প্রথাগত শ্রমিক ও কৃষক রাজনীতিতে সিরাজুল আলম খান
তিনি (সিরাজুল আলম খান) এমন মানুষ যাকে ভালােবাসতে হয় । তিনি আত্মােৎসর্গের প্রতীকস্বরূপ। আমার শুধু ভয় ছিল, দারিদ্র্যমুক্তির পথের ধীরগতিতে তিনি সন্তুষ্ট হতে পারবেন না এবং হয়তাে রূঢ় ও অগ্রহণযােগ্য ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে অপ্রিয় হয়ে যাবেন।
– জেনারেল উবানী২৯৫
তাঁর (সিরাজুল আলম খান) মূল উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধুকে অপ্রিয় করে তােলা। এটার মধ্যে যাদের হাত ছিল, আমি সেটা বলবাে না, তবে আমি জানি।
– তােফায়েল আহমেদ২৯৬
বাঙালি উঠতি বুর্জোয়া, পেটিবুর্জোয়া, মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের স্বার্থ রক্ষাকারী সংগঠন হিসেবেই আওয়ামী লীগের উৎপত্তি ও বিকাশ। সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বাধীন আব্দুর রব-সিরাজ গ্রুপ ‘স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তােলার সিদ্ধান্ত নিলেও সর্বহারা আন্তর্জাতিকতাবাদের দষ্টিকোণ থেকে শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী পার্টি গড়ে তােলার ধারায় শ্রমিক-কৃষকরাজ প্রতিষ্ঠার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিটি তাদের কাছে স্বচ্ছ ছিল না।
-আ ফ ম মাহবুবুল হক, আহ্বায়ক, বাসদ২৯৭
সিরাজুল আলম খান ছিলেন ছাত্র রাজনীতির সংগঠক। আর জাসদ হলাে তার সৃষ্টি। স্বভাবত জাসদে সূচনাকালে ছাত্র সংগঠকরাই ছিলেন কেন্দ্রে এবং জেলা পর্যায়েও মুখ্য ব্যক্তিত্ব। তারা তখন বলতেন, “আমরা লড়ছি শ্রেণিসংগ্রামকে ত্বরান্বিত করে সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য।’ অন্যদিকে তাদের উদ্দেশ্য করে ছাত্রলীগের মাখন-সিদ্দিকী গ্রুপ বলত, ‘বৈজ্ঞানিকের ভাওতাবাজি- মাও নিক্সনের কারসাজি’; ‘নিক্সন পেড়েছে ডিম- মাও দিয়েছে তা- তা থেকে বের হলাে বৈজ্ঞানিকের ছা!’ এতসব আক্রমণাত্মক শ্লোগানের পরও অবশ্য রব-সিরাজ গ্রুপ ‘সমাজ বিপ্লবের অভিমুখে’ ছিলেন দৃঢ় পদক্ষেপে আগুয়ান। ছাত্রলীগের এই অংশের আরেকটি চিত্তাকর্ষক শ্লোগান ছিল, ‘পিকিং মস্কো বুঝি না- মাও লেনিন ছাড়া চিনি না।
ছাত্রদের দ্বারা শ্রেণিসংগ্রাম ত্বরান্বিত করার এরূপ চেষ্টা মার্কসবাদী বিশ্ব-।অভিজ্ঞতায় বেশ অভিনব হলেও এও সত্য, ছাত্র রাজনীতিতে থাকার সময়ই
……………………………………………………………..
