যাপকভিত্তিক অবিশ্বাস ও বৈরিতার সৃষ্টি করেছিল। দ্বন্দ্ব ও বিভেদ সৃষ্টিকারী এই দুটি ভরকেন্দ্রই আবার
…………………………………………………………………
৫৩৩) এই তরুণরা খুন হন শামসুন নাহার হলের পার্শ্ববর্তী শিক্ষকদের আবাসিক এলাকায়। এ ঘটনায় চারজন মারা গেলেও ইদ্রিস নামে একজন আহত অবস্থায় বেঁচে যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. বি. ওয়াজিউর রহমানের স্ত্রী বিলকিস রহমান- যিনি তখন দ্য। মর্নিং নিউজ পত্রিকায় কাজ করতেন, উল্লিখিত ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। ১৯৭৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর এ বিষয়ে পত্রিকায় মতামত প্রকাশের কারণে সরকারি চাপে মর্নিং নিউজ থেকে চাকুরিচ্যুত হন তিনি। তবে ১৯৭৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর আহত ইদ্রিসের জবানিতে দ্য মর্নিং নিউজে এই হত্যাকাণ্ডের নায়কদের সম্পর্কে ইঙ্গিতপূর্ণ অনেক তথ্য প্রকাশিত হয়ে পড়লে তা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী অনেকের জন্য বিব্রতকর হয়ে ওঠে। বিস্তারিত দেখুন, Mahfuz Ullah, Ibid, p. 100.
৫৩৪) গাজী গােলাম মােস্তফা ছিলেন আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগরী শাখার সভাপতি। রেডক্রস নামক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হিসেবে যুদ্ধোত্তর সময়ে পুনর্বাসন কাজে এবং বিশেষভাবে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের সময় জনাব মােস্তফার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ ও বিতর্কিত । প্রচুর বিদেশি সহায়তা আসছিল তখন রেডক্রসের মাধ্যমে। কিন্তু অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির প্রচুর অভিযােগ উঠে প্রতিষ্ঠানটির বিপক্ষে। এর বাইরে গােলাম মােস্তফা বিশেষভাবে পরিচিতি পান তৎকালীন এক সামরিক কর্মকর্তা মেজর শরীফুল হক ডালিম ও তার স্ত্রী নিম্মীকে ঢাকার লেডিস ক্লাব থেকে অপহরণের ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার কারণে। উল্লেখ্য, ডালিমও বাংলাদেশের ইতিহাসে বিশেষভাবে আলােচিত- ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানে ভূমিকার কারণে।
৫৩৫) আমি সারােয়ার বলছি, অষ্টম কিস্তি, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৮ নভেম্বর ২০১২, ঢাকা।
Page 326
আবর্তিত হচ্ছিল সমাজতন্ত্রের উচ্চকিত শ্লোগানকে ব্যবহার করে এবং তার ভীতিকর রূপটি একেবারে মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারিত হয় ১৭ মার্চের সংঘর্ষমূলক ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে। জাসদেরই একটি ভিন্ন মতাবলম্বী গ্রুপ৫৩৬ পরে দলটির১৭ মার্চের কর্মসূচি মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলে,
…………………………………………………………………
৫৩৬) লক্ষীপুর খােলাচিঠি এপ নামে এই ভিন্নমতালম্বীরা বিশেষ পরিচিতি পান। ১৯৮১ সালের জুলাইয়ে গ্রুপের পক্ষে আ ও ম শফিক উল্ল্যা, মােহাম্মদ মহিউদ্দীন বি এ., আতিকুর রহমান, আলমগীর কবির, ওমর ফারুক, মােহাম্মদ ইসমাইল ও মতিউর রহমান খান ‘জাসদ- বাসদের ভ্রান্ত, দোদুল্যমান ও বিভ্রান্তিকর রাজনীতি প্রসঙ্গ’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। সেখান থেকেই উপরােক্ত উদ্ধৃতি দেয়া হলাে, পৃ. ৩০-৩১।
জাসদ কেন ১৭ মার্চের কর্মসূচি নিয়েছিল- যা কার্যত উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া মনে হয়েছে, তার একেবারে ভিন্ন একটি বিশ্লেষণ দিয়েছেন সেই সময়কার জাসদপন্থী শ্রমিক লীগের নেতা মেসবাহ্উদ্দীন আহমেদ। ২০১২ সালের ৩১ অক্টোবর বর্তমান লেখকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে। তার মতে ‘সেই সময়কার দুটি ঘটনা হয়তাে জাসদ নেতৃবৃন্দকে এভাবে দ্রুত একটা কিছু করার দিকে ঠেলে দিয়ে থাকবে। একটি ঘটনা ছিল ঢাকায় ভুট্টোকে নিয়ে জনতার উচ্ছাস এবং অপরটি ছিল দাউদ হায়দারের একটি কবিতা নিয়ে দক্ষিণপন্থীদের মিছিল-সমাবেশ। এই দুটি ঘটনায় মনে হয়ে থাকতে পারে, মুজিববিরােধী জনমত যে কোনােভাবে দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলাে নিয়ে নিতে পারে। তাই জাসদ দ্রুত আন্দোলনকে একটা উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যেতে উচ্চাভিলাষী হয়ে থাকতে পারে। মেসবাহউদ্দীন এও জানান, গণবাহিনী গড়ে তােলার সিদ্ধান্তটি জাসদের র্যাংক এন্ড ফাইলের সর্বব্যাপক কোনাে সিদ্ধান্ত ছিল না- কেন্দ্রীয় অর্গানাইজিং কমিটির মতামতে এ কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। বলা হচ্ছিল, ‘আত্মরক্ষা এবং প্রতিরােধ করা না গেলে কর্মীদের ধরে রাখা যাবে না। মেসবাহউদ্দীন বর্তমানে রাজনৈতিকভাবে গণফোরামের সঙ্গে আছেন, তবে নিষ্ক্রিয়।
[ উল্লেখ্য, ‘কালাে সূর্যের কালাে জ্যোৎস্যায় কালাে বন্যায়’ শীর্ষক কবিতাটির জন্য তীব্র জনঅসন্তোষ দেখা দিলে দাউদ হায়দারকে সরকার কলকাতাগামী একটি বিমানে তুলে দিয়েছিল ১৯৭৪ সালের ২১ মে। বিস্তারিত দেখুন,
http://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%A6%E0%A6%BE%E0%A6%89%E0%A6
%A6_%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A6%A6
%E0%A6%BE%E0%A6%B0 Ireterived on 20th Feb. 2013.]
জাসদের কুমিল্লাকেন্দ্রিক অন্যতম জাতীয় নেতা হাবিবুল্লাহ চৌধুরীও মেসবাহউদ্দীনের মতাে জাসদের অভ্যন্তরে সমরবাদিতা বিকশিত হওয়ার পেছনে নিজস্ব কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন বর্তমান লেখককে। যার মধ্যে ছাত্রলীগের জাসদ-বিরােধী অংশের উচ্ছলতা ও আক্রমণাত্মক মনােভঙ্গির কথা বলেন তিনি। ১৯৭২-এর ৪ জানুয়ারি ঢাকায় সচিবালয়ের সামনে থেকে সুপরিচিত মুক্তিযােদ্ধা স্টুয়ার্ট মুজিবের অপহরণকে তিনি সেই সময়কার একটি ভয় ছড়ানাে ঘটনা হিসেবে তুলে ধরেন। স্টুয়ার্ট মুজিবুর রহমান (জন্ম : ১৯৪০] ছিলেন আগরতলা মামলার ৩ নং আসামি এবং মুক্তিযুদ্ধকালে মাদারিপুর অঞ্চলের একজন খ্যাতনামা কমান্ডার। এর প্রায় দুই সপ্তাহ আগে ফরিদপুর অঞ্চলের আরেকজন খ্যাতনামা মুক্তিযােদ্ধা হাবিবুর রহমানকেও একইভাবে হত্যা করা হয়। হাবিবুর রহমান ছিলেন আগরতলা মামলার আসামি কমান্ডার মােয়াজ্জেমের অন্যতম সহযােগী এবং নৌবাহিনীর প্রাক্তন সদস্য। ১৮ ডিসেম্বর তাঁকে হত্যা করা হয়। অর্থাৎ বিজয় দিবসের মাত্র দু’দিন পর।
Page 327
‘ঘেরাও আন্দোলনের এই ব্যর্থ কর্মসূচিটি ছিল মূলত জাসদ রাজনীতির নিছক রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের প্রথম উম্মত্ত প্রচেষ্টা। মুজিবী দুঃশাসন ও নির্যাতনে অতিষ্ঠ জনগণকে সমাজ বিপ্লবের লক্ষ্যে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে- বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া-পদ্ধতির মাধ্যমে গড়ে ওঠা একটি বিপ্লবী পার্টির নেতৃত্বে সংগঠিত করার বদলে বিক্ষুদ্ধ, অসচেতন ও নেগেটিভ সমর্থনদানকারী হাজার হাজার জনতাকে উত্তেজিত করে ঘেরাও অভিযানে ঠেলে দেওয়ার যৌক্তিকতা কোথায়?…১৭ মার্চের কর্মসূচিটি সঠিক অর্থে বিপ্লবীকর্ম নয়। বড় জোর রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের একটি ব্যর্থ কর্মকাণ্ড- যা সফল হলে একটি নব্য ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রশক্তির জন্ম দেওয়া ছাড়া আর কিছুই সম্ভব ছিল না।’
জাসদের মাঠ পর্যায়ের একজন নেতা সিরাজগঞ্জের আবদুর রউফ পাতার ভাষায়, আমরা ঐ দিন দলকে জনআন্দোলনের ধারা থেকে অস্ত্রের রাজনীতিতে নিয়ে গেলাম। ১৭ মার্চ না ঘটলে আমাদের জনসম্পৃক্তির ধারা অব্যাহত থাকত এবং তিয়াত্তরের নির্বাচনে না পারলেও পরের নির্বাচনে জনগণ আমাদের বিজয়ী করত। তিয়াত্তরে মানুষ আমাদের বলছিল, এবার তােমাদের দিচ্ছি না, পরেরবার দেবাে। মুজিবকে তারা তখনও সময় দিতে চাইছিল।”৫৩৭
কেন্দ্রীয়ভাবে জাসদ নেতৃবৃন্দ অবশ্য এরূপ বিশ্লেষণ একেবারেই মানতে নারাজ ছিলেন। নিজস্ব তাত্ত্বিক মুত্রপত্র ‘সাম্যবাদ’-এ তারা ঐদিনের ঘটনাকে তুলনা করে রাশিয়ার ১৯০৫ সালের ২২ জানুয়ারির রক্তাক্ত রবিবার, ১৯ ডিসেম্বরের স্টিল শ্রমিকদের মস্কো অভ্যুত্থান; চীনের ১৯১৯ সালের ৪ঠা মে আন্দোলন এবং কিউবার বিপ্লবীদের ১৯৫৩ সালের মনাকাড়া দুর্গ আক্রমণের সঙ্গে।৫৩৮
জাসদ আশা করেছিল, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবনের সামনে সৃষ্ট ঘটনাবলি একটা স্ফুলিঙ্গ ঘটাবে, বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনে কয়েকজন ছাত্রের মৃত্যু যেমনটি ঘটিয়েছিল। কিন্তু ১৭ মার্চ নিহতের সংখ্যা বায়ান্ন সালের চেয়ে বেশি হওয়া সত্ত্বেও জনসাধারণ্যে তা পর্যাপ্ত আলােড়ন তােলেনি। এর চেয়ে, ১৯৭৩-এর মে মাসে মাওলানা ভাসানী যখন ‘দ্রব্যমূল্য কমানাে, দমননীতি বন্ধ করা এবং জানমালের নিরাপত্তা সংক্রান্ত তিনদফা দাবিতে অনশন ধর্মঘটের মতাে অহিংস কর্মসূচি পালন করছিলেন তখন মানুষ অধিক আগ্রহী হয়ে উঠেছিল বিরােধী দলের
…………………………………………………………………
৫৩৭) সিরাজগঞ্জে জাসদের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন তিনি। তার এই সাক্ষাৎকারটি নেয়া হয় ঢাকায় ২০১২ সালের ১৬ নভেম্বর। সেসময় তিনি স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
৫৩৮) বিস্তারিত দেখুন, সংযুক্তি বারাে-এ।
Page 328
প্রতি।৫৩৯ কিন্তু জাসদের ১৭ মার্চের পর জনগণ ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বুদ্ধ হওয়ার পরিবর্তে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। যে কারণে লক্ষ্য করা যায় ১৭ মার্চের হত্যালীলার প্রতিবাদে জাসদ আহুত পরের দিনের হরতাল পালিত হয় অবিশ্বাস্য নির্লিপ্ততা ও উদ্বেগের সঙ্গে। উপরন্তু এদিন সরকারি দলের কর্মীরা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঢাকায় বিশাল মিছিল করে জাসদকে শায়েস্তা করার প্রস্তুতির কথা জানিয়ে দেয় । জাসদ কর্মীদের মােকাবেলায় এসময় দেশের প্রায় সকল জেলা শহরে ১৪৪ ধারা জারি হয়। তারপরও জাসদ নিজস্ব চলমান রণনৈতিক অবস্থানের পক্ষে ছিল দৃঢ়; তাদের ভাষায়,
“১৭ মার্চের ঘটনা আকস্মিক ছিল না। এটা ছিল স্বাধীনতা-উত্তর রাজনৈতিক বিকাশেরই অনিবার্য ধাপ। নিরস্ত্র জনতার ওপর খুনী মুজিব সরকারের সেদিনের গুলিবর্ষণ ২৫ মার্চের গণহত্যার সঙ্গে তুলনীয়। ২৯ দফা দাবিতে গড়ে ওঠা গণআন্দোলনকে নস্যাৎ করাই ছিল সরকারের এই হঠকারি কাজের উদ্দেশ্য। এ ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিকে এক নতুন পর্যায়ে উন্নীত করেছে। এটা উৎপাদন করতে বাধ্য সেই স্ফুলিঙ্গ- যা বিরাটকায় অগ্নিকাণ্ড ঘটাতে পারে। ১৭ মার্চ প্রমাণ করেছে, বাংলাদেশের আজকের পরিস্থিতিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন ও সাধারণ হরতাল
…………………………………………………………….
