ঠাকুরকোনা সেতু ধ্বংস
ঠাকুরকোনা ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোনা মহকুমার (বর্তমানে জেলা)। নেত্রকোনা থানার অন্তর্গত একটি গ্রাম। গ্রামটির অবস্থান থানা সদর থেকে ৩-৪ কিলােমিটার উত্তরে। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে সােমেশ্বরী নদী। গ্রামের মাঝামাঝি অবস্থানে নদীর উপর সেতুটিই ঠাকুরকোনা সেতু হিসেবে এলাকায়। পরিচিত। নেত্রকোনা থেকে উত্তরে কলমাকান্দা ও দুর্গাপুর থানার সাথে সড়কপথে যােগাযােগ এ ঠাকুরকোনা সেতুর উপর নির্ভরশীল ছিল। এ সেতু। পাহারায় ১০জন রাজাকারের একটি দল নিয়ােজিত ছিল। ১৩ জুলাই মুক্তিযােদ্ধা আবদুল জব্বারের নেতৃত্বে ৩০জন মুক্তিযােদ্ধার একটি দল ঠাকুরকোনা সেতু আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে সেতু পাহারারত রাজাকাররা পালিয়ে যায়। সেতু এলাকা দখলের পর মুক্তিবাহিনী। ডিনামাইট দিয়ে সেতুটিকে উড়িয়ে দেয়। সেতুটি অকেজো হয়ে পড়ার ফলে। থানা থেকে উত্তর দিকের কলমাকান্দা, দুর্গাপুরের সাথে যােগাযােগ ব্যবস্থা । বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধাদের নাম নিমে উল্লেখ করা হলাে:
১. আবদুল জব্বার
২. আবু বকর সিদ্দিক
৩. মােহাম্মদ হাবিব।
৪. আবু আব্বাস
৫. আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ।
কটিয়াদি অ্যামবুশ
কটিয়াদির অবস্থান
ময়মনসিংহ জেলার কিশােরগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) একটি থানা কটিয়াদি। এলাকাটি ছিল চারদিকে হাওড়, বিল, খাল ও জলাভূমি এবং রাস্তাঘাট ও যােগাযােগ ব্যবস্থা অনুন্নত। চলাচলের জন্য নৌকাই ছিল প্রধান বাহন। কটিয়াদি সদরে কয়েকটি পাকা বাড়ি ছাড়া কোনাে স্থাপনা তখনাে গড়ে ওঠেনি। এলাকাটির দক্ষিণ পাশ দিয়ে পূর্ব-পশ্চিমে লম্বালম্বিভাবে ব্রহ্মপুত্র নদ বয়ে গেছে। মহকুমা শহর কিশােরগঞ্জ কটিয়াদি থেকে ২৫ কিলােমিটার উত্তরে অবস্থিত। কটিয়াদি থেকে ১০-১২ কিলােমিটার দক্ষিণে কুলিয়ারচর থানা এবং ২৫ কিলােমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ভৈরব বাজার অবস্থিত। ভৈরব বাজার থেকে কুলিয়ারচর হয়ে কটিয়াদি পর্যন্ত একটি কাচা রাস্তা ছিল এবং অসংখ্য স্থান ছিল বিধ্বস্ত। বর্ষার দিনে এ সড়কের অনেকাংশ পানির নিচে তলিয়ে যেত। থানা সদরের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলাের মধ্যে চরিরাকোমা, চরপুকিয়া, চড়িপাড়া, ঘগাইর, জালালপুর, মুদগা উল্লেখযােগ্য।
মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে কটিয়াদির গুরুত্ব
সড়কপথে ও নদীপথে বাজিতপুর ও ভৈরব বাজারে যাতায়াতের পথে একটি বিশেষ স্থান কটিয়াদি। কিশােরগঞ্জ থেকে ভৈরব বাজার ও আশুগঞ্জে চলাচলের জন্য কটিয়াদি ও কুলিয়ারচর ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ভৈরব ও কিশােরগঞ্জের মধ্যে যাতায়াতব্যবস্থা অবিচ্ছিন্ন রাখা এবং এলাকা মুক্তিবাহিনীর দখলমুক্ত রাখার জন্য পাকিস্তানি বাহিনী কটিয়াদি ও তার আশপাশ এলাকায় একাধিক ক্যাম্প স্থাপন। করে। এ ক্যাম্প স্থাপনের প্রধান কারণ ছিল কিশােরগঞ্জ মহকুমায় দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের সড়ক, রেলপথ ও নদীপথের উপর পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।
পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান
কিশােরগঞ্জের কটিয়াদি থানা ছিল ৭০ উইং রেঞ্জার্সের অপারেশনাল এলাকায়। পাকিস্তানি বাহিনী তাদের সহযােগী রেঞ্জার্স ও রাজাকারদের মাধ্যমে কটিয়াদি, মঠখােলা, কালিয়াচাপড়া, পাকুন্দিয়া, মনােহরদী, বাজিতপুর, কুলিয়ারচর ও গচিহাটায় একাধিক ঘাঁটি স্থাপন করে। ভৈরববাজার ও আশুগঞ্জেও ছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তিশালী অবস্থান। কিশােরগঞ্জের ঘাঁটিতে অবাঙালি রাজাকারদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হতাে। কটিয়াদি থেকে প্রায় ২০ কিলােমিটার
উত্তরে হােসেনপুর থানা সদর এলাকায় রাজাকারদের অনুরূপ একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ছিল। কটিয়াদিতে স্থানীয়ভাবে নিয়ােগকৃত আরও এক কোম্পানি রাজাকারের অবস্থান ছিল।
মুক্তিবাহিনীর অবস্থান
কিশােরগঞ্জ কটিয়াদি এলাকায় রেঞ্জার্স ও রাজাকারের ব্যাপক চলাচল থাকায় মুক্তিবাহিনীর এ এলাকায় কোনাে স্থায়ী ঘাঁটি গড়ে ওঠেনি। মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়কগণ সীমান্ত অবস্থান থেকে এলাকায় আক্রমণ পরিচালনা করতেন। জুন মাস নাগাদ এ এলাকায় মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি পায় এবং আশপাশের এলাকায় অবস্থান নিতে চেষ্টা করে। এ সময় স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধা দলের নেতা হারুন-অর-রশিদ পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি আক্রমণ পরিচালনা করেন। কটিয়াদির অ্যামবুশ এ যুদ্ধগুলাের মধ্যে একটি উল্লেখযােগ্য।
যুদ্ধের বিবরণ
১৯৭১ সালের ১৪ জুলাই কটিয়াদি এলাকায় অবস্থানকারী মুক্তিবাহিনীর দলনায়ক হারুন-অর-রশিদের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর চলাচলের একটি সংবাদ আসে। তথ্য সংগ্রহে জানা যায়, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৫টি সৈন্যবাহী লঞ্চ বেলাবাে থেকে এসে কটিয়াদিতে অপেক্ষা করছে। ১৫ জুলাই লঞ্চগুলাে যুদ্ধাস্ত্র, রসদ ও খাদ্যসামগ্রী নিয়ে পরবর্তী সময় ঢাকা অথবা ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার উদ্যোগ নিচ্ছে। অধিনায়ক হারুন-অর-রশিদ এ খবরের উপর ভিত্তি করে কটিয়াদি এলাকায় অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে কটিয়াদি থেকে কিছু দূরে সাগরদী বাজারের কাছে অবস্থান গ্রহণের মাধ্যমে সুবিধাজনক স্থানে লঞ্চের উপর আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। একই সময় গ্রুপ অধিনায়ক মােশাররফ হােসেন কিরণের নেতৃত্বে ২০জন মুক্তিযােদ্ধার আরাে একটি দল খিদিরপুর গ্রাম থেকে অগ্রসর হয়ে সাগরদী বাজারে এসে হারুন-অর-রশিদের দলের সাথে যােগ দেয়। অধিনায়ক হারুন-অর-রশিদ সাগরদী বাজারের কাছে রামপুরা গ্রামের উত্তর প্রান্তে যেখানে ব্রহ্মপুত্র নদ বাঁক নিয়েছে, সেখানে অ্যামবুশ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি মুক্তিযােদ্ধা দলটিকে ৩টি ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত করে ৩টি সুবিধাজনক স্থানে অবস্থানের নির্দেশ দেন। তিনি আরও নির্দেশ দেন, প্রথম লঞ্চটি মুক্তিবাহিনীর তৃতীয় ও শেষ অবস্থানে না পৌছানাে পর্যন্ত কেউ যেন গুলি না চালায়। তৃতীয় অবস্থানে ছিলেন শেখ হারুন-অর-রশিদের নেতৃত্বাধীন মূল দল।
১৫ জুলাই পাকিস্তানি সৈন্যবাহী লঞ্চগুলাে যাত্রা না করায় অধিনায়কের নির্দেশে সবাই শক্রর অপেক্ষায় থাকে। ১৬ জুলাই সকালে সংবাদ আসে যে,লঞ্চ ৫টি কটিয়াদি থেকে রওনা করেছে। যে-কোনাে সময় রামপুরা বাক। অতিক্রম করবে। এ সংবাদে শেখ হারুন-অর-রশিদ তার দলকে পুনরায় নদের তীরে ৩টি স্থানে অবস্থান গ্রহণে নির্দেশ দেন। | ১৬ জুলাই সকাল ৮টায় পাকিস্তানি বাহিনীর প্রথম ২টি লঞ্চ মুক্তিবাহিনীর অবস্থানে প্রবেশ করে। ২টি করে লঞ্চ একসাথে বাঁধা। সবাই দলনেতার নির্দেশের জন্য অপেক্ষায় থাকেন। দ্বিতীয় জোড়া