You dont have javascript enabled! Please enable it! পশ্চিম সেক্টর - উত্তর-পশ্চিম সেক্টর - দক্ষিণ-পূর্ব সেক্টর - সংগ্রামের নোটবুক
পশ্চিম সেক্টর
৪ ডিসেম্বর পুরােদমে লড়াই শুরু হতে না হতেই ৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের পুরােটাই পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এ অঞ্চলের নিচু এলাকাগুলাের মধ্যে সংযােগ স্থাপন করে, চৌগাছা অঞ্চলের সৈন্যদের যশােরে সরিয়ে এনে এবং রাজশাহী অঞ্চল থেকে বিমানে ১ ব্যাটালিয়ন সৈন্য এনে যশােরের প্রতিরক্ষা আরও সুদৃঢ় করা হয়। কাজেই ৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা ভেদ করার লক্ষ্যে তাদের উপর বারংবার আঘাত করার। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এর আগে ২৮ নভেম্বরে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, বয়রা অঞ্চলে ডিভিশনটি তাদের আত্মরক্ষামূলক অবস্থান বজায় রাখার জন্য প্রয়ােজনে অগ্রসর হয়ে চুয়াডাঙ্গা-হাকিমপুর-যশাের এবং মিঠাপুকুরিয়া-লেবুতলা-যশাের অক্ষরেখা ব্যবহারের ভান করতে পারে। কিন্তু পালটা আক্রমণের আশঙ্কায় বাস্তবে কাজটা তারা বেশ ধীরগতিতে করতে থাকে। এ অচলাবস্থার। পরিপ্রেক্ষিতে ৫ ডিসেম্বর ডিরেক্টর অব মিলিটারি অপারেশন মেজর জেনারেল। ইন্দর সিং গিলের সাথে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চীফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জ্যাকব কথা বলেন।
আর্মি হেডকোয়ার্টারসে রিজার্ভে রাখা ৫০ প্যারাশুট ব্রিগেডের ১ ব্যাটালিয়ন। গ্রুপ, যেটা টাঙ্গাইলে অবতরণ করার কথা, সেটাকে ব্যবহার করতে দেওয়ার অনুরােধ করেন। বরাবরের মতাে সহায়তাকারী মেজর জেনারেল ইন্দর তখনি এতে সম্মতি প্রদান করেন। কিন্তু শর্ত দেন যে, প্রয়ােজন হলে তাদের আর্মি হেডকোয়ার্টারসের নিয়ন্ত্রণে ফেরত দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। সাথে সাথে ৫০ প্যারাশুট ব্রিগেড অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার ম্যাথু টমাসকে আক্রমণ রেখা নির্দেশ করে পিছন থেকে যশাের দখল করার দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয়। তার জন্য বাড়তি ১ট ব্যাটালিয়নেরও ব্যবস্থা করা হয়। ২ কোরের লেফটেন্যান্ট জেনারেল টি, এন, রায়নাকে এ সম্পর্কে অবহিত করে ব্রিগেডিয়ার টমাসকে সব ধরনের সহযােগিতা প্রদান করতে বলা হয়।
১ ব্যাটালিয়ন গ্রুপটি তার কাজ সম্পন্ন করার লক্ষ্যে ৬ ডিসেম্বর যাত্রা করে। ইতােমধ্যে ৫০ প্যারাশুট ব্রিগেড এসে পৌছানাের আগেই ৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন যশাের আক্রমণের জন্য উদ্দীপিত হয়ে থাকে। পাকিস্তানি বাহিনী এর আগেই যশাের ত্যাগ করে তাদের সুরক্ষিত ঘাটি দৌলতপুর, খুলনা ও মধুমতি নদীর পূর্ব পাড়ে সরে যাওয়ার ফলে ৬ ডিসেম্বর চুয়াডাঙ্গা-যশাের রােডে অবস্থিত দুর্গা বরকতি এলাকা দখলের কাজে এ ব্রিগেড গ্রুপকে ব্যবহার করার প্রয়ােজন পড়ে নি। ৭ ডিসেম্বর বিকালের মধ্যেই মিত্র বাহিনী যশােরের নিয়ন্ত্রণ। গ্রহণ করে। সিগন্যাল ইন্টারসেপশনের কাজে নিয়ােজিত পাকিস্তানি বাহিনী ৫০ প্যারাশুট ব্রিগেড চলাচলসংক্রান্ত সিগন্যাল ধরতে পারলেও সঠিকভাবে সেটার মর্মোদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়। দমদম এয়ারপাের্টে ৫,০০০ ছত্রীসেনা দেখা গেছে, সিবিএস (CBS) রেডিওতে প্রচারিত এ খবর থেকে ১ ব্যাটালিয়ন গ্রুপ এয়ারড্রপের পর নিয়াজির ধারণা জন্মায় যে, ৫০ প্যারাশুট ব্রিগেড পুরােটাই টাঙ্গাইলে নেমেছে। ৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের কথা ছিল যে, ফরিদপুর আক্রমণে ৪ মাউন্টেন ডিভিশনের শক্তিবৃদ্ধির জন্য তারা যশাের থেকে মাগুরায় সৈন্য পাঠাবে। এটা না করে ৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন মূল পরিকল্পনার ধারার বিপরীতে তার বাহিনীগুলাে পুনরায় একত্র করে কিঞ্চিৎ বিরতির পরে গতি পরিবর্তন করে। খুলনা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে ৫০ প্যারাশুট ব্রিগেডকে মাগুরা অক্ষরেখা। ধরে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এতে এ ব্রিগেডের ১টি ব্যাটালিয়নের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়।
