You dont have javascript enabled! Please enable it! পাকুল্লা সেতু আক্রমণ ও জামুর্কি সেতু দখল - ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কে ১৭টি সেতু ধ্বংস - মির্জাপুর সেতুর পতন - কুর্নি কালভার্ট ও শুভল্লা সেতু ধ্বংস - সংগ্রামের নোটবুক
পাকুল্লা সেতু আক্রমণ ও জামুর্কি সেতু দখল
টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর থানার অন্তর্গত পাকুল্লা ও জামুর্কি সেতু অবস্থিত। ১৯ নভেম্বর অধিনায়ক হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে পাকুল্লা ও জামুর্কি সেতু ধ্বংসের পরিকল্পনা সফলতা লাভ করে। এ সেতু ২টি দখল অভিযানে অধিনায়ক হাবিবুর রহমান শত্রুর সাথে ৪ ঘণ্টাব্যাপী রক্তক্ষয়ী লড়াই চালিয়েও প্রথমে ব্যর্থ হন। অবশেষে রাত ১১টায় অবরােধ উঠিয়ে এক মাইল উত্তরে জামুর্কি সেতু আক্রমণ করেন। দীর্ঘ ৪ ঘণ্টার আক্রমণে পাকুল্লা সেতুর কোনাে ক্ষতিসাধন করতে না পারলেও, মাত্র ১০ মিনিটের ঝটিকা আক্রমণে জামুর্কি সেতুর প্রতিরােধ পুরােপুরি ভেঙে পড়ে। সেতুতে পাহারারত ৩০-৪০জন রাজাকার, জামুর্কির। সুলতান ও পাকুল্লার লতিফের সাথে যােগাযােগ করে মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। অধিনায়ক হাবিব যখন সেতুতে আঘাত হানেন, তখনই আত্মসমর্পণে ইচ্ছুক ৪০-৪২জন রাজাকার আস্তে আস্তে তাদের বাংকার ছেড়ে রাস্তার পশ্চিম পাশের পাড়ার দিকে সরে যায়। কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা দ্রুত শত্ৰু পরিত্যক্ত বাংকারে অবস্থান নেয়। অন্য একটি দল বুকে হেঁটে পুলের অপর পাড়ে গিয়ে শক্রর বাংকারে হাতবােমা ছুঁড়তে থাকেন। অন্যদিকে ১০জন সহযােদ্ধাসহ হাবিব জামুর্কি স্কুলের পাশ থেকে শত্রুর বাংকারে প্রায় ৫ মিনিট অবিশ্রান্তভাবে এলএমজি’র গুলি চালান। অধিনায়ক হাবিবের গুলিবৃষ্টির মুখে সেতুর উত্তর-পূর্বের বাংকার থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর গুলি ছােড়া একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। আক্রমণের তীব্রতা সইতে না পেরে বাকি রাজাকার ও মিলিশিয়ারা সড়কের পশ্চিম পাশ ঘেঁষে উত্তর দিকে পালাতে শুরু করে। কিন্তু পালানাের সুযােগ কোথায়? তাদের পিছনেও ফাদ। নাটিয়াপাড়া ও জামুর্কির মাঝামাঝি যেতেই তারা মুক্তিবাহিনীর ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে যায় । তবে এখানে রাজাকাররা কোনাে প্রতিরােধের চেষ্টা করেনি, বরং তাদের সঙ্গের ১২জন মিলিশিয়াকে নিজেরাই ধরে মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে হস্তান্তর করে এবং ৩৫জন রাজাকার নিজেরাও আত্মসমর্পণ করে।
ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কে ১৭টি সেতু ধ্বংস
১৯ নভেম্বর টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনী ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কের বিভিন্ন স্থানে ৩০ মাইলব্যাপী রাস্তায় ছােটো-বড়াে মােট ১৭টি সেতু ধ্বংস বা আংশিক ক্ষতিসাধন করে পাকিস্তানি সেনাদের চলাচলে ব্যাপক বাধার সৃষ্টি করে। টাঙ্গাইলের দিক থেকে ভাতকুড়া সেতু হলাে এক নম্বর। আর ঢাকার দিক থেকে কালিয়াকৈরের মহিষবাথান সেতু এক নম্বর। টাঙ্গাইলের দিক থেকে এক নম্বর ভাতকুড়া, দুই নম্বর করটিয়া, তিন নম্বর করাতিপাড়া, চার নম্বর মটরা, পাচ নম্বর বাঐখােলা, ছয় নম্বর ইসলামপুর, সাত নম্বর জামুর্কি, আট নম্বর পাকুল্লা, নয় নম্বর শুভুল্লা, দশ নম্বর কুর্নি, এগারাে নম্বর মির্জাপুর, বারাে নম্বর দেওহাটা, তেরাে নম্বর কোদালিয়া, চৌদ্দ নম্বর সূত্রাপুর, পনেরাে নম্বর। কালিয়াকৈর (এক), ষােলাে নম্বর কালিয়াকৈর (দুই) এবং সতেরাে নম্বর মহিষবাথান সেতু। টাঙ্গাইলের দিক থেকে ক্রমিক নম্বর অনুযায়ী সেতুগুলি ধ্বংস করার জন্য নিমােক্তভাবে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছিল:
এক কাদের সিদ্দিকী নিজে ভাতকুড়া পুলে অভিযান পরিচালনা করেন।
দুই করটিয়া সেতু – বায়েজিদ।
তিন করাতিপাড়া-মটরা সেতু – সােলেমান, শামসুল হক। বাঐখােলা ও ইসলামপুর – গাজী লুত্যর রহমান। জামুর্কি ও পাকুল্লা – জাহাজমারা হাবিবুর রহমান। শুভুল্লা ও কুর্নি – বাদশা, এস এ খান আজাদ, হুমায়ুন ও লায়েক আলম। মির্জাপুর সেতু – আজাদ কামাল। আট দেওহাটা – রবিউল ও রঞ্জু। নয় কোদালিয়া – আবদুস সবুর, সাইদুর, তমছের আলী। দশ সূত্রাপুর ও কালিয়াকৈর (১) – সুলতান, নাসির। এগারাে। কালিয়াকৈর (২) ও মহিষবাথান – আফসার কোম্পানির সহকারী আব্দুল হাকিম।
 
মির্জাপুর সেতুর পতন
অন্যান্য সেতুর মতাে মির্জাপুর সেতু দখল করা মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য অতটা। সহজ হয় নি। মির্জাপুর সেতু থেকে মাত্র ৪০-৫০ গজ দূরে মির্জাপুর থানায় শত্রুর শক্ত ঘাটি থাকায় মির্জাপুর সেতু দখল ছিল বেশ কষ্টসাধ্য। ২০ নভেম্বর সেতুটিতে মুক্তিবাহিনী আঘাত হানার সাথে সাথে হানাদাররা প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ শুরু করে। অধিনায়ক আজাদ কামাল এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর মির্জাপুর সেতু দখল করে নেন। মির্জাপুর সেতু দখলের ৩০-৪০ মিনিটের মাথায় সবুর। ইঞ্জিনিয়ার দলের সহায়তায় সেতুটিতে বিস্ফোরণ ঘটান এবং সেতু ধ্বংস করতে সক্ষম হন। এ সেতুটি ধ্বংস করতে যে পরিমাণ বিস্ফোরক দেয়া হয়েছিল, তার মাত্র এক-চতুর্থাংশ ব্যবহার করা হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের দ্বারা নির্ভুল ও নিখুঁত সেতু ধ্বংস অভিযানের পর থেকেই শত্রু সেনাদের আস্ফালন ও গৌরবে ক্রমাগত ফাটল ধরতে শুরু করে।
কুর্নি কালভার্ট ও শুভল্লা সেতু ধ্বংস
মির্জাপুর সেতুর পর মুক্তিযােদ্ধারা একই থানাধীন কুর্নির কালভার্ট ও শুভল্লা সেতু ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেন। প্রায় বিনা বাধায় অধিনায়ক আজাদ ও বাদশাহর কোম্পানি কালভাটটি উড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়। অধিনায়ক হুমায়ুন ও অধিনায়ক নায়েক আলমের কোম্পানি সন্ধ্যা ৭টায় শুভল্লা সেতুতে অতর্কিতে। আক্রমণ চালায়। সেখানে তারা দীর্ঘ ২ ঘণ্টা প্রচণ্ড যুদ্ধ করে। শুভুল্লা সেতুর। মজবুত পাকা বাংকারে বসে হানাদারদের গুলি ছোঁড়া যত সুবিধা ছিল, মুক্তিযােদ্ধাদের ততটা ছিল না। তবুও মুক্তিযােদ্ধাদের পর্বত পরিমাণ উচু মনােবল ও সাহসিকতার কাছে শেষ পর্যন্ত হানাদারদের নতি স্বীকার করতে হয়েছে। এ সেতু দখলের যুদ্ধে ২জন মুক্তিযােদ্ধা গুরুতর আহত হন। অপর দিকে হানাদারদের ৬জন গ্রেনেডের আঘাতে নিহত হয়। অবশিষ্ট হানাদার ও রাজাকাররা মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – চতুর্থ খন্ড