৫৩৯) মাওলানার অনশনকে ঘিরে সেসময় বিরােধী দলগুলাের মাঝে এক দফা ঐক্য গড়ে ওঠার পরিবেশ তৈরি হয়। সেসময় রাজনৈতিক দলগুলাের মাঝে সিদ্ধান্ত হয়েছিল ২২ মে (১৯৭৩) সর্বদলীয় সভা ডাকা হবে। ২৯ মে থেকে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হবে। কিন্তু শিগগির জাসদ এই ঐকমত্য থেকে বেরিয়ে যায়- যা অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে বিস্মিত করে। অন্যদিকে আওয়ামী কর্মী-সমর্থকরা সর্বদলীয় সভাটিও পণ্ড করে দেয়। মিছিল করে এসে তারা মাঠের সমাবেশস্থলে গুলি চালায়। জাসদ ও আওয়ামী লীগের এরূপ প্রতিক্রিয়ায় সে দফায় মাওলানার অনশন ব্যর্থ হয়। ১৫ মে শুরু করে ১৮০ ঘণ্টা অনশন শেষে সহকর্মীদের অনুরােধে তিনি নিজেই এক পর্যায়ে কর্মসূচি ত্যাগ করেন। ঐ সময় আরেকটি ঘটনার মাধ্যমেও রাজনৈতিক অঙ্গনে জাসদ অন্যান্য বাম দলের কাছে নিজেকে সন্দেহের বিষয় করে তােলে- তা হলাে ১৯৭৩-এর নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নে। সে অবস্থার বিবরণ দিয়ে সাংবাদিক-রাজনীতিক নির্মল সেন লিখেছেন :
সেসময় সকলের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিলাে নির্বাচন অবাধ হবে না। আওয়ামী লীগের সঙ্গে মূল সংঘর্ষ হচ্ছিলাে জাসদের। তাদের অনেক প্রার্থী হাইজ্যাক হচ্ছিলাে। কিন্তু মুস্কিল হলাে জাসদ নির্বাচনের মাঠে থাকলে তা বর্জনের অবকাশ কোথায়? তাদের সেকালের কথাবার্তা শুনে আমার মনে হতাে নির্বাচনকে গ্রহণযােগ্য করানাের জন্যই তারা মাঠে নেমেছে। জাসদ নেতৃবৃন্দ প্রতিদিনই হুমকি দিচ্ছিলেন, এ ধরনের আর একটি ঘটনা ঘটলে তারা নির্বাচন বর্জন করবে। কিন্তু এ ধরনের বিবৃতি দিয়েই তারা নির্বাচনপর্ব পার করে দিলেন।… দেখুন, নির্মল সেন, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৮৬-৮৭।
তবে একই বিষয়ে জাসদের ব্যাখ্যা ছিল, সামাজিক বিপ্লবের পক্ষে জনমত গঠন ও সংগঠনকে দৃঢ় করার লক্ষ্যে তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণের পক্ষে। দেখুন, জাসদের প্রথম কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্মেলনে আহ্বায়ক কমিটির বক্তব্য, সংযুক্তি এগারাে।
Page 329
সংগ্রামের স্বাধীন ও প্রধান ধরন হিসেবে প্রায় অচল।…বিপ্লবী অভ্যুত্থান একটি আর্ট, তার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সাহসী ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ আক্রমণ।”৫৪০
এসব উত্তেজক বক্তব্য ফ্যাসিবাদকে প্রায় আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে এসেছিল বলা যায়। কিন্তু সেদিনের বাস্তবতা প্রমাণ করে, জাসদ সাহস ও দৃঢ়তার সঙ্গে রক্ষীবাহিনীর পাল্টা আঘাত মােকাবেলা করতে পারেনি। রাজনীতির নিরস্ত্র পথে বস্তুত তা সম্ভবও ছিল না। সরকারপন্থী প্রধান দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ (রক্ষীবাহিনী ও যুবলীগ) ছিল প্রকাশ্য কিংবা পরােক্ষে সশস্ত্র । তাছাড়া আওয়ামী লীগের ছিল তৃণমূল পর্যন্ত শক্তিশালী এক সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক। পাল্টা আক্রমণ সামাল দিতে তাই প্রতিরক্ষা ব্যুহ হিসেবে গণবাহিনী গড়ে তােলার কাজে পুরাে শক্তি নিয়ােজিত করে জাসদ। এসময় চারজন নেতা- হাসানুল হক ইনু, শরীফ নুরুল আম্বিয়া, কাজী আরেফ আহমেদ ও মনিরুল ইসলাম (মার্শাল মনি নামে যিনি পরিচিত ছিলেন) বিশেষভাবে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন দলের সাংগঠনিক পরিসরে। গণবাহিনীর কাণ্ডারি ছিলেন তাঁরা। এভাবে দলে নতুন একটি প্রভাবশালী উপদল তৈরি হয়। কেউ কেউ যে আবার শ্লেষ সহকারে এদের ‘গ্যাং ফোর’ হিসেবে অভিহিত করতেন সে বিষয়টি ইতঃপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। এর বিপরীতে ‘গণনেতা’ রব-জলিল-শাজাহান সিরাজের আবেদন ও ভূমিকা খর্ব হয়ে পড়ে। এসময় নিজস্ব তাত্ত্বিক মুখপত্র ‘সাম্যবাদ’-এর দ্বিতীয় সংখ্যাতে জাসদ মাও সেতুঙকে উদ্ধৃত করে ঘােষণা দেয়- দেশে এখন যুদ্ধাবস্থা চলছে- এখানে সংগ্রামের প্রধান রূপ হচ্ছে যুদ্ধ আর সংগঠনের প্রধান রূপ হচ্ছে সৈন্যবাহিনী।৫৪১ জাসদ কর্মীদের শ্লোগানগুলােও তখন পাল্টে যায়; জঙ্গী হয়ে ওঠে। আগে শ্লোগান ছিল : ‘সংগ্রাম সংগ্রাম শ্রেণীসংগ্রাম’; জনগণের মন্ত্র- বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র
……………………………………………………………..
