বাহাত্তরের বাংলাদেশ : স্বপ্নের অপহরণ
“আমি ফিরে না এলে তােমরা সিকিম হইয়া যাইতা।’
-শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৩ সালে সাংবাদিক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ ও গিয়াস কামাল চৌধুরীকে ৩২ নম্বর রােডে এক ব্যক্তিগত আলাপচারিতায়।২৬১
১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে আগস্টের মধ্যে আমি পাঁচ বার ঢাকা শহরে ঢুকেছি। মাঝখানে প্রতিটি এলাকায় একই কথা শুনেছি। সকলেরই এক প্রশ্ন, ভারতীয় বাহিনী কবে আসবে? ইন্দিরা গান্ধী কবে সৈন্য পাঠাবে? ইন্দিরা গান্ধী সৈন্য পাঠাচ্ছে না কেন? তিনি কি আমাদের মেরে ফেলতে চান?…অন্যদিকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকায় যে কথাগুলাে প্রথম শুনলাম তার মর্মার্থ হচেছ চরম ভারত বিরােধিতা। কোন কৃতজ্ঞতা নয়, কোন মুক্তিযুদ্ধের গল্প নয় । সর্বত্র শুধু লুটপাটের কাহিনী।
-নির্মল সেন, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক২৬২
১৯৭১-এর ২৫ মার্চের আগে মুজিব এবং তাঁর রাজনৈতিক সহযােগীরা ‘সােনার বাংলা’ নামক দুটি শব্দের স্বপ্নে বিভাের করে তুলেছিলেন পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষদের। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের প্রায় তিন সপ্তাহ পর মুজিব যখন দশ-এগারাে মাসের অনুপস্থিতি শেষে ‘সােনার বাংলায় ফেরেন তখন তার জনপ্রিয়তা ছিল গগনচুম্বি এবং ব্যক্তিত্ব ছিল চ্যালেঞ্জের অযােগ্য। কিন্তু মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে কীভাবে জাসদ ও সর্বহারা পার্টির মতাে নবীন দলগুলাে তার জন্য রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠল তার উত্তর পাওয়া যায় প্রকৃতপক্ষে সেই সময়কার সমাজ জীবনের উদীয়মান লক্ষণগুলােতে। যার কয়েকটি শনাক্ত করা যায় এভাবে :
– দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাচ্ছিল তীব্র বেগে। যুদ্ধের সময় চালের মন ছিল চল্লিশ টাকার নিচে। বাহাত্তরের জানুয়ারিতে তা ৫০ টাকায় দাড়ায়। পরবর্তী দু’মাসে তা ৮০ টাকা হয়। সকল পণ্যের ক্ষেত্রে না হলেও কিছু জরুরি সামগ্রী স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যােগাড় করা দুঃসাধ্য হয়ে উঠছিল। তার মধ্যে একটি ছিল শিশুখাদ্য। ন্যায্যমূল্যে ‘বেবিফুডে’র দাবিতে ঢাকায় একাধিক দিন মিছিল হতেও দেখা যায়। ডিমের হালি ৫০ পয়সা থেকে এক টাকা হয়ে যায়। ফলে সৎ মানুষরা দারুণ দুর্ভোগে পড়ে। অবস্থা সামাল দিতে সরকার দেশীয় উৎপাদিত পণ্য এবং আমদানিকৃত পণ্যের একটি নতুন সরবরাহ
…………………………………………………………
২৬১) উপরােক্ত মন্তব্যের পটভূমি সম্পর্কে দেখুন, রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৮।
২৬২) নির্মল সেন, আমার জবানবন্দী, তরফদার প্রকাশনী, ২০০৬, ঢাকা, পৃ. ৩৮১।
Page 172
ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ‘ডিলারশিপ’ প্রদান শুরু করে। কিন্তু প্রক্রিয়াটি এত বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল যে, এরূপ ২৫ হাজার ডিলারশিপের অর্ধেকের বেশি অব্যবসায়ী আওয়ামী লীগ নেতারাই নিয়ে নেন এবং পরে তা পেশাদার ব্যবসায়ীদের কাছে উচ্চমূল্যে বিক্রি করেন। সামগ্রিক পরিস্থিতিতে সংবাদপত্রগুলাে যে জনমতের প্রকাশ ও জনদুর্ভোগের খবর প্রকাশ করে প্রশাসনকে প্রতিকারে উদ্বুদ্ধ করবে এবং গণতন্ত্রকে প্রাণবন্ত রাখবে তাও ছিল দুঃসাধ্য। স্বাধীনতার আগে নিউজপ্রিন্ট ছিল টনপ্রতি ১ হাজার ১৪০ টাকা, স্বাধীনতার পরপর তা প্রথম দফায় ২ হাজার ১৫০ টাকায় পৌছে। যা ছিল প্রায় ৯০ ভাগ বৃদ্ধি। ১৯৭৪-এর মার্চে, ততদিনে সমাজতন্ত্রের নামে সকল উৎপাদন যন্ত্র সরকারের হাতে চলে গিয়েছিল আরেক দফা বাড়িয়ে নিউজপ্রিন্ট টনপ্রতি ৩ হাজার ২০০ টাকায় উন্নীত করা হয়।২৬৩
যুদ্ধবিধ্বস্ত সমাজে সংকট ছিল অফুরন্ত । অনভিজ্ঞ সরকারের ভুলভ্রান্তি হওয়াও অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু জনগণ ধৈর্য ধরতে ছিল একেবারে নারাজ। বাঙালি চরিত্রের এই ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য সেসময় বস্তুত বিপর্যয় ঢেকে আনে। এক শ্রেণির মানুষের কাছে আওয়ামী লীগের প্রতিটি ভুল খুব বড় আকারে প্রতিভাত হচ্ছিল- তেমনি সরকারও সমালােচকদের প্রতি ছিল অসহিঞ্চু ও নির্মম । বিরুদ্ধমতকে দেশদ্রোহিতাও আখ্যায়িত করা হতাে। অস্ত্রের জোরে অনেক অন্যায় দাবি পূরণ হয়ে যাচ্ছিল। পাবলিক পরীক্ষাগুলােতে বিরাট সংখ্যক শিক্ষার্থী নকলের সুযােগ দাবি করে প্রকাশ্যে এবং আদায় করে নেয়। ঢাকা ও কুমিল্লা বাের্ডে পাসের হার বেড়ে দাঁড়ায় ৯০ শতাংশের উপরে। অনেক স্থানে নকলের দাবিতে সশস্ত্র মিছিল বের হয়। যা মূল্যবােধের অবক্ষয়কে ত্বরান্বিত করে তােলে। ঐ সময় এক বিবৃতিতে মাওলানা ভাসানী তাঁর সাপ্তাহিক হককথার ২৫ ফেব্রুয়ারি (১৯৭২) সংখ্যায় মন্তব্য করেছিলেন, এক শ্রেণীর দুষ্কৃতকারী মুজিব বাহিনী বা মুক্তিবাহিনী পরিচয় দিয়া যেসব সমাজবিরােধী কাজ করছে তাতে আগামী ২৫ বছরেও দেশে শান্তি আনা সম্ভব হবে না।”২৬৪ প্রায় একই ধরনের বক্তব্য পাওয়া যায়
……………………………………………………………..
