একাত্তরের ‘স্বপ্নের অপহরণ’ : হত্যালীলার নতুন তরঙ্গ মুজিববাদ বনাম বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র
৪.ক. ভারতের বলয় থেকে বেরােতে মুজিবের স্ববিরােধী বিবিধ চেষ্টা; জাসদের জন্ম
অত্যাচারী-অত্যাচারিতের দ্বন্দ্বের সমাধান শুধু তাদের পারস্পরিক স্থান বদলের মধ্যে নিহিত নেই। এমনকি মুক্তির নামে পুরানাে অত্যাচারীর স্থলে নতুন অত্যাচারীকে স্থাপনের মধ্যেও নেই। কারণ, তাতে অত্যাচারিতের বিলুপ্তি ঘটে না।… অত্যাচারিতরা তাদের অস্তিত্বের অভিজ্ঞতার এক পর্যায়ে অত্যাচারী ও তাদের জীবন-যাপনের পদ্ধতির প্রতি অপ্রতিরােধ্য আকর্ষণ বােধ করে। তাদের মতাে জীবন-যাপন করাই প্রধান উম্মাদনা ও কামনা হয়ে ওঠে। এই উম্মাদনার জন্য তারা যে কোন মূল্যে অত্যাচারীর মতাে হতে চায়, তাকে অনুসরণ । করে।…সত্যিকার অর্থে তাদের ‘মনি তাদের ভেতরই বাস করে।
-পাওলাে ফ্রেইরি, অত্যাচারিতের শিক্ষা১৭৯
পূর্ববর্তী অধ্যায়ের শেষ পর্যায়ে সিরাজুল আলম খান ও তার অনুসারীদের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের রাজনৈতিক নৈকট্যের যে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে বস্তুত তার শুরু যুদ্ধকালেই। যুদ্ধের শুরুতে শেখ মণি’র পাশাপাশি সিরাজুল আলম খান ও তাঁর অনুসারীরা একসঙ্গেই তাজউদ্দীন বিরােধিতায় থাকলেও এক পর্যায়ে তাজউদ্দীন আহমদে এদের মাঝে বিভক্তি আনতে সক্ষম হয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়। যার মধ্য দিয়ে সিরাজপন্থীদের তরফ থেকে যুদ্ধকালে তাজউদ্দীন বিরােধিতা ক্রমে কমে আসে। এ সম্পর্কে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ভাষ্য পাওয়া যায় যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রীর সেক্রেটারি ফারুক আজিজ খানের জবানিতে। তিনি লিখেছেন :
Tajuddin thought he could moderate the BLF leaders through Shirajul Alam Khan and therefore wanted to meet him without the knowledge of his colleagues in the
………………………………………………
১৭৯) উদ্ধৃতিটি গ্রন্থটির বাংলা অনুবাদ থেকে নেয়া। দেখুন, পাওলাে ফ্রেইরি, অত্যাচারিতের শিক্ষা, অনুবাদ: আমিনুল ইসলাম ভুইয়া, আরবান, ২০০৮, ঢাকা, পৃ. ২৯, ৩৩-৩৪ ।
Page 123
BLF. I do not know how it was arranged but Shirajul came once to Theatre Road (prime minister’s office) on a Sunday and had a long session with the prime minister. When the two came out of the room I thought they had a fruitful discussion. Even was leaving the building the two of them standing outsideunder the portico continued their discussion in a very low voice. I was the only other person standing a little distance away so that their privacy wasn’t disturbed. Then Sirajul steped out unfolding his big umbrella as the heavy monsoon rains slowed down for a while. I did not know the gist of their discussion but I could draw some conclussions from the prime minister’s relaxed mood.১৮০
জাসদ গঠনের সময় উপরােক্ত উদ্ধৃতিতে উল্লিখিত ঘনিষ্ঠতা আরও বিকশিতহওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। ১৯৭২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে জাসদের কার্যক্রমশুরুর সময় ছাত্রলীগের সিরাজুল আলম খান সমর্থক অংশের সম্ভাব্য যে কোনােরাজনৈতিক উদ্যোগে তাজউদ্দীন আহমদের নীরব সমর্থন রয়েছে বলে মনে করাহতাে। সরকারের বিভিন্ন পেটোয়া বাহিনীর নিপীড়ন থেকে রেহাই পেতে সিরাজ অনুসারী সংগঠকরা তাজউদ্দীনের কাছে সহানুভূতি আশা করতেন এবং নতুন দল গঠনের প্রচেষ্টা সম্পর্কেও অবহিত করতেন। সিরাজ অনুসারীদের প্রতি সহানুভূতি সত্ত্বেও তিনি নতুন দলের বিষয়ে ধীরে এগােনাের পক্ষপাতী ছিলেন বলেই সাক্ষ্যপাওয়া যায়।
মুজিব দেশে ফিরে এসেছিলেন বাহাত্তরের জানুয়ারিতে। মে-জুনেই সিরাজুলআলম খানরা আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেন বা বেরিয়ে যেতে বাধ্য হন। এ পর্যায়ের একটি বড় প্রশ্ন হলাে, মাঝখানের ৪-৫ মাসে এমন কী ঘটেছিল যে, নতুন দল গঠন ‘অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। সিরাজুল আলম খানের ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের কাছ থেকে১৮১ এ বিষয়ে যেসব ভাষ্য পাওয়া তার সংক্ষিপ্ত ও সম্মিলিত বক্তব্য এ রকম যে, জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মাঝে একের পর এক এমন অনেকগুলাে ঘটনা ঘটছিল, যেগুলাে সিরাজ গ্রুপ প্রথমত, তাদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক অস্তিত্বের জন্য ভবিষ্যৎ হুমকি হিসেবে গ্রহণ করে এবং দ্বিতীয়ত, তাদের মাঝে মুজিবের ক্ষমতার বলয়ে ‘উপেক্ষার একটি বােধ’ তৈরি হয়। এইরূপ
………………………………………………….
১৮০) Faruk Aziz Khan, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৮৪-৮৫।
১৮১) কীভাবে এসব তথ্য সারসংকলন করা হয়েছে সে বিষয়ে অন্যত্র পদ্ধতিগত ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে।
Page 124
অভিজ্ঞতার শুরু বস্তুত মুজিবের আগমনের পরদিন থেকেই।১৮২ যেমন সিরাজুল আলম খান-আ স ম রব-শাজাহান সিরাজরা চাইছিলেন দেশে ফিরে মুজিব দেশ ও দলের দায়িত্ব নিন, সরকারের নয়। বিশেষ করে চীনে মাও সেতুঙ যেভাবে দেশ পরিচালনায় দলে চেয়ারম্যানরূপী একটি ভূমিকা নিয়েছিলেন সিরাজরা চাইছিলেন মুজিবের ভূমিকাও সেইরূপ হােক- যুদ্ধকালীন ‘তাজউদ্দীন প্রশাসন অক্ষুন্ন থাকুক। ৬২ থেকে ৭২- এই এক দশকে জনসমাজে যেসব রাজনৈতিক দাবি তৈরি হয়েছিল- দল ও দেশের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে মুজিব সেগুলাের বাস্তবায়ন বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেবেন এবং তাজউদ্দীন সরকার ও ছাত্র-যুবারা তা বাস্তবায়ন করবে। এইরূপ দৃষ্টিভঙ্গি কেবল আকাঙ্ক্ষার পর্যায়েই থাকেনি। অন্তত মুজিব বাহিনীর অন্যতম নেতা এবং সিরাজুল আলম খানের ঘনিষ্ঠ সংগঠক মনিরুল ইসলাম দাবি করেছেন, ৩১ জানুয়ারি তারা যে অস্ত্রসমর্পণ করেছিলেন সেটার ভিত্তি ছিল মুজিবের সঙ্গে অন্তত তিন দফা নিম্নোক্ত বােঝাপড়া :
– বিভিন্ন মত ও দলের সমন্বয়ে দেশে অন্তবর্তীকালীন বিপ্লবী জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে;
– যদিও আওয়ামী লীগ এই সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করবে এবং সরকার রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করবে, কিন্তু মুজিবুর রহমান সরকার বা দল কোনােটাতেই থাকবেন না; তিনি অবস্থান করবেন রাজধানীর বাইরে;
– তবে দেশের নীতিনির্ধারণী বিষয়গুলােতে মুজিব মতামত দিতে পারবেন এবং দেবেন।
মনিরুল ইসলাম এও জানাচ্ছেন যে, মুজিব উপরােক্ত বােঝাপড়ার অংশ হিসেবে দেশের দক্ষিণের দ্বীপ মনপুরাতে থাকার বিষয়েও আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন!১৮৩
কার্যত যে এসব কিছুই ঘটেনি সেটাই এখন ইতিহাস। দেশে ফিরেই সরকারে যােগ দিয়েছিলেন মুজিব। এমনকি প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি থেকে পার্লামেন্টারি
……………………………………….
১৮২) বন্দিদশা থেকে রাষ্ট্রপতি মুজিব যেদিন দেশে ফিরে আসেন সেই ১০ জানুয়ারি সিরাজুল আলম খান ঢাকায় ছিলেন না। ৯ জানুয়ারি খুলনা থেকে ঢাকায় রওয়ানা দিয়ে রাজবাড়ীর গােয়ালন্দ ঘাটে কুয়াশার কারণে আটকা পড়ে থাকতে হয় তাকে। সেদিন অনেক রাতে তিনি মুজিবের কাছাকাছি পৌছাতে পেরেছিলেন। মাঝখানের এই কয়েক ঘণ্টা সময়কে অনেকে মুজিব ও তার মাঝে পরবর্তীকালে সৃষ্ট দূরত্বের এক বড় উৎস হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন। এরূপ পর্যবেক্ষকদের মতে, ১০ জানুয়ারির ঐ সময়টুকু ছিল মুজিবকে ঘিরে প্রভাব বলয় সৃষ্টির এক মাহেন্দ্রক্ষণ। মুজিব বাহিনী ও আওয়ামী লীগে সিরাজুল আলম খানের প্রতিদ্বন্দ্বিরা যা সর্বোত্তমভাবে কাজে লাগিয়েছিল।
১৮৩) মনিরুল ইসলাম, পূর্বোক্ত, পৃ. ২১২-২১৩.
Page 125
পদ্ধতিতে ফিরে গিয়ে তিনি এমনভাবে একজন প্রেসিডেন্ট বাছাই করেন যাতে নীতিনির্ধারণী বিষয়ে প্রশাসনের কোনাে পর্যায়ে কোনাে ধরনের শক্তিশালী ভিন্নমতের সম্ভাবনা না থাকে। এইরূপ ভাবনায় অবশ্য শিগগির ছেদ পড়ে। রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তিয়াত্তরের ২৪ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন। কাগুজে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা উপভােগ করতে না পেরেই স্বীয় পদ ছেড়ে দেন তিনি। এ বিষয়ে এক সাক্ষাৎকারে ইঙ্গিতে তিনি বলেন, ১০ বছর উচ্চ আদালতের জজ থাকাতে আমার সব কনকুশন ছিল রিজনড় কনকুশন। কিন্তু যে পদ্ধতিতে।
(পার্লামেন্টারি পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতি হিসেবে) অন্যের কনক্লশনে সব সময় এগ্রি করতে হচ্ছিল- সেটা আমার ভালাে লাগেনি।১৮৪ …উল্লেখ্য, প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর পদত্যাগের একটি তাৎক্ষণিক কারণ ছিল দালাল আইনে আটককৃতদের ক্ষমা ঘােষণা ও ছেড়ে দেওয়া। ক্ষমা ঘােষণার এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির হলেও সেসময় ঘােষণাটি এসেছিল প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে। যা ছিল রাষ্ট্রপতির জন্য খুবই ব্রিতকর। আবু সাঈদ চৌধুরীর পদত্যাগের পর প্রেসিডেন্ট করা হয়েছিল মুহাম্মদুল্লাহকে। তিনি পূর্বসূরির পদত্যাগের পেছনের টানাপােড়েন সম্পর্কে লিখেছেন,
‘সেই সময়ে (আবু সাঈদ চৌধুরী রাষ্ট্রপতি থাকাকালে) বাজারে গুঞ্জন চালু হয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় লন্ডনে উত্তোলিত চাঁদা নিয়ে। অনিয়ম হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিচারপতি চৌধুরী সাহেব বাংলাদেশের পক্ষে প্রচার চালান। ফলে এহেন অপপ্রচারে মনঃক্ষুন্ন হয়েছিলেন। আমি স্পিকার থাকাকালে তিনি যাবতীয় হিসাবের বিবরণ দেন।…তিনি রাষ্ট্রপতি থাকাকালে যে প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সরকারি বিল তার কাছে উত্থাপিত হয়েছে বা সই করতে হয়েছে। তা নিয়ে তিনি অস্বস্তির মধ্যে ছিলেন। আমাকে তিনি তাঁর অসুবিধার কথা বিস্তারিত বলেছেন। অবশেষে ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরে তিনি পদত্যাগ করেন।১৮৫
উল্লেখ্য, প্রচুর ভালাে না লাগা এবং অস্বস্তি’ নিয়ে পদত্যাগের আগেইরক্ষীবাহিনী বিষয়ে আইনগুলাে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর স্বাক্ষরেই
…………………………………………………..
১৮৪) বিচারপতি চৌধুরীর এ বিষয়ক মনােবেদনার বিস্তারিত দেখুন, মােহাম্মদ সেলিম, বাংলাদেশের তিন রাষ্ট্রপতির কথন, সুবর্ণ, ২০১২, ঢাকা, পূ, ১৮০-১৮২। উল্লেখ্য, রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর খন্দকার মােশতাক আহমদের নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রিসভায় বিদেশমন্ত্রী হিসেবে যােগ দিয়েছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এবং মুজিব শাসনামলে দেশ থেকে নির্বাসিত গণতন্ত্র মােশতাক আহমদ আবার ফিরিয়ে আনতে চান’- বিদেশমন্ত্রী হিসেবে ১৯৭৫-এর ২৩ আগস্ট বিচারপতি চৌধুরী এমন মন্তব্যও করেছিলেন লন্ডনে। দেখুন, Daily Star, 17 August 2014, Dhaka.