৫৪০) ১৭ মার্চ সম্পর্কিত ঘটনার বিষয়ে জাসদের তৎকালীন পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, ‘সাম্যবাদ’ (প্রথম সংখ্যা)। পত্রিকাটিতে প্রকাশকাল, সম্পাদকীয় কার্যালয় ইত্যাদির কোন উল্লেখ ছিল না। সাম্যবাদের প্রথম সংখ্যা পুরােটাই প্রকাশিত হয় ১৭ মার্চের বিপ্লবী শিক্ষা শিরােনামে দীর্ঘ এক লেখা নিয়ে । সংযক্তি : বারাে।
৫৪১) ‘সাম্যবাদ’-এর দ্বিতীয় সংখ্যাটি পুরােপুরি গণবাহিনী গঠন ও এর অভিযানকেন্দ্রিক দার্শনিক, রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক দিকের ওপর আলােকপাত করে প্রকাশিত হয়। এ সংখ্যাতেও প্রকাশকাল, সম্পাদকীয় কার্যালয় ইত্যাদির উল্লেখ ছিল না। দেখুন, সংযুক্তি তেরাে।
উল্লেখ্য, ১৭ মার্চের সৃষ্টি এবং সাম্যবাদের দ্বিতীয় সংখ্যার উপরােক্ত বক্তব্য সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে জাসদের তখনকার একজন জ্যেষ্ঠ নেতা হাবিবুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘জাসদের অভ্যন্তরীণ একটি গােষ্ঠী সচেতনভাবে এসব করেছে। তারা চেয়েছিল একটা কিছু ঘটিয়ে গণসংগঠনের নেতাদের জেলে ঢােকার পটভূমি তৈরি করতে এবং সশস্ত্র শ্রেণিভিত্তিক সংগঠন গড়ে তুলতে । কিন্তু শেষােক্ত কাজে যাদের নেতৃত্ব দেয়ার সুযােগ করে দেয়া হয় তাদের গণসংগঠনের কাজের অভিজ্ঞতা ছিল অতি নগণ্য। ফলে দ্রুত তারা পুরাে কার্যক্রমকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। পূর্বোক্ত।
Page 330
ইত্যাদি। গণবাহিনীর কার্যক্রম শুরুর পর শােনা যেতে থাকে : ‘রাইফেলের বিরুদ্ধে রাইফেল তুলে নাও- এলএমজির বিরুদ্ধে এলএমজি তুলে নাও’; শ্বেত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লাল সন্ত্রাস ছড়িয়ে দাও’ ইত্যাদি শ্লোগান।
এইরূপ জঙ্গী পরিস্থিতির প্রধান এক শিকার ছিল জাসদ-ছাত্রলীগ নিজেই। ‘যেহেত গণবাহিনীতে ব্যাপক জনগণের অংশগ্রহণ ছিল না সে কারণে গণসংগঠনগুলাের সদস্যদের মধ্যে থেকে গণবাহিনী গড়ে উঠতে লাগল। এভাবে গণসংগঠনগুলাের অপমৃত্যু ঘটতে শুরু করল।৫৪২ তখনকার ছাত্রনেতা মাহমুদুর রহমান মান্নার ভাষায় ছাত্র সংগঠনের কাজ বাদ দিয়ে গােপন ও সশস্ত্র কাজে যােগ দেওয়ার হিড়িক পড়ে যায় প্রচণ্ড উদীয়মান এই সংগঠনে।… বছর তিনেক পরে যখন এই উত্তেজনা থামল তখন তাদের বিপ্লবের অগ্নিশিখার তেমন কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। ৫৪৩ লক্ষ্যণীয়, ১৯৭২-এ জাসদ ছাত্রলীগের আবির্ভাব দেশের ক্যাম্পাসগুলাে ছাত্র ইউনিয়নকে অপ্রাসঙ্গিক করে ফেলেছিল। আর ১৭ মার্চকে উপলক্ষ করে ধীরে ধীরে একই পরিসরে ছাত্রলীগকেও বিধ্বস্ত করে দেয় রাষ্ট্র। এভাবেই কার্যত অবসান ঘটে শিক্ষাঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধোত্তর সমাজতান্ত্রিক প্রজন্মের ।
১৭ মার্চ সৃষ্ট গণবাহিনীর আরেকটি অভিপ্রকাশ দেখা যায় এ সময় সেনাবাহিনীতে। সে সম্পর্কেও এ পর্যায়ে কিছু আলােচনা করা প্রাসঙ্গিক হবে। বস্তুত জাতীয় পরিসরে দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের পরপর জাসদ সেনাবাহিনীতে বিস্তার কার্যক্রম শুরু করেছিল। সেনাবাহিনীতে ঐ কার্যক্রম শুরু হয় গণবাহিনীর শাখা হিসেবে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার মাধ্যমে। যে তৎপরতার চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে আমরা দেখবাে পঁচাত্তরের নভেম্বরে ‘সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান।৫৪৪ এপর্যায়ে জাসদ রাজনীতিতে, বিশেষত এর সামরিক শাখা হিসেবে গণবাহিনীর
………………………………………………………………
৫৪২) ১৯৭৯ সালের ১৮ মার্চ প্রকাশিত জাতীয় কমিটির আত্মসমালােচনামূলক দলিল, যার শিরােনাম ছিল শুধু সদস্যদের জন্য।’ পূ, ২১-২২। মাহমুদুর রহমান মান্না সম্প্রতি এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, আত্মসমালােচনামূলক ঐ দলিলটি ছিল তাঁর লেখা এবং একপর্যায়ে জাসদের কয়েকজন নেতা এর প্রচার বন্ধ করে দিয়েছিলেন। মিথ্যা ইতিহাসের ওপর জাতি দাঁড়াতে পারে না, পূর্বোক্ত। মান্নার এই বক্তব্যও বিস্ময়কর। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী সংসদের সহ-সভাপতি হিসেবে তিনি তখনও আনুষ্ঠানিকভাবে জাসদের সাংগঠনিক কেউ নন- অথচ তাকেই লিখতে হচ্ছে জাসদের আত্মসমালােচনামূলক দলিল। বিষয়টি আরও করুণ হয়ে ওঠে- যখন আত্মসমালােচনামূলক এই দলিল লেখার কারণে মান্নাকে বহিষ্কার করা হয় এবং এই বহিষ্কারাদেশকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ ভেঙে যায়।
৫৪৩) মাহমুদুর রহমান মান্না, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪১। গণবাহিনী গঠন থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় সবকিছুকে আমি তখন হঠকারি বলে উল্লেখ করেছিলাম’- দাবি করেছেন মান্না সাম্প্রতিক এক লেখায়। পূর্বোক্ত । তবে মান্না নিজেও গণবাহিনীর ময়মনসিংহ এলাকার নজরদারির দায়িত্বে ছিলেন সেসময়।
৫৪৪) এই অভ্যুত্থানের বিস্তারিত বিবরণের জন্য দেখুন, আলতাফ পারভেজ, পূর্বোক্ত। বহিষ্কার করা হয়ে ওঠে- যখনতে হচ্ছে জাসদে
Page 331
কার্যক্রমে ব্রাজিলের মার্কসবাদী বিপ্লবী কার্লোস ম্যারিগেল্লার ভাবাদর্শিক প্রভাব সম্পর্কেও সংক্ষেপে আলােকপাত করা দরকার।
পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলােতে ইতঃপূর্বে জাসদ রাজনীতির পুরােপুরি সামরিক রূপ পরিগ্রহ করার আত্মগত ও বস্তুগত পটভূমি সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। এটাও বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় জাসদ, সামান্য ব্যতিক্রম বাদে- পুরােপুরি গণবাহিনী গঠনে অনুমােদন দিয়েছিল। কিন্তু সামরিক এই শাখার বিকাশের ধরন সম্পর্কে এর দায়িত্বপ্রাপ্ত মূল সংগঠকদের সঙ্গে দলটির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ভাবনার দূরত্ব ছিল বলেই প্রতীয়মান হয়।৫৪৫ তবে রাজনৈতিক ও সামরিক ঘটনাবলি এত দ্রুত এগােচ্ছিলাে এবং হাতে অস্ত্র থাকায় গণবাহিনীর সদস্যরা তাতে এত তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া দিচ্ছিলাে যে, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তাতে লাগাম টেনে ধরার কোনাে সুযােগই পাননি। যদিও সেরকম কোনাে ইচ্ছা তাদের ছিল কি না তারও প্রমাণ মেলে না। এসময়ই গণবাহিনীর ঢাকাকেন্দ্রিক মূল নেতৃত্বে কার্লোস ম্যারিগেল্লার ‘মিনিম্যানুয়েল অব দ্য আরবান গেরিলা’ শীর্ষক গ্রন্থের চর্চা লক্ষ্য করা যায়। গণবাহিনী এসময় নিজেই এইরূপ একটি ম্যানুয়েল তৈরি করে তরুণ গেরিলাদের প্রদান করে। কিন্তু কার্যত তা ছিল কার্লোস ম্যারিগেল্লার তৈরি মূল ইংরেজি গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত অনুবাদ মাত্র।
১৯১১ সালে জন্ম গ্রহণকারী ম্যারিগেল্লা মূলত ছিলেন ব্রাজিলের কমিউনিস্ট পার্টি Partido Comunista Brasileiro – PCB এর সদস্য। কিন্তু পরে ভিন্নমতের জন্য তাঁকে দলটি বহিষ্কার করে। এরপর ম্যারিগেল্লা ও তার অনুসারীরা Agao Libertadora Nacional (ALN) নামে আরেকটি দল গঠন করেন। ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৯ এর মাঝে যখন এসব ঘটছে তখন দক্ষিণ আমেরিকাসহ বিশ্বজুড়ে কিউবার বিপ্লব ও চে গুয়েভারার বিপুল প্রভাবের মাঝেই ম্যারিগেল্লা তার মতাদর্শের সংক্ষিপ্ত রূপ হিসেবে ‘মিনিম্যানুয়েল’-এর মাধ্যমে নতুন যে তত্ত্ব দেন তা হলাে, র্যাডিক্যাল ধারায় সমাজ রূপান্তরের জন্য শহরভিত্তিক গেরিলাযুদ্ধ হলাে সঠিক রণকৌশল। এর মাধ্যমেই কেবল দ্রুত বিদ্যমান রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলােকে অকার্যকর করে দেয়া যায়। প্রকাশের পরপর উপরােক্ত ‘মিনিম্যানুয়েল’ রেডআর্মি, বাস্ক ইটিএ, আইরিশ রেভ্যুলুশনারী আর্মি ইত্যাদি বিশ্বের ঝাঝালাে সব গেরিলা দলের বাইবেল হয়ে ওঠে। ম্যারিগেল্লার শহরভিত্তিক গেরিলা যুদ্ধের তত্ত্বে অপহরণও এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচ্য। ম্যারিগেল্লা৫৪৬ ও তার
……………………………………………………….
৫৪৫) পিটার কাস্টার্সের সাক্ষাৎকার থেকে। পিটার ইতিহাসের ঐ সময়টিতে ঢাকায় গণবাহিনীর সংগঠকদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত ছিলেন। যদিও গণবাহিনীর সামরিক কৌশল ও জাসদের রাজনৈতিক রণনীতি সম্পর্কে তার ভিন্নমত ছিল বলে দাবি করেছেন তিনি। এ বিষয়ে ২০১৩-এর মার্চে গৃহীত পিটারের সাক্ষাৎকার দেখুন সংযুক্তি : আঠারাে-তে।
৫৯৬) ১৯৬৯ সালের ৪ নভেম্বর গােপন অ্যামবুশ থেকে ম্যারিগেল্লাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
Page 332
অনুসারীরা ১৯৬৯-এ ব্রাজিলের রাজধানীতে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত Charles Burke EIbrick-কে ৭৮ ঘণ্টার জন্য অপহরণ৫৪৭ করে কেবল যে বিশ্বব্যাপী একদফা হই-চই ফেলে দিয়েছিলেন তাই নয়- অন্যান্য গেরিলা দলগুলাের জন্যও এটা ছিল পথপ্রদর্শনমূলক। গণবাহিনীর সদস্যরাও অনুরূপ ভাবাদর্শিক অবস্থান থেকে ১৯৭৫ সালের ২৬ নভেম্বর ঢাকার ধানমন্ডিতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সমর সেনকে অপহরণ করে তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ের। তবে সে উদ্যোগ বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে শেষ হয়।
এই ঘটনার পর জাসদ রাজনীতি সম্পর্কে কেবল যে সাধারণ জনগণ ভীত ও বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে তাই নয়- জাসদ পরিবার নিজেও এইরূপ কার্যক্রমের রাজনৈতিক মূল্যায়ন করতে গিয়ে স্ববিরােধী ভূমিকা নেয়।৫৪৮ সে সময় ঢাকা মহানগর গণবাহিনীর সামরিক প্রধান ছিলেন লে. কর্নেল আবু তাহেরের ভাই আনােয়ার হােসেন। আর তাহেরের আরেক ভাই আবু ইউসুফ খান- যিনিও সাধারণভাবে গণবাহিনীর সঙ্গে সক্রিয় ছিলেন, সমর সেনকে অপহরণ উদ্যোগের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন-
‘আসলে মার্কিন দূতবাসের পরিবর্তে ভারতীয় দূতাবাসে আক্রমণ হয়ে যায়। এই সময় ফিলিস্তিনের বীর রমণী লায়লা খালেদ
……………………………………………………………
৫৪৭) এই অপহরণ কাহিনীর ওপর ভিত্তি করেই ১৯৯৭ সালে Bruno Barreto তৈরি করেছেন বিখ্যাত মুভি Four Days in September,
৫৪৮) ৬৬ বছর বয়সী সমর সেন ছিলেন বাংলাদেশে দ্বিতীয় ভারতীয় রাষ্ট্রদূত। গণবাহিনীর ক্যাডারদের তরফ থেকে তাকে অপহরণ চেষ্টার পর ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশে ভারতীয় বিমান সেনাদের পাঠানাের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ঐ অপহরণ চেষ্টার সময় সমর সেন ডান কাঁধে গুলীবিদ্ধ হন। দেখুন,