২৯৫) পূর্বোক্ত, পৃ. ২৩।
২৯৬) ১৯৮৯ সালের ১৪ এপ্রিল টেপরেকর্ডারে ধারণকৃত তােফায়েল আহমেদের সাক্ষাৎকার, বিস্তারিত দেখুন, মাসুদুল হক, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৬৭।
২৯৭) আ ফ ম মাহবুবুল হক, বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স: একটা পর্যালােচনা, সংযুক্তি: দুই।
Page 191
সিরাজুল আলম খান পূর্ব-পাকিস্তানের শ্রমিক রাজনীতিতেও সংগঠন করার চেষ্টা শুরু করেছিলেন। শিক্ষাঙ্গনে তিনি যে নিউক্লিয়াস মডেল’-এ সফলতা পান শিল্পাঙ্গনেও (এমনকি অন্যান্য অনেক পেশাজীবীদের মাঝেও) সেই একই পথ অনুসরণ শুরু করেন তিনি ‘৬৬-৬৭ থেকে। তার প্রত্যক্ষ উদ্যোগেই ১৯৬৯ সালে। গড়ে ওঠে শ্রমিক লীগ । ১৯৭২ সালে ছাত্রলীগের ভাঙন যেমন শিক্ষাঙ্গনকে অস্থির ও রক্তাক্ত করে তােলে তেমনি শিল্পাঞ্চলেও অনুরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে বাংলাদেশ শ্রমিক লীগের বিভক্তি। এ পর্যায়ে তাই সিরাজুল আলম খানের শ্রমিক রাজনীতিতে প্রবেশ ও প্রভাব বিস্তারের কাহিনী কিছুটা সংক্ষেপে হলেও তুলে ধরা প্রাসঙ্গিক হবে। এটা এ কারণেও জরুরি যে, সিরাজুল আলম খান ও তাঁর তরুণ সহযােগীরা যখন ১৯৭২ সালে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’-এর ডাক দিচ্ছেন তখন তাদের শ্রমিক ফ্রন্টে সাধারণ শ্রমিকদের জন্য তা ছিল অনেকাংশেই বিস্ময় ও কৌতূহলের বিষয়। এই শ্রমিকদের ‘৬৮-৬৯ পর্যায়ে সংগঠিত করা হয়েছিল মুজিব ও তার ছয়দফার সমর্থনে, অথচ মাত্র ২-৩ বছরের ব্যবধানে তাদের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মতাে এক আদর্শের পক্ষে দাড়ানাের জন্য বলা হয় এবং পাশাপাশি মুজিবের বিরুদ্ধেও। যুদ্ধের এই নতুন সমীকরণে মুজিব ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব পড়ে যান অনেকাংশে শ্রেণিশত্রুর কাতারে। অন্যদিকে শেখ মুজিব, এমনকি শেখ মণিও তখন ‘সমাজতন্ত্র চাইছিলেন- ফলে মাঠ পর্যায়ে শ্রমিকরা ছিল প্রকৃতই বিভ্রান্ত। বিশেষত এই দুই ধারার ‘সমাজতন্ত্রীরা কেউই শ্রমিক লীগের কর্মীদের মার্কসবাদী ধারায় পদ্ধতিগতভাবে সমাজ পরিবর্তনের পথ ও পদ্ধতি বিষয়ে দীক্ষা দেওয়ার কোনাে প্রচেষ্টা নেয়নি, অন্তত বাহাত্তর-তিয়াত্তরের আগে। ফলে সাধারণ শ্রমিকরা চারিদিকের বহুমুখী তীব্র সমাজতান্ত্রিক বাক্য জালে ছিলেন অনেকখানি হতবিহ্বল।২৯৮
শ্রমিক অঙ্গনে প্রবেশের সময় প্রাথমিক পর্যায়ে সিরাজুল আলম খানের অন্যতম নির্ভরশীল একজন সংগঠক ছিলেন মেসবাহ্উদ্দীন আহমেদ।২৯৯ তাঁর
………………………………………………………………..
২৯৮) অনেক বােদ্ধা মধ্যবিত্তের জন্যও সমাজতন্ত্রের এরূপ রণধ্বনি ছিল হতবুদ্ধিকর। কারণ ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশে যেসব রাজনৈতিক দলিলকে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়- যেমন বহুল আলােচিত ২১ দফা, ৬ দফা, ১১ দফা- এমনকি ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিলের ‘স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র ইত্যাদির কোথাও ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রটির সমাজ ব্যবস্থা হিসেবে সমাজতন্ত্র’-এর সরাসরি উল্লেখ্য ছিল না। উপরােক্ত তিনটি দলিলে একইভাবে অনুপস্থিত ছিল ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ প্রসঙ্গও।