১৮৫) মুহাম্মদুল্লাহ, নীরবতা ভেঙ্গে, অয়ন, ২০০৬, ঢাকা, পৃ. ৯৩।
Page 26
জনসম্মুখে এসেছিল। তারপরও তিনি শেষরক্ষা করতে পারেননি। তার পদত্যাগ ছিল তৎকালীন শাসন পরিমণ্ডলে এমন একটি সুস্পষ্ট বার্তা যে, মুজিব যা চাইবেন সেভাবেই দেশ চলবে। কিন্তু তারপরও ছাত্রলীগের সিরাজ গ্রুপের পক্ষ থেকে কৃষি, শিল্প, অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়ে একের পর এক সংস্কারধর্মী নানান পরিকল্পনা পেশ করা হতে থাকে মুজিবের কাছে। বিশেষত ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে ১৫ দফার একটি করণীয় পেশ করা হয়। যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল : জাতীয় ঐক্য ও মুক্তি সংগ্রামের প্রতীক মুজিবকে সরকারের উর্ধ্বে স্থান দিয়ে তাঁর নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি অক্ষুন্ন রাখা, আওয়ামী লীগের পরিবর্তে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল দলকে নিয়ে সরকার গঠন করা, প্রশাসনসহ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে মুক্তিযােদ্ধাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিয়ােগ দেওয়া ইত্যাদি।
ছাত্রলীগের এই অংশের দাবি-দাওয়াতে তখন ‘পুঁজি বিনিয়ােগ বিরােধী মনােভঙ্গিটি ছিল বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়- যদিও স্বাধীন দেশের পুনর্গঠনে যে কোনাে প্রকারে সেটাই ছিল প্রয়ােজনীয়। জাসদ ছাত্রলীগের সেসময়ের একটিউল্লেখযােগ্য শ্লোগান ছিল : জ্বালাে জ্বালাে, আগুন জ্বালাে-উঠতি পুঁজির গদিতে আগুন জ্বালাে একসাথে। উপরে উল্লিখিত ১৫ দফা পেশের পরপর বঙ্গবন্ধুর হাতকে শক্তিশালী করতে বাহাত্তরের ৭ জুন শরীফ নুরুল আম্বিয়া ও শাজাহান সিরাজ ‘সংগ্রাম-স্বাধীনতা-বিপ্লব’ শীর্ষক এক পুস্তিকায় মুদ্রিত আকারে আরও কিছু করণীয়’ তুলে ধরেন, যার মধ্যে নিম্নোক্ত সুপারিশটি লক্ষ্যণীয় :
বাংলার রাজনৈতিক আকাশ আজ বিদেশী শত্রুমুক্ত। কিন্তু অর্থনৈতিক আকাশে অশুভ নক্ষত্রের অভ্যুদয় ঘটছে। …বাংলাদেশ সরকার জাতীয়করণ আইন ঘােষণা হওয়ার পরই এ দেশে বৃহৎ পুঁজির সৃষ্টির অবকাশ না থাকলেও অতি সঙ্গোপনে উঠতি পুঁজি ও মাঝারি পুঁজির জন্য দেখা যাচ্ছে।.. (সরকারের) দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনার লক্ষ্য হতে হবে ব্যক্তি শােষণ, শ্রেণী শােষণ বন্ধ করা, আমলা ও আমলাতন্ত্রের উৎখাত, ছােট-মাঝারি-বড়, সকল ধরনের পুঁজি বা উৎপাদনযন্ত্রকে রাষ্ট্রায়ত্তকরণ এবং বুর্জোয়া মনােভাবাপন্ন শ্রেণীকে সকল প্রকার সুযােগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা।১৮৬
…………………………………………………………………
১৮৬) পুঁজি ও পুঁজি বিনিয়ােগ সম্পর্কিত হবু জাসদ নেতাদের উল্লিখিত অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির আশ্চর্যরকম মিল পাওয়া যায় বাংলার বাণীতে সেসময় প্রকাশিত শেখ ফজলুল হক মণির ক্ষুরধার কলামগুলােতে এবং সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের ‘অর্থনীতিবিদদের তাবৎ প্রয়াসে। এইরূপ দৃষ্টিভঙ্গিরই সম্মিলিত ফল হয়েছিল চুয়াত্তর-পঁচাত্তরের অর্থনৈতিক বিপর্যয়- যদিও তার জন্য কেবল শেখ মুজিবুর রহমানকেই দোষের ভাগীদার হতে হয়েছে। বিনিয়ােগ বিরােধিতা ও রাষ্ট্রায়ত্তকরণকে এসময় সমাজতন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করার সুপরিকল্পিত প্রয়াস দেখা যায় খােদ রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা কমিশনের প্রভাবশালী পঞ্জিত সদস্যদের মাঝে । তার একটি নজির হিসেবে এখানে বিশিষ্ট শিল্পপতি মঞ্জুর এলাহির একটি সাক্ষাৎকার থেকে ঐ সময়কার বিনিয়ােগ অভিজ্ঞতার একটি খণ্ডাংশ তুলে ধরা হলাে :
..১৯৭৩ সালে চিন্তা করছিলাম ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে যাবাে। তখন আবার বঙ্গবন্ধু সরকার ঠিক করে দিল, পঁচিশ লাখের উপরে কোন ইন্ডাস্ট্রি করতে পারবে না কেউ। প্রজেক্ট কস্ট সিলিং করে দিল। ভাবলাম রিকশা তাে খুব চলে আর সাইকেল রিকশার সবচেয়ে বেশি বিক্রয় হয় স্পেক। স্পেকটা ভেঙ্গে যায়। ভাবলাম একটা স্পােক ইন্ডাস্ট্রি দেব। এপ্লাই করলাম শিল্প ব্যাংকে। শিল্প ব্যাংকে আমার বন্ধুবান্ধব ছিল। জেনারেল ম্যানেজার মােস্তফা কামাল ছিলেন আমার রুমমেট। বলল, দোস্ত তুমি কোন চিন্তা করাে না। আমি তােমার প্রােপজালটা নেক্সট বাের্ড মিটিংয়ে পাস করিয়ে দেব। হয়ে যাবে। …কিন্তু আর পাসই হয় না। কী ব্যাপার? বললাে প্ল্যানিং কমিশনে গেছে, তারা না করে দিয়েছে। প্ল্যানিং কমিশনের সঙ্গে একটা স্পােক ইন্ডাস্ট্রির কী সম্পর্ক আমি বুঝি না। প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ছিলেন নুরুল ইসলাম। সদস্য রেহমান সােবহান। আমি তাে ভাবলাম পােয়াবারাে। (দু’জনই আমার শিক্ষক)। সােবহান স্যারকে ফোন করে গেলাম। বললাম, আমার স্পেক ইন্ডাস্ট্রির একটা প্রস্তাব আছে, আপনি তা না করে দিয়েছেন? উনি বললেন, হ্যা আমরা সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তি করেছি একটা সাইকেল ইন্ডাস্ট্রি করবাে। ওর মাধ্যমেই আমরা সারা দেশ কাভার করবাে। যত সাইকেল পার্টস আছে সব সেখানেই তৈরি হবে। আমি বললাম, স্যার ওদের স্পেসিফিকেশনই আলাদা। চাইনিজদের সঙ্গে আমাদের একটা মিল আছে। বললেন, না না আমরা অলরেডি সাইন করে দিয়েছি। তারা আসবে, আমরা জমির চেষ্টা করছি।…আমি তর্ক করছি, উনি ক্ষেপে গেলেন। বললেন, মনজুর, পশ্চিম পাকিস্তানী উদ্যোক্তাদের আমরা তাড়িয়েছি পুঁজিবাদ তাড়াতে ।… দেখুন, সৈয়দ মনজুর এলাহী, আত্মজৈবনিক সাক্ষাৎকার, সাপ্তাহিক, ২৬ আগস্ট ২০১০, ঢাকা, পৃ. ২১৫।
Page 27
জাতীয়করণের প্রসঙ্গ ব্যতীত শরীফ নুরুল আম্বিয়া ও শাজাহান সিরাজদের দফায় দফায় প্রদত্ত উপরােক্ত সুপারিশসমূহের খুব কমই সেসময় গৃহীত হয়। বিশেষ করে রাজনৈতিক সুপারিশসমূহ সরকার অবজ্ঞা করে তাৎক্ষণিকভাবে ফলে সিরাজুল আলম খানদের নিউক্লিয়াসের পক্ষে অনুসারীদের রাজনৈতিকভাবে সন্তুষ্ট রাখা দুরূহ হয়ে পড়ে- যে কর্মীদের তারা বিগত এক দশক ধরে বুঝিয়ে এসেছে, স্বাধীনতা মানেই ‘সােনার বাংলা এবং যে কর্মীরা এও দেখেছিল, সিরাজুল আলম খান ও “নিউক্লিয়াস’ যা চেয়েছে মুজিবও তাই করেছেন এতদিন; কিন্তু এবার সেই সমীকরণ কাজ করছে না এবং সােনার বাংলাও অনিশ্চিত।
উপরন্তু বাহাত্তরেই এইরূপ ভিন্নমতালম্বীদের সরকারি বিভিন্ন পেটোয়া বাহিনী হয়রানি, নাজেহাল ও আটক করতে শুরু করে। মাওলানা ভাসানী ছাড়া আর কাউকেই জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিকভাবে ভিন্নমত প্রকাশের অনুমতি দেওয়া হচ্ছিল না তখন। সিরাজদের পুরাে গ্রুপটি তাই এ পর্যায়ে অস্তিত্বের সংকটের আশঙ্কায় পড়ে যায়। এর বাইরে ছিল দেশব্যাপী সর্বহারা পার্টি ও নকশাল ধারার রাজনীতির উত্থান এবং তরুণদের সেইদিকে ধাবিত হওয়ার বাস্তব এক ‘বিপজ্জনক’ সম্ভাবনা। জাসদ গঠনে এই শেষােক্ত নিয়ামকটি সম্পর্কে এই লেখার
Page 128
অন্যত্র আলােকপাত করা হয়েছে। এইরূপ পরিস্থিতিরই সামগ্রিক যােগফল ছিল জাসদ। বলা যায়, একাত্তরের মার্চে সিরাজুল আলম খান পতাকা, জাতীয় সংগীত ইত্যাদি তৈরি করে মুজিবকে যেমন এক ধরনের রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার মাঝে ফেলে দিয়েছিলেন মাত্র ১২ মাস পরেই মুজিবও নীরব এক রাজনৈতিক উপেক্ষার মাধ্যমে সিরাজকে অনুরূপ এক বিপজ্জনক পরিস্থিতির মাঝে ফেলে দেন। প্রথমােক্ত খেলার ফল ছিল যুদ্ধ, আর দ্বিতীয় খেলার ফল দাঁড়িয়েছিল গৃহযুদ্ধ।
ঠিক এসময়টিতে জাসদের নেতৃস্থানীয় সংগঠকদের অনেকে আশা করতেন। তাজউদ্দীন শেষপর্যন্ত তাদের সঙ্গে চলে আসবেন। আসবেন আবদুর রাজ্জাকও। কিন্তু এদের অজ্ঞাতে ভিন্ন আরেকটি মহল অপর একটি পরিকল্পনা নিয়ে এগােতে থাকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বর্তমান জাসদের একজন সংগঠকের মতে তৃতীয় এই পরিকল্পনাটি ছিল এমন যে, তিয়াত্তরের নির্বাচন শেষে তাজউদ্দীনকে সভাপতি করে নতুন একটি দল গঠিত হবে। তার আগে নির্বাচনে বিশেষভাবে বাছাইকৃত অন্তত একশত জনের মনােনয়ন পাওয়া ও বিজয় নিশ্চিত করা হবে; আর তরুণ এই এমপিরাই হবেন নতুন দলটির শক্তিভিত। দেশের বাইরের একটি মহল যখন এই পরিকল্পনা নিয়ে ধীরে ধীরে এগােচ্ছে তখনি হুট করে প্রায় একক সিদ্ধান্তে সিরাজুল আলম খান জাসদ গঠন করে ফেলেন। আর এসময় জাসদের অন্যতম শ্লোগান হয়ে ওঠে “রুশ-ভারতের দালালেরা হুশিয়ার-সাবধান। এত দ্রুত জাসদের গােড়াপত্তন, নতুন দলটির প্রধান শ্লোগান নির্ধারণ, ভারত বিরােধী আইকন মেজর এম এ জলিলকে নতুন দলের সভাপতি নির্বাচন, মুজিব সরকার থেকে তাজউদ্দীনকে অপসারণ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে আবদুস সামাদ আজাদকে সরিয়ে ড. কামাল হােসেনকে নিয়ােগ, যুদ্ধকালে বাংলাদেশকে ঘিরে তাজউদ্দীন সৃষ্ট ভারতীয় বলয় থেকে বেরােনের জন্য মুজিবের প্রাণান্তকর চেষ্টা এসবই ছিল একসূত্রে গাঁথা। মুজিব তখন দেশজুড়ে ভারত বিরােধী জন-জোয়ার চাইছিলেন, বললেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপরােক্ত নেতা।
প্রশাসনিকভাবে এসময় মুজিবের উল্লেখ্যযােগ্য এবং দূরদর্শী এক কৃতিত্ব ছিল বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বেসামরিক প্রশাসনকে প্রত্যাহার করানাে। এই উদ্যোগের পটভূমিটি এ পর্যায়ে ব্যাখ্যা করা প্রাসঙ্গিক হবে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন আত্মসমর্পণ করে তখন পূর্ব-পাকিস্তানের প্রশাসনের কর্তৃত্ব নেয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার বা ঐ সরকারের কাউকে উপস্থিত পাওয়া যায়নি। এসময় নতুন দেশের নবীন প্রশাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন ভারতীয় জেনারেল বি এন সরকার।১৮৭ মে. জে. সরকার
……………………………………………………………….
১৮৭) Aftab Ahmed, Politics Ethnicity and Security: Bangladesh and South Asian Perspective, Riverside Press, 2012, Dhaka, p.6.
Page 129
একাত্তরের প্রথম দিকে ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ-এর মিলিটারি সেক্রেটারি। একই বছরের শেষের দিকে তাকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সিভিল এফেয়ার্স অর্গানাইজেশনের (Civil Affairs Organization-CAO) প্রধান করা হয়। বাংলাদেশের যুদ্ধকালেই, বিশেষত ভারতীয়রা যখন যুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ হস্ত ক্ষেপের দিকে এগিয়ে যায় তখনই প্রথমবারের মতাে ভারতীয় সেনাবাহিনী CAO তৈরি করে তাদের ইস্টার্ন কমান্ডের অধীনে। শুরুতে CAO-এর প্রধান ছিলেন ব্রিগেডিয়ার এস সি সিনহা, পরে বি এন সরকার ঐ দায়িত্ব নেন।১৮৮ এসময় প্রস্তাব করা হয় যে, ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের সহায়তায় সেদেশের পুলিশ নতুন দেশটির আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব নেবে এবং প্রশাসন দেখবে সেদেশের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। বিশেষ করে বাংলাদেশের সকল মন্ত্রণালয়ে ন্যূনপক্ষে একজন করে ভারতীয় প্রশাসনিক উপদেষ্টা থাকবেন। এসব নিয়ে আলাপচারিতা ও মতবিনিময়ের মধ্যবর্তী সময়ে কার্যত বাংলাদেশ পরিচালনা করছিল বি এন সরকারের নেতৃত্বে CAO, কলকাতা থেকে প্রবাসী সরকারের ঢাকায় প্রত্যাবর্তনের নজরদারির দায়িত্বও ছিল বি এন সরকার ও CAO-এর ওপর। যুদ্ধ জয় সত্ত্বেও অন্তত ছয় দিন পর্যন্ত প্রবাসী সরকার নিকটবর্তী কলকাতায় অবস্থান করেও মাতৃভূমিতে আসতে ব্যর্থ হয়। মাঝের এই সময়টিতে বি এন সরকারই ছিলেন কার্যত বাংলাদেশের বেসামরিক প্রধান।১৮৯ এসময়ের উল্লেখযােগ্য ঘটনা ছিল ঢাকাসহ সকল জেলা থেকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণকৃত সকল অস্ত্র ভারতে নিয়ে যাওয়া। এই প্রক্রিয়ায় কেবল যে অস্ত্রসম্ভার নিয়ে নেয়া হয় তাই নয়- বাস, ট্রাক, ভারী কল-কারখানাও খুলে খুলে নিয়ে নেয়া হয়। এইরূপ লুণ্ঠনের বিরােধিতা করতে গিয়েই সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল CAO-এর রােষানলে পড়েন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের যুদ্ধকালীন সামরিক নেতৃত্বও CAO-এর কার্যক্রমে এক ধরনের
……………………………………………………………….
১৮৮) Aftab Ahmed, Ibid.
১৮৯) বাংলাদেশে বি এন সরকারের ঐ সময়কার ভূমিকার সঙ্গে একালে (২০০৩-২০০৪ সময়ে), যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনীর অধীনে ইরাকে Paul Bremer-এর ভূমিকার কিছুটা তুলনা করা যায়। ইরাকে ন্যাটো বাহিনী ঢুকে পড়ার পর Paul Bremer-কে সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধি হিসেবে প্রশাসক’ করে পাঠানাে হয়েছিল । Paul Bremer সেখানে CPA (Coalition Provisional Authority) গড়ে তুলে তার স্বঘােষিত প্রশাসক তথা দেশটির প্রধান নির্বাহী হন। ইরাকের এই CPA-এর মতােই ছিল একাত্তরে বাংলাদেশে বি এন সরকারের নেতৃত্বাধীন CAO, প্রশাসক হিসেবে Paul Bremer ডিক্রি জারি করে ইরাক পরিচালনা করতেন। তাঁর প্রথম ডিক্রি ছিল সেদেশের বাথ পার্টি নিষিদ্ধ করা; দ্বিতীয় ডিক্রি ছিল ইরাকের সেনাবাহিনী ভেঙে দেয়া ইত্যাদি। তীব্র বিক্ষোভের মুখে ২০০৪-এর জুলাই থেকে ইরাকিরা Paul Bremer-এর হাত থেকে ধীরে ধীরে তাদের কিছু স্বাধিকার ফিরে পায়। বাংলাদেশে CAO গুটিয়ে যেতে থাকে মুজিব আসার পর।
Page 130
নীরব সহযােগিতাই দিয়ে গেছে। খােদ ওসমানী দেশে ফিরেছিলেন- বিস্ময়করভাবে, যুদ্ধ বিজয়ের আট দিন পর। যুদ্ধকালীন ৭ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার কাজী নূরুজ্জামান ঐসময়কার পরিস্থিতি সম্পর্কে লিখেছেন,
We knew that the Indians had whisked away all the Pakistani weapons, ammunitions, trucks, tanks and cannons. Our military HQ had to know it. However, the Mukti Bahini was not directed to do anything about it. Major Jalil of Sector 9 was relatively young, patriotic, and fierce. He stood up against the Indians when they started to take away cars, buses, trudks, factory equipment and materials, just as I had tried to stop them from carrying off jute products from Mohodipur sub-sector after December 16. But with Jalil, it got complicated. He got into trouble. He was arrested and brought to Dhaka. Our military HQ had many charges agaunst him. ১৯০
খােদ সেক্টর কমান্ডার এম এ জলিলও তার যুদ্ধকালীন আত্মজীবনীতে১৯১ বেশ খেদের সঙ্গে সে সময়কার ঘটনাবলি স্মরণ করেছেন। তিনি লিখেছেন,
…সুপরিকল্পিত উপায়ে তারা (ভারত) বাংলাদেশকে লুণ্ঠন করে। খুলনা ও যশােরে আমি তাদের লুট দেখেছি। ভারত যদি মানবতার খাতিরেই যুদ্ধ করে থাকে তাহলে এ ধরনের লুট বড় এক হীনমন্যতার পরিচয়।…একাত্তরের ১৭ ও ১৮ ডিসেম্বর রাতে ভারতীয় সৈনিকরা কারফিউ দিয়ে পরিকল্পিতভাবে দোকান-পাট, ফ্যাক্টরী, পাের্ট, রেডিও স্টেশন, নিউজপ্রিন্ট মিল লুট করে। এমনকি ছােট ছােট বাড়ি-ঘরও বাদ যায় নি। সারা রাত ধরে এই লুণ্ঠন চলে। এর বাইরে ট্রাকে করে পাক-হানাদারদের পরিত্যক্ত অস্ত্রশস্ত্র, গাড়ি, সরঞ্জাম ভারত সেদেশে নিয়ে গেল। যেন তারা দেশটা জয় করেছে। ১৮ ডিসেম্বর এই স্বেচ্ছাচারিতার বিবরণ লিখে ওদের অধিনায়কের কাছে পাঠিয়েছিলাম । মি, তাজউদ্দীনের কাছেও এক কপি পাঠিয়েছিলাম।… এই প্রতিবাদলিপি পাঠাবার পর সব যেন কর্দমাক্ত হয়ে উঠলাে। ৩১ ডিসেম্বর যশােরের কাছে ওত পেতে আমাকে আটক করা হয়। তারা আমাকে মেরেই ফেলতাে- যদি না আমার সঙ্গে ১৫ জন সাথী থাকত।… যশাের ক্যান্টনমেন্টের এক নির্জন কক্ষে আমাকে নিক্ষেপ করা হলাে।
……………………………………………………………….