http://www.hindu.com/2003/03A12/stories/2003031201921300.htm (পর্যবেক্ষণ : ২০ এপ্রিল ২০১৩)। উল্লেখ্য, গণবাহিনীর ছয় সদস্যের একটি স্কোয়াড ঐ অপারেশন পরিচালনা করে- যাদের চার জন (সাখাওয়াত হােসেন বাহার, মীর নজরুল ইসলাম বাচ্চু, মাসুদুর রহমান ও হারুনুর রশীদ] সেখানে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান। বাকি দুজন (ওয়ারেসাত হােসেন বেলাল ও সৈয়দ বাহালুল হাসান)-কে আটকের পর সামরিক আদালতে বিচার শেষে পাচ বছর করে সাজা দেয়া হয়। জাসদ পরে এই ঘটনাকে ‘অবিপ্লবী তৎপরতা হিসেবে অভিহিত করে এবং ঢাকা নগর গণবাহিনী থেকে আনােয়ার হােসেন অপসারিত হন। তবে আশির দশকে জাসদ ছাত্রলীগ প্রায়ই এই শ্লোগান দিয়েছে, বাহার-বাচ্চু-মাসুদ- হারুণ…দিকে দিকে জ্বালাও আগুন। অন্যদিকে আহত হওয়ার পর ‘৭৬-এর নভেম্বরেই সমর সেনকে ভারত বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহার করে নেয়। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে। বাংলাদেশ সৃষ্টিকালে সমর সেন জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি ছিলেন এবং বাংলাদেশের যুদ্ধে ভারতের ভূমিকার স্বপক্ষে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশেষ সক্রিয়তা ছিল তাঁর। ফলে স্বাধীন বাংলাদেশে তার ওপর শারীরিক আক্রমণ ভারতের কূটনীতিক পল্লিকে চরমভাবে বিস্মিত ও বিচলিত করে। ২০১৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ৮৯ বছর বয়সে সমর সেন মারা গেছেন।
Page 333
তরুণদের বিরাট অনুপ্রেরণার উৎস ছিলেন। আমাদের পার্টিতে বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্ন রকম চিন্তা-ভাবনা ছিল । যদি বিপ্লব হয় তাহলে ডানপন্থীরা তাে সহজে মানবে না, একটা প্রতিক্রিয়া হবেই। সেক্ষেত্রে করণীয় কী হবে? একটা ভাবনা ছিল মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে জিম্মি করে অবস্থা অনুকূলে নিয়ে আসতে হবে। সে লক্ষ্যে গণবাহিনীর ছেলেরা মতিঝিলের আদমজীকোর্টে মার্কিন দূতাবাসের ওপর বহুদিন নজরদারি করে। যখন আমরা সবাই এরেস্ট হয়ে গেলাম- তখন যারা এ কাজে জড়িত ছিল তাদের ভাবনা থেকে এ কাজটি (সমর সেনকে অপহরণ) হয়ে যায়।৫৪৯
একটি মার্কসবাদী সমাজতান্ত্রিক দল- যে দল ‘বিপ্লবের স্তর নির্ধারণ করেছে। সমাজতান্ত্রিক এবং যে বিপ্লব হওয়ার কথা শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে- তারা কতটা নিয়ন্ত্রণহীন রােমান্টিকতাবাদে ভুগত তার এক বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত বলা যায় ১৯৭৫ সালের ২৬ নভেম্বরের উপরােক্ত ঘটনাকে। উপরােক্ত উদ্ধৃতি থেকে স্বাভাবিকভাবে তখনকার জাসদ রাজনীতির বহুমুখী দুর্বলতা আঁচ করা সম্ভব। উল্লেখ্য, আবু ইউসুফ খান নিজের এক ভাইকেও হারিয়েছিলেন ঐ ঘটনায়।
বিদেশি রাষ্ট্রদূতকে অপহরণ করে ‘বিপ্লব’ রক্ষা করার এমন হঠকারি চেষ্টা একটি দেশের জন্য যেমন তাৎক্ষণিক সংকট সৃষ্টি করে তেমনি সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলকেও তা বিপজ্জনক প্রতিক্রিয়ার মুখে ঠেলে দেয়। ঐ ঘটনার প্রতিক্রিয়া সামাল দিতে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সায়েমকে ফোন করতে হয় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে। তাতেও যখন দুই দেশের মধ্যে দূরত্ব কমছিল না তখন বিচারপতি আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন একটি প্রতিনিধিদলকে ভারতে পাঠানাে হয়।৫৫০ বিচারপতি সাত্তার প্রেসিডেন্ট সায়েমের ‘স্পেশাল এ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। অন্যদিকে জেনারেল জিয়াউর রহমান পরিস্থিতি সামাল দিতে এ পর্যায়ে জাসদের প্রতি অতিকঠোর হয়ে ওঠেন। বিধ্বস্ত হয় গণবাহিনী।
জাসদ ও গণবাহিনীর একাংশের কার্যক্রমে শহরভিত্তিক সমরবাদ যে প্রবলভাবে আধিপত্য বিস্তার করে ছিল তার স্বাক্ষর সমর সেন অপহরণ অধ্যায়। ‘শহরভিত্তিক গেরিলা অভিযানের কলাকৌশল সম্পর্কে কার্লোস ম্যারিগেল্লার চিন্তার আলােকে ধারাবাহিক লেখা প্রকাশের দায়ে বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৭-১ধারাকে ব্যবহার করে ১৯৭৪ সালের জুলাইয়ের বিভিন্ন দিনে তল্কালীন সরকার জাসদের মুখপত্র গণকণ্ঠের অন্তত ১১টি সংখ্যা বাজেয়াপ্ত করেছিল। ৫৫১ কিন্তু
………………………………………………………………
৫৪৯) আবু ইউসুফ খান বীরবিক্রমের সাক্ষাৎকার, বিশেষজনের বিশেষ সাক্ষাঙ্কার, সম্পাদনা : রােবায়েত ফেরদৌস ও ফিরােজ জামান চৌধুরী, পাঠক সমাবেশ, ঢাকা, পৃ. ১৫০।
৫৫০) আবদুল হক, লেখকের রােজনামচায় চার দশকের রাজনীতি-পরিক্রমা : প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ ১৯৫৩-৯৩, ইউপিএল, ঢাকা, পৃ. ৩৮৬।
৫৫১) Mahfuz Ullah, Ibid, p. 110.
Page 334
তাতে দলটির অভ্যন্তরীণ উপরােক্ত সমরবাদ নিয়ন্ত্রণ করা গিয়েছে কমই। এ ক্ষেত্রে জাসদের জন্য সবচেয়ে প্রাণস্পর্শী বিপর্যয় ছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক কুমিল্লার অধিবাসী মুক্তিযােদ্ধা নিখিল চন্দ্রের মৃত্যু। গণবাহিনীর বােমা তৈরির অন্যতম বিশেষজ্ঞ হিসেবে ১৯৭৪-এর ২৬ নভেম্বর আহুত হরতাল উপলক্ষ্যে স্থানীয়ভাবে তৈরি বােমার উন্নয়ন ঘটাতে গিয়ে ঢাকার সায়েদাবাদ এলাকায় পুরাে শরীরে অগ্নিদগ্ধ হন তিনি এবং তিন-চার দিন পরে মারা যান। ঠিক এক মাস পরেই দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয়।
উল্লেখ্য, নগরভিত্তিক গেরিলা যুদ্ধ বিকশিত করা গণবাহিনীর মুখ্যতত্ত্ব হিসেবে স্থান করে নেয়ার আরেকটি বস্তুগত পার্শ্ব-পটভূমি ছিল স্বাধীনতা-উত্তর সেনাবাহিনীতে জাসদের ব্যাপক যােগাযােগ। বিশেষত, সৈনিকদের মাঝে লে. কর্নেল আবু তাহের ও মেজর এম এ জলিলের বিপুল সংখ্যক অনুরাগী ছিলেন । এসব অনুরাগী সহযােগিরা মুজিব সরকারের প্রশাসনিক বিবিধ ব্যর্থতাকে পুঁজি করে সেনাবাহিনীর ভেতরে নিজস্ব যােগসূত্রের পরিধি আরও বাড়িয়ে নিতেও পেরেছিলেন। সেই যােগসূত্র থেকেই জাসদ গণবাহিনীর শাখা হিসেবে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কার্যক্রম বিকশিত করার সুযােগ পায়। তবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আর্মাড কোর তথা বেঙ্গল ল্যান্সারের সদস্য হাবিলদার বারীর বাসায় ১৯৭৩ সালের জানুয়ারিতে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’র জন্ম’ বলে দাবি করেছেন এর জন্মকালীন সভাপতি নায়েক সুবেদার মাহবুবুর রহমান।৫৫২
সৈনিক সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাহবুবর রহমান ছিলেন মূলত কাদের সিদ্দিকীর মুক্তিযুদ্ধকালীন বাহিনীর একজন সদস্য। আরেক নায়েক সুবেদার জালাল উদ্দিন আহমেদ ছিলেন সংস্থার সহ-সভাপতি এবং বিমানবাহিনীর কর্পোরেল ফখরুল আলম ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। গঠিত হওয়ার আগে থেকেই আবু তাহের ও এম এ জলিলের মাধ্যমে এই সংগঠনের মূল সংগঠকরা জাসদের কাছাকাছি ছিলেন।৫৫৩ এভাবেই জাসদ পরিবারে মুজিব বাহিনী বহির্ভূত আরেকটি রাজনৈতিক-সামরিক ধারার মােটাদাগে অন্তর্ভুক্তি ঘটতে শুরু করে। তাহের ও জাসদের অন্যান্য নেতাদের, বিশেষ করে যারা সেনাবাহিনীর প্রাক্তন সদস্য বা মুক্তিযােদ্ধা ছিলেন তাদের সঙ্গে যেসব সৈনিকের যােগাযােগ ছিল, তাদের
………………………………………………………….
৫৫২) দেখুন, মাহবুবর রহমান, সৈনিকের হাতে কলম, প্রকাশক : সংলাপ, জার্মানি, প্রকাশকাল : উল্লেখ নেই, প্রাপ্তিস্থান : আলীগড় লাইব্রেরি, ঢাকা। উল্লেখ্য, জিয়াউর রহমানের শাসনকালে মাহবুবুর রহমানসহ সাতজনকে ক্যানবেরা, মস্কো ও কুয়ালালামপুরের বাংলাদেশ দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয়। পরে (জুন, ১৯৭৮) মাহবুবুর জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন। এই লেখার সময় (২০১৪ সালে) সেখানেই ছিলেন তিনি।
৫৫৩) নায়েক সুবেদার মাহবুব অবশ্য দাবি করেছেন, তাঁর সঙ্গে জাসদ নেতা শাজাহান সিরাজের আগে থেকে পরিচয় ছিল- যেহেতু দু’জনই টাঙ্গাইলের অধিবাসী। দেখুন, পূর্বোক্ত, পৃ. ৯৩।
Page 335
সংগঠিত করেই প্রাথমিকভাবে এই গােপন সংগঠন করা হয়।…১৯৭২ সাল থেকে জাসদের কর্মকর্তাদের অনেকের সঙ্গে অনেক জওয়ান, জেসিও, এনসিও ও সামরিক অফিসারদের যােগাযােগ ছিল।৫৫৪ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে নিয়মিত জাসদ নেতাদের সঙ্গে এসব সৈনিকদের বৈঠক হতাে। পরে এম এ জলিল আটক হলে কর্নেল আবু তাহের এই সংগঠনকে বিস্তৃতি দেন এবং প্রশিক্ষিত করে তােলেন। সিরাজুল আলম খানও বিষয়টি পুরােপুরি অবহিত ছিলেন। প্রতিটি ক্যান্টনমেন্টেই সৈনিক সংস্থার শাখা ছিল। তবে পদাতিক ব্যাটালিয়নগুলােতে এর প্রভাব কম ছিল। সাংগঠনিকভাবে এর বিস্তৃতি বেশি হয় সেনাবাহিনীর ল্যানসার, আর্টিলারী, সিগন্যাল ইউনিটগুলােতে এবং বিমান বাহিনীতে সৈনিক সংস্থার সংগঠকদের মধ্যে অধিক অগ্রসরদের নিয়ে পাঠচক্রধর্মী নিয়মিত রাজনৈতিক আলােচনারও ব্যবস্থা করা হয় মূল দলের উদ্যোগে। বিভিন্ন সেনা ইউনিটে সৈনিক সংস্থার শাখাগুলােকে বলা হতাে ‘ফোরাম’ । এই ফোরাম-এর সাংগঠনিক আদলটি ছিল পাকিস্তান শাসনামলে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে সিরাজুল আলম খানদের গড়ে তােলা নিউক্লিয়াস’-এর মতাে। তবে নিউক্লিয়াসে যেভাবে বিশেষভাবে যাচাই-বাছাই করে সদস্য রিক্রুট করা গিয়েছিল সৈনিক সংস্থার ক্ষেত্রে তা করা হয়নি বা করা যায়নি। প্রমাণ হিসেবে দেখা যায় ১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বর অভ্যুত্থানকালে সৈনিকরা অনেক জেলায়
ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে এসে অনেক অবিপ্লবী কাজেও লিপ্ত হয়ে পড়ে- যা এই বিপ্লবের চরিত্র সম্পর্কে জনমনে বিভ্রান্তি ও শঙ্কা তৈরি করে। এমনকি রংপুর গণবাহিনীর সংগঠক অলােক সরকার এও বলেছেন, এক পর্যায়ে এই সৈনিকদের ক্যান্টনমেন্টে ফেরত পাঠানােই আমাদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়ালাে।’
জাসদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর জওয়ানদের উপরােক্ত সম্পর্ক গড়ে ওঠার প্রাথমিক রাজনৈতিক ও সামরিক তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ইব্রাহিম লিখেছেন, এতে জাসদ হাতে লাঠি পায়, আর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা মাথার উপর ছাতা পায়।৫৫৫ গণবাহিনী গঠন ও মাঠ পর্যায়ে সশস্ত্র কার্যক্রমের পাশাপাশি সেনাবাহিনীতে অনুরূপ কাজে নামার ক্ষেত্রে তখন অগ্রসর ভূমিকায় ছিলেন আবু তাহের, ড. আখলাকুর রহমান ও হাসানুল হক ইনু। তবে ১৯৭৫-এর সাতই নভেম্বর সিপাই অভ্যুত্থানের ডাক দেওয়ার ক্ষেত্রে ড. আখলাকুর রহমান নিরুৎসাহী ছিলেন। বিপ্লবী গণঅভ্যুত্থানমূলক পরিস্থিতির জন্য জাসদের আরও অপেক্ষা করা উচিত বলে সেসময় তিনি মনে করতেন। তবে
…………………………………………………………
৫৫৪) হায়দার আকবর খান রনাে, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৮০।
৫৫৫) মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, মিশ্রকথন, অনন্যা, ঢাকা, ২০১১, পৃ.
