You dont have javascript enabled! Please enable it! তারাকান্দা রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ - ধলাপাড়ায় যুদ্ধ - ধলাপাড়া নদীর যুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক
তারাকান্দা রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ
তারাকান্দা ময়মনসিংহ জেলার ফুলপুর থানার অন্তর্গত একটি গ্রাম। ফুলপুর। থানা সদর থেকে ময়মনসিংহ জেলা সদরে আসার পথের মাঝামাঝি স্থানে। তারাকান্দা বাজারের অবস্থান। তারাকান্দা বাজারটি এ এলাকায় একটি উল্লেখযােগ্য বাজার। এ বাজার এলাকায় ১ প্লাটুন রাজাকার সদস্যের অবস্থান। ছিল। রাজাকারদের অবস্থান এলাকায় মুক্তিবাহিনীর চলাচলে বাধার সৃষ্টি করে। ১৬ আগস্ট অধিনায়ক জবেদ আলীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল তারাকান্দা বাজার এলাকায় রাজাকারদের অবস্থানের উপর আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনীর আকস্মিক আক্রমণে রাজাকার বাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্য নিহত ও আহত হয়। অন্য রাজাকার সদস্যরা অবস্থান ছেড়ে পালিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনী এ আক্রমণে রাজাকারদের কাছ থেকে ১০টি রাইফেল ও বেশ কিছু গুলি হস্তগত করে।
এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধাদের নাম নিমে উল্লেখ করা হলাে
: ১. আবদুল মান্নান
২. শামছুদ্দিন
৩. হাবিব।
৪. রফিজ উদ্দিন
৫. শরিফুল ইসলাম
৬. মতিন বেগ
৭. এ কে এম মঞ্জুরুল হক (তােতা)
৮. আলাউদ্দিন
৯, আবুল হােসেন
১০. গনি মিয়া
১১. রিয়াজ উদ্দিন
১২. ডা, বাবর আলী
১৩. আবদুল হালিম সরকার
১৪. লিয়াকত আলী
১৫. আবদুল হাই
১৬. আবদুর রাজ্জাক
১৭. সুরুজ আলী মণ্ডল
১৮, আবদুল হাকিম মণ্ডল
১৯, আফাজ উদ্দিন।
২০, আবদুল হান্নান
২১. আবদুর জব্বার ফকির
২২. খুরশেদ আলম
২৩. মফিজ উদ্দিন
২৪. আবদুল বাছেদ আকন্দ
২৫. নূরুল হক।
২৬. লােকমান হােসেন।
২৭. আবুল কালাম
২৮. আলতাব উদ্দিন।
২৯. আবদুর রশিদ প্রমুখ।
ধলাপাড়ায় যুদ্ধ
টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল থানার সর্বপূর্বে ধলাপাড়া গ্রামটি অবস্থিত। ১৯৭১ সালের ১৬ আগস্ট বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী সংবাদ পান, তার ৩টি কোম্পানি পাকিস্তানি সৈন্যদের ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়েছে। তিন দিক থেকে সেখানে টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীকে পাকিস্তানি সেনারা ঘেরাও করেছে এবং টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর চেয়ে পাকিস্তানি বাহিনী সংখ্যা ও অস্ত্রশস্ত্রের দিক দিয়ে বহুগুণে শক্তিশালী। তাই ঐ ঘেরাওয়ের মধ্যে থেকে সঙ্গীদের বের করে আনতে হলে একটা বড়াে ধরনের যুদ্ধে