You dont have javascript enabled! Please enable it! গণবাহিনী ও রক্ষীবাহিনীর সংঘাত এবং দ্বিতীয় তরঙ্গের হত্যালীলা - সংগ্রামের নোটবুক

 ‘গণবাহিনী’২৪৭ ও রক্ষীবাহিনীর সংঘাত এবং দ্বিতীয় তরঙ্গের হত্যালীলা

             ‘অস্ত্র জমা দিয়েছি – ট্রেনিং জমা দেইনি।

                       – স্বাধীনতার ঊষালগ্নে ঢাকায় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে লিখিত শ্লোগান।২৪৮

   আমরা (মুজিব বাহিনী) জাতীয় বিপ্লবী সরকারের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। এটা সিরাজুল আলম খান আর আমি মুজিব বাহিনীর পক্ষ থেকে দিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু এ প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। কারণ, এ প্রস্তাব গৃহীত হবার অনুকূল অবস্থা তখন ছিল না। কেননা, আগেই ভারতের সঙ্গে আমাদের একটা চুক্তি হয়েছিল ।…

      -আবদুর রাজ্জাক, মুজিব বাহিনীর প্রধান চার নেতার একজন২৪৯

……………………………………………………………

১৪৭) গণবাহিনী ছিল জাসদের সশস্ত্র শাখা। জাসদ নিজেকে একটি ‘দল’ হিসেবে উল্লেখ করলেও তাত্ত্বিকভাবে সে নিজেকে ‘মাল্টিক্লাস অর্গানাইজেশন’ মনে করত এবং ভবিষ্যৎ সমাজতান্ত্রিক পার্টির ‘ভণ’ হিসেবে সেখানে একটি সিওসি (সেন্ট্রাল অর্গানাইজিং কমিটি) গড়ে তােলা হয় সবগুলাে অঙ্গসংগঠনের প্রধান প্রধান নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে। গণবাহিনী এই সিওসি’র অধীনে কাজ করত। ১৯৭২ সালের মে মাসে অনানুষ্ঠানিকভাবে ঐ কাঠামাের গােড়াপত্তন। সিরাজুল আলম খানও কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থার ১২ সদস্যের একজন ছিলেন। কর্নেল আবু তাহেরকে গণবাহিনীর প্রধান করা হয়েছিল, যদিও তা সাধারণ্যে প্রকাশ করা হয়নি। গণবাহিনীর উপনেতা হিসেবে হাসানুল হক ইনুর (সাংগঠনিকভাবে যিনি ছিলেন কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক) পরিচিতি ছিল প্রকাশ্য। জাসদ রাজনীতি কীভাবে গণবাহিনীকেন্দ্রিক রূপ নিয়েছিল সে বিষয়ে পরবর্তী পর্যায়ে বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে। বহু ক্ষয়ক্ষতি শেষে ১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে এক নীতিনির্ধারণী বৈঠক শেষে জাসদ তার এই সামরিক অঙ্গসংগঠনের কার্যক্রম বন্ধ করে। তবে সাংগঠনিক কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ হলেও অস্ত্রসমর্পণের সেরকম উদ্যোগ দেখা যায়নি। মানিকগঞ্জের গণবাহিনীর একজন সুপরিচিত সংগঠক বর্তমান লেখককে জানিয়েছেন, কার্যক্রম বন্ধ ঘােষণার পর তাদের অস্ত্র ‘ক্যাশ করে রাখার (লুকিয়ে রাখা) জন্য বলা হয়। তবে বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যক্তিগত ও গ্রুপভিত্তিতে এর পরও গণবাহিনী সংশ্লিষ্টরা তাদের সশস্ত্র তৎপরতা অব্যাহত রেখেছিলেন- জাসদ রাজনৈতিকভাবে যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। কুষ্টিয়া, কালীগঞ্জ প্রভৃতি অঞ্চলের দৃষ্টান্ত এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। তবে এর ব্যতিক্রমও রয়েছে।