২৯৯) জাসদ গঠনের পর তিনি ঢাকা মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। পাশাপাশি দলটির শ্রমিক সংগঠনেরও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হন তিনি। বর্তমানে ঢাকার সুপরিচিত প্রকাশনা সংস্থা ‘অংকুর’-এর স্বত্বাধিকারী। জাসদের প্রথম দফা ভাঙনে শাহজাহান সিরাজের সঙ্গে, তারপর মীর্জা সুলতান রাজার সঙ্গে এবং পরে ড. কামাল হােসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরামে যােগ দেন। তবে বর্তমানে সাধারণভাবে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হলেও শ্রমিক রাজনীতিতে সক্রিয়।
Page 192
সঙ্গে আলাপচারিতার (৩১ অক্টোবর এবং ৩ নভেম্বর ২০১২, ঢাকায়) ভিত্তিতে জানা যায়, মূলত মুজিবের ছয়দফাকে জনপ্রিয় করার আন্দোলনের সময় সেই উদ্যোগেরই অংশ হিসেবে সিরাজুল আলম খান তার কয়েকজন ছাত্র সংগঠক সহযােগীকে তখনকার বিদ্যমান শ্রমিক সংগঠনগুলাের নৈকট্য অর্জনের জন্য দায়িত্ব দেন। একে তৎকালীন বিদ্যমান শ্রমিক রাজনীতিতে অনুপ্রবেশের চেষ্টা হিসেবেও ব্যাখ্যা করা যায়। এসময় সবচেয়ে বড় শ্রমিক সংগঠন ছিল কমিউনিস্ট দল আরএসপি৩০০ প্রভাবিত চটকল ফেডারেশন এবং মুসলিম লীগ প্রভাবিত ‘পাকিস্তান ফেডারেশন অব লেবার। এসব সংগঠনে অনুপ্রবেশের পাশাপাশি তেজগাঁও, নারায়ণগঞ্জ ইত্যাদি শিল্পাঞ্চলেও সিরাজুল আলম খান কিছু শ্রমিক সংগঠকের সঙ্গে নৈকট্য গড়ে তুলতে সক্ষম হন সত্তরের আগেই। এসব যােগাযােগ গড়ে তােলার কাজে সিরাজুল আলম খান অনেক সময় আঞ্চলিকতার সদয় সহযােগিতাও পেয়েছেন বলা যায়। দেশের শিল্পাঙ্গনে বৃহত্তর নােয়াখালীর শ্রমিকদের প্রাধান্য এসময় সিরাজুল আলম খানকে তাঁর পরিকল্পিত অগ্রযাত্রায় বিশেষ সহায়তা করে। যেহেতু তার গ্রামের বাড়ি ছিল একই জেলায়। এভাবে একদিকে যেমন তিনি আদমজীতে পান মােহাম্মদ উল্ল্যা ও সায়েদুল হক সাদু’দের৩০১, তেমনি তেজগায়ে যােগাযােগ ঘটে রুহুল আমিন ভূঁইয়াদের সঙ্গে।
…………………………………………………………………
৩০১) রেভল্যুশনারী সােসালিস্ট পার্টি বা “আরএসপি’ হলাে ব্রিটিশ বিরােধী সংগ্রামকালে গড়ে ওঠা গােপন বিপ্লবী সংগঠন ‘অনুশীলন’-এর একটি গােষ্ঠীর পরবর্তী সময়ে বিকশিত সাংগঠনিক নাম। যােগেশ চ্যাটার্জি, ত্রিদিব চৌধুরী, কেশবপ্রসাদ শর্মা প্রমুখ ছিলেন আদি সংগঠক। আনুষ্ঠানিকভাবে দলের জন্ম ১৯৪০-এ। আরএসপি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া একটি অংশ পরে গঠন করে এসইউসি আই জাসদ গঠনকালে যে দলের ভূমিকা আমরা অন্যত্র আলােচনা করেছি। পাকিস্তান শাসনামলে পূর্ববাংলায় এই দলের সংগঠকরা মূলত শ্রমিকদের সঙ্গে মিশে ট্রেড ইউনিয়ন রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। বর্তমানে দলের ভারতীয় শাখার কেন্দ্রীয় কার্যালয় দিল্লির ১৭ নং ফিরােজ শাহ রােড়-এ। ১৯৯৯ ও ২০০৪ সালের নির্বাচনে এই দল ভারতীয় পার্লামেন্টে তিনটি করে আসন লাভ করেছিল। বাংলাদেশে এই দলের আলােচিত সংগঠক ছিলেন নির্মল সেন। তাঁর মৃত্যুর পর বাংলাদেশে এই দল নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।
৩০১) সাদু পরবর্তীকালে বাংলাদেশের শ্রমিক রাজনীতিতে, বিশেষত আদমজী এলাকায় এক সুপরিচিত চরিত্র হয়ে ওঠেন আশির দশকে। সিপিবি’র শ্রমিক সংগঠন ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের অন্যতম শ্রমিক সংগঠক তাজুল ইসলামকে যখন ১৯৮৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আদমজীতে হত্যা করা হয় তখন সাদু ও তার সহযােগিদের এজন্য দায়ী করা হচ্ছিল। তাজুল ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ও ছাত্র ইউনিয়নের সংগঠক। সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির টানে তিনি আদমজীতে শ্রমিক সংগঠন গড়ে তুলতে গিয়েছিলেন ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের হয়ে। তার হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ঐ সময়কার