পাথরঘাটা পুনর্দখলের যুদ্ধ
টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর থানায় পাথরঘাটা অবস্থিত। ২২ জুলাই সন্ধ্যায় পাথরঘাটা মুক্তিবাহিনী ঘাঁটির পতন ঘটলে মুক্তিযােদ্ধা কাদের সিদ্দিকী তা পুনর্দখলের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। পাথরঘাটা পতনের কারণ পর্যালােচনা করে দেখা যায় যে, অস্ত্রবল ও মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবলের অভাবে পাথরঘাটা ঘাটির পতন ঘটেনি। পতন ঘটেছে সঠিক কৌশল সময়মতাে শত্রুকে আঘাত না হানতে পারার কারণে। পাথরঘাট পুনর্দখলের জন্য কাদের সিদ্দিকী অভিনব কৌশল অবলম্বনের সিদ্ধান্ত নেন। বাছাই করা ৩০জন মুক্তিযােদ্ধাকে তাঁর সহযােদ্ধা হিসেবে নেন। ২৫ জুলাই দলটি তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে ৬টি নৌকায় পাকিস্তানি পতাকা উড়িয়ে বাদাম থেকে পাথরঘাটার উদ্দেশ্যে রওনা হয় । পাকিস্তানিদের বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে মুক্তিযােদ্ধারা খাকি পােশাক ও হেলমেট পরে নৌকায় চড়েন। নৌকাগুলাে যখন পাথরঘাটা থেকে ৩০০ মিটার দূরে, তখন পাহারারত একটি সৈনিক ঘাটের কাছে এগিয়ে আসে। রসদ অথবা বদলি লােক আসছে ভেবে পাহারারত শত্রুর মধ্যে কোনাে উত্তেজনাই দেখা দেয়নি। ধীরে ধীরে নৌকাগুলাে বিভিন্ন দিক থেকে ঘাটে ভিড়তে থাকে। শেষ নৌকাটি যখন ঘাটে ভিড়ে, ঠিক তখন সৈনিকটির মনে সন্দেহ হয়। সে চাইনিজ রাইফেলযুক্ত নতুন নৌকাটিকে চ্যালেঞ্জ করে। অপরদিকে, ডান দিকের নৌকা থেকে নেমে আগেই মুক্তিযােদ্ধারা প্রস্তুত ছিলেন। সৈনিকটি চ্যালেঞ্জ করামাত্র পিছন থেকে একজন মুক্তিযােদ্ধা ৩০৩ রাইফেলের বাট দিয়ে সৈনিকটির মাথায় প্রচণ্ড জোরে আঘাত করেন। সাথে সাথে সৈনিকটি মৃত্যুবরণ করে। ঘাটে আচমকা শব্দ শুনে পাহারারত দ্বিতীয় সৈনিকটি স্বাভাবিকভাবেই সেদিকে এগিয়ে আসতে থাকে। কী ঘটছে, তা বুঝতে পারার আগেই শত্রুর পিছন থেকে একযােগে গুলি ও গ্রেনেড বিস্ফোরিত হতে শুরু হয়। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সে পানিতে ঝাপিয়ে পড়ে। তার পক্ষে আর পানি থেকে উঠে আসা সম্ভব হয়নি।
প্রথম পাহারারত শত্রুর মাথায় আঘাত করার সময় বাম দিকের ৪০জনের দলটি পিছন থেকে ক্যাম্পের ভিতর ঢুকে পড়েছিল। শত্রু দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে আক্রমণের কথা ভাবতেই পারেনি। পাথরঘাটা ক্যাম্পে যে ৮-১০টি বাংকার খোঁড়া হয়েছিল, তার ৬টির মুখই ছিল পশ্চিম দিকে। মুক্তিযােদ্ধারা পশ্চিম দিকটি আগলে ছিলেন। পশ্চাত্ৰক্ষার জন্য তারা মাত্র ২টি বাংকার পূর্ব দিকে খুঁড়েছিল। মিলিটারিরা ফরেস্ট ক্যাম্পে এসে পশ্চিম দিকের বাংকারগুলাে মাটি দিয়ে ভরাট করে ফেলে। পূর্ব-উত্তর দিকে নতুন করে ১০টি বাংকার খোঁড়ে। কারণ, মুক্তিবাহিনী বা তাদের ভাষায় দুষ্কৃতিকারীরা পূর্বউত্তরের দিকে আছে। তাই বন্দুকের নলও হওয়া উচিত পূর্ব-উত্তরে। কিন্তু ২৫ জুলাই সন্ধ্যায় মুক্তিযােদ্ধারা পূর্ব-উত্তর দিক থেকে না এসে পশ্চিম দিক থেকে একেবারে ঘাড়ে ঝাপিয়ে পড়ে। ৫০ মিটারের মধ্যে মুক্তিযােদ্ধাদের পৌছে যাওয়ার পরও তারা ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি, কী ঘটছে।