৪ মাউন্টেন ডিভিশনও মাগুরা দখলের জন্য প্রস্তুত হয়ে | যশাের দখলের পর ৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের ৩২ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড খুলনার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। এ অগ্রসরকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য পাকিস্তানি বাহিনী সুরক্ষিত এলাকা রামনগর, সিংড়া, নওয়াপাড়া ও ফুলতলায় কয়েকটি শক্ত প্রতিরক্ষা অবস্থান রেখেছিল। রাস্তার দুই পাশে ছিল জলাভূমি। শত্রু সরে। যাবার আগে ব্যাপক হারে ব্রিজ ও কালভার্ট ধ্বংস করে যায়। তাদের তৈরি করা বাধাগুলাে অবশ্য একের পর এক অপসারণ করা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে শত্রুকে বেষ্টন করে বাম পাশ কাটিয়ে যাওয়া সম্ভব হলেও সামগ্রিকভাবে অগ্রগতি ছিল। শম্বুকগতি সম্পন্ন। শক্রর প্রধান প্রতিরক্ষা দৌলতপুরে ভারতীয় বাহিনী তাদের মুখােমুখি হয় ১১ ডিসেম্বর। দৌলতপুর খুলনারই একটি অংশ এবং তারা এ উভয় স্থান মিলে প্রায় ২ মাইল দীর্ঘ একটি সরু বেল্ট তৈরি করেছে। তাৎক্ষণিকভাবে এটাকে পাশ কাটানাের কোনাে উপায় ছিল না। কারণ, এর পশ্চিম পাশে জলাভূমি আর পূর্ব পাশে ভৈরব নদ। পাকিস্তানি বাহিনী শেষ পর্যন্ত লড়াই করে যাবার সব প্রস্তুতি নেয়। এর ফলে দৌলতপুর ও খুলনা দখলের অপারেশন এক দীর্ঘ ক্লান্তি কর কঠিন প্রতিযােগিতায় রূপান্তরিত হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রতি ইঞ্চি জমির দখল রাখার জন্য মরিয়া হয়ে লড়াই করে।
পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অপারেশনের পরিকল্পনা ও নির্দেশের সাথে সংগতি না থাকা সত্ত্বেও সম্পূর্ণ ৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন তার জন্য নির্ধারিত মাগুরাফরিদপুরমুখী আক্রমণ রেখা অনুসরণ করার পরিবর্তে বিনা কারণে এ এলাকায় মনােনিবেশ করে। উপর্যুপরি আক্রমণ ও পালটাআক্রমণের মুখে উভয়পক্ষেরই প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ ডিভিশন পূর্ব শিরােমণি, পশ্চিম শিরােমণি ও শ্যামগঞ্জের মাত্র ৩টি শত্রু এলাকা দখল করতে সমর্থ হয়। এর আগে ৪২ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড ভৈরব নদী অতিক্রম করে পশ্চিম পাড়ে ঘাঁটি স্থাপন করে একটি আক্রমণ রচনার চেষ্টা করে। ১৩-১৪ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর। সহায়তায় নৌকায় করে প্রথম পারাপারটি সম্পন্ন হয়। ব্রিগেডটি প্রায় কোনােপ্রকার বাধার মুখােমুখি না হয়েই দক্ষিণে নদীর মােহনা পর্যন্ত চলে যায়। দ্বিতীয় দফায় পারাপারের সময় অবশ্য তারা শক্ত প্রতিরােধের মুখে পড়ে। অপারেশন বাতিলের নির্দেশ দেওয়ার পরও পারাপার অব্যাহত ছিল। ৪ মাউন্টেন ডিভিশন ৫ ডিসেম্বর দর্শনা ও কোটচাদপুর দখল করে। কালীগঞ্জ দখল করে মেইন রােড ধরে ঝিনাইদহের দিকে অগ্রসর হওয়ার পরিবর্তে ডিভিশনটি ক্ষেত কোনাকুনি সংক্ষিপ্ত পথে উত্তরে যাত্রা করে। চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহের মধ্যবর্তী স্থানে তারা ১ ব্যাটালিয়ন এবং ১ স্কোয়াড্রন ট্যাংকের ১টি রােড ব্লক স্থাপন করে। এ অবরােধ ভাঙার লক্ষ্যে শত্রুর বেশ কয়েকটি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। অবরােধের পশ্চিম দিকে অবস্থিত সৈন্যদের ঝিনাইদহে শক্তিবৃদ্ধির পরিবর্তে উত্তরে কুষ্টিয়ার দিকে পশ্চাদপসরণ করতে হয়। ৪১ মাউন্টেন ব্রিগেড় অত্যন্ত দুরূহ কোটচাদপুর-তালশর-ঝিনাইদহ অক্ষরেখা ধরে ঝিনাইদহে প্রবেশ করে। ৭ ডিসেম্বর বিকালে তুলনামূলকভাবে সহজে ঝিনাইদহের পতন হয়। মাগুরার পতন হয় ৮ ডিসেম্বর এবং তারপর মধুমতি ফেরিঘাটে পৌছে যায়। ফলে শেষ পর্যন্ত এ অঞ্চলের জন্য নির্ধারিত ২ কোম্পানি ছত্রীসেনা নামানাের প্রয়ােজন পড়ে নি। মাগুরা দখলের পর ৬২ মাউন্টেন ব্রিগেড ফরিদপুরের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। কুমার নদীর ব্রিজ পাকিস্তানি সৈন্যরা উড়িয়ে দিয়ে মধুমতি নদীর পূর্ব পারে সরে যায় এবং ভারতীয় অগ্রাভিযানকে বাধা দেওয়ার জন্য নদীর পশ্চিম পাড়ে মাজাইল এলাকায় কিছু সৈন্য রেখে যায়।
৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যার আগেই তারা নদী অতিক্রমের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলে। এর মধ্যে ৭ মাউন্টেন ব্রিগেড, যেটাকে কুষ্টিয়া পাঠানাে হয়েছিল, পাকিস্তানি বাহিনীর ভেঙে যাওয়া ১টি ব্রিগেড এবং উত্তর দিক থেকে অতর্কিত আক্রমণের জন্য মােতায়েন করা ১ স্কোয়াড্রন পাকিস্তানি লাইট ট্যাংকের আক্রমণের মুখে পড়ে। কুষ্টিয়ায় শত্রুপক্ষের এত শক্তিশালী অবস্থান আগে বােঝা যায় নি। ফলে ৭ মাউন্টেন ব্রিগেড বেশ অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে যায়। ভারতীয় ৫টি ট্যাংক ধ্বংস হয় এবং অগ্রবর্তী কোম্পানির (Vanguard Company) প্রচুর সৈন্য হতাহত হয়। তারপর ৪ মাউন্টেন ডিভিশনের প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত অপ্রয়ােজনীয় রকমের হয় । মধুমতি অতিক্রম করে আক্রমণ রেখা ধরে অগ্রসর হওয়ার পরিবর্তে ৯। ডিসেম্বরে তারা কুষ্টিয়া রওনা হয়। ১২ ডিসেম্বরে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পৌছে দেখা গেল। যে, পাকিস্তানি বাহিনী সরে গেছে এবং যাবার সময় ব্রিজটি আংশিকভাবে ধ্বংস করে গেছে। ২ কোর যদি পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রস্তাবিত শিকারপুর-কুষ্টিয়া আক্রমণ রেখা ধরে চলত তাহলে হয়ত এ অঘটন ঘটত না। এতে হার্ডিঞ্জ ব্রিজও অক্ষত থাকত, পাকিস্তানি বাহিনীও নদীর অপর পারে সরে যাবার সুযােগ মনােনিবেশ করে। উপর্যুপরি আক্রমণ ও পালটাআক্রমণের মুখে উভয়পক্ষেরই। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ ডিভিশন পূর্ব শিরােমণি, পশ্চিম শিরােমণি ও শ্যামগঞ্জের মাত্র ৩টি শত্রু এলাকা দখল করতে সমর্থ হয়। এর আগে ৪২ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড ভৈরব নদী অতিক্রম করে পশ্চিম পাড়ে ঘাঁটি স্থাপন করে একটি আক্রমণ রচনার চেষ্টা করে। ১৩-১৪ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় নৌকায় করে প্রথম পারাপারটি সম্পন্ন হয়। ব্রিগেডটি প্রায় কোনােপ্রকার বাধার মুখােমুখি না হয়েই দক্ষিণে নদীর মােহনা পর্যন্ত চলে যায়। দ্বিতীয় দফায় পারাপারের সময় অবশ্য তারা শক্ত প্রতিরােধের মুখে পড়ে। অপারেশন বাতিলের নির্দেশ দেওয়ার পরও পারাপার অব্যাহত ছিল।
৪ মাউন্টেন ডিভিশন ৫ ডিসেম্বর দর্শনা ও কোটচাদপুর দখল করে। কালীগঞ্জ দখল করে মেইন রােড ধরে ঝিনাইদহের দিকে অগ্রসর হওয়ার পরিবর্তে ডিভিশনটি ক্ষেত কোনাকুনি সংক্ষিপ্ত পথে উত্তরে যাত্রা করে। চুয়াডাঙ্গা। ও ঝিনাইদহের মধ্যবর্তী স্থানে তারা ১ ব্যাটালিয়ন এবং ১ স্কোয়াড্রন ট্যাংকের। ১টি রােড ব্লক স্থাপন করে। এ অবরােধ ভাঙার লক্ষ্যে শত্রুর বেশ কয়েকটি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। অবরােধের পশ্চিম দিকে অবস্থিত সৈন্যদের ঝিনাইদহে শক্তিবৃদ্ধির পরিবর্তে উত্তরে কুষ্টিয়ার দিকে পশ্চাদপসরণ করতে হয়। ৪১ মাউন্টেন ব্রিগেড় অত্যন্ত দুরূহ কোটচাদপুর-তালশর-ঝিনাইদহ অক্ষরেখা ধরে ঝিনাইদহে প্রবেশ করে। ৭ ডিসেম্বর বিকালে তুলনামূলকভাবে সহজে ঝিনাইদহের পতন হয়। মাগুরার পতন হয় ৮ ডিসেম্বর এবং তারপর মধুমতি ফেরিঘাটে পৌছে যায়। ফলে শেষ পর্যন্ত এ অঞ্চলের জন্য নির্ধারিত ২ কোম্পানি ছত্রীসেনা নামানাের প্রয়ােজন পড়ে নি। মাগুরা দখলের পর ৬২ মাউন্টেন ব্রিগেড ফরিদপুরের দিকে অগ্রসর হতে। শুরু করে। কুমার নদীর ব্রজ পাকিস্তানি সৈন্যরা উড়িয়ে দিয়ে মধুমতি নদীর পূর্ব পারে সরে যায় এবং ভারতীয় অগ্রাভিযানকে বাধা দেওয়ার জন্য নদীর পশ্চিম পাড়ে মাজাইল এলাকায় কিছু সৈন্য রেখে যায় ।
৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যার আগেই তারা নদী অতিক্রমের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলে এর মধ্যে ৭ মাউন্টেন ব্রিগেড, যেটাকে কুষ্টিয়া পাঠানাে হয়েছিল, পাকিস্তানি বাহিনীর ভেঙে যাওয়া ১টি ব্রিগেড এবং উত্তর দিক থেকে অতর্কিত আক্রমণের জন্য মােতায়েন করা ১ স্কোয়াড্রন পাকিস্তানি লাইট ট্যাংকের আক্রমণের মুখে পড়ে। কুষ্টিয়ায় শত্রুপক্ষের এত শক্তিশালী অবস্থান আগে। বােঝা যায় নি। ফলে ৭ মাউন্টেন ব্রিগেড বেশ অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে যায়। ভারতীয় ৫টি ট্যাংক ধ্বংস হয় এবং অগ্রবর্তী কোম্পানির (Vanguard Company) প্রচুর সৈন্য হতাহত হয়। তারপর ৪ মাউন্টেন ডিভিশনের প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত অপ্রয়ােজনীয় রকমের হয়।  মধুমতি অতিক্রম করে আক্রমণ রেখা ধরে অগ্রসর হওয়ার পরিবর্তে ৯। ডিসেম্বরে তারা কুষ্টিয়া রওনা হয়। ১২ ডিসেম্বরে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পৌছে দেখা গেল। যে, পাকিস্তানি বাহিনী সরে গেছে এবং যাবার সময় ব্রিজটি আংশিকভাবে ধ্বংস করে গেছে। ২ কোর যদি পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রস্তাবিত শিকারপুর-কুষ্টিয়া আক্রমণ রেখা ধরে চলত তাহলে হয়ত এ অঘটন ঘটত না। এতে হার্ডিঞ্জ ব্রিজও অক্ষত থাকত, পাকিস্তানি বাহিনীও নদীর অপর পারে সরে যাবার সুযােগ পেত না। এর চেয়েও বড় ক্ষতি হলাে ডিভিশনটির মূল আক্রমণ রেখায় ফিরে আসতে বিলম্ব । ৪ মাউন্টেন ডিভিশন যে তাদের প্রাথমিক দায়িত্বকে পাশ কাটিয়ে অন্য কাজে সৈন্য পাঠিয়েছে, সে ব্যাপারে কোর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল টি, এন, রায়না অবগত ছিলেন না। এর ফলে ফরিদপুরের দিকে যাত্রা শুরু করতে কমপক্ষে ৩ দিন দেরি হয়ে যায় এবং এ কারণে গােয়ালন্দ ঘাট দিয়ে।  পদ্মা পার হয়ে ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়ার পরিকল্পনা কার্যকর করা সম্ভব হয়। নি। মূল নির্দেশ অনুযায়ী ২ কোর যশাের-মাগুরা অক্ষরেখায় ৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনও সৈন্য পাঠাতে ব্যর্থ হয় এবং অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যস্থল খুলনা দখলের কাজে শক্তির অপচয় হয়। ৫ ডিসেম্বর হার্ডিঞ্জ ব্রিজের সামান্য। উজানে আইডব্লিউটি ফ্লোটিলা ২ কোরের কাছে রিপাের্ট করে।