আদমজীতে সাদুকেন্দ্রিক শ্রমিক লীগের পুরানাে সংগঠকদের কমিউনিস্ট বিরােধী মনস্তত্ত্ব প্রকটভাবে ধরা পড়ে। সাদুদের নেতৃত্বেই আদমজিতে স্বাধীনতা-উত্তর ‘লাল বাহিনী গড়ে উঠেছিল। স্বাধীনতা-উত্তর সময় থেকে নিজস্ব একটি বাহিনীও ছিল তার। এসব বাহিনীর চাপেই সত্তর-একাত্তরে ইউনাইটেড এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের নেতা মাওলানা সাইদুর রহমানকে শ্রমিক লীগে আসতে হয়েছিল, আর এই প্রক্রিয়ায় দূর থেকে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন সিরাজুল আলম খানও। এসময় শেখ ফজলুল হক মণিও আদমজীর রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টায় নামেন-“আদমজী জুটমিলস্ শ্রমিক সংঘনামে একটি নতুন সংগঠনের রেজিস্ট্রেশনের মধ্য দিয়ে। জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর সাদু ও শ্রমিক লীগের প্রধান অংশ সামরিক শাসকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ‘জনস্বাধীন শ্রমিক ফেডারেশন’ নামে নতুন একটি শ্রমিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে তাদের পুরানাে আধিপত্য ধরে রাখতে সমর্থ হয়। ১৯৮৭ সালের ২৯ মে সাদু মারা যান।
Page 193
আদমজীতে নােয়াখালী সংযােগ শক্তিশালী করতেই সিরাজ তার তরুণ ‘কমরেড ফজলে এলাহীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়ােগ দেন সেখানে সংগঠন গােছাতে। রুহুল আমিন ভূঁইয়াকে পাওয়ার ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের ‘নিউক্লিয়াস’ সদস্য আবদুর রাজ্জাক তাকে সাহায্য করেছিলেন। রুহুল আমিন ভূঁইয়া তখন মজদুর
ফেডারেশন করতেন। সামগ্রিক এসব তৎপরতার ফসল ছিল ১৯৬৯ সালের ১২ অক্টোবর জাতীয় শ্রমিক লীগ’-এর প্রতিষ্ঠা। মেসবাহউদ্দীনের ভাষায়, একজন ছাত্রনেতার হাতেই আসলে আওয়ামী লীগের শ্রমিক সংগঠনের জন্ম হয়েছিল এবং খােদ আওয়ামী লীগেও এর প্রবল বিরােধিতা ছিল। সেখানে শ্রম বিষয়ক সম্পাদক জহুর আহমেদ চৌধুরী ছাড়াও তাজউদ্দীন আহমদও দলীয় অঙ্গসংগঠন হিসেবে শ্রমিক সংগঠন গড়ার বিপক্ষে ছিলেন।’
কিন্তু সিরাজুল আলম খান শ্রমিক লীগ দাঁড় করাতে এতটাই মরিয়া ছিলেন যে, অন্য সংগঠনে ঢুকে পড়ে ভালাে সংগঠকদের নিজের রাজনৈতিক বলয়ে নিয়ে আসার পাশাপাশি পেশাগতভাবে ভিন্ন পরিসরের অনেককে ধরে এনে ‘ট্রেড ইউনিয়ন পরিমণ্ডলে ঢােকানােরও চেষ্টা করেন। যেমন তার হাতে সৃষ্ট শ্রমিক নেতা মােহাম্মদ শাহজাহান শ্রমিক লীগে আসার আগে ছিলেন একজন সাধারণ নির্মাণ ঠিকাদার। আবদুল মান্নানকে নিয়ে আসা হয় চটকল ফেডারেশন থেকে। মুজিবের প্রতি মান্নানের বিশেষ আকর্ষণ ছিল। সামগ্রিক এসব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মাওলানা সাইদুর রহমান৩০২, নুরুল হক, রুহুল আমিন ভূঁইয়া, আবদুল মান্নান, মােহাম্মদ শাহজাহান, মেসবাহ আহমেদ প্রমুখ সংগঠকের মাধ্যমে শ্রমিক লীগের গােড়াপত্তন ঘটে। এর মধ্যে নুরুল হক ছিলেন পেশায় ব্যবসায়ী। নােয়াখালীর বাসিন্দা হিসেবে তিনি নােয়াখালীর শ্রমিকদের আকৃষ্ট করতে পারবেন এই বিবেচনা কাজ করেছিল।
সূচনাকালে শ্রমিক লীগের অধীনে কারখানাভিত্তিক কোনাে ইউনিয়নই ছিল না। বস্তুত ট্রেড ইউনিয়নের প্রয়ােজনে কিংবা সরাসরি শ্রমিকদের পেশাগত বিষয়ে কাজ করার লক্ষ্য নিয়ে নয়- জাতীয় রাজনীতিতে সিরাজুল আলম খানের পরিকল্পনার অংশীদার হতেই জন্ম হয় নতুন এই শ্রমিক সংগঠনের। মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের রাজনীতির বিজয় একাত্তর পরবর্তী সময়ে শিল্পাঙ্গনে ঐ শ্রমিক সংগঠনকে একচেটিয়া রাজত্ব এনে দেয়। ইতােমধ্যে লীগসংশ্লিষ্ট
…………………………………………………………..