অনিবার্যভাবে লিপ্ত হতে হবে। বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী পাকিস্তানি সেনাদের অগ্রগতি, সংখ্যা ও অস্ত্রশস্ত্রসহ শক্তি ও বিশদের সংবাদ পাওয়ার পর সামান্যতম ভয় পেলেন না। এবার তিনি অত্যন্ত গােপনে অগ্রসর হতে থাকেন, যাতে করে পাকিস্তানি সেনারা কোনােপ্রকার খবর পায়। আর তার পরিকল্পনা হচ্ছে, কীভাবে তিনি শত্রুর উপর অতর্কিত আক্রমণ চালাতে পারবেন। সুযােগের সদ্ব্যবহার করতে পারলে তিনি ঐ বহুগুণ। শক্তিশালী পাকিস্তানি সেনাদের ঘায়েল করতে পারবেন। সকালবেলা পাকিস্তানি সেনাদের অগ্রগতির সংবাদ এসে পৌছার কিছু পরই ধলাপাড়া চৌধুরী বাড়ির দিক থেকে ব্যাপক গােলাগুলির শব্দ আসতে থাকে। ঐ বাড়ির কাছাকাছি স্থানে টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক হাবিবুর রহমানের কোম্পানিসহ ২টি কোম্পানির প্রায় ১৫০জন যুবক অবস্থান করছিল। বঙ্গবীর অতি সহজেই বুঝতে পারেন যে, তাঁর যােদ্ধারাই অতর্কিত আক্রমণের সুযােগ পেয়েছে। তাই বঙ্গবীর নিজেও শক্রদের উপর অতর্কিত আক্রমণের জন্য উত্তর দিক থেকে যে রাস্তা ধরে পাকিস্তানি সেনারা আসছিল, মাইল দুয়েক ঘুরে উত্তরে সে রাস্তায় পাকিস্তানি সেনাদের পিছনে এসে হাজির হয়। পাকিস্তানি সেনাদের যে আঁধারেই ঐ রাস্তা ধরে ফিরতে হবে, সেটুকু বুঝে অবস্থান নিয়ে শত্রুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। তখন বঙ্গবীরের সঙ্গে ছিলেন সাইদুর, সামসু, একটি ১৩-১৪ বছরের ছেলে আমজাদ, খােকা, সেলিম, দুলাল ও হালিম।
অন্যান্য বহুবারের মতাে এবারের বঙ্গবীরের ভুল হলাে না। দুপুর ১টা বাজতেই সিগন্যাল আসে, ঐ পথ ধরেই পাকিস্তানিরা পিছু হটতে শুরু করেছে। আর সংবাদ পান যে, শক্ররা নিশ্চিন্ত মনেই এগিয়ে আসছে এবং তাদের সংখ্যা এক কোম্পানির বেশিই হবে। অথচ তখন বঙ্গবীরের সঙ্গে মাত্র ১০জন। কিন্তু ঐ সংখ্যার ব্যাপারটা কখনাে বঙ্গবীরকে বিচলিত করতে পারে নি। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী পাকিস্তানিদের পুরাে অভ্যর্থনা করার জন্যই প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। তিনি সব সময়ই বিশ্বাস রাখতেন যে, শত্রু কোনাে সময়ই টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর সংখ্যা ও শক্তির খবর কিছুই রাখে । আর তার বিশ্বাসটুকুই ছিল তার সবচেয়ে বড়াে হাতিয়ার। তিনি একান্ত ভাবেই তার নিজের উপর বিশ্বাস রেখে সেখানে অপেক্ষা করতে থাকেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই পাকিস্তানি সেনারা তাঁর দৃষ্টিগােচর হয়। তাই শেষবারের মতাে তিনি তার সঙ্গীদের সাবধান করে দিয়ে বলেন, তারা যেন আগে ফায়ার ওপেন না করে। শত্রু যত কাছেই আসুক না কেন বঙ্গবীর ফায়ার না করা পর্যন্ত তারা যেন কিছুতেই ফায়ার না করে। আরও বলেন, ঘাবড়ালে চলবে না। দেখবে