১৮৯।
Page 336
তাহেরের পীড়াপীড়িতে জাসদ সেদিন অনেকটা অনিচ্ছুক ভঙ্গিতে সিপাহী অভ্যুত্থানের সিদ্ধান্তের পেছনে ধাবিত হয়।৫৫৬
১৯৭৪-৭৫ এ জাসদ ছাড়াও অন্যান্য বামপন্থী দলগুলাের সঙ্গেও সেনাবাহিনীর অফিসার ও সৈনিকদের নানারূপ রাজনৈতিক যােগাযােগ ছিল। এসব যােগাযােগ ছিল বস্তুত মুক্তিযুদ্ধকালীন সম্পর্কেরই একধরনের ধারাবাহিকতা। কাজী জাফর আহমেদ, রাশেদ খান মেনন ও হায়দার আকবর খান রনােদেরও সেনাবাহিনীতে সংগঠন করার একটি উদ্যোগ ছিল ।৫৫৭ লে. কর্নেল জিয়াউদ্দীন-এর মাধ্যমে পূর্ববাংলা সর্বহারা পাটিও অফিসার পর্যায়ে যথেষ্ট যােগাযােগ গড়ে তুলেছিল। তবে তুলনামূলকভাবে জাসদের উদ্যোগের আদর্শিক ও রাজনৈতিক ধরন এবং ব্যাপকতা ছিল অন্যদের চেয়ে অনেক অগ্রসর ও কৃতিত্বপূর্ণ। বেসামরিক পরিসরে সংগঠন করার ক্ষেত্রে শ্রেণিচেতনার কঠোরতা মােটাদাগে এড়িয়ে গেলেও সেনাবাহিনীতে মূলত ‘উর্দিপরা কৃষকদেরই দলবদ্ধ করছিল জাসদ। উপনিবেশিক আদলের প্রতিরক্ষা বাহিনীতে জওয়ানরা যে, বিপ্লবী প্রলেতারিয়েতের অংশ হিসেবে আমূল সংস্কারবাদী রাজনীতির এক অপরিহার্য মনােযােগের কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে- জাসদের আগে বাংলাদেশের সমাজতন্ত্রীরা আর কখনাে এত সফলভাবে তা তুলে ধরতে পারেনি। আবু তাহের ও এম এ জলিল এক্ষেত্রে প্রকৃতই ব্যাপক সফলতা দেখিয়েছিলেন। বাংলাদেশের বিপ্লবী রাজনীতিতে এরূপ সফলতার দ্বিতীয় কোনাে নজির নেই।
গণবাহিনী ও বিপ্লবী সিপাহী সংস্থার কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে এসময় গণবাহিনীর ঢাকা শাখা পিটার কাস্টার্স নামে একজন বিদেশি নাগরিকের কাছ থেকে সহযােগিতা পেয়েছিল বলে জানিয়েছেন বাহিনীর নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নেতৃস্থানীয় সদস্য। ঢাকায় পিটারের অফিস ও বাসস্থান গণবাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন প্রয়ােজনে ব্যবহার করত। জাসদের রাজনীতি এবং গণবাহিনীর কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কৌতূহলােদ্দীপক ও রহস্যঘেরা এই পিটার কাস্টার্স অধ্যায়- আন্তর্জাতিক পরিসরে যিনি এখন একজন বামপন্থী পণ্ডিত হিসেবে সুপরিচিত।
১৯৪৯ সালে হল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলে জন্মগ্রহণকারী পিটার ছাত্রাবস্থায় পড়ালেখা করেছেন ঐ দেশের লেইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরে ১৯৭০-এর সেপ্টেম্বর নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের জনহপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন তিনি।
সেখানে আন্তর্জাতিক আইন ও এশীয় সমাজ বিষয়ে অধ্যয়ন করেন পিটার।
………………………………………………………………
৫৫৬) আবু তাহের কীভাবে এবং কী পরিস্থিতিতে জাসদ নেতৃত্বকে সিপাহী অভ্যুত্থানে সম্মত হতে পীড়াপীড়ি করছিলেন সে আলােচনার জন্য দেখুন, মহিউদ্দিন আহমদ, তাহের-জিয়া ও ৭ নভেম্বরের সাতকাহন, দৈনিক প্রথম আলাে, ২ জুন ২০০৩, ঢাকা।
৫৫৭) দেখুন, হায়দার আকবর খান রনাে, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৩-৫৪।
Page 337
উচ্চতর অধ্যয়নকালে জনহপকিন্সে একদল মার্কসবাদী তাত্ত্বিকের সঙ্গে গভীর সখ্যতা গড়ে উঠেছিল তাঁর। যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ছড়িয়ে পড়া ভিয়েতনামের যুদ্ধ-বিরােধী বিক্ষোভ এবং দক্ষিণ আমেরিকায় চে গুয়েভারার উত্থান ও মৃত্যুও এ পর্যায়ে পিটারকে বিপ্লবী রাজনীতির প্রতি বিশেষ আগ্রহী করে তােলে। এসময় বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে আমেরিকায় গড়ে ওঠা সংহতি আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে পিটার এদেশটি নিয়ে বিশেষভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ১৯৭৩ সালের জানুয়ারিতে তিনি প্রথম বাংলাদেশে আসেন এবং তিন মাস থাকেন। আমেরিকায় পরিচয় হওয়া এক বাংলাদেশি বন্ধুর ঢাকাস্থ কলাবাগানের বাসায় উঠেছিলেন সেবার তিনি । পিটারের বাঙালি সেই বন্ধু ছিলেন একজন বিখ্যাত আমলার ভাই এবং সিপিবি’র রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। পরে Revo Conti ছদ্মনাম নিয়ে সাংবাদিক পরিচয়ে আবারও বাংলাদেশে আসেন পিটার। এ পর্যায়ে সাংবাদিক পরিচয়ে থাকলেও মূলত বিপ্লবী রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়াই ছিল তার কাজের মূল লক্ষ্য। সে লক্ষ্যে তিনি সারা দেশ ঘােরেন এবং এখানকার সমাজ কাঠামাের ওপর কয়েকটি দলিল’ প্রস্তুত করেন। এসময় বিশেষভাবে জাসদ ও সর্বহারা পার্টির কর্মীদের সঙ্গে ভবিষ্যৎ বিপ্লবের পথ-প্ররিক্রমা নিয়ে ব্যাপক সংলাপ হয় তার। কিন্তু রণকৌশলগত ভিন্নতার কারণে ১৯৭৫-এর মাঝামাঝি তিনি ও তার অনুসারীরা সর্বহারা ঐক্য আন্দোলন’ নামে স্বতন্ত্র রাজনৈতিক উদ্যোগ নিতে শুরু করেন এবং এ পর্যায়ে জাসদের সিপাহী। অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়াজনিত ধর-পাকড় শুরু হয় এবং পিটারও আটক হয়ে যান।
তবে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে কারাদণ্ড ও দেশ থেকে বিতাড়নের পরও স্থানীয় বামপন্থী শক্তিসমূহের সঙ্গে পিটারের নানান পর্যায়ের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ পিপলস্ সলিডারিটি সেন্টার (বিপিএসসি) নামে হল্যান্ডভিত্তিক একটি সংগঠনও গড়ে তুলেছিলেন তিনি। ইয়ােরােপে বাংলাদেশ বিষয়ে তাকে একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের একটি শীর্ষ দৈনিকের সঙ্গে ইয়ােরােপীয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন এবং দক্ষিণ এশীয় সমাজে ইসলামের সুফী ঘরানার প্রভাব বিষয়ে গবেষণারত।
জাসদ রাজনীতিতে পিটারের সম্পৃক্তির ধারণা এবং তাঁকে ঘিরে বাংলাদেশে জীবন্ত কৌতূহলের কারণে বর্তমান লেখক কর্তৃক সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলাে নিয়ে কয়েক দফায় তার বিস্তারিত সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। সেই কথােপকথনে পিটার জানান, বাংলাদেশে ‘বিপ্লবী পরিবর্তনে ভূমিকা রাখার লক্ষ্যেই তিয়াত্তর-চুয়াত্তরে ঢাকায় অনেক বামপন্থী সংগঠনের সঙ্গে যােগাযােগ রাখতেন তিনি। প্রাথমিকভাবে তিনি গণবাহিনী ও জাসদকে পৃথক সত্তা হিসেবেই মনে করতেন। সাক্ষাৎকারে পিটার স্বীকার করেন, কর্নেল তাহেরের সঙ্গে তার বিশেষ সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। বললেন, তাকে আমার প্রকৃতই এক বিপ্লবী মনে হয়েছিল। বাংলাদেশের বিপ্লবী
Page 338
রাজনীতিতে সশস্ত্র সংগ্রাম গ্রামভিত্তিক হবে- না শহরভিত্তিক হবে এ নিয়ে তাদের মাঝে সুনির্দিষ্ট মতভিন্নতা থাকলেও পরস্পর তারা নিজেদের সম্পর্ককে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন এবং এ বিষয়ে একমত ছিলেন যে, বাংলাদেশের ‘বিপ্লবী পরিবর্তন হবে গণঅভ্যুত্থানমূলক- চীনা ধাঁচের গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে নয়, যদিও চীনের মতােই প্রধানত গ্রামীণ ভূমিহীনরাই এখানে প্রলেতারিয়েত হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং বিপ্লবেও এদের নির্ধারক ভূমিকা থাকবে। এইরূপ দৃষ্টিভঙ্গিগত ঐকমত্যেরই ফসল ছিল গণবাহিনীর ঢাকা মহানগর শাখার সঙ্গে তার পরােক্ষ যােগাযােগ। সেসময় গণবাহিনীর ঢাকা মহানগর কার্যক্রমে তাহেরের তিন ভাই সরাসরি যুক্ত ছিলেন। পিটার নগরভিত্তিক গণবাহিনীর এই যােদ্ধাদের বিভিন্ন উপায়ে সহযােগিতা করতেন। তবে এক সময় তাত্ত্বিক রণকৌশলগত ভিন্নতা তৈরি হলে তীব্র চাপ ও হুমকি সত্ত্বেও পিটার বাড়তি সহায়তায় আপত্তি করছিলেন।৫৫৮ সিরাজুল আলম খান, ড. আখলাকুর রহমান এবং রব-জলিলের সঙ্গেও পিটারের পরিচয় ছিল। তবে জাসদের Mode of Production বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সঠিক নয় বলে মনে করতেন তিনি। তাঁর ভাষায়, গ্রামীণ পরিস্থিতির বিশ্লেষণ নিয়েই আমাদের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য ছিল। বিশেষ করে বিপ্লবী রূপান্তরে মাঝারি ও বৃহৎ কৃষকের ভূমিকা কী হবে এ বিষয়ে মতভিন্নতা ছিল। অন্যদিকে গণবাহিনী সম্পর্কে তাঁর পর্যবেক্ষণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, এর গঠনে জাসদের কেন্দ্রীয় যারা অনুমােদন দিয়েছেন এবং বাস্তবে এটা যারা পরিচালনা করতেন তাদের উভয়ের সকল চিন্তা ও পরিকল্পনা এক রকম ছিল এমন বলা যাবে না। নেতৃত্বের ধরনেও পৃথকত্ব ছিল। কাজের ক্ষেত্রে এডভেনচারিস্ট লাইন প্রাধান্য পাচ্ছিলাে।