বাম দিকের দলের নেতা আবদুস সবুর খান, সাইদুর, খােকা, আমজাদ, কদুস, বেনুসহ ৪০জনের একটি দল নিয়ে প্রথমে আঘাত করে। কাদের সিদ্দিকী তখন সবুর থেকে প্রায় ২০০ মিটার দক্ষিণে। সন্ধ্যায় ক্যাম্প অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট নাজমুল হুদা এক সুবেদার ও ২জন হাবিলদারবেষ্টিত হয়ে ডাকবাংলাের সামনে বসে চা পান করছিল। সবুরের দল প্রথমে এ ৪জনের উপরই ঝাপিয়ে পড়ে। অকস্মাৎ গুলিবিদ্ধ হয়ে ১৬ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের লেফটেন্যান্ট ‘ভা-গাে দুশমন অ্যায়া’ বলেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। মুক্তিযােদ্ধারা। শত্রুর ব্যারাকের উপর বৃষ্টিধারার মতাে গুলি ছােড়েন। রফিক, মুক্তাগাছার মকবুল ও মােতালেব ওখাসহ ৬-৭জন অসীম সাহসিকতার সাথে ক্যাম্পের পূর্বউত্তরে ছুটে গিয়ে বাংকারে গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে লাগলেন। মাত্র ২০ মিনিটের ঝটিকা আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী পালানাের পথ খুঁজে পেল না। পশ্চিম দিক থেকে মুক্তিযােদ্ধারা আক্রমণ করেছেন। পূর্ব দিকে শত্রু আছে জেনে তারা বিশৃঙ্খলভাবে ক্যাম্প ছেড়ে ছুটে পূর্ব দিকেই গেল। পাথরঘাটা পুনর্দখলের ২০২৫ মিনিটের যুদ্ধে শত্রু পুরােপুরি নেতৃত্বহীন হয়ে ১২টি মৃতদেহ ও আহত ৬জনকে ফেলে পালাতে শুরু করে। আহত-নিহতদের চেয়ে শক্রর অস্ত্রশস্ত্র ও ব্যবহারিক দ্রব্যসামগ্রী পড়েছিল অনেক বেশি। পাকিস্তানিরা ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে পূর্ব দিকে প্রায় ২ কিলােমিটার গিয়ে সােজা দক্ষিণে চলতে শুরু করে। তাদের অর্ধেকের হাতেই অস্ত্র নেই। যাদের হাতে অস্ত্র আছে, তাদেরও অনেকের কাছে কোনাে গুলি নেই। অনেকেই পােশাক ও জুতা-মােজা পরার সুযােগ পায় নি। মূল দল থেকে ২জন শত্রু ছিটকে পড়েছিল। তারা একটু পরই মুক্তিবাহিনীর কাছে ধরা পড়ে। পাথরঘাটা দখলে আসায় বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গােলাবারুদ, কাপড়চোপড়, রেশন ও টাকাকড়ি মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে আসে। টাকার পরিমাণ প্রায় ৪০,০০০। দখলকৃত অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে ২টি চাইনিজ ৬০ মিলিমিটার মর্টার, ১০টি এসএমজি, ১টি ৮২ মিলিমিটার বেন্ডিসাইড, ২টি চাইনিজ এলএমজি, ২০টি চাইনিজ রাইফেলসহ কয়েকটি ৩০৩ রাইফেল।
কালিদাস পাড়ায় রাজাকার ক্যাম্প রেইড
টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল থানার কালিদাস পাড়ায় একটি রাজাকার ক্যাম্প ছিল। রাজাকারদের এ ক্যাম্প স্থাপনের ফলে মুক্তিযােদ্ধাদের কার্যক্রমে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। রাজাকাররা ক্যাম্পের পার্শ্ববর্তী গ্রামের নিরীহ মানুষকে নানাবিধ অত্যাচার-নির্যাতন করতাে। মুক্তিযােদ্ধারা রাজাকারদের অত্যাচারনির্যাতনের হাত থেকে স্থানীয় জনসাধারণকে উদ্ধারের জন্য এ ক্যাম্প আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুসারে ২৬ জুলাই কালিদাস পাড়ায় রাজাকারদের ক্যাম্পে মুক্তিযােদ্ধারা আক্রমণ করেন। উভয় পক্ষে প্রচণ্ড গােলাবিনিময় হয়। এ আক্রমণের ফলে স্থানীয় জনগণের জীবনে শান্তি ফিরে আসে এবং মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতি তাদের আস্থা ও শ্রদ্ধা বৃদ্ধি পায়। মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণে ১৯জন রাজাকার নিহত হয় এবং ৭জন আহত হয়। আহত ও নিহত রাজাকারদের কাছ থেকে ২৬টি ৩০৩ রাইফেল ও প্রচুর গােলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। বাকি রাজাকাররা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এ রেইডে মুক্তিযােদ্ধাদের কোনাে ক্ষয়ক্ষতি হয় নি।
ফুলতলার অ্যামবুশ
টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল থানার ফুলতলা একটি গ্রাম। টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কের উপর দিয়ে নিয়মিত পাকিস্তানিদের টহল গাড়ি চলাচল করতাে। ২৬ জুলাই মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক হাবিব এমন একটি টহল দলের উপর অ্যামবুশের মাধ্যমে হামলা করার পরিকল্পনা করেন। রাতে ১৫জনের একটি অ্যামবুশ দল নিয়ে তিনি ফুলতলা গ্রামের পাশে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ পাকা সড়কের ৬০-৭০ মিটার পশ্চিমে অবস্থান নেন। সারারাত অ্যামবুশে থেকে শক্রর কোনাে সন্ধান মেলেনি। রাত ৩টার দিকে যদিও পর পর ৩-৪টি গাড়ি তাদের সামনে দিয়ে চলে যায় কিন্তু সেই গাড়িগুলাে শত্রুর নয়, সাধারণ পণ্যবাহী ও একটি যাত্রীবাহী গাড়ি। কিছুটা হতাশ হয়ে সবাই যখন ঘাটিতে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত, ঠিক এমন সময় দূর থেকে গাড়ির হেডলাইটের আলাে তাদের দৃষ্টিগােচর হয়। অধিনায়ক হাবিবের নির্দেশে তৎক্ষণাৎ অ্যামুবশ দলটি আবার তাদের অবস্থান নেয়। গাড়িগুলাে খুব ধীরে। ধীরে এগিয়ে আসছিল।
পর পর ৩টি গাড়িতে ছিল পাকিস্তানি সেনা। তখন। সময় ভাের ৪টা ৩০ মিনিট। গাড়িগুলাে অ্যামবুশ দলটির সামনে এসে পড়লে অধিনায়ক হাবিব প্রথম গাড়ির উপর তার এলএমজি’র ব্রাশ ফায়ার শুরু করেন। সাথে সাথে অপর মুক্তিযােদ্ধারা বাকি গাড়ি ২টিকে লক্ষ্য করে ফায়ার শুরু করেন। সামনের ২টি গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পূর্ব পার্শ্বে পড়ে যায়। তৃতীয় জিপটির চাকা বায়ুহীন অবস্থায় রাস্তার উপর পড়ে থাকে। অনুমান করা হয়, ৩টি গাড়িতে মােট ৩০জন পাকিস্তানি নিয়মিত প্রভাতি টহলে বের হয়েছিল। অন্যান্য দিন এ টহল নির্বিঘ্নে হলেও ২৭ জুলাই সকাল শক্রর জন্য মােটেই শুভ হয়নি। হঠাৎ এ আক্রমণের পর অধিনায়ক হাবিব অত্যন্ত দ্রুততার সাথে নিরাপদে ঐ স্থান ত্যাগ করেন। ফুলতলায় মুক্তিবাহিনীর অ্যামবুশে পড়ে প্রায় ৭জন পাকিস্তানি নিহত এবং ১৩জন আহত হয়। মুক্তিযােদ্ধারা ৭টি অস্ত্র ও গােলাবারুদ উদ্ধার করেন। মুক্তিযােদ্ধাদের কোনােরূপ ক্ষতি হয়নি।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – চতুর্থ খন্ড