২৬৩) Mahfuz Ullah, ibid, p. 114.
২৬৪) উল্লেখ্য, দেশে ফিরে আসার পর এরূপ বক্তৃতা-বিবৃতির জন্য মাওলানা ভাসানী দ্রুত সরকারের একাংশের রােষানলে পড়েন। শেখ মণি বাংলার বাণীর কলামে তাঁকে “সিআইএ’র এজেন্ট, মার্কিন দালাল ইত্যাদি অভিধায় অভিহিত করেন। ভাসানী সম্পর্কে মণি’র আক্রমণের তীব্রতা বােঝার জন্য বাংলার বাণীতে নিম্নোক্ত তারিখের কলামগুলাে দেখা যেতে পারে : ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭২, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৭২, ৯ জানুয়ারি ১৯৭৫। এসময় পশ্চিমবঙ্গের গণমাধ্যমেও তাঁকে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি হিসেবে অভিহিত করে ‘বাংলাদেশ-ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী ভাঙার চেষ্টার জন্য দোষারােপ করা হয়। দেখুন, সাপ্তাহিক সপ্তাহ, ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩, কলকাতা। উপরােক্ত সাপ্তাহিকীটি ছিল সেখানকার মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র। সেখানকার আরেক প্রভাবশালী কাগজ দৈনিক আনন্দবাজার-এ ১৯৭৩ সালের ৩১ জুলাই মৌলানাকে নিয়ে তির্যক ভাষায় সম্পাদকীয় লেখা হয় ‘ভাসানীর জেহাদী জিগির’ শিরােনামে। এরূপ প্রচারণা সত্ত্বেও মাওলানা এসময় মুজিবের প্রতি নমনীয় নীতি নিয়েছিলেন বলেই প্রমাণ মেলে। বিশেষ করে তিয়াত্তরের মার্চে নির্বাচনের ঠিক পূর্বমহর্তে ‘নৌকা মার্কার বিপক্ষে ন্যাপ প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারণায় অংশ না নিয়ে ‘বুকজ্বালা, পেটব্যথা ইত্যাদি ধরনের মামুলি সমস্যা নিয়ে তার হাসপাতালে ভর্তি হওয়ায় অনেকেই বিস্মিত হন। এ বিষয়ে তার নির্বাচনী জোটের অন্যতম শরিক রাজনীতিবিদ অলি আহাদ লিখেন, “সেদিন মাওলানার ভূমিকা আওয়ামী প্রার্থীদের পরােক্ষভাবে নির্বাচনে বিজয়ে প্রচুর সহায়তা করেছিল।’ অলি আহাদ, জাতীয় রাজনীতি: ১৯৪৫-৭৫, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সােসাইটি লি., ২০০৪, ঢাকা, পৃ. ৫৫৪।
Page 173
সে সময়কার গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান রক্ষীবাহিনীতে মুজিব কর্তৃক নিয়ােগপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক সারােয়ার হােসেন মােল্লার নিমােক্ত পর্যবেক্ষণে :
সে সময় সারা দেশে প্রায় ৭০টি থানা লুট হয়েছিল। মা-বােনেরা ইজ্জত সহকারে রাস্তায় চলাফেরা করতে পারতেন না।… মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাতাে। বেআইনি অস্ত্র ছিল ঘরে ঘরে।২৬৫
– দ্রব্যমূল্য বাড়লেও চারদিকে ভারতীয় পণ্যের অবাধ উপস্থিতি দেখা যায়। প্রথম দিকে দুই দেশ এক চুক্তির মাধ্যমে সীমান্তের ১৬ কিলােমিটারের মধ্যে বাণিজ্য উন্মুক্ত করে দিলে চোরাচালান ব্যাপকতা পায়। ১৯৭২ সালের ২৮ মার্চ চুক্তিটি হয়। বাংলাদেশের পক্ষে বাণিজ্যমন্ত্রী এম আর সিদ্দিকী এবং ভারতের পক্ষে বৈদেশিক বাণিজ্যমন্ত্রী এল এন মিশ্র এই চুক্তি করেন। চুক্তির আওতায় সীমান্তের ১৬ কিলােমিটারের মধ্যে বসবাসকারী নির্বাচিত কিছু মানুষকে এক ধরনের পারমিট দেওয়া হয় যার ভিত্তিতে তারা অবাধে মালামাল আনা নেয়ার অধিকার পায়। অদ্ভুত এই উদ্যোগ বাস্তবে চোরাচালানকে সর্বগ্রাসী রূপ দেয়। প্রাথমিকভাবে এক বছরের জন্য চুক্তিটি হলেও বাংলাদেশে তীব্র বিতর্ক ও ক্ষোভ তৈরি হওয়ায় ১৯৭২ সালের ৫ থেকে ৮ অক্টোবর ঢাকায় এ বিষয়ে এক পর্যালােচনা বৈঠক হয় এবং তারপর উভয় দেশের সরকার চুক্তিটি স্থগিত রাখার ঘােষণা দেয়। তবে এরপরও চোরাচালান ছিল অবাধ। এই চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য আবদুল মােহাইমেন লিখেছেন, ৭১ সালে অনুকূল আবহাওয়ার ফলে মুক্তিযুদ্ধ চলা সত্ত্বেও দেশে প্রচুর ধান হয়েছিল। তখন দেশে চালের দাম ছিল ৩৫-৪০ টাকা মণ। উন্মুক্ত সীমান্ত বাণিজ্যের ফলে লাখ লাখ মণ ধান ভারতে চলে যাওয়ায় স্বাধীনতার ছয়
………………………………………………………………
২৬৫) সারােয়ার হােসেন মােল্লা, কর্নেল সারােয়ার বলছি, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৩ নভেম্বর ২০১২,
ঢাকা ।
Page 174
মাসের মধ্যে চালের মণ এক শত টাকায় উঠে। ফলে মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।২৬৬
