স্বাধীনতা-উত্তর মুজিব বাহিনী : রক্ষীবাহিনীর গঠন ও আত্তীকরণ প্রক্রিয়া
আমরা সব সময়ই বর্তমানে বাস করি। কিন্তু বর্তমানের মাঝে থেকেও শুধুই সমকালীন হয়ে থাকা বােধ হয় সম্ভব নয় আমাদের পক্ষে। ইতিহাস নানান চাতুরি জানে। নানান ছদ্মবেশ ধারণ করে সে প্রতিনিয়ত হাজির হয় বর্তমানে। আগের বহু দৃশ্যপট থাকে তার বর্তমানের মুখােশে। এটাই তার এগােবার কৌশল। আমরা তার এসব কৌশল বুঝতে অনেক সময় ব্যর্থ হই, আর তাতে খেলার বহু তাৎপর্য আমাদের বােধবুদ্ধির বাইরে থাকার উপক্রম হয়। প্রতিবারই নাটকের পর্দা যখন ওঠে, অতীত ধারাবাহিকতাটুকু বােঝা জরুরি। তবে না বুঝলে- সেই দোষের ভাগিদার ইতিহাস নয়। সমস্যা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও দূরদৃষ্টিতে; যে আবার বরাবরই স্মৃতি আর বয়ানে ভারাক্রান্ত থাকে- যা সে শিখেছে এবং দেখেছে অতীতে । বর্তমানকে যখন আমরা আসলে দেখি, তখন অতীতই সেখানে প্রবলভাবে আরােপিত হয়ে থাকে। এমনকি যখন বর্তমানকে এক বৈপ্লবিক কাল বলেও মনে হয়।
-Regis Debray, Revolution in the Revolution?
দু’ জন সেক্টর কমান্ডার (কাজী নূরুজ্জামান ও রফিকুল ইসলাম)সহ বহু নেতৃস্থানীয় মুক্তিযােদ্ধার ইতঃপূর্বে উল্লিখিত ভাষ্য থেকেই দেখা গেছে, বিএলএফ বা মুজিব.বাহিনী সম্পর্কে একাত্তরের মূলধারার সশস্ত্র সংগ্রামী অর্থাৎ মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের৩৪১ ধারণা ছিল সন্দেহময়- তথা নেতিবাচক। মুজিব বাহিনীর ভিন্ন কমান্ড, তাজউদ্দীন বিরােধিতা, ভারতীয় গােয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক এ বাহিনীর প্রতি।বিশেষ আনুকূল্য এবং কমিউনিস্ট র্যাডিক্যালদের প্রতি এই বাহিনীর আক্রমণাত্মক নীতির কারণেই এমনটি ঘটেছিল। যুদ্ধকালে তৃণমূল পর্যায়ে এই বাহিনীর বাস্তব ভূমিকাও বিস্তর সংশয় এবং অবিশ্বাসের জন্ম দেয়। ফলে সিরাজুল আলম খানদের দীর্ঘমেয়াদে বিপুল রাজনৈতিক ক্ষতি হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের বিশাল পরিসরে যুদ্ধদিনে হাজার হাজার দেশপ্রেমিক-সমাজতন্ত্রকামী তারুণ্যের সঙ্গে
……………………………………………………………….
৩৪০) Translation from English and Spanish: Bobbye Ortis. Penguin Books, 1968, p.19 উদ্ধৃতির ইংরেজি থেকে অনুবাদ বর্তমান লেখকের।
৩৪১) ‘মুক্তিবাহিনী’ পদটি সাধারণত দুই ধরনের মুক্তিযােদ্ধাদের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য। দেশের ভেতর থেকে বেসামরিক পেশার যেসব মানুষ গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন এবং যাদের আরেকটি নাম ছিল “ফ্রিডম ফাইটার’; দ্বিতীয়ত, পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিভিন্ন নিয়মিত বাহিনী থেকে যেসব বাঙালি সৈনিক ও অফিসার মুক্তিযুদ্ধে যােগ দিয়েছিলেন এবং যাদের বলা হতাে মুক্তিফৌজ’ বা নিয়মিত বাহিনী’- এই দুইয়েরই সমন্বয়ে মুক্তিবাহিনী। মুজিব বাহিনী ছিল এই ধারার।বাইরের ভিন্ন একটি ধারা। মুক্তিবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত সব ধারাই মুজিবনগরের সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণাধীন ও অনুগত ছিল; কিন্তু মুজিব বাহিনী নয়। শেষােক্ত বাহিনীর ছিল পৃথক নিয়ন্ত্রক কাঠামাে।
Page 218
সংযােগ ঘটার বাস্তব সম্ভাবনা বিনষ্ট হয়েছে উল্লিখিত সংশয় ও বৈরিতার মধ্য দিয়ে। দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর জাসদকে নিয়ে সমাজের প্রগতিশীল মহলে যে শঙ্কা ও প্রশ্ন কাজ করত তারও উৎস ছিল বিএলএফ-এর সঙ্গে সিরাজুল আলম খানদের সংযুক্তি।৩৪২ তাছাড়া মাঠ পর্যায়ের সরাসরি যুদ্ধেও সিরাজুল আলম খানরা অবদান রাখতে পেরেছেন খুব কম। এও তাদের সম্পর্কে অবিশ্বাস তৈরিতে জ্বালানি হিসেবে কাজ করেছে। যদিও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে অনেকে তাৎক্ষণিকভাবে জানতেন না সিরাজুল আলম খান গ্রুপের অনেকেই যুদ্ধের শেষ মাসে দেরা দুনের তান্দুয়া প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ভারতীয় বাহিনীর হাতে অনেকটা বন্দি দশায় থেকেছেন। সে বিষয়ে ইতােমধ্যে ৩.৬ উপ-অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রসঙ্গক্রমে ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের আরেকটি মন্তব্য উল্লেখ করা।যেতে পারে। মুজিব বাহিনীর কার্যক্রম সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি।বলেছেন, জাতি যখন একটি নেতৃত্বের পেছনে ঐক্যবদ্ধ ও আস্থাবান তখন যুবশক্তিকে নেতৃত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করা বা বিভেদ সৃষ্টির প্রচেষ্টা মুক্তিযুদ্ধের জন্য।যেমন সহায়ক হয়নি, তেমনি পরে দেশ পুনর্গঠনের কাজেও তা অন্তরায় হিসেবে কাজ করেছে। আমীরুল ইসলাম মুজিব বাহিনী গড়ে তােলার বিষয়টি প্রাথমিকভাবে গােপন রাখার ভারতীয় প্রচেষ্টাকে পীড়াদায়ক’ বলেও অভিহিত করেছেন। অন্যদিকে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান জানিয়েছেন, বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী যখন মুজিব বাহিনীর বিষয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে ব্যাখ্যা চাইতেন তখন ইন্দিরা সেটা তার ক্যাবিনেট সেক্রেটারিকে জিজ্ঞাসা করতে।বলতেন আর ক্যাবিনেট সেক্রেটারির কাছে ব্যাখ্যা চাইলে তিনি সেটা এড়িয়ে যেতেন- এসবই ছিল (তাজউদ্দীনের জন্য) আত্মসম্মান হানিকর।৩৪৩ বলাবাহুল্য, অসন্তোষ, ক্ষোভ ও গ্লানি থাকলেও মুজিবনগর সরকার মুজিব বাহিনী নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভারতীয় পরিকল্পনা থামাতে পারেনি।
……………………………………………………………
৩৪২) সিরাজুল আলম খান ও তােফায়েল আহমেদ মুজিব বাহিনীর অবিচ্ছেদ্য চার’-এর দু’জন হলেও ‘জাসদ’ গঠনকে তােফায়েল আহমেদ ষড়যন্ত্র হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, স্বাধীনতা বিরােধিরা সর্বপ্রথম জাসদের ছত্রছায়ায় সমবেত হওয়ার সুযােগ পেয়েছিল। সে দিন (জাসদ গঠনকালে) তারা নিজেদের এক আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত করে।’ মাসুদুল হক, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৬৬। মুজিব বাহিনীতে সিরাজুল আলম খানের আরেক সহযােদ্ধা আবদুর রাজ্জাক জাসদ গঠনকে ‘সিরাজুল আলম খানের পশ্চিমবঙ্গে অতিবামদের সঙ্গে মেলামেশার ফল হিসেবে অভিহিত করেছেন। পূর্বোক্ত, পৃ. ১৫৯। পাঠকের হয়তাে স্মরণ রয়েছে, ছাত্রলীগের স্বাধীনতা-পূর্ব কথিত ‘নিউক্লিয়াস’-এ এই আবদুর রাজ্জাকই ছিলেন সিরাজুল আলম খানের প্রধান সহযােগী।
৩৪৩) আমীরুল ইসলাম-এর সাক্ষাৎকার, স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র (১৫ শ’ খণ্ড), তথ্য মন্ত্রণালয়, ঢাকা, ১৯৮৫, পৃ. ১৩১। আনিসুজ্জামান, পূর্বোক্ত।
Page 219
স্বাধীনতা যুদ্ধের সমাপ্তির পর মুজিব বাহিনীর সদস্যদের প্রধানত পাঁচটি ধারায় নতুন রূপে দেখা যায়। এর প্রধান একাংশকে জাতীয় রক্ষীবাহিনী (জেআরবি)৩৪৪ তে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অন্য অংশগুলাের বিবরণ দেওয়ার আগে বর্তমান উপ-অধ্যায়ে মুজিব বাহিনীর প্রধান এই বিকাশধারাটির দিকেই যদি আমরা মনােযােগ নিবদ্ধ রাখি তাহলে দেখতে পাবাে, রক্ষীবাহিনী ছিল একই সঙ্গে সরকার প্রধানের এমন এক ‘নিজস্ব প্রহরীদল- যাদের কার্যক্রম ছিল ঝড়াে পুলিশের মতাে এবং যাদের ভবিষ্যৎ অবয়বটি ফুটে উঠছিল বিকল্প সেনাবাহিনীর আদলে । ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে রক্ষীবাহিনী গড়ে তােলার দায়িত্ব যখন ভারতীয়দের হাতে তখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বিডিআর ও পুলিশ বাহিনী পুনর্গঠনের কাজটি দেশের নিজস্ব ব্যবস্থাপনাতেই হচ্ছিল। এই বৈপরীত্য ছিল বিস্ময়কর ও প্রশ্নবােধক। আরও বিস্ময়কর ছিল। পরিকল্পিতভাবেই রক্ষীবাহিনীকে রাখা হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর অধীনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে নয়। আবার এই বাহিনীর পােশাক রাখা হয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর মতাে। রক্ষীবাহিনীর পরিচালক ব্রিগেডিয়ার এ.এন.এম নূরুজ্জামান ‘বাকশাল’-এর কেন্দ্রীয় কমিটির ১১২ নম্বর সদস্য ছিলেন।৩৪৫ ১৯৭৪ সালের ২৫ জানুয়ারি দৈনিক গণকণ্ঠে প্রকাশিত জাতীয়
……………………………………………………………..
৩৪৪) প্রথমে এই বাহিনীর নাম নিয়ে বিভিন্নমুখী চিন্তা ছিল। একটা মত ছিল- এর নাম হবে “বেঙ্গল মিলিশিয়া’, আরেকটা মত ছিল- এর নাম হবে এনএসএফ বা ন্যাশনাল সিকিউরিটি ফোর্স। শেষপর্যন্ত অবশ্য এর নাম হয় রক্ষীবাহিনী। মুজিব বাহিনীর ‘অতি অনুগত’ একাংশ ছাড়াও বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বহু সংখ্যক নতুন রিক্রুমেন্টও হয়েছিল এ বাহিনীতে। বিশেষত অফিসার পর্যায়ে ৫ম থেকে পরবর্তী ব্যাচগুলাে। তবে মুজিব বাহিনীর সদস্যরাই ছিল রক্ষীবাহিনীর মূল নিউক্লিয়াস’-যেভাবে ছাত্রলীগে একটি নিউক্লিয়াসের অস্তিত্ব দেখেছি আমরা পূর্বে। রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তা সারােয়ার হােসেন মােল্লা দাবি করেছেন, তাদের বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল ১২ হাজার। দেখুন, কর্নেল সারােয়ার বলছি, দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২ নভেম্বর, ২০১২, ঢাকা, পৃ. ৪। অন্যদিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বেঙ্গল ল্যান্সারের প্রথম অধিনায়ক মেজর নাসির উদ্দিন- যিনি রক্ষীবাহিনীর একাংশের সঙ্গে তেসরা নভেম্বরের অভ্যুত্থানেরও অন্যতম সংগঠক রক্ষীদের সংখ্যা ১৬ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছিল বলে দাবি করেছেন। দেখুন, গণতন্ত্রের বিপন্নধারায় বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯৭, পৃ. ৭৫।
৩৪৫) এ পর্যায়ে নূরুজ্জামান সম্পর্কে আরও কিছু বিবরণ তুলে ধরা প্রাসঙ্গিক হবে। একটি রাষ্ট্রীয় বাহিনীর প্রধান করা হলেও স্বাধীনতা যুদ্ধকালে তিনি ছিলেন ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের অবসরপ্রাপ্ত একজন ক্যাপ্টেন মাত্র। নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার সায়েদাবাদ গ্রামে তার জন্ম। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ২৮ নং অভিযুক্ত ছিলেন তিনি। পাকিস্তান সেনবাহিনী থেকে ক্যাপ্টেন হিসেবে অবসর দেয়া হলে ব্যবসায় যুক্ত হন। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বেও তিনি ঠিকাদারিতে নিযুক্ত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ১৯৭১ সালের জুনে তিনি ৩ নং সেক্টরে শফিউল্ল্যাহ’র বাহিনীতে যােগ দেন। ‘৭১-এর জুন থেকে ‘৭২-এ রক্ষীবাহিনীর আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরুর মাঝ পথে মাত্র কয়েক মাসে তিনি কয়েক দফা পদোন্নতি পেয়ে যান। নূরুজ্জামানের মতােই সুপ্রসন্ন ছিল তার বাহিনীরও ভাগ্য। যুদ্ধোত্তর সংকটে সেনাবাহিনীর পুনর্গঠন যখন নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে রক্ষীবাহিনীর গঠন প্রক্রিয়া আর্থিকভাবে তখন ছিল স্বচ্ছন্দ। আট হাজার জনবল নিয়ে শুরু হলেও দ্রুত তা ২৫ হাজারে উন্নীত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। মাঠ পর্যায়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের পাশাপাশি তাদেরও নিয়ােগ করে সরকার। কিন্তু তার অপারেশনের ধরন ‘রাষ্ট্রীয় না হয়ে ‘দলীয়’ রূপ পরিগ্রহ করে। জাসদসহ বিরােধী দলকে প্রতিরােধে এই বাহিনীর ভূমিকা প্রতিবাদের জন্ম দিচ্ছিল। এভাবে সমাজে যে বিরূপতার জন্ম হয় জাসদ তা রাজনৈতিকভাবে পুঁজি করতে শুরু করে। জাসদ, সর্বহারা পার্টি ও রক্ষীবাহিনীর এই সংঘাত মাঠ পর্যায়ে চরম অরাজক অবস্থা তৈরি করে। তৃণমূলের সবচেয়ে অগ্রসর ও সাংগঠনিকভাবে দক্ষ রাজনীতিকরা খুন হতে থাকেন। শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পূর্বপর্যন্ত এই পরিস্থিতি বহাল থাকে। এতে দেশজুড়ে সমাজের ভেতরে কয়েক দশক ধরে গড়ে ওঠা ঐতিহাসিক রাজনৈতিক সামর্থ্য ভেঙে পড়ে। আশির দশকে এসে সে স্থান অন্যভাবে পূরণ হয়। দেশে নতুন আদলে বিদেশি প্রভাবের পথও সুগম করে তােলে তা। রক্ষীবাহিনী সৃষ্টির এই নেতিবাচক দিক সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে সেই সময়কার সেনাকর্মকর্তা মেজর জেনারেল মইনুল হােসেন চৌধুরী লিখেছেন,