১৯০) Quazi Nooruzzman, Ibid, p. 110-111.
১৯১) সীমাহীন সমর, মেজর জলিল রচনাবলি, সম্পাদনা: মাসুদ মজুমদার, প্রকাশক: সায়মা জলিল, ঢাকা, ১৯৯৭, পৃ. ২১২-২১৩.
Page 131
আমি ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ারকে জিজ্ঞাসা করলাম,
‘আমার বিরুদ্ধে অভিযোেগ? তিনি উত্তর দিলেন, “তুমি বিদ্রোহী।
দু’জন সেক্টর কমান্ডারের উপরের দুটি বিবরণ থেকে স্বাধীনতা-উত্তর দেশের প্রশাসনিক নৈরাজ্য সম্পর্কে অনেকখানি ধারণা পাওয়া যায়। যুদ্ধবিধ্বস্থ দেশে এটা অস্বাভাবিক নয়। তবে বাংলাদেশে যা ঘটেছে তা ছিল পরিকল্পিত।১৯২ বি এন সরকারের নেতৃত্বাধীন CAO-এর প্রশাসনের ওপরই উপরােক্ত পরিস্থিতির দায় বর্তায়। একই সময়ে প্রবাসী সরকারের আগমনও বিলম্বিত করা হয়। তবে বিস্ময়করভাবে সরকারের শারীরিক অনুপস্থিতির মাঝেই এসময় স্থানীয় মুদ্রার মান। হ্রাস করা হয়। ১৬ ডিসেম্বর পরবর্তী এই সময়টিতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে ডি পি ধর ঢাকা আসেন (২৩ ডিসেম্বর) এবং ঢাকায় তাঁর একটি উল্লেখযােগ্য কর্মসূচি ছিল বাংলাদেশের সচিব পর্যায়ের আমলাদের এক সমাবেশে সভাপতিত্ব করা! ডি পি ধরের ঐ বৈঠকের পরই এক ঘােষণায় সরকারি কর্মকর্তাদের বেতনের সর্বোচ্চ সিলিং এক হাজার টাকায় বেঁধে দেওয়া হয়। ফলে অনেকের মাইনে কমে যায়। এসময় একদল ভারতীয় বেসামরিক প্রশাসনিক উপদেষ্টাও ঢাকায় চলে আসেন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পরিচালনার লক্ষ্যে। যে বিষয়ে সাংবাদিক নির্মল সেনসহ অন্যান্য সূত্রের সমর্থনসূচক ভাষ্যও এ গ্রন্থের অন্যত্র (৪.ঘ উপ-অধ্যায়ের ২৬৭ ও ২৭০ নম্বর তথ্যসূত্রে) তুলে ধরা হয়েছে। এ বিষয়ে মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনের কীরূপ ব্রিতকর অবস্থা তৈরি হয় তার বিবরণ
………………………………………………………………..
১৯২) ভারত এসময় কী পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে যায় তার কোনাে নির্ভরযােগ্য হিসাব পাওয়া যায় না। তবে যুদ্ধের পর পাকিস্তানে প্রধান বিচারপতি হামুদুর রেহমানের নেতৃত্বে যে তদন্ত কমিশন হয় তার প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, লুণ্ঠিত অস্ত্রের মধ্যে আর্মাড ও আর্টিলারি রেজিমেন্টের বিপুল মর্টার ব্যাটারি, ইনফ্যানট্রি’র হাজার হাজার এলএমজি ও মেশিনগান ছাড়াও অন্তত ৬৩টি ট্যাংক, পাঁচটি সিগনাল ও চারটি ইঞ্জিনিয়ার্স ব্যাটালিয়নের সরঞ্জাম, ১০টি গানবােট, ১৮টি এফ-৮৬ ফাইটার ইত্যাদি রেখে গিয়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। যা বাংলাদেশ পায়নি।
সবচেয়ে বিস্ময়কর ছিল পাটকলগুলাের ভারী যন্ত্রপাতির প্রতি ভারতীয়দের পরিকল্পিত আকর্ষণ। এ সম্পর্কে কমিশন লিখেছে, The loot was partly planned and organized for the benefit of Indian industrialists who were interested in acquipment acquiring the modern jute machinery installed in East Pakistan since 1947.
প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ দিয়ে উপরােক্ত কমিশন এও জানিয়েছে, উল্লিখিত সরঞ্জাম দ্রুত সরিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে সেসময় খুলনা থেকে কলকাতা পর্যন্ত প্রতিদিন একের পর এক ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়। এই প্রতিবেদন পাকিস্তানের এলিট সমাজ ও সেনাবাহিনীর জন্য চরম অপমানকর বিবেচিত হতে পারে এবং তাদের নৈতিক মনােবল আরও ভেঙে পড়তে পারে বিবেচনায় ২০০০ পর্যন্ত অপ্রকাশিতই থেকে যায়। প্রতিবেদনটির বিস্তারিত দেখুন, The Report of the Hamoodur Rehman Commission of inquiry into the 1971 war, Vanguard, Lahore, p. 494.496-97.
Page 132
পাওয়া যায় সেই সময়কার কুমিল্লার এডিসি মােফাজ্জল করিমের নিম্নোক্ত বিবরণ থেকে :
(স্বাধীনতার পরপর) একদিন কুমিল্লায় আমাদের অফিসে নাজিল হলেন এক সুদর্শন ভদ্রলােক। তিনি নাকি এসেছেন দিল্লি থেকে- ভারত সরকার তাকে পাঠিয়েছে স্থানীয় প্রশাসনকে সহায়তা করতে। তিনি মি. বিধুই। তিনি একজন আইএএস অফিসার- দিল্লির ইউনিয়ন গভর্মেন্টের খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি.সেক্রেটারি ।..তার অনুরােধে জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার বৈঠকের ব্যবস্থা করলাম …তিনি জানালেন, আমাদের ধ্বংসপ্রাপ্ত ইকোনমি পুনর্গঠনের জন্য জনশক্তি কী লাগবে, সে সম্বন্ধে একটি সম্যক ধারণা তিনি পেতে চান। তাঁর রিপাের্টের ভিত্তিতে জনপ্রশাসনে, প্রকৌশল ও স্বাস্থ্যখাতে দিল্লি দ্রুত দক্ষ জনবল পাঠাবে।…১৯৩
উল্লেখ্য, এটা কোনাে বিচ্ছিন্ন চিত্র ছিল না। ঢাকাসহ অন্যত্রও এ রকম ঘটনা ঘটেছিল। তবে ভারতীয় প্রশাসনিক উপদেষ্টারা স্থানীয় বাধার মুখে বাংলাদেশে কোনাে কাজ করতে পারেননি। অনেককে বেশ নাজেহাল হয়েই বাংলাদেশ ছাড়তে হয়।১৯৪ বিশেষ করে মুজিব দেশে প্রত্যাবর্তনের পরবর্তী সময়ে জনমনস্ত
……………………………………………………………..
১৯৩) মােফাজ্জল করিম, জীবন মৃত্যু পায়ের ভত্য, অনন্যা, ২০১৩, ঢাকা, পৃ ৭২। উল্লেখ্য, সিএসপি কর্মকর্তা মােফাজ্জল করিম পরে ১৯৯৯ সালে প্রশাসন থেকে সচিব হিসেবে অবসর নিয়েছিলেন।
১৯৪) একজন বিদেশি হয়েও ডি পি ধর কীভাবে বাংলাদেশের আমলাদের সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন এবং তার ঐ ভূমিকা কীভাবে সেসময় প্রশ্নের উদ্রেক করেছিল সে বিষয়ে কূটনীতিবিদ ফারুক চৌধুরীর বিবরণ দেখুন: দেশ-দেশান্তর, জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ১৯৯৯, ঢাকা, পৃ. ৮১-৮২। অন্যদিকে ঢাকায় বিভিন্ন স্তরের ভারতীয় প্রশাসকদের আগমন ও তার বিপরীতে স্থানীয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে শিক্ষাবিদ সৈয়দ আলী আহসান লিখেছেন,
‘বাংলাদেশ সৃষ্টির সাথে সাথে ভারতীয় কিছু পদস্থ কর্মকর্তা আমাদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টা হিসেবে যােগ দেন।… রেডিওতে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন রণেন আচার্য। কিন্তু আশরাফুজ্জামানের নেতৃত্বে রেডিওর কর্মচারীরা তাকে তাড়িয়ে দেন এবং তিনি ভারতীয় দূতাবাসে আশ্রয় নেন। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়েও একজন ভারতীয় এসেছিলেন। মিল্কভিটা দুগ্ধ প্রকল্পকে সাহায্য করার জন্য ভারতীয় ‘আমূল প্রকল্পের একজন কর্মচারী এসেছিলেন।…এরা বেশিদিন ঢাকায় থাকেননি। এ দু’জন আমার বাসায়ও এসেছিলেন। আমার বিশ্বাস, কলকাতায় অবস্থানরত তাজউদ্দীন সরকার ভারতের সাহায্যের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্তে এসেছিলেন। তা না হলে ভারত কেন তাদের কর্মচারীদের আমাদের দেশে পাঠাবেন? দেখুন, সৈয়দ আলী আহসান, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩১।
আরেকজন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান (যিনি প্রবাসী সরকারের প্ল্যানিং সেলে তখনকার প্রধানমন্ত্রীর একজন ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে কাজ করেছেন) এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিয়ে তার আমার একাত্তর’ গ্রন্থে জানাচ্ছেন, ভারত এসময় বাংলাদেশের প্রত্যেক জেলায় তাদের একজন করে কর্মকর্তাকে সংযুক্ত করতে আগ্রহী ছিল। (সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ১৯৯৭, পৃ. ১৪৫)।
Page 133
ত্ত্বে এইরূপ ভারতীয় সহায়তার ব্যাপারে মনােভাবের ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য যায়। ১৯৭২-এর ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে মুজিব কলকাতা সফরকালে ইন্দিরা গান্ধীকে এ মর্মে সম্মত করাতে সমর্থ হন যে, CAO কাঠামাে বাংলাদেশ থেকে ধীরে ধীরে প্রত্যাহার করা হবে। সে অনুযায়ী পরবর্তী তিন সপ্তাহের মধ্যে সেটা বাস্তবায়িত হয়।১৯৫ বস্তুত, বাংলাদেশের হবু সরকার তাদের ইচ্ছা ও প্রত্যাশা মতাে পরিচালিত হয় কি না এ নিয়ে যুদ্ধের সময় থেকে ভারতীয়রা উদ্বিগ্ন ছিল। যুদ্ধকালীন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে Richard sisson ও Leo E. Rose তাদের যৌথ গবেষণায় মন্তব্য করেছেন,
The Indians were skeptical not only of the capacity of the Bangladeshi political groups…but also of the political orientation and stability of any Bangladeshi government not set up under Indian guidance and supervission.১৯৬
তাজউদ্দীন আহমদ ভারতীয় উপরােক্ত উদ্বেগ মেটাতে বরাবর সর্বোচ্চ করেছেন। কিন্তু, মুজিব শাসনদণ্ড পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে ধীরে ধীরে তাজউদ্দীন ও ভারতীয় পরিকল্পনায় কিছু কাটছাট শুরু করেন। এসময় রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে আওয়ামী লীগের ভেতর থেকেই আরেকটি রাজনৈতিক কাঠামাে- বীজের অঙ্কুরােদগম আকারে দৃশ্যমান হতে থাকে। ভারতীয় বাহিনী প্রত্যাহারের ছয় মাস
…………………………………………………………..
১৯৫) তবে মুজিব কর্তক CAO-কে নিষ্ক্রিয় করা হলেও দেশে ঐসময় সরকারি তরফ থেকে কোনাে ধরনের ভারত বিরােধী সমালােচনাই সহ্য করা হচ্ছিল না। কেবল মুজিব বা তার দলই নয় সিপিবি ও ন্যাপও এক্ষেত্রে তীব্র স্পর্শকাতরতা দেখিয়ে যাচ্ছিল। যার এক প্রকাশ হিসেবে দেখা যায়, যুদ্ধশেষে দেশে আসার পর দৈনিক বাংলায় মাওলানা ভাসানী এক সাক্ষাৎকারে ‘ভারতীয় বন্ধুত্বের স্বরূপ সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করায় পরদিনই কাগজটির সামনে বিক্ষোভ দেখায় সিপিবি’র অঙ্গশাখা ছাত্র ইউনিয়ন। ঐ বিক্ষোভের চাপে সরকারি ঐ দৈনিক ২৬ জানুয়ারি সাক্ষাৎকারটি প্রকাশের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে। এটা ছিল স্বাধীনতা-উত্তর গণমাধ্যমে প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক চাপের শুরু- যে চাপ আর কখনাে কাটিয়ে ওঠা যায়নি। উল্লেখ্য, মাওলানা ভাসানী ১৯৭২-এর ২২ জানুয়ারি যখন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তখন শাসক গােষ্ঠীর তরফ থেকে কেউ তাকে কোথাও স্বাগত জানানাের জন্য উপস্থিত ছিলেন না। নীরবে নিভতে তিনি টাঙ্গাইলের সন্তোষে জীর্ণ কুটিরে প্রবেশ করেছিলেন। আর ইতিহাসের ঠিক ঐ সময়টিতে ১৯৭২ সালের ২২ এপ্রিল বাংলাদেশে লেনিনের ১০২তম জন্মবার্ষিকী পালন করতে গিয়ে সিপিবি নেতা মনি সিংহ বলেন, মহান লেনিনের আদর্শ অনুসরণ করেই মুজিব সরকার বাংলাদেশের উন্নয়নে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ। করেছে। দেখুন: দৈনিক সংবাদ, ২৩ এপ্রিল ১৯৭২।
১৯৬) War and Secession: Pakistan, India and the Creation of Bangladesh, University of California Press, 1990, P. 207.
Page 134
নাগাদ জাসদের প্রথম আহ্বায়ক কমিটি ঘােষিত হয়। এই কমিটির সাত সদস্যের তালিকায় সপ্তম ব্যক্তি হিসেবে যিনি অন্তর্ভুক্ত হন সেই রহমত আলী তাজউদ্দীনের ইচ্ছাতেই নতুন দলের নেতৃত্বে সংযুক্ত হন বলে কথিত ছিল। কিন্তু চূড়ান্তভাবে জাসদ গড়ে ওঠার পর তাজউদ্দীন তাে তাতে শামিল হনই নি উপরন্তু তার ‘প্রতিনিধি হিসেবে চিহ্নিত রহমত আলীও দ্রুত জাসদ ত্যাগ করেন।১৯৭ যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তখন ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগে কোণঠাসা হয়ে পড়ছিলেন। এর চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখা যায়, যুদ্ধ-পূর্বকালে আওয়ামী।লীগের সফল সাধারণ সম্পাদক এবং যুদ্ধকালীন সফল প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে মাত্র তিন মাসের মধ্যে আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠন করার যে উদ্যোগ নেন তাতে সাধারণ সম্পাদক করা হয় জিলুর রহমানকে। এক্ষেত্রে জিল্লুর রহমানের প্রধান যােগ্যতা হিসেবে দেখা হয় ‘মুজিববাদ’-এর প্রতি তাঁর দৃঢ় সমর্থনকে।১৯৮ এসময় গণপরিষদেও ডেপুটি লিডার পদে তাজউদ্দীনকে না নিয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে নেয়া হয়। ১৯৯
……………………………………………………………….
১৯৭) এসময় আবদুর রাজ্জাককেও জাসদে প্রত্যাশা করা হলেও তিনি পিছু টান দেন।
১৯৮) জোহরা তাজউদ্দীন-এর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলােকপাত করেছেন, কামাল হােসেন (তাজউদ্দীন আহমদ: বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং তারপর, অংকুর প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০৮, পৃ. ৫৪১)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের শিক্ষক ড. মাে. নূরুল ইসলাম, যিনি মুজিব বাহিনীর একজন যােদ্ধা এবং সিরাজুল আলম খানের একজন অনুরাগী শিষ্য ও ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন- বর্তমান লেখকের সঙ্গে ০৮ নভেম্বর ২০১২ তারিখে এক আলাপচারিতায় দাবি করেছেন, জাসদ গঠনের পেছনে জিল্লুর রহমানের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়াও একটি কারণ ছিল। তাঁর মতে, সিরাজ ঐ পদ পেতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু যুবনেতা মণিও একই আগ্রহ প্রকাশ করায় বিবাদ এড়াতে জিল্লুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। তবে সিরাজুল আলম খানের ঘনিষ্ঠ একজন প্রাক্তন রাজনৈতিক সংগঠক বর্তমান লেখককে বলেছেন, মুজিব নিজেই সিরাজুল আলম খানকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু শেষােক্তজন অজ্ঞাত কারণে তাতে রাজি হননি। এমনকি আওয়ামী লীগের সদস্য না হওয়া সত্ত্বেও কাকরাইলে এই দলের স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম যে সাংগঠনিক সম্মেলন বসে তাতে সিরাজুল আলম খানকে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে ডেলিগেট করা হয়েছিল। অন্যদিকে মনিরুল ইসলাম দাবি করেছেন, কাকরাইলে স্বাধীনতা-উত্তর আওয়ামী লীগের ঐ প্রথম কাউন্সিলে কামরুজ্জামানকে সভাপতি এবং আবদুর রাজ্জাককে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়ে মুজিব দলীয় ও সরকারি। আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেবেন এমনি কথা ছিল। বাস্তবে তা না ঘটায় ছাত্রলীগের সিরাজুল আলম খান সমর্থকরা ভাবতে শুরু করেন যে মুজিব বিশেষ কোনাে চাপের মধ্যে রয়েছেন। দেখুন, মনিরুল ইসলাম, পূর্বোক্ত, পৃ. ২২২।
১৯৯) এক্ষেত্রে মণির সমর্থক পরিমণ্ডলে একটি যুক্তি তুলে ধরা হয় এভাবে যে, ১৯৭০-এ নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের নিয়েই যেহেতু বাহাত্তরের গণপরিষদ গঠিত এবং যেহেতু জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি দলের উপনেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রাদেশিক পরিষদে মূলনেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন ক্যাপ্টেন (অব.] মনসুর আলী, তাই তাজউদ্দীনকে গণপরিষদে মুজিবের পরবর্তী মর্যাদায় অভিষিক্ত করার সুযােগ নেই। দেখুন, আমির হােসেন, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫০।
Page 135
সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাজউদ্দীন আহমদের অবস্থানের এভাবে কেবল অবনতিই ঘটছিল। যার চূড়ান্ত এক পর্যায়ে ১৯৭৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঘােষিত এবং ৭ জুনে গঠিত বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক লীগ (বাকশাল)’-এর কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি বা কেন্দ্রীয় কমিটি- কোথাও ঠাই হয়নি তাজউদ্দীন আহমদ- এর (যদিও নতুন দলের নামটি তার দেওয়া বলে কথিত রয়েছে২০০)। এ সময় বাকশালের ১৫ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটিতে ‘মুজিব বাহিনীর প্রতিনিধি হিসেবে দু’জনকে দেখা যায়। তিন জন সেক্রেটারি (জিল্লুর রহমান, শেখ ফজলুল হক মণি ও আবদুর রাজ্জাক)-এর দুজনই ছিলেন মুজিব বাহিনীর নেতা। এদের প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদাও দেওয়া হয়। লক্ষ্যণীয়, প্রবাসী সরকারে তাজউদ্দীন আহমদ ভারতীয় সমর্থন নিয়ে মুজিব বাহিনীর বৈরিতা সামাল দিলেও স্বাধীন দেশে শেখ মুজিবুর রহমান তাকে সেই সুরক্ষা দিতে পারেননি বা দেননি। মুজিব বাহিনী এবং আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে শেখ মণিই শেষপর্যন্ত ‘বিজয়ী হন। অন্যদিকে যুদ্ধোত্তর ছয় মাসের মধ্যে মুজিবের একান্ত বলয়ে তাজউদ্দীন ও সিরাজুল আলম খান উভয়ে ভূতপূর্ব গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেন প্রায় পুরােপুরিভাবে।
বলা বাহুল্য, সরকার থেকে তাজউদ্দীন আহমদ-এর অপসারণ এবং আওয়ামী ঘরানা থেকে সিরাজুল আলম খান ও তার অনুসারীদের বিচ্ছেদের পর অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর প্রভাব বিস্তারের একছত্র অবস্থা পেয়ে যান শেখ ফজলুল হক মণি । বাকশালের জন্য সাংবিধানিক আয়ােজনের আগে, অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারির পূর্বে শেখ ফজলুল হক মণি ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সদস্য মাত্র। কিন্তু একক জাতীয় দল বাকশাল গঠনের পর তাঁর কর্তৃত্ব একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামােগত রূপ পায়, কারণ আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও সিপিবি’র মতাে রাজনৈতিক দলসমূহের সদস্য ছাড়াও রাষ্ট্রের সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারীরাও বাকশালের সদস্য ছিলেন। কেবল তিন জন সম্পাদকের একজন হিসেবে নয়- চূড়ান্তভাবে বাকশালের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার কথা ছিল শেখ মণি’রই- যদিও প্রাথমিকভাবে ঘােষিত কমিটিতে এম মনসুর আলীর নাম ‘সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে উল্লেখিত হয়।২০১ ১৫ আগস্ট অধ্যায়ের কারণে বাধাগ্রস্ত না হলে সেটা
…………………………………………………………………
২০০) Mahfuz Ullah, ibid, p.124.
২০১) এ বিষয়টি নিশ্চিত হয় শেখ মণি কর্তৃত্ব এনায়েতুল্লা খানকে বাংলাদেশ টাইমস্-এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের আমন্ত্রণ সংক্রান্ত কথােপকথনের মধ্য দিয়ে। বাকশাল গঠিত হওয়ার পর দেশে চারটি দৈনিক পত্রিকা রেখে বাকিগুলাে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল । জীবনী ভিক্ষা পাওয়া দৈনিকগুলাের মধ্যে বাংলাদেশ টাইমস্ও ছিল। মণি ছিলেন এই দৈনিকের সম্পাদক। কিন্তু বাকশালের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিতে হবে বিধায় মণি টাইমস্-এর সম্পাদকের দায়িত্বভার ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং মুজিব ও মণি-এর মধ্যে ঐকমত্য হয় যে, টাইমস্-এর নতুন সম্পাদক করা হবে এনায়েতুল্লা খানকে। ১৯৭৫ সালের ২৯ জুলাই মুজিবের সঙ্গে এবং ৯ আগস্ট ফজলুল হক মণির সঙ্গে এতদবিষয়ে এনায়েতুল্লা খানের সাক্ষাৎ ও কথােপকথন হয়। এ বিষয়ে এনায়েতুল্লা খানের ভাষ্য এবং সংশ্লিষ্ট বিবরণের জন্য দেখুন, Mahfuz Ullah, Press Under Mujib Regime, Kakali Prokashani, 2002, Dhaka, p. 133. উপরােক্ত বিবরণের কৌতুহল ও কৌতুককর দিক হলাে, ১৯৭৫ সালেই এনায়েতুল্লা খান তাঁর লেখনীর জন্য মুজিবকর্তৃক বিশেষ ক্ষমতা আইনে কয়েকমাস কারাবরণ করলেও [লেখক মাহফুজ উল্লাহ’র বিবরণ থেকে আরও দেখা যায় একদলীয় ব্যবস্থা হিসেবে বাকশাল গঠনের পর দেশের গণমাধ্যম জগতকে চারটি দৈনিকে সীমিত করে আনার প্রক্রিয়ায় সম্ভাব্য করণীয় সম্পর্কে মুজিবকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সহায়তা করেছিল তিন সদস্য বিশিষ্ট যে সাংবাদিক কমিটি- তারও সদস্য ছিলেন এনায়েতুল্লা খান; কমিটির অন্য দুই সদস্য ছিলেন তােয়াব খান ও শহীদুল হক। দেখুন, Ibid, p. 133. এই বিষয়ে সমর্থনসূচক ভাষ্য মেলে সেসময় প্রেসিডেন্টের সহকারী প্রেস সচিব মাহবুব তালুকদারের লেখনিতেও। দেখুন: বঙ্গভবনে পাঁচ বছর, ইউপিএল, ঢাকা, পৃ. ১৪২।
Page 136
হতাে জাতীয় পরিসরে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় মুজিব বাহিনীর চূড়ান্ত বিজয় এবং নতুন অধ্যায়। আওয়ামী লীগের কাঠামােতে মুজিব বাহিনী থেকে উথিত নেতৃবৃন্দের মধ্যে কেবল নূরে আলম সিদ্দিকী বাকশালরূপী একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিরােধী ছিলেন।২৯২ বাকশাল গঠনের আগে মুজিব সিরাজুল আলম খানকে প্রত্যক্ষ-পরােক্ষ যে কোনােভাবে ঐ দলে সম্পৃক্ত হতে অনুরােধ করেছিলেন বলে দাবি করেছেন শেষােক্তজনের ঐ সময়কার এক তরুণ সহযােগী মহিউদ্দিন আহমদ। তার বর্ণনাটি ছিল নিম্নরূপ :
(১৯৭৪-এ) শেখ মুজিব অত্যন্ত চাপের মুখে ছিলেন। একদিকে তাঁর সাংবিধানিক গণতন্ত্রের প্রতি দায়বদ্ধতা, অন্যদিকে অবনতিশীল পরিস্থিতি।…অনেকদিন তার সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের ব্যক্তিগত যােগাযােগ ছিল না। জাসদের বিরুদ্ধে পুলিশ, রক্ষীবাহিনী ও আওয়ামী লীগের দলীয় সন্ত্রাস ছিল ব্যাপক। তথাপি খান ছিলেন মুক্ত। তাকে কেউ ছোঁয়নি। এ পর্যায়ে মুজিব, সিরাজুল আলম খানকে অনুরােধ করলেন। তিনি একটি জাতীয় দল করবেন, রব-জলিল যেন সেই দলে যােগ দেয়। তাদের যােগদান
…………………………………………………………………
২০২) আওয়ামী লীগের মধ্যে বাকশাল কার্যক্রমের অন্যান্য বিরােধী ছিলেন খন্দকার মােশতাক আহমদ, জেনারেল (অব.) ওসমানী, ব্যারিস্টার মইনুল হােসেন প্রমুখ। দেখুন, এম এ ওয়াজেদ মিয়া, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ, ইউপিএল, এপ্রিল ২০০০, ঢাকা, পৃ. ২৩৩। জাতীয় সংসদে নূরে আলম সিদ্দিকী একদলীয় ব্যবস্থার বিরােধিতা করে দীর্ঘ বক্তব্য রেখেছিলেন এবং সেই থেকে দলটিতে তাঁরও ‘ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে এবং আজও তিনি সেই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারেননি। জাতীয় সংসদের ১৯৭৪ সালের জানুয়ারিতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সংক্রান্ত আরও কিছু বিতর্ক থেকে দেখা যায়, জনাব সিদ্দিকী সেসময় কিছু কিছু বিষয়ে স্বাধীন মত প্রদানের চেষ্টা করতেন।
Page 137
যেন সিরাজুল আলম খান নিশ্চিত করেন। তিনি এই প্রস্তাবে রাজি হলেন না।..মুজিবের পরামর্শে মােহাম্মদউল্লাহ চুয়াত্তরের ২৮ ডিসেম্বর জরুরি অবস্থা ঘােষণা করেন। নীতিনির্ধারক মহলে সিদ্ধান্ত হয়, সিরাজুল আলম খানকে গ্রেফতার করা হবে। পরদিন তিনি মুবিনুল হায়দার চৌধুরীকে নিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে ভারত চলে যান। ফিরেন পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর।২০৩
মহিউদ্দিন আহমদের উপরােক্ত ভাষ্যটি স্বাধীনতা-উত্তর জাসদ রাজনীতি বােঝার জন্য খুবই ইঙ্গিতবহ। বর্তমান লেখক সিরাজুল আলম খানের নিজস্ব রাজনৈতিক আডডায় যাতায়াত করেন এমন ব্যক্তিদের ব্যবহার করে তার সঙ্গে পরােক্ষ আলাপচারিতার মাধ্যমে এটা নিশ্চিত হয়েছেন, বাহাত্তর থেকে বাকশাল গঠনের পূর্ব পর্যন্ত জাসদ রাজনীতির উত্তাল নানান ঘটনা প্রবাহের মাঝেও শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের যােগাযােগ ছিল। এমনকি তারা দেখা-সাক্ষাৎও করতেন। রক্ষীবাহিনী যখন জাসদ কর্মী পাওয়া মাত্র তুলে নিয়ে যাচ্ছে তখনও সিরাজুল আলম খানের নির্বিঘ্ন গােপন জীবনের যােগসূত্র ছিল সম্ভবত এখানেই।
একই বিষয়ে সিরাজুল আলম খানের ঘনিষ্ঠ তরুণ সহযােগী মনিরুল ইসলামেরও সমর্থনসূচক বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি। তিনি লিখেছেন :
(১৯৭২-এর মাঝামাঝি থেকে আওয়ামী লীগ থেকে জাসদের বিভক্তি প্রক্রিয়া শুরু হলেও) সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যােগাযােগের কোন ব্যত্যয় ঘটেনি। প্রায়ই গণভবনে দুজনের একান্ত সাক্ষাৎ হতাে এবং যা ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসে জরুরি অবস্থা বলবৎ করার আগ পর্যন্ত কার্যকর ছিল। এই সাক্ষাগুলােতে নিয়মিত মতবিনিময় অব্যাহত ছিল। ‘৭৪-এর ১৭ মার্চের পর জাসদের অনেকের নামে হুলিয়া থাকলেও আজিমপুরের একটি নির্দিষ্ট বাসায় সিরাজুল আলম খানের অবস্থান জাতির পিতার জানা ছিল। ফলে যােগাযােগের কোন ব্যত্যয় ঘটেনি।২০৪
এইরূপ বিবরণ থেকে অনুমান করা যায়, শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম থেকে প্রত্যাশা করেছেন, সিপিবি, ন্যাপ, সর্বহারা পার্টি ও পুরানাে নকশালদের হাত থেকে মুজিব বাহিনীর সশস্ত্র তরুণদের সরিয়ে রাখতে হলে জাসদের মতাে একটি কাঠামাে গড়ে উঠুক এবং জারি থাক। কিন্তু মুজিব বাহিনীর শেখ মণি গ্রুপ ও সিপিবি-ন্যাপের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি যখন বাকশাল কার্যক্রম অনুমােদন
…………………………………………………………..
২০৩) মহিউদ্দিন আহমদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৯৩।
২০৪) মনিরুল ইসলাম, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৩২।
Page 138
করেন তখন জাসদের কর্মী বাহিনীর ভবিষ্যৎ অভিমুখ নিয়ে মুজিব নিজেও উদ্বিগ্ন। ছিলেন । সিরাজুল আলম খানও তখন মনে করতেন, পুরাে ‘অধ্যায়’টি শেষ অংকে প্রবেশ করেছে। সিরাজ জরুরি অবস্থা জারির আগে মুজিবকে বহুভাবে নিরস্ত্র করতে চেষ্টা করেছিলেন বলে তার উপরােক্ত ঘনিষ্ঠ সূত্রের মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া গেছে । ঐ সূত্রের মতে, সিরাজুল আলম খান চাইছিলেন বিভিন্ন দলের সমন্বয়ে একটি বিপ্লবী সরকার- একদলীয় ব্যবস্থা নয়। কিন্তু মুজিবকে তার পরিকল্পনা থেকে হটানাে যায়নি। যদিও শেখ মণি এবং শেখ মুজিবুর রহমান দু’জনই তখন চাইছিলেন, সিরাজুল আলম খান ও তাঁর অনুসারীরা পুরানাে বলয়ে প্রকাশ্যে ফিরে আসুক। তারই ভিন্ন আরেকটি সাক্ষ্য পাওয়া যায় বামপন্থী রাজনীতিবিদ হায়দার আকবর খান রনাের জবানিতে। তাঁর সহযােগী কাজী জাফর আহমেদ ও রাশেদ খান মেননের মতােই তিনিও আধা আত্মগােপন অবস্থায় তখন। লিখেছেন :
..চারিদিকে খবর আসছিল একদলীয় ব্যবস্থা হবে। এই সময় ফজলুল হক মণি আমাদের সঙ্গে যােগাযােগের চেষ্টা করেন। কাজী জাফর আহমদের সঙ্গে গােপনে দেখা করেন তিনি। জাফর আমাদের আলােচনার বিষয় জ্ঞাত করালে জানতে পারি মণির প্রস্তাব। তাদের প্রস্তাব ছিল একদলীয় ব্যবস্থা হবে, যার নেতৃত্বে থাকবেন ছয় জন। এর মধ্যে চার জন হবেন মণি নিজে, কাজী জাফর, মােহাম্মদ ফরহাদ এবং সিরাজুল আলম খান। অন্য একজনকে মুজিব নিজ পছন্দ অনুযায়ী বাছাই করবেন। আর মুজিব নিজে হবেন সুপ্রিম লিডার। মণি’র ভাষ্য অনুযায়ী, ‘বঙ্গবন্ধুর সম্মতি রয়েছে এতে। কাজী জাফর রাজি হননি। সিরাজুল আলম খানের কাছে প্রস্তাব গিয়েছিল কি না সেটাও জানি না।২০৫
বাহাত্তর ও পঁচাত্তরের মধ্যবর্তী সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের রাজনৈতিক যােগাযােগের ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য পাওয়া যায় সেই সময়কার আরেকজন জাসদ নেতা মাহবুবুর রব সাদীর বক্তব্যেও। বর্তমান লেখকের সঙ্গে (২০১২ সালের অক্টোবরে, ঢাকায় নিজ বাসভবনে) এক সাক্ষাৎকারে সাদী স্মৃতিচারণ করে বলেন, ১৭ মার্চের উত্তাল ঘটনার পরও আমাদের দলের সেন্ট্রাল অর্গানাইজিং কমিটির মিটিং হচ্ছে ঢাকাতেই সুপরিচিত চায়না বিল্ডিংয়ে। এটা আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হতাে। অথচ সেসময় রক্ষীবাহিনী মাঠ পর্যায়ে আমাদের কাউকে পাওয়া মাত্র তুলে নিয়ে যেত।’ উল্লেখ্য, সাদী ছিলেন জাসদের প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির কৃষি বিষয়ক সম্পাদক এবং জাতীয় কৃষক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। একই বিষয়ে আলােকপাত করেছেন সেই সময়কার একজন সুপরিচিত সাংবাদিক আমির হােসেন এভাবে: ‘সিরাজুল আলম
…………………………………………………………………
২০৫) হায়দার আকবর খান রনাে, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৩৩।
Page 139
খানের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু যে প্রতিহিংসামূলক কোন ব্যবস্থা নেননি তার কারণ হিসেবে শােনা গেছে, পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ওপর সুস্পষ্ট নির্দেশ ছিল, তার পূর্ব অনুমতি ছাড়া যেন কোনাে অবস্থাতেই সিরাজুল আলম খানকে গ্রেফতার করা না হয়।’২০৬
অন্যদিকে বাকশালের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে যােগ দিতে সিরাজুল আলম কেন শেষপর্যন্ত রাজি হলেন না সে বিষয়ে আরেক জাসদ নেতা আবু সাঈদ খান সিরাজুল আলম খানের সূত্রে আরও সুনির্দিষ্ট তথ্য দিয়েছেন। ২০১২ সালের ২ নভেম্বর বর্তমান লেখককে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আমি যখন কারাবন্দি তখন সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে কিছু দিন থেকেছি। সেসময় একদিন কথা প্রসঙ্গে দাদা জানালেন, বাকশালের নেতৃত্বে যােগদানের জন্য মুজিবের তরফ থেকে যখন প্রস্তাব এলাে তখন তিনি তাজউদ্দীনকেও তাতে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব দেন। মুজিব তখন জানান, সেটা সম্ভব নয়। এরপর আর আলােচনা এগােয়নি। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, মুজিব তাজউদ্দীনের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি মেনে নিলে রাজনীতির পুরাে চিত্রটি তাৎক্ষণিকভাবে অন্যরকম হয়ে পড়ত। উল্লেখ্য, বাকশাল গঠনের পর তাতে যােগদানে অস্বীকৃতির কারণে জাতীয় সংসদের জাসদ দলীয় সদস্য আবদুল্লাহ সরকার ও মঈনুদ্দিন মানিক তাদের সংসদ সদস্যপদ হারান। সরকারিভাবে তৈরি নির্দিষ্ট একটি রাজনৈতিক দলে যােগ না দিলে জনগণের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির সংসদ সদস্যপদ বাতিলের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র’ এসময় অদ্ভুত এক চেহারায় হাজির হয় বাংলাদেশে।
জাসদ রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে বাকশাল’-এর বিরােধিতা করলেও এটা ছিল তাদের পূর্ববর্তী সাংগঠনিক কাঠামাে মুজিব বাহিনীর আদর্শ ‘মুজিববাদ’-এরই নতুন সংস্করণ মাত্র। মুজিব নিজেই জাতীয় সংসদে সংবিধানের চতুর্থ সংশােধনী বিল (যার ভিত্তিতে বাকশাল কর্মসূচি আসে) পাসের সময় সমাপনী ভাষণে বলেছিলেন,
‘স্পিকার সাহেব, আমরা শােষিতের গণতন্ত্র চাই।…এটা আজকের কথা নয়। বহুদিনের কথা আমাদের। সেজন্য আমাদের শাসনের। পরিবর্তন করতে হচ্ছে। …আমাদের শােষণহীন সমাজ গড়তে হবে। এটা আমাদের প্রতিজ্ঞা। This is our second revolution. যারা দেশকে ভালােবাসেন- জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রিন্সিপালকে ভালােবাসেন। তারা আসুন, কাজ
……………………………………………………………….
২০৬) আমির হােসেন, পূর্বোক্ত, পৃ. ৬৪। বর্তমানে (২০১৪) আমির হােসেন ডেইলী সানের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
Page 140
করুন। সেজন্য আমরা সংশােধিত সংবিধানে নতুন ব্যবস্থা করতে যাচ্ছি। এটা শােষিতের গণতন্ত্র ।…”২০৭
মুজিব বাহিনী তাদের আদর্শ হিসেবে যে ‘মুজিববাদ’-এর কথা বলত মুজিব নিজে তাকে যে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সম্মিলিত। এক রূপ হিসেবে মনে করতেন সে বিষয়ে এই গ্রন্থের অন্যত্র বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। তবে বাস্তবতা হলাে ১৯৭৫-এ এসে ‘মুজিববাদ’-এর এই নতুন সংস্করণ, যাকে মুজিব বলেছেন second revolution- তার বাস্তব চেহারা পুরােদস্তুর একনায়কতান্ত্রিক রূপ নেয়। কারণ বাকশাল নামক এই second revolution-এর কর্মসূচি অনুযায়ী :
ক. দেশে একটিমাত্র রাজনৈতিক দল থাকবে, সেটি হলাে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক লীগ বা বাকশাল। আসলে বাকশাল ছিল আওয়ামী লীগেরই পরিবর্তিত নাম। যদিও এই দলে সিপিবি ও ন্যাপও যােগ দিয়েছিল, কিন্তু কার্যনির্বাহী কমিটিতে আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোন দলের প্রতিনিধি ছিল না। নতুন দলটির প্রতীকটিও ছিল আওয়ামী লীগের প্রতীক নৌকা। ১১৫ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটিতে অপর দলগুলাের প্রতিনিধিত্ব ছিল অতি নগণ্য- যেমন সিপিবি’র সদস্য ছিলেন মাত্র এক জন (মাে. ফরহাদ, ৭৭ নং সদস্য)২০৮!
……………………………………………………………..
২০৭) প্রথম জাতীয় সংসদের সপ্তম অধিবেশনের দ্বিতীয় দিন শেখ মুজিবুর রহমান এই ভাষণ দেন। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সম্পাদনা: শেখ হাসিনা ও বেবী মওদুদ, আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৮, ঢাকা, পৃ. ৭৬-৯৩।
বাকশালকে মুজিবুর রহমান তার দ্বিতীয় বিপ্লব’, ‘শােষিতের গণতন্ত্র’ ইত্যাদি বললেও এর তাত্ত্বিক উৎস ছিল সােভিয়েত ইউনিয়ন। এ সম্পর্কে সেই সময়কার সাংবাদিক ও বামপন্থী নেতা নির্মল সেন ক্রুদ্ধ ভাষায় লিখেছেন, বাকশাল ছিল একটি রাজনৈতিক দর্শন। যার মূলকথা হলাে অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সমাজতন্ত্রে পৌছানাে। এ দর্শন সােভিয়েত তাত্ত্বিক উলিয়ানভের। এই তত্ত্ব মনে করত, যেদেশে শিল্প বিপ্লব হয়নি, যেখানে শ্রমিক নেতৃত্ব দুর্বল, সেখানে জাতীয় বুর্জোয়ার সহযােগিতায় বিপ্লব সাধন। এ তত্ত্বের আলােকে রাজনীতির ধরন হবে একদলীয় । তানজানিয়া, মােজাম্বিক, ইথিওপিয়া, সােমালিয়া ইত্যাদি দেশে এর নিরীক্ষা হয়েছিল।… আমাদের দলের মতে, এটা ছিল মহাভুল। বাকশাল ছিল সমাজতন্ত্রের লেবেল। জনতার রােষ থেকে বাঁচা ও বামপন্থীদের ভাওতা দিয়ে একদলীয় শাসন কায়েমের জন্য এটা করা হয়। আরও বিস্তারিত দেখুন, নির্মল সেন, আমার জবানবন্দি, তরফদার প্রকাশনী, ২০০৬, ঢাকা, পৃ. ৫৪৪-৪৫।
২০৮) সাংগঠনিক নগণ্য প্রতিনিধি সত্ত্বেও সিপিবি ‘বাকশাল’ কর্মসূচি এগিয়ে নিতে অতি আন্তরিক ছিল। এই কর্মসূচি ঘােষণার কয়েকদিন পর ১৯৭৫-এর ১৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক আলােচনাসভায় প্রাক্তন (!) সিপিবি নেতা মােহাম্মদ ফরহাদ ‘বাকশাল’কে একটি ‘বিপ্লবী প্রক্রিয়া হিসেবে অভিহিত করেন। দেখুন, দৈনিক সংবাদ, ২০ ফেব্রুয়ারি, ‘৭৫।
শ্রমিক শ্রেণির দল বলে দাবিদার কোনাে কমিউনিস্ট পার্টির অপর একটি বুর্জোয়া দলে রাতারাতি এবং স্বেচ্ছায় বিলীন হয়ে যাওয়ার এরূপ ঘটনা আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে খুব বিরল দৃষ্টান্ত। যদিও দীর্ঘ প্রায় এক যুগ পর প্রকাশিত এক দলীয় সাহিত্যে সিপিবি দাবি করেছে, বাকশালে যােগ দিলেও পার্টি ‘গােপনে তার সংকুচিত একটি কাঠামাে বজায় রেখেছিল। দেখুন, কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত কালপঞ্জি, সিপিবি, ১৯৯৯, ঢাকা, পূ, ১০। তবে এই দাবি কতটা সত্য তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। কারণ বাকশাল গঠনের অনেক পূর্ব থেকেই ন্যাপসহ সিপিবি আওয়ামী লীগের সঙ্গে ‘ঐক্যবদ্ধ হতে চাচ্ছিল (সে বিষয়ে এই লেখার অন্যত্র আলােকপাত করা হয়েছে) এবং ‘দল বিলুপ্ত করে বাকশালে যােগদানের বিষয়ে সিপিবি’র সম্পাদকমণ্ডলীর সভায় ভােটাভুটিতে যােগদানের পক্ষেই সংখ্যাগরিষ্ঠ ভােট পড়েছিল। দেখুন, ড. মােস্তাফিজুর রহমান, মনি সিংহ: কমিউনিস্ট আন্দোলন ও সমকালীন রাজনীতি, বাঙলায়ন, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ১৭৭।
১৯৮০ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সিপিবি’র তৃতীয় কংগ্রেসের রাজনৈতিক রিপাের্টেও স্পষ্টত উল্লেখ রয়েছে, ১৯৭৪-এর জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মুজিবের সঙ্গে সিপিবির কয়েক দফা বৈঠক হয় এবং মুজিবের নেতৃত্বে সৎ ও সমাজতন্ত্রমনাদের নিয়ে যে একটি একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে সে বিষয়ে সিপিবি ওয়াকিবহাল ছিল এবং নিজেদের পার্টিকে তারা সেভাবেই প্রস্তুত করেছে। দেখুন, তৃতীয় কংগ্রেসের রাজনৈতিক রিপাের্ট, ১৯৮০, ঢাকা, পৃ. ২৩-২৪।
অন্যদিকে ডেইলী স্টারের প্রতিষ্ঠাতা সাংবাদিক এস এম আলীর পর্যবেক্ষণে সিপিবি এসময় পশ্চিমবঙ্গের সিপিআই-এর অভিজ্ঞতা দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত ছিল। যে অভিজ্ঞতার মূল বিষয় ছিল সােভিয়েতপন্থী হিসেবে টিকে থাকতে হলে বাম-মধ্য ঘরানার একটি বড় সংগঠনের আনুকূল্য প্রয়ােজন- সিপিআই যেটা পেয়েছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের তরফ থেকে। S. M. Ali, ibid, p. 168.
Page 141
খ. চতুর্থ সংশােধনী অনুযায়ী দেশে যে ‘একটিমাত্র দল থাকবে তাতে চেয়ারম্যানই হবেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী; যদিও ঐ চেয়ারম্যান কীভাবে নির্বাচিত হবেন তার কোনাে বিধান করা হয় নি। অর্থাৎ শেখ মুজিব নিজেই যে হবেন নতুন দলের চেয়ারম্যান- এটা এত বেশি স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নেয়া হয় যে, তার জন্য কোনাে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার উল্লেখ করারও প্রয়ােজনবােধ করেন নি নতুন দলের উদ্যোক্তরা।
গ. চেয়ারম্যানের পর সবচেয়ে ক্ষমতাসম্পন্ন কাঠামাে হলাে একক দলটির কার্যনির্বাহী কমিটি- সাধারণ সম্পাদকসহ যার ১৫ জন সদস্যের সকলকে চেয়ারম্যানই মনােনীত করবেন;
ঘ. একক এই দলের শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, মহিলা ও যুব বিষয়ে অঙ্গ সংগঠন থাকবে; তার বাইরে দেশে আর কোনাে শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, মহিলা ও যুব সংগঠন থাকতে পারবে না ।
ঙ. পার্লামেন্ট নির্বাচনে কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাইলে, তাকে চেয়ারম্যানের, অর্থাৎ শেখ মুজিবুর রহমানের অনুমতি নিতে হবে। চেয়ারম্যান ইচ্ছা করলে গঠনতন্ত্র পাল্টাতে পারবেন এবং চেয়ারম্যানই গঠনতন্ত্রের একমাত্র ব্যাখ্যাদানকারী হবেন;
চ. বাকশালের অধীনে জেলার মূল প্রশাসক হিসেবে যেসব গভর্নর নিয়ােগ হবেন তারাও হবেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের মনােনীত।
নতুন দেশে নতুন দল ও নতুন রাজনীতির উপরােক্ত ধাঁচের বৈশিষ্ট্যগুলাে ছিল পুরােপুরি এক ব্যক্তিনির্ভর এবং গণতন্ত্রের মৌলচেতনার বিরােধী, বিশেষত যে জাতি গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম করেছে তাদের জন্য পুরােপুরি
Page 142
বেমানান। ‘জাতীয় দল’ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে কেবল যে দেশের সকল রাজনৈতিক দল ও গণসংগঠন বিলুপ্ত ঘােষণা করা হয় তাই নয়, দুই যুগের পুরানাে আওয়ামী লীগের অস্তিত্বও বিলীন করে দেয়া হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্র স্বৈরাচারী রূপ পরিগ্রহ করতে প্রায় দু’ দশক সময় নিলেও বাংলাদেশে স্বাধীনতার মাত্র চার বছরের মধ্যে গণতন্ত্র অতীতের চেয়েও নিকৃষ্ট রূপ পরিগ্রহ করায় জনগণই কেবল নয়, স্বয়ং মুজিবের নীতিনির্ধারক, সমর্থক পরিমণ্ডলেও প্রশ্ন ওঠে।২০৯ যদিও এরূপ প্রশ্নকারীর সংখ্যা ছিল অতি কম ।
কেবল আওয়ামী লীগের বিলুপ্তিই নয়- এসময় সংসদীয় গণতন্ত্রেরও অবসান ঘটানাে হয় এবং সংবিধানের মৌলিক চরিত্রও পাল্টে ফেলা হয়। অথচ এ দাবিগুলােই ছিল একাত্তর পূর্ববর্তী শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক তৎপরতার নৈতিক শক্তি। দেখা গেল সারা জীবন যেসব ‘গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য তিনি লড়েছেন সেগুলাের চর্চা করতে গিয়ে মাত্র দু-তিন বছরেই বিরক্ত হয়ে পড়েন তিনি। এসময় পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারের এককালের অর্থমন্ত্রী ড. অশােক মিত্র বােম্বের খ্যাতনামা পত্রিকা ‘The economic and political weekly’তে লিখেন As far as civil liberties are concerned, Sheikh Mujibur
Rahman’s Second Revolution in Bangladesh has lighted the way to dusty death.২১০ তবে ভারতের তৎকালীন ক্ষমতাসীনরা বাংলাদেশের বহুদলীয় গণতন্ত্রের অবলুপ্তিকে অভিনন্দিত করেছিলেন বলেই সাক্ষ্য মেলে। বাকশাল কর্মসূচির পর এ বিষয়ে ১৯৭৫ সালের ২৯ জানুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধুর প্রতি ইন্দিরা গান্ধীর অভিনন্দন’ শিরােনামের প্রতিবেদনটি ছিল নিম্নরূপ :
নয়াদিল্লি, ২৫ জানুয়ারি (বাসস) : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী তাঁহাকে অভিনন্দন জ্ঞাপন করিয়াছেন। বঙ্গবন্ধুর নিকট প্রেরিত এক বাণীতে মিসেস গান্ধী বঙ্গবন্ধুর স্বাস্থ্য ও সাফল্য কামনা করিয়াছেন।২১১
………………………………………………………………..
২০৯) পরিকল্পনা কমিশনে মুজিব তার যেসব অধ্যাপক বন্ধুর সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন থিংকট্যাংক’ আকারে- তারা সংবিধানের চতুর্থ সংশােধনীর পর ছুটি নিতে শুরু করেন। কেউ কেউ দেশ ছেড়েই চলে যান।
২১০) অশােক মিত্রের পুরাে লেখাটির জন্য দেখুন, Enayetullah Khan, ibid, p. 397.
২১১) উল্লেখ্য, একদলীয় ব্যবস্থা কায়েমের জন্য বাংলাদেশের বন্ধুকে অভিনন্দন জানানাের ঠিক পাঁচ মাস পর ১৯৭৫-এর ২৬ জুন ইন্দিরা গান্ধী স্বাভাবিক রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করে ভারতে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন। প্রায় ২১ মাস স্থায়ী হয়েছিল ভারতীয় ইতিহাসের ঐ পর্যায়- যাকে আজও ভারত স্মরণ করে তার গণতন্ত্রের সবচেয়ে কালাে অধ্যায় হিসেবে। বাংলাদেশে অবশ্য বাকশাল’ কর্মসূচি যে ভুল ছিল তা এখনও আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব স্বীকার করেন না। এ বিষয়ে দলটির সাম্প্রতিক একটি অভিমত দেখুন,
http://www.thedailystar.net/beta2/news/know-context-of-baksal/[২২.০৪.২০১৩]
Page 143
ইতােমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের অভ্যন্তরে রাষ্ট্র ও রাজনীতির পরিমণ্ডলে মুজিবের এইরূপ উল্টো যাত্রায় তার আশপাশের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা খুব কম জনই সেদিন স্বাধীন ও সােচ্চার ভঙ্গিতে বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ২৯২ জন সরকার দলীয় সংসদ সদস্যদের মধ্যে কেবল জেনারেল এম এ জি ওসমানী ও ব্যারিস্টার মঈনুল হােসেন চতুর্থ সংশােধনী মেনে নিতে না পেরে সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে দেন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ দলীয় কসবার এমপি এডভােকেট সিরাজুল হকও এসময় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আলােচনায় ‘সরকারের গণতন্ত্র বিরােধী বিভিন্ন কার্যক্রমের ওপর সমালােচনামূলক বক্তব্য রেখেছিলেন।২১২ সংসদে সংবিধানের চতুর্থ সংশােধনী বিল উত্থাপনের আগে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সর্বশেষ যে বৈঠক হয় (১৮ জানুয়ারি ১৯৭৫) সেখানে সম্ভাব্য সংশােধনী প্রস্তাবের বিরােধিতা করে জেনারেল ওসমানী বলেছিলেন, ‘আমরা আইয়ুব খানকে দেখেছি, আমরা ইয়াহিয়া খানকে দেখেছি। আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শেখ মুজিবুর রহমান খান হিসেবে দেখতে চাই না।’ ওসমানী বা মঈনুল হােসেন বা সিরাজুল হকদের এইরূপ বিরােধী অবস্থানের কারণে তাঁদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক কোনাে আচরণ করা হয়েছে বলে জানা যায় না।২১৩ সুতরাং যারা বাকশালের বিরােধিতা করেননি তাঁরা। গুরুতর হুমকির মুখে ছিলেন এটা বলা যায় না।
তবে তৎকালীন নানান সূত্র সাক্ষ্য দিচ্ছে, বাকশাল গঠনকালে শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক ভঙ্গি তাঁর নতুন শাসনতান্ত্রিকক কর্মসূচির মতােই ক্রমে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছিল। যার এক নিবিড় পর্যবেক্ষণ দেখা যায় সাংবাদিক নির্মল সেনের জবানবন্দিতে। বাকশালের যখন পত্তন হয় নির্মল সেন তখন ঢাকায় সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি। বাকশাল পদ্ধতি চালু হওয়া মাত্র চারটি দৈনিক পত্রিকা রেখে বাকি সব বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় (এবং ১৯৭৫ সালের জুন থেকে তা কার্যকরও হয়)। বিষয়টি নিয়ে গণভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাংবাদিক প্রতিনিধিদলের এক আলােচনার পর বৈঠকের বিবরণ দিচ্ছেন নির্মল সেন এভাবে:
…শেখ সাহেব কথা শুরু করলেন। তিনি বললেন, বাকশাল গঠন করেছি। চারটি দৈনিক পত্রিকা থাকবে। পরবর্তীকালে আরও দুটি বের হবে। কিছু সাপ্তাহিক-মাসিক থাকবে। এসব হবে বিনােদনমূলক কাগজ।…আমরা চুপ করে শেখ সাহেবের কথা শুনছিলাম। আমার সঙ্গে গিয়াস কামাল চৌধুরী, কামাল লােহানী ও
………………………………………………………………..
২১২) দেখুন, সাঈদ তারেক, ফিরে দেখা পঁচাত্তর, সাপ্তাহিক এখন সময়, ৮ ডিসেম্বর ২০০৯, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র। লেখক ঐ সময় দৈনিক গণকণ্ঠের সংসদ বিষয়ক রিপাের্টার ছিলেন।
২১৩) উল্লেখ্য, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ১৯৭৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাকশাল গঠন সংক্রান্ত সরকারি আদেশটি বাতিল ঘােষিত হয়।
Page 144
রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ। শেখ সাহেব জিজ্ঞাস করলেন, কোন কথা বলছেন না কেন। আমি বললাম, বলার কিছু নেই, সাংবাদিক ইউনিয়নের সভা ডাকবাে। যা সিদ্ধান্ত হয় আপনাকে জানাবাে। শেখ সাহেব তীব্র কণ্ঠে বললেন, দেশে এখন কোন ইউনিয়ন- টিউনিয়ন নেই। সব বাতিল হয়ে গেছে। আপনাদের ডেকেছি সমস্যা সমাধানের জন্য। অন্যকিছু বলার অবকাশ নেই। মিটিং করুন। কিন্তু সংবাদপত্রে কোন বিজ্ঞপ্তি যাবে না। এ যেন মনে থাকে।… ২১৪
উল্লেখ্য, বাকশালের প্রধান এক আঘাত সংবাদপত্র শিল্পে এসে লাগলেও এর কেন্দ্রীয় কমিটিতে তিনজন সম্পাদকের নামও দেখা যায়। তারা হলেন, ওবায়দুল হক (অবজারভার), আনােয়ার হােসেন মঞ্জু (ইত্তেফাক) এবং মিজানুর রহমান (সংবাদ সংস্থা “বিপিআই’- পরে এটি বাসসে যুক্ত হয়েছিল)। বাকশালে যােগদানের কারণে সাংবাদিক ইউনিয়নের অবজারভার শাখা এই সম্পাদকদের সম্মানে সংবর্ধনার আয়ােজন করেছিল ১৯৭৫ সালের ১২ জুন।২১৫ বাকশালে যােগদানকারী সাংবাদিকরা কেবল নিজেদের নয় বাকশালের জেলা গভর্নরদের জন্যও জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবর্ধনার আয়ােজন করেছিলেন।২১৬ নেতৃস্থানীয় সাংবাদিকদের মধ্যে নির্মল সেন, কামাল লােহানী এবং আবদুল গাফফার চৌধুরী বাকশাল কার্যক্রমে শামিল হননি এবং এজন্য তাদের কোনাে ধরনের নিগ্রহের শিকারও হতে হয়নি। এ থেকে ধারণা করা হয়, যারা বাকশালে যােগ দিয়েছিলেন তারা নিজস্ব আগ্রহ ও সিদ্ধান্তেই সেটা করেছিলেন। যদিও সেসময় যােগদানের স্বপক্ষে পারিপার্শ্বিক চাপ ছিল। বাকশাল গঠনকালে জাতীয় রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে যে এক ধরনের একনায়কতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক বিকৃতির সৃষ্টি হয়েছিল তারই এক নিবিড় পর্যবেক্ষণ পাওয়া যায় সাহিত্যিক আহমদ ছফার সেসময়কার এক লেখায়।২১৭ ছফা লিখেছেন :
যে কেউ ইচ্ছা করলে সরকারি দলে (বাকশালে) যােগদান করতে পারবে, এটা ছিল সরকারি ঘােষণা। আসলে যােগ না দিয়ে কারাে নিস্তার পাওয়ার উপায় ছিল না। ভেতরে ভেতরে সমস্ত সরকারি- বেসরকারি দফতর, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, পত্রিকার সাংবাদিক, লেখক, কবি, সাহিত্যিক এবং
…………………………………………………………
২১৪) নির্মল সেন, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৪২-৪৩।
২১৫) দেখুন, Mafuz Ullah, ibid, p.125.
২১৬) রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন, অনন্যা, ২০০০, ঢাকা, পৃ. ৪০।
২১৭) ‘মুজিব শাসন: একজন লেখকের অনুভব’ শীর্ষক এই লেখাটি ছফা লিখেছেন ১৯৭৫ সালের
২০ সেপ্টেম্বর। পরে এটি সংকলিত হয়েছে তার নির্বাচিত রাজনৈতিক প্রবন্ধ গ্রন্থে। প্রকাশক: খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি, ২০১১, ঢাকা, পৃ. ৪৯৯-৫২০।
Page – 145
বুদ্ধিজীবীদের ওপর চাপ প্রয়ােগ করা হচ্ছিলাে- সবাইকে জাতীয় দলে যােগ দেওয়ার আবেদনপত্রে সই করতে হবে। কর্তৃপক্ষ যাকে বিপজ্জনক মনে করেন সদস্যপদ দেবেন না, কিন্তু বাংলাদেশে বাস করে চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য করে বেঁচে-বর্তে থাকতে চাইলে জাতীয়দলের সদস্যপদের আবেদনপত্রে সই করতেই হবে। সর্বত্র বাকশালে যােগদান করার একটা হিড়িক পড়ে গেল। শেখ মুজিবুর রহমান যেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে বাকশালের কেন্দ্রীয় দফতর২০১৮ উদ্বোধন করতে এলেন তাঁকে স্বাগত সম্ভাষণ জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে গােটা দেশের উচচপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, শ্রমিক, কৃষক সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে হাজির থাকতে বাধ্য করা হয়েছিল। সেদিন ছিল মুষলধারে বৃষ্টি। অবিরাম ধারাস্রোতে প্লাবিত হয়ে ভেজা কাকের মতাে সুদীর্ঘ মানুষের সারি- কীভাবে রাস্তায় তারা। অপেক্ষা করছিলেন, যারা এ দৃশ্য দেখেছেন ভুলবেন না। মহিলাদের গাত্রবস্ত্র ভিজে শরীরের সঙ্গে একশা হয়ে গিয়েছিল। এই সুবিশাল জনারণ্যে আমাদের দেশের নারীকুলকে লজ্জা-শরম জলাঞ্জলি দিয়ে সশংকিত চিত্তে তাঁর আগমনের প্রতীক্ষা করতে হচ্ছিলাে।
যেহেতু বাকশাল ছিল একটি বিশেষ রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং বিশেষ রাজনৈতিক দর্শনের ফল- সে কারণে পঁচাত্তরের বাংলাদেশে গণতন্ত্রমনা সবাই এর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বিরােধিতা আশা করছিলেন। কিন্তু জাসদের তরফ থেকে মুজিবের বাকশাল মডেলের বিরােধিতার যৌক্তিক এবং দৃঢ় নৈতিক ভিত্তি ছিল কমই। কারণ স্বাধীনতার পরপর সিরাজুল আলম খানের তিন গুরুত্বপূর্ণ সহযােগী আ স ম আব্দুর রব, শাজাহান সিরাজ ও শরীফ নুরুল আম্বিয়া বিবৃতি দিয়ে ‘দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলাের সদস্যদের নিয়ে একটি জাতীয় বিপ্লবী সরকার গঠনেরই দাবি জানিয়েছিলেন। তারা সেদিন জরুরি অবস্থা ঘােষণারও আহ্বান জানান- যা ছিল স্পষ্টত গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেয়ার প্রস্তাব। রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে বাকশাল ছিল তাদের তিন বছর আগেকার দাবিরই হুবহু না হলেও অনেকটা কাছাকাছি কর্মসূচি। তবে বাকশাল কায়েমের পর প্রথম তাৎক্ষণিক আঘাত আসে জাসদের ওপরই। সংবিধানের চতুর্থ সংশােধনী পাসের ৪৮ ঘণ্টা পরই পুলিশ জাসদের মুখপত্র হিসেবে পরিচিত ‘গণকণ্ঠ’ কার্যালয় দখল করে নেয়।
……………………………………………………………….
২১৮) বাকশালের কেন্দ্রীয় দপ্তর খােলা হয়েছিল ঢাকার কাকরাইলের ১১২ নং সার্কিট হাউস রােডে।
Page 146
স্বভাবত ডান এবং বাম উভয় ধারার রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সংবিধানের চতুর্থ সংশােধনী এবং তার আওতায় সৃষ্ট নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার সমালােচনায় ছিলেন পঞ্চমুখ। এমনকি আওয়ামী লীগেও স্পষ্ট ভিন্নমত ছিল বাকশাল ব্যবস্থা নিয়ে যে বিষয়ে ইতােমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল মস্কোপন্থী ন্যাপ (মােজাফফর) ও কমিউনিস্ট পার্টি। তারা এই ব্যবস্থার সমর্থক ছিল, তাতে অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং শাসন ও রাজনৈতিক পদ্ধতির এরূপ ভূমিকম্পতুল্য পরিবর্তনে তাদের সঙ্গে মুজিব পরামর্শ করতেন বলেও সমাজের সর্বত্র ধারণা ছিল।২১৯ এই ধারণার বাস্তব অবকাঠামােগতভিত্তি তৈরি হয়েছিল তিয়াত্তরের ১৪ অক্টোবরে আওয়ামী লীগ-সিপিবি-ন্যাপের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ত্রিদলীয় গণ ঐক্যজোটের মাধ্যমে। এ দিন ত্রিদলীয় এই জোটের ঘােষণা ও ১৯ সদস্য বিশিষ্ট সমন্বয় কমিটির সদস্যদের নাম প্রকাশ করা হয়। সদস্যদের মধ্যে ১১ জন ছিলেন আওয়ামী লীগের; ৫ জন মােজাফফর ন্যাপের এবং ৩ জন সিপিবি’র। চুয়াত্তরের মার্চ মাসে গণ ঐক্যজোটের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম বৈঠক হয়। পরবর্তীকালে এর আর কোনাে কার্যক্রম দেখা যায়নি; নীরবেই এর পরিসমাপ্তি ঘটেছে বলে ধরা যায় ।
সরকারের সঙ্গে বা সরকারি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ফ্রন্ট গঠন কার্যত সরকারে অংশগ্রহণ- সেক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতার ভাগিদার ফ্রন্টভুক্তরাও। সিপিবি ও ন্যাপ অবশ্য এ রকম দায়ভার স্বীকার করেনি কখনাে। তবে বাকশাল গঠনের ক্ষেত্রে সিপিবি’র যে সক্রিয় ভূমিকা ছিল সেই বিষয়ে দলটির পক্ষ থেকেই স্বীকারােক্তি পাওয়া যায়। ঐ সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালােচনা করতে গিয়ে বাকশাল পরবর্তী সিপিবির তৃতীয় কংগ্রেসের রাজনৈতিক রিপাের্টে তারা লিখেছে :
………………………………………………………………
২১৯) নুরুল ইসলাম, পূর্বোক্ত, পৃ. ৮৫। উল্লেখ্য, মুজিব সরকারের প্রতি সিপিবি’র ঐসময়কার সমর্থনসূচক ভূমিকা নিয়ে দলটি ১৯৭৩ সালে দ্বিতীয় কংগ্রেসে এবং ১৯৮০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তৃতীয় কংগ্রেসের রাজনৈতিক প্রতিবেদনে যেসব মূল্যায়ন হাজির করে তাও.ব্যাপক স্ববিরােধিতায় ভরা। দ্বিতীয় কংগ্রেসে মুজিব শাসনকে সমাজে বিপ্লবী প্রক্রিয়ার সূচনা হিসেবে অভিহিত করার পর তৃতীয় কংগ্রেসে আবার বলা হচ্ছে, ‘আওয়ামী লীগের শাসনামলে ব্যর্থতা, ত্রুটি-বিচ্যুতি ও ক্ষতিকর কাজকর্ম ছিল। কিন্তু দেশের ধারা প্রগতির দিকেই ছিল। এটা ছিল আমাদের পার্টির অবদান…বড় সাফল্য। পূর্বোক্ত, পৃ. ২৭, ২৬। এখানে সিপিবি মুজিবের একদলীয় শাসনকে নিজদের সাফল্য হিসেবেই তুলে ধরছে। কিন্তু একই দলিলের অন্যত্র লিখেছে, কি স্বাধীনতার পর জনগণের ঘরে স্বাধীনতার সুফল কখনােই আসেনি।…পু, ৩০। [খ] ‘চুয়াত্তরের মে মাসেই আমাদের মূল্যায়ন ছিল, দেশ অগ্রসর হইতে পারিতেছে না।পৃ. ১৩।
Page 147
দুর্ভিক্ষ-উত্তর পরিস্থিতিতে ‘৭৪ সালের অক্টোবরে কেন্দ্রীয় কমিটির এক বৈঠকে আমরা মিলিত হয়েছিলাম। এ পর্যালােচনায় দেশের সামাজিক সংকটজনক অবস্থা …বিবেচনায় নেয়া হয়। সমগ্র পরিস্থিতি পর্যালােচনা করে কেন্দ্রীয় কমিটি ব্যর্থ সরকার বাতিল কর’ আওয়াজ তােলার সিদ্ধান্ত করে। আর আওয়ামী লীগ সরকারের বিকল্প হিসেবে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই সৎ, যােগ্য, দৃঢ়চিত্ত প্রগতিশীলদের নিয়ে সরকার গঠনের দাবি উত্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এ ছাড়া প্রগতির ধারাকে অগ্রসর করার জন্য প্রয়ােজনীয় প্রশাসনিক, সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের দাবিও উত্থাপন করা হয়।…তদানিন্তন অবস্থা বিবেচনা করলে এই সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল।…তার (মুজিব) সঙ্গে জুন মাস থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বেশ কয়েক দফা আলােচনা হয়। তিনি বলেন, যারা সৎ এবং সমাজতন্ত্রমনা তাদের মিলিত করে একটি শক্তি সমাবেশ তিনি গড়ে তুলবেন। এসব আলােচনার মাধ্যমে আমরা ধারণা করতে পারি, তিনি দেশে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করার কথা ভাবছেন। তার (মুজিব) নেতৃত্বে পরিচালিত (নতুন) এই সরকারের প্রতি আমাদের ঐক্যের নীতি আমরা প্রত্যাহার করিনি।…আমরা যখন বুঝতে পারলাম, বঙ্গবন্ধু শেষাবধি একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করবেন, তখন পার্টিকে প্রস্তুত করার নীতি আমরা গ্রহণ করেছিলাম।২২০
প্রায় ছয় পৃষ্ঠা জুড়ে (১৯-২৫ নম্বর পাতা) দীর্ঘ স্বীকারােক্তিমূলক পর্যালােচনা থেকে অতি সংক্ষেপে উদ্ধৃত উপরের বক্তব্যে স্পষ্ট যে, বাকশাল নামক একদলীয় ব্যবস্থার আগমন সম্পর্কে সিপিবি যে কেবল পূর্ব থেকে জানত তাই নয়- বাকশালের আওতাধীন প্রশাসনিক সংস্কার’-এর অনেক প্রস্তাব তাদের তরফ থেকেই উত্থাপিত । সিপিবি ও আওয়ামী লীগের সেই সময়কার সম্পর্কের বিষয়ে কৌতূহলােদ্দীপক আরও তথ্যের উল্লেখ রয়েছে ৬৩২ নম্বর তথ্যসূত্রে।
উল্লেখ্য, বাকশাল নামক একদলীয় শাসনব্যবস্থায় পদার্পণের আগেই বিশেষ ক্ষমতা আইনের মতাে কালাকানুন তৈরি করে নেয়া হয় এবং ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় সংশােধনীর মাধ্যমে সংবিধানকেও জরুরি অবস্থা জারির উপযােগী করা হয়। বিশেষ ক্ষমতা আইন তৈরি, জরুরি অবস্থা জারির ক্ষমতা অর্জন ও জরুরি অবস্থা জারি এবং পরে একদলীয় ব্যবস্থায় যাত্রা সবই ছিল স্পষ্টত পরিপূর্ণ এক ব্যর্থতার স্মারক। যে ব্যর্থতার বস্তুগত দিক ছিল- দেশ পরিচালনার জন্য আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ এবং তার রাজনৈতিক সহযােগী হিসেবে। ন্যাপ-সিপিবি-ছাত্র ইউনিয়নের সত্তর-একাত্তর-বাহাত্তর পর্যায়ে প্রতিশ্রুত ও গৃহীত
……………………………………………………………
২২০) সিপিবি, তৃতীয় কংগ্রেসের রাজনৈতিক রিপাের্ট, ১৯৮০, ঢাকা।
Page 148
কার্যক্রমের চরম বিপরীত আচরণ। আর এর তাৎক্ষণিক ফল দাঁড়ায় দুর্ভিক্ষ ও অনিয়ন্ত্রিত আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি।
দেশ পরিচালনায় শাসকজোটের তৎকালীন ব্যর্থতার প্রবল এক আত্মগত বৈশিষ্ট্যও ছিল। আন্দোলনের শক্তি হিসেবে উপরােক্ত রাজনৈতিক ভরকেন্দ্রগুলাে সত্তর-পূর্ব সময়ে যতটা সাফল্য দেখিয়েছে, শাসন সামর্থ্যে তারা ঠিক উল্টো রকমভাবে অসফল একাত্তর-পরবর্তী সময়ে। এর প্রমাণ ছিল নীতিনির্ধারকদের সামাজিক দুর্নীতি এবং প্রশাসনিকভাবে অগণতান্ত্রিক কালাকানুনের প্রতি ধারাবাহিক পদ্ধতিগত আগ্রহ। নিয়ন্ত্রণমূলক বিশেষ আইন, জরুরি অবস্থা জারি, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব, মিছিল ও সমাবেশের স্বাধীনতা হরণ, বিচারবিভাগের ক্ষমতা কমিয়ে তাদের নির্বাহী বিভাগের অধীনে নিয়ে আসা, বিচারবহির্ভূত খুন এবং নিবর্তনমূলক আটকাদেশের ক্ষমতার২১১ মতাে পদক্ষেপগুলাে ছিল শাসক
……………………………………………………………
২২১) সংবিধানের দ্বিতীয় সংশােধনীর মাধ্যমে নিবর্তনমূলকভাবে আটককৃতদের মৌলিক মানবাধিকার হরণ করা হয়। মুজিব সরকার কর্তৃক এটা করা হয় সংবিধানের ২৬ নং অনুচ্ছেদ সংশােধন করে। এই সংশােধনীর পূর্বে সংবিধান বর্ণিত মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ আইন স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাওয়ার বিধান থাকলেও নতুন সংশােধনী তা খারিজ করে দেয় এবং গ্রেফতারকৃত কাউকে আটকের কারণ জানানাে, আইনজীবীর পরামর্শের সুযােগ, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযােগ, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আটককৃতকে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করার বাধ্যকতা ইত্যাদি সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেয়। ব্যক্তির গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের ক্ষেত্রে সংবিধানের এরূপ সংশােধনীর দীর্ঘমেয়াদি ফল হয়েছিল বিধ্বংসী । লক্ষ্যণীয়, বাহাত্তর সালে প্রণীত সংবিধানেরই অন্তর্গত এমন কাঠামােগত ত্রুটি ছিল যাতে শাসক এলিটরা চাইলে তাতে সংশােধনের নামে জনগণের মৌলিক অধিকারবিরােধী বিধি ইচ্ছামত ঢুকিয়ে দিতে পারে। কেবল জরুরি অবস্থা বা নিবর্তনমূলক আটকাদেশের সুযােগই নয়- পুরাে গণতান্ত্রিক কাঠামাে পাল্টে দেয়ার মতাে চতুর্থ সংশােধনী আনা সম্ভব হয়েছে সংবিধানের ঐ কাঠামােগত দুর্বলতার সুযােগে। পরে বহুবার রাজনৈতিক এলিটরা সংবিধানের এই ত্রুটির সুযােগ নিয়েছে। কিন্তু তারপরও সমাজের প্রগতিশীল মহল বাহাত্তরের সংবিধানকে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ হিসেবে সর্বোচ্চ এক দলিল হিসেবে অভিহিত করে থাকে। এমনকি আমরা দেখেছি, সেই সময়কার প্রধান বিরােধী দল সিপিবি, ন্যাপ এবং জাসদও সংবিধানের উপরােক্ত দুর্বলতা নিয়ে কোনাে উচ্চবাচ্য করেনি। কাজী জাফর ও রাশেদ খান মেননদের ভাসানী ন্যাপকেন্দ্রিক কমিউনিস্ট গ্রুপটিও একে ‘বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক সংবিধান হিসেবে বেশ ভালাে হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। দেখুন, হায়দার আকবর খান রনাে, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৩১। সংবিধান বিষয়ে জাসদের পক্ষ থেকে দৈনিক গণকণ্ঠে বাহাত্তরের ২০ অক্টোবর আ স ম রব ও শাহজাহান সিরাজ যে বিবৃতি দেন তার মুখ্য বক্তব্য ছিল এই সংবিধানটি মন্দের ভালাে’। মন্দ দিক সম্পর্কে মাত্র চারটি প্রশ্ন ছিল তাদের বক্তব্যে:
ক. ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘােষণা করা হয়েছিল এর সত্যতা কী?
খ. মহিলাদের মতাে কৃষক ও শ্রমিকদের জন্য সংবিধানে আসন সংরক্ষণ করা হচ্ছে না কেন?;
গ. মহিলাদের জন্য কোটা না রেখে সরাসরি ভােটের ব্যবস্থা করা হচ্ছে না কেন? এবং
ঘ. দেশরক্ষা বাহিনীকে উপনিবেশিক ধাঁচে না রেখে পিপলস আর্মি’ ধাঁচে গড়ে তােলার বিধান রাখা হচ্ছে না কেন?
এর আগে অবশ্য সংবিধান প্রণয়ন বিষয়ে নৈতিক একটি প্রশ্ন তুলেছিলেন আ স ম রব ও শাজাহান সিরাজ আরেক যৌথ বিবৃতিতে (৭ অক্টোবর বিবৃতিটি দৈনিক গণকণ্ঠে প্রকাশিত হয়)। তাঁরা বলেন, ‘(সংবিধান রচনার দায়িত্ব গ্রহণকারী) পরিষদ সদস্যদের শতকরা ৯০ জনই যেখানে স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে যুক্ত না থেকে আরাম-আয়েশে গা ভাসিয়ে দিয়ে এবং নানা ধরনের অসামাজিক কাজে লিপ্ত থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের সম্পূর্ণ সময়টুকু ভারতে নির্লিপ্ত জীবন-যাপন করেছে, সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত দেশের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের অধিকার সেই গণপরিষদ সদস্যদের আদৌ আছে কি? কাঠামােগত দিক থেকে রব-সিরাজ তাঁদের বিবৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন করেন এভাবে: ‘প্রায় ৫০ জনের অধিক গণপরিষদ সদস্যের অবর্তমানে (যারা কেউ দুর্নীতির দায়ে বহিস্কৃত, কেউ পদত্যাগী, কেউ অনুপস্থিত), অর্থাৎ প্রায় এক কোটি লােকের প্রতিনিধিত্ব ছাড়াই দেশের সংবিধান প্রণীত হওয়া কতটা সঙ্গত হচ্ছে?’ উপরােক্ত অবস্থানের বাইরে নবসৃষ্ট সংবিধান সম্পর্কে জাসদের আর কোনাে মৌলিক আপত্তি ছিল না। তখন দেশের প্রধান এক বিরােধী দল হলেও জাসদ সংবিধান রচনার রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়াকে কতটা হালকাভাবে গ্রহণ করেছিল তার একটি কৌতুককর বিরণের জন্য দেখুন, মহিউদ্দিন আহমেদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৫৫-৫৬।
Page 149
হিসেবে পাকিস্তানি জেনারেলদের প্রিয় সব শাসনতান্ত্রিক পণ্য। সেই শাসক ও শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতির নিন্দা ও পরাজয়ের ওপর ভিত্তি করে একাত্তরে যে জনগােষ্ঠীর গর্বিত যাত্রা তারা মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে একই নােংরা অতীতের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে শুরু করে শতগুণ মহিমার সঙ্গে। একাত্তর-পরবর্তী সময়ে দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যার যে ব্যাপকতা তা ছিল অতি ভীতিকর এক পরিস্থিতি। রাজনীতি বিজ্ঞানে এ ধরনের ভীতিকেই গণতন্ত্রের বধ্যভূমি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে ।
একাত্তর থেকে পঁচাত্তর সময়ের রাজনৈতিক ব্যর্থতার উপরােক্ত বস্তুগত ও আত্মগত বৈশিষ্ট্যগুলাে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নৈতিক শক্তিকে অভাবনীয় দ্রুততায় নিঃশেষ করে দিচ্ছিলেন তার পুরােধারাই । তৎকালীন শাসকরা যে কেবল জাসদ ও মাওবাদী নকশালদের মতাে ভিন্নমত ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি ক্ষমাহীন ছিলেন তাই নয়- সিপিবি ও ন্যাপের মতাে জাতীয় রাজনৈতিক সহযােগিরাও তাদের আক্রমণের শিকার হয়েছে। যদিও সিপিবি ও ন্যাপ যে কোনােভাবে তখনকার সরকারের সঙ্গে খাপখাইয়ে চলার নীতি নিয়েছিল। কিন্তু সেটা ছিল প্রধানত মস্কোর নির্দেশনার কারণে দলের মাঠ পর্যায়ের আগ্রহের কারণে নয়। যার প্রতিফলন হিসেবে দেখা যায় সরকারকে প্রশ্নহীন সহযােগিতার প্রতিবাদে চুয়াত্তরের নভেম্বরের দ্বিতীয়
Page 150
সপ্তাহে গুরুত্বপূর্ণ একজন ন্যাপ নেতা ও নেতৃস্থানীয় মুক্তিযােদ্ধা ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরী তার সহযােগীদের নিয়ে দল থেকে পদত্যাগ করেন।২২২
জাসদ, সর্বহারা পার্টি বা অন্যান্য কমিউনিস্ট দল ও গ্রুপগুলাের প্রতি আওয়ামী লীগ ও তাদের সরকারের কঠোর নীতি সিপিবি ও ন্যাপের ক্ষেত্রে হুবহু অনুসত না হলেও নানান স্থানে তাদের কর্মীরাও নির্দয় নিপীড়নের শিকার হয়েছে ঐ সময়। বলা যায়, তাদের দিয়েই নিপীড়ন শুরু হয়। এক্ষেত্রে ঢাকায় ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি সিপিবি’র অঙ্গ সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের মিছিলে গুলি চালিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ছাত্র মতিউল ইসলাম ও ঢাকা কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র মির্জা কাদের নামের দু’জন শিক্ষার্থীকে হত্যা এবং গােপালগঞ্জে ১৯৭৩-এর ১০ মার্চের নির্মম হত্যাকাণ্ডের উল্লেখ করা যায় ।
প্রথম ঘটনাটিতে ‘ভিয়েতনাম সংহতি দিবস’ পালন উপলক্ষ্যে ছাত্র ইউনিয়ন ও ডাকসু যৌথভাবে ঢাকার মতিঝিলস্থ যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে স্মারকলিপি দেওয়ার উদ্দেশ্যে মিছিল নিয়ে বের হলে বর্তমানের জাতীয় প্রেসক্লাবের উল্টোদিকে ইউএসআইএস ভবনের সামনে কোনাে সতর্কতা ছাড়া গুলি চালানাে হয় ঐ মিছিলে। স্বাধীনতা-উত্তর কেন্দ্রীয় ঢাকায় সবচেয়ে আলােচিত প্রকাশ্য রাজনৈতিক খুন ছিল এটা।২২৩ ঐদিনের ঘটনায় গলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত পরাগ মাহমুদের বিবরণ থেকে জানা যায়, পুলিশ প্রথমে মিছিলের অগ্রভাগে থাকা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমকে রাইফেল দিয়ে আঘাত করে। এ দৃশ্যে ক্ষুব্ধ মিছিলকারীরা পুলিশের উদ্দেশ্যে কয়েকটি ইট-পাটকেল ছুঁড়ে মারে। এরপরই বেপরােয়া গুলিবর্ষণ শুরু হয়। ২২৪
ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে পরদিন ২ জানুয়ারি স্বাধীন দেশে প্রথমবারের মতাে ব্যাপক স্বতঃস্ফূর্ততায় হরতাল পালিত হয়। একই দিন বিকালে পল্টন ময়দানে আয়ােজিত এক সমাবেশে ডাকসুর পক্ষ থেকে তৎকালীন ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম শেখ মুজিবুর রহমানকে দেওয়া জাতির পিতা’ উপাধি প্রত্যাহার করে নেন এবং তাঁর ডাকসুর আজীবন সদস্যপদ বাতিল করেন। ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ও ডাকসুর জিএস মাহবুব জামান উত্তেজিতভাবে ডাকসু’র সিদ্ধান্ত-বই থেকে এ সংক্রান্ত
…………………………………………………………………
২২২) ১৯৭৪ সালের ১৪ নভেম্বর পদত্যাগকালে ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরী ন্যাপের শিক্ষা ও শ্রম সম্পাদক ছিলেন। পরে কাজী জাফর আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে ইউনাইটেড পিপলস পার্টি গড়ে তুলেছিলেন।
২২৩) একই ঘটনায় গুরুতর আহত হন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ- সভাপতি আবুল কাশেম, দৈনিক বাংলার বাণীর ফটোসাংবাদিক রফিকুর রহমান, পরাগ মাহমুদসহ ছয় জন।
২২৪) ঐ দিনের ঘটনায় পরাগ মাহমুদের অভিজ্ঞতা এবং ঘটনার তৎকালীন রাজনৈতিক তাৎপর্য নিয়ে লন্ডন প্রবাসী লেখক মাসুদ রানার একটি লেখা সংযুক্তি করা হয়েছে গ্রন্থের শেষে। দেখুন: সংযুক্তি একুশ।
Page 151
পাতাও ছিড়ে ফেলেন। সভা থেকে ছাত্রহত্যায় যুক্তদের পদত্যাগ, মিছিল মিটিংয়ে রক্ষীবাহিনীর হামলা বন্ধ করাসহ সাত দফা দাবিও উত্থাপিত হয়েছিল সরকারের কাছে। এ বিষয়ে সিপিবি-ন্যাপ-ছাত্র ইউনিয়নের সমর্থক কাগজ দৈনিক সংবাদে সেদিনের বড় খবরটি ছিল এরূপ :
গতকাল মঙ্গলবার পল্টন ময়দানের জনসমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি ও বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম নিম্নোক্ত ঘােষণা পাঠ করেন : এই সমাবেশের সামনে ডাকসুর পক্ষ থেকে আমরা ঘােষণা করছি যে, বিগত ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানকে ডাকসুর পক্ষ থেকে আমরা যে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দিয়েছিলাম ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে আজ সেই বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রত্যাহার করে নিলাম। আমরা দেশের আপামর জনসাধারণ, সংবাদপত্র, রেডিও ও টেলিভিশনের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, আজ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের নামের আগে তাঁর ‘বঙ্গবন্ধু’ বিশেষণ ব্যবহার করবেন না। একদিন ডাকসুর পক্ষ থেকে আমরা মুজিবকে জাতির পিতা আখ্যা দিয়েছিলাম। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে আবার ছাত্রের রক্তে তাঁর হাত কলংকিত করায় আমরা ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে ঘােষণা করছি, আজ থেকে কেউ আর জাতির পিতা বলবেন না। শেখ মুজিবকে একদিন ডাকসুর আজীবন সদস্যপদ দেওয়া হয়েছিল। আজকের এই সমাবেশ থেকে ডাকসুর পক্ষ থেকে আমরা ঘােষণা করছি, আজ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকসু’র আজীবন সদস্যপদ বাতিল করে দেওয়া হলাে।২২৫
……………………………………………………………….
২২৫) দেখুন, দৈনিক সংবাদ, ৩ জানুয়ারি ১৯৭৩, ঢাকা। মুজাহিদুল ইসলামের উপরােক্ত হুমকি ও ঘােষণার দু’দিন পর ছাত্রলীগের সভাপতি শেখ শহীদুল ইসলাম আরেক সমাবেশ থেকে মুজাহিদুল ইসলামের হুঁশিয়ারিকে তীব্র ভৎসনা করে বলেন, যারা শেখ মুজিবের নামের আগে ‘বঙ্গবন্ধু’ লিখবে না বা বলবে না জনগণ তাদের জিহ্বা ছিড়ে ফেলবে (দেখুন, দৈনিক বাংলা, ৬ জানুয়ারি ১৯৭৩)। ৫ জানুয়ারি ছাত্রলীগ ঢাকায় ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়ন কার্যালয় জ্বালিয়ে দেয়। এইরূপ পাল্টাপাল্টি যুদ্ধ ও বাগযুদ্ধের উপসংহার হলাে, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমকে ঘটনার কিছুদিন পর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে হয় এবং ১০ মাস পর ১৯৭৩ সালের ১১ নভেম্বর ছাত্র ইউনিয়নের চতুর্দশ প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী অনুষ্ঠানের উদ্বোধক হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানই আমন্ত্রিত হন। এর তিন সপ্তাহ পর সিপিবি’র দ্বিতীয় কংগ্রেসেরও উদ্বোধন করেন তিনি। আর উপরােক্ত ঘটনার দু’ বছর পর যখন বাকশাল গঠিত হয় তখন ঐ ‘জাতীয় দল’-এর অঙ্গসংগঠন ‘জাতীয় ছাত্রলীগ’-এ ২১ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটিতে শেখ শহিদুল ইসলামের পরই দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে নাম দেখা যায় মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের । ডাকসুর নির্বাচিত ভিপিকে সেদিন বাকশালের অঙ্গসংগঠনে সদস্য হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল। আরও উল্লেখ্য, ন্যাপ ও সিপিবি প্রথমে মতিউল-কাদের হত্যায় কড়া প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেও পরে আওয়ামী লীগের রুদ্রমূর্তির মুখে তারা ছাত্রহত্যার বিষয়টি ধীরে ধীরে চেপে যায়। এই ঘটনার প্রতিবাদে ৭ জানুয়ারি পল্টনে জনসভা হওয়ার কথা থাকলেও পূর্বদিন ন্যাপ সেই কর্মসূচি বাতিল করে। অথচ ঘটনার পরপরই প্রদত্ত বিবৃতিতে মােজাফফর আহমদ ও পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের এ বর্বরােচিত ছাত্রহত্যা ইয়াহিয়া-মােনায়েম স্বৈরাচারী সরকারের কার্যকলাপের নামান্তর। যে সরকার ছাত্র-জনতার রক্তে হাত কলুষিত করেছে সে সরকারের বিরুদ্ধে দেশবাসীর সংগ্রামকে অব্যাহত গতিতে এগিয়ে নিয়ে যেতে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ । দেখুন, দৈনিক সংবাদ, ৩ জানুয়ারি, ১৯৭৩।
Page 152
পূর্বোক্ত ঘটনার প্রায় সত্তর দিন পর ঘটে গােপালগঞ্জের ঘটনাটি- যেটি ভয়াবহতায় ছিল আরও অধিকতর পৈশাচিক । সেখানে ওয়ালিউর রহমান লেবু, কমলেশ বেদজ্ঞ নামে ন্যাপের দুজন সংগঠক (যারা আসলে কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠক হিসেবে মােজাফফর ন্যাপে কাজ করতেন) কোটালিপাড়া থেকে গােপালগঞ্জ সদরে ফেরার পথে সদর উপজেলার টুপুরিয়া নামক গ্রামে তাদের ডাকাত হিসেবে জনগণের কাছে চিহ্নিত করে নিপীড়ন শেষে নৌকায় বেঁধে সেই নৌকা ডুবিয়ে দেওয়া হয়। নিহতদের পরিবার বর্তমান লেখককে বলেছেন, স্থানীয় ‘হেমায়েত বাহিনী’ ছিল এই ঘটনার সংগঠক। এই খুনের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ঘটনার দু’দিন পর হেমায়েত উদ্দিনকে আটক করা হলেও আট মাস পর তাকে কারাগার থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ইতােমধ্যে তিনি বীরবিক্রম খেতাবে ভূষিত হন।
কমলেশ ও ওয়ালিউর রহমানের ওপর তৎকালীন শাসক এলিটদের ক্ষোভের কারণ ছিল, প্রথমজন তিয়াত্তরের মার্চের নির্বাচনে কোটালিপাড়ায় (ফরিদপুর-১২) আওয়ামী লীগের প্রার্থী সন্তোষ আচার্যের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলেছিলেন। যে কারণে অনেক স্থানে ‘ভােট কেটে’ সন্তোষ আচার্যকে জিততে হয়েছে। অন্যদিকে ওয়ালিউর রহমান গােপালগঞ্জ আসনে প্রার্থী হওয়ায় সেখানকার মূল আওয়ামী প্রার্থী মােল্লা জালালকে সম্ভাব্য পরাজয়ের আশঙ্কায় প্রত্যাহার করা হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই পরে মনােনয়নপত্র দাখিল করেন সেখানে। মুজিব প্রার্থী হচ্ছেন দেখে ওয়ালিউর রহমান মনােনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিলেও তাঁর জনপ্রিয়তা সরকারি দলের স্থানীয় নেতৃত্বকে বিরক্ত করেছিল। যার কারণে ৭ মার্চ নির্বাচন শেষে কোটালিপাড়ায় অবস্থান করা ক্রমে দুরূহ হয়ে পড়েছিল উপরােক্ত কমিউনিস্ট সংগঠকদের পক্ষে। তখন এক পর্যায়ে পায়ে হেঁটে কোটালিপাড়া থেকে গােপালগঞ্জ রওনা দেন তারা এবং পথে উপরে উল্লিখিত পরিকল্পিত খুনের ঘটনাটি ঘটে ১০ মার্চ শনিবার সকাল সাড়ে দশটায়। ওয়ালিউর রহমান, কমলেশ বেদজ্ঞ, শ্যামল ব্যানার্জি মানিক ও বিষ্ণুপদ কর্মকার তাতে নিহত হলেও স্থানীয় দুর্গাপুর গ্রামের লুল্ফর রহমান গঞ্জর (বর্তমানে যিনি
Page 153
গােপালগঞ্জ জেলা কৃষকলীগের সভাপতি) নামে তাঁদের এক সহযােগীঅলৌকিকভাবে বেঁচে যান এবং তার মাধ্যমেই হত্যার বিষয়টি জনসম্মুখে প্রকাশ হয়ে পড়ে। স্বাধীনতা পরবর্তী দ্বিতীয় বছরে মাত্র দু মাসের ব্যবধানে জাতীয় পর্যায়ে আলােড়ন সৃষ্টিকারী এসব হত্যার ঘটনা ঘটলেও কেন্দ্রীয়ভাবে সিপিবি ও ন্যাপ তা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদে উচ্চবাচ্য করার নীতি গ্রহণে বাধ্য হয় মস্কোর মুজিব-সমর্থক নীতির কারণে। উল্লেখ্য, ১৯৭৩ সালের ২৫ মার্চে গােপালগঞ্জে যে মামলার চার্জশীট হয়েছিল (মামলা নম্বর ৫; তাং ১১.০৩.৭৩; জিআর কেস নম্বর ৯৬/৭৩) দীর্ঘ ৪১ বছর পরও সেই মামলা নিয়ে সেখানে লড়ছিলেন কমলেশ বেদজ্ঞের কন্যা সুতপা বেদজ্ঞ ও তাদের নিকটাত্মীয়রা। এ রকম একজন নিকটাত্মীয়ের (সাংবাদিক দীপংকর গৌতম)-এর সঙ্গে আলাপচারিতার ভিত্তিতেই এখানে টুপুরিয়া হত্যাকাণ্ডের বিবরণ তুলে ধরা হলাে।২২৬ বর্তমানে এই মামলার ২৩ জন আসামির মধ্যে জীবিত রয়েছেন মাত্র ১০ জন এবং এই লেখা তৈরির সময় (নভেম্বর ২০১৩) তারা জামিনেই ছিলেন। মামলার প্রধান দুই আসামি ছিলেন কোটালিপাড়ার হেমায়েতউদ্দীন বীরবিক্রম ও গােপালগঞ্জের ফারুকুজ্জামান।
ইতােমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, শাসক দলের পক্ষ থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্মমভাবে আক্রান্ত হওয়ার ধারাবাহিক অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও সিপিবি ও ন্যাপ জাতীয় দল বাকশালকে বরণ করে নিয়ে এগােতে চাইছিল মূলত সােভিয়েত ‘লাইন’-এর কারণে।২২৭ সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ইতােমধ্যে শেখ মণি’র এক
………………………………………………………………..
২২৬) এ সম্পর্কে আরও দেখা যেতে পারে, আশরাফ কায়সার, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪১ ও ৫২।
২২৭) এই সােভিয়েত লাইনটি কী ছিল তার একটি ইঙ্গিত পাওয়া যায় ২০৭ নং ফুটনােটে নির্মল সেনের বক্তব্য থেকে। নির্মল সেন এই লাইন বিকাশে তল্কালীন সােভিয়েত ইউনিয়নের তাত্ত্বিক উলিয়ানভের নাম উল্লেখ করেছেন। আসলে ঐ তাত্ত্বিকের নাম ছিল আর, উলিয়ানভক্সি । তিনি ও ভ. পাভলভ ঐ সময় যৌথভাবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপােষকতায় এশিয়ার পথবিকল্প: উত্তরণকালে সামাজিক প্রগতির পথ (১৯৭৬, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো; মূলগ্রন্থটির নাম ছিল ‘Asian Dilemma’) শীর্ষক একটি তাত্ত্বিক গ্রন্থ লিখে দেখান, এশিয়া-আফ্রিকা- ল্যাটিন আমেরিকার উপনিবেশ ছিন্নকারী সদ্য স্বাধীন দেশগুলাে সােভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় অপুঁজিতান্ত্রিক পথে সমাজতন্ত্রে পৌছাতে পারে এবং তাই ঘটতে যাচ্ছে। এটা হলাে সমাজতন্ত্রে পৌছানাের একটা বিশেষ ধরন এবং এ প্রক্রিয়ায় মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পার্টির প্রত্যক্ষ নেতৃত্বের প্রয়ােজন নেই। সিরিয়া, মিসর, বার্মা, ভারতসহ আরও কয়েকটি দেশের উদাহরণ দিয়ে উপরােক্ত গ্রন্থের ২২৪-২৬৯ পৃষ্ঠা জুড়ে উলিয়ানভক্সি এই তত্ত্বের বিস্তারিত বিবরণ দেন। এশিয়া-আফ্রিকা-ল্যাটিন আমেরিকার সােভিয়েতপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিগুলাে ১৯৭১ পরবর্তী সময়ে এই তত্ত্ব অনুসরণ করে সদ্য স্বাধীন দেশগুলােতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালায় এবং বলা বাহুল্য ব্যর্থ হয়। এই তত্ত্বের আলােকে অধনবাদী পথে সমাজতন্ত্রে পৌছাতে করণীয় হলাে: [ক] মিশ্র অর্থনীতি থেকে ধীরে ধীরে রাষ্ট্রীয় খাতকে একচেটিয়া করে তােলা; [খ] সােভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক শিবিরের সঙ্গে মৈত্রীবদ্ধ হওয়া; তাদের সহায়তা নেয়া; [গ] বৈপ্লবিক একনায়কতন্ত্র কায়েম- প্রয়ােজনে অমার্কসীয় সমাজতন্ত্রীদের নেতৃত্বে; [ঘ] সব ধরনের পুঁজির বিরুদ্ধে দৃঢ়সংকল্প ব্যবস্থা নেয়া; ইত্যাদি। উপরােক্ত শর্তগুলাে অনুসরণ করলে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আর ‘প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র কায়েমের প্রয়ােজন নেই বরং উলিয়ানভক্সির ভাষায় এটা একটা মাওবাদী ‘হঠকারিতা’। বাংলাদেশে ১৯৭১-৭৫ পর্যায়ে বাকশাল কায়েম, অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় খাতের একচেটিয়াত্ব প্রতিষ্ঠা, রাজনীতিতে ন্যাপ-সিপিবি-আওয়ামী লীগের গণঐক্যজোট প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি প্রধান প্রধান ঘটনাবলির পেছনে উলিয়ানভক্সির উপরােক্ত তত্ত্বের সুগভীর প্রভাব কাজ করেছে। ১৯৭১-এর মার্চে অনুষ্ঠিত ২৪তম পার্টি কংগ্রেসের পর থেকে ব্রেজনেভের নেতৃত্বে সােভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন নেতৃবৃন্দের দৃষ্টিভঙ্গি উপরােক্ত তত্ত্বের আলােকেই পরিচালিত হচ্ছিল।
Page 154
ধরনের বােঝাপড়া হয়েছিল বলে প্রথমােক্তরা বিশ্বাস করত এবং একদিকে বাকশাল এবং তাতে সিপিবি-ন্যাপের অবস্থান; অন্যদিকে সরকারে শেখ মণির ক্রমবর্ধমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সােভিয়েত প্রভাব একচ্ছত্র হবে বলেই তাদের হিসাব ছিল (এ বিষয়ে ৭.খ উপ-অধ্যায়ের ৬৩২ নম্বর তথ্যসূত্রে সিপিবি-ন্যাপ ও স্থানীয় সােভিয়েত রাষ্ট্রদূতের তৎকালীন ভূমিকা সম্পর্কে কিছু আলােকপাত করা হয়েছে।) ফজলুল হক মণি এসময় নাটকীয়ভাবে তীব্র সমাজতন্ত্রী হয়ে উঠেছিলেন। তার কার্যকারণ তুলে ধরে সংবাদমাধ্যমে মণির দীর্ঘদিনের সহকর্মী আমির হােসেন লিখেছেন :
শেখ মণি মনে-প্রাণে সমাজতন্ত্রী ছিলেন এমন কথা তাঁর শত্রু-মিত্র কেউ বলবে না। অথচ তিনি দ্রুত সােভিয়েত ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকেছিলেন। এই ঝোঁক আরও বৃদ্ধি পায় তাজউদ্দীন আহমদের বিদায়ের পর। তার আগেই সম্পন্ন হয়েছিল শেখ মণি’র মস্কো সফর। মস্কো সফরকালে মণিকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়। ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে তাঁর ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহও দেখানাে হয়। ক্রেমলিনের এই আগ্রহ পরবর্তীকালে আরও বৃদ্ধি পায়…।২২৮
আমির হােসেনের উপরােক্ত বক্তব্যের সূত্র ধরে ২০১৩ সালের ১১ জুন ঢাকায় কথা হয় সেই সময়কার মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম নেতা অজয় রায়ের সঙ্গে। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল শেখ মণি’র মস্কো সফর সম্পর্কে। তিনি জানান, একবার নয়, শেখ মণি অন্তত তিনবার মস্কো সফর করেন ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫-এর মধ্যবর্তী সময়ে।’ অজয় রায় আরও জানিয়েছেন, মস্কোর পক্ষ থেকে একপর্যায়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ‘পার্টি স্তরে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তার আওতাতেই পরবর্তী সময়ে নতুনধারার সম্পর্ক বিকশিত হয় । ইতােমধ্যে দেশে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ-সােভিয়েত মৈত্রী সমিতির প্রধান পৃষ্ঠপােষক হতেও সম্মত হন। একজন সরকার প্রধানের তরফ থেকে
……………………………………………………………..
২২৮) আমির হােসেন, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৯।
Page 155
এইরূপ একটি বেসরকারি সংগঠনের পৃষ্ঠপােষক হওয়া ছিল রীতিমত বিস্ময়কর। এই সমিতি সরাসরি সােভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাবাধীন ছিল।
বাংলাদেশের রাজনীতির উপরােক্ত ‘অগ্রগতি’সমূহ যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রখর নজরদারির মধ্যেই ছিল পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ থেকে সেটাই প্রতীয়মান হয়। শাসক গােষ্ঠীর সমাজতান্ত্রিক বিলাস ও বিভ্রমের মাঝেই নিজের ভবিষ্যৎ সক্রিয়তার পথ করে নিচ্ছিলাে ওয়াশিংটন।
Source: মুজিব বাহিনী থেকে গন বাহিনী ইতিহাসের পুনর্পাঠ; আলতাফ পারভেজ