অন্যদিকে স্বাধীনতার আগে ভারতের মুদ্রার সঙ্গে পাকিস্তানের মুদ্রার বিনিময় মূল্য প্রায় সমান থাকলেও ১৬ ডিসেম্বরের পর বাংলাদেশের মুদ্রার মান কমতে থাকে। মাস ছয় পরে এটা ভারতীয় মুদ্রার তুলনায় প্রায় অর্ধেক হয়ে যায়। যুদ্ধের পর এটা কেন কম হবে তার কোনাে যৌক্তিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। দেশের বাজারে ভারতীয় পণ্য কিনতে গেলে অন্তত ৩০-৪০ শতাংশ বেশি বাংলাদেশি মুদ্রা দিতে হচ্ছিল তখন। অনেক ক্ষেত্রে বাস্তব বিনিময় হার ভারতীয়দের পক্ষে আরও বেশি অনুকূল ছিল। ফলে কিছু দিন আগেও যারা পাঞ্জাবি বিদ্বেষে ভুগতেন তারা এবার ভারত বিদ্বেষে ভুগতে শুরু করেন।২৬৭ বিষয়টি আরও গভীরতা পায় বাংলাদেশের প্রথম কিস্তির ৩৫০ কোটি টাকার কারেন্সি নােট মুদ্রণের দায়িত্ব ভারতকে প্রদানের মধ্য দিয়ে। পত্রিকায় এসময় একই নম্বরের একাধিক নােটের ছবি প্রকাশিত হয়। গুজব ছড়িয়ে পড়ে ভারত অধিক নােট ছাপিয়ে বাজারে ছেড়েছে। ফলে টাকার দাম আরও পড়ে যায় এবং জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকে।২৬৮ এ থেকে আবার এক ধরনের অযৌক্তিক সাম্প্রদায়িকতারও উন্মেষ ঘটতে শুরু করে। সাম্প্রদায়িকতার চর্চা বন্ধে সরকার ধর্মভিত্তিক কয়েকটি দলকে নিষিদ্ধ করেই দায়িত্ব শেষ করে। কিন্তু ঐ সব দলের সদস্যরা নানা রূপে সমাজে তাদের আদর্শকে সজিব ও সক্রিয় রাখতে পেরেছিলেন। যে কোনাে মূল্যে মুক্তিযােদ্ধাদের হেয় করারও একটি প্রবণতা তৈরি হয় এদের মাধ্যমে ।
শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনকে ঘিরেও এক ধরনের সাম্প্রদায়িকতা তৈরি হয়। যুদ্ধ শেষ হওয়া মাত্র ভারত এদের ফেরত পাঠানাের ব্যাপারে সর্বোচ্চ তৎপর হয়ে ওঠে। শরণার্থীদের মাঝে হিন্দুদের সংখ্যাই ছিল বেশি; কারণ গিয়েছিলও তারা বেশি। তবে কোথাও কোথাও একাত্তরের আগের দেশান্তরিরাও ফিরছিলেন। এক্ষেত্রে বাস্তব সংখ্যার চেয়ে গুজব তৈরি হচ্ছিল অধিক হারে। এসব হিন্দুরা এসে তাদের বিক্রিত বা পরিত্যক্ত বা দখল হয়ে যাওয়া সম্পত্তি ফেরত চাইবে এ ভয় মুসলমান সমাজে তীব্রতা পায়; যার
…………………………………………………………..
২৬৬) মাে. আবদুল মােহাইমেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ, প্রকাশক: লেখক নিজে, ১৯৮৭, ঢাকা, পৃ. ২৩।
২৬৭) এর একটি অশােভন প্রকাশ দেখা যায় বেসামরিক ভারতীয় প্রশাসক- যারা ঐসময় নীতিনির্ধারক পর্যায়ে সমঝােতার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করতে এসেছিলেন, তাঁদের প্রতি স্থানীয়দের আচরণে। এ সম্পর্কে আরও দেখুন : ১৯৪ নং ফুটনােট।
২৬৮) মাে. আবদুল মােহাইমেন, পূর্বোক্ত, পৃ. ২০।
Page 175
ছাপ পড়ে গণমাধ্যমেও এবং রাজনৈতিক মেরুকরণেও তা ভূমিকা রাখে। এ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে তৃণমূলে একধরনের হিন্দু বৈরিতা দেখা দেয়। এক পর্যায়ে অবস্থা এমন দাঁড়াল, খােদ মুজিবকে বিবৃতি দিয়ে বলতে হয়, বাংলাদেশ কেবল একাত্তরে যাওয়া হিন্দুদের গ্রহণ ও পুনর্বাসন করবে।২৬৯ তবে মুজিবের এই হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও সমাজে হিন্দু বৈরিতা নীরবে পাখা মেলছিল। প্রমাণ হিসেবে দেখা যায়, যুদ্ধোত্তর প্রথম দুর্গা-উৎসবে (১৪-১৭ অক্টোবর) দ্বিতীয় দিনেই প্রতিমা ভাঙ্গচুর হয় খােদ ঢাকায়, যা কখনাে অবিভক্ত পাকিস্তানকালেও ঘটেনি।
রাষ্ট্রীয়ভাবে ১৫ লাখ টাকার অধিক মূল্যের শিল্প-সম্পত্তিগুলাে জাতীয়করণের ফলে ব্যক্তি উদ্যোগ চরমভাবে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ে। ফলে ধারণা তৈরি হয়, ভবিষ্যতে এখানে ভারতীয় পণ্যের একচেটিয়া কারবার শুরু হবে। যা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদেরও চরমভাবে নিরুৎসাহিত করে। ভারত বিদ্বেষকে এটা আরও বেগবান করে এবং অন্ধকার করে তােলে শিল্প- অর্থনীতির ভবিষ্যৎ। টাকার মান কমানাে, সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেওয়া এবং অভ্যন্তরীণ বেসরকারি বিনিয়ােগ নিরুৎসাহিত করার মাধ্যমে (যার উর্ধ্বসীমা করা হয় ২৫ লাখ টাকা) এ সময় পরিকল্পিতভাবে ভারত নির্ভরতার একটি প্রবণতা দেখা যায়।২৭০
……………………………………………………………
২৬৯) কার্তিক ঠাকুর, সংবিধান ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, প্রকাশকাল ও প্রকাশ তারিখ উল্লেখ নেই, পৃ. ৫-৬। কার্তিক ঠাকুর বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলে হিন্দু সম্প্রদায়ের অতি পরিচিত নেতা।
২৭০) যদিও মুজিব বলছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ হবে এশিয়ার সুইজারল্যান্ড’-এর মতাে (নিরপেক্ষ
চরিত্রের), কিন্তু তাঁর শাসনামলজুড়ে ‘নির্ভরতা’ প্রবণতার নানান মাত্রা লক্ষ্য করা যায়। ব্যাপক অর্থে এই প্রবণতা ছিল চতুর্মাত্রিক। প্রথমত, আর্থিক ও শিল্পনির্ভরতার চেষ্টা; যার বড় এক প্রকাশ ছিল পাটখাতসংশ্লিষ্ট নীতি-কৌশলে। এ বিষয়ে ৬.গ উপ-অধ্যায়ে বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া অর্থনীতিতে দেশীয় বিনিয়ােগ নিরুৎসাহিত করে নির্ভরতাকে কীভাবে প্রাতিষ্ঠানিকতা দেয়ার চেষ্টা ছিল তার একটি চমৎকার অভিজ্ঞতা দেখুন ১৮৬ নং ফুটনােটে ।
দ্বিতীয়ত, সামরিকনির্ভরতা; যার বড় প্রকাশ ছিল রক্ষীবাহিনী গড়ে তােলার ক্ষেত্রে ভারতীয় সংশ্লিষ্টতায়। এ বিষয়ে পরবর্তী উপ-অধ্যায়গুলােতে বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে। তৃতীয়ত, প্রশাসনিকনির্ভরতা; এই প্রবণতার প্রকাশ ঘটে দু’ভাবে; এক, স্বাধীনতার পরও বেশ কয়েক সপ্তাহ দেশের দায়িত্ব গ্রহণে প্রবাসী সরকারের বিলম্ব এবং এসময় বেসামরিক প্রশাসন পরিচালনায় ভারতীয় কর্মকর্তাদের নিয়ে আসার মধ্য দিয়ে [ভারতীয় সরকারি দলিলপত্রের সহায়তায় Salam Azad লিখিত Contribution of India in the war of liberation of Bangladesh (২০০৩) শীর্ষক গ্রন্থের তথ্য অনুযায়ী, ঐসময় অন্তত ২৮ জন ভারতীয় কর্মকর্তা বাংলাদেশের সিভিল প্রশাসনে দায়িত্ব পালনের জন্য এসেছিলেন। দেখুন, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৯০] এবং পরে মুজিব বাহিনীর যােদ্ধাদের অন্তত দুটি ব্যাচে প্রশ্নসাপেক্ষ প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের ক্যাডার পদগুলােতে নিয়ােগ দেয়ার মধ্য দিয়ে । চতুর্থত. ভাবাদর্শিকনির্ভরতা; যার প্রধান এক প্রকাশ হিসেবে দেখা যায় সংবিধান প্রণয়ন ও চূড়ান্তকরণের পূর্বে ড. কামাল হােসেন-এর ভারত গমন (যাকে ‘হককথায় ভাসানী বলেছিলেন সংবিধানের ভারত যাত্রা; তবে কামাল হােসেন কেবল ভারত নয় গিয়েছিলেন যুক্তরাজ্যেও; দেখুন, মুক্তিযুদ্ধে জনআকাঙ্ক্ষা এবং গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রতিষ্ঠার লড়াই, গণসংহতি, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ২৮)! ভাবাদর্শিকনির্ভরতার আরেক প্রকট ক্ষেত্র ছিল। দমনমূলক চরিত্রের প্রতিষ্ঠান ও আইন প্রণয়নকালে ভারতকে অনুসরণ। এ বিষয়ে রক্ষীবাহিনী গড়ে তােলার ক্ষেত্রে ভারতীয় সিআরপিএফকে মডেল হিসেবে অনুসরণ ও ভারতীয় Armed Forces (Special Powers) Act-কে বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশে বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রণয়ন-এর উল্লেখ করা যায়।
একাত্তর-উত্তর সমাজের অন্যতম আলােচিত লেখক এনায়েতুল্লা খান প্রমুখ ১৯৭৪-এ উপরােক্ত নির্ভরতাতত্ত্ব নিয়ে দীর্ঘ আলােচনা করলেও (দেখুন, Enayetullah Khan, ibid, p.300-319.) তার উৎস হিসেবে কলকাতাকেন্দ্রিক প্রবাসী সরকারকেই দায়ী করেছেন। এ বিষয়ে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের গ্রন্থেও (পূর্বোক্ত, পৃ. ১৮১) এমন উদাহরণ পাওয়া যায়- যা থেকে প্রমাণ মেলে, তাজউদ্দীন পরিপূর্ণভাবে ভারতের কর্তৃত্ব মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু রক্ষীবাহিনী বিকাশকেন্দ্রিক অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, মুজিবও এরূপ পদক্ষেপগুলাের স্বপক্ষে ছিলেন দৃঢ়। তবে তিনি আবার ক্ষেত্রবিশেষে বিপরীতমুখী ও স্ব-বিরােধী পদক্ষেপও নিয়েছেন। যার ফল হয়েছে তার জন্য বিধ্বংসী।
Page 176
শিল্প পরিমণ্ডলে জাতীয়করণের নামে ‘সমাজতন্ত্র’-এর ধ্বনি উঠলেও গ্রামে সামঞ্জস্যপূর্ণ কোনাে কর্মসূচি ছিল অনুপস্থিত। সত্তরের নির্বাচনে মুজিব ও আওয়ামী লীগের পক্ষে ‘গণরায়’-এর বড় এক শক্তি ছিল গ্রামীণ খুদে চাষী সমাজ। মুক্তিযুদ্ধকালে যারা কল্পনা করেছিল স্বাধীনতা জমির পুনর্বণ্টন ও কৃষিজাত ফসলের মালিকানার কিছুটা হলেও সামাজিকীকরণ বা পুনর্বিন্যাস ঘটাবে। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর সমাজে সরকার সিদ্ধান্ত দেয়, পরিবারগুলাে একশত বিঘা পর্যন্ত জমি দখলে রাখতে পারবে। উপরন্তু এই ঘােষণায় ‘পরিবার’-এর সংজ্ঞাও নির্ধারিত ছিল না। ফলে ধনী জোতদাররা নানান কৌশলে সকল জমিই রক্ষা করতে পারল ।২৭১ এতে ক্ষুদ্র ও ভূমিহীন চাষী সমাজ বুঝল, ‘পরিবর্তন’-এর কোনাে সম্ভাবনা নেই। তারা তখন নকশাল
…………………………………………………………….
২৭১) ১৯৭২-এর ২৬ মার্চ মুজিব ঘােষণা দিয়েছিলেন, পরিবারগুলাে ১০০ বিঘা জমি রাখার পাশাপাশি যাদের ২৫ বিঘার কম জমি থাকবে তারা খাজনা রেয়াত পাবে। তৎকালীন পরিকল্পনা কমিশন একে সমাজতন্ত্র অভিমুখীন ভূমি সংস্কার কর্মসূচি হিসেবে চিহ্নিত করলেও তার ফলাফল ছিল শূন্যগর্ভ ! কারণ যদি কর্মসূচিটি বাস্তবায়িতও হতাে তাহলে সর্বোচ্চ দু লাখ একরের মতাে জমি উদ্ধার হতাে এবং তা যদি সে সময়কার ৩২ লাখ ভূমিহীনের মাঝে বণ্টিত হতাে তাহলে প্রতি পরিবারের বরাদ্দ দাঁড়াত ০.০৭ একর। আর্থিক বিবেচনায় এরূপ জমি প্রাপ্তির তাৎপর্য হতাে অতি নগণ্য। উপরন্তু বলা হচ্ছিল, এরূপ উদ্বৃত্ত জমি দিয়ে সমবায়ের মাধ্যমে চাষাবাদ করা হবে। দেশজুড়ে বিচ্ছিন্ন আকারে উদ্ধার করা ছােট ছােট জমি খণ্ডগুলাে কীভাবে সমবায়ের মাধ্যমে আবাদ করা যাবে এমন কোনাে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা মুজিবের ঘােষণায় যেমন ছিল না। তেমনি পরিকল্পনা কমিশনও তা কখনাে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেনি। এ সম্পর্কিত আলােচনার জন্য দেখুন, S. M. Ali,
ibid, p.133-134.
Page 177
ধারার রাজনৈতিক শক্তিসমূহের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে শুরু করল, যারা বিভিন্ন অঞ্চলে জোতদারদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ বলপ্রয়ােগের কর্মসূচির স্বপক্ষে একটা জাগরণের প্রচেষ্টায় ছিল।
– ঠিক উপরােক্ত সময়েই চারিদিকে চলছিল লুণ্ঠন, ডাকাতি, চোরাকারবারি, ছিনতাই, কালােবাজারি, মজুদদারি। আবার এমনি এক অবস্থায় সরকারি তরফ থেকে ডাক দেওয়া হচ্ছিলাে কৃচ্ছতাসাধনের, যার আওতায় সরকারি- বেসরকারি কর্মচারিদের বেতনের ৩০ ভাগ কেটে নেয়া শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরাও এ থেকে বাদ যাননি। কিন্তু চারদিকের লুণ্ঠন প্রক্রিয়ায় এবং ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্যের মাঝে সরকারের এই উদ্যোগ শুধুই ক্ষোভ বাড়াচ্ছিল। সমাজ দেহের এইরূপ নতুন পরিস্থিতি সম্পর্কে সেসময় মেহেরপুরের গাংনীতে গবেষণারত দু’জন বিদেশি গবেষক তাদের পর্যবেক্ষণ লিখেছেন এভাবে : “সেই সময়ে শােষণের প্রধান রূপ ছিল ব্যবসা ও দুর্নীতি (যেমন ফটকাবাজি, মজুতদারি, চোরাচালানী, ঘুষ ইত্যাদি); উৎপাদনের ক্ষেত্রে শােষণের রূপ সে সময় ততটা প্রকট ছিল না।২৭২ নতুন এই শােষকরা সরকারের আশীর্বাদ পাচ্ছিল দেখে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠের সঙ্গে শাসকদের বিচ্ছিন্নতা তৈরি হতে শুরু করে।
– ডাকাতি, ছিনতাই ইত্যাদির কারণে সমাজে এক ধরনের ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়। বিশেষ করে রাজনীতিমনষ্ক অনেক তরুণ গ্রেফতার হয়েই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্তৃত্ব ছিল ন্যুনতম । সাংবাদিক নির্মল সেনের ভাষ্য থেকে দেখা যায়, স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম বছরই দেশে ৪ হাজার ২০০ ডাকাতি ঘটে। যার মধ্যে কেবল ঢাকাতে ৬৮৬টি ডাকাতি সংঘটিত হয়।২৭৩ তবে দৈনিক গণকণ্ঠের হিসাবে দেখা যায়, উল্লিখিত এক
………………………………………………………………
২৭২) ইয়েনেকা আরেন্স ও ইরস ফান ব্যুরদেন, ঝগড়াপুর, অনুবাদ : নিলুফার মতিন, গণপ্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯৮, পৃ. ২০৯।
২৭৩) নির্মল সেন, স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই, তরফদার প্রকাশনী, ২০০৯, ঢাকা, পূ, ৬৬। সাংবাদিক-রাজনৈতিক নির্মল সেন এই লেখা লিখেছিলেন ১৯৭২-এ দৈনিক বাংলায়। ঐ পত্রিকায় ‘অনিকেত’ নামে নিয়মিত উপসম্পাদকীয় লিখতেন তিনি। ১৯৭৩-এর ১৬ মার্চ লেখা তাঁর একটি উপ-সম্পাদকীয়ের শিরােনাম ছিল স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই।’ সমকালীন বাস্তবতা ফুটে ওঠার কারণে সর্বত্র সেসময় এই কলামটি আলােড়ন তুলেছিল। ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশােধনী পাসের পর অনিকেতের কলামটি বন্ধ হয়ে যায়। সে বিষয়ে পরে তিনি জানিয়েছেন, ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে অনিকেত নামে আমার উপ-সম্পাদকীয় লেখা বন্ধ করে দেয়া হয়। জাতীয় সংসদে তখন সংবিধানের চতুর্থ সংশােধনী আলােচিত হচ্ছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে ডেকে পাঠালেন এবং জানিয়ে দেন, দৈনিক বাংলায় ‘অনিকেত’ নামে আমার কোনাে উপ- সম্পাদকীয় আর প্রকাশিত হবে না। সে বিতর্ক দীর্ঘ। এর পর তার জীবিতকালে ঐ নামে কোনাে উপ-সম্পাদকীয় দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত হয়নি।’ পূর্বোক্ত, পৃ. ৮।
Page 178
বছরে ব্যাংক ডাকাতি হয়েছে ৩১টি, গুপ্তহত্যা ১ হাজার ৪৬৭টি, ডাকাতি ২ হাজার ৩৯টি এবং ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে ১৭ হাজার ৩৪১টি।২৭৪ বস্তুত এসময় দিনে রাতে অনেক সময়ই গুলি বােমা ইত্যাদির শব্দ শােনা যেত। যারা এসব করছিল তারা ছিল সশস্ত্র । আবার সশস্ত্র ব্যক্তি মাত্রই চিহ্নিত হচ্ছিল মুক্তিযােদ্ধা হিসেবে। যে কারণে সকল ধরনের অন্যায়ের জন্য দোষ পড়ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের গায়ে। এ নিয়ে প্রকৃত মুক্তিযােদ্ধাদের মাঝেও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। অথচ স্বাধীনতা যুদ্ধকালে প্রকৃত মুক্তিযােদ্ধার সংখ্যা এক থেকে দেড় লাখের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।২৭৫ সরকার অবাঞ্ছিত কাজ যেমন বন্ধ করতে পারছিল না, তেমনি অপবাদের হাত থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের রক্ষা করতেও ব্যর্থ হয়। মুক্তিযােদ্ধারা অধিকাংশ ছিল তরুণ। নিজেদের পেশাগত ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকের মাঝে উদ্বেগ তৈরি হয়। কারণ সরকারের তরফ থেকে এই সশস্ত্র জনশক্তির জন্য যথাযথ কোনাে পুনর্বাসন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছিল না। আবার পুলিশকে ব্যবহার করে ডাকাতি, সন্ত্রাস ইত্যাদি দমনেরও সুযােগ ছিল সীমিত। কারণ একদিকে পুলিশের সংখ্যা ছিল অতি অল্প (১৯৭২-৭৩-এ মাত্র ২২-২৩ হাজার) এবং অন্যদিকে দুষ্কৃতকারীদের ব্যবহৃত অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ ছিল পুলিশের চেয়ে উন্নত। উপরন্তু কোথাও ধরা পড়া মাত্রই প্রথমােক্তরা রাজনৈতিক যােগাযােগ কাজে লাগিয়ে ছাড়া পেয়ে যেত।
রাজনৈতিক পরিমণ্ডল থেকে আলাপ-আলােচনার সংস্কৃতি একেবারে অবলুপ্ত হয়ে যায়। রাজধানী থেকে গ্রাম পর্যন্ত সর্বত্র রাজনৈতিক মতপার্থক্য খুনােখুনির মাধ্যমে ফয়সালার রেওয়াজ শুরু হয়। কেউই বিশ্বাস করতে পারত না এবং চর্চা করতেও ছিল অনিচ্ছক ছিল যে, রাজনৈতিক বিবাদ সংলাপ, বিতর্ক ও রাজনৈতিকভাবেই মীমাংসাযােগ্য।
পাকিস্তান ও ভারত প্রত্যাগতদের পুনর্বাসনে যথাযথ কোন উদ্যোগ ছিল না। ভারত প্রত্যাগতদের পরিবার প্রতি ১০০ টাকা বরাদ্দ করা হয়। পরে কমতে কমতে তা ২৫ টাকায় নেমে আসে। পাকিস্তান প্রত্যাগতদের জন্য তাও মেলেনি। অন্যদিকে সরকার প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর ব্যাপকভিত্তিক রিলিফের উদ্যোগ নিলেও পুরাে প্রক্রিয়াটি ছিল আওয়ামী লীগ নির্ভর এবং দুর্নীতির
…………………………………………………………
২৭৪) দৈনিক গণকণ্ঠ, ২৯ জানুয়ারি ১৯৭৩, ঢাকা ।
২৭৫) এ বিষয়ে অরাজক অবস্থার স্বরূপ উঠে এসেছে সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে; যেখানে দেখা যায়, দেশে এখন (২০১২ সালে স্বীকৃত মুক্তিযােদ্ধার সংখ্যা ২ লাখ ৪ হাজার ৮০০। ১৯৯৪ সালে বিএনপি’র শাসনামলে মুক্তিযােদ্ধা সংসদের ভােটার তালিকায় তালিকাভুক্ত ছিলেন ৮৬ হাজার জন। অর্থাৎ সরকার পরিবর্তন হলেই মুক্তিযােদ্ধার সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে এবং এখনও মুক্তিযােদ্ধা হিসেবে নাম তালিকাভুক্তির জন্য এক লাখ ৪০ হাজার জনের আবেদন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। দেখুন, প্রথম আলো, ১৫ ডিসেম্বর ২০১২, ঢাকা।
Page 179
কারণে উদ্যোগটি ব্যর্থ হয়। এর মধ্য দিয়ে সর্বত্র দুর্নামের শিকার হয় আওয়ামী লীগ।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলােতে গুটিকয়েক সন্ত্রাসী ছাত্র ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে । সংখ্যায় তারা অত্যাল্প থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের বশংবদ হয়ে পড়ে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভয়-ভীতির সংস্কৃতি এতটা শেকড় গাঢ়তে শুরু করে যে, পরবর্তীকালে শেখ মুজিবুর রহমান যখন দেশের সকল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত করে একটি জাতীয় দল’ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং সবাইকে তার সদস্য হতে পরােক্ষে চাপ প্রয়ােগ শুরু হয়। তখন দেখা গেল, গণতান্ত্রিক আবহের জন্য বিখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র পনেরােজন শিক্ষক ঐ একক দলে যােগ দিতে অপারগতার কথা সাহস করে জানিয়েছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবুল ফজল ব্যতীত আর সকল উপাচার্যই তাদের কর্মচারী ও শিক্ষকদের জাতীয় দলে যােগ দেওয়ার জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছিলেন।২৭৬ তিনজন উপাচার্য উল্লিখিত দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতেও অন্তর্ভুক্ত হন। এরা হলেন ড. আবদুল মতিন চৌধুরী (ঢাকা
বিশ্ব.), ড. মাযহারুল ইসলাম (রাজশাহী বিশ্ব.) এবং ড. মােহাম্মদ এনামুল হক (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ব.)। এভাবে পঁচাত্তরে এসে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ ‘সরাসরি মেঠো রাজনীতির অংশীদার হয়ে পড়ে যা কার্যত শিক্ষার পরিবেশকে দারুণভাবে কলুষিত করে; যে সাংস্কৃতিক অবক্ষয় থেকে বাংলাদেশ আর কখনাে বেরিয়ে আসতে পারেনি। উপাচার্যদের যে মেয়াদ শেষের আগেই অপমানজনকভাবে দায়িত্ব ছেড়ে চলে যেতে হয় সাম্প্রতিক
…………………………………………………………………
২৭৬) আহমদ ছফা, মুজিব শাসন: একজনের লেখকের অনুভব’, নির্বাচিত রাজনৈতিক প্রবন্ধ গ্রন্থে সংকলিত, খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি, ২০১১, ঢাকা, পৃ. ৫১৭। উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষকরা সেসময় বাকশালে যােগ দেননি তাদের মধ্যে ছিলেন আহমদ শরীফ, মমতাজুর রহমান তরফদার, আবদুল লতিফ, হােসনে আরা হক, লতিফা আকন্দ, নূরুল ইসলাম, আহমেদ কামাল, স্বপন আদনান, মুনতাসীর মামুন প্রমুখ। উল্লিখিত শিক্ষকদের অন্তত একজন বর্তমান লেখককে জানিয়েছেন, যদিও তারা স্ববিবেচনাবােধ থেকেই ‘একক দল’-এ যােগ দেননি, তবে সেই সময়কার প্রভাবশালী পণ্ডিত প্রফেসর আবদুর রাজ্জাকও গােপনে তাদের অনুপ্রাণিত করেছিলেন এই দলে যােগ না দিতে। প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক ও এই শিক্ষকদের মাঝে যােগাযােগের অন্যতম মাধ্যম ছিলেন লেখক আহমদ ছফা। অন্যদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবুল ফজলের সঙ্গে মুজিবের কথােপকথনের বিবরণী থেকে দেখা যায়, বাকশালে যােগদান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল না। তবে পরােক্ষ চাপ ছিল। ১৯৭৫ সালের ২৮ জুন শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ শেষে আবুল ফজল ডায়েরিতে লিখেছেন :
‘..আশ্বস্ত হলাম তিনি মুজিব যখন বল্লেন আপনাকে আমি বাকশালে যােগ দিতে বলবাে না। তবে আপনার কোন শিক্ষক যদি যােগ দিতে চান তাঁকে আপনি বাধা দেবেন না।’ দেখুন : আবুল ফজল, শেখ মুজিব : তাঁকে যেমন দেখেছি, আগামী প্রকাশনী, ১৯৭৮, ঢাকা, পৃ. ৩১।
Page 180
এই সংস্কৃতিরও শুরু বাহাত্তর-তিহাত্তর থেকে। চারটি প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম দফায় নিয়ােগপ্রাপ্ত উপাচার্যদের (ড, মজাফফর আহমদ চৌধুরী, সৈয়দ আলী আহসান, ড. ইন্নাস আলী প্রমুখ) অধিকাংশ স্বাভাবিকভাবে নিয়ােগকাল শেষ করতে পারেননি। মূলত সরকার দলীয় ছাত্রদের চাপের মুখে এদের অপসারণ করা হয়।
সর্বশেষ যে রাষ্ট্রীয় প্রবণতাটি সমাজের বন্ধনকে দুর্বল করে দেয় তা হলাে। জনসমাজকে তিনভাবে চিহ্নিত করা শুরু হয় এসময়- মুক্তিযুদ্ধকালে যারা সীমান্ত অতিক্রম করেছেন, যারা পূর্ববাংলা বা নিজ আবাসস্থলে ছিলেন এবং যাঁরা পশ্চিম পাকিস্তানে ছিলেন। এর মাঝে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন বা না নেন। ‘সীমান্ত অতিক্রমকারী’ মাত্র প্রশাসনে বিশেষ মর্যাদা ও সুবিধা পাচ্ছিলেন। মেধা বা যােগ্যতার পরিবর্তে সীমান্ত ফেরােনাে’কে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পদোন্নতির একমাত্র মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করার দাবি ওঠে এবং সেটাই করা হচ্ছিল।২৭৭ প্রশাসনে এসময় প্রভাবশালী কর্মকর্তা হয়ে উঠেছিলেন সৈয়দ হােসেন। তাঁর অনানুষ্ঠানিক অবস্থান ছিল যুদ্ধকালে কলকাতায় অবস্থানকারী কিংবা ঢাকায় অবস্থানকালীন সকল ধরনের কর্মকর্তার ওপরে, যদিও তিনি ছিলেন একজন যুগ্ম-সচিব মাত্র। পারিবারিক পরিচয়ে তিনি ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মীয়। সৈয়দ হােসেন নিজে প্রভাব বিস্তারে ব্রতী ছিলেন – বরং অন্যরাই বদলি, ভালাে পদে নিয়ােগ ইত্যাদি বিষয়ে তার কাছে ছুটতে শুরু করে। অন্যদিকে স্থানীয় প্রশাসকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকলেও এবং নানানভাবে মুক্তিযােদ্ধাদের সহযােগিতা করলেও দেশে অবস্থান করার কারণে মনস্তাত্ত্বিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করা হচ্ছিল তাঁদের; দেখা হচ্ছিল সন্দেহ ও অবিশ্বাসের চোখে- যদিও সংখ্যায় ছিলেন এরাই সর্বাধিক। আর তৃতীয় দল পশ্চিম পাকিস্তানে থাকার কারণে রীতিমতাে সামাজিক রােষে পড়েন, অথচ এরা পরিস্থিতির শিকার হয়েই যুদ্ধকালে ভৌগােলিকভাবে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করছিলেন এবং সর্বোতভাবে যুদ্ধে স্বজাতীয় মুক্তিযােদ্ধাদের সাফল্য কামনা করেছেন। যুদ্ধোত্তর সমাজে এইরূপ সচেতন বিভক্তি শেষােক্ত দুই বর্গকে একটি শিবিরে ঠেলে দেয় এবং প্রথম বর্গের বিপক্ষে মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক অবস্থান নিতে থাকে তারা। এভাবেই জন্ম হয় একটি জাতীয় বিভেদ রেখার। ২৭৮
………………………………………………………..
২৭৭) এরূপ মানদণ্ড এমন এক হাস্যকর অবস্থার জন্ম দেয়- যাতে দেখা যায়, সীমান্ত ফেরােনাে এক কোটি মানুষকে বাদ দিলে দেশে জনসংখ্যার হিসাবে তথাকথিত ‘দালাল’-এর সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে প্রায় সাড়ে ছয় কোটি! উপরােক্ত পরিস্থিতিকে ব্যঙ্গ করেই সেসময় সাংবাদিক এনায়েতুল্লা খান সাপ্তাহিক হলিডেতে নিবন্ধ লিখেন [February 6, 1972] Sixty-Five Million Collaborators.’ সেসময় এই লেখাটি বিশেষ আলােড়ন তুলেছিল।
২৭৮) এই বিষয়ে সমাজতাত্ত্বিক এক পর্যবেক্ষণ পাওয়া যায় সেই সময়কার সচিব আসাফোদ্দৌলার নিম্নোক্ত বিবরণে:
As soon as liberation was achived, the claim for victory which belongs to the people was denied to them. It was monopolized by a particular political party. Those who stayed within and suffered much more than whose who had run away, were given guilt trips by those who had crossed the border and demaned to be addressed as the liberators. They put price tags on them. Some occupied abandoned houses, some got jobs for which they were not qualified. Some took promotions and some professed seniority. This was the most tragic divide of the Bangladesh psyche….cracked our national solidarity. Asafuddowlah, Of Pains and Panics, Adorn Publications, 2010, Dhaka, p.311.
উল্লেখ্য, ৩৪ বছরের প্রশাসক জীবন শেষে আসাফোদ্দৌলা বর্তমানে অবসর জীবন যাপন করছেন।
যুদ্ধোত্তর উক্তরূপ পরিস্থিতির আরেকটি দৃষ্টান্তমূলক বিবরণ দিয়েছেন সৈয়দ আলী আহসান। সেই বিবরণ থেকে দেখা যায়, যুদ্ধোত্তর সময়ে দেশে কলকাতাগামীদের ‘দেশপ্রেমিক ও কলকাতায় না যাওয়াদের ‘দেশদ্রোহী’ হিসেবে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে শেখ মুজিবুর রহমানের তেমন উৎসাহ দেখা যায়নি যেমনটি ছিল প্রবাসী সরকারের নেতৃবৃন্দের। আলী আহসান আওয়ামী লীগের দুই পরিষদ সদস্যের কাহিনী তুলে ধরেছেন (আবদুল হাদী তালুকদার ও জহির উদ্দীন)- যারা দেশে অবস্থানের কারণে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযােগ ছাড়াই নিগ্রহের শিকার হন। দেখুন, আলী আহসান, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪০-৪৩।
Page 181
আর উপরােক্ত সম্মিলিত বাস্তবতারই এক ধরনের সামাজিক প্রতিক্রিয়া থেকে সৃষ্টি হয় সােনার বাংলায় বাহাত্তর-তিয়াত্তরের রাজনৈতিক হতাশা এবং ক্ষোভ। দেশে ফিরে মাত্র কয়েক মাস পরেই মুজিব বিস্ময়ের সঙ্গে কেবল এটাই আবিষ্কার করেননি যে, চল্লিশ-অনুর্ধ্ব একদল তরুণের ঔদ্ধত্যের মুখােমুখি হতে হচ্ছে তাকে সশস্ত্র-নিরস্ত্র সকল পরিসরে, বরং তিনি এও দেখতে পান, তাঁর পরিমণ্ডল থেকেই ঐ ঔদ্ধত্যে প্রতিনিয়ত জ্বালানি যােগানাে হচ্ছে। এ যেন ছিল একাত্তর-পূর্ব তাঁর স্ববিরােধী রাজনীতিরই এক ঐতিহাসিক প্রতিশােধ।
Source: মুজিব বাহিনী থেকে গন বাহিনী ইতিহাসের পুনর্পাঠ ; আলতাফ পারভেজ