৩০২) তিনি ছিলেন আদমজীতে শ্রমিক ইউনিয়ন’-এর নেতা। ভয়-ভীতি দেখিয়ে তাকে নিয়ে আসা হয়েছিল।
Page 194
শ্রমিকদের একাংশ একাত্তরে মুজিব বাহিনীতেও সামরিক প্রশিক্ষণ পেয়ে এসেছিলেন।৩০৩
জাসদ গঠনের পর শ্রমিক লীগ নেতাদের মধ্যে রুহুল আমিন ভূঁইয়া, মােহাম্মদ শাহজাহান ও মেসবাহ আহমেদ সিরাজুল আলম খানের ডাকে সাড়া দিলেন। আদমজীতে সাদুরা এলেন না। আবদুল মান্নানও নয়! জাতীয় রাজনীতির টানাপােড়েনে ট্রেড ইউনিয়ন পরিমণ্ডলের আবহাওয়াই তখন পাল্টে যাচ্ছিল। যে কোন শিল্পাঞ্চলেই কোনাে শ্রমিক সংগঠক জাসদের পক্ষ নেয়া মাত্রই তাকে সেখান থেকে উৎখাত হতে হচ্ছিল- কেবল পােস্তগােলা এলাকা ব্যতীত। শেখ মুজিব ও শেখ মণি’র প্রলােভন কিংবা আহ্বান কোনােটা প্রত্যাখ্যানই সহজ ছিল না। শ্রমিক লীগে যার সবচেয়ে বড় বলী ছিলেন রুহুল আমীন ভূঁইয়া। জাসদ গঠনের আগেই তাকে আটকের উদ্যোগ নেয়া হয়। প্রথম গ্রেফতারে শ্রমিকরা থানা ঘেরাও করে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান। কিন্তু পরের দফায়, প্রেস কনফারেন্স করে আওয়ামী লীগের শ্রম সম্পাদক পদ থেকে পদত্যাগের আগের দিন- ১৯৭২-এর ৬ ডিসেম্বর আটক হওয়ার পর সমগ্র মুজিব আমল তাঁকে কারাগারেই থাকতেই হয়। তিনটি মামলা দেওয়া হয় তার বিরুদ্ধে।৩০৪ এসময় ঢাকায় কোথাও জাসদপন্থী শ্রমিক লীগের অফিসও করা যায় নি। প্রথমে পল্টনে এবং পরে মগবাজারে তাদের অফিস তুলে দেওয়া হয়। এসবই হচ্ছিল দেশব্যাপী এক মৃদু গৃহযুদ্ধের মাঝে। সংঘাতের বিস্তৃতি ছিল এসময় পুরাে প্রায় দেশজুড়ে। তবে প্রধানত শিক্ষাঙ্গনে। আর শ্রমিক অঙ্গনে চলছিল জাতীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি।
মেসবাহউদ্দীন আহমেদের মতে, কেবল মুক্তিযুদ্ধোত্তর সামাজিক হতাশা থেকেই নয়, সর্বগ্রাসী এক নিরাপত্তাহীনতার বােধ জাসদ গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। নতুন দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে অনেকেই বিশ্বাস করতেন- আওয়ামী লীগ বা ঐ দলের ছাত্র সংগঠনে পড়ে থাকলে রাজনৈতিক ভিন্নমতের কারণে কোনােভাবেই তারা রেহাই পাবেন না। নতুন দল হলে হয়তাে প্রতিরােধের একটি কাঠামাে গড়ে তােলা যাবে।৩০৫ এসব বিবেচনায় সবার আগ্রহ তখন সশস্ত্র কার্যক্রমে। কারণ যুদ্ধের সময় পাওয়া অস্ত্র তখন অনেকের কাছে। তারপরও পদ্ধতিগতভাবে ট্রেড ইউনিয়ন রাজনীতি গড়ে তুলতে ক্যাডারভিত্তিক প্রশিক্ষণের
…………………………………………………………………
৩০৩) শ্রমিক লীগ গড়ে তােলার ক্ষেত্রে সিরাজুল আলম খানের অন্যতম নির্ভরশীল সংগঠক মেসবাহউদ্দীন আহমেদ মুজিব বাহিনীর প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণার্থী ছিলেন।
৩০৪) রুহুল আমীন ভূইয়ার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় যে অভিযােগটি সরকার দাঁড় করাতে পারলাে তা হলাে তাঁর বাড়িতে বিপুল অস্ত্রসম্ভার পাওয়া। শ্রমিক লীগের নাম প্রকাশে অনছুিক একটি সূত্র বলেছে, উর্ধ্বতনদের নির্দেশেই ‘ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য এসব অস্ত্র রেখে দেয়া হয়েছিল। তিয়াত্তরে এসে ঐ ‘ভবিষ্যৎ রাজনীতি’র দিকচিহ্ন স্পষ্ট হতে শুরু করে।
৩০৫) মেসবাহউদ্দীন আহমেদ, সাক্ষাত্তার, ৩১ অক্টোবর ২০১২, ঢাকা।
Page 195
আয়ােজনও শুরু হয় চুয়াত্তর নাগাদ। ইতােমধ্যে মাহমুদুর রহমান মান্না, মার্শাল মনিরুল ইসলাম, একরামুল হক প্রমুখ ছাত্রনেতারাও আসছিলেন জাসদপন্থী শ্রমিক লীগ গড়ে তুলতে । প্রথাগত বামপন্থী শ্রমিক সংগঠকদের থেকে নিজেদের পৃথকত্ব বােঝাতে জাসদ ইতােমধ্যে দুনিয়ার মজদুর এক হও’ বাদ দিয়ে নতুন শ্লোগান হাজির করে ‘বাঙলার মেহনতী মানুষ এক হও’। কারণ ‘জাতীয় সমাজতন্ত্র’-এর জন্য চাই জাতীয় শ্লোগান’!