এরূপ উপলব্ধি থেকেই ঐসময় পৃথক একটি বিপ্লবী প্রক্রিয়ার গােড়াপত্তন করেছিলেন পিটার। গ্রামীণ বিভিন্ন জনপদে নিরক্ষরতা দূরীকরণ কার্যক্রমের
…………………………………………………………………
৫৫৮) সাতই নভেম্বরের সিপাই অভ্যুত্থানকে একটি ভুল ও অপরিণত পদক্ষেপ হিসেবে শনাক্ত করার কারণেও গণবাহিনীর সদস্যরা পিটারের উপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। তাঁকে এসময় তারা “সিআইএ’র চর হিসেবে শনাক্ত করারও চেষ্টা চালান। গণবাহিনীর সদস্যরা বেশ হেনস্থা করেছিলের তখন তাঁকে। বাংলাদেশ নিয়ে পিটারের মাঝে বিপুল বিপ্লবী রােমান্টিকতা ছিল। জাসদ ও গণবাহিনীর মুষ্টিমেয় কর্মী সেই রাজনৈতিক আগ্রহকে কাজে লাগিয়ে তাঁকে ‘নানানভাবে ব্যবহার করতে চেষ্টা চালিয়েছিল। বিষয়টি শেষপর্যন্ত ভয়ভীতি প্রদর্শনের পর্যায়ে পর্যবসিত হয়। বিশেষ করে প্রত্যাশিত সহায়তা না পাওয়ায় ঢাকার ল্যাবরেটরি রােড়ে এক বাড়ির ছাদ থেকে ফেলে হত্যার হুমকিও দেয়া হয় তাঁকে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত গণবাহিনীর নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সদস্য লেখককে এই তথ্য জানিয়েছেন। তবে বর্তমান লেখককে প্রদত্ত ‘আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকার’-এ পিটার গণবাহিনীর সদস্যদের কোনাে ধরনের বস্তুগত সহায়তা প্রদানের বিষয় অস্বীকার করেন । দেখুন, সংযুক্তি আঠারাে। উল্লেখ্য, পিটার গ্রেফতার হওয়ার পর তাদের পরিচালনাধীন এনজিওটি BOFE]-র তাবৎ সম্পদও বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল।
Page 339
আড়ালে পিটারের কর্মীরা ভূমিহীন কৃষকদের মাঝে তাদের এই কর্মসূচি শুরু করার কিছু দিন পরই দেশে পরপর তিনটি অভ্যুত্থান ঘটে এবং ১৯৭৫ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকার এলিফ্যান্ট রােড থেকে পিটার সহযােগীদের নিয়ে আটক হন।৫৫৯
উল্লেখ্য, নেদারল্যান্ড থেকে পিটার কাস্টার্স প্রথমে সাংবাদিক পরিচয়ে বাংলাদেশে আসলেও পরে বাংলাদেশে নিজ কার্যক্রমের অরাজনৈতিক আচ্ছাদন হিসেবে গড়ে তােলেন ‘BOFE (Bangladesh Organization for Functional Education) নামের একটি এনজিও। তবে যেমনটি বলা হয়েছে – বরাবরই বাংলাদেশের রাজনীতির বিপ্লবী রূপান্তরেই ছিল তার মূল আগ্রহ। বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানমূলক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে গ্রামভিত্তিক ভূমিহীন কৃষকদের গেরিলা বাহিনী গড়ে তােলার বিষয়ে পিটারের দৃষ্টিভঙ্গিকে জাসদের গণবাহিনীর সংগঠকরা পারস্পরিক সম্পর্ক’-এর একটি ভিত্তি হিসেবে সাব্যস্ত করেছিলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত সে সম্পর্ক বিকশিত হয়নি। গণবাহিনীর কার্যক্রমের সীমাবদ্ধতাকে তিনি চিহ্নিত করেছেন এভাবে : ‘রাজনৈতিক ভিত্তি গড়ে তােলার আগেই সামরিক ভিত্তি গড়ে তােলার যে চেষ্টা নেয়া হয়েছিল সেটা বিকশিত হওয়ার সুযােগ ছিল; ভূমি ও কৃষি সংস্কারের সুনির্দিষ্ট কোনাে কর্মসূচিও ছিল না তাদের।’
বলা বাহুল্য, তারপরও যে কোনাে উপায়ে জাসদের রাজনীতির ঐ সময়কার সামরিক রূপ পরিগ্রহ করাকে বাংলাদেশের ইতিহাসের এক নব অধ্যায় হিসেবে যেমন দেখার যথার্থতা রয়েছে তেমনি একে সংগঠন হিসেবে মুজিব বাহিনীর অভিপ্রকাশের একটি নতুন পর্যায় হিসেবে ব্যাখ্যারও সুযােগ রয়েছে। কারণ গণবাহিনীর মাধ্যমে জাসদ যে সশস্ত্রতার ডাক দিয়েছিল এবং তাকে প্রতিরােধের জন্য ভারতীয় প্রশিক্ষণে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে রক্ষীবাহিনী নামে ইতােমধ্যে যে কাঠামাে গড়ে উঠতে দেখেছি আমরা উভয়ে ছিল একই সাংগঠনিক সত্তার ঐতিহাসিক অংশীদার। এসময় গণবাহিনীর পেছনে যেমন বিশাল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও অভিলাষ নিয়ে কার্যরত ছিলেন সিরাজুল আলম খান তেমনি শেখ মুজিবুর রহমানকে জরুরি অবস্থা ঘােষণা (২৮ ডিসেম্বর ১৯৭৪) এবং সংবিধানের চতুর্থ সংশােধনীর মাধ্যমে একদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা কায়েমের
…………………………………………………………………
৫৫৯) তাঁকে কীভাবে গােপন বিচারের মুখােমুখি হতে হয়েছিল সে বিবরণ দেখুন সংযুক্তিতে [আঠারাে]। ১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বরে পিটার কাস্টার্স বাংলাদেশের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। উল্লেখ্য, বর্তমান লেখকের নিজস্ব অনুসন্ধানে দেখা যায়- গােয়েন্দাদের হস্তগত পিটারের ডায়েরিতে এমন বহু নাম পাওয়া গিয়েছিল যারা তার সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে পরিচিত হলেও তাঁর রাজনৈতিক উদ্যোগে শামিল ছিলেন না। যেমন বদরুদ্দীন উমর, এনায়েতুল্লা খান, ড. আনিসুর রহমান, ড. কামাল সিদ্দিকী প্রমুখের নামও পাওয়া গিয়েছিল পিটারের ডায়েরিতে। গােয়েন্দাদের নিগ্রহ থেকে বাঁচতে উপরােক্ত ব্যক্তিদের অনেককে তখন দেশে-বিদেশে আত্মগােপন করতে হয়েছিল। বর্তমান লেখকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে পিটার কাস্টার্স অবশ্য এসব বিষয়ে কথা বলতে অস্বীকার করেন।
Page 340
মতাে বিধ্বংসী সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব বিস্তারে সক্ষম জায়গায় ছিলেন ফজলুল হক মণি, তােফায়েল আহমেদ প্রমুখ । যা ধীরে ধীরে বাংলাদেশকে ১৯৭৫-এর মাঝামাঝি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের এমন এক চূড়ান্ত অনিবার্যতার দিকে নিয়ে যায়- যা ছিল পুরােপুরি অস্বাভাবিক ধাঁচের এবং নবীন রাষ্ট্র’-এর অস্তিত্বই প্রায় বিপন্ন করে তুলেছিল তা।৩৬০