২৪৮) এটাকে স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম দেয়াল লিখন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন জাসদ নেতা আবু সাঈদ খান তাঁর শ্লোগানে শ্লোগানে রাজনীতি’ শীর্ষক গ্রন্থে, অঙ্কুর প্রকাশনী, ২০০৮, ঢাকা, প, ৪৬।

২৪৯) ১৯৮৯ সালের ২ জুন টেপরেকর্ডারে ধারণকৃত মুজিব বাহিনী নেতা আবদুর রাজ্জাক-এর সাক্ষাঙ্কার, সাক্ষাৎকার প্রদানকালে তিনি বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বিস্তারিত দেখুন, মাসুদুল হক, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে র এবং সিআইএ’, প্রচিন্তা প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১১, পৃ. ১৫৭।

Page 165

১৯৭২-এর প্রথম থেকে মুজিব বাহিনীর একাংশের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের তীব্র বিরােধ, মুজিব বাহিনীর মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিরােধ, সামগ্রিক পরিস্থিতির ওপর কর্তত্ব ধরে রাখতে সর্বগ্রাসী ভারতীয় চেষ্টা, শেখ মুজিবুর রহমান ফিরে আসামাত্র যুদ্ধকালে তাজউদ্দীনপন্থীদের দ্বারা নয় মাস কোণঠাসা থাকা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের একাংশের আবারও প্রভাবশালী হয়ে ওঠা ইত্যাদির মাঝেই জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গড়ে ওঠার কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর এম এ জলিল ও আ স ম রব২৫০কে যুগ্ম-আহ্বায়ক করে জাসদের জন্ম হয়। পরবর্তী ডিসেম্বরে আহ্বায়ক কমিটি কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটিতে বর্ধিত হয়। তিয়াত্তরের মে মাসে গঠিত হয় পূর্ণাঙ্গ জাতীয় কমিটি।

নবগঠিত এই দলের প্রধান শক্তিভিত ছিল মুজিব বাহিনীতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যােদ্ধারা, যদিও দলের প্রথম প্রকাশ্য আহ্বায়ক কমিটি দেখে তা বােঝার উপায় ছিল না।২৫১ কিন্তু দ্রুত সেই যােদ্ধাদের গুরুত্ব বেড়ে যায় যখন দেখা গেল, জাসদ গঠনের পরপরই নবাবগঞ্জ এবং মানিকগঞ্জে খুন হলেন তাদের দুই জনপ্রিয় নেতা সিদ্দিকুর রহমান মাস্টার ও বাদল বিশ্বাস। মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার

……………………………………………………………….

২৫০) জনসম্মুখে এ সময় জাসদের সবচেয়ে সােচ্চার তথা মুজিবের প্রতি আক্রমণাত্মক বক্তা ছিলেন আ স ম রব (জন্ম: ১৯৪৫)। ১৯৭১-এর ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বাংলাদেশের সম্ভাব্য পতাকা উত্তোলন করে তার একটি সাহসী ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছিল। যে কারণে একাত্তর-উত্তর সময়ে তিনি যখন সরকারের বিরুদ্ধে অনলবর্ষী হয়ে ওঠেন তখন তরুণদের মাঝে আওয়ামী লীগ বিরােধী মনােভাব তৈরির ক্ষেত্রে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তার এরূপ বিশেষ ভাবমূর্তির কারণে জাসদ নামে একটি পৃথক ‘দল গঠনের পর বেশ কয়েক মাস সাধারণ্যে এ দলকে (ছাত্রলীগের) ‘রব গ্রুপ হিসেবে অভিহিত হতে দেখা যায় । ১৯৯৬-২০০১ পর্যায়ে এসে সেই আ স ম রবই শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারে মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার আগে তিনি সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের সঙ্গে রাজনৈতিক আঁতাতের দায়েও নিন্দিত হন রাজনৈতিক অঙ্গনে।

২৫১) আহ্বায়ক কমিটি ছিল মাত্র সাত সদস্যের। জলিল-রব ছিলেন যুগ্ম আহ্বায়ক। বাকি সদস্যরা ছিলেন শাজাহান সিরাজ, বিধানকৃষ্ণ সেন, নূর আলম জিকু, সুলতান উদ্দীন আহমদ এবং রহমত আলী। শেষােক্তজন অবশ্য এক সপ্তাহের মধ্যে আবার আওয়ামী লীগে ফিরে যান। যা নবগঠিত দলকে বেশ ব্রিত অবস্থায় ফেলে। উপরােক্ত সাত জনের মধ্যে সুলতানউদ্দিন এবং বিধান কৃষ্ণ ছিলেন আগরতলা মামলার আসাম। এ ছাড়া তখন আর তাদের কোনাে রাজনৈতিক পরিচয় ছিল না। জাসদের যাত্রার সময়ের উল্লেখযােগ্য একটি দিক ছিল, ‘জয়বাংলা’ শ্লোগান দিয়েই নবগঠিত দল তার প্রথম সাংগঠনিক বক্তব্য উপস্থাপন করে (দেখুন, সংযুক্তি: জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের প্রথম ঘােষণাপত্র)। অন্যদিকে তিয়াত্তরের নির্বাচনে প্রতীক হিসেবেও নতুন দলের প্রথম পছন্দ ছিল নৌকা এবং দ্বিতীয় পছন্দ ছিল মশাল । নৌকা প্রতীকের জন্য আইনগত লড়াই চালিয়েছিল জাসদ।

Page 166

চারিগ্রামে জন্মগ্রহণকারী সিদ্দিক মাস্টার ছিলেন নওয়াবগঞ্জ পাইলট হাইস্কুলের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক; ১৯৭২ সালের ১২ নভেম্বর স্কুল হােস্টেলে গুলি করে জনপ্রিয় এই নেতাকে হত্যা করা হয়। অন্যদিকে সাহাদাত হােসেন বিশ্বাস বাদল খুন হন ১৯৭৩-এর ১০ জানুয়ারি দোহারের জয়পাড়ার পালংগঞ্জে। এরপর ১৯৭৩ সালের ৭ অক্টোবর সরকারপন্থী ছাত্রলীগের সবচেয়ে বড় শিকার হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সিরাজুল আলম খানদের অনুসারী জাকসুর নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ছাত্রনেতা শাহ বােরহান উদ্দিন রােকন।২৫২ নারায়ণগঞ্জে বােনের বাসায় যাওয়ার পথে তাঁকে বন্দুকের মুখে অপহরণ করা হয় এবং পরদিন লক্ষীনারায়ণ কটনমিলের পাশে তার লাশ পাওয়া যায়। ময়নাতদন্তে রােকনের মাথায় একটি গুলির চিহ্ন শনাক্ত করা হয়েছিল ।

এ ধরনের মৃত্যুর মিছিল এরপর স্বাভাবিক ও প্রাত্যহিক ব্যাপার হয়ে পড়ে। তবে মাঝে মাঝেই হত্যার নির্মমতা ও হত্যাকারীদের বেপরােয়া ভঙ্গি জনগণকে ভবিষ্যৎ নিয়ে আতঙ্কিত করে তুলত। ১৯৭৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর এ রকম এক ঘটনায় ছােট্ট জনপদ নওয়াবগঞ্জে একই দিন রক্ষীবাহিনী ও সরকারি দলের ক্যাডাররা স্থানীয় সাতজন রাজনৈতিক কর্মীকে হত্যা করে।২৫৩ যশােরে অ্যাডভােকেট মােশারফ হােসেনের হত্যাকাণ্ডও ছিল এ রকম আরেক আতঙ্কজনক

……………………………………………………………

২৫২) রােকন খুব খ্যাতনামা সংগঠক ছিলেন। স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম জাকসু নির্বাচনে তিনি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরের নির্বাচন সরকার সমর্থক ছাত্রলীগ বানচাল করে দেয়। ফলে রােকন জিএস হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন। স্বাধীনতার পরপর দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলাে কীভাবে শাসকগােষ্ঠীর সরাসরি সম্পৃক্ততায় সন্ত্রাসকবলিত হয়ে পড়েছিল তার এক করুণ দৃষ্টান্ত হতে পারে রােকনের মৃত্যু। ঐ সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন শিক্ষাবিদ সৈয়দ আলী আহসান। তার বিবরণ থেকে জানা যায়, জাসদ ছাত্রলীগের একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মুজিব ও ইন্দিরাকে লক্ষ্য করে গায়ক আবদুল জাব্বার ব্যঙ্গাত্মক একটি গান গাওয়ার প্রতিশােধ হিসেবে তৎকালীন ছাত্রলীগের একজন বহুল আলােচিত প্রভাবশালী নেতা তার কিছু সঙ্গীকে নিয়ে কিছুদিন পর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা চালান। রােকন ছিলেন তাদের প্রধান টার্গেট। কিন্তু রােকন প্রাথমিকভাবে নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন। বিষয়টি শিক্ষকদের তরফ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে জানানাে হলেও কিছুদিন পরই রােকনকে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জে যাওয়ার পথে অপহরণ করা হয় এবং পরদিন শীতলক্ষ্যার তীরে তার মৃতদেহ পাওয়া যায় । বলা বাহুল্য, প্রতিকারহীন এরূপ হত্যাকাণ্ড প্রতিপক্ষের মাঝেও অনুরূপ জিঘাংসার সঞ্চার করেছিল। রােকনের মৃত্যুর পূর্বাপর জানতে দেখুন: সৈয়দ আলী আহসান, বঙ্গবন্ধু: যেরকম দেখেছি, বার্ড পাবলিকেশন্স, ১৯৯৬, ঢাকা, পৃ. ২২-২৩। রােকনের গ্রামের বাড়ি ছিল বৈদ্যেরবাজার থানার বুরুন্ডি। তিনি পরিসংখ্যানের ছাত্র ছিলেন। ১৯৭৩-এর নভেম্বরে পরবর্তী জাকসু’র নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক মােজাম্মেল হকও (যিনি ছিলেন ছাত্রলীগের।বিপক্ষ গ্রুপের সমর্থনপুষ্ট) আততায়ীর হাতে নিহত হন।

২৫৩) এরা ছিলেন খালিদ হােসেন, এবাদত আলী, বাবুল, রবি, কালু, এবাদত (২) এবং মােতালেব।

Page 167

ঘটনা। তিনি ছিলেন সেখানে জেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি । ১৯৭৪ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি রাতে জাসদ কার্যালয়ে কর্মরত অবস্থায় মাত্র দু’ জন মুখােশধারী সন্ত্রাসী স্টেনগান থেকে গুলি চালিয়ে ধীরেসুস্থে হেঁটে হেঁটে রাস্তা পার হয়ে যায়। মােশারফ হােসেনের সঙ্গে আরও দু’জন সেদিন গুলিবদ্ধ হয়েছিলেন। ২৫৪

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, এসব মৃত্যুকে রাজনৈতিকভাবে মােকাবেলা কঠিন হয়ে পড়ে বিশেষত যখন দেখা যায় প্রায় প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও সরকারি ছত্রছায়ায় বলপ্রয়ােগের এরূপ ঘটনা ঘটছে। সিদ্দিক মাস্টারের লাশ রাজধানীতে এনে জাসদ নেতৃত্ব প্রকাশ্যেই শপথ নিয়েছিলেন যে তারা এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিশােধ নেবে। সিদ্দিক মাস্টার ও বাদল বিশ্বাসের খুনের আগেই অবশ্য ছাত্রলীগের এই অংশের কর্মীরা মুজিববাদ সমর্থকদের হাতে মারা যেতে শুরু করে। এক্ষেত্রে মুজিববাদপন্থীদের প্রথম শিকার ছিলেন দিনাজপুরের আবদুল মালেক। ১৯৭২-এর ২৩ জুলাই তিনি খুন হন। মালেক-সিদ্দিক-বাদল-মােশারফ হােসেন প্রমুখের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জাসদ ও প্রতিপক্ষ বাহিনীর মধ্যে খুনের যে হােলিখেলা শুরু হয় তাকে যে ধীর লয়ে চলা এক ধরনের গণহত্যার সঙ্গে তুলনা করা যায় তার স্মারক এই গ্রন্থের শেষে সংযােজিত নিহতদের তালিকা। এই তালিকা নিহতদের এক খণ্ডাংশ মাত্র। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগ্রামের ধারা বরাবর এসব মৃত্যুর যৌক্তিকতা, খুনীদের বিচার কিংবা নিহতদের পরিবারের ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির বিষয়টি সচেতনভাবে এড়িয়ে যায়।২৫৫

এটা ছিল বাস্তবে স্বাধীনতা যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের সমাজে দ্বিতীয় তরঙ্গের হানাহানি- যার ইঙ্গিত দেশবাসী পেয়েছিল এই আলােচনার শুরুতে উদ্ধৃত স্বাধীনতা-উত্তর সেই দেয়াল লিখনে অস্ত্র জমা দিয়েছি-ট্রেনিং জমা দেইনি। স্বাধীনতা পরবর্তী হত্যালীলার প্রথম তরঙ্গটি প্রবাহিত হয়েছিল সম্মিলিতভাবে সকল ধারার ‘মুক্তিযােদ্ধাদের দ্বারা উর্দুভাষীদের ওপর। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগেই আওয়ামী লীগ ও পাকিস্তানের শাসক গােষ্ঠীর মাঝে রাজনৈতিক

………………………………………………………..

২৫৪) বেগম মােশারফ হােসেন তাঁর স্বামীর মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী প্রেরিত শােকবাণীও সেদিন এই বলে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন: ‘যার দলীয় কর্মীরা আমাকে শােক সাগরে ভাসিয়েছে- তিনি আবার আমার কাছে শােকবাণী পাঠিয়েছেন। এটাকে পরিহাস ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে। দৈনিক গণকণ্ঠ, ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪, ঢাকা। উল্লেখ্য, মােশারফ হােসেনের নিহতস্থল গুরুদাস বাবু লেনস্থ জাসদ অফিসের উপরতলাতেই ছিল তাঁর বাসস্থান!

২৫৫) এসময় সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের দ্বারা প্রায় ৫০-৬০টি থানা ও পুলিশ ফাড়িতেও হামলা ও লুণ্ঠনের ঘটনা ঘটে। সেসব থানা ও ফাড়ির তালিকা ও আক্রমণের তারিখের জন্য দেখুন: আনােয়ার উল আলম, রক্ষীবাহিনীর সত্য-মিথ্যা, প্রথমা, জুন ২০১৩, ঢাকা, পৃ. ২১৭-২১৯ । তবে এসব হামলার অনেকগুলাে ঘটে পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টি কর্তক।

Page 168

দরকষাকষি যতই দুরূহ হয়ে উঠছিল ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে ‘বিহারি’ নামে পরিচিত উর্দুভাষীদের ওপর বিচ্ছিন্নভাবে আক্রমণ ততই বাড়ছিল। চট্টগ্রামের ছাত্রলীগ নেতা ডা. মাহফুজুর রহমান সেই বিবরণ দিয়েছেন এভাবে : ১ মার্চ ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘােষণার পরপরই…পথেঘাটে পশ্চিম পাকিস্তানিদের দোকান লুট হয়। বিভিন্ন স্থানে অবাঙালিদের ওপর হামলা শুরু হয়। উল্লেখ্য, এসময় ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের তরুণ স্বাধীনতাপন্থীদের অন্যতম একটি শ্লোগান ছিল একটা দুইটা মাউরা ধরাে, সকাল-বিকাল নাস্তা করাে’, ‘মাউরাদের হত্যা করাে – বাংলাদেশ স্বাধীন করাে’। মাউরা’ হলাে উর্দুভাষীদের প্রতি গালিসুলভ একটি শব্দ। এসময় সান্তাহার, দিনাজপুর ও সিরাজগঞ্জে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মাঠ পর্যায়ে পৌছানাের আগেই কয়েক হাজার। ‘বিহারি খুন হয়ে যায়।২৫৬ সেসময় চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে বিহারিদের পক্ষ থেকেও পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটেছে। এই জনগােষ্ঠীর ওপর মুক্তিযােদ্ধাদের তরফ থেকে পদ্ধতিগত একতরফা হত্যালীলার অভিযােগ ওঠে মূলত একাত্তর সালের ১৬ ডিসেম্বরের পরে, বিশেষ করে ভারতীয় বাহিনী প্রত্যাহার শেষে। সবচেয়ে সংগঠিত ও ব্যাপকতর হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছিল ১৯৭২ সালের ১০ মার্চ দিবাগত রাতে খুলনার খালিশপুরে ভারতীয় বাহিনী প্রত্যাহারের পরপর! অভিযােগ রয়েছে, প্রায় ১০ হাজার কলােনিবাসী শ্রমিক ও তাদের পরিবার-পরিজন খুন হন তাতে। হত্যাকারীরাও ছিলেন শ্রমজীবী। খালিশপুরের হত্যালীলার কথা পরদিন বিবিসি থেকে প্রচার হলে আন্তর্জাতিক পরিসরে ব্যাপক উদ্বেগ তৈরি হয়। তবে এই ঘটনায় কোনাে অভিযােগ দায়ের হয়নি, কোনাে তদন্ত হয়নি এবং কেউ গ্রেফতারও হয়নি কখনাে। ঐ সময়ের সংবাদপত্র থেকে দেখা যায়, বিচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধোত্তর অনেক মাস জুড়ে উর্দুভাষীদের প্রতি এরূপ আক্রমণ চলে নিয়মিতভাবে। এইরূপ হত্যার জন্য কাউকে যাতে জবাবদিহিতার মুখে পড়তে না হয় সেজন্য তৎকালীন সরকার ১৯৭৩ সালে এক আইনে পেছনের তারিখ দিয়ে ১৯৭১ সালের১ মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জাতীয় স্বাধীনতার সংগ্রামের অংশ হিসেবে এবং শান্তি-শৃঙ্খলা বজায়ের স্বার্থে কৃত কাজকে আদালতে প্রশ্নযােগ্য নয় বলে ঘােষণা করে।

আলােচ্য আইনের তৃতীয় অনুচ্ছেদটি ছিল নিম্নরূপ : ১ মার্চ ১৯৭১ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত সময়ে কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনাে মামলা থাকলে তা জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনাে কাজের কারণে বা সম্পর্কিতভাবে তার দ্বারা কৃত হয়েছে বা এমন কাজ পরিচালনা অথবা শৃঙ্খলা পুনঃস্থাপনের সঙ্গে

……………………………………………………….

২৫৬) এ বিষয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উৎসের বিবরণের জন্য দেখুন: আহমেদ ইলিয়াস, বিহারি: বাংলাদেশে ভারতীয় অভিবাসী, শামসুল হক ফাউন্ডেশন, ঢাকা, ২০০৭, পৃ. ৯৭।

Page 169

জড়িত এই মর্মে একজন সরকারি উকিল সরকারের পক্ষ থেকে প্রত্যয়ন করবেন অথবা আদালতে আবেদন করবেন। এইরুপ আবেদনের শুনানি শেষে আদালত আর মামলাটি পরিচালনা করবে না, যা তুলে নেয়া হয়েছে বলে ধরা হবে এবং অভিযুক্ত ব্যক্তি এরপর খালাস পাবেন।২৫৭

একাত্তরে এবং বাহাত্তরে বাংলাদেশে উর্দুভাষীদের ওপর নিপীড়নের সবচেয়ে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেছেন খ্যাতনামা সাংবাদিক কুতুবুদ্দিন আজিজ তার “Blood and Tears’ শীর্ষক গ্রন্থে। ২৫৮  উর্দুভাষী যুদ্ধ-উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনে করাচিতে দায়িত্বপূর্ণ পদে যুক্ত ছিলেন তিনি। সেই সূত্রে ১৭০ জন প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে নিবিড় আলাপচারিতা শেষে ৩৩ অধ্যায় জুড়ে স্থান-কাল-পাত্রসহ শত শত হামলার বিবরণ তুলে ধরে কুতুবউদ্দিন দাবি করেছেন, দু’ দফায় (২৫ মার্চের আগে এবং ১৬ ডিসেম্বরের পরে) বাংলাদেশের অন্তত ১১০টি শহরে হাজারে হাজারে উর্দুভাষী পদ্ধতিগতভাবে হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনের মুখােমুখি হন। তবে তিনি প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে এও উল্লেখ করতে ভােলেননি, স্থানীয় অনেক বাঙালি ঝুঁকি নিয়ে ভীত বিহ্বল অবাঙালিদের আশ্রয়ও দিয়েছিল।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক খুন তথা বিচারবহির্ভূত হত্যার সংস্কৃতির উপরােক্ত যাত্রাবিন্দুকে স্থানীয় ইতিহাসবেত্তারা বরাবর এড়িয়ে যান। জাতীয় পর্যায়ে ইতিহাসের ঐ লগ্নে প্রায় সকল প্রধান প্রধান দল ‘সমাজতন্ত্র’-এর জন্য উচ্চকণ্ঠ থাকলেও বেসামরিক নিরস্ত্র উর্দুভাষীদের (যাদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠই ছিল রেলওয়ে ও পাটকলগুলাের শ্রমজীবী ও নিম্নপদস্থ কর্মচারী এবং সৈয়দপুরসহ আরও কয়েকটি স্থানে যারা যুদ্ধ-পূর্ববর্তী সময়ে মূলত বামপন্থী ধারার ট্রেড ইউনিয়নে সম্পৃক্ত ছিল) বিরুদ্ধে সৃষ্ট ঐ হত্যাযজ্ঞের সক্রিয় বিরােধিতা করেছে

…………………………………………………………..

২৫৭) দেখুন, The Bangladesh National Liberation Struggle [Indemnity] Order, 1973. President’s Order No. 16 of 1973. Published in the Bangladesh Gazette, Extraordinary, Dated the 28 February 1973, Dhaka, এই আইন উর্দুভাষীদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হত্যা ও অন্যান্য অপরাধের জন্য দায়ীদের দায়মুক্তি দেয়ার পাশাপাশি ঢাকায় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সামনে নিরস্ত্র বিশ্বাসঘাতকদের বেয়নেট দিয়ে হত্যাকারী কাদের সিদ্দিকীকেও দায়মুক্তি দেয় । ৫ জন উর্দুভাষীকে কোনাে ধরনের নিয়মতান্ত্রিক বিচার ছাড়াই প্রকাশ্য হত্যার ঐ ঘটনাটি ঘটে ঢাকা স্টেডিয়াম এলাকায় ১৮ ডিসেম্বর বিকাল চারটায়। সেদিন সেখানে একটি মুক্তিযােদ্ধা সমাবেশের আয়ােজন করা হয়েছিল। এ বিষয়ে বিস্তারিত দেখুন, আহমেদ ইলিয়াস, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৯১। বর্তমান গবেষণায় এই বইটির ইংরেজি ভাষ্য থেকেও অনেক উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে । ইংরেজি ভাষ্যটি আগে প্রকাশিত হয়। বাংলা ভাষ্যটি বর্ধিত আকারে এই অনুসন্ধান চলা অবস্থায় প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য, কাদের সিদ্দিকীর ঐ হত্যার ভিডিও ফুটেজ দেখুন: http://www.youtube.com/watch?v=y_EoP5IM_8 (Retrieved on 16 January 2013.)

২৫৮) কুতুবউদ্দিন আজিজ, ব্লাড এন্ড টিয়ার্স, ভাষান্তর: এডভােকেট মহিম মিত্র, অনির্বাণ প্রকাশনী, লেলিন সরণি, কলকাতা, এপ্রিল ২০০৪ গ্রন্থটির মূল সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালে ।

Page 170

এমন দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। জিঘাংসার এই অধ্যায় এতই বর্ণবাদী চেতনায় আপ্লুত ছিল যে, মােহাম্মদ আলাউদ্দিন নামে যে উর্দুভাষী ব্যক্তিটি ঢাকার মােহাম্মদপুর ইউনিট আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস যাকে লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল নিজ কমিউনিটির হাত থেকে বাচার জন্য- তিনিও একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর ধানমন্ডিতে প্রকাশ্যে খুন হয়ে যান স্রেফ অবাঙালি হওয়ার কারণে। অথচ ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে সেদিন গিয়েছিলেন তিনি আওয়ামী লীগের অন্যান্যদের সঙ্গে বিজয় উদযাপনের জন্য।২৫৯

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর প্রায় ১০-১২ হাজার উর্দুভাষীকে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ করা হয়েছিল। এদের ঘিরে কীরূপ দুর্নীতি হয়েছে তার একটি বিবরণ পাওয়া যায় সেই সময়কার সুপরিচিত দৈনিক গণকষ্ঠে ১৯৭৪ সালের ৮ জুলাই, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার সংক্রান্ত এক লেখায়। কারাবাসী উর্দুভাষীদের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে লেখা হয়েছে :

“…এসব বিহারির কাছ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত (আটককালে পাওয়া) জমা নেয়া হয়। কোন কোন বিহারির কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছিল।…তদন্তে দেখা যায়, যে জমা দিয়েছে ৫ হাজার টাকা। তার নামের পাশে লেখা আছে ৫০ টাকা।..এমনও শােনা যায়, বিহারিরা থাকাকালীন টাকার বিনিময়ে রাতে মহিলা সেল খােলা থাকত ।…”২৬০

হত্যা, অপহরণ ও নির্যাতনের পাশাপাশি এসময় উর্দুভাষীদের সম্পদও যে। গণহারে বেদখল হয়েছে সে বিষয়ে এই লেখার অন্যত্র আলােকপাত করা হয়েছে। উর্দুভাষীদের ভাগ্য বিপর্যয়ের সঙ্গে তুলনা করলে যুদ্ধের সময় পশ্চিম পাকিস্তানে আটকেপড়া বাংলাদেশিদের সৌভাগ্যবানই বলতে হবে। কারণ ঐরূপ চার লাখ বাঙালি, যাদের মধ্যে প্রায় ২০ হাজার সেনা অফিসার ও জওয়ানও ছিলেন- তুলনামূলকভাবে অতি নগণ্য শারীরিক ক্ষয়ক্ষতি ও বস্তুগত সম্পদ খুইয়ে নির্বিঘ্নেই বাংলাদেশে ফিরতে পেরেছিলেন। ১৯৭৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর আটকেপড়া বাংলাদেশিদের প্রথম দলটি ঢাকায় পৌছায়। উল্লেখ্য, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে আটকেপড়া সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিরা যে চুক্তির বলে নিজ নিজ দেশে ফেরার সুযােগ পান তাতে বাংলাদেশ কোনাে পক্ষই ছিল না। চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয় নয়াদিল্লিতে ১৯৭৩ সালের ২৮ আগস্ট। ভারতের পক্ষে পি এন হাকসার এবং পাকিস্তানের পক্ষে আজিজ আহমেদ এই চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তি স্বাক্ষর বিশেষভাবে সহজ হয়- যখন বাংলাদেশ জানিয়ে দেয়, ভারতের হাতে আটক ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানি সেনার বিচারের দাবি সে ছেড়ে দিচ্ছে।

……………………………………………………………..

২৫৯) দেখুন, Ahmed Ilias, Ibid, p.119-20.

২৬০) ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে-৩, দৈনিক গণকণ্ঠ, ৮ জুলাই ১৯৭৪, ঢাকা।

Source: মুজিব বাহিনী থেকে গন বাহিনী ইতিহাসের পুনর্পাঠ; আলতাফ পারভেজ