কিন্তু পঁচাত্তরে একের পর এক রাজনীতির উত্তাল ঢেউ স্থিরতা পেতে দেয়নি পদ্ধতিগত কোনাে আয়ােজনকেই। সিপাহি বিপ্লব’ ব্যর্থ হয়ে ততদিনে আবার সংগঠনে ভাটার টান শুরু হয়েছে- দফায় দফায় ভাঙতে শুরু করে জাসদ, সঙ্গে শ্রমিক লীগও। ১৯৭৮ সালে সংগঠনের নাম পাল্টে রাখা হয় জাতীয় শ্রমিক জোট’; আর ১৯৮৪ সালে শুরু হয় ধাপে ধাপে তার বিভক্তি প্রক্রিয়া- মােহাম্মদ শাহজাহান গেলেন জেনারেল এরশাদের নৈকট্য আকাঙ্খী আ স ম রবের সঙ্গে, রুহুল আমিন ভূইয়া ও ফজলে এলাহী সরাসরি জাতীয় পার্টিতে। মেসবাহউদ্দীনের ভাষায়, ‘সবাই তখন যেন হারিকিরি করছিল।’৩০৬
জাসদ গড়ে ওঠার সময় ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগকে যেভাবে বেদনাদায়ক এক বিভক্তির কাল পেরােতে হয়েছিল কৃষক লীগের ক্ষেত্রে তেমনি ঘটেনি। পূর্ববর্তী অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন হিসেবে কৃষক লীগেরও প্রতিষ্ঠা সিরাজুল আলম খানের মাধ্যমে স্বাধীনতার পরে, ১৯৭২ সালের ১৯ মে। তখনও ছাত্রলীগে ভাঙনের উত্তেজনাকর অধ্যায় শুরু হয়নি- সিরাজুল আলম খান শেখ মুজিবুর রহমানকে বােঝাতে সক্ষম হলেন, আওয়ামী লীগের একটি কৃষক সংগঠন থাকা দরকার। সম্মতি পাওয়ামাত্র সিরাজ একটি কমিটি তৈরি করে মুজিবের সম্মতি নিয়ে নেন। মুক্তাগাছা থেকে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য খােন্দকার আবদুল মালেক শহীদুল্লাহকে সভাপতি এবং হাসানুল হক ইনুকে সাধারণ সম্পাদক করে কৃষক লীগের কমিটি গঠিত হয়ে যায়। কাজী আরেফ আহমেদ এই কমিটির সহ-সভাপতি ছিলেন।
এ পর্যায়ের বিস্ময়কর দিক হলাে সংগঠনটি গড়ে ওঠার স্বল্প সময়ের মধ্যে তাদের তরফ থেকে সমাজতান্ত্রিক কৃষি বিপ্লব’-এর এক তাত্ত্বিক দলিল হাজির করা হয় মুজিবের সামনে। যদিও এই সংগঠন তখন কিংবা পরবর্তী ২-৩ বছরে কখনােই দেশের কোথাও কৃষি বিষয়ে সাধারণ কৃষকদের নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তােলার কোনাে উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা যায় না। কিন্তু ছাত্রলীগে ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে এমন অনেক র্যাডিকাল কর্মীকে ‘সমাজতান্ত্রিক কৃষি বিপ্লব’-এর আওয়াজের মাধ্যমে কৃষক লীগে নিয়ে আসা হয় এবং তাদের মাধ্যমে সারা দেশে
…………………………………………………………
৩০৬) এসময় নেতৃত্বের প্রশ্নে মতদ্বৈততায় জাসদপন্থী শ্রমিক লীগের সম্বেলনে তীব্র মারামারিও হয় । সৃষ্টি হয় একাধিক ধারা।
Page 196
প্রচুর সাধারণ কৃষককে এই সংগঠনের সদস্যও করা হয়। কিছু দিন পরই যখন নতুন দল জাসদ গঠিত হলাে তখন কৃষক লীগের পুরােটাই সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে গেল,৩০৭ আর তার সামান্য কিছু দিনের মধ্যে প্রায় পুরাে কৃষক লীগ গণবাহিনীতে পরিণত হয়ে যায়। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায়, গণবাহিনী মানেই কৃষক লীগ। সমাজতান্ত্রিক কৃষি কর্মসূচি বাস্তবায়নের পথ’ সম্পর্কে এসময় কৃষক লীগের তরফ থেকে তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাটি দেওয়া হলাে এভাবে :
‘…সমাজতান্ত্রিক কৃষি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারে কেবল সমাজতান্ত্রিক সরকার। বাংলাদেশে বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের মতাে ধনিক শ্রেণীর সরকার সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। সমাজতান্ত্রিক সরকারের অর্থ হচ্ছে শােষিত শ্রেণীর সরকার, শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতী জনগণের বিপ্লবী সরকার। কেবল সর্বহারার অগ্রণী নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষক এবং মেহনতী জনগণের সহযােগিতায় সত্যিকারের সমাজ বিপ্লবের মাধ্যমে এরূপ সরকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব। সর্বহারার অগ্রণী নেতৃত্বে শহরে-নগরে শ্রমিকশ্রেণীর।লৌহ-কঠিন সামরিক সংগঠন তার একটি পূর্বশর্ত।…”৩০৮
এইরূপ থিসিসকে আঁকড়ে ধরে, কিন্তু কৃষি বিষয়ে উল্লেখযােগ্য কোনাে।আন্দোলন-সংগ্রাম ছাড়াই ১৯৭৩-এর ডিসেম্বর থেকে কৃষক লীগ ২১ দফা দাবিতে দেশব্যাপী গণবিক্ষোভের কর্মসূচি ঘােষণা করে। তাদের ২১ দফা’র প্রথম দফাই।ছিল ‘ব্যর্থ আওয়ামী লীগ সরকার পদত্যাগ কর।’ এসময় কৃষক লীগ কর্মীরা।অবিশ্বাস্য দ্রুততায় শহুরে জনপদে রাষ্ট্রযন্ত্র ও সরকারি পেটোয়া বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে এবং একের পর এক মারা যেতে থাকে। পরবর্তীকালে জাসদ সশস্ত্র সংগ্রাম ছেড়ে দিলেও কৃষক লীগের ঐ সশস্ত্র অনেক স্থানেই তাৎক্ষণিকভাবে থামানাে যায়নি। ইতােমধ্যে অবশ্য সংগঠনটির সভাপতি নানা চড়াই উত্রাই পেরিয়ে আবার ফিরে গেছেন মুক্তাগাছা আওয়ামী লীগে।৩০৯ আর
…………………………………………………………………
৩০৭) এসময় খােন্দকার আবদুল মালেক শহীদুল্লাহ জাসদে যােগ দেয়ায় আওয়ামী লীগ তাকে বহিষ্কার করে। আওয়ামী লীগে তার আনুষ্ঠানিক পদ ছিল ময়মনসিংহ জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে। আওয়ামী লীগ ছেড়ে আসার ক্ষেত্রে তাঁর সাহস নতুন দল হিসেবে জাসদকে নৈতিকভাবে বেশ চাঙ্গা করে তােলে। ১৯৭২ সালের ৯ সেপ্টেম্বর তাঁকে গণপরিষদ থেকেও বহিষ্কার করা হয়।
৩০৮) সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসূচি, খন্দকার আবদুল বাতেন কর্তৃক পুরানাে পল্টন, ঢাকা থেকে প্রকাশিত ও প্রচারিত, পৃ. ২৪-২৬, ঢাকা। উল্লেখ্য, খন্দকার আবদুল বাতেন বর্তমানে আওয়ামী দলীয় সংসদ সদস্য।
৩০৯) আওয়ামী লীগে ফিরে যান তিনি ১৯৯৪-এ। এখন স্রেফ উপজেলা কমিটির সদস্য। ২০১৩ সালের জুনে ৭৭ বছর বয়সী খােন্দকার শহীদুল্লাহ’র কাছে যখন তাঁর জাসদে যােগদান, গণবাহিনীর তৎপরতায় যুক্ত হওয়া ইত্যাদি বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় তখন তিনি বলেন :