১৮ ডিসেম্বর ঢাকায় নিয়ে যাবার আগে পর্যন্ত নৌবহরটি সেখানেই নােঙর করা ছিল। লেফটেন্যান্ট জেনারেল রায়না ফ্লোটিলাটির যথাযথ ব্যবহার করে ঢাকা পৌছার। যথেষ্ট উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন নি। কুষ্টিয়া ও ভেড়ামারা শত্রুমুক্ত করার পর আবার মধুমতি অতিক্রমের দিকে মনােনিবেশ করা হয়। ১৩ ডিসেম্বরের মধ্যে ৬২ মাউন্টেন ব্রিগেড নদীর পশ্চিম পাড়ে এবং ৭ মাউন্টেন ব্রিগেড পরদিনের মধ্যেই মাগুরায় সমবেত হয়। ৫০ গজ চওড়া এবং কোথাও কোথাও ৪০ ফুট গভীর নদীটি ছিল বেশ বড়াে একটি বাধা। পূর্ব দিকে প্রক্ষিপ্ত গভীর একটি কোণ ফেরিঘাটের পশ্চিমে একটি রাস্তা তৈরি করেছে, যেটা নদীর পাড় ঘেঁষে উত্তরে আনুমানিক ২ মাইল এবং দক্ষিণে ৪ মাইল জুড়ে বিস্তৃত। | শক্র তাদের ৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের কর্নেল স্টাফের অধীন আনুমানিক ২টি দুর্বল ব্যাটালিয়ন এবং ১০৫ মিলিমিটার কামানের ১টি ব্যাটারি নিয়ে ১টি অ্যাডহক ব্রিগেড তৈরি করে পূর্ব পাড়ে তাদের দখল বজায় রেখেছিল। মূল। পরিকল্পনা অনুযায়ী ৬২ মাউন্টেন ব্রিগেড় উত্তর দিক দিয়ে নদী অতিক্রম করবে। শক্রর মূল অবস্থানের পাশ দিয়ে ছড়িয়ে পড়বে। তাদের ঘিরে রাখবে এবং মেইন রােডের ওপারে অবস্থিত কুমারখালী দখল করবে। আরও চিন্তাভাবনা করে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, এ কাজে ৬২ ও ৭ মাউন্টেন ব্রিগেডকেই ব্যবহার করা হবে। এক দল এগােবে উত্তর দিক দিয়ে এবং অন্য দল দক্ষিণ দিক দিয়ে। এবং সাঁড়াশি আক্রমণ করে ফেরিঘাটের পূর্ব দিকের রাস্তাটি বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে।
প্রবল প্রতিরােধের মুখে ১৪-১৫ ডিসেম্বরে এ ব্রিগেড ২টি নদী পার হয়। ৭ মাউন্টেন ব্রিগেডের কাজটি ছিল বেশ দুরূহ। কারণ, প্রাথমিক অবস্থা যাচাইয়ের। বা রেকি করার মতাে যথেষ্ট সময় তাদের হাতে ছিল না এবং নদীর তীরে জায়গা মতাে পৌছানাের জন্য তাদের প্রায় ৩০ কিলােমিটার পথ মাঠের মধ্যে। দিয়ে এগােতে হয়। নদী অতিক্রমের কাজটি সফলভাবেই শেষ হয় এবং ১৫ ডিসেম্বর বিকালের মধ্যে মেইন রােডে সাঁড়াশি আক্রমণ সম্পন্ন হয়। প্রতিরক্ষা। ব্যুহ ভেদ করে বেরিয়ে যাবার কয়েকটি বেপরােয়া প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় শত্রু বাহিনী তাদের সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র ও লােকজন নিয়ে আত্মসমর্পণ করে।৪ মাউন্টেন ডিভিশনকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যর্থতার কারণে এবং যশাের-মাগুরা আক্রমণ রেখা থেকে সরে এসে খুলনা আক্রমণের জন্য ৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনকে মৌন সম্মতি দানের সাথে সাথে তারা ইনল্যান্ড ওয়াটারওয়েজ ফ্লোটিলা ব্যবহার না করায় এতে বেশ কিছুটা দেরি হয়। এর ফলে এ দিক থেকে ঢাকা আক্রমণের সম্ভাবনাও তিরােহিত হয়ে যায়।
উত্তর-পশ্চিম সেক্টর
৭১ মাউন্টেন ব্রিগেড ইতােমধ্যেই মিরগড় থেকে শুরু করে ৩ ডিসেম্বরের মধ্যেই পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও দখল করে নেয় এবং দক্ষিণ দিকে তাদের অগ্রগতি অব্যাহত রেখে ৫ ডিসেম্বরে বীরগঞ্জ অধিকার করে ৬ ডিসেম্বর কান্তানগরে ঢ্যাপা নদীর ব্রিজের কাছে পৌছায়। অনুমান অনুযায়ী পাকিস্তানি সৈন্যরা ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে ঢ্যাপা ও আত্রাই নদীর মধ্যবর্তী এলাকায় তাদের শক্ত ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল। নদী অতিক্রমের চেষ্টা করলে ৭১ মাউন্টেন ব্রিগেডের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। | ১৯৭১ সালের ৯-১০ ডিসেম্বর রাতে দিনাজপুরের দিকে শত্রু অবস্থানের। দক্ষিণে ১টি ব্যাটালিয়ন ব্লক স্থাপন করা হয়। কিন্তু এতে শত্রু খুব একটা বাধাগ্রস্ত হয় নি। কারণ, তাদের রসদের সরবরাহ আসত পূর্ব দিক থেকে। তারপর মূল আক্রমণ রেখা পূর্ব দিক থেকে নীলফামারীর দিকে পরিবর্তনের | নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত ব্রিগেডটি দিনাজপুর শহরের প্রান্ত পর্যন্ত ক্রমাগত টহল দল পাঠিয়ে আক্রমণের হুমকি অব্যাহত রাখে। আরও ১০ মাইল উত্তরে গিয়ে। ব্রিগেড ঢ্যাপা নদী অতিক্রম করে এবং ১৩ ডিসেম্বর খানসামা দখল করে । ১৪ ডিসেম্বরে খানসামার আরও ৪ মাইল পূর্ব দিকের একটি এলাকা শত্রুমুক্ত করা। ১৬ ডিসেম্বর সকালের মধ্যে ব্রিগেডটি নীলফামারী শহরের ৫ মাইল। দক্ষিণ-পশ্চিমে পৌছায়।
