মােহনগঞ্জ থানা আক্রমণ
ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান তার অধীনস্থ মুক্তিযােদ্ধা দলটি নিয়ে ১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর মােহনগঞ্জ থানা আক্রমণের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ধরমপাশা থানা থেকে মােহনগঞ্জ থানার দূরত্ব ৫ কিলােমিটার। ২টি থানাই সুরমা নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত। ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান অগ্রাভিযান অব্যাহত রাখার জন্য অতি সাবধানতা অবলম্বন করেন। এ সময় নদীর তীরবর্তী গ্রামাঞ্চলে ১টি দিন অতিবাহিত করা ছিল কষ্টসাধ্য ব্যাপার। দিনের বেলা মুক্তিবাহিনীর নৌকাগুলাে হাওড়ের জঙ্গলের ভিতরে লুকিয়ে থাকত। অনেক সময় মুক্তিযােদ্ধাদের কোনাে কোনাে দলকে একটি বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে সারাদিন সে বাড়ির কোনাে লােককে বাইরে বের হওয়া বন্ধ করার প্রয়ােজন দেখা দিত। ধরমপাশা থানা মুক্তিবাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার কারণে ১০ অক্টোবর পাকিস্তানি গানবােটগুলাে নদীতে বারবার যাওয়া-আসা করতে থাকে। গানবােট থেকে মাঝে মাঝে ধরমপাশা থানা এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় অযথা ভারি মেশিনগানের গুলি চালায়। এ সময় মুক্তিযােদ্ধারা প্রত্যুত্তর না দিয়ে আত্মগােপন করে থাকার কৌশল বেছে নেন। ফলে বিকালের দিকে গানবােটগুলাে পুনরায় ছাতক ও সুনামগঞ্জের দিকে ফিরে যায়। এদিন সন্ধ্যার পর ক্যাপ্টেন মতিউর ১টি প্লাটুনকে ধরমপাশা থানা এলাকায় রেখে অন্যদের নিয়ে মােহনগঞ্জ থানা আক্রমণের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। তিনি রাত ১০টায় মােহনগঞ্জ থানার পার্শ্ববর্তী সিংদা গ্রামে অবস্থান নিয়ে থানা আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। মােহনগঞ্জ থানার অনতিদূরে বারহাট্টাতেও শত্রু বাহিনীর ঘাঁটি ছিল। বারহাট্টার সাথে ঠাকুরকোনা ও নেত্রকোনায় সরাসরি রেল যােগাযােগ আছে।
মােহনগঞ্জ থানা আক্রান্ত হলে বারহাট্টা থেকে। সাহায্যকারী সৈন্য দলের আসার সম্ভাবনা ছিল। ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান মােহনগঞ্জ থানা আক্রমণের জন্য ১টি প্ল্যাটুন। বাদে ২টি কোম্পানি নিয়ােজিত করেন। ১টি কোম্পানিকে তিনি বারহাট্টা থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর সাহায্যকারী সৈন্যদলের চলাচল বন্ধ করার লক্ষ্যে বারহাট্টা ও মােহনগঞ্জ রেল স্টেশনের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থান নিতে নির্দেশ দেন। কোম্পানির অধিনায়ক ছিলেন সুবেদার মুসলেহ উদ্দিন। অন্য কোম্পানির দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন মতিউর নিজে। থানা এলাকায় রাজাকার ও পুলিশের অবস্থান বিবেচনা করে আক্রমণকারী দলকে দুই ভাগে বিভক্ত করে দুই দিক। থেকে আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। রাত ১২টার পর পরই ২টি দল দুই দিক থেকে মােহনগঞ্জ থানার উপর প্রচণ্ড বেগে আক্রমণ করে। বেশির ভাগ শত্রু সেনা ঘুম থেকে জেগে অপ্রস্তুত অবস্থায় দৌড়াদৌড়ি করতে থাকে। ট্রেঞ্চে অবস্থানরত কয়েকজন মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। প্রায় ১ ঘণ্টা স্থায়ী এ যুদ্ধের শেষপর্যায়ে রাজাকার ও পুলিশ দল থানার অবস্থান ছেড়ে রাতের অন্ধকারে। বারহাট্টার দিকে পালিয়ে যায়। ভােররাতে মােহনগঞ্জ থানা মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। মােহনগঞ্জ ও ধরমপাশা থানা আক্রমণে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধা মােহনগঞ্জ ও ধরমপাশা থানা আক্রমণকারী মুক্তিযােদ্ধাদের নাম নিমে উল্লেখ করা হলাে:
১. ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান
২. সুবেদার মুসলেহ উদ্দিন
৩. অধিনায়ক সুরুজ মিয়া
৪. অধিনায়ক নুরুল ইসলাম
৫. আরদ আলী প্রমুখ ।
মােহনগঞ্জ ও ধরমপাশা থানা আক্রমণকারী শহিদ মুক্তিযােদ্ধা হলেন:
১. মােয়াজ্জেম হােসেন। যুদ্ধের উল্লেখযােগ্য দিক বিশ্লেষণ যুদ্ধ পরিকল্পনা, শত্রু বাহিনীর অবস্থান, লােকবল এবং অস্ত্রশস্ত্র সম্বন্ধে সঠিক তথ্য সংগ্রহ এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর জয়লাভে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ধরমপাশা ও মােহনগঞ্জ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর জয়ের পিছনে একটি বড় কারণ। ছিল যুদ্ধের সঠিক নেতৃত্ব। সীমান্তের বেশ অভ্যন্তরে নদীপথে মুক্তিবাহিনীর অগ্রসর হওয়া, ধরমপাশা দখলের পর সারাদিন নদীর তীরে গ্রামের বাড়িতে লুকিয়ে থাকা, পাকিস্তানি বাহিনীর টহলযানকে বাধা না দিয়ে অগ্রসর হতে দেওয়া ক্যাপটেন মতিউরের এই সিদ্ধান্তগুলি সঠিক ছিল। এরূপ দুর্গম নদীবিল-হাওর অঞ্চলে একই সঙ্গে এক দিনের ব্যবধানে ২টি থানা দখল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা। সামগ্রিক মূল্যায়ন ধরমপাশা ও মােহনগঞ্জ থানা দখল এটাই প্রমাণ করে যে, মুক্তিবাহিনী এ সময় অনেক বেশি শক্তিশালী ও সুসংগঠিত ছিল। অন্যদিকে, পাকিস্তানি বাহিনী মানসিকভাবে যুদ্ধ করার শক্তি হারিয়ে ফেলে। অক্টোবর মাস থেকে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ তৎপরতা প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানি বাহিনী এলাকার জনগণ থেকে ছিল সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। গণ বিচ্ছিন্ন কোনাে সামরিক বাহিনী শক্তিশালী হলেও জয়লাভ করতে পারে না। অন্যদিকে, মুক্তিবাহিনীর প্রতি জনগণের সমর্থন ছিল সর্বাত্মক ও স্বতঃস্ফূর্ত। বস্তুত জনগণের সমর্থনের কারণেই মুক্তিবাহিনী দক্ষ পেশাধারী পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়।
কলমাকান্দা থানা আক্রমণ
ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোনা মহকুমার (বর্তমানে জেলা) একটি থানা কলমাকান্দা। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি মুক্তিযােদ্ধা দল কর্তৃক কলমাকান্দা থানা আক্রান্ত হয়। রংড়া সাব-সেক্টরের অধিনায়ক নাজমুল হক তারা তার কোম্পানিসহ এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযােদ্ধা দল কলমাকান্দা থানা দখলের পর ৪টি রাইফেল উদ্ধার করে। এ সময় ৫জন রাজাকারসহ একজন দারােগা আত্মসমর্পণ করে।
এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধাগণ ছিলেন
১. নাজমুল হক তারা
২. মােজাফফর আহাম্মদ
৩. আবদুল মান্নান
৪. রিয়াজ উদ্দিন।
৫. জাবেদ আলী
৬. বাবু মান্নান।
৭. আলতাফ হােসেন।
৮, খােরশেদ আলী।
৯. আবদুল খালেক
১০. এস এম ইকবাল
১১. ইলিয়াস চৌধুরী
১২. মােসলেম উদ্দিন
১৩. আবদুল সালাম।
১৪. নূরুল ইসলাম।
১৫. লিয়াকত আলী
১৬. সাহাব উদ্দিন প্রমুখ।
মাইজখা সেতু ধ্বংস
ময়মনসিংহ বাহাদুরাবাদ ঘাট রেল চলাচল বন্ধের লক্ষ্যে মুক্তিযােদ্ধাদের বিভিন্ন। দল সব সময় তৎপর ছিল। রেল যােগাযােগ ব্যাহত করার লক্ষ্যে পরিচালিত এ অপারেশন মাইজখা রেলসেতু ধ্বংসের যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত ঈশ্বরগঞ্জ থানার একটি প্রত্যন্ত গ্রাম মাইজখা। এ গ্রামের কাছাকাছি মাইজখা রেলসেতুর অবস্থান। গুরুত্বপূর্ণ এ সেতুতে একটি রাজাকার সেকশন পাহারারত ছিল। একইসাথে পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়মিত প্যাট্রল দল রেলযােগে এ রেললাইন প্রহরায় নিযুক্ত ছিল। ১৯৭১ সালের ১৫ অক্টোবর রাত ৯টা-১০টার মধ্যে রেলসেতু ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। গ্রুপ অধিনায়ক আবদুস সালাম ফকিরের নেতৃত্বে আক্রমণের কৌশল নির্ধারিত হয়। স্থানীয় বাস্তব অবস্থার কারণে শেষ রাতের দিকে বিস্ফোরণের মাধ্যমে মুক্তিযােদ্ধারা সেতু ও টেলিযােগাযােগ ব্যবস্থার ধ্বংস সাধন করেন। সেতুর অদূরে পাহারারত রাজাকার দল মুক্তিবাহিনীর উপর ব্রাশ ফায়ার শুরু করলে এলএমজি ম্যান আবদুল হামিদ এলএমজি দিয়ে ব্রিজের উপর রাজাকারদের লক্ষ্য করে ব্রাশ ফায়ার শুরু করেন। এ ফায়ারের আড়ালে। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা সহজেই অবস্থান ত্যাগ করেন।
এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধাদের নাম নিমে উল্লেখ করা হলাে:
১. আবদুস সালাম ফকির
২. নূরুল ইসলাম।
৩. আবু তাহের মিয়া
৪, হাবিবুর রহমান হিরু প্রমুখ।
খিচা হাই স্কুলের যুদ্ধ
ময়মনসিংহ জেলার ফুলপুর থানার অন্তর্গত খিচা হাই স্কুলে ছিল স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর ক্যাম্প। ১৯৭১ সালের ৭ নভেম্বর মাঝরাতে মুক্তিবাহিনী। অধিনায়ক আবদুল হালিমের নেতৃত্বে ৮৫জন এবং অধিনায়ক শামসুদ্দিনের নেতৃত্বে ৩২ সদস্যবিশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধা দল সম্মিলিতভাবে এ আক্রমণে অংশগ্রহণ। করে। আক্রমণ চলাকালীন অধিনায়ক শামসুদ্দিন শক্রর গুলিতে আহত হন এবং তার ২টি পা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। এ অবস্থায় শামসুদ্দিন অনেক কষ্টে হাতের উপর ভর দিয়ে ক্রলিং করে ঘটনাস্থল থেকে একটু দূরে সরে আসেন। সেখান থেকে অধিনায়ক আবদুল হালিম ও জবেদ আলী শামসুদ্দিনকে উদ্ধার করেন। ৪ ঘণ্টাব্যাপী এ যুদ্ধে রাজাকার বাহিনীর অনেক সদস্য আত্মসমর্পণ করে এবং অন্যরা অবস্থান ছেড়ে পালিয়ে যায়।
এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধাদের নাম নিমে উল্লেখ করা হলাে:
১. জবেদ আলী
২. আবদুল হালিম
৩. আবুল হাসেম
৪. আশরাফুজ্জামান সেলিম
৫. ইন্নাছ আলী
৬, আনছার আলী
৭. আবদুল বারিক সরকার
৮. ইসমাইল হােসেন
৯. সামছুদ্দিন
১০, আব্বাছ আলী।
১১. আবদুস সালাম প্রমুখ।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – চতুর্থ খন্ড