‘…অন্তত আমার মধ্যে তখন দোদুল্যমানতা ছিল। আমরাই একটা সরকার প্রতিষ্ঠা করলাম,।আবার আমরাই তাকে উৎখাতের জন্য নেমেছি…নিজের কাছে কনভিন্স ছিলাম না। এটা বিশ্বাসঘাতকতা হয় কি না তাও ভাবছিলাম ।..অনেক পরে মনে হয়েছে, সরকার ভুল।করেছিল আর আমরা তা সংশােধন করতে গিয়ে আরও বড় ভুল করলাম। এও মনে হয়েছে, সরকারের মধ্যে থেকেও আমরা তার ভুলগুলাে সংশােধন করতে পারতাম।…আমি অনেকটা রাগের মাথায় জাসদে যােগ দিয়েছিলাম।’ উল্লেখ্য, জাসদের বিভিন্ন পর্যায়ের ভাঙনে। শহীদুল্লাহ প্রথমে আ স ম রবের সঙ্গে, দ্বিতীয় পর্যায়ে শাহজাহান সিরাজের সঙ্গে এবং তৃতীয় দফায় মীর্জা সুলতান রাজার সঙ্গে ছিলেন। সর্বশেষ তিনি আওয়ামী লীগে চলে আসেন।
Page 197
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হাসানুল হক ইনুও আওয়ামী লীগের অনেক কাছাকাছি এসেছেন ২০১২ সালে শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় তথ্যমন্ত্রী হয়ে।
আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে আসার সময় ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ ছাড়াও মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়েও জাসদ পৃথক একটি গণসংগঠনের জন্ম দেয় ‘জাতীয় মুক্তিযােদ্ধা সংগ্রাম পরিষদ’ নামে। প্রথমে এই সংগঠনে নেতৃত্ব দেন মেজর এম এ জলিল ও হাবিবুল হক বেনু, পরে মেজর জিয়াউদ্দিন। শেষােক্তজন বর্তমানে আওয়ামী পরিবারের একজন সদস্য। জাসদের একটি নারী শাখাও ছিল ‘মহিলা সাংগঠনিক কমিটি’ নামে। এর সভাপতি ছিলেন মমতাজ বেগম, সহ- সভাপতি ছিলেন রাজিয়া হােসেন এবং সাধারণ সম্পাদক হন হাসনা রহমান। ১৯৭৩ সালের ৯ মে এটি গঠিত হয়েছিল। ছাত্রলীগে সিরাজুল আলম খান গ্রুপে এবং পরে জাসদ গঠনের পর এই দলের সাংগঠনিক বিকাশে শামসুন্নাহার ইকু, ফরিদা খানম সাকি, রাবেয়া সিরাজ, আমেনা সুলতানা বকুল, লুঙ্কা হাসিনা রােজী প্রমুখ নারী গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। জাসদ গঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে আরেকটি সংগঠন দলটির সমাবেশ ক্ষমতা প্রদর্শনের বিশেষ হাতিয়ার ছিল, তা হলাে বাস্তুহারা সমিতি। মুক্তিযুদ্ধ-পূর্বে আবুল কালাম আজাদ এই সংগঠনের মূল সংগঠক ছিলেন। যুদ্ধের পর জাসদ গড়ে ওঠবার মুহূর্তে তিনি আওয়ামী সমর্থক হিসেবে থেকে যান এবং বেলায়েত হােসেন ও আবদুল খালেকের নেতৃত্বে বাস্তুহারা সমিতির একাংশ জাসদকে সমর্থন দেয়।
সাংগঠনিক উপরােক্ত ঘটনাবলি এবং তার প্রস্তুতি ও বিকাশে ব্যক্তির ভূমিকাও।জাসদ গঠনকালীন পরিস্থিতি অনুধাবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। যুদ্ধোত্তর সময়ে ছাত্রলীগকে কেন্দ্র করে আবর্তিত মুজিব বাহিনীর প্রধান প্রধান কুশীলবদের ব্যক্তিগত পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কীভাবে স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন এক রাজনৈতিক পর্যায়ের জন্ম দিতে যাচ্ছিল তারও বিবরণ আমরা দেখবাে পরবর্তী অধ্যায়ে। (৪.ক উপ-অধ্যায়েও এইরূপ কিছু বিবরণ রয়েছে।)
Source: মুজিব বাহিনী থেকে গন বাহিনী ইতিহাসের পুনর্পাঠ – আলতাফ পারভেজ