৭১ মাউন্টেন ব্রিগেডের অব্যাহত চাপের মুখেও পাকিস্তানি সৈন্যরা শেষ পর্যন্ত দক্ষিণের বিপদগ্রস্ত অঞ্চলে শক্তিবৃদ্ধির লক্ষ্যে তাদের মজবুত ঘাঁটি সৈয়দপুর, রংপুর, পার্বতীপুর ও দিনাজপুর থেকে সৈন্য এনে ঐ ঘাটিগুলাের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল করে ফেলে নি। ৬ মাউন্টেন ডিভিশনের অধীনস্থ ৯ মাউন্টেন ব্রিগেড ৬ ডিসেম্বরের মধ্যে কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট দখল করে নেয় এবং অধিকৃত এলাকাগুলাে থেকে রংপুরের উপরে আক্রমণের মহড়া অব্যাহত রাখে। পরবর্তী সময় ২০ মাউন্টেন ডিভিশনের অধীনস্থ ৩৪০ মাউন্টেন ব্রিগেডকে আক্রমণাত্মক অপারেশনের জন্য। বিশ্রাম দেওয়ার লক্ষ্যে এ ব্রিগেডটি দিনাজপুরের দক্ষিণ দিকের এলাকায়। স্থানান্তর করা হয়। ২০ মাউন্টেন ডিভিশন বালুরঘাট অঞ্চলে দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৬৫ মাউন্টেন ব্রিগেডকে সেখানে মােতায়েন করে। দক্ষিণ দিক থেকে দিনাজপুর। করায়ত্ত করার জন্য ৩৪০ মাউন্টেন ব্রিগেড এবং মূল আক্রমণ রচনার জন্য ৬৬ ও ২০২ মাউন্টেন ব্রিগেড পীরগঞ্জে অবস্থান নেয়। ৬৬ মাউন্টেন ব্রিগেড ফুলবাড়ি দখল করে। অন্যদিকে, হিলি-চরখাই অক্ষরেখা ধরে অগ্রসর হওয়ার। নির্দেশ থাকলেও ২০২ মাউন্টেন ব্রিগেড হিলি অতিক্রম করতে পারে নি। ফলে ৬৬ মাউন্টেন ব্রিগেডকে চরখাই দখলেরও নির্দেশ দেওয়া হয়, যা তারা ৪ ডিসেম্বর সম্পন্ন করে। পীরগঞ্জের দিকে অগ্রসর হওয়ার পথে ৬৬ মাউন্টেন ব্রিগেড ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে নবাবগঞ্জ ও হাতঙ্গিঘাট এবং ৬ ডিসেম্বরের মধ্যে কাঞ্চনধা ঘাট দখল করে ।
পীরগঞ্জ অভিমুখে অভিযানের গতি বাড়ানাের লক্ষ্যে ৯ মাউন্টেন ব্রিগেড এসে ৩৪০ মাউন্টেন ব্রিগেডকে অব্যাহতি দেয়। ৭ ডিসেম্বর পশ্চিম দিক থেকে ঘােড়াঘাটে পৌছানাের জন্য ৬৬ মাউন্টেন ব্রিগেডকে নির্দেশ দেওয়া হয়। অন্যদিকে, পীরগঞ্জ দখল করে ৩৪০ মাউন্টেন ব্রিগেড উত্তর-পূর্ব দিক থেকে ঘােড়াঘাটে পৌছায়। পাকিস্তানি বাহিনীর ২টি ইনফ্যান্ট্রি কোম্পানি ও ১ টুপ ট্যাংকের নিয়ন্ত্রণাধীন ভাদুরিয়ায় এসে ৬৬ মাউন্টেন ব্রিগেড কঠিন প্রতিরােধের মুখােমুখি হয়। ভাদুরিয়াকে শত্রুমুক্ত করতে তাদের ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় লাগে এবং গণনা করে দেখা যায় যে, শত্রুর ৮২জন নিহত হয়েছে। ৬৬ মাউন্টেন ব্রিগেডের পক্ষে আক্রমণকারী ১৭ কুমায়ুনের ৫৫জন নিহত এবং ৭২জন আহত হয়। | ৩৪০ মাউন্টেন ব্রিগেড দ্রুতগতিতে অগ্রসর হতে থাকে। ৭ ডিসেম্বর। পীরগঞ্জ; ৯ ডিসেম্বর পলাশবাড়ি এবং ১০ ডিসেম্বর তারা গাইবান্ধা ও ফুলছড়ি ঘাট দখল করে। এর ফলে একটি কটিরেখা’ (Waistline) তৈরি হয় এবং পাকিস্তানি সৈন্যরা দিনাজপুর-রংপুর অঞ্চলে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আরও দক্ষিণে। চাপ সৃষ্টি করে এ ব্রিগেড পাশ থেকে অসাধারণ এক আক্রমণ রচনার মাধ্যমে ১১ ডিসেম্বর গােবিন্দগঞ্জ দখল করে। ৩টি ট্যাংক ও ৫টি ১০৫ মিলিমিটার গানসহ সম্পূর্ণ ১টি ব্যাটালিয়ন তারা অধিকার অথবা নিশ্চিহ্ন করে। ইতােমধ্যে পাকিস্তানি সৈন্যরা হিলি ও ঘােড়াঘাটের মধ্যবর্তী অঞ্চলে তাদের সুসংহত অবস্হান থেকে পরিকল্পিতভাবে লড়াই করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ১১ ডিসেম্বর হিলির ও ১২ ডিসেম্বর ঘােড়াঘাটের পতন হয়। সড়ক পথটি চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করার উদ্দেশ্যে পীরগঞ্জেও পাকিস্তানিরা প্রচণ্ড পালটা আক্রমণ চালায় কিন্তু তারা কোনাে সাফল্য লাভ করতে পারে নি। ‘কটিরেখার ওপারে দখল নিশ্চিত হওয়ার পর বগুড়া দখলের জন্য ২টি অক্ষরেখা ধরে অগ্রসর হওয়ার পরিকল্পনায় হাত দেওয়া হয়। ৩৪০ মাউন্টেন।
ব্রিগেড এগােবে গােবিন্দগঞ্জ-বগুড়া, আর ২০২ মাউন্টেন ব্রিগেড এগােবে ঘোড়াঘাট-ক্ষেতলাল-বগুড়া অক্ষরেখা ধরে। একই সাথে ১৬৫ মাউন্টেন ব্রিগেডের উপর জয়পুরহাটের দিকে কিছুটা এগিয়ে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। ১৩ ডিসেম্বর পাঁচবিবি দখল করতে গিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের উদ্দীপিত। প্রতিরােধের মুখােমুখি হলেও ১৬৫ মাউন্টেন ব্রিগেড জয়পুরহাট দখল করে বিনা বাধায়। ২০২ মাউন্টেন ব্রিগেডের ১টি কলাম ঘােড়াঘাট-সৈয়দপুর-ক্ষেতলাল অক্ষরেখা ধরে এগােবার পথে প্রবল প্রতিরােধের মুখেও ১২ ডিসেম্বর ক্ষেতলাল দখল করে। রাস্তাঘাট ব্যাপকভাবে ধ্বংস করে দেওয়ার ফলে ক্ষেতলাল ছাড়িয়ে অগ্রসর হওয়া সম্ভব ছিল না। ৩৪০ মাউন্টেন ব্রিগেড অবশ্য খুব দ্রুতগতিতে অগ্রসর হয়। অসাধারণ আরও একটি অভিযানে ১ কোম্পানি পাকিস্তানি সৈন্যের নিয়ন্ত্রণাধীন ইছামতি নদীর ব্রিজ অক্ষতভাবে ১৩ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনী দখল করে। বগুড়া পৌছানাের পথে করতােয়া নদীর ব্রিজও তারা অক্ষত অবস্থায় দখল করে। বগুড়ার দালানকোঠা সমৃদ্ধ এলাকা শত্রুর ২০৫ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের অবশিষ্ট অংশের নিয়ন্ত্রণে ছিল। সেখানে পাকিস্তানি সৈন্যরা শেষ পর্যন্ত