পাকিস্তানি সেনারা পালানাের রাস্তা পাবে না। তারপর ঠিক ১টা ২০ মিনিটের সময় পাকিস্তানি সেনারা যখন এগােতে এগােতে বঙ্গবীর আব্দুল কাদেক সিদ্দিকী এবং তাঁর সঙ্গীদের থেকে মাত্র ৪০ গজের মধ্যে এসে গেছে, তখন বঙ্গবীর শেষবারের মতাে একবার তাঁর ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিয়ে তার লাইট মেশিনগানের ট্রিগার চেপে ধরেন। আর সঙ্গে সঙ্গেই সঙ্গী যােদ্ধারাও তাদের অস্ত্রগুলাের ট্রিগার চাপতে দেরি করে না। ফলে তলােয়ারের মুখে কচুগাছ কেটে পড়ার মতাে। পাকিস্তানি হানাদার সেনারা লুটিয়ে পড়তে থাকে রাস্তার উপর। বহু হানাদার সেনা ঐ লাইট মেশিনগানের প্রথম গর্জনের শব্দে ছত্রভঙ্গ হয়ে ছুটাছুটি করতে শুরু করে দেয়। প্রায় দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়েই যে যেদিকে পারে পালাতে থাকে।
কিছুসংখ্যক আবার শুয়ে অবস্থান নিয়ে রাইফেল বা মেশিনগান চালাতে শুরু করে দেয়। বেশির ভাগ পাকিস্তানি সেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে ছুটে পালিয়েছে। কিছুসংখ্যক আবার অবস্থান নিয়ে গুলি চালাচ্ছে আর বাকিগুলাে সব রাস্তার উপর উল্টে মরে পড়ে রয়েছে। দৃশ্যটি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে এতই উত্তেজিত করে তুলেছে যে, তিনি আর শুয়ে থেকে গুলি চালিয়ে বৃথা গুলি নষ্ট করতে রাজি নন। হঠাৎ করে তার এলএমজিটা হাতে নিয়ে দাড়িয়ে উঠে ব্রাশ ফায়ার শুরু করে দিয়েছেন। ফলে আরও কয়েকটি হানাদার যারা। শুয়ে গুলি চালাচ্ছিল, তারা তাদের রাইফেল এলএমজি হাতে নিয়ে উল্টে পড়েছে। আর অন্যরা শুয়ে থাকতে সাহস করেনি। পাছপালা উচু-নিচু কভার নিয়ে উধ্বশ্বাসে ছুটে পালাতে চেষ্টা করেছে। ঠিক ১০ মিনিটেই অর্থাৎ ১টা। ৩০ মিনিটেই পাকিস্তানি সেনাদের অনেকে আহত এবং মােট ৩৮জন নিহত হয়। এ যুদ্ধে কাদের সিদ্দিকী গুরুতর আহত হন। হানাদারদের একটি গুলি সিদ্দিকীর এলএমজি-এর ফোর ছাইট নবে লেগে ভেঙে স্লিন্টার হাতের তালু ভেদ করে চলে যায় এবং বুলেটটি হাঁটুর ইঞ্চি খানেক উপরে আঘাত করে।
ধলাপাড়া নদীর যুদ্ধ
টাঙ্গাইল জেলা সদর থেকে উত্তরে অবস্থিত ঘাটাইল থানার সর্বপূর্বে ধলাপাড়ার অবস্থান। ১৬ আগস্ট সকাল ৭টা ৩০ মিনিট। পাকিস্তানিরা বিনা বাধায় ধলাপাড়া চৌধুরীবাড়ির ঘাট পর্যন্ত এসে নদীর উঁচু পাড় ঘেঁষে শুয়ে অবস্থান নেয়। শুধু অধিনায়কেরা ডান-বামে ঘােরাফেরা করে নদীর অপর পাড়ের অবস্থা দেখতে চেষ্টা করে। পূর্ব পাড় একেবারে নীরব। কোনাে সাড়াশব্দ নেই। ২৫-৩০ মিনিট পর শত্রুনেতা নির্দেশ দিল, “তুম লােগ উঠ যাও। কিস্তিকা এন্তেজাম কারাে। উস কিনার পার যানা হােগা।” এদিকে নদীর পূর্ব পাড়ে মৃত্যু যে ওত পেতে বসে আছে, তা শত্রু মােটেও জানতে পারেনি। অধিনায়কের নির্দেশ পেয়ে পাকিস্তানিরা ঘাটের কাছাকাছি জড়াে হয়। জায়গাটা শত্রুমুক্ত এবং নিরাপদ ভেবে তাদের মধ্যে আর আগের সতর্কতা রইল । ১০-১২জন শত্রু নদীর নিচে নেমে এল। বিকট চিৎকার করে পূর্ব পাড়ের লােকজনকে ডাকতে শুরু করে দিল, “ভাইলােগ কিস্তি কাহা হ্যায়? ঘাবড়ানা নেহি, বাহার আ যাও। হামলােগ দোস্ত হু।” চাচামেচি ও শশারগােল তুলে শক্র। যখন মুক্তিযােদ্ধাদের রাইফেলের নলের মুখে অসতর্ক ও এলােমেলাে দাড়িয়ে ছিল, তখন মুক্তিযােদ্ধারা অধৈর্য হয়ে পড়েন। এত ভালাে সুযােগ – একেবারে নলের মুখে শক্র। তাঁরা বাংকারে আর শক্র উন্মুক্ত স্থানে। গুলি চালালেই অবধারিত মৃত্যু, তবুও অধিনায়ক কোনাে নির্দেশ দিচ্ছেন না! ট্রিগারে রাখা আঙুলগুলাে নিশপিশ করছে মুক্তিযােদ্ধাদের, আর যেন দেরি সইছে না। চাই শুধু নির্দেশ সংকেত।
এমনিভাবে ৫-৬ মিনিট পার হলে শত্রু যখন আরও সুবিধাজনক জায়গায় আসে, তখন অধিনায়ক হাবিব, হাকিম, গফুর ও হুমায়ূন – এ চার কোম্পানি অধিনায়কের এলএমজি গর্জে ওঠে। সাথে সাথে কয়েক’শ মুক্তিযােদ্ধার সব কটি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র অগ্নি উদ্‌গিরণ শুরু করে দেয়। পাখি শিকারের মতাে শত্রু খতম হতে থাকে। মাত্র ১৫ মিনিট মুক্তিযােদ্ধারা অবিরাম শত্রুর উপর গুলি ছোঁড়েন। এরপর শুরু হয় শক্রর গুলি ছোড়ার পালা। শত্রু ভারি মেশিনগান ও মাঝারি মেশিনগান, রিকয়েললেস রাইফেল, ৩ ইঞ্চি মর্টার ও অন্যান্য অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থেকে অবিরাম গুলি নিক্ষেপ করে আশপাশের এলাকা কাপিয়ে। তুলল। কিন্তু আচমকা ১৫ মিনিটের অবিশ্রান্ত গুলিবর্ষণে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করে ফেলেছিলেন। প্রাথমিকভাবে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির পর শত্রু কিছুটা নিরাপদ স্থানে অবস্থান নিতে সক্ষম হয়। ব্যাপক গুলি ছোঁড়া নিরর্থক, তাই শুধু শত্রুর অবস্থান পরিবর্তনের সময় নিখুঁত লক্ষ্যের দিকে মুক্তিযােদ্ধারা ২-১টি গুলি ছুঁড়ে তাদের খতম ও ব্ৰিত করতে থাকলেন। এমন অবস্থায় এক ব্যাটালিয়ন অর্থাৎ ৮০০ নিয়মিত সেনা ও ২০০ রাজাকারের নেতৃত্বদানকারী লে. কর্নেল মােক্তার মােহাম্মদ ও মেজর মমিন যখন বুঝল, নিজেদের প্রায় ১২৫জন সৈন্য আহত হওয়ার পরও নদী পার হওয়া কিছুতেই সম্ভব হলাে না, তখন দুপুর ১২টা ৩০ মিনিট থেকে তারা পিছিয়ে যেতে শুরু করলাে। যুদ্ধের রিপাের্ট নিয়ে কাদের সিদ্দিকী ধলাপাড়া থেকে শেওড়াবাড়ি যান। কিন্তু তিনি শেওড়াবাড়ি পেীছার ঘণ্টা খানেক আগে হাতেম মারা যান। হাতেমকে শেওড়াবাড়ি মসজিদের পাশে যথাযােগ্য মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। এ যুদ্ধে শক্রর প্রায় শতাধিক সৈন্য হতাহত হয় এবং মুক্তিযােদ্ধা হাতেম শহিদ হন।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – চতুর্থ খন্ড