লঞ্চ দুই নম্বর উপদলের সম্মুখে উপস্থিত হলে হঠাৎ করে এ দলের মুক্তিযােদ্ধা আফতাব উত্তেজিত হয়ে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে লঞ্চের উপর গুলিবর্ষণ শুরু করেন। সাথে সাথে মুক্তিযােদ্ধারা লঞ্চের উপর গুলি চালাতে থাকেন। ততক্ষণে প্রথম দিকের ৪টি লঞ্চ মুক্তিযােদ্ধাদের অ্যামবুশ সীমানার মধ্যে ঢুকে পড়েছে এবং ৪টি লঞ্চই আক্রান্ত হয়েছে। পিছনের লঞ্চটি সম্মুখের লঞ্চগুলাে আক্রান্ত হতে দেখে আর। সম্মুখে না এগিয়ে কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে রামপুরা বাজারের কাছে নদীর পশ্চিম তীরে সৈনিকদের নামিয়ে দেয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী লঞ্চের ছাদে বালুর বস্তা দিয়ে পূর্বেই একাধিক মজবুত বাংকার তৈরি করে রেখেছিল। সে অবস্থান থেকে তারা এলএমজি দিয়ে প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ শুরু করে। একইসাথে পিছনে স্থলপথে নেমে আসা এক সৈনিকও মরিয়া হয়ে গুলি চালাতে চালাতে অগ্রসর হতে থাকে।
দলনেতা হারুন বুঝতে পারেন, এ অবস্থায় পাকিস্তানি বাহিনীর সামনে টিকে থাকা সম্ভব নয়। তিনি তার নিজের দলের এলএমজি’র ফায়ারিং কভারে ৩টি দলকেই প্রত্যাহার করে নিয়ে আসতে সমর্থ হন। অধিনায়ক হারুন কটিয়াদির যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে নিজ দলসহ সাগরদী বাজার পার হয়ে চালাকচরে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে আসেন। অল্প কিছু সময়ের ব্যবধানে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর একটি হেলিকপ্টার আড়ালিয়া বাজারের পার্শ্ববর্তী মাঠে অবতরণ করে। এ অবস্থায় মুক্তিবাহিনীর এ দলটি প্রথমে ভেবেছিল, পাকিস্তানি বাহিনী তাদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য নতুনভাবে সৈন্য সমাবেশ ঘটাচ্ছে। পরে এলাকার জনগণের কাছ থেকে জানা যায় যে, হেলিকপ্টারটি এসেছিল পাকিস্তানি বাহিনীর আহত সৈনিকদের সরিয়ে নেয়ার জন্য। পাকিস্তানি বাহিনীর হেলিকপ্টারটি তিনবার এ এলাকায় আসা-যাওয়া করে। প্রত্যক্ষদর্শীর মতে, কটিয়াদি লঞ্চ আক্রমণে ১৫-১৬জন আহত ও নিহত সৈনিককে হেলিকপ্টারে করে নিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। কটিয়াদি অ্যামবুশে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধা কটিয়াদি অ্যামবুশে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধাদের নাম নিমে উল্লেখ করা হলাে:
১. শেখ হারুন-অর-রশিদ
২. ছানােয়ার আলী।
৩, মােশাররফ হােসেন
৪. আবদুর রশিদ
৫. হায়দার আলী নান্ন
৬. আতাউর রহমান
৭. কাজী মােস্তফা।
৮. আবদুল আউয়াল
৯, আবদুল কুদ্ছ।
১০. কাজী সাইদুর রহমান
১১. জয়নাল আবেদীন
১২. মতিউর রহমান
১৩. জয়নাল
১৪. মােস্তফা
১৫, তমিজউদ্দিন
১৬. আমিনুল ইসলাম
১৭. মাে. শামসুদ্দিন
১৮. মুজিবর রহমান
১৯. আবু তাহের।
২০. রফিকুল ইসলাম
২১. আতাউর রহমান।
২২. আহম্মদ হােসেন খান
২৩. আবদুল জব্বার।
২৪. আফতাব উদ্দিন
২৫. আবদুর রশীদ।
২৬. আবদুল মালেক
২৭. আবদুল হাকিম প্রমুখ।
সামগ্রিক মূল্যায়ন কটিয়াদি এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর লঞ্চ আক্রমণে মুক্তিবাহিনী সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করে। কিন্তু লঞ্চে পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তিশালী অবস্থান। সম্পর্কে অনভিজ্ঞতার কারণে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর পাল্টা আক্রমণের শিকার হয় এবং কটিয়াদি এলাকা থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – চতুর্থ খন্ড