মরিয়া হয়ে লড়াই করে। এর মধ্যে যুদ্ধ থেমে যায়। ৩৪০ মাউন্টেন ব্রিগেড পাকিস্তানি ২০জন অফিসার ও ৫০০জন অন্যান্য পদবির সৈন্যকে বন্দি করে এবং বগুড়ার উত্তরাংশে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। ১৪ ডিসেম্বর, ৬৬ মাউন্টেন ব্রিগেড এবং তারপর ২০২ মাউন্টেন ব্রিগেডকে রংপুরের দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। হালকা প্রতিরােধের পর ১৫ ডিসেম্বর মিঠাপুকুর অধিকৃত হয় এবং অভিযান বন্ধের নির্দেশ আসার আগেই দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণ দিক থেকে ব্রিগেড ২টি রংপুরে প্রবেশ করে। সবচেয়ে কঠিন প্রতিরােধের মুখােমুখি হলেও ২০ মাউন্টেন ডিভিশন অপারেশন সম্পন্ন করায় সবচেয়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখে।
দক্ষিণ-পূর্ব সেক্টর
৮ মাউন্টেন ডিভিশনের অন্তর্ভুক্ত ৫৯ মাউন্টেন ব্রিগেড ১ ডিসেম্বর থেকে কুলাউড়ায় আটকে থাকে। শেষ পর্যন্ত ৬ ডিসেম্বর শত্রু নিধনের জন্য বিমান আক্রমণ করলে কুলাউড়ার পতন হয় । ৮১ মাউন্টেন ব্রিগেড ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে মুনশিবাজার দখল করে এবং ৭ ডিসেম্বর প্রবল প্রতিরােধের মুখে মৌলভীবাজারের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিন্ন করে ফেলে। পাকিস্তানি ৩১৩ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডকে মৌলভীবাজার থেকে সিলেটে সরে। যেতে নির্দেশ দেওয়া হয়। ১০ ডিসেম্বর ৮১ মাউন্টেন ব্রিগেড বিনা বাধায় সাদীপুর ও শেরপুরঘাট দখল করে সিলেটের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের একমাত্র সড়ক সংযােগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তারপর কোর রিজার্ভ হিসেবে তারা আগরতলায় সমবেত হয়। ৭ ডিসেম্বর ৫৯ মাউন্টেন ব্রিগেডের ৪/৫ গােখা হেলিকপটারে করে সুরমা নদী অতিক্রম করে সিলেটের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে যায়। পাকিস্তানি সৈন্যরা সিলেট থেকে অসামরিক লােকজনকে সরিয়ে দিয়ে শহরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুসংহত করে। পাকিস্তানি ২০২ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের হাতে শহর প্রতিরক্ষার দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল। মৌলভীবাজার থেকে পাকিস্তানি ৩১১ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড এসে সিলেট গ্যারিসনে যােগ দেয়। এতে সিলেটে তাদের শক্তির পরিমাণ দাঁড়ায় ৬টি ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন, ১টি রেজিমেন্ট আর্টিলারি ১০৫ মিলিমিটার গান এবং ১ ব্যাটারি ১২০ মিলিমিটার মটার। পাকিস্তানি ৩১১ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড যে মৌলভীবাজার থেকে সিলেটে চলে আসতে পারে, তা ভাবা যায় নি। ধারণা করা হয়েছিল যে, এ ব্রিগেডটি মেঘনা নদীর ওপর রেল সেতুতে পিছিয়ে গিয়ে মেঘনা ক্রসিং ও ঢাকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দৃঢ়তর করবে। ওরা এটা করলে মেঘনা পেরিয়ে ৪ কোরের অগ্রযাত্রা খুব কঠিন হতাে। তাদের সিলেট যাওয়া সম্পর্কিত রেডিও ইন্টারসেপ্ট পেয়ে ভারতীয় বাহিনী খুব আশ্বস্ত বােধ করে। এর অর্থ হলাে যে, এ ব্রিগেড ২টি এখন সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় সিলেটে থাকছে, যেখানে তাদের অকার্যকর করে আটকে রাখা সম্ভব।
বাস্তবে নিয়ােজিত হঠাৎ এ দুর্গ প্রতিরক্ষা’র ধারণা যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি বদলে দেয়। আক্রমণকারী যৌথ বাহিনী শত্রুকে এ দুর্গে অবরুদ্ধ রেখে অপেক্ষাকৃত সহজভাবে ঢাকা অভিমুখী হতে পেরেছে। অন্যথায়। অগ্রাভিযান আরও কঠিন হতাে নিঃসন্দেহে। | ডাউকি থেকে দক্ষিণে অগ্রসরমাণ ৫/৫ গাের্খা রেজিমেন্টকে ৮ মাউন্টেন ডিভিশনের অধীন আনা হয় এবং ৭ ডিসেম্বর জৈন্তাপুর-দরবস্ত-সিলেট রােড ধরে সিলেটের দিকে এগােতে শুরু করে। এ ব্যাটালিয়ন চন্দনঘাট দখল করে। উত্তর-পূর্ব দিক থেকে সিলেটে প্রবেশ করে। ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গোখা সুসম্পন্ন এক অভিযান শেষ করে কানাইঘাট থেকে চিকনাগুল এসে ৫/৫ গােখা। রেজিমেন্টের সাথে যােগ দেয়। ৫৯ মাউন্টেন ব্রিগেড ৪/৫ গাের্খা রেজিমেন্ট ছাড়া সিলেটের দিকে অগ্রসর হয়, ১১ ডিসেম্বর ফেঞ্চুগঞ্জ দখল করে এবং ১৩ ডিসেম্বর ৪/৫ গাের্খা রেজিমেন্টের সাথে পুনর্মিলন হয়। ৯-১৭ ডিসেম্বর চূড়ান্ত আত্মসমর্পণের পূর্ব পর্যন্ত তারা পাকিস্তানি ২টি ব্রিগেডকে সিলেট গ্যারিসনে ঘেরাও অবস্থায় রাখতে গিয়ে সেক্টরের বাকি অংশের সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে।  ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশন আশুগঞ্জ ঘিরে ফেলে এবং ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে দখল করে। এ যুদ্ধের সময় ৩১১ মাউন্টেন ব্রিগেডের ১টি ব্যাটালিয়ন কড়া এলাকায় তিতাস নদীর ওপারে আড়াআড়িভাবে অবরােধ তৈরি করতে সমর্থ হয়। এবং দেখতে পায় যে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-আখাউড়া রেলপথ থেকে রেললাইন তুলে। ফেলে সেটাকে রােড বানানাে হয়েছে। তিতাসের ওপারের রেলসেতুটি শুধু অক্ষতই ছিল না বরং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে আরও অনুসন্ধান করে দেখা যায় যে, এ এলাকাটি প্রায় অরক্ষিতই রয়ে গেছে।
