নিউজ ডে ১০ অক্টোবর ১৯৭১
পাকিস্তান ভারতের উপর যুদ্ধের ছায়া
পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে প্রায় ছয় মাস। এবং এর ফলাফল ঐতিহাসিক। কয়েক লক্ষ বেসামরিক বাঙালি নিহত হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক ধ্বংস চলছে। এবং প্রায় ৮ মিলিয়ন উদ্বাস্তু ভারতের ওপর অর্থনৈতিক ও কাঠামোগত চাপ তৈরি করেছে। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ অবস্থা প্রায় আসন্ন।
পাকিস্তান বিষয়টি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উত্থাপন করেছে – তারা আবেদন করেছে যাতে তাদের হস্তক্ষেপে বিষয়টি সুরাহা হয়। দেখা যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং অন্য কিছু দেশে এই দুই দেশের মধ্যে মধ্যস্ততায় ভূমিকা রাখবে।
মাহমুদ আলী – জাতিসংঘে পাকিস্তানের প্রধান প্রতিনিধি – বুধবার অভিযুক্ত করেন যে ভারত ইতিমধ্যে তার দেশের বিরুদ্ধে একটি গোপন যুদ্ধ আবহ তৈরি করেছে । ওদিকে ভারত বলেছে পাকিস্তান ভারতীয় সীমান্ত এলাকায় শেলিং করছে।
তিনি অভিযোগ করেন ভারতীয় বাহিনী সিলেট জেলার সীমান্ত গ্রামে “প্রায় ১০০০ সেল” নিক্ষেপ করেছে যাতে ২৮ জন নিহত এবং ১৩ জন আহত হয়েছে। আরও বলা হয় ভারতীয়রা খাদ্য বহনকারী জাহাজের উপর বিস্ফোরক চার্জ স্থাপন করেছে যেখানে ৭০ মিলিয়ন লোক দুর্ভিক্ষ মুখে পড়েছে।
ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগে তিনি শরনার্থি সমস্যা নিয়ে কোন কথা না বলে কীভাবে সেনাবাহিনী দিয়ে দুই পাকিস্তানকে এক রাখা যায় সেটা নিয়ে কথা বলেন।
১৯৪৭ এ ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান, মাঝে ভারতীয় ভূখণ্ড দিয়ে ১০০০ মাইলের দূরত্বে অবস্থিত, যারা মুসলমান ধর্ম দ্বারা আবদ্ধ আছে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশই বাঙালি, এবং জাতিগতভাবে পশ্চিম পাকিস্তানীদের থেকে ভিন্ন। এবং ১৩৭ মিলিয়ন এর অর্ধেকের বেশী জনগণ পূর্ব পাকিস্তানে বসবাস করে। তবে পশ্চিম পাকিস্তান এই অংশের প্রাধান্য বজায় রেখেছে। এবং তারা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামীলীগ এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে।
গৃহযুদ্ধ আর গণহত্যার ফলে, এই অঞ্চল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ধ্বসের দিকে যাচ্ছে। এবং ভারতের উপর উদ্বাস্তু সমস্যা আরোপিত হচ্ছে যারা নিজেরাই নিজেদের জনসংখ্যার বোঝা নিয়ে সমস্যায় আছেন। এখানে ইরান এবং সম্ভবত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের আসা উচিৎ।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সম্প্রতি ১ দিনের সফরে তেহরান গিয়েছেন – সেখানে তিনি শাহ রিজা পেল্ভি কে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সমঝোতা করানোর কথা বলেন – ইয়াহিয়া বলেন তার সাথে ইন্দিরা গান্ধী সাক্ষাত করতে অস্বীকৃতি জানান। কিছু সূত্র বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া ইতিমধ্যে মধ্যস্থতার এ প্রচেষ্টায় ইরানকে সহায়তা করছে। এবং ধারণা করা হয় যদি ইরান শান্তিরক্ষায় অবদান রাখার চেষ্টা করতে পারে তাহলে বড় বড় ক্ষমতাশীল দেশগুলোও সেই আওতায় পরে এবং তাদেরও এগিয়ে আসা উচিৎ।
এদিকে ইয়াহিয়া সরকার পূর্ব পাকিস্তানের ৭৫ মিলিয়ন বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রাম দমন করার কাজ করে যাচ্ছে যদিও তার কোনটাই ভালো পথ নয়।
সে তার দমন নীতি চালিয়ে যেতে পারেন তবে অধিকাংশ বিদেশী পর্যবেক্ষক বিশ্বাস করেন যে সেগুলো ব্যর্থ হবে। এর ফলে ভারতের সাথে যুদ্ধ হতে পারে – যাতে তারা প্রায় নিশ্চিতভাবে হারবে। তারা বাংলার স্বাধীনতা অস্বীকার করতে পারেন এবং নিজস্ব সেনা দিয়ে প্রতিরোধ করতে পারেন – তবে এতে শুধু জাতিগত সংখ্যালঘুদের ক্রোধ জাগিয়ে তোলাই হবে। পূর্ব পাকিস্তানীদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে আলোচনার এখন আর তেমন সুযোগ নাই – অনেক রক্ত গিয়েছে- অনেক ক্রোধ জমেছে।
ভয়ানক দৃশ্যের পর্যবেক্ষকরা ধারণা করছেন যে, সমস্ত বিকল্প পথের মধ্যে প্রথমটাই ইয়াহিয়ার সরকার অনুসরণ করবেন। তৃতীয়টা বিবেচনার সম্ভবনা কম। কিন্তু দ্বিতীয়টা, ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ সমগ্র এশীয় উপমহাদেশকে জ্বালিয়ে দেবে – যা একটি বড় হুমকি। এই ধরনের দ্বন্দ্বে শুধুমাত্র ভারত ও পাকিস্তান নয় বরং তাদের পেছনের বিশ্বশক্তিগুলোও জড়িয়ে পড়বে।