“যারা সে সময় রক্ষীবাহিনীর সদস্য নির্বাচন, প্রশিক্ষণ, পােশাক ও পরিচালনা ইত্যাদির ব্যাপারে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, তাদের এরূপ বাহিনী সম্পর্কে জ্ঞান, মেধা ও দূরদর্শিতার প্রচণ্ড অভাব ছিল অথবা সজ্ঞানে তারা নিজেদের হীন স্বার্থে সরকারকে বিপথগামী করেছিলেন।…রক্ষীবাহিনী নিয়ে বিভিন্ন স্তরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া এবং সত্য-মিথ্যা নানানরকম রটনার কারণে সরকারি প্রশাসনের ওপর কালিমা পড়ে। এই অবস্থা প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তায়ও চিড় ধরায়।” দেখুন, এক জেনারেলের, নীরব সাক্ষ্য: স্বাধীনতার প্রথম দশক, মাওলা ব্রাদার্স, ২০০০, ঢাকা, পৃ, ৩৯-৪০।
Page 220
সংসদের প্রশ্নোত্তরের বিবরণ থেকে দেখা যায, কেবল ১৯৭৩ সালে রক্ষীবাহিনী ৪ হাজার ১৯৬ ব্যক্তিকে আটক করেছিল ।
রক্ষীবাহিনীর গঠন প্রক্রিয়ায় মুজিব বাহিনী তথা এই বাহিনীর প্রধান চার নেতার কীরূপ প্রভাব কাজ করেছে তার একটি উদাহরণ হিসেবে এই বাহিনীর উপপরিচালক সারােয়ার হােসেন মােল্লার নিয়ােগ সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব ভাষ্যকে বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। সারােয়ার হােসেন মােল্লা ছাত্রাবস্থায় মাদারিপুরের নাজিমুদ্দিন কলেজে রাজনীতি করতেন। মুজিব বাহিনী সৃষ্টি হলে তিনি এই বাহিনীর প্রথম ব্যাচে অন্তর্ভুক্ত হন এবং মাদারিপুর অঞ্চলের কমান্ডার হিসবে দেশে প্রবেশ করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে মুজিব বাহিনীর কার্যক্রমে কেন্দ্রীয়ভাবে এই অঞ্চলটি নিয়ন্ত্রণ করতেন তােফায়েল আহমেদ। তবে রাজনৈতিকভাবে সারােয়ার মােল্লা ছিলেন মুজিব বাহিনীর চার প্রধান সংগঠকের অন্যতম আবদুর রাজ্জাকের যােগসূত্রের। আওয়ামী লীগ নেতা ফণিভূষণ মজুমদারেরও খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। রক্ষীবাহিনীতে নিয়ােগের পটভূমি তুলে ধরে সারােয়ার মােল্লা লিখেছেন :
৩০ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে বঙ্গবন্ধুর কাছে অস্ত্রসমর্পণ করার জন্য
আমরা ৮-১০টি লঞ্চযােগে মাদারিপুর থেকে ঢাকায় আসি।
Page 221
সদরঘাটে আমাদের অভ্যর্থনা জানানাের জন্য সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই, তােফায়েল ভাই উপস্থিত ছিলেন। তােফায়েল ভাই প্রথমে আমাকে বলেন, তােমার জন্য একটি নতুন দায়িত্বের কথা চিন্তা করেছি। মণি ভাই তােমাকে জানাবে। এরপর সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাইও আমাকে একই কথা বললেন। ব্যাপারটি আমার কাছে রহস্যজনক মনে হলেও কাউকে জিজ্ঞাসা করতে পারিনি। অস্ত্রসমপণের পরদিন সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই, তােফায়েল ভাই আমাকে নিয়ে মণি ভাইয়ের বাসায় যান। মণি ভাইকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর অফিসে যাই। সেখানে আনােয়ার উল আলম শহীদের সঙ্গে দেখা হয়। বঙ্গবন্ধু আমাকে দেখে বললেন,…আমি একটা নতুন ফোর্স করতে চাই। কমান্ডার যাকে বানাবাে সে ইতােমধ্যে নির্ধারণ হয়ে আছে। আমি দু’জন ডেপুটি কমান্ডার চেয়েছিলাম। মণি-সিরাজ-রাজ্জাক-ততাফায়েল তােকে এবং শহীদকে সিলেক্ট করেছে ।৩৪৬
সারােয়ার হােসেন মােল্লার উপরিউক্ত ভাষ্য থেকে রক্ষীবাহিনীর গঠন উদ্যোগের একেবারে শুরুর দিককার কিছু দিকনির্দেশনা পাওয়া যায় বটে তবে তা অতি সামান্য- যদিও সেখান থেকেই শুরু করা যেতে পারে স্বাধীন বাংলাদেশের অভিনব এই সামরিক কাঠামাের উদ্ভব, বিকাশ ও আত্তীকরণ প্রক্রিয়ার অনুসন্ধান অধ্যায়। নূরুজ্জামান ও সারােয়ার মােল্লার পর এই বাহিনীতে তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ নিয়ােগ ছিল আনােয়ার উল আলম শহীদের। তিনি ছিলেন টাঙ্গাইলের কাদেরিয়া বাহিনীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক। বলা বাহুল্য, পুরােপুরি রাজনৈতিক নিয়ােগ ছিল এগুলাে।
…………………………………………………………
৩৪৬) সারােয়ার মােল্লার উপরােক্ত ভাষ্য নানান দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। রক্ষীবাহিনীর সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় মুজিব বাহিনীর প্রধান চার সংগঠকই যে সংশ্লিষ্ট ও সক্রিয় ছিলেন এই ভাষ্য তা স্পষ্ট করে। উপরােক্ত প্রক্রিয়ায় যে জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সিরাজুল আলম খানও সংশ্লিষ্ট ছিলেন তাও দেখা যাচ্ছে তাঁর বক্তব্য থেকে। দ্বিতীয়ত, ইতােমধ্যে এ লেখায় যেমনটি বলা হয়েছে, শুধু মুজিব একা নন। তাঁর অনুপস্থিতিতে গড়ে ওঠা মুজিব বাহিনী এবং বিশেষ ভারতীয় কর্তৃপক্ষ যৌথভাবে রক্ষীবাহিনীর গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত এবং বাহিনীর মানবসম্পদ এবং যান্ত্রিকসম্পদ- অনেকখানিই উপরােক্ত সম্মিলিত প্রক্রিয়ারই ফসল- তা অনেকটা স্পষ্ট হয় রক্ষীবাহিনীর উপ-পরিচালক জনাব মােল্লার বক্তব্য থেকে। দেখুন, কর্নেল সারােয়ার বলছি-দ্বিতীয় কিস্তি, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২ নভেম্বর ২০১২, ঢাকা, পৃ. ৪।
রক্ষীবাহিনীর সরঞ্জাম ও পােশাক পাওয়ার বিষয়টি কীভাবে সরাসরি এ বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে জেনারেল উবানের স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের জেনারেল বি এন সরকারের Civil Affairs Organization-CAO-এর মাধ্যমে সমাধা হতাে তার মনােযােগ আকর্ষণী বিবরণ দেখুন, আনােয়ার উল আলম, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৬-৪৭। অন্যদিকে CAO সম্পর্কে দেখুন বর্তমান গ্রন্থের ৪.ক উপ-অধ্যায়।
Page 222
ইতােমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রথম দিকে রক্ষীবাহিনী নামক সামরিক, কাঠামােটির মূল জনশক্তি এসেছিল মুজিব বাহিনী থেকে। যেহেতু এই বাহিনী নিয়ে নীতিনির্ধারক মহলে ব্যাপক পরিকল্পনা ছিল সে কারণে মুজিব বাহিনীর বাইরের কিছু বিশ্বস্ত’ মুক্তিযােদ্ধারও অন্তর্ভুক্তি ঘটে তাতে। এমনকি এক পর্যায়ে মুক্তিযােদ্ধা নন এমন সামরিক কর্মকর্তাদেরও নেয়া হয় এই বাহিনীতে। পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত কিছু আর্মি অফিসারও রক্ষীবাহিনীতে নিযুক্তি পেয়েছিলেন।৩৪৭ সেটা হয় বাহিনী প্রধান হিসেবে নূরুজ্জামানের পছন্দ অনুসারে। মেজর এ কে এম আজিজুল ইসলাম, লে. কর্নেল সাবিহ উদ্দিন আহমেদ, মেজর শরিফউদ্দিন আহামেদ এবং ডেপুটি ডিরেক্টর মেজর আবুল হাসান খান ছিলেন সেরকম কয়েকজন। অন্যদিকে রক্ষীবাহিনীতে মুজিব বাহিনী বহির্ভূতদের প্রধান এক অংশ এসেছিল কাদের সিদ্দিকীর মুক্তিযুদ্ধকালীন বাহিনী থেকে। ৫ম, ৬ষ্ঠ ও ৭ম ব্যাচের রক্ষী অফিসারদের সেনাবাহিনীর রিক্রুটমেন্টের মতাে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে বাছাই করা হলেও বাহিনীর মূল শক্তিভিত ছিল মুজিব বাহিনীর সদস্যরাই। এক থেকে চার নম্বর ব্যাচের নিয়ােগ সরাসরি মুজিব বাহিনী থেকে হয়েছিল। ৭টি ব্যাচে এভাবে রিক্রুট করা কর্মকর্তার সংখ্যা ছিল আনুমানিক ৩-৪ শত।৩৪৮ আনােয়ার উল আলম এই সংখ্যা সুনির্দিষ্টভাবে ২১৩ জন বলে উল্লেখ করেছেন।৩৪৯ আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশ রাইফেলস্ ও রক্ষীবাহিনীকে একীভূত করা কিংবা এই দুয়ের সমন্বয়ে জাতীয় একটি মিলিশিয়া গঠনের অস্পষ্ট একটি পরিকল্পনা ছিল নীতিনির্ধারকদের মাঝে প্রথম দিকে। এ নিয়ে উভয় বাহিনীতে ছিল অনাগ্রহ, যার ভিত্তিতে এক দফা বিধ্বংসী সংঘর্ষও হয় পিলখানাতে- যে বিষয়ে ৪.খ উপ-অধ্যায়ে ইতােমধ্যে আলােচনা করা হয়েছে ।
১৯৭২ সালের ৭ মার্চ রক্ষীবাহিনী সম্পর্কিত আইনগত কাঠামাের প্রকাশ্য।ঘােষণা আসে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরে। তবে তার আগেই ২১ ফেব্রুয়ারি রক্ষীবাহিনীর কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। ১৯৭২ সালের ২১ জুন রক্ষীবাহিনীর প্রথম কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় ব্যাচের শিক্ষা সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয় ৬ ডিসেম্বর। এই বাহিনীর সদর দপ্তর ছিল ঢাকার শেরেবাংলা নগরে (বর্তমানের এরােপ্লেন মােড়ের কাছে)। প্রধান প্রশিক্ষণকেন্দ্র ছিল ঢাকার সাভারে। প্রথমে এর অফিসারদের প্রশিক্ষণের মেয়াদ ছিল আড়াই মাস। পরে তা ছয় মাস করা হয়। বিজ্ঞাপন দিয়ে রিক্রুটদের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ ১০ মাসে উন্নীত করা হয়। বাহিনী অন্তর্ভুক্তদের অনেকের ক্ষেত্রে ভারতেও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। নাম প্রকাশে
……………………………………………………………
৩৪৭) মে. জেনারেল মইনুল, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৬।
৩৪৮) বর্তমান লেখকের সঙ্গে রক্ষীবাহিনীর ৫ম ব্যাচের অফিসার মেজর (অব.) রেজার অপ্রকাশিত আলাপচারিতা থেকে, পূর্বোক্ত।
৩৪৯) আনােয়ার উল আলম, পূর্বোক্ত, পৃ. ৭৫।
Page 223
অনিচ্ছুক রক্ষীবাহিনীর সপ্তম ব্যাচের একজন কর্মকর্তা- যিনি পরবর্তীকালে লে. কর্নেল পদমর্যাদায় সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়েছেন- ২ নভেম্বর ২০১৩ তারিখে ঢাকার নিউডিএইচএস-এ আলাপচারিতায় জানিয়েছেন, ছয় মাস মেয়াদি তাদের মূল পেশাগত প্রশিক্ষণ দেরাদুনেই হয়। ওই কর্মকর্তা এও জানান, প্রশিক্ষণের জন্য দেরাদুন যাওয়ার আগে স্বয়ং শেখ মুজিবুর রহমান গণভবনে তাদের নির্দেশনামূলক ব্রিফ্রিং দেন এবং বিদায় জানান। রক্ষীদের ভারতে প্রশিক্ষণের এই প্রক্রিয়া শুরু ১৯৭২ সালের এপ্রিলে- যখন বাহিনীর সর্বোচ্চ স্তরের একটি দল ভারত গমন করে প্রশিক্ষণের জন্য। এদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ২১ জন্য লিডার’- যারা ছিলেন পুরাে বাহিনীর মেরুদণ্ডস্বরূপ।
রক্ষীবাহিনীর গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে বিশেষ মিল ছিল ভারতের সেন্ট্রাল রিজার্ভ ফোর্স-এর। কৌতূহলােদ্দীপক দিক হলাে রক্ষীবাহিনী গড়ে তােলার দায়িত্বও পেয়েছিলেন জেনারেল উবান, যিনি ছিলেন ‘র’-এর স্পেশাল ফোর্সের ইন্সপেক্টর জেনারেল। এই বাহিনীর প্রশিক্ষণ হয় মুজিব বাহিনীর যেখানে প্রশিক্ষণ হয়েছিল সেসব ক্যাম্পে। সিআইএ’র সহায়তায় যে সশস্ত্র অবকাঠামাে তৈরির পটভূমি ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে ৩.খ ও ৩.ঘ উপ-অধ্যায়ে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। রক্ষীবাহিনীর জন্য ভারতীয় সরঞ্জাম পরিবহনের জন্য ‘এএন ১২’ ধরনের বিশেষ পরিবহন বিমানও বরাদ্দ করেছিল ভারতীয় কর্তৃপক্ষ।৩৫০
মুজিব বাহিনীর ধারাবাহিকতা হিসেবে এই বাহিনী গড়ে তােলার বিষয়টি যে রাষ্ট্রীয়ভাবে অনেকাংশে ভারতীয় নজরদারিতে হয়েছে তার প্রমাণ হিসেবে বলা যায়, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন মুখ্য সচিব পরমেশ্বর নারায়ণ হাকসারের মাধ্যমেই রক্ষীবাহিনীর প্রশিক্ষক হিসেবে জেনারেল উবানের নিযুক্তি ঘটেছিল- যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশে উবানের পদমর্যাদা ছিল প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত উপদেষ্টা৩৫১ প্রকাশ্যে রক্ষীবাহিনীর কমান্ডে ছিলেন ক্যাপ্টেন (পরে কর্নেল এবং ব্রিগেডিয়ার) নূরুজ্জামান। নূরুজ্জামানের পর বাহিনীতে প্রধান কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিলেন মেজর (অব.) আবুল হাসান খান (উপ-পরিচালক, প্রশাসন), লে. কর্নেল সাবিহউদ্দিন আহমেদ (উপ-পরিচালক, সিগন্যাল), লে. কর্নেল আজিজুল ইসলাম (প্রথমে উপ-পরিচালক, প্রশিক্ষণ এবং পরে কমান্ডার, চট্টগ্রাম), সারােয়ার হােসেন মােল্লা (উপ-পরিচালক, অপারেশন), আনােয়ার উল আলম শহীদ (উপ-
………………………………………………………….