প্রথম দিকে এ অক্ষরেখা ধরে ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়ার কথা ভাবা হয়। নি। ধারণা করা হয়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা খুব মজবুত হবে এবং মৌলভীবাজার থেকে হটে আসা পাকিস্তানি ব্রিগেডের অংশটিও এ অঞ্চলেই। আসবে। তা ছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও আশুগঞ্জের মধ্যে তেমন কোনাে সড়ক যােগাযােগ ছিল না। অবশ্য পাকিস্তানি ৩১১ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড উত্তরে সিলেটের দিকে যাওয়ার সড়ক পথে তখন একটি অক্ষরেখা বিদ্যমান ছিল। কোর অধিনায়ক সমর্থিত জিওসি বেন গনজালভেসের সুপারিশ অনুযায়ী ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশনের আক্রমণ রেখা দাউদকান্দির পরিবর্তে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-আশুগঞ্জে পরিবর্তন করা হয়। এ ডিভিশনটি জলমগ্ন এলাকা দিয়ে ত্রিমুখী আক্রমণ চালায়। সাঁড়াশি আক্রমণের মুখ বন্ধ হওয়ার আগেই অবশ্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সটকে পড়ে। ৯ ডিসেম্বর ডিভিশন আশুগঞ্জে পৌছায়। কিন্তু তার আগেই যেমন ভাবা হয়েছিল, রেল ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে আশুগঞ্জে সামান্য কিছু প্রতিরােধ রেখে শত্রুরা ভৈরব বাজারে সরে যায়। সদর দপ্তর মেইন ৪ কোরের প্রত্যক্ষ আওতাধীন ৬১ মাউন্টেন ব্রিগেডকে গােমতী নদী অতিক্রম করে পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম দিকের সড়ক সংযােগ বিচ্ছিন্ন করে ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনকে সাহায্য করার জন্য ময়নামতির নিকটবর্তী হওয়ার দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়। ৭ ডিসেম্বর সংবাদ পাওয়া যায় যে,বুড়িচং থেকে শত্রু সরে গেছে। ৬১ মাউন্টেন ব্রিগেড সাহসের সাথে সুযােগটি তৎক্ষণাৎ কাজে লাগায়। বিনা বাধায় তারা গােমতী অতিক্রম করে চান্দিনা ও জাফরগঞ্জে অবরােধ বসায়। ইঞ্জিনিয়ার কোরের সদস্যরা একটি পার্শ্ব সড়ককে মাত্র ১২ ঘণ্টার মধ্যে ক্লাস ৫ ট্র্যাকে রূপান্তরিত করেন। একই ট্রাককে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ১টি ব্রিজ তৈরিসহ ক্লাস ৯ ট্র্যাকে উন্নীত করা হয়। এ ট্র্যাকের ওপারে ব্রিগেডটি শেষ পর্ষন্ত তাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিল। এর মধ্যে ১ টুপ ট্যাংকসহ ১২ কুমায়ুন রেজিমেন্টকে দাউদকান্দি দখলের। জন্য দ্রুত সামনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। রাস্তায় কোনাে সুসংগঠিত প্রতিরােধ তাদের মােকাবিলা করতে হয় নি, শুধু ইলিয়টগঞ্জে ১ প্লাটুন সৈন্যের দুর্বল। প্রতিরােধ ছাড়া। এলাকাটি শত্রুমুক্ত করা হয় এবং ৯ ডিসেম্বর দাউদকান্দি নিয়ন্ত্রণে আসে।
পাকিস্তানি সৈন্যরা বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে। শত্রুমুক্ত শহর কুমিল্লা ৯ ডিসেম্বর দখল করা হয়। পাকিস্তানি সৈন্য যারা পেরেছে, তারা ময়নামতি নগর দুর্গে আশ্রয় নেয়। ময়নামতির দিকে সরে যাবার সময় কুমিল্লা ও দাউদকান্দির। মাঝামাঝি অঞ্চলে প্রায় ১,৫০০ সৈন্য আটকা পড়ে এবং আত্মসমর্পণ করে। স্থানীয় পর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনীর এটাই সর্বপ্রথম বড়াে আকারের। আত্মসমর্পণ । কুমিল্লা-লাকসাম-চৌদ্দগ্রাম-মুজাফফরগঞ্জ অঞ্চলের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। লালমাই পাহাড় এলাকায় পাকিস্তানি ১১৭ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের বেশ শক্ত অবস্থান থাকলেও তাদের অবস্থানের গভীরতা ছিল কম। ফলে লাকসামকে। বিচ্ছিন্ন করে লালমাইয়ের প্রতিরােধ এড়িয়ে চাদপুরে আঘাত হানার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ৬১ মাউন্টেন ব্রগেড চৌদ্দগ্রাম অঞ্চলের সড়ক অবরােধ করে উত্তর দিকের এলাকা দখল করে। ৩ ডিসেম্বর রাতে ৩০১ মাউন্টেন ব্রিগেড নিঃশব্দে লালমাই পাহাড় ও লাকসামের মধ্যবর্তী এলাকায় প্রবেশ করে এবং ৬ ডিসেম্বরের মধ্যে মুজাফফরগঞ্জ অধিকার করে। পথে শত্রুর ১টি সম্পূর্ণ ব্যাটালিয়ন তাদের হাতে ধরা পড়ে। ৭-৮ ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা মুজাফফরগঞ্জের উপরে প্রচণ্ড