জাসদের অধীনে ‘গণবাহিনী’ নামে মুজিব বাহিনীর একটি অংশের নবতর বিকাশের কিছু পৃথক পটভূমিও এ পর্যায়ে উল্লেখের দাবি রাখে। ইতােমধ্যে আমরা উল্লেখ করেছি, স্বাধীনতার পর মুজিব বাহিনীর সদস্যদের অস্ত্রসমপর্ণের বিষয়টি ছিল অনেকখানিই প্রতীকী। পরাজিত শত্রুরা আবার হামলা করতে পারে এই যুক্তিতে শেখ মণি সমর্থক অংশ যেমন যুদ্ধোত্তর সমাজে তাদের সশস্ত্র সামর্থ্যের অনেকখানিই রেখে দিয়েছিল- তেমনি সিরাজুল আলম খান সমর্থক অংশও অস্ত্র ধরে রেখেছিল। শেষােক্তদের জন্য ‘শত্রুর হামলার আশঙ্কা ছিল বরং দ্বিমুখী। ফলে তারা অস্ত্র রক্ষা করা রাজনৈতিক কর্তব্য হিসেবেই নিয়েছিল। যেহেতু যুদ্ধের শেষপর্যায়ে এসে মুজিব বাহিনীতে প্রায় ৯০ ভাগ কর্মীই সিরাজ গ্রুপের সমর্থকে পরিণত হয় ফলে অস্ত্র ও তাদের হাতেই ছিল বেশি। তাছাড়া রাজাকারদের থেকেও প্রচুর অস্ত্র পাওয়া যায় ১৬ ডিসেম্বরের পর। যুদ্ধের পর রাজনৈতিক মেরুকরণের পাশাপাশি অস্ত্রধারী এই কর্মীদের শৃঙ্খলার ভেতরে নিয়ে আসা, সিরাজ গ্রুপের নেতৃস্থানীয় সংগঠকদের সামনে বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়। ফলে সশস্ত্র তাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার মাধ্যমে একটি বাহিনীর গােড়াপত্তনের। কার্যক্রমটি তখন থেকেই শুরু হয়। মুজিব বাহিনীর প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রশিক্ষক ভূমিকার কারণে হাসানুল হক ইনু ও পাশাপাশি মার্শাল মনিকে এ কাজে নেতৃত্ব দিতে বলা হয়েছিল। তখন এও একটি দলীয় মৌখিক সিদ্ধান্ত ছিল- যারা অস্ত্রধারণ ও সংরক্ষণ করবেন তারা প্রকাশ্য রাজনীতির পরিচিতির জায়গায় থাকবেন না; উপরন্তু তারা অধিকতর শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবন-যাপন করবেন। এভাবেই কোনাে ধরনের বিপ্লবী তাগিদ ছাড়াই অনেকটা পরিস্থিতি দ্বারা চালিত হয়ে
…………………………………………………………………
৫৬০) ১৯৭৩-৭৫ সময়ের সংবাদপত্রগুলাে লক্ষ্য করলে একটি গতানুগতিক সংবাদ চোখে পড়ে, তাহলাে। প্রায় প্রতিদিন ঢাকায় প্রচুর বেওয়ারিশ লাশ পাওয়া যাচ্ছে। ১৯৭৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের কর্মাধ্যক্ষ মােহাম্মদ ওয়াহেদ ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, সর্বশেষ ছয় মাসে কেবল ঢাকায় তারা ২ হাজার ৪৪টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছেন। এই ধারাবাহিকতা দীর্ঘ কয়েক বছর অব্যাহত ছিল। প্রমাণ হিসেবে দেখা যায়, ১৯৭৫ সালের ২ জানুয়ারি দৈনিক গণকষ্ঠে একটি সংবাদ শিরােনাম ছিল : গতকাল আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম ঢাকায় আরও ২৫টি লাশ দাফন করলাে। এটা ছিল আর্থসামাজিক নৈরাজ্যের ভীতিকর এক প্রকাশ- যদিও নিয়মিত তখন এরূপ সংবাদ দেখা যেত।
Page 341
জাসদকে একটি সশস্ত্র বাহিনী পরিচালনা শুরু করতে হয়। গণবাহিনী’ নামটিও চূড়ান্ত হয়নি তখনাে।
অন্যদিকে আগেই যেমনটি বলা হয়েছে- জলিল ও তাহের জাসদে যােগ। দেওয়ার পর প্রায়ই সেনাবাহিনীতে কর্মরত জওয়ানরা সেনানিবাস থেকে তাদের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। এ পর্যায়ে এদেরও একটা শৃঙ্খলাপূর্ণ কাঠামাের অধীনে নিয়ে আসার চ্যালেঞ্জ তৈরি হয় নতুন দলে এবং প্রথমে মেজর জলিল এবং পরে কর্নেল তাহের সেই দায়িত্ব পালন করেন। চুয়াত্তরের ১৭ মার্চ জলিল গ্রেফতার হওয়ার পর সামরিক বাহিনীতে যােগাযােগের বিষয়টি প্রায় একচেটিয়াভাবে তাহেরই করতেন। এই কার্যক্রমের শুরুর দিকের বিবরণ দিতে গিয়ে মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন :৫৬১
এটা (সেনাবাহিনীতে জাসদের সাংগঠনিক কার্যক্রম) মূলত শুরু হয়। মেজর জলিলের অনুগত সৈনিকদের নিয়ে।…তেহাত্তরের ২০ নভেম্বর ঢাকার নাখালপাড়ায় তিনি জেসিও-এনসিওদের নিয়ে একটি সভা করেন। সভায় সার্জেন্ট রফিক, ফ্লাইট সার্জেন্ট রােকনউদ্দীন ও সার্জেন্ট কাদের উপস্থিত ছিলেন। সভায় তিনি সারা দেশকে চারটি অঞ্চলে ভাগ করে প্রতিটি অঞ্চলের জন্য। একজনকে দায়িত্ব দেন। তাদের কাজ ছিল সেনানিবাসগুলােতে জাসদের আদর্শে সৈনিকদের উদ্বুদ্ধ ও সংগঠিত করা।…এই গ্রুপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হন কর্পোরাল আবদুল মজিদও।
এভাবেই তেহাত্তরের শেষ এবং চুয়াত্তরের শুরুতে জাসদ সামরিক ও বেসামরিক পরিসরে দুটি সশস্ত্র শাখা পরিচালনার গুরুদায়িত্ব কাঁধে নেয়। এ পর্যায়ে একটির নামকরণ হয় গণবাহিনী এবং অপরটিকে উল্লেখ করা হয় বিপ্লবী সিপাহী সংস্থা হিসেবে। পরে এই দু’টিকেই গণবাহিনী হিসেবে অভিহিত করা হতাে এবং তার প্রধান হিসেবে লে. কর্নেল আবু তাহেরকে এবং উপ-প্রধান হিসেবে হাসানুল হক ইনুকে বিবেচনা করা হতাে। ইনু যেমন সেনাবাহিনীর বিপ্লবাকাক্ষী জওয়ানদের রাজনীতির প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তেমনি সাধারণ রাজনৈতিক কর্মী থেকে গণবাহিনীতে আগতদের সামরিক প্রশিক্ষণে দেখা গেছে তাহেরকে। কেন্দ্রীয় দায়িত্ব ছাড়াও ইনু জেলা হিসেবে মানিকগঞ্জ ও টাঙ্গাইলেরও পলিটিক্যাল কমিশার ছিলেন।৫৬২ কেন্দ্রীয় স্তরে গণবাহিনীর পলিটিক্যাল কমিশার ছিলেন মােহাম্মদ শাহজাহান।
…………………………………………………………………
৫৬১) মহিউদ্দিন আহমদ, ৭ নভেম্বরের সাত-সতেরাে, প্রথম আলাে ঈদ সংখ্যা, জুলাই ২০১৪, ঢাকা, পৃ. ২৪৪।
৫৬২) ওই সাংগঠনিকভাবে কৃষক লীগের নেতা হলেও হাসানুল হক ইনু কীভাবে গণবাহিনীর নেতৃত্ব পর্যায়ে উঠে এলেন তার বর্ণনা দিতে গিয়ে মাহমুদুর রহমান মান্না লিখেছেন :
..বাংলাদেশের মতাে সমতল ভূমির একটি দেশে যাকে সাপাের্ট দেওয়ার মতাে কোনাে। প্রতিবেশী দেশও নেই সেখানে গেরিলাযুদ্ধ কীভাবে সম্ভব- এ প্রশ্ন যখন দলের কেন্দ্রীয় ফোরামের প্রায় সবাই তুলেছিলেন তখন হাসানুল হক ইনু সে প্রশ্নের জবাব দিয়ে গণবাহিনী গঠনের যৌক্তিকতা তুলে ধরেছিলেন। তাকে গণবাহিনীর সেকন্ড-ইন কমান্ড বানানাে হয়েছিল । দেখুন, মিথ্যা ইতিহাসের ওপর জাতি দাঁড়াতে পারে না, পূর্বোক্ত।
Page 342
তাহের ও ইনুর পরই কেন্দ্রীয় স্তরে গণবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন শরীফ নুরুল আম্বিয়া, কাজী আরেফ আহমেদ, মার্শাল মনিরুল ইসলাম প্রমুখ । এদের মধ্যে আম্বিয়া ছিলেন বর্তমানের বরিশাল বিভাগ, খুলনা বিভাগ ও বৃহত্তর ফরিদপুরের পলিটিক্যাল কমিশার। কাজী আরেফ ছিলেন চট্টগ্রাম বিভাগের পলিটিক্যাল কমিশার। মার্শাল মনি ছিলেন রাজশাহী বিভাগের পলিটিক্যাল কমিশার। জেলাগুলাের বাইরে শহর ঢাকারও বিশেষ গুরুত্ব ছিল গণবাহিনীর কর্মকাণ্ডে। কর্নেল তাহেরের ভাই আনােয়ার হােসেন ছিলেন ঢাকা মহানগরী গণবাহিনীর কমান্ডার। তাঁর পলিটিক্যাল কমিশার ছিলেন এল সি রফিক।৫৬৩ ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন আবুল হাসিব খান। ঢাকার ১২টি থানাতেই গণবাহিনীর এক প্লাটুন করে সশস্ত্র কর্মী ছিল। এসব সশস্ত্র কর্মীদের পরিচালনায় প্রতি থানাতেই ছিলেন একজন কমান্ডার। যেমন মতিঝিল থানায় ছিলেন আবদুস সালাম, সূত্রাপুরে গােলাম মাহমুদ, কোতয়ালীতে আবু বকর সিদ্দিকী, ডেমরায় খালেকুজ্জামান চৌধুরী, মােহাম্মদপুরে খায়রুজ্জামান বাবুল, মিরপুরে নজরুল ইসলাম প্রমুখ। এসব কমান্ডারদের অন্যতম একজন রাজনৈতিক প্রশিক্ষক ছিলেন কুমিল্লার লাকসামের আবদুল বাতেন চৌধুরী। সহযােদ্ধাদের কাছে যিনি এবিসি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। হাবিব সানােয়ার মিলন এবং রায়হান ফেরদৌস মধুও ঢাকায় গণবাহিনীর কার্যক্রমে নেতৃত্ব পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতেন।
১৯৭৩-এর জুন থেকে গণবাহিনীর সংঘটিত কার্যক্রমের আগে বিচ্ছিন্ন। উদ্যোগ হিসেবে কিছু অপারেশন হলেও চারটি ঘটনা গণবাহিনী গঠনকে বিশেষ বেগবান করে তােলে। প্রথমত, বৃহত্তর কুষ্টিয়া অঞ্চলে আখচাষদের সঙ্গে সরকারি প্রশাসনের বিরােধকে কেন্দ্র করে ১৯৭২ থেকেই এক ধরনের সশস্ত্র গণসংগ্রাম বেগবান হয়ে উঠেছিল। এ অঞ্চলে সাধারণত আখের ব্যাপক ফলন হয়। চাষরা নিজস্ব উদ্যোগে মাড়াই করতে চাইলেও প্রশাসন চাইছিল তারা যেন সুগারমিলে আখ জমা দেয়। সেজন্য সুগারমিল এলাকাতে আখ মাড়াই নিষিদ্ধ করা হয়। আখের সরকারি মূল্য ছিল মণপ্রতি আট টাকা। কিন্তু গুড় বানালে লাভ হতাে বেশি। চাষিদের অনেকে ছিল জাসদ সংগঠকদের অনুসারী এবং অস্ত্রধারী। ফলে সেখানে চাষীরা প্রশাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরােধে নেমে পড়ে। ফলে
…………………………………………………………..
৫৬৩) উচ্চতায় খাটো ছিলেন বলে তাঁকে সহযােদ্ধারা লিটল কমরেড’ [এল সি] রফিক বলতেন। তবে গণবাহিনী সংশ্লিষ্ট এরূপ একটি মতও রয়েছে যে, ঢাকা নগর শাখার পলিটিক্যাল কমিশার ছিলেন আ ফ ম মাহবুবুল হক । দেখুন মহিউদ্দিন আহমদ, পূর্বোক্ত। এল সি রফিক বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন।
Page 343
গণবাহিনীর কার্যক্রম শুরুর আগেই জাসদের অধীনে সেখানে কৃষকদের সশস্ত্র একটি বাহিনী বিকশিত হয়ে পড়ে। জাসদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অন্যতম ব্যক্তি নূর আলম জিক ছিলেন যার নেততে। পরবর্তীকালে দলীয়ভাবে যাদের সশস্ত্র শাখার মুখ্য সংগঠকের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাদের একজন হাসানুল হক ইনু’র বাড়িও ছিল কুষ্টিয়া। প্রভাবশালী জাসদ নেতা কাজী আরেফ আহমেদও ছিলেন কুষ্টিয়ার অধিবাসী। এসবের মিলিত ফল হিসেবে দাবি আদায়ের মাধ্যম হিসেবে এবং রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সেখানে সশস্ত্র উত্তাপ চলে আসে। পরবর্তী যেসব ঘটনা জাসদের সশস্ত্র কার্যক্রম বেগবান করে তার মধ্যে রয়েছে, ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চের ঘটনা; রব-জলিলসহ দলের নেতৃস্থানীয় সংগঠকদের আটক হয়ে পড়া এবং চতুর্থত, শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক দেশে জরুরি অবস্থা জারি। এই চার অভিজ্ঞতার পর জাসদ তার রাজনীতি এগিয়ে নেয়ার জন্য সেই কাঠামােটি পুনরুজ্জীবিত করে যেটি সে সংরক্ষণ ও ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছিল স্বাধীনতার পর থেকে এবং যে বিষয়ে ইতােমধ্যে আমরা উল্লেখ করেছি। এভাবে এক পর্যায়ে পুরাে দেশে গণবাহিনী জাসদের বিকল্প পরিচিতি হয়ে ওঠে। এই সশস্ত্র বিকল্পের মাধ্যমে প্রধানত যেসব কাজ হতাে তার মধ্যে রয়েছে :
– রক্ষীবাহিনীর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা এবং প্রতিরােধ (ধারণা করা হচ্ছিলাে শারীরিক সুরক্ষা না দিলে কর্মীরা মাঠ ছেড়ে চলে যাবে);
– রক্ষীবাহিনীর আক্রমণ থেকে জাসদের সভা-সমাবেশকে সুরক্ষা দেওয়া;
– শহরগুলাের গুরুত্বপূর্ণ মােড়ে সশস্ত্র পাহারায় দেয়াল লিখন;
– রক্ষীবাহিনী ও সরকারের অন্যান্য বাহিনীর হামলার বিপক্ষে প্রতিশােধমূলক হামলা চালানাে;
– রাজনৈতিক শত্রু খতম করা (যেমন কুমারখালীতে আওয়ামী লীগ এমপি গােলাম কিবরিয়াকে ঈদের দিন প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়);
– রাজনৈতিক প্রচারমূলক বিভিন্ন হামলা চালানাে (যেমন- ঢাকার একমাত্র ইন্টারন্যাশনাল হােটেলটিতে হামলা করা, বাস ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে বাস জ্বালিয়ে দেওয়া ইত্যাদি);
– শহরতলী ও গ্রামীণ জনপদে সশস্ত্র হয়ে দল বেঁধে ঘুরে বেড়ানাে;
ইত্যাদি।
এর বাইরে গণবাহিনী কয়েকটি স্থানে খাসজমি দখল করে গরিব কৃষক ও ভূমিহীনদের মাঝে বিতরণ করে। বগুড়ায় এরূপ একটি উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়।
তবে অন্তত দেশের একটি অঞ্চলে জাসদের সশস্ত্র কার্যক্রমের উল্লেখযােগ্য কোনাে ছাপ পড়েনি। তা হলাে সিলেট । কারণ এই অঞ্চলে যাকে সশস্ত্র।বিকশিত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল (মাহবুবুর রব সাদী) তিনি তাত্ত্বিকভাবে মনে করতেন এভাবে রাজনীতিকে সশস্ত্র সংগঠন ও তৎপরতানির্ভর করা ভুল।
Page 344
হচ্ছে। প্রতিনিয়ত তিনি বিষয়টি কেন্দ্রীয় পর্যায়ে তুলে ধরলেও তা অবজ্ঞাত হয় । দ্বিতীয় আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করা যায় এ সময়, যদিও শুরুতে সিদ্ধান্ত ছিল, যিনি সশস্ত্র শাখায় থাকবেন তিনি সাধারণ রাজনীতির প্রকাশ্য কাজে থাকবেন না কিন্তু গণবাহিনী বিকশিত হওয়ার পর দেখা গেল অনেক অঞ্চলেই যারা রাজনীতির মুখ্য ব্যক্তি ছিলেন সশস্ত্র পর্যায়ে এসেও তারাই মুখ্য ব্যক্তি থাকছেন। টাঙ্গাইলে খন্দকার আবদুল বাতেন, বগুড়ায় এ বি এম শাহজাহান প্রমুখের দৃষ্টান্ত এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। এই দুই জনের অধীনেই নিজ নিজ অঞ্চলে গণবাহিনীর কার্যক্রম উতুঙ্গে উঠেছিল এবং দুই জনই পরে ভিন্ন ভিন্ন দলে যােগ দিয়েছিলেন। প্রথমজন আওয়ামী লীগে এবং পরের জন জাতীয় পার্টিতে। বাম আন্দোলনের বিশেষ বিশেষ সংগ্রামী এলাকাগুলােতে গণবাহিনীর ব্যাপক তৎপরতা এবং পরে মূল নেতৃত্বের দল ও আদর্শ পরিবর্তনের এইরূপ দৃষ্টান্ত বিশেষ তাৎপর্যবহ। উল্টোদিকে, যেখানে মাওবাদী নকশাল ধারার রাজনীতি খুব বেশি ছিল না। সেখানে গণবাহিনীও খুব বেশি সক্রিয়তা দেখাতে পারেনি। যেমন কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ইত্যাদি। এ পর্যায়ের আরেকটি তাৎপর্যবহ ঘটনা এই যে, সশস্ত্র কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ ঘােষিত হওয়ার পর পার্বত্য চট্টগ্রামের ‘শান্তি বাহিনীর মতাে সশস্ত্র গ্রুপগুলাের জন্য সরকারের ব্যাপক পুনর্বাসন কার্যক্রম থাকলেও গণবাহিনীর মতাে সংগঠনের কর্মীদের জন্য দ্রুপ কোনাে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কমিউনিজম সম্পর্কে ভীতি ও ব্যর্থতার নজির জারি রাখতেই হয়তােবা এইরূপ বাহিনীর কর্মী ও অস্ত্র উভয়ই মাঠপর্যায়ে থেকে যায়। উল্লেখ্য, সিপাহী অভ্যখান ব্যর্থ হওয়া তাহেরসহ পরবর্তীকালে বহু সৈনিকের ফাসি সত্ত্বেও ১৯৮১ পর্যন্ত জাসদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সৈনিকদের বিচ্ছিন্ন আকারে রাজনৈতিক যােগাযােগ ছিল বলে জানিয়েছেন ঐ দলের একজন প্রাক্তন সংগঠক। ফলে ‘গুটিয়ে ফেলার নির্দেশ সত্ত্বেও গণবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে গুটিয়ে গেছে- এমনটিও বলা যায় না।
বিশেষত, এরপর গণবাহিনী ও জাসদের অনেক তরুণ কর্মীকে সুদূর লেবাননে যেতেও দেখা যায় প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পাশে যুদ্ধ করার জন্য। ১৯৮২ সালে লেবাননে ইসরায়েলের সরাসরি আগ্রাসনের পূর্ব পর্যন্ত এইরূপ ‘সংহতি অব্যাহত ছিল- যা বিশেষভাবে বেগবান হয় ঢাকায় ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে মেজর জলিলের এক সংক্ষিপ্ত আলাপের পর। ১৯৮১ সালে আন্তর্জাতিক পরিসরে এক জটিকা সফরের প্রাক্কালে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ঢাকা বিমানবন্দরে যাত্রাবিরতি করেন আরাফাত, তখনি নিজস্ব কর্মীদের জন্য উন্নত সামরিক প্রশিক্ষণের ঐ সুযােগ গ্রহণ করেছিলেন জলিল। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে লেবানন গমনকারী এইরূপ স্বেচ্ছাসেবকের সংখ্যা এক হাজারের
Page 345
মতাে ছিল।৫৬৪ এদের কেউ কেউ ইসরায়েলের হাতে ধরা পড়েছিলেন। অনেকে লেবাননে থাকতে না পেরে সেখান থেকে ইয়ােরােপে পাড়ি জমান। কেবল আরাফাতের ফাত্তাহ গ্রুপেই নয়- পিএলও’র অভ্যন্তরে আহমেদ জিবরিলের অধিকতর বামপন্থী গ্রুপেও অনেক বাংলাদেশি যােদ্ধাকে দেখা যেত তখন । বাংলাদেশে আজও প্যালেস্টাইনিদের সংগ্রামে নিয়ােজিত এইরূপ বামপন্থী স্বেচ্ছাসেবকদের সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত সংকলিত হয়েছে বলে জানা যায় না। জাসদও পরবর্তীকালে এইরূপ যােদ্ধাদের অবদান সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে কখনাে স্মরণ করেছে বলে শােনা যায়নি। যুক্তরাজ্যের খ্যাতনামা ফটোগ্রাফার Pteele Perkins হলেন জাসদের গণবাহিনীর যােদ্ধাদের লেবানন অধ্যায়ের একমাত্র ঐতিহাসিক প্রমাণ সংরক্ষণকারী।৫৬৫ এটা কাকতালীয় যে, Pteele Perkins ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে আসার মধ্য দিয়েই তার আন্তর্জাতিক আলােকচিত্রী জীবনের শুরু করেছিলেন। উল্লেখ্য, লেবাননের পর লিবিয়াতেও অনেক গণবাহিনী সদস্যকে সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানাে হয়েছিল বলে জানা যায়। প্যালেস্টাইনিদের জন্য যুদ্ধকারী গণবাহিনী সদস্যদের অন্যতম ছিলেন কর্নেল আবু তাহেরের ভাই ওয়ারেসাত হােসেন বেলাল। তিনি সেখানে প্লাটুন কমান্ডার পর্যায়ের যােদ্ধা ছিলেন। এই ওয়ারেসাত হােসেন বেলালকেই ১৯৭৬ এ ঢাকায় ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে অপহরণ প্রচেষ্টায়ও যুক্ত থাকতে দেখেছি আমরা (উপ-অধ্যায় ৬.খ এবং তথ্যসূত্র ৫৪৮)। এদিকে, সম্প্রতি প্রকাশিত এক চিঠি থেকে দেখা যায় (সংযুক্তি উনত্রিশ-এ উপস্থাপিত) খােদ লে. কর্নেল আবু তাহেরও এক সময় প্যালেস্টাইনিদের পক্ষে যুদ্ধে আগ্রহী ছিলেন। ১৯৭৩-এর অক্টোবরে নারায়ণগঞ্জে সরকারের সী-ট্রাক ইউনিটের ম্যানেজার থাকাকালে তিনি প্যালেস্টাইনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য সেখানে যাওয়ার লক্ষ্যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে আনুষ্ঠানিক অনুমতিও চেয়েছিলেন। তবে এইরূপ অনুমতি তিনি পেয়েছেন বলে জানা যায় না।
………………………………………………………………..
৫৬৪) স্বাধীন প্যালেস্টাইনের জন্য জাপানের রেড আর্মি এবং আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির মতাে সংগঠনগুলাে থেকেও অনেক যােদ্ধা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে তখন লেবাননে যুদ্ধরত ছিলেন।
৫৬৫) http://english.al-akhbar.com/content/remembering-past-bangladeshi-fighters-palestine-1980s (reterived on (4.07.2014)। উল্লেখ্য, গণবাহিনীর যােদ্ধারা যেমন ঐ সময়ে লেবানন গিয়েছেন- তেমনি প্যালেস্টাইন তরুণদের একটি দলও তখন বাংলাদেশে এসেছিল সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য। প্রশিক্ষণ শেষে লেবানন ফেরত যাওয়া মাত্র এরা ইসরায়েলের গােয়েন্দা সংস্থা মােসাদের হাতে আটক ও নিহত হয়। দেখুন, http://www.somewhereinblog.net/blog/shoummo 71/28893049 (retrieve on 11.07.2014)
Source: মুজিব বাহিনী থেকে গন বাহিনী ইতিহাসের পুনর্পাঠ – আলতাফ পারভেজ