৩৫০) পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৬-৪৭। আনােয়ার উল আলমের বিবরণ থেকে স্পষ্ট কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের পরও উবানের নেতৃত্বাধীন স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রক্ষীবাহিনীর সরঞ্জাম ও সম্পদের প্রধান উৎস ছিল। রক্ষীবাহিনীর পক্ষ থেকে আনােয়ার উল আলম নিজেই একবার এসএফএফ-এর কেন্দ্রীয় দপ্তরে গিয়েছিলেন এসব সরঞ্জাম আনার জন্য। সেখানে এসএফএফ-এর ব্রিগেডিয়ার ব্রিজভূষণ ভাটনগর এই সরবরাহ ব্যবস্থা তদারক করছিলেন।
৩৫১) এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণের জন্য দেখুন, জেনারেল উবান, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৪০-৪১।
Page 224
পরিচালক, প্রশিক্ষণ) প্রমুখ। উল্লেখ্য, পরিচালকের পর উপ-পরিচালকদের মাঝে শেষােক্ত দু’টি পদই ছিল রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এদের দু’জনকে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ১৯৭৩-এর সেপ্টম্বরে ছয় মাসের জন্য ভারত পাঠানাে হয়েছিল । ইতােমধ্যে এও উল্লেখ করা হয়েছে, আনােয়ার উল আলম শহীদকে নেয়া হয় ‘কাদেরিয়া বাহিনী থেকে এবং সারােয়ার হােসেন ছিলেন মুজিব বাহিনীর মাদারিপুর অঞ্চলের একজন কমান্ডার। বাকি গুরুত্বপূর্ণ পরিচালকরা অধিকাংশই ছিলেন পাকিস্তান প্রত্যাগত সামরিক অফিসার। সুতরাং এ ভাষ্যটিও ঠিক নয় যে, দক্ষ মুক্তিযােদ্ধাদের দেশের কাজে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে রক্ষীবাহিনীর সৃষ্টি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গড়ে ওঠা বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর বিশাল অফিসার গােষ্ঠী থেকে নূরুজ্জামান ব্যতীত কারােই ঠাই হয়নি রক্ষীবাহিনীর সর্বোচ্চ পরিসরে- যা ছিল সামরিক দিক থেকে তাৎপর্যবহ। এ পর্যায়ের মূল কৌশলগত রাজনৈতিক তাৎপর্য ছিল বিশেষভাবে লক্ষ্য করার মতাে। মুক্তিযুদ্ধকালে মুজিব বাহিনীর গঠন যেভাবে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে তার আস্থার সংকট তৈরি করেছিল এবং ফলে পুরাে যুদ্ধ-প্রক্রিয়ায় প্রবাসী সরকার ও মুক্তিবাহিনীর সার্বভৌমত্ব যেভাবে ক্ষুন্ন হয়েছিল তেমনিভাবে দেখা গেল- স্বাধীনতার পর রক্ষীবাহিনী গঠনের মধ্য দিয়ে এই বাহিনীর সঙ্গে সেনাবাহিনীর আস্থার সংকট সৃষ্টি হচ্ছে (আরও ব্যাপকতর রূপে) এবং এটা পুরাে দেশের রাজনৈতিক ও সামরিক কাঠামাে এবং তার মনস্তত্ত্বকে বিপজ্জনক নাজুকতার দিকে ঠেলে দেয়।
রক্ষীবাহিনীর গঠন প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে সচেতনভাবে দূরে রাখা ও এর গঠন প্রক্রিয়ায় ভারতীয়দের সম্পৃক্তির পাশাপাশি এই সময়টিতে এমন আরও কিছু ঘটনা ঘটছিল যা স্বাভাবিকভাবে সাধারণ্যে এবং সুনির্দিষ্টভাবে সেনাবাহিনীর মাঝে ব্রিতকর অবস্থা তৈরি করে। যেমন ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান জেনারেল অরােরা ১৬ ডিসেম্বরের পরবর্তী ২-৩ মাস যতবার ঢাকা এসেছেন ততবারই ঢাকা সেনানিবাসের কমান্ড হাউজ’-এ তার থাকার ব্যবস্থা হতাে। যেখানে স্বাধীনতার আগে থাকতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্ব- পাকিস্তানস্থ প্রধান। অরােরা ঐ সময় ঢাকায় চলাফেরার সময় তাঁর গাড়িতে ইস্টার্ন কমান্ডের পতাকা শােভা পেত। তাঁর গাড়ির সামনে পেছনে ভারতীয় রক্ষীরা রাস্তার স্বাভাবিক চলাচল বন্ধ করে যাতায়তের ব্যবস্থা করতেন। অনেকটা এখন যেভাবে দেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে করা হয়। অরােরার চলাফেরার। এই ধরন’ এতটাই বিস্ময় তৈরি করে যে, সেই সময়কার ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সুবিমল দত্তকে স্বপ্রণােদিত হয়ে তাতে হস্তক্ষেপ করতে হয়। এ বিষয়ে জনাব দত্তের সঙ্গে ডেপুটি হাইকমিশনার জে এন দীক্ষিতের যে কথােপথন হয় তার উল্লেখ করে শেষােক্তজন লিখছেন,
Page 225
“তিনি (সুবিমল দত্ত) আমাকে বললেন, ভারতের এখন উপলব্ধি করা উচিত, তাদের সামরিক কর্মকর্তাদের বাংলাদেশে এভাবে চলাফেরার সুযােগ নেই। এটা একটা স্বাধীন দেশ এবং ভারতও। তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। জেনারেল অরােরার সফরকালে লজিস্টিক সাপাের্টে অবশ্যই পরিবর্তন আনতে হবে। একটি বিদেশী দেশে তিনি কোনভাবেই ইস্টার্ন কমান্ডের পতাকা উড়িয়ে চলাফেরা করতে পারেন না। তাঁর চলাচলকালে এ দেশের গাড়ি-ঘােড়া সরানাের দায়িত্বও ভারতীয় সৈনিকদের পালন করার কোন সুযােগ নেই। উপরন্তু ঢাকা সেনানিবাসের কমান্ড হাউজে তিনি। কোনভাবেই থাকতে পারেন না। তাঁর থাকা উচিত সেখানকার ভিআইপি গেস্ট হাউজে যদি তিনি তাদের আমন্ত্রণে এসে থাকেন। এ ছাড়া এ দেশে এসেই প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্টের কাছে সরাসরি চলে যাওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করা উচিত অরােরার। তার সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা হতে হবে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে।”৩৫২
উপরিউক্ত উদ্ধৃতিটি দীর্ঘ হলেও এ থেকে বাংলাদেশের তৎকালীন সমাজে ভারত-বিরােধী মনােভাব গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে ভারতীয় ও বাংলাদেশের ঊর্ধ্বতন মহলের দায়-দায়িত্বের কিছুটা আঁচ করা যায়। ভারতীয় একজন পেশাদার কূটনীতিবিদের চোখে যেটা অস্বাভাবিক ও অগ্রহণযােগ্য হিসেবে ধরা পড়ছিলে স্বাধীনতায় উদ্বেল বাংলাদেশের সৈনিক-জনতার কাছে তা নিশ্চিতভাবেই আরও গভীর মর্মবেদনার সঙ্গে দৃষ্টিকটু ঠেকছিল। ঠিক এই সময়টিতেই সরকার রক্ষীবাহিনী গড়ে তােলার প্রক্রিয়ায় ভারতীয়দের সংশ্লিষ্ট করছিলেন। সেই সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে ঐ বাহিনীর উপ-পরিচালক সারােয়ার মােল্লা সম্প্রতি স্পষ্টভাবেই বলেছেন, এই বাহিনী তৈরির পেছনে আসলে যে উদ্দেশ্য কাজ করেছে, তা হলাে সদ্য স্বাধীন দেশের সেনাবাহিনীর পরিসর এবং সংখ্যা বাড়ানাে হলে- এ বিষয়টি ভারত সরকার হয়তাে ভালােভাবে দেখবে না। সুতরাং ভারতের সাহায্য এবং সহযােগিতায় একটি প্যারা মিলিটারি ফোর্স দাঁড় করানাে হলে, ভারত হয়তাে মনে করবে এই ফোর্স তাদের অনুগত থাকবে। এ কারণে ভারত সরকার বিনা দ্বিধায় সব ধরনের সাহায্য-সহযােগিতা প্রদান করবে।৩৫৩
সারােয়ার মােল্লার উপরিউক্ত বক্তব্য পুরােপুরি সত্য হলেও তাতে রক্ষীবাহিনী সৃষ্টির ‘রাজনীতি’টুকু আড়াল করতে গিয়ে অনেক প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। ভারত বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে সাহায্য করবে না, কিন্তু রক্ষীবাহিনীকে সাহায্য করবে- এর কারণ কী? নিশ্চিতভাবে রক্ষীবাহিনীর অতি-উচ্চপদস্থ একজনকর্মকর্তার এই বক্তব্যের গভীর তাৎপর্য রয়েছে এবং সেই তাৎপর্যের যােগ রয়েছে।
……………………………………………………………….
৩৫২) J. N. Dixit, Ibid, p. 146.
৩৫৩) সারােয়ার মােল্লা, পূর্বোক্ত।
Page 226
একদিকে যেমন মুজিব বাহিনীর সৃষ্টির মাঝে তেমনি বাহাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশের ভবিষ্যতের মাঝেও। সারােয়ার মােল্লার বক্তব্য থেকে আরও যে ধাধা তৈরি হয় তা হলাে, একাত্তরের নয় মাসে ভারত উদারভাবে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে সাহায্য করলেও কেন মাত্র কয়েক মাস পরে আর তাকে সাহায্য করবে না বলে ধরে নেয়া হচ্ছে এবং কেনই-বা সেই একই ভারত মুজিব বাহিনীকে অন্য নামে ব্যাপক সাহায্য দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিকতা দিতে যাচ্ছে; উপরন্তু বাংলাদেশ সেই সাহায্য আগ্রহ ভরে নিচ্ছে। এমনকি হবু দল জাসদের নেতারাও। কেন ঐ প্রক্রিয়ায় যুক্ত? রক্ষীবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা সারােয়ার মােল্লার নিয়ােগ প্রক্রিয়ায় যে সিরাজুল আলম খানও সংশ্লিষ্ট ছিলেন সে বিবরণ ইতােমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া বাকি অন্যান্য প্রশ্নেরও উত্তর পাবাে আমরা পরবর্তী অধ্যায়গুলােতে। তার আগে এই বাহিনীর গঠন, আইনগত কাঠামাে এবং প্রশিক্ষণ সম্পর্কিত কিছু মৌলিক তথ্য তুলে ধরা যাক।
মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতীয় শিবিরে মুজিব বাহিনীর প্রশিক্ষকদের মধ্যে যারা সমাজতন্ত্র বিরােধী মনােভাবাপন্ন ছিলেন বলে ধারণা তৈরি হয়। দেখা যায়, তাদেরই বাছাই করে রক্ষীবাহিনীর প্রশিক্ষক করা হচ্ছে। প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে একটি অদ্ভুত ব্যাপার ছিল- এর অফিসারদের (এবং ক্ষেত্রবিশেষে সুবেদারদেরও) প্রশিক্ষণ দেওয়া হতাে ভারতে এবং সৈনিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতাে ঢাকার সাভারে । ভারত থেকে আগত মেজর রেডির নেতৃত্বাধীন একটি দল প্রথম দিকে সাভারের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। রেভিড় ছিলেন একজন খ্যাতনামা প্রশিক্ষক। তবে আনােয়ার উল আলমের মতে, জনৈক মেজর ত্রিবেদীদের নেতৃত্বে ভারতীয় সেনাবাহিনীর তিনজন কর্মকর্তা ও ৪-৫ জন জেসিও ও এনসিও ঢাকায় এসেছিলেন রক্ষীদের প্রশিক্ষণের জন্য।৩৪৫ উল্লেখ্য, নানান স্তরে রক্ষীবাহিনীর প্রাক্তন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যােগাযােগ করেও মেজর ‘মালহােত্রা’, মেজর ‘ত্রিবেদী’ প্রভৃতি নামগুলাের পুরাে বিবরণ সংগ্রহ করা যায়। নি- তাদের সামরিক ক্যারিয়ারের পূর্বাপর জানা যায়নি, যা জরুরি ছিল।
রক্ষীবাহিনীর সর্বনিম্ন পদ ছিল রক্ষী এবং সর্বোচ্চ পদ ছিল ডিরেক্টর জেনারেল । নিম্নপদ থেকে উর্ধ্ব পদের দিকে অধিনায়কদের তারা লিডার বলত। লিডার-ডেপুটি লিডার-এসিসট্যান্ট লিডার এভাবে ছিল অফিসার পদের নিম্নমুখী ধারাবাহিকতা। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল (অব.) মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক (যিনি নিজেও স্বল্প কিছু দিন রক্ষীবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন) তাঁর এক গ্রন্থে রক্ষীবাহিনীর জনবল সম্পর্কিত অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। তাতে দেখা যায়, রক্ষীবাহিনীর অফিসার সম্প্রদায়ের রিক্রুটমেন্ট হয়েছে
……………………………………………………………
৩৫৪) আনােয়ার উল আলম, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৪।
Page 227
নিম্নোক্তভাবে : প্রথম ব্যাচ : ১০ জুলাই, ১৯৭২; দ্বিতীয় ব্যাচ : ২৭ অক্টোবর ১৯৭২; তৃতীয় ব্যাচ : ২৮ অক্টোবর ১৯৭২; চতুর্থ ব্যাচ : ১ অক্টোবর ১৯৭৩; পঞ্চম ব্যাচ : ২৮ এপ্রিল ১৯৭৪; ষষ্ঠ ব্যাচ : ১ মে ১৯৭৫; সপ্তম ব্যাচ : ১ নভেম্বর ১৯৭৫। শেষের ব্যাচটি (যার সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৫৭ জন) প্রশিক্ষণ গ্রহণকালে রক্ষীবাহিনী সেনাবাহিনীতে আত্তীকৃত হয়ে যায়। ৩৫৫ শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের পরিকল্পনা ছিল, বাকশালের অধীনে প্রত্যেক জিলা গভর্নরকে এক ইউনিট করে রক্ষী দেওয়া হবে। ফলে দ্রুত এই বাহিনীর বিকাশ ঘটানাে হচ্ছিল। পনেরাে আগস্টের কু’র পূর্ব মুহূর্তে জেলা গভর্নররা প্রশিক্ষণরত অবস্থায় ছিলেন এবং চৌদ্দ আগস্ট বৃহস্পতিবার বিকেলেও এই গভর্নরদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন একজন রক্ষী কর্মকর্তা!৩৫৬
উল্লেখ্য, আইনগতভাবে রক্ষীবাহিনী ছিল ব্যাপক ক্ষমতাপ্রাপ্ত এক বাহিনী।।এই লেখার শেষে রক্ষীবাহিনী আইন ও তার সংশােধনীগুলাে সংযুক্ত করা হলাে। যা থেকে এই বাহিনীর ক্ষমতার পরিধি সম্পর্কে আঁচ করা সম্ভব। ১৯৭৫ সালের ৬ অক্টোবর খন্দকার মােশতাক আহমদের নেতৃত্বাধীন সরকার এক অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে রক্ষীবাহিনীকে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করার ঘােষণা দেয়। বলা হয় : ‘সেনাবাহিনীতে যারা যােগদান করতে চাইবে ও যােগদানের উপযুক্ত বিবেচিত হবে শুধু তাদেরই নেয়া হবে কতগুলাে শর্তে। এ সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশিত হয় ৯ সেপ্টেম্বর। উপরিউক্ত নির্দেশনায় রক্ষীবাহিনীর যাবতীয় অস্ত্রশস্ত্র, ব্যাংক ব্যালেন্স, যানবাহন ইত্যাদি সেনাবাহিনী অথবা অন্যান্য প্রতিরক্ষা বাহিনীর নিকট হস্তান্তর করার ঘােষণা দেওয়া হয়। এ প্রক্রিয়ায় ঢাকার সাভার, চট্টগ্রামের
………………………………………………………………..
৩৫৫) বিস্তারিত দেখুন, মেজর জেনারেল (অব.) মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে আটাশ বছর, মাওলা ব্রাদার্স, ১৯৯৯, ঢাকা, পৃ. ২৮-২৯। আরও দেখুন, মেজর জেনারেল এস এস উবান, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৪০ এবং মেজর জেনারেল মইনুল হােসেন চৌধুরী, এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য: স্বাধীনতার প্রথম দশক, মাওলা ব্রাদার্স, ২০০০, ঢাকা।
৩৫৬) এই দিনই (১৪ আগস্ট সন্ধ্যায়) প্রায় চার সপ্তাহের এই প্রশিক্ষণপর্বটি শেষ হয় প্রশিক্ষণার্থীদের উদ্দেশে তােফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল হক মণি ও আব্দুর রাজ্জাকের লেকচারের মধ্য দিয়ে। সমাপনী দিনে বক্তাদের এই সন্নিবেশ ও তাদের বক্তব্য থেকে নবীণ গভর্নররাও বুঝে নিয়েছিলেন ভবিষ্যৎ প্রশাসনের আদলটি। ১৯৭৫-এর ২০ জুলাই থেকে এই প্রশিক্ষণটি হয়েছিল সাধারণ কোনাে প্রশাসনিক ভবন বা আমলাদের কোন প্রশিক্ষণ।ইনস্টিটিউটে নয়- বঙ্গভবনে। সেখানকার একটি কক্ষকে এক মাসের জন্য ক্লাশরুমের রূপ দেয়া হয়েছিল । মােট গভর্নরের সংখ্যা ছিল ৬২- যাদের মধ্যে ৫০ জন ছিলেন সরাসরি আওয়ামী লীগের নেতা, একজন ছিলেন সেনা কর্মকর্তা এবং বাকি ১১ জন ছিলেন আমলা। শেষােক্তদের একজন মােফাজ্জল করিম। তিনি গােপলগঞ্জের গভর্নর হিসেবে নিয়ােগ পেয়েছিলেন। প্রশিক্ষণকালে শেষদিন তাদের উদ্দেশ্যে মুজিব বাহিনীর প্রধান তিন নেতার বক্তব্যের জন্য দেখুন, জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৭৪।
Page 228
ভাটিয়ারী, খুলনার গিলতলা, সিলেটের বটেশ্বর ইত্যাদি স্থানের বিপুল ভূ-সম্পদের মালিকানা ছাড়াও সেনাবাহিনীতে রক্ষীবাহিনীর আত্তীকরণকে বাংলাদেশে সেনা আমলাতন্ত্রের জন্য নিজেকে বিস্তৃত করার এক অভাবনীয় উপলক্ষ হিসেবে বিবেচনা করা যায়- শিগগির যার প্রভাব প্রতিভাত হতে শুরু করে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাপনা, রাজনীতি ও আর্থসামাজিক পরিমণ্ডলে।
সেনাবাহিনীতে রক্ষীদের আত্তীকরণ শুরু হয় ১৯৭৫-এর ১২ অক্টোবর থেকে । খুব ধীরে ধীরে এই আত্তীকরণ সম্পন্ন হচ্ছিল। অফিসারদের স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আত্তীকরণ করা হয়। এই পুরাে পদক্ষেপটি আইনগতভাবে সঠিক ধারায় এগােলেও প্রশাসনিকভাবে ছিল অভিনব ও বিস্ময়কর। পঁচাত্তর পরবর্তী সরকার নিজেদের ‘শেখ মুজিবুর রহমানের ভুল থেকে জাতিকে রক্ষা করার জন্য আবির্ভূত বলে কথিত হলেও তারা এমন একটি বাহিনী’কে দেশের সুশৃংখল প্রতিরক্ষা কাঠামােতে একীভূত করে নেয়- যে বাহিনী স্বরাষ্ট্র বা প্রতিরক্ষা কোন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত ছিল না, যে বাহিনী গড়ে উঠেছিল ভিন্ন একটি দেশের সেনাকর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতায়, যে বাহিনীর জনবলের বিরাট এক অংশের সামরিক জীবনের শুরু হয়েছে বিদেশি গােয়েন্দা সংস্থার তত্ত্বাবধানে এবং যে বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্নের বিবেচনাযােগ্য অভিযােগ ছিল, তাকে কোনাে ধরনের প্রকাশ্য তদন্ত বা জবাবদিহিতার মুখােমুখি না করেই এবং তার সদস্যদের মেধা, যােগ্যতা ও অতীত রাজনৈতিক সম্পৃক্তি সম্পর্কে জনমানসে প্রশ্ন থাকার পরও রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীর মতাে সুশৃঙ্খল একটি বাহিনীতে একীভূত করা হয়। তবে রক্ষীবাহিনীর কাছ থেকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য জবাবদিহিতা আদায়ে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ১৯৭৩ সালে প্রণীত ‘রক্ষীবাহিনী সংশােধনী আইন’-এর উল্লেখ করা যায়। এই বাহিনীর কার্যক্রম শুরুর দীর্ঘ ২০ মাস পরে তার অতীত কার্যকলাপ’-এর বৈধতা দিয়ে ঐ সংশােধনী আইনটি তৈরি হয়।
উল্লেখ্য, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রক্ষীবাহিনীর পঞ্চম ব্যাচের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন (যিনি পরে সেনাবাহিনীতেও আত্মীকৃত হন এবং মেজর হিসেবে। অবসরে যান), ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে সাভারে ও দেশের অন্যত্র তাদের এক ধরনের উত্তেজনাকর অবস্থা তৈরি হয়েছিল। তবে ‘সেনাবাহিনীতে যথাযথ মর্যাদায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে এইরূপ আশ্বাসে শান্তি পর্ণভাবে তারা অস্ত্রসংবরণ ও সমর্পণ করে। সেসময় রক্ষীবাহিনীর খুলনা কেন্দ্রে অবস্থানকারী ঐ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ১৫ আগস্টের পর প্রতিশােধমূলক তৎপরতার জন্য তারা প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু বাহিনীর কেন্দ্র তখন ছিল নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনাহীন। নূরুজ্জামান বাইরে থাকায় ঐ সময় রক্ষীবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ছিলেন মেজর আবুল হাসান খান। খুলনায় অবস্থানকারী ঐ কর্মকর্তার ভাষায়, সে সময় প্রতীয়মান হচ্ছিল, ১৫ আগস্টের ঘটনাবলির পেছনে
Page 229
সেনাবাহিনীর সমর্থন বিদ্যমান। এরূপ অবস্থায় পুরাে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে যে নেতৃত্ব প্রয়ােজন তা পাওয়া যাচ্ছিল না। কার্যত রক্ষীবাহিনী তখন প্রতিরােধ বা প্রতিশােধমূলক কোনাে তৎপরতায় অংশ নেয়নি। উল্লেখ্য, ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এ সাভারের ক্যাম্পে রক্ষীবাহিনীর প্রায় এক হাজার সৈনিক ও অফিসার ছিলেন বলে জানা যায়। অধিকাংশ ছিল রিক্রুট ব্যাটালিয়ন- নিয়মিত ব্যাটালিয়ন নয়। অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে এখান থেকে কিছু রক্ষী পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে এবং একাধিক রক্ষী আত্মহত্যাও করে।৩৫৭
রক্ষীবাহিনীর উপ-পরিচালক (অপারেশন) সারােয়ার মােল্লার ভাষ্য থেকে জানা যায়, ১৫ আগস্টের পর তাঁরা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে যাওয়ার কথাও চিন্তা করেছিলেন।৩৫৮ তবে সেই প্রকল্প তারা বাদ দেন এই ভেবে যে, ১৯৭১ সালে আমরা যে সাহায্য পেয়েছিলাম এবারও তা অব্যাহত থাকবে এমনটা আশার করার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। আরও একটা শঙ্কার কারণ ছিল- রক্ষীবাহিনীকে সাহায্য করার নামে তার ছদ্মাবরণে যদি ভারতীয় সেনাবাহিনী। পুনরায় বাংলাদেশে প্রবেশ করে, তাহলে এ দেশের মানুষ বংশপরম্পরায় রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের মীর জাফর হিসেবে গালাগাল করবে।৩৫৯
সারােয়ার মােল্লার ঐ ভাষ্য থেকে এও জানা যায়, ১৫ আগস্ট দুপুর থেকে তােফায়েল আহমেদ নিজ বাসা থেকে যেয়ে রক্ষীবাহিনীর সদরদপ্তরে অবস্থান করছিলেন। একই ভাষ্য থেকে এও প্রতীয়মান হয়, তােফায়েল আহমেদের রক্ষীবাহিনীর সদরদপ্তরে গমন ছিল তার নিরাপত্তার প্রয়ােজনে। আনােয়ার উল আলমের বিবরণ থেকে জানা যায়, তােফায়েল আহমেদকে রক্ষীবাহিনীর উধ্বর্তন এক কর্মকর্তা দীপক কুমার হালদার বাসা থেকে বাহিনীর কেন্দ্রীয় দপ্তরে নিরাপত্তা
…………………………………………………………………
৩৫৭) আনােয়ার উল আলম, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৬১।
৩৫৮) আমি সারােয়ার বলছি (অষ্টম কিস্তি), বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৮ নভেম্বর ২০১২, ঢাকা।
৩৫৯) সারােয়ার মােল্লার এই বক্তব্য সমপর্যায়ের রক্ষীবাহিনীর আরেকজন কর্মকর্তার বক্তব্যের অনুরূপ। সাংবাদিক আফসান চৌধুরী ১৫ আগস্ট পরবর্তী পরিস্থিতি সম্পর্কে রক্ষীবাহিনীর ঐ কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার নেন ২০১০ সালের নভেম্বরে। সেই বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেন:
I interviewed a gentleman who was near the top of the Rakkhi Bahini leadership in 1975 and was once posted abroad after the coup mess was over. I asked him, why he didn’t intervene from Savar when Sheikh Mujib was killed. He said, “We could have attacked and held off the army for two days and that would have been enough for the Indians to intervene. But I had been to India as a freedom fighter and didn’t think well of them. If they came, they would never leave I thought. So I didn’t order the troops to move.”
মূল লেখাটি দেখুন, http://opinion.bdnews24.com/2010/11/08/what-really-happened-
in-1975/ [retrieved 30th Dec. 2013].
Page 230
দিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। ৩৬০ এইরূপ আসা-যাওয়ার পথে, রক্ষীবাহিনীর যানবাহন চলাচলে ঐ সময় অভ্যুত্থানকারীদের পক্ষ থেকে কোনােরূপ বাধা দেওয়া হয়েছে। বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। পরে অভ্যুত্থানকারীদের চাপে তােফায়েল আহমেদকে সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তবে হস্তান্তরের পরও তাৎক্ষণিকভাবে তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানাে হয়নি। অন্যদিকে এ বিষয়ে কর্নেল সারােয়ার হােসেন মােল্লার সদ্য প্রকাশিত ভাষ্যটি নিম্নরূপ :
(১৫ আগস্ট) আনুমানিক সকাল ১০টা বা সাড়ে ১০টার দিকে আমরা রাজ্জাক ভাইয়ের বাসায় টেলিফোন করি। সেখান থেকে জানানাে হলাে তিনি বাসায় নেই। তারপর তােফায়েল ভাইয়ের বাসায় ফোন করলাম। হঠাৎ দেখি উনি টেলিফোন ধরেছেন। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি এখনাে বাসায় আছেন? কারণটা কী? উনি বললেন, কী করবাে বুঝতে পারছি না। তােমরা আমাকে নিয়ে যেতে পারাে, তােমাদের ওখানে? আমি বললাম, হ্যা অবশ্যই আমরা চেষ্টা করতে পারি।..আমরা একজন অফিসারের নেতৃত্বে কয়েকজন রক্ষীসহ একটি ট্রাক পাঠিয়ে তােফায়েল ভাইকে সদর দফতরে নিয়ে আসি।…তােফায়েল আহমেদ সবকিছু জানার পর মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলেন।…ঐদিন বিকালে ব্রিগেডিয়ার। খালেদ মােশাররফ।টেলিফোন মারফত জানতে চান তােফায়েল আহমেদ আমাদের হেডকোয়ার্টারে আছেন কিনা? হা-সূচক জবাব দেওয়ায় তিনি জানালেন, প্রেসিডেন্ট মােশতাক সাহেবের ইচ্ছা তাঁকে বঙ্গভবনে পাঠিয়ে দেওয়া হােক।…সন্ধ্যার দিকে এই ব্যাপারটি নিয়ে আমরা স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডিআইজি ই এ চৌধুরীর সঙ্গে আলাপ করি ।..ই এ চৌধুরী জানালেন, রাত ৮টা-৯টার দিকে।সিটি এসপি সালাম সাহেবকে আপানাদের অফিসে পাঠাচ্ছি। রাতে ১০টা-সাড়ে ১০টা নাগাদ এসপি সালাম সাহেব রক্ষীবাহিনীর সদর দফতরে আসেন। তার কাছে লিখিতভাবে তােফায়েল আহমেদকে হস্তান্তর করি। (পরে) এসপি সালাম সাহেব তােফায়েল আহমেদকে লিখিতভাবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হস্তান্তর করেন। এবং টেলিফোনে বিষয়টি আমাদের অবহিত করেন।৩৬১
রক্ষীবাহিনীর উর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তার উপরিউক্ত বয়ান দীর্ঘ হলেও উদ্ধৃত করা হলাে এ কারণে যে, এ থেকে নিম্নোক্ত উপাত্ত পাওয়া যায় :
প্রথমত, একটি বাহিনীর উপ-পরিচালকরা প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব, যিনি আবার প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় ছিলেন তাঁকে ‘ভাই’
…………………………………………………………………
৩৬০) আনােয়ার উল আলম, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৫৩।
৩৬১) কর্নেল সারােয়ার হােসেন মােল্লা (অব.), রক্ষীবাহিনী নিয়ে ব্যর্থ হলাম যে কারণে, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৫ আগস্ট ২০১৩, ঢাকা, পৃ. ১।
Page 231
হিসেবে সম্বােধন করতেন। এ থেকে বাহিনীর পেশাদারিত্ব ওরাজনৈতিক চরিত্রের বিশেষত্ব সম্পর্কে একরূপ ধারণা গঠন কঠিন নয়;
দ্বিতীয়ত, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রায় সারা দিনই তােফায়েল আহমেদ যে রক্ষীবাহিনীর সদর দফতরে ছিলেন সেটাও উপরােক্ত বয়ান থেকে স্পষ্ট। এই বিষয়ে প্রায় হুবহু বিবরণ দিয়েছেন এই বাহিনীর আরেক উপ-পরিচালক আনােয়ার উল আলম- সেটাও আমরা উপরে দেখেছি এবং তিনি এও জানিয়েছিলেন, রক্ষীবাহিনীর কোন্ অফিসার জনাব তােফায়েল আহমেদকে নিরাপত্তা দিয়ে বাহিনীর সদর দফতরে নিয়ে এসেছিল;৩৬২ এবং এরূপ আসা-যাওয়ার পথে জাতীয় পর্যায়ের কু সংগঠকরা কখনাে কোন বাধা দেয়নি।
কিন্তু একই বিষয়ে জনাব তােফায়েল আহমেদের ২০১৩ সালের ১৫ আগস্ট জানালেন একবারেই ভিন্ন এক ভাষ্য। তিনি লিখেছেন,৩৬৩
ভাের থেকেই দিনটি (১৫ আগস্ট) ছিল বিভীষিকাময়। হত্যাকাণ্ডের পরপর সকালে আমাকে প্রথমে গ্রেফতার করে গৃহবন্দি করা হয়। ধানমন্ডির যে বাসায় আমি থাকতাম সেই বাসাটি সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। কাউকে ঢুকতে বা বেরুতে দেওয়া হয়নি।…
১৫ আগস্টের মতাে গুরুত্বপূর্ণ দিনে মুজিব বাহিনী ও কাদেরিয়া বাহিনীর উপরােক্ত তিন নেতা- যারা তখন রক্ষীবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারক- তাদের নিজস্ব অবস্থান প্রশ্নে এত ভিন্ন ভিন্ন বিবরণ দেওয়া থেকে এটাই সাধারণভাবে প্রতীয়মান হয়, অন্তত একটি ভাষ্য তার সত্য নয়। এমনকি কু-এর প্রতি সমর্থনের প্রশ্নেও কাদেরিয়া বাহিনী থেকে আগত রক্ষীবাহিনী কর্মকর্তা আনােয়ার উল আলমের বক্তব্য মেলে না খােদ কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান কাদের সিদ্দিকীর বক্তব্যের সঙ্গে। কাদের সিদ্দিকী লিখেছেন, রক্ষীবাহিনীর আনােয়ার উল আলম শহীদ বঙ্গবন্ধুদের হত্যাকারীদের সর্বপ্রথম সমর্থন জানিয়েছিলেন।৩৬৪ কিন্তু একই বিষয়ে আনােয়ার উল আলম বলেছেন,
পরিস্থিতিদৃষ্টে তখন আমাদের মনে হয়েছিল, সব বাহিনীপ্রধান যেহেতু নতুন সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে সেহেতু
………………………………………………………….
৩৬২) আনােয়ার উল আলম, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৫৪, ১৬০।
৩৬৩) তােফায়েল আহমেদ, চোখ হাত বেঁধে নিয়ে যায় আমাকে’, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৫ আগস্ট ২০১৩, ঢাকা, পূ, ৫। উল্লেখ্য, আলােচ্য লেখায় ১৫ আগস্ট কু্য পরবর্তী ঘটনাবলি বর্ণনা করা হলেও কোথাও উল্লেখ নেই যে, লেখক ঐদিন রক্ষীবাহিনীর সদর দফতরে ছিলেন। অথচ ঐ বাহিনীর মুখ্য দুই উপ-পরিচালকই জানাচ্ছেন, জনাব আহমেদ সেদিন রাত ১০টা পর্যন্ত এই বাহিনীর সদর দফতরেই ছিলেন।
৩৬৪) কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম, “এক মহাবিপর্যয়ের দিন’, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৫ আগস্ট ২০১৩, ঢাকা, পৃ. ৪।
Page 232
রক্ষীবাহিনীর আনুগত্য প্রকাশ না করে উপায় নেই। তাই আমরা ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আবুল হাসান খানকে রেডিও স্টেশনে পাঠাই।…আমাদের দুজনকে (আনােয়ার উল আলম ও সারােয়ার মােল্লা) রেডিও স্টেশনে যাওয়ার জন্য কয়েক বার বলা হয় ।…চারিদিকের উপর্যুপরি সুপারিশের কারণে অনিচ্ছাসত্ত্বেও তখন আমাদের দু’জনকেও রেডিও স্টেশনে যেতে হয়। এ ছাড়া আমাদের উপায় ছিল না।২৬৫
উপরােক্ত বিবরণগুলাে থেকে স্পষ্ট, শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর তাঁর সৃষ্ট ও ব্যক্তিগতভাবে কেবল তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত রক্ষীবাহিনী ও এর কর্মকর্তারা সামরিক ও কৌশলগতভাবে অভ্যুত্থান সংগঠকদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট কোনাে অবস্থান নিয়েছেন বলে দেখা যায় না।
এরপর আমরা রক্ষীবাহিনীর ১৫ আগস্ট ঘটনা পরবর্তী গতিপ্রকৃতি বিষয়ে কিছু অনুসন্ধান করতে পারি। সেনা-অভ্যুত্থানের অব্যবহিত পরই জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্টের লেফটেন্যান্ট কর্নেল আমিন আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একটি গ্রুপ রক্ষীবাহিনীর সাভার ক্যাম্প থেকে ভারতীয় প্রশিক্ষকদের তুলে নিয়ে ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাসে হস্তান্তর করে। এইরূপ প্রশিক্ষকদের অন্তত একজন ছিলেন মেজর বালা রেডি।
উপরােক্ত সামরিক অভ্যুত্থানের প্রায় ৫০-৬০ দিন পরে শুরু হয় সেনাবাহিনীতে রক্ষীবাহিনীর আত্তীকরণ প্রক্রিয়া। রক্ষীবাহিনীকে শান্তিপূর্ণভাবে একীভূত করতে পারা সেসময় সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কৃতিত্ব হিসেবে দেখা হয়েছিল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে এই কর্তৃত্বপূর্ণ অভিযানে নেতৃত্ব দেন। তৎকালীন এডজুটেন্ট জেনারেল (এ.জি.) ব্রিগেডিয়ার মইনুল হােসেন চৌধুরী (পরে মেজর জেনারেল), এজি অফিসের লে. কর্নেল ওয়াজিউল্লাহ প্রমুখ ।৩৬৬ তবে এক্ষেত্রে একদিকে রক্ষীবাহিনী ও সেনাবাহিনীকে এইরূপ একীভূতকরণের জন্য মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রস্তুত করা এবং অন্যদিকে তৎকালীন সরকারকে একীভূত করার স্বপক্ষে রাজি করাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ও সেনাবাহিনীর আরেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার এম এ মঞ্জুর। মােশতাক সরকারে এসময় প্রতিরক্ষা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকা (প্রেসিডেন্টের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা) ওসমানী দৃঢ়ভাবে চাইছিলেন রক্ষীবাহিনী ভেঙে দেওয়া হােক।৩৬৭ এক্ষেত্রে ওসমানীর বিপক্ষে জিয়া ও মঞ্জুরের যৌথ বিপরীত
…………………………………………………………………
৩৬৫) আনােয়ার উল আলম, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৫২-৫৩।
৩৬৬) বিস্তারিত দেখুন, মেজর জেনারেল মইনুল হােসেন চৌধুরী, পূর্বোক্ত, পৃ. ৮০।
৩৬৭) বঙ্গভবনে রক্ষীবাহিনীর ভবিষ্যৎ নির্ধারণী সভায় ওসমানীর বক্তব্যের জন্য দেখুন, আমি সারােয়ার বলছি-দশম কিস্তি, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১০ নভেম্বর ২০১২, ঢাকা।
Page 233
অবস্থানের পেছনে কিছুটা ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থ কাজ করছিল বলে ধারণা করা হয়। জিয়াউর রহমান এসময় প্রথমত, রক্ষীবাহিনীর একীভূত করার মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীর স্ফীতি ঘটাতে আগ্রহী ছিলেন। যার পরিণতিতে পরবর্তীকালে, ব্রিগেড কাঠামাে থেকে ডিভিশন কাঠামােতে উত্তরণ সহজ হয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য।৩৬৮ আত্মীকরণের মধ্য দিয়ে রক্ষীদের প্রায় ১৬টি ব্যাটালিয়ন পেয়েছিল সেনাবাহিনী। দ্বিতীয়ত, রক্ষীবাহিনীর সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্তির পেছনে জিয়াউর রহমানের মাঝে আরেকটি কৌশলগত বিবেচনাও কাজ করে থাকতে পারে- তা হলাে, উন্নত সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এত বিপুল সংখ্যক রাজনীতিমনস্ক জনবলকে সেনাশৃঙ্খলায় না রেখে জনসমাজে ফিরিয়ে দিলে তা দেশের নিরাপত্তার জন্য ভবিষ্যতে হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। অন্যদিকে মঞ্জুর চাইছিলেন রক্ষীবাহিনীর অন্তর্ভুক্তির মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীতে মুক্তিযােদ্ধাদের সংখ্যা বৃদ্ধি।৩৬৯ কারণ তিনি ভালােভাবেই রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ববর্তী পরিচয় সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। উল্লেখ্য, ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের পরপর মােহাম্মদ আবুল মঞ্জুরের ঢাকায় উপস্থিতিও ছিল রহস্যময়। কারণ অভ্যুত্থানকালে তিনি ছিলেন ভারতে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রতিরক্ষা অ্যাটাশে। কিন্তু দ্রুত ঢাকায় এসে সক্রিয় হয়ে উঠেন তিনি এবং পলাতক অবস্থা থেকে নূরুজ্জামানকে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রেও মুখ্য কুশীলব হয়ে ওঠেন। মঞ্জুরের মতােই নূরুজ্জামানকেও পরে দেখা যায় সেনাবাহিনীতে রক্ষীদের আত্মীকরণে লক্ষ্যণীয় ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে। নূরুজ্জামানের এইরূপ ভূমিকা’কে তাঁর সহযােগী আনােয়ার উল আলম ‘কৌশলগত’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।৩৭০
সেনাবাহিনীতে একীভূত হওয়ার পর পদোন্নতি ও পােস্টিং ইত্যাদি ক্ষেত্রে রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তারা পদ্ধতিগতভাবে কোনাে ধরনের বৈষম্যের শিকার না হলেও রাজনৈতিক সরকারের উত্থান-পতনে তাদের পেশাগত জীবন প্রভাবিত হয়েছে। বিএনপি সরকার এলে তাদের অনেককে যেমন অবসরে যেতে হয়েছে তেমনি আওয়ামী লীগ সরকার এলে তাদের প্রমােশন প্রয়ােজনীয় গতি পেয়েছে। এর মাঝেই রক্ষীবাহিনী থেকে কয়েকজন মেজর জেনারেল হয়েছেন স্বাভাবিক নিয়মে এবং সময়ে’।৩৭১ আবার অনেক রক্ষীবাহিনী কর্মকর্তাকে আত্তীকরণ পর্যায়ে
………………………………………………………………..
৩৬৮) পূর্বোক্ত।
৩৬৯) পূর্বোক্ত।
৩৭০) পূর্বোক্ত, পৃ. ১৬৭।
৩৭১) জেনারেল ইব্রাহিম, মিশ্রকথন, অনন্যা, ২০১১, পৃ. ২১১। জেনারেল ইব্রাহিম ২-৩ জন রক্ষী কর্মকর্তার মেজর জেনারেল হওয়ার কথা বললেও অন্তত আট জন রক্ষী কর্মকর্তা সেনাবাহিনীতে মেজর জেনারেল হয়েছেন বলে জানা যায়- যাদের মধ্যে অন্তত দু’ জন লেফটেন্যান্ট জেনারেলও হয়েছেন। অন্যদিকে এই লেখার বর্তমান উপ-অধ্যায়ে ইতিমধ্যে রক্ষীবাহিনীর সপ্তম ব্যাচের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যে কর্মকর্তার উল্লেখ করা হয়েছে, তার ভাষায়- আত্তিকরণের পর প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তারা সেনাবাহিনীতে বৈষম্যের শিকার না হলেও তাঁদের পৃথকভাবে দেখার একটা আবহ ছিল। ফলে, তার ভাষায়, রক্ষী কর্মকর্তাদের মধ্যে মেধাবী একাংশ স্বল্প সময়ের মধ্যে অবসর নিয়ে চলে যান। এই কর্মকর্তা আরও জানান, রক্ষী অফিসারদের মধ্যে প্রথম চার ব্যাচ এবং পরবর্তী তিন ব্যাচে শিক্ষা-মেধা-যােগ্যতায়। স্পষ্টত পার্থক্য ছিল; ‘নিয়ােগ প্রক্রিয়ার পৃথক ধরনের কারণে এটা ঘটেছিল।’
Page 234
‘অতিরিক্ত উচ্চতর পদমর্যাদা দেওয়া হয়েছে বলে সেনাবাহিনীতে ক্ষোভও ছিল । বিশেষত দু’ জন উপ-পরিচালক সারােয়ার হােসেন মােল্লা ও আনােয়ার উল আলম শহীদকে লে. কর্নেল র্যাংক প্রদান করায় সেনাবাহিনীতে তাদের চেয়ে অধিক বয়সী অনেকে র্যাংকের দিক থেকে তাদের ‘জুনিয়র’-এ পরিণত হন। এই সংকট নিরসনে জিয়াউর রহমান পরে (১৯৭৮) উপরােক্ত কর্মকর্তাদের চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করার ব্যবস্থা করেন। যার পরিণতিতে সারােয়ার হােসেন মােল্লা থাইল্যান্ডে এবং আনােয়ার উল আলম শহীদ ইন্দোনেশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসে ফার্স্ট সেক্রেটারি হিসেবে নিয়ােগ পান। রক্ষীবাহিনী প্রধান নূরুজ্জামানের চাকরিও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত হয়েছিল, তবে তা আরেক নাটকীয় পটভূমিতে। সে বিষয়ে এই লেখার অন্যত্র আলােকপাত করা হয়েছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের পর ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামানকে দেশে ফিরিয়ে আনা, তিনিসহ রক্ষীবাহিনীর উর্ধ্বতনদের চাকরিকেন্দ্রিক পদমর্যাদা ও প্রয়ােজনীয় সম্মানপ্রাপ্তি ইত্যাদি বিষয়ে জেনারেল জিয়াউর রহমান বরাবর উদার মনােভাব গ্রহণ করলেও জেনারেল মঞ্জুরের নেতৃত্বে পরিচালিত অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে অন্তত চারজন ছিলেন রক্ষীবাহিনী থেকে আসা। সংশ্লিষ্টরা অবশ্য একে কাকতালীয় বলে অভিহিত করেন। আবার রাষ্ট্রপতি জিয়ার সঙ্গে নিহত তাঁর এডিসি ক্যাপ্টেন আশরাফুল আজিজ খানও ছিলেন রক্ষীবাহিনী থেকে আত্মীকৃত কর্মকর্তা।
তবে একই বছরের (১৯৭৫) তেসরা নভেম্বরের অভ্যুত্থানে রক্ষীবাহিনীর অংশগ্রহণ যে পরিকল্পিত ছিল সে বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে ঐ অভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক শাফায়াত জামিলের বয়ানে। তিনি বলছেন, “অক্টোবরের (১৯৭৫) মাঝামাঝি কোনাে একদিন সেনাসদরে রক্ষীবাহিনীর দুই প্রভাবশালী কর্মকর্তা আনােয়ার উল আলম শহীদ ও সারােয়ার মােল্লার সঙ্গে অবৈধ সরকারকে প্রতিরােধের ব্যাপার নিয়ে আলাপ করি। তারা আমার সঙ্গে একমত হলেন।…অক্টোবরের ২৮-২৯ তারিখ হবে, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ আমাকে বললেন, কিছু কি ভাবছাে? জিয়া এগিয়ে আসবে না। ডু সামথিং। ব্রিগেডিয়ার খালেদের সঙ্গে রক্ষীবাহিনী প্রধান ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামানের আলাপ হয়েছিল এ ব্যাপারে। খালেদ আমার মতাে চাইলেন। আমি বললাম, “দিন-তারিখ
Page 235
বলেন। আমি প্রস্তুত …১ নভেম্বর খালেদ, নূরুজ্জামান ও আমি খালেদের অফিসে বসলাম । বিস্তারিত আলােচনার পর খালেদ সিদ্ধান্ত দিলেন ২ নভেম্বর দিবাগত রাতে বঙ্গভবনে মােতায়েন আমার দুটো কোম্পানি ক্যান্টনমেন্টে ফিরে আসবে, সেটাই হবে আমাদের অভ্যুত্থান সূচনার ইঙ্গিত।”৩১২
তেসরা নভেম্বর অভ্যুত্থানে রক্ষীবাহিনী সংশ্লিষ্টদের সম্পৃক্তির বিষয়ে এই বাহিনীর কর্মকর্তাদের আরও কিছু বক্তব্য এ পর্যায়ে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে। উল্লেখ্য, আনােয়ার উল আলম শহীদ ও সারােয়ার হােসেন মােল্লা সরাসরি মেজর র্যাংকে নিযুক্ত হয়েছিলেন রক্ষীবাহিনীতে। পরে তারা পদোন্নতি পান। মেজর জেনারেল ইবরাহিমের ভাষায়, কমিউনিস্ট যুগের ভিয়েতনাম বা রাশিয়ান সেনাবাহিনীতে সামরিক অধিনায়কদের পাশাপাশি যেমন পলিটিক্যাল কমিশার’ থাকত অনেকটা ঐ নিয়মেই বা ঐ কায়দায় তাঁরা রক্ষীবাহিনীতে কাজ করতেন।৩৭৩ রক্ষীবাহিনীর আলােচ্য দুই কর্মকর্তা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে আত্মীকৃত হন ১৯৭৫ সালের অক্টোবরে । আর ঐ মাসেই যে তারা কু্য পরিকল্পনায় সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন (যেমনটি বলেছেন শাফায়াত জামিল) তার সত্যতা পাওয়া যায় আনােয়ার উল আলম-এর বয়ানেও। তিনি লিখেছেন :
…অক্টোবরের (১৯৭৫) মাঝামাঝি একদিন সেনাবাহিনীর নতুন অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল নূরুল ইসলামের অফিসকক্ষে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তখন তিনি ছিলেন না। হঠাৎ সেখানে উপস্থিত হন শাফায়াত জামিল। তাঁর সঙ্গে আমার আগে থেকে ঘনিষ্ঠতা ছিল। আমাকে কক্ষের এক কোণায় নিয়ে যান তিনি এবং সরাসরি জিজ্ঞাসা করেন, মােশতাকের অবৈধ সরকারকে উৎখাতের ব্যাপারে আমার মতামত কী? কোন উদ্যোগ নেয়া হলে রক্ষীবাহিনীর প্রাক্তন সদস্যরা কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে? আমি তাৎক্ষণিকভাবে তার সঙ্গে একমত হই। জানাই, অবৈধ সরকার উৎখাতে আমরা সমর্থন জানাব; সরাসরি অংশগ্রহণ করবাে।…৩৭৪
তেসরা নভেম্বরের অভ্যুত্থানে রক্ষীবাহিনীর সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে আরও বিশদ বিবরণ রয়েছে ঐ অভ্যুত্থানের আরেক সংগঠক মেজর নাসির উদ্দিনের বয়ানে । সেখানে তিনি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন কীভাবে শুরু থেকে রক্ষীবাহিনী প্রধান নূরুজ্জামান এই অভ্যুত্থানে সম্পৃক্ত হন। ঢাকার মিরপুরে এবং সাভারে এসময় রক্ষীবাহিনীর ৫টি ব্যাটালিয়নকে অভ্যুত্থানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করেন নূরুজ্জামান। এমনকি ঐ অভ্যুত্থানে সামিল হতে গিয়ে তিনি যে সেনাবাহিনীতে রক্ষীবাহিনীর
…………………………………………………………………
৩৭২) দেখুন, কর্নেল শাফায়াত জামিল (অব.), পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩১-৩২।
৩৭৩) মেজর জেনারেল ইবরাহিম, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৮।
৩৭৪) আনােয়ার উল আলম, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৭৩।
Page 236
আত্তীকরণ প্রক্রিয়া বিলম্বিত করছিলেন সে বিষয়ে ইতােমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তার স্বীকৃতি রয়েছে মেজর নাসিরের জবানিতেও।৩৭৫
রক্ষীবাহিনীর একজন সিনিয়র কর্মকর্তা সাবিহ উদ্দিন (পরবর্তীকালে মে. জেনারেল এবং অবসরপ্রাপ্ত) এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন,৩৭৬ এই বাহিনীর সদস্যরা বেসামরিক প্রশাসনের প্রতি অনুগত থাকার প্রশিক্ষণ এত আন্তরিকতার সঙ্গে আত্মস্থ করেছিল যে, সেনাবাহিনীতে আত্মীকৃত হয়ে যাওয়ার পর কোন ধরনের সামরিক অভ্যুত্থানে শামিল হয়নি। তার এই বক্তব্য যে মােটেই বাস্তবসম্মত নয় উপরে তেসরা নভেম্বর অভ্যুত্থানের দৃষ্টান্তের মাধ্যমেই তা স্পষ্ট হয়। এমনকি ১৯৭৫-এর নভেম্বরে সিপাহী অভ্যুত্থানেও সামিল হয়েছিল রক্ষীবাহিনী থেকে আসা সাধারণ রক্ষীরা।৩৭৭ উপরন্তু ‘১/১১’ নামে খ্যাত ২০০৭ সালের অভ্যুত্থানধর্মী সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও ঘটনাবলির অন্যতম নায়ক ছিলেন রক্ষীবাহিনী (ষষ্ঠ ব্যাচ) থেকে আত্মীকৃত সামরিক কর্মকর্তা জেনারেল মাসুদউদ্দিন চৌধুরী। যিনি পরে লেফটেন্যান্ট জেনারেলও হয়েছিলেন।
রক্ষীবাহিনী গঠনের মধ্য দিয়ে তৎকালীন সরকার, বিশেষত শেখ মুজিবুর রহমান ব্যাপক সমালােচনার শিকার হলেও বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ অলি আহাদ দাবি করেছেন, মুজিবের জন্য এই বাহিনী গঠনের বাধ্যবাধকতাটি তৈরি করে রেখেছিল আসলে ১৯৭১ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশের প্রবাসী অস্থায়ী সরকারই। ভারত সরকারের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন সরকার সাত দফা একটি চক্তি স্বাক্ষর করে ঐ সময়। অলি আহাদের ভাষায়, ঐ চক্তির ততীয় অনুচ্ছেদ ছিল এ রকম : বাংলাদেশের নিজস্ব কোনাে সেনাবাহিনী থাকবে না। অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য একটি প্যারামিলিশিয়া গঠন করা হবে।’৩৭৮ মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের দিল্লি মিশনপ্রধান হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী পরবর্তীকালে অলি আহাদ কথিত এই চুক্তির সত্যতা স্বীকার করলেও বলেন, এটা কোনাে ‘প্যাক্ট ছিল না। ছিল ‘এগ্রিমেন্ট।’ প্রবাসী সরকারের পক্ষে এটা স্বাক্ষর করেছিলেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি নজরুল ইসলাম। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর
…………………………………………………………………
৩৭৫) দেখুন, গণতন্ত্রের বিপন্নধারায় বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৭, পৃ. ১০৯-১১০।
৩৭৬) S A Karim, ibid, p. 272-73.
৩৭৭) দেখুন, মেজর নাসির, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৪৮।
৩৭৮) অলি আহাদ, জাতীয় রাজনীতি: ১৯৪৫-১৯৭৫, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সােসাইটি লি., ২০০৪, ঢাকা, পৃ. ৪৩৩। লেখক এখানে সাত দফা চুক্তির পুরােটাই বিবরণ দিয়েছেন এবং তার তুলে ধরা এই তথ্য সম্পর্কে কখনােই দেশের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকদের তরফ থেকে কোন ভিন্নমত বা আপত্তি দেখা যায়নি।
Page 237
মতে অক্টোবরের ঐ ‘এগ্রিমেন্ট’ই হলাে রক্ষীবাহিনীর ‘উৎস।৩৭৯ ১৯৭২ সালের ১৯ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে এক অনুষ্ঠানে সৈয়দ নজরুল ইসলামও (তখন তিনি শিল্পমন্ত্রী) ঐ চুক্তির বিষয়টি স্বীকার করেন। তাঁর মতে, ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের শর্ত ছিল ঐ চুক্তি।৩৮০ তাজউদ্দীন আহমদ অবশ্য ১৯৭৩-এর ২ জুন সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দেশের স্বার্থ বিক্রি করে ভারতের সঙ্গে কোন চুক্তির বিষয় অস্বীকার করেন। তবে কোনাে চুক্তি হয়নি সরাসরি এমন বক্তব্যও রাখেননি তিনি।৩৮১
তবে উৎস ও পটভূমি যাই-ই হােক- রক্ষীবাহিনীকে মুজিব বাহিনীরই একাংশের সম্প্রসারিত সংস্করণ হিসেবে অভিহিত করার সুযােগ ছিল এবং তার আবির্ভাবের পরই মুজিব বাহিনীর অপরাংশ দ্বারা গঠিত হয় জাসদ।৩৮২ এরপর মুজিব বাহিনীর তৃতীয় এক অংশের অন্তর্ভুক্তি ঘটে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে ১৯৭২ ও ‘৭৩ সালে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে। ১৯৭৩ সালের মধ্যেই পেশাগত প্রশিক্ষণবিহীন অবস্থাতে অনেক ম্যাজিস্ট্রেট’-এর পদায়ন সম্পন্ন হয়, অভিযােগ উঠেছিল, এদের অধিকাংশ মুজিব বাহিনীর সদস্য।৩৮৩ তড়িঘড়ি করে এভাবে বিশেষ ক্যাডার নিয়ােগের পেছনে যেসব উদ্দেশ্য ছিল বলে অনুমান করা হয় তার মধ্যে রয়েছে প্রশাসনে পশ্চিম পাকিস্তানিদের চলে যাওয়াজনিত শূন্যতা পূরণ; এবং নিজস্ব লােক বসিয়ে প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। তবে রক্ষীবাহিনী গড়ে তােলার উদ্যোগ যেমন মূল সামরিক আমলাতন্ত্র মেনে নিতে পারেনি, তেমনি প্রশাসনে রাজনৈতিক কর্মীদের অন্তর্ভুক্তিকেও বেসামরিক আমলাতন্ত্র চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছিল। আমলাতন্ত্রের এইরূপ মনােভাব সম্পর্কে নীতিনির্ধারকরা যে সচেতন ছিলেন তার প্রমাণ হিসেবে তখনকার দৈনিক বাংলার বাণীতে শেখ মণি’র কলামগুলাের উল্লেখ করা যায়। যেমন ১৮ সেপ্টেম্বর (১৯৭২) তিনি লিখছেন, ‘এরা (আমলারা) বর্তমান সরকারের প্রতি বিদ্বেষ ভাবাপন্ন।…এদের কেউ কেউ প্রতিবিপ্লবী চক্রান্তে মেতে উঠতে পারে।…এরা আমেরিকাসহ পশ্চিমা শক্তির দ্বারা
……………………………………………………
৩৭৯) পূর্বোক্ত। ১৯৮৯ সালের ২৭ ডিসেম্বর লেখক মাসুদুল হককে প্রদত্ত সাক্ষাঙ্কারে হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী চুক্তির সত্যতা সম্পর্কে জানান। দেখুন, মাসুদুল হক, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৪১-৪২।
৩৮০) আবদুল হক, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৯৪।
৩৮১) দৈনিক গণকণ্ঠ, ৩ জুন ১৯৭৩, ঢাকা।
৩৮২) রক্ষীবাহিনীর আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশের কয়েক মাস পরই জাসদের জন্ম হয় ১৯৭২-এর ৩০ অক্টোবর।
৩৮৩) অনেকটা এই অভিযােগের স্বীকৃতি দিয়েই সেসময় তাত্ত্বিক যুক্তি হিসেবে শেখ মণি বাংলার বাণীতে লিখেন, ‘মােনায়েম খান, নুরুল আমীনের রিক্রুট করা রাজ কর্মচারী দিয়ে শেখ মুজিবের সােনার বাংলা গড়া যাবে না। মুজিবের শাসনে এরা কেবল বেমানানই নয়, একান্ত ই অবাঞ্চিত।’ দেশ সমাজ রাজনীতি: শেখ মণি’র ভাবনা, সম্পাদনা : ফকীর আবদুর রাজ্জাক, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১১, পৃ. ২৮-২৯।
Page 238
লালিত হয়েছে। চীনের সঙ্গে এদের সংযােগ ছিল। এরা সমাজতন্ত্রের বিরােধী।’ সুতরাং এদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান নয়, উচ্ছেদ অভিযান চালাতে হবে!’৩৮৪ এইরূপ হুমকি কেবল কথার কথা ছিল না। একাত্তরের জানুয়ারির শেষ দিকে ৫৩ জন সরকারি কর্মকর্তাকে এই বলে চাকরিচ্যুত করা হয় যে, তারা উৎসাহের সঙ্গে
………………………………………………………………..
৩৮৪) দেখুন, বাংলার বাণী, দুর্নীতি ও আমলাতন্ত্র, ১১ মে ১৯৭২, ঢাকা। বেসামরিক প্রশাসন সম্পর্কে ১৯৭২ সালে শেখ ফজলুল হক মণি বাংলার বাণীতে ধারাবাহিকভাবে প্রচুর কলাম লিখেছেন। এসব সিরিজ লেখার একক শিরােনাম দিয়েছিলেন তিনি বিপ্লবের পর প্রতিবিপ্লব আসবে।’ অর্থাৎ আমলাতন্ত্রকে তিনি সম্ভাব্য প্রতিবিপ্লবের প্রধান এক ভরকেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। এর বিকল্পও বলে দিয়েছিলেন তিনি এভাবে : ‘মুজিবের শাসন চাই, আইনের শাসন নয়। দেখুন, ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭২ এরূপ দৃষ্টিভঙ্গিই প্রশাসনে রাজনৈতিক মতাদর্শের কর্মীদের অন্তর্ভুক্তি বেগবান করে। যেসব সরকারি কর্মচারী মুক্তিযুদ্ধকালে কলকাতা গিয়েছিল এবং যারা যায়নি উভয়ের মধ্যে একটি ভেদরেখা টেনে প্রথমােক্তদের অধিক বিশ্বস্ত হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টাও লক্ষ্যণীয় ছিল এ সময়। যদিও অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যতই চরমপন্থী কমিউনিস্টদের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ বাড়ছিল ততই পুরানাে ‘অভিজ্ঞ আমলাদের ডাক পড়ছিল সরকারে- যাদের এতদিন ‘দালাল’ হিসেবে চিহ্নিত করা হতাে। এক পর্যায়ে দেখা যায়, সেন্ট্রাল সার্ভিস অব পাকিস্তানের ১৯১ জন বাঙালি কর্মকর্তার ১৮০ জনই মুজিব প্রশাসনে জায়গা করে নিয়েছেন। অথচ মুক্তিযুদ্ধকালীন কলকাতার প্রবাসী সরকারে যােগ দেয়া সিএসপি কর্মকর্তার সংখ্যা ছিল সাকুল্যে ১৩। ইস্ট পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস ও পাকিস্তান পুলিশ সার্ভিসের ক্ষেত্রেও অনুরূপ দৃষ্টান্তের উল্লেখ করা যায়। ডাক পাওয়া এই কর্মকর্তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ ছিলেন একাত্তরের আগে যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষিত এ বি এম সফদার, আবদুর রহিম প্রমুখ। এরা দু’জনই ছিলেন পাকিস্তান পুলিশ সার্ভিসের লােক। সফদার যুদ্ধের সময় ঢাকায় পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের কর্মকর্তা ছিলেন। যুদ্ধের পর পশ্চিম পাকিস্তানিদের সহযােগিতার জন্য এক দফা আটকও হন। কিন্তু তাকেই মুজিব Invigilation Director করেন- যার দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার তদারকি। জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত সংস্থা এনএসআই-এরও প্রধান করা হয় তাকে। অন্যদিকে আবদুর রহিমকে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের একজন সেক্রেটারি করে নেয়া হয়। শাসনামলের শেষের দিকে মুজিব পুরানাে আমলাদের ওপর কতটা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন তার নজির হিসেবে লক্ষ্য করা যায় ‘সমাজতন্ত্র কায়েমের জন্য যখন তিনি বাকশাল নামক দলের পত্তন করেন তখন তার ১১৫ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ৯ জন সিএসপি কর্মকর্তাও অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিলেন। যারা আবার বাকশালের আওতায় জেলা গভর্নরও ছিলেন। অথচ এই একই আমলাদের সম্পর্কে মুজিব শাসনামলে রচিত প্রথম পঞ্চ-বার্ষিকী পরিকল্পনায় পরিকল্পনা কমিশন সদস্যদের মূল্যায়ন ছিল এ রকম:
They (the bureaucrats) can be neither innovators nor catalytic agents for social change. It is only a political cadre with firm roots in the people and motivated by the new ideology and willing to live and work among the people as one of them that can mobilize the masses and transform their pattern of behavior.
Aftab Ahmed, Politics Ethnicity and Security: Bangladesh and South Asian Perspective, Riverside Press, 2012, Dhaka, p. 15, 20, 33.
Page 239
পাকিস্তান সরকারকে সমর্থন দিয়েছিলেন।৩৮৫ অন্যদিকে একই অভিযানের অপর অংশ হিসেবে স্বাধীনতা-উত্তর নতুন দেশের প্রশাসনে সরকার তার পছন্দসই ‘মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ােগ দেওয়ারও উদ্যোগ নেয়। এক্ষেত্রে মুজিব বাহিনীর তরুণরা যে অগ্রাধিকার পেয়েছিল সে বিষয়ে ইতােমধ্যে এই বাহিনীর অন্যতম সংগঠক আবদুল মান্নান চৌধুরীর বক্তব্য এই লেখার অন্যত্র তুলে ধরা হয়েছে।৩৮৬
সাধারণত প্রশাসনের উচ্চতর পদে নিয়ােগের বিষয়টি তদারকের দায়িত্ব পাবলিক সার্ভিস কমিশনের । বাংলাদেশে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের কার্যক্রমের ওপর স্বনামধন্য একজন গবেষক হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লােকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ গিয়াসউদ্দিন আহমেদ (পরবর্তীকালে তিনি ত্রিশালের কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।) তার দেওয়া বিবরণ৩৮৭ থেকে জানা যায়, স্বাধীনতার পর প্রশাসনে মানবসম্পদের যে ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয় তার মােকাবেলায় দ্রুত নিয়মতান্ত্রিক কোনাে নিয়ােগ প্রক্রিয়া চালু করা যায়নি। ১৯৭২ সালের অক্টোবরে প্রথম ‘আনুষ্ঠানিকভাবে প্রশাসনের উচ্চতর পদে (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর পদে) নিয়ােগ শুরু হয় এবং তা কেবল ‘মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য সংরক্ষিত করা হয়। এই নিয়ােগ প্রক্রিয়ায় লিখিত পরীক্ষা ছিল না। স্নাতক ডিগ্রিধারী এবং মুক্তিযােদ্ধা’ হলেই যেকেউ ‘মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে এই নিয়ােগ পেতে পারতেন। প্রশাসনের প্রথম ব্যাচের ঐ নিয়ােগ প্রক্রিয়ায় ২ হাজার ৩৫১ জন অংশ নিয়েছিলেন এবং প্রায় সকলে নিয়ােগ পান।
এরপর ১৯৭৩ সালের জুনে আবার অনুরূপ নিয়ােগ উদ্যোগ নেয়া হয়। এবার অবশ্য মুক্তিযােদ্ধাদের পাশাপাশি মুক্তিযােদ্ধা নয় এমন প্রার্থীদেরও আবেদনের সুযােগ রাখা হয় এবং প্রার্থীদের সর্বোচ্চ বয়সের একটি মানদণ্ডও ঠিক
……………………………………………………………….
৩৮৫) পরে অবশ্য এই কর্মকর্তাদের মধ্যে দুইজন ছাড়া আর সবাই নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছিলেন।
দেখুন, Aftab Ahmed, ibid, p. 18. বাস্তবে প্রশাসনে এসময় ভিন্ন একটি বাস্তবতা কাজ করছিল- যার আলােকপাত করেছেন সেই সময়কার প্রাজ্ঞ আওয়ামী লীগ নেতা মাে আবদুল মােহাইমেন। তিনি ১৯৭০-এ প্রাদেশিক ও ১৯৭৩-এ জাতীয় সংসদ সদস্য ছিলেন। বাহাত্তরে দেশের প্রশাসনের কর্মকর্তা ও কর্মীদের বিরুদ্ধে শেখ মণিদের ধারাবাহিক সমালােচনা ও তিরস্কার সত্ত্বেও মােহাইমেন লিখেছেন, ‘১৯৭২-এ আমরা যখন ক্ষমতায় আসি তখন আমলা ও অফিসারদের সংখ্যা সমগ্র দেশে কমপক্ষে ৫০ হাজার ছিল। সীমান্ত অতিক্রম করে প্রবাসী সরকারে যারা যােগ দিয়েছে তাদের সংখ্যা এক হাজার হবে কি না সন্দেহ। এমতাবস্থায় উপরােক্ত ৫০ হাজার আমলা অফিসারদের অপসারণ করলে সেই শূন্যতা আমরা পূরণ করতাম কাদের দিয়ে?…প্রশাসন, ভূমি রাজস্ব, বিচার ও পুলিশ বিভাগ পরিচালনার মতাে উপযুক্ত জ্ঞান সম্পন্ন প্রয়ােজনীয় লােক পার্টিতে পাওয়া যেত কি না খুবই সন্দেহের বিষয়…।’ দেখুন: মাে. আবদুল মােহাইমেন, পূর্বোক্ত, পৃ. ৮।
৩৮৬) দেখুন, ১১ নং তথ্যসূত্র।
৩৮৭) Syed Giasuddin Ahmed, Ibid, p. 103-105.
Page 240
করা হয়েছিল এবং মৌখিক পরীক্ষার আগে সংক্ষিপ্ত লিখিত পরীক্ষাও হয়। এই দ্বিতীয় ব্যাচে নিয়ােগ দেওয়া হয়েছিল ১০৭৪ জন। উপরােক্ত দুটি প্রক্রিয়া সম্পর্কে অধ্যাপক সৈয়দ গিয়াসউদ্দিন আহমেদ তাঁর গবেষণাগ্রন্থে লিখেছেন :
Most of the 1972 and 1973 recruits lacked such qualification and personal traits as high academic achievements, caliber, integrity and leadership generally demanded of a civil servant.৩৮৮
আরেকজন গবেষক শেখ আবদুর রশিদের অনুসন্ধান থেকে সৈয়দ গিয়াসউদ্দিন আহমেদ উল্লিখিত ১৯৭২ সালের উপরােক্ত নিয়ােগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে আরও সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়। আবদুর রশিদ তথ্য-প্রমাণসহ জানাচ্ছেন,৩৮৯ ১৯৭২ সালের জুনে এবং জুলাইয়ে এসে দুটি বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল এইরূপ ‘স্পেশাল সুপিরিয়র সার্ভিস’-এ নিয়ােগের জন্য। প্রথম বিজ্ঞাপন ছিল শুধু মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য; দ্বিতীয়টি ছিল শুধু অমুক্তিযােদ্ধাদের জন্য। একই পদের জন্য হলেও দুটি বিজ্ঞাপনে প্রার্থীদের জন্য শর্ত ছিল ভিন্ন। যেমন অমুক্তিযােদ্ধা প্রার্থীদের জন্য বয়সের শর্ত ছিল ২১ থেকে ২৭; কিন্তু মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য সেই শর্ত ছিল অনেক নমনীয়- ২১ থেকে ৩৫ বছর। অন্যদিকে মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য বিজ্ঞাপনে ৩৫০টি পদের উল্লেখ থাকলেও নিয়ােগ পেয়েছিলেন সেখানে ১ হাজার ৩১৪ জন। মুক্তিযােদ্ধা প্রমাণের শর্তও ছিল অনেক নমনীয়। সশস্ত্র বাহিনীর অধিনায়কের প্রমাণপত্রের বদলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবের দেওয়া সনদপত্র হলেও যে কোনাে প্রার্থী মুক্তিযােদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত হতেন। উল্লেখ্য, মূলত বিএলএফ-এর যােদ্ধারাই যে স্বরাষ্ট্রসচিবের সনদপত্রধারী ছিলেন সে বিষয়ে এ লেখার অন্যত্র আলােকপাত করা হয়েছে। পুরাে চাকরি জীবনে এই মুক্তিযােদ্ধা কর্মকর্তারা বিসিএস (প্রশাসন), বিসিএস (সচিবালয়)সহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্যাডারে চাকরি করলেও কৌতুহলােদ্দীপক তথ্য হলাে, দীর্ঘ আট বছর চেষ্টার পরও পাবলিক সার্ভিস কমিশন এদের মুক্তিযােদ্ধা সম্পর্কিত তথ্যাদি’ হালনাগাদ করতে পারেনি। এ বিষয়ে সংযুক্তি আটাশ-এ বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।
…………………………………………………………………
৩৮৮) দেশের সর্বোচ্চ প্রশাসনে উক্তরূপ নিয়ােগ প্রক্রিয়ার সময় বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনে চেয়ারম্যান ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কিউ এম বজলুর করিম এবং সদস্য ছিলেন, শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী (সরকারি কলেজে প্রাক্তন প্রিন্সিপাল), আলিমদাদ খান (প্রাদেশিক প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা), আওলাদ হােসেন (প্রাদেশিক প্রকৌশল বিভাগের একজন কর্মকর্তা)।
৩৮৯) Sheikh Abdur Rashid, Civil Service At the Cross-roads, Muktochinta Prokashona, Dhaka, 2008, p. 99, এই গ্রন্থ থেকে পাওয়া (পৃ. ৩৬৭) মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য পাবলিক সার্ভিস কমিশনের ১৯৭২ সালের আলােচ্য নিয়ােগ বিজ্ঞপ্তিটি দেখুন সংযুক্তি ছাব্বিশ-এ।
Page 241
অন্যদিকে আরেকজন প্রখ্যাত আমলা ও প্রশাসন বিষয়ে গবেষক এ এম এম শওকত আলীর অনুসন্ধান থেকে জানা যায়,৩৯০ ১৯৭২-৭৩ সালে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের উচ্চতর পদগুলােতে মুক্তিযােদ্ধাদের সুবিধাজনক উপায়ে নিয়ােগ দেওয়ার পাশাপাশি জাতীয়করণকৃত শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলাের উচ্চতর পদগুলােতেও শুধু একটি রেজুলেশনের মাধ্যমে একদল মুক্তিযােদ্ধা নিয়ােগ পান ১৯৭৩-এর সেপ্টেম্বরে।৩৯১ শিল্প মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনালাইজড ইন্ড্রাস্ট্রিজ ডিভিশন’ (NID)- এর মাধ্যমে এই নিয়ােগ দেওয়া হয় কেবল মৌখিক পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে। প্রথমে বলা হয়েছিল, এরা এডহক ভিত্তিতে নিয়ােগ পাচ্ছেন। কিন্তু পরবর্তীকালে এভাবে নিযুক্তদের ক্যাডার নাম দেওয়া হয়, ‘ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল ম্যানেজমেন্ট সার্ভিস (IMS)। নিয়ােগের দীর্ঘ তিন বছর পর এইরূপ নিয়ােগের বিধিবিধানের গেজেট প্রকাশিত হয় ১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বরে। অর্থাৎ রিক্রুটমেন্ট রুল’ তৈরির তিন বছর আগেই রিক্রুটমেন্ট হয়ে গিয়েছিল আলােচ্য ক্ষেত্রে! বিভিন্ন সেক্টর কর্পোরেশন ও ব্যাংকে বিচরণ শেষে এইভাবে নিয়ােগপ্রাপ্তদের ১৫০ জনকে ১৯৮২ সালের ১৪ নভেম্বর বিসিএস (প্রশাসন)-এ সংযুক্ত করে নেয়া হয়েছিল- যদিও IMS-দের সর্বমােট সংখ্যা ছিল আরাে অনেক বেশি এবং বাকিরা অন্যত্র কর্মরত থেকে যান। এসব নিয়ােগ সম্পর্কে পাবলিক সার্ভিস কমিশনেরও কোনাে মতামত নেয়া হয়নি। যদিও সংবিধানের ১৪০(২) ধারা অনুযায়ী তার প্রয়ােজন ছিল । এতদবিষয়ে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মন্তব্য ছিল : ‘এসব নিয়ােগ নিশ্চিতভাবেই ব্যতিক্রমধর্মী এবং অস্বাভাবিক। ইহাতে প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে প্রার্থী নির্বাচন সংক্রান্ত সংবিধানের ধারা লঙ্তি হইয়াছে।৩৯২ উপরােক্ত তথ্যাদি উল্লেখ শেষে এ এম এম শওকত আলী বলেছেন,
Politicalization of the recrument process started with politics of patronage for the freedom fighters by waiving the requirement of written examination as a test for recrument.
উল্লেখ্য, প্রশাসনে মেধার ভিত্তিতে নিয়ােগের প্রক্রিয়াটি এ দেশে পরেও আর খুব বেশি রাজনৈতিক স্বীকৃতি পায়নি বরং মুজিব সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রথম যে অন্তবর্তীকালীন নিয়ােগ নীতি ঘােষণা করেছিল তাতে প্রবর্তিত কোটা পদ্ধতিতে মেধার ভিত্তিতে পূরণের জন্য মাত্র ২০ শতাংশ পদ বরাদ্দ করা হয়!
…………………………………………………………………
৩৯০) A M M Shawkat Ali, Bangladesh Civil Service, A political-Administrative Perspective, UPL, Dhaka, 2004, p. 96-97.
৩৯১) ঐ রেজুলেশনের স্মারক নং ছিল : NID [estbt] 36/73-2538. August 1, 1973.
৩৯২) আইএমএস ক্যাডারের নিয়ােগসংক্রান্ত অনিয়ম সম্পর্কে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পর্যবেক্ষণের জন্য দেখুন: সংযুক্তি সাতাশ।
Page 242
প্রশাসনের উচ্চতর স্তরে পছন্দ মাফিক নিয়ােগের পটভূমি হিসেবে এ সময় খােদ পাবলিক সার্ভিস কমিশনও পছন্দ মাফিকভাবে গড়ে তােলা হয়। ১৯৭২ সালের মে মাসে প্রথম পাবলিক সার্ভিস কমিশন গড়ে তােলার সময় যাকে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়ােগ দেওয়া হয় সেই ড. এ কিউ এম বজলুল করিম ছিলেন মৃত্তিকা বিজ্ঞানের একজন শিক্ষক! সাধারণ বিবেচনা এবং অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে আশা করা হয়েছিল নবীন দেশটির প্রশাসন গড়ে তােলার জনসম্পদ বাছাই করতে নবীন এই কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান এবং সদস্যরা হবেন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় প্রশাসনে উচ্চতর অভিজ্ঞতাসম্পন্ন খ্যাতনামা বাঙালি কর্মকর্তা বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের লােক প্রশাসনের খ্যাতনামা শিক্ষক। কিন্তু তা কার্যত ঘটেনি বরং কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়ােগ প্রক্রিয়া তীব্র হতাশার জন্ম দেয় ঐসময়। যার ছাপ পড়ে অধ্যাপক সৈয়দ গিয়াসউদ্দিন আহমেদের নিম্নোক্ত পর্যবেক্ষণে :
Chairman Dr. B. Karim had no previous experience in the government service, nor was he known to have any special ability in the sphere of public or personal administration. He had, however, been a teacher of an influential political leader, Tufail Ahmed, who served as the Political Secretary to Sheikh Mujib during the AL regim. Perhaps that link was the basis for Dr. Karim’s appointmen as Chairman of the PSC (First). It is likely that the appointment of the other three members was made on a similar basis.৩৯৩
তােফায়েল আহমেদ ও ড. বি. করিমের মাঝে সম্পর্কের যে ইঙ্গিত করেছেন।.অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ সেই সূত্রেই বাহাত্তর-তিহাত্তরে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্ৰেণীর রাষ্ট্রীয় পদে মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ােগ অগ্রাধিকার অনেকাংশে মুজিব বাহিনীর নিয়ােগ অগ্রাধিকারে পরিণত হয়েছিল এবং এরই ফলে নিয়ােগপ্রাপ্তদের অনানুষ্ঠানিক প্রশাসনিক পরিচয় হয়ে ওঠে “তােফায়েল ক্যাডার।”
জাসদ, রক্ষীবাহিনী এবং প্রশাসন ছাড়াও চতুর্থ আরেকটি ধারাতে সচেতনভাবে মুজিব বাহিনীর এক দল সংগঠক থেকে যায় তা হলাে আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন ‘যুবলীগ’-এ। ১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর এর গােড়াপত্তন। শেখ ফজলুল হক মণি হন প্রথম সভাপতি এবং নূরে আলম
…………………………………………………………………
৩৯৩) Syed Giasuddin Ahmed, Public Personnel Administration in Bangladesh, The University of Dhaka, 1986, P. 291, Dhaka.
৩৯৪) যুবলীগের প্রতিষ্ঠায় শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশ ছিল বলে দাবি করেছেন শেখ মণি। ১৯৭৪ সালের ১১ নভেম্বর দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষ্যে এক আলােচনাসভায় তিনি বলেন: “স্বাধীনতার পর যুবসমাজ নৈরাজ্য ও অবক্ষয়ে ভুগিতেছিল উহা কাটাইয়া উার প্রয়ােজনে ও অর্জিত স্বাধীনতাকে জোরদার ও অর্থবহ করার জন্য বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যুবলীগ গঠন করা হয়।’ দৈনিক ইত্তেফাক, ১২ নভেম্বর ১৯৭৪, ঢাকা।
Page 243
সিদ্দিকী ছিলেন প্রথম সাধারণ সম্পাদক। ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে এর দ্বিতীয় সম্মেলনেও মণি এর সভাপতি থাকেন এবং সাধারণ সম্পাদক করা হয় সৈয়দ আহমদকে। মুজিব বাহিনীতে সৈয়দ আহমদ ছিলেন আবদুর রাজ্জাকের প্রধান সহকারী । উল্লেখ্য, বাকশাল গঠনের সময় যুবলীগের প্রধান হন মুজিব বাহিনীর প্রধান চারজনের আরেকজন তােফায়েল আহমেদ। এসময় তার আরেকটি প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় ছিল রাষ্ট্রপতির বিশেষ সহকারী তথা রাজনৈতিক সচিব।৩৯৫ রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে রাজনৈতিক সচিবের মাধ্যমেই রক্ষীবাহিনীতে রাজনৈতিক নির্দেশনা আসত বলে ধারণা করা হতাে।৩৯৬ তাঁকে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদাও দেওয়া হয়। যদিও প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে প্রশাসনিকভাবে তার উপরেই অবস্থান ছিল মুখ্যসচিব রুহুল কুদুসের। রক্ষীবাহিনীর কাজে তােফায়েল আহমেদের প্রভাব সম্পর্কে ভিন্নতর মতামত দিয়েছেন এই বাহিনীর উপ-পরিচালক আনােয়ার উল আলম। তাঁর ভাষায়, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব রুহুল কুদুস রক্ষীবাহিনী সংক্রান্ত যাবতীয় দায়িত্ব পালন করতেন। তাঁকে সাচিবিক সহায়তা করতেন প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের যুগ্ম-সচিব মনােয়ারুল ইসলাম ।…রক্ষীবাহিনী সম্পর্কিত কোনাে নথি বা ফাইল প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিবের কাছে যেতে দেখিনি।…তােফায়েল আহমেদ রক্ষীবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন এটা একেবারেই মিথ্যা।৩৯৭ তবে আনােয়ার উল আলম একই গ্রন্থে (পৃ. ১৫৪) ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থান পরবর্তী পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন,
“তােফায়েল আহমেদের সঙ্গে আমরা (লেখক ও অন্য উপ-পরিচালক সারােয়ার হােসেন মােল্লা) বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী নানান বিষয় নিয়ে আলােচনা করলাম। ঠিক হলাে, আমরা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তুলবাে। তার সঙ্গে
……………………………………………………………..
৩৯৫) স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের এই শক্তিশালী অবস্থান আওয়ামী লীগে বরাবর ধরে রেখেছিলেন। তােফায়েল আহমেদ। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত দলটির দ্বিতীয় দফা শাসনামলে তিনি শিল্পমন্ত্রী হন। ২০০৯ থেকে দলটির তৃতীয় দফা শাসনামলে তিনি জাতীয় সংসদের শিল্প মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি হন।
৩৯৬) সেই নির্দেশ বাস্তবায়নের জন্য প্রয়ােজনীয় প্রশাসনিক কাজের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে ছিলেন একজন যুগ্ম-সচিব। প্রধানমন্ত্রী থেকে সিদ্ধান্ত যেত রাজনৈতিক সচিবের কাছে; সেখান থেকে যেত নির্ধারিত যুগসচিবের মাধ্যমে রক্ষীবাহিনীর পরিচালকের কাছে- এই ছিল রক্ষীবাহিনীর সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া।
৩৯৭) পূর্বোক্ত, পৃ. ১১৩-১৪।
Page 244
আলােচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হলাে, সারােয়ার ও আমি সাভারে যাবাে। লিডার শেখ দলিল উদ্দিনকে সাভারে যাওয়ার পথ রেকি করতে পাঠানাে হয়…।’
উপরােক্ত দু’টি বক্তব্য স্পষ্টত পরস্পর বিরােধী। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব রুহুল কুদুসই যদি আলােচ্য বাহিনীটির যাবতীয় বিষয় নিয়ন্ত্রণ করতেন- যেমনটি দাবি করেছেন আনােয়ার উল আলম, তাহলে কেন বঙ্গবন্ধু হত্যা প্রতিরােধের সিদ্ধান্ত নিতে তােফায়েল আহমেদের প্রয়ােজন হলাে। প্রশাসনিকভাবে এইরূপ স্পর্শকাতর। প্রসঙ্গে তােফায়েল আহমেদের ভূমিকা রাখার সুযােগইবা কোথায় বা তিনি সরকারের একটি বাহিনীকে প্রতিরােধ যুদ্ধে নামার সিদ্ধান্ত দেওয়ার এখতিয়ার কীভাবে রাখেন; একটি শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা এভাবে কোনাে রাজনৈতিক ব্যক্তির সিদ্ধান্তে কোনাে ধরনের যুদ্ধে নামতে পারেন কি না- এসব প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবে উঠে । উপরােক্ত কর্মকর্তা অবশ্য তাঁর গ্রন্থে এসব প্রসঙ্গের কোনাে ব্যাখ্যা দেননি। বাস্তবে রক্ষীবাহিনীর তৎপরতাকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে দেশের সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন যে পুরােপুরি কতৃহীন ছিল সে বিষয়টি ৫. উপ-অধ্যায়ে একজন বামপন্থী নেতার নিজস্ব অভিজ্ঞতাকেন্দ্রিক একটি দীর্ঘ উদ্ধৃতি থেকে পাঠক দেখতে পাবেন। উল্লেখ্য, রক্ষীবাহিনী ছাড়াও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়ােজনে মুজিব শাসনামলে ঢাকায় পুলিশের একটি স্পেশাল বাহিনী’ও সক্রিয় ছিল। তখনকার বামপন্থী নেতা হায়দার আকবর খান রনাের ভাষায়, ‘বড় ভয়ংকর ছিল এদের (স্পেশাল বাহিনী) কাজ। সাদা টয়ােটা গাড়িতে ঘুরে বেড়াত তারা। হঠাৎ কাউকে সন্দেহজনক মনে হলে গাড়িতে তুলে নিয়ে উধাও হতাে। আর খোঁজ পাওয়া যেত না তার।৩৯৮
দেশে স্বাধীনতা-উত্তর নতুন পরিস্থিতিতে জাসদ, যুবলীগ, রক্ষীবাহিনী ইত্যাদির বাইরে মুজিব বাহিনীর পঞ্চম এক ক্ষুদ্র বিকাশ ধারা হিসেবেই চিহ্নিত করা যায় স্বেচ্ছাসেবক লীগকে। এটা গড়ে উঠেছিল আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে। শেখ মণি ও তােফায়েল আহমেদের বাইরে এসময় মুজিবের পাশে মুজিব বাহিনীর তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন আবদুর রাজ্জাক। উল্লেখ্য, পঁচাত্তরের পরে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রক্ষীবাহিনীর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলেও যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের কার্যক্রম ও সক্রিয়তায় কোনাে ছেদ পড়েনি কখনাে।
উপরােক্ত ধারাগুলাের বাইরেও সেই সময়ের আরেকটি বহুল আলােচিত সংগঠন ছিল ‘লাল বাহিনী। গণবাহিনী ও রক্ষীবাহিনীর গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে আলােচনাকালে এটা উল্লেখ করা হয়েছে যে, এগুলাে ছিল অনেকাংশে মুজিব বাহিনীর জনবলেরই নতুন কাঠামােগত রূপ। কিন্তু লাল বাহিনীর উৎস ছিল সে
……………………………………………………………..
৩৯৮) হায়দায় আকবর খান রনাে, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩১৩।
Page 245
অর্থে কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী। এটা ছিল রক্ষীবাহিনীর একটি সহায়ক মারমুখী শক্তি-যা গড়ে উঠেছিল আওয়ামী লীগের সহযােগী সংগঠন শ্রমিক লীগ’-এর নেতৃত্বে। এই বাহিনী গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন শ্রমিক নেতা আবদুল মান্নান। স্বাধীনতার আগে এই আবদুল মান্নান চটকল শ্রমিক ফেডারেশন করতেন। যে সংগঠনটি গড়ে তুলেছিল কমিউনিস্ট পার্টি ‘আরএসপি’। এই সংগঠনের সঙ্গে নির্মল সেন, নেপাল নাহা, রুহুল আমিন কায়সার প্রমুখ যুক্ত ছিলেন । মান্নান ছিলেন নেপাল নাহার তৈরি সংগঠক। কিন্তু ছয়দফা আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগের সিরাজুল আলম খানদের নৈকট্যে ও প্রভাবে আওয়ামী অঙ্গ সংগঠন জাতীয় শ্রমিক লীগে আসেন। তবে জাসদ গঠনের পর আবদুল মান্নান আর সিরাজুল আলম খানদের সঙ্গে থাকেননি। তিনি তখন শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ মণি’র প্রভাববলয়ে চলে যান।
স্বাধীনতার পর লাল বাহিনীর তৎপরতার কেন্দ্র ছিল দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চল । প্রথমে এই বাহিনী একটি ইতিবাচক উদ্দেশ্যেই গড়ে উঠেছিল । বিভিন্ন শিল্পাঙ্গনে সরকারি ও উর্দুভাষীদের কারখানা দখলের হিড়িক পড়ে গিয়েছিল ঐ সময় । এইরূপ অবৈধ ও নৈরাজ্যকর অবস্থা।থেকে কলকারখানা রক্ষার জন্যই প্রথমে লাল বাহিনীর গােড়াপত্তন । কারখানা রক্ষার সঙ্গে শ্রমিকদের রুটি-রুজির সম্পর্ক ছিল। তবে দ্রুত এই বাহিনীর মূল লক্ষ্য হারিয়ে যায়। অনেকটা একাত্তরের স্বাধীনতার আগে যেভাবে শিক্ষাঙ্গনে মােনায়েম খানের আনুকূল্যে ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফেডারেশন বা এনএসএফ নামের পেটোয়া ছাত্র সংগঠনের সৃষ্টি হয়েছিল সেভাবেই বিভিন্ন শিল্পাঙ্গনে শ্রমিক নামধারীদের ‘লাল বাহিনী’র কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। প্রতিদ্বন্দ্বী বাম সংগঠনগুলােকে উৎখাত করা এবং সর্বগ্রাসী চাঁদাবাজি হয়ে পড়ে এদের কার্যক্রমের প্রধান অংশ । বিরােধী দলগুলাের সমর্থক প্রায় সব সিবিএ ইউনিয়ন হাইজ্যাক করে এরা। তবে ‘রাজাকার ও সমাজ বিরােধীদের নির্মূল’-এর নামেই এসব হচ্ছিল। লাল বাহিনী বিশেষভাবে ‘বিহারি’ নামে পরিচিত উর্দুভাষীদের ওপর আক্রমণাত্মক ছিল। ঢাকায় বাহাত্তরের মে দিবসের সমাবেশে আবদুল মান্নান ঘােষণা দেন, ‘সরকার যদি বিহারিদের আটক ও বিচার না করে তার সংগঠনই সেই কাজটি করবে।’ লাল বাহিনীর ক্যাডাররা লাল জামা পরত । মাথায় লাল একটি শিরস্ত্রাণও থাকত তাদের।
১৯৭২-এর জুন থেকে লাল বাহিনী ঘােষণা দিয়ে কথিত ‘সমাজ বিরােধীদের বিপক্ষে শুদ্ধি অভিযান শুরু করে। এমনকি নিজস্ব অভিযানকালে আটককৃতদের ‘শাস্তি প্রদানের আইনগত ক্ষমতাও চাচ্ছিল তারা।৩৯৯ এইরূপ এক শুদ্ধি
……………………………………………………………….
৩৯৯) দেখুন, আশরাফ কায়সার, বাংলাদেশে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ১৯৯৫, পৃ. ৩৯।
Page 246
অভিযানেরই করুণ শিকার হন আহমেদ ফজলুর রহমান। যিনি ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ, আগরতলা মামলায় সহ-অভিযুক্ত এবং মুক্তিযুদ্ধের আগে যেসব উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা আওয়ামী লীগ রাজনীতির সঙ্গে গােপনে গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন তাদের একজন। ১৯৭৩ সালের ৩০ এপ্রিল মে দিবস’- এর পূর্বদিন ঢাকায় ব্যাপকভিত্তিক শুদ্ধি অভিযানকালে লাল বাহিনীর কয়েক ডজন সদস্য আহমেদ ফজলুর রহমানকে ধানমন্ডির বাসভবন থেকে মারতে মারতে টেনে হিচড়ে নিয়ে যায় শ্রমিক লীগ অফিসে। সেখানে স্বয়ং বাহিনী প্রধান আবদুল মান্নানের জেরার মুখে পড়েন ফজলুর রহমান। তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের পর ১৩টি পেট্রোল পাম্প দখলের অভিযােগ আনে লাল বাহিনী। পরে খােদ প্রধানমন্ত্রিকে ফোন করে শ্রমিক লীগ অফিস থেকে মুক্তি পান জনাব রহমান। পরদিন ঢাকার অনেক দৈনিকে এই খবর প্রকাশিত হয়। আহমেদ ফজলুর রহমান। লালবাগ থানায় একটি অভিযােগও দায়ের করেছিলেন (নম্বর : ১৪/৩০ এপ্রিল)।৪০০
বলা বাহুল্য, এইরূপ অভিযান ও শাস্তি উভয়ই ছিল প্রশাসনিক নৈরাজ্যের চরম দৃষ্টান্ত এবং অভিযানকালে আটককৃত সবার পক্ষে দেশের প্রধানমন্ত্রীর সহানুভূতি পাওয়া সম্ভব ছিল না। টঙ্গী, বাড়বকুণ্ড, কালুরঘাট ইত্যাদি স্থানে বামপন্থী শ্রমিক সংগঠনগুলাের বহু শ্রমিক সংগঠক নির্মম নির্যাতনের শিকার হয় এই বাহিনীর হাতে । তবে জাসদপন্থী শ্রমিক লীগের নেতা মেসবাহউদ্দীন আহমেদ মনে করেন, কিছুকিছু ক্ষেত্রে লাল বাহিনীর নেতিবাচক কর্মকাণ্ড বাস্তবতার তুলনায় অতিরিক্ত প্রচার পেয়েছে।”৪০১
১৯৭৫ সালের ২ জানুয়ারি বাকশাল গঠনকালে লাল বাহিনীর নেতা আবদুল মান্নান শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক উদ্যোগের বিরােধিতা করলে দুর্নীতির অভিযােগে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ফলে এই বাহিনীর কার্যক্রম কিছুটা স্তিমিত হয়। এর আগে মানান বাকেরগঞ্জ থেকে পার্লামেন্ট মেম্বারও নির্বাচিত হয়েছিলেন। মান্নানকে অপসারণের পর অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক করা হয়েছিল। উল্লেখ্য, লাল বাহিনীর কার্যক্রম ছাড়াও তিয়াত্তর- চুয়াত্তরে শিল্পাঞ্চলগুলােতে ব্যাপকভাবে আঞ্চলিকতার বিষবাষ্পও ছড়িয়ে পড়ে। ফলে শিল্প উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছিল। শিল্পাঙ্গনে এরূপ অস্থিরতার মাঝেই ১৯৭৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের বাড়বকুণ্ড শিল্পাঞ্চলে আর আর
…………………………………………………………………
৪০০) ১ ও ৩ মে, দৈনিক গণকণ্ঠ, ঢাকা। আলােচ্য ঘটনার পুরাে বিবরণ দিয়ে আহমদ ফজলুর রহমান গণমাধ্যমে যে বিবৃতি দেন তাতে তিনি এও উল্লেখ করেন যে, শ্রমিক লীগ অফিসে লাল বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে যখন নিপীড়ন চালাচ্ছিলাে তখন সেখানে সরকারপন্থী ছাত্রলীগের সভাপতি শহীদুল ইসলামও উপস্থিত ছিলেন।
৪০১) মেসবাহউদ্দীন আহমেদ-এর সাক্ষাৎকার, পূর্বোক্ত।
Page 247
টেক্সটাইল মিলে কেবল একটি ঘটনাতেই প্রায় ২২ জন শ্রমিক মারা যায়। স্থানীয় জেলা প্রশাসন অবশ্য প্রেসরিলিজে ৯ জনের মৃত্যুর কথা স্বীকার করে। আর দৈনিক গণকণ্ঠ মৃতের সংখ্যা ৫০ বলে উল্লেখ করে । বাঁশের তৈরি গুচ্ছগ্রামের মতাে শ্রমিক কলােনিতে চারদিক থেকে আগুন ধরিয়ে দিয়ে তারপর তিন দিক থেকে গুলি ছােড়ার মাধ্যমে এই আক্রমণ হয়। এ নিয়ে পরদিন চট্টগ্রাম, নােয়াখালী, কুমিল্লায় হরতাল পালিত হয়।৪০২ গণমাধ্যমের ভাষ্য থেকে জানা যায়, নােয়াখালী অঞ্চলের শ্রমিক প্রাধান্যপূর্ণ এই কারখানায় কিছুদিন পর সিবিএ নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোনােভাবেই সরকার দলীয় শ্রমিক সংগঠনটি তার শাখা স্থাপন করতে পারছিল না; তারই প্রতিশােধ ছিল এই হামলা।৪০৩
Source: মুজিব বাহিনী থেকে গন বাহিনী ইতিহাসের পুনর্পাঠ; আলতাফ পারভেজ