পালটা আক্রমণ চালায়, কিন্তু মিত্র বাহিনীকে তারা সরাতে পারে নি। ৩০১ মাউন্টেন ব্রিগেড তার অব্যাহত অগ্রযাত্রার মধ্যে ৮ ডিসেম্বর প্রবল। প্রতিরােধের মুখে হাজিগঞ্জ দখল করে এবং ৯ ডিসেম্বর চাঁদপুরে পৌছায়। ৩০১ মাউন্টেন ব্রিগেডকে অনুসরণ করে ১৮১ মাউন্টেন ব্রিগেড লাকসামের। উত্তর ও পশ্চিমের অক্ষরেখার উপর অবস্থান নেয়। লালমাই পাহাড়ের দক্ষিণ । ভাগ পাকিস্তানি সৈন্যরা ৭ ডিসেম্বর ছেড়ে দেয় এবং ১৮১ মাউন্টেন ব্রিগেড তা অধিকার করে। ইতােমধ্যে ৩ অথবা ৪ ডিসেম্বর রাতে ৮৩ মাউন্টেন ব্রিগেডও নিঃশব্দে। প্রবেশ করে এবং চৌদ্দগ্রাম ও লাকসামের মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবরােধ স্থাপন। করে। ৫ ডিসেম্বর চৌদ্দগ্রাম মুক্ত করা হয়। লাকসাম গ্যারিসন ময়নামতিতে সরে যায় এবং ৯ ডিসেম্বর লাকসাম দখল করা হয়। ৯ ডিসেম্বরের মধ্যে ভারতীয় বাহিনী মেঘনার তীরবর্তী প্রধান ৩টি পয়েন্ট। আশুগঞ্জ-দাউদকান্দি ও চাঁদপুরে পৌছে যায় এবং মেঘনা নদীর গুরুত্বপূর্ণ।
এলাকার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ফলে পূর্ব দিক থেকে ঢাকার প্রবেশপথ উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। ট্যাংক প্রতিরােধী পরিখা ও তিন লাইন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ময়নামতি শত্রুর এক মজবুত ঘাটিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। ৪টি ট্যাংক এবং ১টি আর্টিলারি ব্যাটারিসহ কুমিল্লা, লাকসাম ও চৌদ্দগ্রাম থেকে হটে আসা সৈন্য মিলিয়ে এ ক্যান্টনমেন্টে প্রায় ৪,০০০ সৈন্যের সমাবেশ ঘটেছিল। সরাসরি আক্রমণ করলে অনেক বেশি মূল্য দিতে হতে পারে, এ বিবেচনায় ময়নামতি সেনানিবাস অবরুদ্ধ রেখে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়। ৯ ডিসেম্বরের মধ্যে এ অবস্থানকে পাশ কাটিয়ে দুই দিক থেকে অবরােধ করা হয়। ৬১ মাউন্টেন ব্রিগেড উত্তর ও পশ্চিম দিক থেকে এগিয়ে আসে এবং তাদেরকে ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনের কমান্ডে আনা হয়। ২৩ মাউন্টেন। ডিভিশনের অধীনস্থ ১৮১ মাউন্টেন ব্রিগেড এগিয়ে আসে দক্ষিণ দিক থেকে । ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি ৮৬জন অফিসার, ১৭৫জন জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার। এবং ৪,০০০জন অন্যান্য ব্যাংকের সৈন্য আত্মসমর্পণ করার পূর্ব পর্যন্ত ময়নামতি সেনানিবাস অবরুদ্ধ অবস্থায় থাকে হিসেব মতাে চট্টগ্রাম কম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হলেও আর্মি হেডকোয়াটারস তার প্রাথমিক লক্ষ্যস্থলের তালিকায় যেহেতু চট্টগ্রামকে রেখেছে, এ এলাকা দখলের জন্য মিত্র বাহিনীকে কিছু সৈন্যের ব্যবস্থা করতে হয়। লাকসাম এলাকায় যৌথ অপারেশনের ফলে শত্রু ফেনী ছেড়ে চলে যায় এবং ৬ ডিসেম্বর কিলাে ফোর্স তা দখল করে। ৮ ডিসেম্বরের মধ্যে মিত্র বাহিনী। করেরহাট ও জোরারগঞ্জ দখল করে এবং চট্টগ্রামের দিকে যাত্রা শুরু করে। শক্রদের ঘিরে ফেলে ১২ ডিসেম্বরের মধ্যে সীতাকুণ্ড মুক্ত করা হয়।
চট্টগ্রাম দখলের ব্যাপারে উৎসাহী কোর অধিনায়কের উদ্যোগে শক্তিবৃদ্ধি ও চট্টগ্রাম। দখল ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে ৮৩ মাউন্টেন ব্রিগেড এসে কিলাে ফোর্সের সাথে যােগ দেয় এবং ১২ ডিসেম্বর তারা সীতাকুণ্ড অঞ্চলে সমবেত হয়। শত্রুপক্ষের ২টি কোম্পানির অধিকৃত কুমিরাঘাট মুক্ত করা হয় ১৩ ও ১৪ ডিসেম্বর। চট্টগ্রাম উপকণ্ঠে ফৌজদারহাটে পৌছানাের পর যুদ্ধবিরতি শুরু হয়। মেজর জেনারেল সুজন সিং উবানের নিয়ন্ত্রণাধীন স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সকে প্রয়ােজনীয় ব্যবহার করার ব্যবস্থা করা হয়। চূড়ান্ত আক্রমণে তাদের সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে জেনারেল মানেকশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডারকে চাপ দিচ্ছিলেন। ইস্টার্ন কমান্ড তাদের সম্পূর্ণ ভিন্ন এলাকা দখলের দায়িত্ব দেয়। তারা সুজন সিং উবানের বাহিনীকে মূল বাহিনীর সাথে অন্তর্ভুক্ত করতে চায় নি।  মিজোরাম থেকে ২টি ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন সরিয়ে এনে সুজন সিং উবানের বাহিনীর সাথে যুক্ত করে মিজোরাম থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে ঢুকে কয়েকজন কমান্ডাে ও অনিয়মিত বাহিনীর সামান্য কয়েকজন সদস্যের নিয়ন্ত্রণে থাকা রাঙামাটি দখল করবে এবং চট্টগ্রাম আক্রমণের উপক্রম করবে। এলাকাটি পাহাড় ও ঘন বনজঙ্গলে পূর্ণ থাকায় সুজন সিং উবানের বাহিনী তাদের উপরে অর্পিত দায়িত্ব সহজেই পালন করতে সমর্থ হয়। যুদ্ধবিরতির পর তারা চট্টগ্রামে চলে আসে এবং সেখান থেকে তাদের ভারতে ফিরিয়ে নেয়া হয়।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড